বাড়িতে তমিজের বাপ বেটার দিকে মোটে তাকায় না। প্রতিদিন ঘরে ফিরে তমিজ দ্যাখে অন্ধকারে মাচার ওপর শুয়ে ভোঁসভেস করে ঘুমাচ্ছে তার বাপ। আর ঐ ঘরের ভেতরের ছোটো বারান্দায় চুলার সামনে বসে আগুনের আভায় ও ধোঁয়ায় এবং আগুন ও ধোঁয়ার ছায়ায় মুখে অন্যরকম চেহারা করে আগুনের ওপরকার অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কুলসুম। খিয়ারের চাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার যখন তখন ভাত রাধার আর খান্ত হবে না। তমিজের বাপের ভাত খাবার কোনো সময় অসময় নাই। দুই বছর আগে আকালের সময় খুদও জুটতো না, না খেয়ে থাকাটা তখন বেশ অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো। আর এখন খিয়ার থেকে চাল নিয়ে ফিরলে লোকটার খাবার কোনো আগামাথা থাকে না। বিকলাবেলা হয়তো ঘুমিয়েছে ভর পেট খেয়ে, অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মাচা থেকে নেমে হাঁড়ি হাতড়ায়। আর সেদিন পেট খারাপ হলো, সেরে ওঠার পর তার খাওয়া বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। পারিমাণে তমিজ যতোই খাক, তার খাবার একটা সিজিলমিছিল আছে। সকালে পান্তা খেয়ে মাঠে যাবার সময় ভাত বেধে নিয়ে যায়। রাতে ফিরে সে একবারই ভাত খায়। খেতে বসার আগে ডোবায় কয়েকটা ড়ুব দিয়ে এলেও হাতে হোক, পায়ে হোক, কানের লতিতে কি ঘাড়ের খাজে হোক, কোথাও না কোথাও একটুখানি কাদা তার লেগেই থাকে। কুলসুম মহা উৎসাহে সেদিকে আঙুল দিয়ে দ্যাখালে তার সমস্ত উদ্দীপনা নস্যাৎ করে দিয়ে বাপের দিকে চোখ নাচিয়ে তমিজ জিগ্যেস করে, তামান দিন ঘরের মদ্যেই আছিলো?
কুলসুম কখনোই এই প্রশ্নের জবাব দেয় না। স্বামীর সারাদিন শুয়ে-থাকা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে ফের আরেক দফা তার বিবরণ দিতে গেলে তার হাই উঠতে পারে। সন্ধ্যাবেলা হাই তুলতে তার ভালো লাগে না। কিংবা একটু তফাত থেকে তমিজের কানের লতি কি ঘাড়ের খাজ কিংবা হাত কি পায়ে লেগে থাকা কাদার গন্ধ চুরি করতে নিয়োজিত থাকায় স্বামীর প্রসঙ্গটি কুলসুম এড়িয়ে যায়। সে জিগ্যেস করে, হাল দেওয়া শ্যাষ হলো? কিংবা আর কয়টা হাল দেওয়া লাগবি?
গোগ্রাসে ভাত গিলে হাত ধুয়ে নিজের ঘরের ভেতরের বারান্দায় দরজার চৌকাঠে–হুকা হাতে বসে তমিজ ধীরেসুস্থে জবাব দেয় কুলসুমের কথার, এখনি? আরে লিজে জমি বর্গা করলে মেলা খাটনি গো! ইটা তো তোমার মানষের জমিত কামলা খাটা লয় যে চুক্তিমতোন দুটা হাল দিলাম আর ধানের বিছন রুয়া দিলাম। বলে আমন ধানের খন্দ, খাটো তো ফসল উঠবি বুনা ধানের দেড়া, না খাটলে ফক্কা, হুঁকায় টান দিতে দিতে সে জানায়, জমি খেদমত চায়, খেদমত না পেলে জমি অসন্তুষ্ট হয়। জমি হলো ছিনাল মাগীমানুষের লাকান—। বলতে বলতে সে মুখ সামলায়, হুরমতুল্লার কথা সে বলতে বসেছে কোথায়?—একটু থেমে হয়তো হুরমতুল্লাকে অনুসরণ করার সাফল্যের খুশিতেই একটি উপমা বেরিয়ে আসে তার নিজের মাথা থেকেই, অসন্তুষ্ট জমি হলো কিপটার একশেষ। শালার জগদীশ সাহার চায়াও কিপটা। কৃপণতায় মানুষের সঙ্গে . জমির তুলনা শুনে কুলসুম হেসে গড়িয়ে পড়ে। তমিজের এই উপমা কি তার হাসির কারণ, না-কি তার হাসির অছিলা তা না বোঝে তমিজ, না বোঝে সে নিজে। কুলসুমের হাসিতে তমিজের উৎসাহ বাড়ে। সে ঘোষণা করে, এবার জমির যে সেবাটা সে করছে তাতে ঐ শালা হুরমতুল্লার মুখটা আন্ধার না করে ছাড়বে না। অনেক ধান পাবার সম্ভাবনায় হতে পারে, হুরমতুল্লার মন্ধকার মুখ দ্যাখার আশায় হতে পারে, আবার কুপির শিখার কালচে হলুদ আঁচেও হতে পারে, তমিজের কালো মুখে বেগুনি রঙের আভা ফুটতে দেখে কুলসুমের সারাটা শরীর শিরশির করে ওঠে। খুব ঝাপসা এই কাঁপনকে কথায় গড়িয়ে নিতে পারলে কুলসম শুনতো : তমিজের বাপের মুখেও এমনি ছায়া ছায়া, আভা কখনো কখনো ফুটে ওঠে। কখন? কখন গো?—সেই দিনক্ষণ খুঁজে বার করতে কুলসুম শো শো করে নিশ্বাস নিতে থাকে, গন্ধ শুকে এঁকে তমিজের এই চেহারায় তার বাপের ঠিক সময়ের আদলটা দেখতে পারবে। কয়েকটি বড়ো বড়ো নিশ্বাসেই পাওয়া গন্ধে কুলসুম সত্যি বুঝতে পারে, তমিজের বাপের মুখে হলুদ-বেগুনি ও কালো রঙের ঝাপটা টের পাওয়া যায় সন্ধ্যার আগে আগে। না, সব দিন নয়, মাঝে মাঝে। কখন? কুলসুম আরো কয়েক বার গন্ধ নেয়। —হ্যা, মানুষটা যে রাতে ঘুমের মধ্যে হেঁটে হেঁটে বাইরে যায়, সেই সব সন্ধ্যায় এই সব গাঢ় রঙের ঝাপটা লেগে মুখটা তার ঝাপসা হয়ে আসে।
তার বেটা তো খালি জমিতেই পড়ে থাকে, রাতেও তার ধানের ভাবনা। রাত্রির খোয়াব কি আর তাকে কখনো কবজা করতে পারে? তবু, তবু সাবধানের মার নাই। ঘুমের মধ্যে তমিজের বাইরে যাবার সম্ভাবনাটিকে বিনাশ করতে তমিজের কালো মুখের এই হলুদ-বেগুনি দাগ এক্ষুনি মুছে ফেলা চাই, হয়তো এই বিবেচনা থেকেই হুরমতের প্রসঙ্গটাই সে অব্যাহত রাখে, হুরমত তোমার কী করবি? বুড়া মানুষ, তাই তোমার কী লোকসান করবার পারে?
বুড়ার শয়তানির কথা শুনবা? শুনবা? হুরমতুল্লার আপত্তিকর স্বভাব প্রকাশের উত্তেজনায় ঠুকায় নতুন করে তামাক সাজানো স্থগিত রেখে তমিজ সোজা হয়ে বসে এবং হুরমতুল্লা চাষার রক্তের দাপটে তাকে কীভাবে হেলা করে, কাজ শেখাবার ছলে। পদে পদে তার ভুল ধরে, এইসব নালিশ করতে করতে গলা কেবলি ওপরে চড়ায়। বুড়া কয়, ও মাঝির বেটা, হামরা হলাম চাষার জাত, হামাগোরে ঘরের বিটিছোলও চাষবাসের কাম যা জানে তোরা জেবনভর নাঙল ঠেললেও তার এক কানিও শিখবার পারবু না।—এটা কি কোনো একটা কথা হলো? নিজের ঘরের বেটিদের বেআব্রু করতে তার এতোটুকু বাধে না, চাষার বংশের ফুটানি মারে সে কোন আক্কেলে? আবার এরা নাকি রফাদানি জামাতের মুসলমান? তমিজ ভোররাতে জমিতে পৌঁছলেও হুরমতের বড়ো মেয়েটাকে কাজ করতে দেখে। তাকে দেখে আস্তে করে সরে পড়ে। ঐরকম জোয়ান সোন্দরি মেয়েকে হুরমতুল্লা ঘরের বাইরে আনে, পরপুরুষরা তাদের গতর দেখে, আল্লা সহ্য করবে না এসব!
হুরমতুল্লার সুন্দরী মেয়েদের বেহায়াপনার গল্প তমিজ করে চলেছে, করেই চলেছে, কুলসুম কোনো সায়ই দেয় না। তমিজ হঠাৎ বুঝতে পারে, তার একটু কাছে ঘেঁষে কুলসুম জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। এই নিশ্বাস কথার বিকল্প হয়ে দাঁড়ালে তমিজকে চুপ করতে হয়, কল্কেতে তামাক সাজিয়ে সে হুঁকা টানতে শুরু করে। কিছু হারিয়ে গেলে কুলসুম মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গন্ধ শুকে শুকে যেমন করে খোজে,—তাই নিয়ে তমিজের বাপ তাকে কতোবার তাকে বকাবকি করে এবং তমিজ নিজেও ঠাট্টা করে আসছে কুলসুমের বিয়ের আগে থেকেই,—তেমনি করে এক হাত দূর থেকে তমিজের সর্বাঙ্গ খুঁকেতে শুকতে সে খোজেটা কী? কুলসুমের সজোর নিশ্বাসের আওয়াজে তমিজের বুক ধড়ফড় করে : কুলসুমের কী হারিয়ে গেছে? সেই জিনিস কি তার ঝাঁকড়াচুল মাথায় কি কাদা-লেগে-থাকা ঘাড়ের খাঁজে কি হাতের কনুইতে লুকানো রয়েছে যে বাপের বৌটা এমন পাগলের মতো খুঁজতে শুরু করলো? সে কি কুলসুমের কিছু চুরি করেছে?—এই অনিশ্চয়তা ছাপিয়ে সে কী চুরি করলো তাই ঠাহর করার উদ্বেগ মাথা চাড়া দিলে হুঁকার মালাটা সে হাত দিয়ে চেপে ধরে বেশি জোর দিয়ে এবং ঐ মালার ফুটোতে পুরু ঠোঁটজোড়া চেপে ধরে এতোটাই সেঁটে চেপে ধরে যে তার চুমুর টানে ডাবার সব পানি কল্কের তামাকের আগুনের তাপে ধোয়া হয়ে তার পেট ও বুকের, এমন কি তলপেটের ফাঁকফোকর সব অন্ধকার করে ফেলে। তার প্রাণপণে হুঁকা টানার গুরগুর ধ্বনি এবং লসুমের গন্ধ শোকার জন্যে নিশ্বাসপ্রশ্বাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ চড়তে থাকে সমান মাত্রায়। এগুলোর মধ্যে সংঘাতের লক্ষণ নাই, আবার সময়ের সম্ভাবনাও নাই। তমিজ তাই কিছুক্ষণের মধ্যে নিস্তেজ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসেই থাকে। অকেজো হাতিয়ারের মতো কাটাকে সে রেখে দেয় দরজার পাশে বেড়ার সঙ্গে ঠেস দিয়ে। কাটা কাৎ হয়ে থাকে এবং সেটার গড়িয়ে পড়ার ভয় একটু থাকলেও তমিজ সেদিকে ফিরেও তাকায় না। সে দরজার ভেতরদিকে আরেকটু সরে বসে এবং মোটামুটি নিরাপদ দূরত্ব তৈরি হলে কয়েকবার কাশে, উঠানের দিকে থুথু ফেলে এবং একটা ঢেকুরও তোলে। ঢেকুরের সংক্ষিপ্ত ধাক্কায় জিভে তামাকের গন্ধ-মাথা একটু-আগে-গেলা ভাত, খেসারির ডাল, বেশি মরিচ দিয়ে রাধা খলসে মাছ-বেগুনের চচ্চড়ির স্বাদ একটুখানি পেয়েই তমিজের গায়ে বল আসে। নিজের ঘরে যাবার জন্যে সে উঠে দাঁড়ালে কুলসুম দুই কদম পিছে গিয়ে চড়া গলায় বলে, চাষার ঘরের বিটিছোল খন্দের তয়তদবির তোমার চায়া ভালোই করবি। হুরমতুল্লা পরামাণিক কথাটা অলেয্য কয় নাই। তোমার বাপও তো কাল ইংকা কথাই কচ্ছিলো। কয়, মাঝির বংশের বেটা জমির মদ্যে নাঙল ঢুকালে জালের সাথে নাঙলের আগামা জড়ায়া যায়। ওটি ফসল কুনোদিন ভালো হবি না। জালখানাও মাটির তলা থ্যাক্যা আর ওপরে ওঠে না। মাঝির বেটার তখন মাছ ধরারও শ্যাষ।
মা কুলসুমের প্রবল বেগে গন্ধ-শোঁকা ফেটে পড়লো এইসব কথার তোড়ে। তার সজোর নিশ্বাসপ্রশ্বাস থেকে অব্যাহতি পেয়ে তমিজ ফের চাঙা হয়ে ওঠে এবং সমান। তেজে চাঁচায়, তুমি কী বোঝো? ফকিরের ঘরের বিটি, মানষের ঘরত ঘরত ভিখ মাঙিছে, মানুষের গোয়ার পিছে ঘুরা ভাত চায়া খাছো, জমিজমার তুমি বোঝো কী? যাও যাও। তোমাক আর প্যাচাল পাড়া লাগবি না। উঠা বাজানেক ভাত দেও। বুড়া মানুষ, তার খিদা নাগে না? তোমার লজর খালি লিজের প্যাটের দিকে। ফকিরের বেটির ওংকা চোপা ভালো লয়।।
এইসব কথা যেন অন্য কোনো মানুষের হাতের চড় থাপ্পড় হয়ে তমিজকেই ঘা মারতে থাকে একটা একটা করে। যতোই ঘা খায়, তমিজের কথা ততোই বাড়ে। সেই রাত থাকতে বিল পেরিয়ে হুরমতুল্লার গোয়াল থেকে গোরু নেওয়ার সময় থেকেই তমিজের ঘোর লাগার শুরু, সারাটা দিন জমিতে লাঙল চষতে চুষতে তা আরো পুরুষ্টু হয়েছে। কুলসুমের গন্ধ শোঁকার ধাক্কায় ধাক্কায় তা চাপা পড়েছিল, এখন নিজের এই চড়া চড়া কথায় সেই ঘোর একেবারে কেটে গেলে তমিজের শরীর ভেঙে পড়ে অবসাদে। তার ঘুম পায়, খুব ঘুম পায়। ঘুমঘুম চোখে মাচার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে শোনে, পাশের ঘর থেকে বাবার ঘর্ঘরে গলার ভাঙাচোরা কথা, শমশেরের ভিটার পুব ধারে ধানের বীজতলা করিছে। কাল বেনবেলা শমশেরের কাছে যাস। হামার সাথে অর কথা হছে। অর ধানের পুলের বরকত বেশি। শমসের লিজে হামাক কলো। পয়সাও কেমই লিবি না।
তমিজের বাপের ঘুম-ভাঙা গলার এইসব ছোটো ছোটো বাক্য মনোযোগ দিয়ে না শুনলে এগুলোর মধ্যে সম্পর্ক ঠিক করা মুশকিল। তমিজের ঘুমে-ভারি মাথাতেও শমশেরের ভিটার বীজতলা কচি কলাপাতা রঙে ঢেউ খেলাতে লাগলো। এতে তার ঘুম নামে আরো কেঁপে।
কুলসুম এদিকে নিজের ঘরের দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত ঠেকিয়ে চিৎকার করে তমিজের কথার জবাব দেয়, হামি না হয় ফকিরের বেটি। তোমার বাপের জমিদারি আছে তো, আমি তাই জমি আর খন্দের বিত্তান্ত সবই শিখ্যা লেমো, না? তোমার মাও তো তামান দিন বলে মণ্ডলবাড়িতই পড়্যা থাকিচ্ছিলো। জোতদারের বাড়িত গতর খাটায়া তাই জমিজমার ব্যাক কথা শিখ্যা লিছিলো, না? ঐ বাড়িত কাম করা তাই খুব সুখে আছিলো, না? ওংকা সুখ আমি চাই না। ওংকা সুখের পাছাত হামি নাথি মারি।
তমিজের বাপ কিন্তু এর মধ্যেও শমশেরের বীজতলার কথা বলেই চলছিলো। ঘুমভাঙা ঘর্ঘর-করা পুরুষ কণ্ঠের সঙ্গে চড়া মাত্রার মেয়েলি গলা মিলে এমন আওয়াজ তৈরি হয় এবং কলাপাতা রঙের ঢেউতে তা এমনভাবে ঢেউ খেলায় যে তমিজের ঢুলুঢুলু চোখের ভেতরে ঢুকে পড়ে তাই তাকে গড়িয়ে দেয় আরো গভীর ঘুমের পরতে।