০৮. বাবা রুস্তম আলী

বাবা রুস্তম আলী

দোয়া গো,

আমি তোমার উপর বিরক্ত, মহাবিরক্ত, মহারও অধিক বিরক্ত। তোমার মাথায় কিছু সমস্যা আছে এই বিষয়ে আমি অবগত আছি। আবার তুমি যে বদ্ধ উন্মাদ না এই বিষয়েও আমি অবগত। কিন্তু তুমি এখন যা করছ তা কোনো বদ্ধ উন্মাদও করবে না।

শুনলাম বিরানি ছগীর এখন তোমার সঙ্গেই থাকে, খায়, ঘুমায়। ইহা কি? ছগীর কি বস্তু তা কি তুমি জানো? পাঁচ-দশ হাজার টাকার বিনিময়ে সে মানুষ খুন করতে পারে। র্যাব-পুলিশ তার সন্ধানে আছে। তারা ছগীরকে যখন তোমার বাড়ি থেকে উদ্ধার করবে তখন কি তোমাকে ছাড়বে?

চিঠি পাওয়া মাত্র কিছু টাকা-পয়সা দিয়া ছগীরকে বিদায় করবে। ইহা পিতৃ আজ্ঞা। কথার অন্যথা হলে তোমাকে ত্যাজ্যপুত্র করা ছাড়া আমার গতি নাই।

আমার শরীর ভালো না। রাতে এক ফোঁটা ঘুমাতে পারি। মুসা গুণ্ডার ফাঁসির ঘটনা লিখেছিলাম। ফাঁসির পূর্বে সে চিৎকার করছিল, আমারে মারিস না, আমারে মারিস না। তার চিৎকার এখন আর কেউ শুনে না। কিন্তু আমি শুনি। বিরাট অশান্তিতে আছি। তবে তোমাকে এইসব বলা বৃথা।

তুমি ভালো থাকার চেষ্টা করো।

ইতি তোমার হতভাগ্য

পিতা।

এস. আলী B.Sc. (Hons)

পুনশ্চ ১ বিরানি ছগীরকে বিদায় করো।

পুনশ্চ ২ বিরানি ছগীরকে বিদায় করো।

পুনশ্চ ৩ বিরানি ছগীরকে বিদায় করো।

 

বিরানি ছগীরকে বিদায় করতে হলো না। সে নিজে নিজেই বিদায় হলো। রুস্তমের জন্যে নারায়ণগঞ্জে পাগলের তেল আনতে গিয়ে র্যাবের হাতে ধরা পড়ল। র্যাবের মেজর ইসমাইল বললেন, তোর হাতে কি?

ছগীর বলল, স্যার বোতল।

কিসের বোতল? বোতলে আছে কি?

ছগীর দাঁত বের করে বলল, আপনি কি ভাবছেন এসিড? এসিড না, পাগলের তেল। দুই বোতল আছে। আপনার প্রয়োজন থাকলে এক বোতল রেখে দেন।

তোর যে সময় শেষ বুঝতে পারছিস?

ইয়েচ চ্যার।

ইংরেজিও জানিস?

দুই-চাইরটা ইংরেজি না জানলে আপনের মতো মানুষদের সামনে কথা বলব ক্যামনে? স্যার কি আমারে ক্রস ফায়ারে দিবেন?

কিছু ইনফরমেশন দে, তারপর বিবেচনা করব। তালেব কোথায় আছে বললে ছেড়ে দিব।

ছগীর বলল, স্যার আমি পুলাপান না। কেন আমারে বুঝ দেন? তালেব কই আছে বললে সেও মরব আমিও মরব। এরচে আমার একা মরা ভালো না।

মেজর ইসমাইল চোখে সানগ্লাস পরলেন। সন্ধ্যার পর মেজর সাহেবের চোখে সানগ্লাস পরা খারাপ লক্ষণ।

ছগীর! রাতের খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?

না।

কি খেতে চাস বল, বিরানি?

জে। সাথে একটা লাচ্ছি দিয়েন। স্যার আরেকটা কথা, দুই বোতল পাগলের তেল আমি একজনের জন্যে কিনেছি। তার ঠিকানা দিতেছি তেলের বোতল দুটা তার হাতে পৌছায়ে দিবেন। যদি পৌছায়া না দেন রোজ হাশরে আমি আপনার ঘাড় কামড়ায়া ধরব। রোজ হাশরে আপনার হাতে বন্দুক থাকব না কিন্তু আমার মুখে দাঁত ঠিকই থাকব।

পরদিনের খবরের কাগজে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বিরানি ছগীরের ক্রস ফায়ারে মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হলো।

রুস্তম খবরের কাগজ পড়ে না কাজেই ছগীরের মৃত্যু সংবাদ সে জানল। দুপুরবেলা অচেনা এক লোক তাকে দু বোতল পাগলের তেল দিয়ে গেল।

 

আমিনের তাড়া খেয়ে রুস্তমের বাড়ি ছেড়ে যারা পালিয়ে গিয়েছিল একে একে তারা সবাই ফিরে আসছে। সবার আগে উপস্থিত হলেন চণ্ডিবাবু। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠার ক্ষমতা তার নেই। ড্রাইভারের কাঁধে ভর দিয়ে অনেক কষ্টে দোতলায় উঠলেন। রুস্তমের শোবার ঘরে উঁকি দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, স্যার আমার অন্তিম সময় উপস্থিত। শেষ কয়েকটা দিন কি আপনার বাড়িতে থাকতে পারি?

রুস্তম বলল, অবশ্যই পারেন।

চণ্ডিবাবু বললেন, স্যার আপনার জন্যে আমার কিছু করতে ইচ্ছে করে। কি করব বুঝতে পারি না। আমার শক্তি নাই, সামর্থ্য নাই। জ্ঞান-বুদ্ধিও নাই।

আপনাকে কিছু করতে হবে না। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে পনার শরীর খুবই খারাপ। কি হয়েছে বলুন তো।

হাঁপানি আগেই ছিল এখন বেড়েছে। আর কিছু না।

হাসপাতালে ভর্তি করে দেই? কিছু দিন হাসপাতালে থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন।

আমি হাসপাতালে যাব না। আপনার আশেপাশেই থাকব। বেশ তো থাকুন।

চণ্ডিবাবুর দাখিল হবার পরদিনই ফিটবাবুকে দেখা গেল। তার সবকিছুই আগের মতোই আছে, শুধু টাইয়ের রঙ বদল হয়েছে। এখন টাইয়ের রঙ সবুজ।

রুস্তম সাইকেল নিয়ে বের হচ্ছে তখন ফিটবাবুর সঙ্গে দেখা। সে ছুটে এসে গেট খুলতে খুলতে বলল, স্যারের কিছু লাগবে?

কিছু লাগবে না।

স্যার কি ভালো আছেন?

হ্যাঁ ভালো।

স্যার আকাশের অবস্থা ভালো না। বৃষ্টি নামবে। আজ সাইকেল নিয়ে বের না হলে ভালো হয়।

রুস্তম বলল, কোনো অসুবিধা নেই। না হয় কিছুক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজব।

স্যার আমি কি একটা ছাতা নিয়ে পিছনে পিছনে আসব?

না। আপনি ফিরে এসেছেন এটা দেখে ভালো লাগছে। যারা চলে যায় তারা কখনো ফিরে আসে না।

স্যার আমাকে তুমি করে বলবেন।

আচ্ছা বলব।

রুস্তম সাইকেল নিয়ে বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই বৃষ্টি নামল। ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট অদ্ভুত। আকাশে ঘন কালো মেঘ দেখা গেলেই রাস্তায় পানি উঠে যায়। বৃষ্টি পড়ার প্রয়োজন হয় না।

মাথায় বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তায় পানি। রুস্তম পানি কেটে এগুচ্ছে। তার চমৎকার লাগছে। প্রণাশ বাবুর মৃত্যুর ব্যাপারটা নতুন করে মাথায় এসেছে। ঝড়-বৃষ্টির রাতে তার মৃত্যু হলে কেমন হয়? পথের পাঁচালি উপন্যাসে দুর্গার মৃত্যু যেমন হলো। রুস্তম প্রণাশ বাবুর মৃত্যুর বিষয়টা মাথায় সাজাতে সাজাতে এগুচ্ছে।

 

প্রণাশ বাবুর মৃত্যু
(ঝড়-বৃষ্টির রাত)

সন্ধ্যা থেকেই বৃষ্টি। শোঁ শোঁ বাতাস। মিউনিসিপালটি ইলেকট্রিসিটি বন্ধ করে শহর অন্ধকার করে দিয়েছে।

প্রণাশ বাবু বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে ঘরে ফিরলেন। স্ত্রীকে বললেন, গরম পানি করো তো। ড্রেনে পড়ে গিয়েছিলাম, পা কেটেছে। একটা টিটেনাস ইনজেকশন নেয়া দরকার।

প্রণাশ বাবুর স্ত্রী বললেন, কি সর্বনাশ! রক্তে তো তোমার পাজামা ভিজে গেছে। এতটা কাটল কিভাবে?

কথা বলে সময় নষ্ট করো না। তাড়াতাড়ি পানি গরম করো…।

 

চণ্ডিবাবুর ফেরার দুদিন পর বৃহস্পতিবার দুপুরে আর্টিস্ট ফিরে এলো। মনে হয় সে বিরাট কোনো ঝামেলার ভেতর দিয়ে গিয়েছে। চোখ-মুখ শুকনা। গায়ের কাপড় নোংরা। পায়ে জুতা নেই। হাঁটছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। বাম চোখের চারপাশে কালো ছোপ। চোখ লাল হয়ে আছে। চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি পড়ছে। রুস্তম বলল, আপনার এই অবস্থা কেন?

দুই রাত হাজতে ছিলাম। পুলিশ মারধর করেছে।

হাজতে ছিলেন কেন?

পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে এই জন্য ছিলাম। ইচ্ছা করে কেউ হাজতে যায়? হাজত তো হোটেল না।

পুলিশ ধরল কেন?

এত প্রশ্নের জবাব তত দিতে পারব না। এখন গরম পানি দিয়ে স্নান করব, তারপর আগুনগরম এক কাপ চা বাব। সাত দিন গোসল করি নাই।

দুদিন ছিলেন হাজতে, সাত দিন গোসল করেননি কেন?

আপনার কাছে কৈফিয়ত দেব কী জন্য? আপনি কি অ্যাটর্নি জেনারেল? সিগারেট আনিয়ে দিন। দুই দিনে সিগারেটে একটা টানও দিতে পারি নাই। টাকা নাই যে কাউকে দিয়ে সিগারেট আনা।

রুস্তম বলল, সিগারেট আনিয়ে দিচ্ছি। আপনার একটা ভালো খবর আছে।

ভালো খবরের আমি গুষ্টি কিলাই। আগে গোসল, তারপর গরম চা-সিগারেট। তারপর ভাত খেয়ে ঘুম। আপনার বদ দুলাভাইটা শুনেছি বাড়িতে নাই।

ঠিকই শুনেছেন। উনি মালয়েশিয়ায়।

থাক ব্যাটা মালয়েশিয়াতে। আর আসবি না। তোকে বাংলাদেশের প্রয়োজন নাই। আমি একজন আর্টিস্ট মানুষ। আমাকে সিঁড়িতে ধাক্কা দিয়েছে। একটু হলে পা পিছলে পড়তাম।

হোসেন মিয়া আধঘণ্টা সময় নিয়ে গোসল করল। গরম চায়ের সঙ্গে সিগারেট খেল। একটা সিগারেটের অর্ধেক শেষ হয়েছে, এর মধ্যেই অন্য আরেকটা সিগারেট বের করে দেয়াশলাইয়ের পাশে রেখে দিয়েছে।

সে বসেছে রুস্তমের ঘরে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুস্তমের আঁকা ছবির দিকে।

এই ছবি আপনি এঁকেছেন?

জি।

চোখের পাপড়ি কোবাল্ট রু দিয়ে এঁকেছেন?

জি।

চোখের মণিতে লেমন ইয়েলো দিয়েছেন কেন?

চোখ কোমল করার জন্য।

মেয়েটা কি ফিরে এসেছে?

না।

মন থেকে এঁকেছেন?

জি।

ছবিটা যে অসাধারণ হয়েছে, এটা বুঝতে পারছেন?

না।

এমন ছবি একটা এঁকে মরে গেলে কোনো ক্ষতি নেই। ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কী মনে হচ্ছিল জানেন? মনে হচ্ছিল, যে কোনো মুহূর্তে মেয়েটা কথা বলে উঠবে। ছবি আঁকা নিয়ে আপনাকে অনেক কঠিন কঠিন কথা বলেছি। ফালতু উপদেশ দিয়েছি। আপনি ক্ষমা করবেন।

রুস্তম বলল, আপনার ভালো খবরটা কি এখন বলব?

হোসেন মিয়া ছবি থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, বলুন।

ফ্রান্স দূতাবাস থেকে চিঠি এসেছে। ফ্রান্স সরকার আপনাকে একটা স্কলারশিপ দিয়েছে। এক বছরের স্কলারশিপ। সব ফ্রি। হাতখরচ হিসেবে সপ্তাহে পঞ্চাশ ইউরো করে পাবেন।

এত বড় খবরেও হোসেন মিয়ার ভাবান্তর হলো না। সে ছবির দিকেই তাকিয়ে রইল।

হোসেন মিয়া বলল, মুনিয়া মেয়েটাকে এই ছবিটি দেখানো দরকার।

মুনিয়া তো রোজই দেখে।

তার মানে?

মানে আপনি বুঝবেন না। এটা আমার মনের একটা রোগ।

হোসেন মিয়া বিড়বিড় করে বললেন, ভাই যে হাতে আপনি ছবিটা এঁকেছেন, সেই হাতটা দিন। আমি আপনার হাতে চুমু না খাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাব না।

 

বছর ঘুরে নতুন বছর এসেছে। সামিনা দুই কন্যা ডাবল স্ট্রলারে শুইয়ে বড় শপিংমলগুলোতে যাচ্ছে। সামিনার সঙ্গী আমিন। বাচ্চা দুটিকে এক মুহূর্ত না দেখে সে থাকতে পারে না। সে এখন কোনো ব্যবসা দেখে না। মুখে বলে, সব গোল্লায় যাক। মেয়ে দুটা ঠিক থাকলেই আমি ঠিক। দুটা ফুটফুটে মেয়ে পাশাপাশি শুয়ে আছে, এই দৃশ্য অনেকেই অবাক হয়ে দেখে। মুগ্ধ চোখে বলে, কী সুন্দর! কী সুন্দর!

আমিনের খুবই চিন্তা হয়। নজর লাগবে না তো! সে স্ত্রীর কানে কানে তার দুশ্চিন্তার কথা জানায়। সামিনা বলে, দুজনকেই কালো মোজা পরিয়ে রেখেছি। নজর লাগবে না।

হোসেন মিয়া চলে গেছে ফ্রান্সে। সেখানে সে ভালোই আছে। অবসর সময়ে অপূর্ব সব ওয়াটার কালার করছে। বিষয়বস্তু বাংলার গ্রাম। তার অনেক ছবিতে শান্ত দিঘির জলের পাশে একটি তরুণীকে বসে থাকতে দেখা যায়। তরুণীর চেহারার সঙ্গে মুনিয়ার সাদৃশ্য আছে।

বিভাস দার্জিলিংয়ে পড়তে গেছে। যাওয়ার সময় বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসে হঠাৎ বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে খুব কাঁদল। রুস্তম বলল, কাঁদছ কেন বাবা? বিশ্বাস করো সারাক্ষণ তুমি আমার পাশেই থাকবে। আমার খুব ভালো একটা অসুখ হয়েছে। এই অসুখের কারণে আমি আমার পছন্দের যে কোনো মানুষকে আমার পাশে বসিয়ে রাখতে পারি।

বাবা তোমার কথা বুঝতে পারছি না।

আমি নিজেও বুঝতে পারি না। নিজের কাছেও মাঝে মাঝে অদ্ভুত লাগে। মনে করো তুমি দার্জিলিংয়ে পড়ছ। হঠাৎ আমার ইচ্ছা হলো তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করি। ইচ্ছাটা হওয়া মাত্র তোমাকে আমি আমার সামনে দেখব। তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারব।

কম্পিউটার দিয়ে? আমার মা আমাকে একটা ল্যাপটপ দিয়েছে। ল্যাপটপের সামনে বসে আমি যখন মার সঙ্গে কথা বলব তখন মা তার কম্পিউটারে আমাকে দেখতে পাবে।

রুস্তম বলল, অনেকটা সে রকমই, শুধু কম্পিউটার নেই।

বিভাস বলল, মনে হয় তোমার মাথার ভেতর আছে। আমাদের সায়েন্স মিস বলেছেন মানুষের ব্রেইন খুব পাওয়ারফুল কম্পিউটার।

হতে পারে।

মানুষের ব্রেইনে অনেক মেগাবাইট মেমোরি। মেগাবাইট কি তুমি জানো?

না।

তুমি সায়েন্সে দুর্বল তাই না?

হ্যাঁ।

চাঁদ যে একটা আয়না এটা জানো?

না।

আমাদের সায়েন্স মিস বলেছেন চাঁদ একটা আয়না। এই আয়নায় সূর্যের আলো পড়ে। আয়না সেই আলো পৃথিবীতে পাঠায়।

তোমাদের সায়েন্স মিস তো অনেক গুছিয়ে কথা বলেন।

আমাদের সায়েন্স মিসের নাম মিস রুমা। তুমি যে ছবিটা আঁকছ মিস রুমা সেই ছবির মতো সুন্দর। তোমাকে একটা গোপন কথা বলব বাবা?

বলো।

কাউকে কিন্তু বলতে পারবে না।

কাউকে বলব না।

আমি বড় হয়ে সায়েন্স মিসকে বিয়ে করব।

আমি কি সেই উৎসবে থাকতে পারব? দাওয়াতের কার্ড কি পাঠাবে?

বিভাস হালকা গলায় বলল, মা তোমাকে কার্ড পাঠাতে দেবে না। তুমি তো পাগল এই জন্যে। পাগলদের কোনো অনুষ্ঠানে ডাকতে হয় না। পাগলরা ঝামেলা করতে পারে।

তাও ঠিক।

আমার গত জন্মদিনে এই জন্যে মা তোমাকে দাওয়াত করেনি। মা ভালো করেছে না?

হ্যাঁ।

মিস রুমা জন্মদিনে এসেছিলেন। তিনি আমাকে একটা অটোগ্রাফের বই দিয়েছেন। বইটা আমি নিয়ে এসেছি। বাবা তুমি আমার অটোগ্রাফ বইতে কিছু লিখে দাও।

রুস্তম লিখল,

দিঘির কালো জলে
আনন্দে ভেসে চলে
অলৌকিক এক চন্দ্রহাঁস
আমাদের ছোট্ট বিভাস॥

ডাক্তার রেণুবালা বিদেশি এক বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিয়ে চলে গেছেন। রুস্তমের চিকিৎসা বন্ধ। রেণুবালা প্রায়ই নিউজার্সি থেকে রুস্তমকে টেলিফোন করেন। তার উপন্যাস কেমন এগোচ্ছে জানতে চান। তিনি রুস্তমকে একটা বইও পাঠিয়েছেন, Brain and Mind।

মাসে একবার তিনি টেলিফোনে দীর্ঘ সময় ধরে রুস্তমের সঙ্গে কথা বলেন। টেলিফোনে তার গলা কিশোরীদের গলার মতো শোনায়। তার কথা শুনতে রুস্তমের খুব ভালো লাগে।

রু আদে সাহেব!

জি।

Realityর নানান রূপ আছে এটা কি জানেন?

না।

একজন Sleep walker যখন ঘুমের ঘোরে হেঁটে বেড়ায় তখন সেটাই তার কাছে Reality। যারা তাকে হাঁটতে দেখছে তাদের Reality কিন্তু ভিন্ন। বুঝতে পারছেন?

বুঝার চেষ্টা করছি।

আমরা যখন স্বপ্ন দেখি তখন স্বপ্নটাই আমাদের কাছে বাস্তব। আবার যখন জেগে উঠি তখন জাগ্রত অবস্থাটাই বাস্তব। সমস্যা হচ্ছে একজন মানুষের কি দুই ধরনের বাস্তবতা থাকতে পারে? আপনার কি মনে হয়?

জানি না।

থাকতে পারে। আপনি যেমন অনেক বাস্তবতা নিয়ে বাস করছেন। আপনার সবচে বড় সুবিধা হচ্ছে আপনি একটা বাস্তবতাকে অন্য একটা বাস্তবতা থেকে আলাদা করার চেষ্টা করছেন না। আচ্ছা অন্য প্রসঙ্গে কথা বলি, মুনিয়া নামের যে মেয়েটির ছবি এঁকে আপনি শেষ করেছেন সে কি ফিরেছে?

না।

তাঁকে খুঁজে বের করার কোনো চেষ্টা কি করেছেন?

না।

না কেন?

ইচ্ছা করলেই তো মুনিয়াকে আমি আমার সামনে উপস্থিত করতে পারি। তাকে খুঁজে বের করার দরকার কি?

তাও ঠিক। আমি এখন টেলিফোন রেখে দেব। আপনি কি কিছু বলতে চান?

চাই।

বলুন, আমি শুনছি।

আমার ছেলে বিভাস বড় হয়ে তার সায়েন্স টিচার মিস রুমাকে বিয়ে করবে।

শুনে ভালো লাগল। আর কি বলবেন?

আমি খুব আনন্দে থাকার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না।

আপনি পারবেন। Please dont give up.

 

সাইকেলে বৃষ্টিতে ঘুরে ঘুরে রুস্তম জ্বরে পড়েছে। প্রবল জ্বর। থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মাপা হয়নি বলে কত জ্বর জানা যাচ্ছে না। তার বিছানা জানালার পাশে। তার সময় কাটছে জানালা দিয়ে বৃষ্টিভেজা আকাশের দিকে তাকিয়ে। আকাশে মেঘের কত না অদ্ভুত খেলা। রুস্তমের মনে হচ্ছে সে তার বাকি জীবনটা বিছানায় শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিতে পারবে।

 

শ্রাবণ মাসের সন্ধ্যা। আকাশে ঘন কালো মেঘ। যে কোনো মুহূর্তে বর্ষণ শুরু হবে। রুস্তমের বাড়ির গেটের কাছে রেক্সিনের সুটকেস হাতে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার শাড়ি মলিন। চেহারা মলিন। সে ভেতরে ঢোকার সাহস সঞ্চয় করতে পারছে না। ঘন ঘন ঢোক গিলছে। সে কাঁদছে। তার চোখ ভর্তি টলটলা পানি। মেয়েটার নাম মুনিয়া।

বারান্দা থেকে মেয়েটিকে চণ্ডিবাবু প্রথম দেখলেন। অভয় দেওয়ার মতো গলায় বললেন, ভেতরে চলে যাও মা। স্যার আছেন। স্যার থাকতে আমাদের ভয় কী?

মুনিয়া বললেন, ভালো আছেন দাদু?

চণ্ডিবাবু বললেন, ভালো আছি মা।

আমার স্যার ভালো আছেন?

স্যারের জ্বর। দুদিন ধরে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। আমার শরীরের যে অবস্থা, দোতলায় উঠে যে একবার দেখব সে উপায় নেই।

মুনিয়া সিঁড়ি ভেঙে ধীরে ধীরে দোতলায় উঠছে। তার শরীর কাঁপছে। মুনিয়ার মা মারা গেছেন। তার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।

 

মুনিয়ার প্রতি লেখক হুমায়ূন আহমেদের শুভেচ্ছা। জীবন তার মঙ্গলময় বাহু দিয়ে মেয়েটিকে স্পর্শ করুক–এই শুভ কামনা।

1 Comment
Collapse Comments
হামিদুল August 15, 2021 at 7:29 am

Lekhar sesta osadharon.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *