হ্যাঁ, বকুলের বড়দাই ওই গুরুদায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছিল। বকুলের বাল্যকাল থেকেই। বকুলটা কোনো ফাঁকে পিছলে সরে গিয়ে পাশের বাড়ির ছেলেটার মুখোমুখি হচ্ছে কিনা তা দেখার।
আচ্ছা বাল্য আর কৈশোরের সীমারেখাটা বয়সের কোন রেখায় টানা হত সে যুগে!
বকুল জানে না সে কথা।
বকুল দশ—এগারো বছর বয়েস থেকেই শুনে আসছে, ধাড়ি মেয়ে, তোমার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবার এত কী দরকার?.. ধিঙ্গী অবতার! এবাড়ি ওবাড়ি বেড়িয়ে বেড়ানো হচ্ছে? যাও না সংসারের কাজ করগে না।…ছাতে ঘোরা হচ্ছিল? কেন? বড় হয়েছো, সে খেয়াল কবে হবে?
বড়দা বলতো, বাবা বলতেন।
বড়দাই বেশী।
আর বড়দার ওই শাসন-বাণীর মধ্যে যেন হিতচেষ্টার চাইতে আক্ৰোশটাই প্রকট ছিল। পাশের বাড়ির ওই নির্মলটার যে এ বাড়ির বকুল নামের মেয়েটার প্রতি বেশ একটু দুর্বলতা আছে, সে সত্য বড়দার চোখে ধরা পড়তে দেরি হয়নি। অতএব এদিক ওদিক কিছু দেখলেই বড়দার দেহের শিরায় শিরায় প্রবাহিত সনাতনী রক্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠতো এবং শাসনের মাত্রা চড়ে উঠতো। বড়দা নির্মলকেও দূচক্ষের বিষ দেখতো। সে কি নির্মল বড়লোকের একমাত্র ছেলে বলে?
বকুলের মা বেঁচে থাকতে তবু বকুলের পৃষ্ঠবল ছিল। মা তার বড় ছেলের এই পারিবারিক পবিত্ৰতা রক্ষার কর্তব্যপালন দেখে রেগে উঠে বলতেন, তোর অতো সব দিকে নজর দিয়ে বেড়াবার কী দরকার? যা বারণ করবার আমি করবো।
তুমি দেখলে তো কোনো ভাবনাই ছিল না— বলতো বড়দা, অম্লান বদনে মার মুখের উপরেই বলত, তা দেখতে তো দেখি না। বরং আমাদের ওপর টেক্কা দিয়ে মেয়েকে আস্কারা দেওয়াই দেখি। খু-ব মনের মতন মেয়ে কিনা!
মা চুপ করে যেতেন।
শুধু কখনো কখনো মায়ের চোখের মধ্যে যেন আগুনের ফুলকি জ্বলে উঠতো। তবু মা বকুলকেই কাছে ডেকে বলতেন, দাদা যা ভালবাসে না, তা দাদার সামনে কোরো না।
ছেলেবেলা থেকে মা বকুলদের শিখিয়েছেন, যা করবে সাহসের সঙ্গে করবে! লুকোচুরির আশ্রয় নিয়ে কিছু করতে যেও না। অথচ মা তাঁর বড় ছেলের তীব্র তিক্ত ব্যঙ্গের মুখটা মনে করে বলতেন, ওর সামনে কোরো না। বলতেন না, কোনো সময়ই কোরো না।
কিন্তু মা আর বকুলের ভাগ্যে কতোদিনই বা ছিলেন? মৃত্যুর অনেক দিন আগে থেকেই তো সংসারের দৃষ্টিতে মৃত হয়ে পড়েছিলেন। ছায়া দিতে পারতেন। কই?
তারপর তো প্রখর সূর্যালোকের নীচে, সনাতনী সংসারের জাঁতার তলায় বড়দার সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়ানো বকুলের।
অকারণেই হঠাৎ-হঠাৎ বলে বসতো বড়দা, ওদের বাড়ির জানলার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে কী করছিলি?…বলত-বারান্দায় দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে ইশারায় কথা হচ্ছিল?
অপরাধটা সত্যি হোক বা কাল্পনিক হোক, প্রতিবাদ করবার সাহস ছিল না বকুলের। বকুল শুধু মাথা হেঁট করে অস্ফুটে বলতো, কার সঙ্গে আবার, বাঃ!
বলতো, জানলার দিকে দাঁড়াতে যাবো কেন?
এর বেশী জবাব দেবার সাহস ছিল না বকুলের। বকুলের ভয়ে বুক টিপ টিপ করতো।
এ যুগের মেয়েরা যদি বকুলের সেই অবস্থাটা দেখতে পেতো, না জানি কতো জোরেই হেসে উঠতো।
অনামিকা দেবীর ভাইঝিটাই যদি দর্শক হত সেই অতীতের ছবির?
তা ও হয়তো হেসে উঠতো না।
ওর প্রাণে মায়া-মমতা আছে।
ও হয়তো শুধু মুখের রেখায় একটি কৃপার প্রলেপ বুলিয়ে বলতো, বেচারা!
তা শুধু ভাইঝি কেন, অনামিকা দেবীরও তো ওই ভীরু নির্বোধ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে-বেচারা! কী ভীরু! কী ভীরু!
কিন্তু ভীরু হওয়া ছাড়া উপায়ই বা কী ছিল বকুলের? কার ভরসায় সাহসী হবে? পাশের বাড়ির সেই ছেলেটার ভরসায়? অনামিকা দেবীর মুখে সূক্ষ্ম একটি কৃপার হাসি ফুটে ওঠে।
হাতে একবার হাত ছোঁয়ালে শীতের দিনে ঘেমে যেতো ছেলেটা। একটু ভালবাসা মত কথা কইতে গেলে কথাটা জিভে জড়িয়ে যেতো তার। আর জেঠিপিসির ভয়ে চোখে সর্ষেফুল দেখত।
তা জেঠি-পিসিদেরও তো ভীষণ ভাবে রাইট ছিল তখন শাসন করবার। নির্মল নামের সেই ছেলেটা তার দূর্দান্ত এক জেঠির ভয়ে তটস্থ থাকতো। জেঠির ঘ্রাণশক্তিটাও ছিল তীব্র। বিড়ালরা যেমন মাছ বস্তুটা বাড়ির যেখানেই থাকুক তার আঘ্রাণ পায়, জেঠিরও তেমনি বাড়ির যেখানেই কোনো অপরাধ সংঘটিত হোক তার আঘ্রাণ পেতেন।
অতএব নির্মলদের তিনতলার ছাতের সিঁড়ির ঘরটাকে অথবা সাতজন্ম ধুলো হয়ে পড়ে থাকা বাড়ির পিছন দিকের চাতালটাকে যখন বেশ নিশ্চিন্ত নিরাপদ ভেবে ওরা দুমিনিট দাঁড়িয়ে কথা বলছে, হঠাৎ জেঠির সাদা ধবধবে থানধুতির আঁচলের কোণটা ওদের চোখের সামনে দুলে উঠতো।
ওমা নির্মল তুই এখানে? আর আমি তোকে সারাবাড়ি গরু খোঁজা করে খুঁজে বেড়াচ্ছি!
ওই দুমিনিটের আগের মিনিটটায় নির্মল জেঠিমার চোখের সামনেই ছিল, মানে আর কি ইচ্ছে করেই চোখের সামনে ঘোরাঘুরি করে এসেছিল, যাতে তার অনুপস্থিতির পিরিয়ডটা অনেকক্ষণের ধূসবতায় ছড়িয়ে না পড়ে। তবু জেঠিমা ইতিমধ্যেই নির্মলকে গরুখোঁজা খুঁজে ফেলে বাড়ির এই অব্যবহৃত অবান্তর জায়গাটায় খুঁজতে এসেছেন!
কিন্তু খোঁজার কারণ?
সেটা তা অনুক্তই থেকে যায়।
জেঠিমার বিস্ময়োক্তিটাই যে শ্রোতা যুগলের বুকের মধ্যেটা ছুরি দিয়ে কেটে কেটে নুন দেয়।
ওমা! বকুলও যে এখানে? কতক্ষণ এলি মা? আহা মা-হারা প্ৰাণ, বাড়িতে তিষ্ঠোতে পারে না, ছুটে ছুটে পাড়া বেড়িয়ে বেড়ায়। আয় মা আয়, আমার কাছে এসে বোস।
অতএব মাতৃহীনা বালিকাকে ওই মাতৃস্নেহ-ছায়ায় আশ্রয় নিতে গুটিগুটি এগোতে হয়। নির্মল তো আগেই হাওয়া হয়ে গেছে, কোনো বানানো কৈফিয়তটুকু পর্যন্ত দেবার চেষ্টা না করে।
জেঠিমা বালবিধবা, জেঠিমা অতএব নিঃসন্তান। কিন্তু জেঠিমার সীমাহীন স্নেহসমূদ্র সৰ্বক্ষণ অভিষিক্ত করছে দেবর-পুত্রকন্যাদের। সেই অভিষিক্ত প্রাণীগুলো কি এমনই অকৃতজ্ঞ হবে যে তার প্রতি সশ্রদ্ধ সমীহশীল হবে না? বকুলেরই বা উপায় কি সেটা না হবার?
বকুলকেও জেঠির সঙ্গে সঙ্গে হয়তো তার নিরিমিষ রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে বসতে হত এবং জেঠি শাক বাছতে বাছতে, কিংবা খুন্তি নাড়তে নাড়তে সুমধুর প্রশ্ন করতেন, তা হ্যাঁরে বকুল, তোর বাবা কি নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে? তোর বিয়ের কিছু করছে না?
বলা বাহুল্য বকুলের দিক থেকে এ প্রশ্নের কোনো জবাব যেতো না। জেঠি পুনঃপ্রশ্ন করতেন, হচ্ছে কোনো কথাবার্তা? শুনতে পাস কিছু? তারপর ওই নিরুত্তর প্রাণীটার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নির্মলের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলতেন, বুঝলে ছোটবৌ…মেয়ের বিয়েটিয়ে আর দিচ্ছে না বকুলের বাবা, লাউ-কুমড়োর মতো পাঁড় রাখবে!
নির্মলের মা মানুষটা বড় সভ্য ছিলেন, এ ধরনের কথায় বিব্রত বোধ করতেন, কিন্তু দোর্দণ্ড প্রতাপ বড় জায়ের কথার উপর কথা বলার ক্ষমতা তার ছিল না।
তিনি অতএব শ্যাম কুল দুই রাখার পদ্ধতিতে বলতেন, মা-টি মারা যাওয়াতে আরো গড়িয়ে গেল! নইলে দিদি হয়ে যেতো এতোদিনে। ভদ্রলোক আরও তিন-তিনটে মেয়ে তো পার করেছেন।
জেঠিমা এ যুক্তিতে থেমে যেতেন না, তেতো-তেতো গলায় বলতেন, করেছেন, তখন সময়কালে। মেয়েরা নিজের ছক্কা পাঞ্জা হয়ে ওঠকার আগে। এবার ক্রমশঃ যতো শেষ, ততো বেশ। বকুল হল নভেলপাড়া একেলে মেয়ে, ও হয়তো একখানা লভ-টিভ করে বসে ব্যাপকে বলে বলবে, বাবা, হাড়ি ডোম বামুন কায়েত যাই হোক, অমুক লোকটার সঙ্গেই বিয়ে করতে চাই।…কী রে বকুল, বলবি নাকি?
জেঠিমা হেসে উঠতেন।
জেঠিমার সামনের একটা দাঁত ভাঙা ছিল, সেই ভাঙা দাঁতের গহ্বর দিয়ে হাসিটা যেন ছিটকে ছিটকে বেরিয়ে আসতো।
তাই জেঠি মিনিট কয়েক পরেই বলে উঠতেন, বকুল, কুমড়োফুলের বড়া-ভাজা খাবি?. কেন, না কেন? পিটুলীবাটা দিয়ে মুচমুচে করে ভেজেছি। নে একখানা ধর। তোরা যখন এ বাড়িতে প্রেথম এলি, তুই তো তখন কাঁথায় শোওয়া মেয়ে, তোর মা মাঝে মাঝে বেড়াতে আসতো। তা একদিন এমনি কুমড়োফুলের বড় ভাজছি, বললাম, গরম গরম ভাঁজছি, খাও দুখানা; খেয়ে অবাক, বলে পিটুলীবাটা দিয়ে যে এমন বড় হয় এ তো কখনো জানি না, ভাল-বাটা দিয়ে হয় তাই জানি।
বকুলের সেই এক আবেগ-থরথর মুহূর্তের উপর চিলের ডানার ঝাপটা বসিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে এসে এইরকম সব আলাত-পালাত অবান্তর কথা বলতে শুরু করতেন জেঠি, হয়তো বা কিছু খাইয়েও ছাড়তেন। অবশেষে বকুলকে তার বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে তবে ফিরতেন।
আর শেষবেশ আর একবার বলতেন, তোর বাপকেই এবার ধরতে হবে দেখছি। সোমত্ত মেয়ে শূন্যপ্ৰাণ নিয়ে এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াবে, ঘরসংসারে মাথা দেবে না, আর বাপ বসে বসে পরিবারের শোকে তুষ হতে থাকবেন এটা তো নেয্য নয়।
বকুল মরমে মরে যেতো, বকুল লজ্জায় লাল হয়ে যেতো, বকুল মাথা তুলতে পারতো না। ওই মাথা-নীচু চেহারাটার দিকে তাকিয়ে অনামিকা দেবীর আর একবার মনে হল, বেচারা!
জেঠির এই নেয্য কথার হূলটির জ্বালা সহজে মিটতো না, অনেকদিন ধরেই তাই ওবাড়ির চৌকাঠে বকুলের পদচিহ্ন পড়তো না। সমন্ত আবেগ আকাঙ্খাকে দমন করে বকুল আপন খাতাপত্রের জগতে নিমগ্ন থাকতে চেষ্টা করতো। কিন্তু সে তপস্যা কি স্থায়ী হত? দুর্বার একটা আকর্ষণ যেন অবিরত টানতে থাকত বকুলকে ওই বাড়িটার দিকে। তাছাড়া ও বাড়ির রাস্তার দিকের জানলায় ছাতের আলসে ধরে একখানি বিষণ্ণ-বিষণ্ণ মুখ মিনতির ইশারায় তপোভঙ্গ করে ছাড়তো।
ভাবলে হাসি পায়, একটা পুরুষ ছেলে প্ৰায় একটা ভীরুলাজুক তরুণী মেয়ের ভূমিকায় রেখে দিতো নিজেকে।
বকুল ওই আবেদন-ভরা চোখের আহ্বানকে অগ্রাহ্য করতে পারতো না। বকুল আবার একদিন কোনো একটা ছুতো করে আস্তে ও-বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়াতো।
বকুলের সেই ছুতোটা আদৌ জোরালো হত না, কাজেই ছুতোটা অতি সহজেই ছুতো বলেই ধরা পড়তো।
কিন্তু অবোধ বকুল আর তার অবোধ প্ৰেমাস্পদ দুজনেই ওরা ভেবে নিতো বড়দের বেশ ফাঁকি দেওয়া গেল।
যেমন একদিনের কথা-বাবার আবার হাঁপানির টানের মত হয়েছে আর হোমিওপ্যাথির পর বকুলের বাবার আস্থা, এবং পাশের বাড়ির নির্মল নাকি কোন একজন ভালো হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের নাম জানে। এ কি একটা কম বড় ছুতো!
অতএব বকুল এসে অনায়াসেই নির্মলের মার কাছে জিজ্ঞেস করতে পারে, কাকিমা নির্মলদা কি বাড়ি আছেন? বাবা বলছিলেন নির্মলদা নাকি কোন একজন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার—মানে সেই হাঁপানি মতনটা আবার একটু—
স্পষ্ট স্পষ্ট করে নির্মলদা নামটা উচ্চারণ করতে হয়, যেন কিছুই না। যেন ওই নামটা উচ্চারণ করতে গিযে ওর গলা কাঁপে না, ওর বুকের মধ্যেটা কেমন যেন ভয়-ভয় করে না। তবে নির্মলের মা মানুষটি নিতান্তই ভালমানুষ, অতএব সরলচিত্ত। ওই ছেলেবেলা থেকে বড়চিত ছেলেমেয়ে দুটো যে আবার কোনো নতুন পরিচয়ের মধ্যে নতুন হয়ে উঠতে পারে, এমন সম্ভাবনা তার মাথায় আসতো না। এবং তার ভালমানুষ ছেলেটা এবং পাশের বাড়ির নিরীহ মেয়েটা যে তাঁর সঙ্গে এমন চাতুরী খেলতে পারে তা ভাবতেও পারতেন না। কাজে কাজেই জানলা থেকে চোখের ডাক পেয়ে বিভ্রান্ত হয়ে চলে আসা বকুল ওঁর সামনে বেশ সপ্ৰতিভ গলায় বলতে পারতো, কাকিমা নির্মলদা কি বাড়ি আছেন?
কাকিমার এক মস্ত বাতিক চটের আসন বোনা, তাই তিনি সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে বড় জা ও দজ্জাল ননদের চোখ এড়িয়ে যখন-তখনই ওই চটের আসন নিয়ে বসতেন। ওই আসনের ঘর থেকে চোখ না তুলেই তিনি জবাব দিলেন, নির্মল? এই তো একটু আগেই ছিল। আছে বোধ হয়। দেখগে দিকি তার পড়ার ঘরে। বাবার আবার শরীর খারাপ হল?
হুঁ।
আহা তোর মা গিয়ে অবধি যা অবস্থা হয়েছে! মানুষটা আর বোধ হয় বাঁচবে না। যা দেখগে যা। কোন ডাক্তার কে জানে? আমাদের অনাদিবাবু তো-
ততক্ষণে বকুল হাওয়া হয়ে গেছে। পৌঁছে গেছে নির্মলের পড়ার ঘর, মানে এদের তিনতলার ছাদের চিলেকোঠার ঘরে।
কিন্তু এসে কি বকুল তার প্ৰেমাস্পদের বুকে আছড়ে পড়তো? নাকি নিবিড় সান্নিধ্যের স্বাদ নিতো?
কিছু না, কিছু না।
এ যুগের ছেলেমেয়েরা সেকালের সেই জোলো জোলো প্রেমকে শহুরে গোয়ালার দুধের সঙ্গে তুলনা করবে।
ধরা সেদিনের কথাই
বকুল হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললো, বলতে হল বাবার হাঁপানিটা আবার বেড়েছে, সেই পাপে নিজেরই হাঁপানি ধরে গেল।
নির্মল এগিয়ে এসে হাতটাও ধরলো না, শুধু কৃতাৰ্থমন্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, কাকে বললে?
বললাম কাকিমাকে। এই মিছে কথা বলার পাপটি হল তোমার জন্যে।
নির্মলের মুখে অপ্রতিভের ছাপ।
খুব মিছে কথা আর কি? মেসোমশাই তো ভুগছেনই।
নির্মলের মাকে বকুল কাকিমা বলে, নির্মলের জেঠাইমাকে জেঠাইমা, কিন্তু নির্মল বকুলের মাকে যে কোন নিয়মে মাসীমা বলতো, আর বাবাকে মেসোমশাই,-কে জানে! তবে বলতো তাই।
ডাকা হচ্ছিল কেন?
এমনি। দেখা-টেখা তো হয়ই না। আর। অথচ লাইব্রেরী থেকে সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের একখানা নতুন বই আনা পড়ে রয়েছে।
বকুল উৎসুক গলায় বলে, কই?
দেব পারে। আগে একটু বসবে, তবে।
বসে কি হবে?
এমনি।
খালি এমনি আর এমনি! নিজে যেতে পারেন না বাবু!
নিজে?
নির্মল একটা ভয়ের ভান করে বলে, ও বাবা! তোমার বড়দার রক্তচক্ষু দেখলেই গায়ের রক্ত বরফ হয়ে যায়! যা করে তোকান আমার দিকে!
বড়দা তোমার থেকে কী এমন বড় শুনি যে এতো ভয়! বাবা তো কিছু বলেন না। মা তো—তোমাকে কতো–
হা, মাসীমা তো কত ভালোবাসতেন। গেলে কতো খুশি হতেন। কিন্তু বড়দা? মানে বেশী বড় না হলেও, সাংঘাতিক ম্যান! পুলিস অফিসার হওয়াই ওঁর উপযুক্ত পেশা ছিল।
তা আমারই বুঝি খুব ইয়ে? পিসি আর জেঠির সামনে পড়ে গেলে-
এই, আজকে পড়নি তো?
নাঃ! জেঠিমা বোধ হয় পুজোর ঘরে। আর পিসি রান্নাঘরে।
সত্যি ওঁদের জন্যে তোমার-
নির্মল একটা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে।
বকুলের চোখে আবেগের ছায়া।
বকুল ক্ষুব্ধ অভিমানের গলায় বলে, সত্যি, ওঁদের জন্যে তোমার-বলে নিঃশ্বাস ফেললেই তোমার সব কাজ মিটে গেল, কেমন?
কী করবো বল?
ঠিক আছে। আমি আর আসছি না।
না না, লক্ষ্মীটি, রাণীটি! অত শাস্তি দিও না।
ওই!
প্ৰেম সম্বোধনের দৌড় ওই পর্যন্তই।
আর প্রেমালাপের নমুনাও তো সেই লাইব্রেরীর বই, আর কেউ আসছে কিনা এইটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ।
কেউ এসে তো কোনো দৃশ্যই দেখবে না, তবু ভয়।
ভয়-ভয়! ভালবাসা মানেই ভয়।
বারেবারেই মনে হয় পিছনে বুঝি কেউ এসে দাঁড়ালো। বারেবারেই মনে হয় বাড়িতে হঠাৎ খোঁজ পড়লেই ধরা পড়বে বকুল নির্মলদের বাড়ি গেছে।
সেই ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তো ধরা পড়ে যাবে ওই ছুতোটা ছুতোই।
বাবা বলবেন, কই, নির্মলকে বলতে যেতে তো বলিনি! শুধু বলেছিলাম, নির্মলদের বাড়িতে তো বড় বড় অসুখেও হোমিওপ্যাথি চালায়!
আর দাদা বলবে, ও বাড়িতে গিয়েছিলি কী জন্যে? ও বাড়িতে? কী দরকার ওখানে? ধিঙ্গী মেয়ের এতো স্বাধীনতা কিসের?
তবু না এসেও তো পারা যায় না।
তবে এ বাড়িতে মুখোমুখি কেউ বলে ওঠে না, এ বাড়িতে এসেছ কি জন্যে? এ বাড়িতে? এতো বেহায়ামি কেন?
এ বাড়িতে যেন সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি।
দৈবাৎ যদি জেঠি এসে উপস্থিত নাও হন, সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামবার সময় তো কারুরনা-কারুর সঙ্গে দেখা হয়েই যাবে। হয়তো পিসিরই সঙ্গে।
পিসিও ভুরু কুঁচকে বলবে, বকুল যে। কতক্ষণ এসেছিস?
বকুলকে বলতে হবে, এই একটু আগে।
কোথায় ছিলি? কই দেখিনি তো?
ইয়ে-নির্মলদা লাইব্রেরীর একটা বই দেবেন বলেছিলেন–
ও; বই! তা ভাইপোটাকে একটু পাঠিয়ে দিলেও তো পারিস বাছা! বাপের এই অসুখ, আর তুই ডাগর মেয়ে বই বই করে তাকে ফেলে রেখে এসে-আবার সেই হাঁপাতে হাঁপাতে তিনতলার ছাদে যাওয়া। নির্মল ছিল বাড়িতে?
হাঁ।
গলার মধ্যে মরুভূমি, চোখের সামনে অর্থই সমুদ্র। তবু সেই গলাকে ভিজিয়ে নিয়ে বলতে হয়–হ্যাঁ। এই যে দিলেন বই।
নভেল-নাটক?
ইয়ে, না। গল্পের বই।
ওই একই কথা! তা এ বয়সে এতো বেশী নভেল-নাটক না পড়াই ভালো মা, কেবল কুচিন্তা মাথায় আসার গোড়া। বাবা গা করছেন না তাই, নচেৎ বয়সে বিয়ে হলে তো এতো দিনে দুছেলের মা হয়ে বসতিস।
এই উপদেশ! এই ভাষা!
তাই বকুল বলে, এই ছাত থেকে ছাতে যদি অদৃশ্য হয়ে উড়ে যাওয়া যেতো!
প্ৰভাত মুখুয্যের মনের মানুষের গল্পের মতো!
যা বলেছ। সত্যি ভীষণ ইচ্ছে হয় স্বপ্নে কোনো একটা শেকড় পেলাম, যা মাথায় ছোঁয়ালেই অদৃশ্য হয়ে যাওয়া যায়! তোমার মাথায় আর আমার মাথায় ঠেকিয়ে নিয়ে বেশ সকলের নাকের সামনে বসে গল্প চালানো যায়-
হঠাৎ ভীরু নির্মল একটা সাহসীর কাজ করে বসে।
সম্মুখবর্তিনীর একখানা হাত চেপে ধরে হেসে বলে ৰসে, অদৃশ্য হলে বুঝি শুধুই গল্পে ছাড়বো?
আহা! ধ্যেৎ!
ওই আহার সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য হাত ছাড়ানো হয়ে গেছে।
ছাত থেকে ছাতে একটা ফেলা সিঁড়ি থাকলে বেশ হত! ডিটেকটিভ গল্পে যেমন দড়ির মইটই থাকে-
হ্যাঁ, এমনই সব কথা।
কিন্তু কেন যে, ওই সব দূরূহ পথের চিন্তা, তা দুজনের একজনও জানে না।
শুধু যেন দেখা হওয়াটাই শেষ কথা।
বকুল এ-যুগের এই অনামিকা দেবীর ভাইঝির মতো বলে উঠতে পারবার কথা কল্পনাও করতে পারতো না, আগে মনস্থির কর বাড়ির অমতে বিয়ে করতে পারবে এবং বিয়ে করে বৌকে রাজার হালে রাখতে পারবে, তবে প্রেমের বুলি কপচাতে এসো!
বকুলের যুগ অন্য ছিল।
বকুল মেয়েটাও বোধ হয় আরো বেশী অন্য টাইপের ছিল।
তাই বকুলের অভিমান ছিল না, অভিযোগ ছিল না, শুধু ভালবাসা ছিল। মানে সেই গোয়ালার দুধের জোলো ভালোবাসাই।
বকুল বললো, কই বইটা দাও, পালাই।
এসেই কেবল পালাই-পালাই!
তা কী করবো, বাঃ!
যদি যেতে না দিই, আটকে রাখি?
ইস! ভারী সাহস। আটকে রেখে করবে কি?
কিছু না এমনি।
সঙ্গীন মুহূর্তগুলো এইভাবেই ব্যর্থ করতো নির্মল।
কারণ ওর বেশী ক্ষমতা তার ছিল না।
ওই ছেলেটার দিকে তাকিয়েও মায়া হয় অনামিকা দেবীর।
বলতে ইচ্ছে করে, বেচারা!
কিন্তু সেদিন ওই বেচারাও রেহাই পায়নি। শেষরক্ষা হয়নি। যখন বইটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছে, সামনেই জেঠি জপের মালা হাতে।
ওমা, ই কি কাণ্ড! বকুল তুই এখানে? ওদিকে তোদের বাড়ি থেকে-তা বই নিতে এসেছিলি বুঝি?
হুঁ।
আমি তো তা জানি না। তাহলে বলে দিতাম তোর ভাইপোকে। আমি এসেছি ছাদটা পরিষ্কার আছে কিনা দেখতে। দুটো বড়ি দেব কাল।
কাল বড়ি দেবেন জেঠি, আজ তাই জপের মালা হাতে ছুটে এসেছেন, ছাদ পরিষ্কার আছে কিনা দেখতে!
আর ভাইপো?
সে খবরটা সম্পূর্ণ কল্পিতও হতে পারে। জানা তো আছে বকুল বাড়ি গিয়ে ভেরিফাই করতে যাবে না। অথবা সত্যিই হতে পারে। বড়দা যেই টের পেয়েছে বকুল বাড়ি নেই, পাঠিয়েছে।
.
কলকাতার দক্ষিণ অঞ্চলে রাজেন্দ্রলাল স্ট্রীটের একেবারে রাস্তার উপর বয়সের ছাপধরা এই বাড়িখানার দোতলায় সাবেকি গড়নের টানা লম্বা দালানের উঁচু দেয়ালে সিঁড়ির একেবারে মুখোমুখি চওড়া ফ্রেমের বেষ্টনীর মধ্যে আবদ্ধ যে মুখখানি দেদীপ্যমান, সে মুখ এ বাড়ির মূল মালিক প্ৰবোধচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের।
চারিদিকে খোলা জমির মাঝখানে সস্তায় জমি কিনে তিনিই এই বাড়ি খানি বানিয়ে একান্নাবর্তী পরিবারের অন্ন-বন্ধন ছিন্ন করে এসে আপন সংসারটিকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বর্তমান মালিকরা, অর্থাৎ প্ৰবোধচন্দ্রের পুত্ররা এবং তাদের বড়ো-হয়ে-ওঠা পুত্ররা অবশ্য প্ৰবোধচন্দ্রের দূরদর্শিতার অভাবকে ধিক্কার দেয়, কারণ আশেপাশের সেই ফেলাছড়া সস্তা জমির দুচার কাঠা জমি কিনে রাখলেও এখনকার বাজারে সেইটুকু জমি বেচেই লাল হয়ে যাওয়া যেতো। কিন্তু অদূরদর্শী প্ৰবোধচন্দ্ৰ কেবল নিজের মাপের মতো জমি কিনে আজেবাজে প্ল্যানে শুধু একখানা বাড়ি বানিয়ে রেখেই কর্তব্য শেষ করেছিলেন; যে বাড়িটায় তার পুত্র-পৌত্রবর্গের মাথা গুঁজে থাকাটুকু পর্যন্তই হয়। তার বেশি হয় না। অথচ সুপরিকল্পিত নক্সায় ফ্ল্যাটবাড়ির ধাঁচে বাড়িটা বানালে যে, একতলার খানিকটা অংশ ভাড়া দিয়ে কিছুটা আয় করা যেত এখন, সেটা সেই ভদ্রলোকের খেয়ালেই আসেনি।
এদেরও অথচ খেয়ালে আসে না, ফ্ল্যাট শব্দটাই তখন অজানা ছিল তাঁদের কাছে! তখন সমাজে ফ্ল্যাটের অনুপ্রবেশ ঘটাবার আভাসও ছিল মা! বাসা ভাড়া, ঘর ভাড়া, বাড়ি ভাড়া এই তো কথা।
খেয়াল হয় না বলেই যখন-তখন সমালোচনা করে।
তবে হ্যাঁ, স্বীকার করে ঘরটরগুলো ঢাউশ ঢাউশ, আর ফালতু ফালতু এদিক ওদিক ক্ষুদে ক্ষুদে ঘরের মতন থাকায় ফেলে ছড়িয়ে বাস করার সুবিধে আছে।
কিন্তু ওই যে লম্বা দালানটা একতলায়, দোতলায়? কী কাজে লাগে ও দুটো? যখন সপরিবারে পিঁড়ি পেতে পংক্তিভোজনে বসার ব্যবস্থা ছিলো, তখন নীচের তলার দালানটা যদিও বা কাজে লাগতো, এখন তো তাও নেই। এখন তো আর পরিবারের সকলেই একান্নভুক্ত নয়? যাঁরা আছেন তাঁরা নিজ নিজ অন্ন পৃথক করে নিয়েছেন এবং খাবার জন্যে এলাকাও ভাগ করে নিয়েছেন।
প্ৰবোধচন্দ্রের বড় ছেলে অবশ্য এখন আর ইহ-পৃথিবীর অন্নজলের ভাগীদার হয়ে নেই, তার বিধবা স্ত্রী একতলায় নিজস্ব একটি পবিত্র এলাকা ভাগ করে নিয়ে আপন হবিষ্যান্নের শুচিতা রক্ষার মধ্যে বিরাজিতা, তারই জ্যৈষ্ঠপুত্র অপূর্ব দোতলার ঘর-বারান্দা ঘিরে নিয়ে নিজের মেলোচ্ছপনার গণ্ডির মধ্যে বিরাজমান।
অপুর্বর আর দুই ভাই চাকরি-সূত্রে ঘরছাড়া, তারা দৈবাৎ কোনো ছুটিতে কেউ আসে, কোনোদিন মায়ের রান্নাঘরে, কোনোদিন বৌদির রান্নাঘরে, আর কোনো-কোনোদিন নেমন্তন্ন খেয়েই কাটিয়ে চলে যায়। একজন থাকে রেঙ্গুনে, একজন ত্রিপুরায়, যেতে আসতেই সময় যায়। নেমন্তম জোটে কাকাদের ঘরে, শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্মীয়দের বাড়িতে, কদাচ বড় পিসির বাড়ি। কলকাতায় বড় পিসি চাঁপাই আছে।
প্ৰবোধচন্দ্রের মেজ ছেলে, যাঁর ডাকনাম কানু, তার সংসার নিয়ে দোতলার আর এক অংশে বাস করেন। তিনি। তাঁর গিন্নী বাতের রোগী, নড়াচড়া কম, ছেলেমেয়েরা চাপা আর মুখচোরা স্বভাবের, তাদের সাড়াশব্দ খুব কম পাওয়া যায়।
মেজ কানুও তার বড়দা-বড়বৌদির নীতিতে বিশ্বাসী, মেয়েদের যতো তাড়াতাড়ি পেরেছেন বিয়ে দিয়ে ফেলেছেন, বিবাহিতা মেয়েদের আসা-যাওয়া কম, কারণ কানু নামের ব্যক্তিটি আয়-ব্যয় সম্পর্কে যথেষ্ট সতর্ক, হৃদয়কে প্রশ্রয় দিতে গেলেই যে পকেটের প্রতি নির্দয়তা হবে, তা তিনি বোঝেন।
বুঝতেও হয়, কারণ সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন।
আর আছেন প্ৰবোধচন্দ্রের সেজ ছেলে, ডাকনাম মানু, ভাল নাম প্রতুল। বর্তমানে যিনি ছোট।
এ পরিবারের পোশাকী নামের ব্যাপারে প্ৰয়ের প্রতাপ প্ৰবল!
সুবল নামের যে ছোট ছেলেটি একদা প্ৰবোধচন্দ্রের সংসারে সম্পূর্ণ বহিরাগতের ভূমিকায় নির্লিপ্ত মুখে ঘুরে বেড়াতে, সংসার-টংসার করেনি, সে অনেকদিন আগে চলে গেছে তার জায়গা ছেড়ে দিয়ে।
বরাবর ছোড়দা বলে বকুল।
ছোড়দার রান্নাঘরেই বকুলের ঠাঁই।
প্ৰবোধচন্ত্রের এই সৃষ্টিছাড়া ছোট মেয়েটা তো চিরদিনের জন্যই এই সংসারে শিকড় গেড়ে বসে আছে।
.
মৃত্যুকালে প্ৰবোধচন্দ্ৰ তার পুরনো বাড়ির নবনির্মিত তিনতলার ঘর বারান্দা ছাদ ইত্যাদি কেনই যে তার চির বিরক্তিভাজন হাড়জালানী ছোট মেয়ের নামে উইল করে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই এক রহস্য। তবে দিয়ে গিয়েছিলেন। তার পুত্রদের চমকিত বিচলিত ও গোত্ৰান্তরিত কন্যাদের ঈর্ষিত করে।
তিনতলার ওই ঘরের সংলগ্ন একটুকরো ঘরের মতও আছে রান্নাবাবদ কাজে লাগাতে, কিন্তু সে কাজে কোনোদিন লাগেনি সেটা। সেখানে অনামিকা দেবীর ফালতু বই কাগজের বোঝা থাকে স্তুপীকৃত হয়ে।
পিতৃগোত্রের মধ্যে অবিচল থেকে অনামিকা অবিচল সাহিত্য সাধনা করে চলেছেন।
অনামিকার আমলে প্ৰবোধচন্দ্রের মত রক্ষণশীল ব্ৰাহ্মণের ঘরে বিয়ে না হয়ে পড়ে থাকা মেয়ের দৃষ্টান্ত প্রায় অবিশ্বাস্য, তবু এহেন অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ঘটেও ছিল। ঘটেছিল নেহাৎই ঘটনাচক্রে। না, কোনো উল্লেখযোগ্য কারণে নয়, স্রেফ ঘটনাচক্রেই।
নামের আগে চন্দ্ৰবিন্দু হয়ে যাওয়া সেই প্ৰবোধচন্দ্রের রাশ খুব ভারী না হলেও গোঁয়ার্তুমি ছিল প্ৰবল, তিন-তিনটে মেয়ের যথাবয়সে যথারীতি বিয়ে দিয়ে এসে ছোট মেয়ের বেলায় তিনি যে হেরে গেলেন, সেটা মেয়ের জেদে অথবা তার চিরকুমারী থাকবার বায়নায় নয়, নিতান্তই নিজের আলস্যবশতঃ।
অথবা শুধুই আলস্য নয়, আরো কিছু সূক্ষ্ম কারণ ছিল।
তাঁর চার ছেলে আর চার মেয়ের মধ্যে সাত-সাতটাই তো হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল, ছেলেদের মধ্যে তিনটিকে নিয়ে নিয়েছিল বৌরা অর্থাৎ পরের মেয়েরা। সেই ছেলেদের পোশাকী এক-একটা গালভরা নাম থাকলেও ডাকনাম তো ওই ভানু, কানু আর মানু; বাকি ছেলেটাকে কোনো পরের মেয়ে এসে দখল করে নিতে পারেনি, কারণ সুবল নামে সেই ছেলেটাকে তো কারো দখলে পড়ার আগে ভগবানই নিয়ে নিয়েছিলেন।
আর মেয়ে চারটের মধ্যে চাপা, চন্দন আর পারুল নামের বড় মেজো সেজো তিনটিকে যথারীতি হাতিয়ে নিয়েছিল পরের ছেলেরা। হয়তো সেই জন্যেই জামাইদের দুচক্ষে দেখতে পারতেন না প্ৰবোধচন্দ্ৰ। স্ত্রী-বিয়োগের পর আরো। মেয়েদের আনাআনির নামও করতেন না, সঙ্গে সঙ্গে ওই জামাইরা আর তাদের ছানা-পোনারা এসে ভিড় বাড়ায় এই আশঙ্কায়।
অতএব শেষ ভরসা সর্বশেষটি।
তাকে হাতছাড়া করার ভয়ে তার বয়স সম্পর্কে চোখ বুজে থেকে থেকে ভদ্রলোক যখন চিরতরে চোখ বুজলেন যে, তখন আর তার বিয়ে দেবার প্রশ্ন ওঠে না। কাজে কাজেই তার দাদারা সে প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামাতে বসলো না।
আর বসবেই বা কি? পারুলের জুড়ি বকুল নামের সেই শান্ত নম্র নিরীহ মেয়েটা যে তখন অন্য নামে ঝলসে উঠে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়েছে।
তাছাড়া-বাপের উইল!
সেই উইলের বলে বকুল যদি এ বাড়ির একাংশ দখল করে বসে থাকতেই পায়, তাকে আর বাড়িছাড়া করবার চেষ্টায় লাভ কী? বরকে সুদ্ধু নিয়ে এসে বসলেই কি ভালো?
অতএব বিশেষ কোনো কারণে নয়, বিশেষ কোনো ইতিহাস সৃষ্টি করে নয়, নিতান্ত মধ্যবিত্ত এবং নেহাতই মধ্যবিত্ত এই পরিবারের একটা মেয়ে সেকালের সমাজ নিয়মের বজ্রআঁটুনির মধ্য থেকে ফসকে বেরিয়ে পড়ে একালের সমাজে চরে বেড়াচ্ছে।
এখন আর কে কী বলবে? একালে কেউ কাউকে কিছু বলে না।
কিন্তু একালের সমাজে পড়ার আগে?
তা তখন বলেছিল বৈকি অনেকে অনেক কথা। প্ৰবোধচন্দ্ৰ অনেক দিন আগে যে–পরিবারের একান্নের বন্ধন ছিন্ন করে চলে এসেছিলেন, তারা বলেছিলো। মহিলাকুল গাড়ি ভাড়া করে কলকাতার উত্তর অঞ্চল থেকে দক্ষিণ অঞ্চলে এসে হাজির হয়ে বংশমর্যাদার কথা শুনিয়ে গিয়েছিল, তবে সেই বলার মধ্যে তেমন জোর ফোটাতে পারেনি তারা, কারণ ততদিনে তো আসামী পলাতক!
প্ৰবোধচন্দ্রের মৃত্যুর পরই না তাদের টনক নড়েছিল? শ্রাদ্ধের সময় জ্ঞাতিভোজনে এসেই তো দেখে হাঁ হয়ে গিয়ে বয়েস হিসেব করতে বসেছিল এই অবিশ্বাস্য ঘটনার নায়িকার।
তাছাড়া ততোদিলে–বকুলের অন্য নামটাও দিব্যি চাউর হয়ে উঠেছে।
মোট কথা, তালগোল অথবা গোলে-হরিবোলে, বকুল রাজেন্দ্রলাল স্ট্রীটের এই বাড়িটায় শেকড় গেড়ে বসে থেকে চোখ মেলে দেখে চলেছে কেমন করে বাড়ির চারিপাশের উদার শূন্যতা সংকীর্ণ হয়ে আসছে, আর সমাজের বন্ধ সংকীর্ণতা উদার হয়ে পড়ছে।
বকুলের নিজের জীবনটার সঙ্গে বুঝি এই পাড়াটার মিল আছে। বকুলের নিজের মধ্যে কোনোখানে আর হাঁফ ফেলবার মত ফাঁকা জমি পায় না বকুল, কোনোদিন যে কোনোখানে অনেকখানি শূন্যতা ছিল, তা স্মরণে আনতেও সময় নেই তার, সবখানটাই ঠাসবুনুনিতে ভর্তি। ঠিক ওই রাস্তার ধারের বাড়ির সারির মত।
রাস্তার ধার থেকে দেখলে শুধু একসারি। আর তিনতলায় ওপরের ছাদে উঠলে——তার পিছনে, আরো পিছনে শুধু বাড়ি আর বাড়ির সারি।
কিন্তু তিনতলারও ওপরের ছাদে উঠে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখার মত বিলাসিতার সময় কোথায় বকুলের? ঘরের সামনের ছাদটুকুতে একটু দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখার সময় হয় না!
আশ্চর্য!
যখন সময় ছিল, তখন এই তিনতলার ওপরের ছাদটা পেলে একটা রাজ্য পাওয়ার সুখানুভূতি হতে পারতো, তখন ওটার জন্ম হয়নি। এখন কদাচ কোনোদিন ওই ছাদটায় ওঠবার সরু লোহার সিঁড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে কল্পনা করে বকুল, বকুলের কৈশোরকালে যদি এটা থাকতো!
থাকলে যে কী হতো তা জানে না বকুল, যদি থাকতো ভাবতে গেলেই অন্য একটা বাড়ির ছাদে একখানা হাসি-হাসি মুখ ভেসে ওঠে।
যে মুখের অধিকারীকে সেজদি পারুল বলতো, বোকা, হাঁদা, নীরেট।
অবিশ্যি সে-সব তো সেই তামাদি কালের কথা। যখন এক-আধবার আসতো পারুল বাপের বাড়িতে। অনেক দিন আগে বিয়ে হওয়া তিন মেয়ের মধ্যে পারুলই মা মারা যাওয়ার পরও মাঝে মাঝে এসেছে।
আর চাপা, চন্দন?
তারা তো আর মরণকালে কেঁদে কেঁদে বলেছিলই, মা তুমিও চললে, আমাদেরও বাপের বাড়ি আসা ঘুচলো—
যদিও তখন সেখানে উপস্থিত মহিলাকুল, যাঁরা নাকি ওদের খুড়ি জেঠি পিসি, তারা বলেছিলেন, ষাঠ-ষাঠ, বাপ বেঁচে থাকুন একশ বছর পরমায়ূ নিয়ে–
ওরা সেই ক্ৰন্দন-বিজড়িত গলাতেই সতেজ সংসারের নিয়ম বুঝতে দিয়েছিল গুরুজনবৰ্গকে। বলেছিল, থাকুন, একশো কেন হাজার বছর, মা মরলে বাপ তালুই, এ আর কে না জানে?
হয়তো মা থাকতেই বাপের ব্যবহারে তার আঁচ পেয়েছিল তারা। টের পেতো বাবার একান্ত অনিচ্ছার ওপরও মা প্ৰায় জোর করেই তাদের নিয়ে আসেন। যদিও এও ধরা পড়তে নাকি থাকতো না-এই যুদ্ধের মধ্যে স্নেহবিগলিত চিত্তটা ততো নয়, কর্তব্যবোধটাই কাজ করেছে বেশী।
সুবৰ্ণলতার এই প্ৰবল কর্তব্যবোধটাই তো প্ৰবোধচন্দ্ৰকে চিরকাল জব্দ করে রেখেছিল। প্ৰবোধচন্দ্ৰ বুঝে উঠতে পারতেন না নিজের জীবনটা নিয়ে নিজে যা খুশি করতে পারে না কেন মানুষ।
নেহাৎ অসচ্ছল অবস্থা না হলে-মানুষ তো অনায়াসেই খাওয়া থাকা আয়েস আরাম সুখভোগ করে কাটিয়ে দিতে পারে, তবে কী জন্যে মানুষ কর্তব্য নামক বিরক্তিকর একটা বস্তুকে নিয়ে ভারগ্রস্ত হতে যাবে? সেই বস্তুটার পিছনে পিছনেই তো আসবে যাতে রাজ্যের চিন্তা, আর যতো রাজ্যের অসুবিধে।
প্ৰবোধচন্দ্রের এই মতবাদের সঙ্গে চিরকাল লড়ালড়ি ছিল সুবৰ্ণলতার, কিন্তু শেষের দিকে কতকগুলো দিন যেন সুবৰ্ণলতা হাত থেকে অস্ত্ৰ নামিয়ে যুদ্ধবিরতির অন্ধকার শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
মায়ের কথা মনে করতে গেলেই বকুলের মায়ের সেই নির্লিপ্ত নিরাসক্ত হাত থেকে হালনামানো মূর্তিটাই মনে পড়ে।
মৃত্যুর অনেক আগে থেকেই সুবৰ্ণলতা যেন এ সংসার থেকে বিদায় নিয়ে নিজেকে মৃতের পর্যায়ে রেখে দিয়েছিলেন। সেই মৃত্যুর শীতলতার মধ্যে কেটেছে বকুলের কৈশোরকাল।
তবু আশ্চৰ্য, সেই শীতলতার মধ্যেই ফুটেছে ফুল, জ্বলেছে আলো।
তারপর তো সুবৰ্ণলতা সত্যিই বিদায় নিলেন।
তার কতোদিন যেন পরে সে-বার পারুল এলো বাপেরৰাড়ি।
ঠিক মনে পড়ে না কবে!