অষ্টম পর্ব
ফেসীয়দের ক্রীড়ানুষ্ঠান
সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন রাজা অ্যালসিনোয়াস। উঠে দেখলেন ওডিসিয়াসও ঐ সময় উঠেছেন। ওডিসিয়াসকে সঙ্গে নিয়ে সোজা জাহাজঘাটে চলে গেলেন অ্যালসিনোয়াস। এই সময় প্রতিদিন দেশীয় নাবিকরা বিভিন্ন কার্যোব্যপদেশে সমবেত হয় এই পোতাশ্রয়ে। সেখানে গিয়ে দুজনে দুটি মর্মর প্রস্তর নির্মিত আসনে উপবেশন করলেন। এদিকে প্যালাস এথেন ওডিসিয়াসের প্রত্যাবর্তনের জন্য যে পরিকল্পনা করেছিলেন তা দ্রুত কার্যকরী করার জন্য রাজা অ্যালসিনোয়াসের প্রহরীবেশে নেমে এলেন তাঁর রাজধানীতে। নগরমধ্যে পথে যেকোন পারিষদকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলতে লাগলেন, হে মাননীয় ফেসীয় পরিষদ, আপনারা সকলে সভায় গিয়ে সমবেত হোন। রাজা অ্যালসিনোয়াসের প্রাসাদে যে অতিথি এসেছেন তিনি বহু সমুদ্রপথ অতিক্রম করেছেন এবং দেখতে তিনি ঠিক দেবতাদের মত।
এই সংবাদে সকলেই এক উত্তেজনা ও কৌতূহল অনুভব করল। অল্পকালের মধ্যেই সভাস্থল লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠল। সকলেরই কৌতূহলী দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো লার্তেসপুত্রের বুদ্ধিদীপ্ত মুখের উপর। দেবী এথেন তাঁর দেহটিকে এমন এক দেবোপম মহিমায় সমৃদ্ধ করে তুললেন যাতে তাঁকে দেখে আরো বলিষ্ঠ ও দীর্ঘকায় মনে হতে লাগল যার ফলে তিনি ফেসীয় জনতার কাছ থেকে প্রীতি ও শুভেচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে এক ভীতিবিহ্বল শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে লাগলেন। তাঁকে দেখে মনে হলো যেকোন পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হবেন তিনি।
সভাস্থলে সকলে সমবেত হলে রাজা অ্যালসিনোয়াস উঠে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলেন জনতার উদ্দেশ্যে, হে ফেসীয় নেতৃবর্গ ও পারিষদগণ, আজ আমি একটি বিষয়ের প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। একটি বিষয় আপনাদের পর্যালোচনার জন্য উপস্থিত করতে চাই আপনাদের কাছে। যে বিদেশী অতিথিকে আমার পাশে দেখছেন আমি তার নাম জানি না–তিনি পৃথিবীর পূর্ব না পশ্চিম প্রান্ত হতে এসেছেন তাও জানি না। শুধু এইটুকু জানি যে তিনি তাঁর দেশভ্রমণকালে আমাদের দেশে এসে অতিথিরূপে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি আমাদের নিকট হতে তার স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের উপযুক্ত পাথেয় ভিক্ষা করছেন। আমাদের দেশের প্রথাগত বদান্যতার কথা স্মরণ করে তার যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি সম্পন্ন করার প্রস্তাব করছি আমি। কারণ এর আগে আমার প্রাসাদে যেসব বিদেশী এসেছেন তাঁদের কেউ উপযুক্ত পাথেয়র অভাবে আমার রাজ্যে আটক হয়ে পড়ার অভিযোগ করতে পারেন নি কখনো। সুতরাং তার যাত্রার জন্য একটি কৃষ্ণকায় অর্ণবপোত আর বাহান্নজন এমন যুবককে সংগ্রহ করা হোক যা ইতিমধ্যে নাবিক হিসেবে তাদের দক্ষতার পরিচয় দিতে পেরেছে।
নাবিকরা সমুদ্রযাত্রার উপযোগী করে জাহাজটিকে প্রস্তুত করে তোলার পর তারা যেন আমার প্রাসাদে এসে তাড়াতাড়ি আহার করে নেয়। আমি তাদের সকলের জন্য খাদ্য জাহাজে দিয়ে দেব। নৌবিভাগের কর্মচারীদের প্রতি এই হলো আমার আদেশ। এছাড়া আমি উপস্থিত রাজন্যবর্গকে অনুরোধ জানাচ্ছি, আমি আমার প্রাসাদের অভ্যন্তরে এই আগন্তুককে আপ্যায়নের যে ব্যবস্থা করেছি তাতে যেন তাঁরা এসে যোগদান করেন। অবশ্য আমার প্রাসাদ আজ সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। কারো প্রবেশের কোন বাধা থাকবে না। আমাদের দেশের প্রখ্যাত চারণকবি ডেমোডোকাসকে আহ্বান জানানো হোক। বিষয়বস্তু যাই হোক না কেন, তিনি তাঁর সুমধুর কন্ঠের দ্বারা আমাদের যেভাবে প্রীত করেন তেমন আর কোন কবি পারেন না।
অ্যালসিনোয়াসের কথা শেষ হলে তিনি উঠে প্রাসাদের পথে পা বাড়াতেই রাজন্যবর্গও তাঁর সঙ্গ নিল। তাঁর বিশেষ দূতরা চারণকবির সন্ধানে চলে গেল। ইতিমধ্যে নাবিকেরা জাহাজ সমুদ্রতলে ভাসিয়ে পাল মাস্তুল প্রভৃতি খাঁটিয়ে যাত্রার উপযোগী করে তুলল। প্রাসাদে এসে পশুবলি ও ভোজসভার আয়োজন করতে লাগলেন অ্যালসিনোয়াস। প্রাসাদের সব অলিন্দ, দরবারকক্ষ ও প্রাঙ্গণ লোকের ভিড়ে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। সেদিন বারোটি মেষ, আটটি শুভ্রদন্তবিশিষ্ট শূকর ও কয়েকটি কচি বলদ বলির ব্যবস্থা হয়।
চারণকবিকে সঙ্গে নিয়ে দূতরা ফিরে এল যথাসময়ে। কলাবিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী কবির কণ্ঠে যথেষ্ট মাধুর্য ঢেলে দিলেও তাঁর চক্ষুর দৃষ্টি হরণ করে নিয়েছেন। চারণকবি ডেমোডোকাস অন্ধ। ভোজসভাগৃহের মাঝখানে তার জন্য রৌপ্যখচিত একটি চেয়ার পেতে দিল পন্টোনোয়াস। তাঁর সামনে বীণাটি ঝুলিয়ে দিয়ে কিভাবে বাজাতে হবে তা বুঝিয়ে দিলেন। তারপর তার পাশে একটি টেবিলে একটি পানপাত্রে মদ রাখল যাতে পিপাসার্ত ডেমোডোকাস তা পান করতে পারেন। ভোজসভার কাজ শুরু হলো।
ভোজনপর্ব শেষ হলে গানের জন্য প্রস্তুত হলেন চারণকবি। তিনি আজ গাইবেন বিখ্যাত বীরদের কাহিনী। তিনি বিশ্ববিশ্রুত একটি আখ্যানকাব্যের একট অনুচ্ছেদ বেছে নিলেন। তার শিরোনাম হচ্ছে ওডিসিয়াস ও অ্যাকেলিসের কলহ। তাতে আছে কেমন করে এই দুই বীর এক ভোজসভায় এক বিবাদে প্রবৃত্ত হন এবং উত্তপ্ত বাগযুদ্ধ কিভাবে ভীত সন্ত্রস্ত করে তোলে সে সভায় উপস্থিত গ্রীকদের। অথচ এই দুই গ্রীকবীরের কলহ দেখে অন্তরে এক গোপন উল্লাস অনুভব করেছিলেন রাজা অ্যাগামেমনন। তিনি তখন শুধু ভাবছিলেন ফীবাস অ্যাপোলোর একটি ভবিষ্যদ্বাণীর কথা। সে বাণীতে বলা হয়, দেবরাজ জিয়াসের বিধানে ট্রয় ও গ্রীকজাতি উভয় পক্ষের উপরেই নেমে আসবে এক বিরাট বিপর্যয়ের প্লাবন।
এই হলো চারণকবির গানের বিষয়বস্তু। এ গান শুনে ওডিসিয়াস তাঁর নীলবর্ণের পোশাকের অঞ্চলভাগ তুলে মুখ ঢাকলেন। তাঁর অপূর্ণ চোখ পাছে ফেসীয়রা দেখে ফেলে এই ভেবে লজ্জা পাচ্ছিলেন তিনি। গানের মাঝে মাঝে তিনি চোখ মুখে তার পার্শ্বস্থ দ্বিমুখী পানপাত্র হাতে নিয়ে দেবতাদের উদ্দেশ্যে মদের অঞ্জলি দান করছিলেন। কিন্তু ফেসীয় শ্রোতৃবর্গের উৎসাহের আতিশয্যে অনুপ্রাণিত হয়ে যখনই সেই গান আবার শুরু করছিলেন ডেমোডোকাস, তখনি নতুন করে জল আসছিল ওডিসিয়াসের চোখে। একমাত্র রাজা অ্যালসিনোয়াস ছাড়া কেউ অবশ্য তাঁর সেই অশ্রুপূর্ণ চোখ দেখতে পায় নি। অ্যালসিনোয়াস ওডিসিয়াসের পাশে বসে থাকায় তিনি তাঁর দীর্ঘশ্বাস স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি ভাবলেন গানের সকরুণ সুরই ব্যথার উদ্রেক করছে ওডিসিয়াসের নরম মনে। তাই তিনি সঙ্গীত শেষ করার আদেশ দিয়ে বললেন, হে আমার পারিষদবর্গ, চারণকবি তাঁর সুমধুর কণ্ঠের দ্বারা আমাদের যথেষ্ট আনন্দ দান করেছেন। এবার বাইরে গিয়ে অন্যান্য ক্রীড়ানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হোক যাতে আমাদের এই বিশেষ অতিথি তাঁর স্বদেশে গিয়ে বলতে পারেন মল্লযুদ্ধ, দৌড় ও উল্লম্ফন প্রতিযোগিতা প্রভৃতি ক্রীড়াতেও আমরা অদ্বিতীয় এবং অপরাজেয়। এই বলে প্রাসাদের বাইরে চলে গেলেন অ্যালসিনোয়াস আর সকলেই তাকে অনুসরণ করতে লাগল। ভৃত্যেরা অন্ধ চারণকবিকে প্রাসাদের বাইরে ধরে নিয়ে গেল।
ক্রমে ক্রীড়ানুষ্ঠানের স্থানটি এক বিরাট জনতায় পূর্ণ হয়ে গেল। সেই ক্রীড়ানুষ্ঠানে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য ছুটে এল দেশের যুবকবৃন্দ। তাদের মধ্যে ছিল অ্যাফ্রোনিয়স, ওসিয়ানাস, অলাট্রিয়াস, মাতিয়াস, প্রিয়নিয়াস, অ্যাঙ্কিয়ানাস, ইরেগমিয়াস, পন্টিয়াস, পোতিয়াস, খুন ও ইউরিয়ানাস। এই ইউরিয়ানাস একমাত্র লাওডামাস ছাড়া আর সকলের থেকে সর্বতোভাবে শ্রেষ্ঠ। রাজা অ্যালসিনোয়াসের তিন পুত্র–লাওডামাস, হেলিয়াস ও ক্লাইটেনিয়াসও অংশগ্রহণ করলেন প্রতিযোগিতায়।
প্রথমে হলো দৌড় প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগীরা তাদের পদভরে ধূলিরাশির মেঘ তুলে দৌড়তে শুরু করল। কিন্তু কে শীর্ষস্থান অধিকার করবে তা কারো অজানা ছিল না। সকলের ধারণামত সর্বাপেক্ষা দ্রুতগামী ক্লাইটেনিয়াসই প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করলেন। এরপর শুরু হলো মল্লযুদ্ধ–এত জয়লাভ করলেন ইউনিয়ানাস। এরপর বক্সিং এ জয়ী হলেন লাওডামাস আর উল্লম্ফন প্রতিযোগিতায় জয়ী হলেন অ্যাঙ্কিয়ানাস।
ক্রীড়ানুষ্ঠান শেষ হলে লাওডামাস অন্যান্য প্রতিযোগীদের বললেন, শোন তোমরা, চল আমরা আমাদের আগন্তুককে কোন এক প্রতিযোগিতায় আহ্বান করি। তার দেহ সুগঠিত, তাঁর পা ও ঊরুদেশের পানে তাকিয়ে দেখ। তাঁর হাত পেশিবহুল আর স্বন্ধদেশ প্রশস্ত। তিনি বলিষ্ঠদেহী এবং বয়সেও বৃদ্ধ বলা যায় না। পথকষ্ট ও ক্লান্তিতে তিনি কিছু ভেঙ্গে পড়েছেন মাত্র। বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম বলিষ্ঠ মানুষকে ভেঙ্গে দেয় একেবারে।
ইউরিয়ানাস কথাটা শুনে বলল, লাওডামাস, আমিও সমর্থন করি তোমাকে। তুমি নিজে গিয়ে ভদ্রলোককে আহ্বান জানাও।
এবার লাওডামাস সোজা ওডিসিয়াসের কাছে গিয়ে তাঁকে বললেন, আসুন মহাশয়, আমাদের সঙ্গে আপনিও কি এ ক্রীড়ায় অংশগ্রহণ করবেন না? দেখে মনে হচ্ছে আপনিও নিশ্চয় একজন ব্যায়ামবিদ। আপনি শীঘ্রই স্বদেশে রওয়ানা হবেন, যাত্রার ব্যবস্থা সব ঠিক। জাহাজ ও নাবিকেরা প্রস্তুত। তার আগে একবার এসে আমাদের সঙ্গে এ ক্রীড়ায় যোগদান করুন।
ওডিসিয়াস তখন উত্তর করলেন সঙ্গে সঙ্গে, লাওডামাস, আমাকে কেন শুধু শুধু বিরক্ত করছ? এখনো পর্যন্ত আমি এতদূর ক্লান্ত ও অবসন্ন যে কোন ক্রীড়ামোদের কথা ভাবতেই পারছি না। দীর্ঘ যাত্রাপথে বহু তিক্ত ও দুঃসহ অভিজ্ঞতায় আমার প্রাণশক্তির অনেকখানি হয়েছে নিঃশেষিত। এখন গৃহে প্রত্যাবর্তনের কথাই ভাবছি আমি শুধু। আর তার জন্য রাজা ও তোমাদের সমগ্র জাতির নিকট জানিয়েছি আমার সনির্বন্ধ আবেদন।
ইউরিয়ানাস তখন ওডিসিয়াসের মুখের সামনে অপমান করল। বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন, মহাশয়। ব্যায়ামবিদ বলতে যা বোঝায়, আপনাকে দেখে আমার কিন্তু তা মনে হয় নি। আপনাকে দেখে মনে হয় আপনি কোন পণ্য ব্যবসায়ী জাহাজের নাবিক যে সব সময় নতুন কোন সমুদ্রযাত্রার কথা ভেবে অথবা লাভ করা টাকাকড়ি সব গুছিয়ে নিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আপনাকে কেউ ক্রীড়াবিদ বলে ভাবতেই পারে না।
বুদ্ধিমান ওডিসিয়াস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ইউরিয়ানাসকে একবার দেখে নিয়ে প্রত্যুত্তর করলেন, এটা কিন্তু এক কুৎসিত মন্তব্য। এ মন্তব্য করে তুমি নির্বোধের মতই কাজ করেছ। এতে বোঝা যায় একই মানুষের মধ্যে একই সঙ্গে দেহসৌন্দর্য, বুদ্ধি ও বাগ্মিতার সঙ্গে সদগুণাবলি আশা করা যায় না। কোন মানুষ উপরে দেখতে খারাপ হয়েও ঈশ্বরপ্রদত্ত বাগ্মিতা-গুণের অধিকারী হতে পারেন যিনি এক বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয় ও চিত্তাকর্ষক গাম্ভীর্যের সঙ্গে তার প্রতিটি যুক্তি বিশ্লেষণ করেন, যাকে অজস্র মানুষের মধ্যে চিনে নেওয়া যায় এবং তিনি নগর মধ্যে যখন পথ দিয়ে চলে যান তখন সকলে দেবতাজ্ঞানে শ্রদ্ধার সঙ্গে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। আবার কেউ বা দেবতার মত সুদর্শন হলেও তার মধ্যে বাগিতাগুণের অভাব। এই যেমন তোমার চেহারা দেখে দেবতাদের থেকেও একটি বিশিষ্ট ও যোগ্য লোক বলে মনে হয়। কিন্তু তোমার মাথায় বুদ্ধি বলে কোন জিনিস নেই। তুমি আমার প্রতি অশোভন মন্তব্য করে আমার মধ্যে ক্রোধ সঞ্চার করেছ এবং আমি দেখিয়ে দেব আমি ক্রীড়া বিষয়ে নিতান্ত অনভিজ্ঞ নই, বরং আমি একসময় প্রথম সারির সুদক্ষ ক্রীড়াবিদ ছিলাম। দীর্ঘদিন ধরে বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করে আমি ক্লান্ত ও অবসন্ন আজ। যাই হোক, যত অবসাদগ্রস্ত হই না, এই ক্রীড়া-প্রতিযোগিতায় আমি অংশগ্রগণ করবই। তোমার কথার দংশন আমার সুপ্ত শক্তিকে জাগিয়ে দিয়েছে।
এই বলে ওডিসিয়াস লাফ দিয়ে ভারী জিনিস উত্তোলন-প্রতিযোগিতার আসরে গিয়ে সবচেয়ে একটি ভারী আয়ত বস্তু হাত দিয়ে তুলে অবলীলক্রমে সেটি উপরে ছুঁড়ে আবার লুফে নিলেন। সে বস্তু নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়িয়ে অনেক উঁচুতে উঠে গেল। অবাক হয়ে গেল ফেসীয় জনতা ও উপস্থিত লর্ডগণ। জনতার মধ্যে হতে এথেন সাধারণ দর্শকের ছদ্মবেশ ধারণ করে বলে উঠলেন, এ ব্যাপারে আপনি মহাশয় অদ্বিতীয়। কোন ফেসীয় প্রতিযোগী পরাজিত করতে পারবে না আপনাকে।
একথায় উৎসাহিত হলেন ওডিসিয়াস। তিনি বুঝলেন এখানেও তাঁর গুণমুগ্ধ ব্যক্তি আছে। ওডিসিয়াস তখন বললেন, হে প্রতিযোগী যুবকবৃন্দ, আমি যে ভারী বস্তুটিকে যতদূর উপরে ছুঁড়েছি, আপনাদের কেউ ততদূর ছুঁড়তে পারেন কি না দেখুন। তারপর বক্সিং, মল্লযুদ্ধ, দৌড় প্রতিযোগিতা, যেকোন খেলায় আমার প্রতিযোগী হিসেবে এগিয়ে আসার কারো যদি সাহস থাকে আসুন। আমি প্রস্তুত। আমি তাঁদের অতিথি বলে লাওডামাস হয়ত আসতে পারছেন না। তাছাড়া যিনি বিদেশে আমাকে আতিথ্য ও আশ্রয় দান করেছেন, তাঁকে আমি কোন প্রতিযোগিতায় আহ্বান করতে পারি না। তাতে তার ভবিষ্যৎ সুনাম নষ্ট হবে।
কিন্তু তিনি ছাড়া বাকি আর সব? কেউ নেই। এবিষয়ে আমি সত্যিই গর্বিত। আমি যেকোন ক্রীড়ায় অভ্যস্ত এবং আমি সকল প্রতিযোগীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে প্রস্তুত। আমি ভালভাবে তীরধনুক চালাতে পারি। আমি আমার তীরের দ্বারা শত্রুপক্ষের যেকোন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে বিদ্ধ করতে পারি এবং এ বিষয়ে আমার কোন প্রতিযোগী আমাকে পরাস্ত করতে পারবে না। একবার আমরা গ্রীকরা ট্রয়যুদ্ধকালে তীর ধনুক নিয়ে আক্রমণ করি ট্রয়বাসীদের। কিন্তু তীর চালনার ব্যাপারে একমাত্র ফিলোকটেটাস ছাড়া আর কেউ আমার সঙ্গে পেরে ওঠে নি। বর্তমানে সারা পৃথিবীর জীবিত তীরন্দাজদের মধ্যে আমি শ্রেষ্ঠ, অবশ্য অতীতের হেরাকেলস, ইউরিটাস প্রমুখ তীরন্দাজদের কথা বলছি না। তাঁরা ছিলেন তীরন্দাজ হিসেবে দেবতাদের ঈর্ষার পাত্র।
ইউরিটাস একবার অ্যাপোলোকে এক প্রতিযোগিতায় আহ্বান করেন বলে তিনি অকালে নিহত হন অ্যাপেলোর দ্বারা। শ্রেষ্ঠত্বের অহঙ্কারই তার মৃত্যু ঘটায় অকালে। বর্শাচালনাতেও আমি অদ্বিতীয়। একটি লোকের নিক্ষিপ্ত তীর যতদূর যায় আমার নিক্ষিপ্ত বর্শাও ঠিক ততদূর যাবে। তবে বর্তমানে দৌড়-প্রতিযোগিতায় আপনাদের অনেকে আমাকে হয়ত পরাস্ত করতে পারেন। কারণ আমার নৌকো সহসা ঝড়ে ভেঙ্গে যাওয়ায় অবিরাম সমুদ্রতরঙ্গের সঙ্গে সংগ্রাম করে করে আমার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এখনও অবসন্ন হয় আছে। আমার দেহের হৃতশক্তি এখনও খুঁজে পাই নি পুরোমাত্রায়।
ওডিসিয়াস এবার তাঁর কথা শেষ করলেন। কিন্তু ফেসীয়রা সকলেই স্তব্ধ হয়ে রইল। প্রতিযোগী বা দর্শকদের মধ্যে কেউ কোন কথা বলল না। অবশেষে রাজা অ্যালসিনোয়াস তার কথার উত্তরে বললেন, বন্ধু, আপনি যা বললেন তাতে আমরা কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হই নি। যেভাবে এ যুবকটি আপনাকে সর্বসমক্ষে অপমানিত করে তাতে আপনার নিজস্ব যোগ্যতাকে সম্প্রমাণিত করার ইচ্ছা জাগবেই। কিন্তু আমার একটা কথা শুনুন। যখন আপনি বাড়ি ফিরে আপনার স্ত্রী ও পুত্রন্দ্রে নিয়ে ভোজসভার গল্প করবেন তখন যেন বিশেষ কয়েকটি বিষয়ে আমাদের পারদর্শিতার কথাকে ব্যক্ত করবেন তাদের কাছে। আপনি তাদের বলবেন জিয়াস আমাদের জাতিকে কত বিরল গুণে ভূষিত করেছেন যা আমাদের পূর্বপুরুষদের কাল থেকে আজ পর্যন্ত তা সঞ্চারিত হয়ে আসছে আমাদের মধ্যে যদিও বক্সিং ও মল্লযুদ্ধে আমরা ত্রুটিমুক্ত নই, তথাপি দৌড় প্রতিযোগিতা ও নৌকার্যে আমরা অদ্বিতীয়। কিন্তু যে বিষয়ে আমরা সবচেয়ে বেশি গর্ব অনুভব তা হলো সঙ্গীত, নৃত্য ও সূচীশিল্প। সুতরাং হে নৃত্যশিল্পীবৃন্দ, তোমরা তোমাদের অপরূপ নৃত্যছন্দের পরিচয় দাও যাতে আমাদের এই মাননীয় অতিথি বাড়ি ফিরে তাঁর বন্ধুদের নিকট বলতে পারেন আমরা সঙ্গীত নৃত্য ও নৌচালনার কাজে অন্যান্য জাতির থেকে শ্রেষ্ঠ। তোমাদের মধ্যে একজন ছুটে গিয়ে ডেমোডোকাসের হাতে তাঁর বীণাটি এনে দাও। সেটি বোধহয় এখন প্রাসাদে পড়ে আছে।
রাজার আদেশে একজন দূত বীণাটি আনার জন্য ছুটে গেল আর নৃত্য গীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে লাগল নয়জন সদস্যবিশিষ্ট এক সমিতি। নৃত্যের মঞ্চটি প্রস্তুত হতেই ডেমোডোকাসের হাতে বীণা এনে দেওয়া হলো। তিনি বীণায় নৃত্যের উপযুক্ত সুর বাজাতে লাগলেন আর কয়েকজন পূর্ণযৌবনসম্পন্ন শিল্পী অপরূপ ছন্দে নৃত্য পরিবেশন করতে শুরু করলেন। তা দেখে সত্যিই মুগ্ধ হয়ে গেলেন ওডিসিয়াস।
অল্পক্ষণের মধ্যেই বীণার সুর ছাড়িয়ে চারণকবি ডেমোডোকাসের কণ্ঠ শোনা গেল। ওঁর গানের বিষয়বস্তু ছিল রণদেবতা অ্যারেস ও কামদেবী অ্যাফ্রোদিতের প্রেমকাহিনী। কিভাবে দেবশিল্পী হিফাস্টাসের নির্জন প্রাসাদে দেবী অ্যাফ্রোদিতের সঙ্গে গোপনে মিলিত হতেন অ্যারেস কি কি উপহার দিয়ে তিনি প্রীত করতেন অ্যাফ্রোদিতেকে তা সব গানের মধ্যে দিয়ে ব্যক্ত করলেন চারণকবি। এইভাবে দিনের পর দিন অ্যারেস হিফাস্টাসের দাম্পত্যশয্যাকে কলুষিত করেন গোপনে। কিন্তু তাঁদের আলিঙ্গনাদি, বিবিধ শৃঙ্গারসমৃদ্ধ গোপন প্রেমচর্চার সাক্ষী ছিলেন সূর্যদেব। তিনি সবকিছু দেখে হিফাস্টাসকে জানান। হিফাস্টাস তখন রেগে গিয়ে প্রতিশোধবাসনায় উন্মত্ত হয়ে তাঁর শিল্পাগারে গিয়ে খাঁটি ইস্পাত দিয়ে এমন এক শৃঙ্খল তৈরি করেন যা কেউ কোনদিন ছিন্ন করতে পারবে না। অ্যারেসের প্রতি তার ক্রোধের প্রচণ্ডতা এ কাজে অনুপ্রাণিত করতে লাগল তাকে। লৌহশৃঙ্খলসংযুক্ত এক ফাঁদ রচনা করার পর হিফাস্টাস চলে গেলেন তার প্রাসাদমধ্যস্থিত শয়নকক্ষে। সেখানে গিয়ে তাঁর পর্যঙ্কের চারপাশে এমনভাবে সেই অদৃশ্য শৃঙ্খলজাল পেতে রাখলেন যাতে তা দেবতাদেরও বোধগম্য না হয় এবং যাতে সে পালঙ্কে যেকেউ শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাতে আটকে যায়। সেই শৃঙখলজাল বিস্তারের কাজ শেষ করে হিফাস্টাস শহর ত্যাগ করে তাঁর প্রিয় দেশ লেমনস যাবার ভান করলেন। অ্যারেস এসবের কিছুই জানতেন না। তিনি স্বচক্ষে হিফাস্টাসকে প্রাসাদ ত্যাগ করে যেতে দেখে সাইথেরিয়া বা অ্যাফ্রোদিতের প্রতি এক গভীর প্রেমাবেগের বশবর্তী হয়ে তাঁদের প্রাসাদে চলে গেলেন। অ্যাফ্রোদিতে সেইমাত্র পিতৃগৃহ হতে এসে বসেছিলেন তাঁর ঘরে।
অ্যারেস সোজা তার কাছে গিয়ে বললেন, হিফাস্টাস এখন নেই, চল আমরা শয়ন মন্দিরে গিয়ে রতিক্রিয়ায় মত্ত হই। সে তার সিন্থিয়ানিবাসী বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য লেমনস গেছে। তার প্রণয়ী অ্যারেসের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে এক নিবিড় রতিসুখসার উপভোগ করতে বড় ভালবাসতেন অ্যাফ্রোদিতে। সুতরাং তারা দুজনেই রতিমন্দিরে গিয়ে শয়ন করলেন পরস্পরের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে।
কিন্তু তারা শয়ন করার সঙ্গে সঙ্গে হিফাস্টাসের হাতে পাতা সেই অদৃশ্য শৃঙ্খলজালে এমনভাবে আবদ্ধ হয়ে গেলেন যে হাত পা পর্যন্ত নাড়তে পারলেন না তাঁদের কেউ, পালিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা। কিছুক্ষণের মধ্যে খঞ্জ দেবতা হিফাস্টাস এসে আবির্ভূত হলেন তাদের সামনে। সূর্য তার গুপ্তচর হিসেবে কাজ করছিল এবং সূর্য তাকে এই ঘটনার কথা জানাতেই তিনি লেমনস দ্বীপে না গিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসেন মুখে নিদারুণ এক উদ্বেগ নিয়ে। সেই ঘরের মাঝখানে স্বচক্ষে এক কাণ্ড দেখে এক প্রচণ্ড ক্রোধে আগুন হয়ে এমন জোরে চিৎকার করে উঠলেন তিনি যাতে দেবতারাও তা শুনতে পান। হিফাস্টাস বলতে লাগলেন, হে পরম পিতা জিয়াস ও অন্যান্য দেবতাগণ, এখানে স্বয়ং এসে তোমরা এক মজার অথচ নিষ্ঠুর ব্যাপার দেখে যাও। জিয়াস কন্যা অ্যাফ্রোদিতে আমি খঞ্জ বলে আমাকে ঘৃণা করে এবং সে নরঘাতক অ্যারেসকে তার হৃদয় দান করেছে, কারণ সে সুদর্শন এবং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সবল ও সুগঠিত আর আমি জন্ম হতে খঞ্জ। কিন্তু আমার এই খঞ্জতের জন্য দায়ী কে–আমার পিতা না মাতা? তারা আমার জন্ম না দিলেই ভাল করতেন। কিন্তু তোমরা এসে দেখ এরা দুজনে কেমন গোপনে আমার শয্যায় আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় শুয়ে আছে। এ দৃশ্য আমাকে ভীষণভাবে বিচলিত করে তুলেছে। কিন্তু আমি এমন এক পরিকল্পনা করেছি যাতে ওরা ওদের এই আলিঙ্গনকে দীর্ঘায়িত করার কোন আগ্রহ আর অনুভব করবে না। এদের সমস্ত প্রেমানুভূতি সত্ত্বেও ওরা আর আলিঙ্গন করতে পারবে না পরস্পরকে। ওরা এমন এক সুদীর্ঘ নিদ্রায় অভিভুত হয়ে পড়বে যাতে ওরা নিজেরাই ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে উঠবে। কিন্তু আমি ওদের ঠিক এইভাবে ততক্ষণ আবদ্ধ করে রেখে দেব যতক্ষণ পর্যন্ত না এই মেয়েটাকে বিবাহ করার জন্য ওর পিতাকে যা যা উপহার দিয়েছি তা আমাকে ফিরিয়ে দেয়। মেয়েটা সুন্দরী এবং জিয়াসের কন্যা হতে পারে, কিন্তু বড় রিপুর বশীভূত।
হিফাস্টাসের চিৎকার শুনে দেবতারা সকলে এসে প্রাসাদ মধ্যস্থিত শয়নকক্ষের দ্বারদেশে সমবেত হলেন। সেইসব দেবতাদের মধ্যে ছিলেন পসেডন, হার্মিস ও অ্যাপোলো। কিন্তু নারীসুলভ লজ্জার বশবর্তী হয়ে দেবীরা কেউ আসেন নি। সেই দ্বারদেশের সম্মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন দেবতারা। তারা যখন হিফাস্টাসের পাতা ফাঁদটি স্বচক্ষে দেখলেন তখন তারা এক অদম্য হাসির বেগকে চেপে রেখে দিতে পারলেন না কিছুতেই।
দেবতাদের মধ্যে একজন তার পার্শ্ববর্তী আর একজনকে বললেন, খারাপ কাজের ফল কখনো ভাল হয় না। শ্লথগতি কচ্ছপও অনেক সময় দ্রুতগতি খরগোসকে ধরে ফেলে। যে অ্যারেসের মত দ্রুত অন্য কোন দেবতা দৌড়তে পারে না সেই অ্যারেসকে মন্দগতি খঞ্জ হিসফাস্টাস ধরে ফেললে। হিফাস্টাস খঞ্জ হতে পারে, কিন্তু সে কৌশলে জয়ী হয়েছে এ ব্যাপারে। ব্যভিচার করার অপরাধে অ্যারেসকে অবশ্যই জরিমানা দিতে হবে।
অ্যাপোলো তখন অ্যারেসকে বললেন, আচ্ছা অ্যারেস, তুমি কি লৌহশৃঙ্খলে এইভাবে আবদ্ধ হয়েও অ্যাফ্রোদিতের পাশে শুয়ে থাকতে চাও?
এর উত্তরে অ্যারেস বললেন, এ্যাপোলো, এর থেকে আনন্দদায়ক ও কাম্য আর কিছুই হতে পারে না আমার কাছে। যে শৃংখল আমাকে আবদ্ধ করে রেখেছে সে শৃংখল যদি আরও তিনগুণ শক্ত হয় এবং যদি তোমরা সকল দেবদেবী আমার পানে তাকিয়ে থাক এইভাবে তা হলেও আমি সুবর্ণবরণী অ্যাফ্রোদিতের পাশে আনন্দে নিদ্রা যাব।
একমাত্র পসেডন ছাড়া আর সব দেবতাই এ কথায় হেসে উঠলেন। একমাত্র পসেডন এতে কৌতুক অনুভব করলেন না; তিনি শুধু হিফাস্টাসকে বারবার অনুরোধ করতে লাগলেন অ্যারেসকে ছেড়ে দেবার জন্য। তিনি বললেন, ওকে ছেড়ে দাও। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, অ্যারেস নিজ দেবতাদের সামনে তোমার কথামত যথাযথভাবে প্রায়শ্চিত্ত করবে।
মহান খঞ্জ দেবতা হিফাস্টাস উত্তর করলেন, পসেডন, তুমি আমাকে এ অনুরোধ করো না। এই কাপুরুষদের দরুন কোন জামীন নেওয়াটা লজ্জার কথা। অ্যারেস যদি মুক্ত হয়ে তার ঋণ শোধ না করে তাহলে কেমন করে আমি তোমাকে আর পাঁচজনের সামনে ধরব?
পসেডন তখন বললেন, অ্যারেস যদি তোমার ঋণ শোধ না করেই পালিয়ে যায় আমি তাহলে তোমাকে তার জন্য জরিমানা দেব।
হিফাস্টাস বললেন তুমি যদি একথা বল তাহলে আমি আর ‘না’ বলতে পারি না।
এই কথা বলে হিফাস্টাস ওঁদের বাঁধন খুলে দিতেই ওঁরা দুজনে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলেন ঘর হতে। অ্যারেস গেলেন ফ্রেম আর অ্যাফ্রোদিতে গেলেন সাইপ্রাসের প্যাকসে। সেখানে সতত অগুরু ও চন্দনসুবাসিত এক নির্জন কুঞ্জবন ছিল। সেখানে তিনি যাবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সখীরা তাকে ভাল মন্ত্রঃপূত তেল মাখিয়ে স্নান করিয়ে দিল। তারপর তাঁকে বেশভূষায় সজ্জিত করে তুললে আবার তিনি মনোহারিণী হয়ে উঠলেন।
এই কাহিনীটি চারণকবি ডেমোডোকাস গানের মধ্য দিয়ে বিবৃত করলেন। সে গান, সে কাহিনী শুনে ওডিসিয়াস ও অন্যান্য ফেসীয় নেতারা মুগ্ধ হয়ে গেলেন। এ গান শেষ হলে গেলে অ্যালসিনোয়াস হেলিয়াস ও লাওডামাসকে নৃত্য করতে অনুরোধ করলেন। নৃত্যশিল্পে তাদের কোন সমকক্ষ নেই। সুদক্ষ কারিগর পলিথান একটি নীল রঙের বল তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেই বলটি তাদের একজন নিয়ে ছুঁড়ে দিল মেঘের পানে আর একজন লাফিয়ে মাটিতে পা দিয়ে সেই বলটি ধরার চেষ্টা করতে লাগল। এই খেলাটি দেখানোর পর তারা বলটি তাড়াতাড়ি নাচাতে লাগল আর নিজেরাও তার তালে তালে নাচতে লাগল। অন্যান্য যুবকরা পাশে দাঁড়িয়ে তাল দিতে লাগল। এক ছন্দোময় ধ্বনি পরিপূর্ণ হয়ে উঠল ঘরের বাতাস। মুগ্ধ ওডিসিয়াস উঠে দাঁড়িয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন। তিনি বললেন, হে রাজন অ্যালসিনোয়াস, আপনি আপনাদের নৃত্যশিল্পের জন্য গর্ব অনুভব করেছিলেন। আপনার দাবি যথার্থ। আমি সে নৃত্য দর্শন। করে বিস্মিত হয়ে পড়েছি।
ওডিসিয়াসর মুখ থেকে এই প্রশংসাবাক্য শুনে অ্যালসিনোয়াস দর্শকদের উদ্দেশ্যে বললেন, শুনুন ফেসিয়ার বয়োপ্রবীণ ব্যক্তিগণ ও রাজন্যবর্গ, আমি বুঝেছি আমাদের এই বিশিষ্ট অতিথি একজন গুণবান ব্যক্তি। বন্ধু হিসেবে ওঁকে কিছু উপহার দান করা উচিত আমাদের। আমাদের এই সারা দেশের মধ্যে আমাকে নিয়ে তেরজন রাজা আছে। আমার প্রস্তাব এই যে আমাদের প্রত্যেকেই একটা করে উত্তম পোশাক ও একটি করে স্বর্ণমুদ্রা দান করব আমাদের এই অতিথিকে। তবে আমাদের তরফ থেকে যা দেবার তাড়াতাড়ি দিতে হবে। কারণ উনি যা পাবার তা যেন ওর নৈশভোজনের আগেই পেয়ে গিয়ে শান্তিতে ভোজন করতে পারেন। ইউরিয়ানাস ব্যক্তিগতভাবে তাঁর কাছে ক্ষমা চাইবে এবং তার প্রকাশ্য অভদ্রতার জন্য পৃথকভাবে কিছু উপহার দেবে।
রাজা অ্যালসিনোয়াসের প্রস্তাবে সকলেই সম্মত হলো। সকলেই দূত মারফৎ শীঘ্রই তাদের উপহার পাঠিয়ে দিল। ইউরিয়ানাস তাঁর পিতার ভসনাবাক্যের উত্তরে বলল, হে রাজন, আমি আপনার বিধান মেনে নিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে সম্মত। গজদন্ত নির্মিত কোষসহ রৌপ্যনির্মিত হাতলবিশিষ্ট আমার এই ব্রোঞ্জের তরবারিটি উপহার দিতে চাই এই মাননীয় অতিথিকে। আশা করি এটির মূল্য উনি বুঝবেন।
ইউরিয়ানাস তার তরবারিটি ওডিসিয়াসের হাতে দিয়ে বলল, সে পিতৃপ্রতিম বিদেশী, আমি আপনাকে অভিবাদন জানাই। যদি কোন অশোভন আচরণ ও অভদ্রোচিত বাক্য আমার মুখ হতে নিঃসৃত হয়ে থাকে, তাহলে তা যেন বাতাস এসে উড়িয়ে নিয়ে যায়। ঈশ্বর যেন আপনাকে গৃহে প্রত্যাবর্তনের আনন্দ দান করেন, কারণ দীর্ঘদিন গৃহ ছাড়া। পুত্র পরিবার হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুঃখময় জীবন যাপন করছেন।
তার উত্তরে ওডিসিয়াস বললেন, আমার নিকট হতে তুমি এ অভিবাদনের প্রতিদান গ্রহণ করো। ঈশ্বরের আশীর্বাদ নেমে আসুক তোমার মস্তকে। শ্রদ্ধার সঙ্গে যে তরবারি আমাকে তুমি দান করলে তা তোমারই থাকবে। এই কথা বলে ওডিসিয়াস সেই তরবারিটি তার কাঁধ হতে নিয়ে তাকে দিয়ে দিলেন।
সূর্যাস্তের আগেই সকলের কাছ থেকে সব উপহার পেয়ে গেলেন ওডিসিয়াস। প্রহরী ও দূতরা সেসব উপহার বহন করে এনে অ্যালসিনোয়াসের প্রাসাদে রেখেছিল রাজপুত্রগণ সেসব মূল্যবান উপহারগুলো তাদের মার কাছে এনে জমা করছিল। অ্যালসিনোয়াস এবার একটি উচ্চ আসনে উপবিষ্ট হয়ে রাণী এ্যারিতেকে বললেন, প্রিয়তমা এ্যারিতে আমাদের প্রাসাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম পোশাক ও একটি দেহবন্ধনী এনে দাও। তারপর আগুনে একটি তাম্রখণ্ড পুড়িয়ে তোলার ব্যবস্থা করো। অতিথির জন্য কিছু জল গরম করতে বল। সেই জলে স্নান করে উনি সব উপহারগুলো গুছিয়ে বাঁধা অবস্থায় দেখে নৈশ ভোজন করতে করতে চারণকবির মধুর সঙ্গীত উপভোগ করবেন। দেখ, আমি আমার পানপাত্রটি ওকে উপহার দেব যাতে উনি দেবরাজ জিয়াস ও অন্যান্য দেবতাদের উদ্দেশ্যে ও পাত্রদ্বারা মদের অঞ্জলি দান করতে পারেন।
রাণী এ্যারিতের নির্দেশে দাসীগণ একটি বিরাট পাত্রে জল গরম করতে লাগল ওডিসিয়াসের জন্য। ইত্যবসরে এ্যারিতে তাঁর ঘরে গিয়ে একটি বাক্স এনে তাতে ওডিসিয়াসের সব উপহার ও স্বর্ণমুদ্রা গুছিয়ে ভরে রেখে দিলেন। তারপর তাঁকে বললেন, আপনি নিজে এই বাক্সের ঢাকনাটি বন্ধ করে চাবি দিয়ে দিন। তা নাহলে জাহাজে করে সমুদ্রপথে যাবার সময় আপনি ঘুমিয়ে গেলে বাক্সটি চুরি হয়ে যেতে পারে।
তার পরামর্শমত ওডিসিয়াসের বাক্সের ঢাকনাটি নিজের হাতে বন্ধ করে দিয়ে এমনভাবে চাবি দিয়ে দিলেন যাতে তিনি ছাড়া অন্য কেউ আর খুলতে না পারে। এইভাবে তালা দেওয়া সে এক যাদুকরীর কাছে শিক্ষা করেছিল। এ কাজ তার হয়ে গেলে স্নান করাটা সত্যিই আরামের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে তাঁর কাছে। এ আরাম ক্যালিপসের সেই গুহা ত্যাগ করার পর থেকে আর কখনো পান নি তিনি। ওখানে থাকাকালে তিনি দেবতার মত যত্ন ও খাতির পেতেন। অতিথিসেবার জন্য নিয়োজিত প্রাসাদের দাসীরা তার গায়ে তৈল মর্দন করার পর তাঁকে স্নান করালে পর তাদের দেওয়া পোশাক করে ভোজসভায় চলে গেলেন ওডিসিয়াস।
এদিকে দেবদত্ত এক অলৌকিক সৌন্দর্যে বিভূষিতা নৌসিকাও ওডিসিয়াসের ভোজসভায় যাবার পথে একটি স্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়েছিল। ওডিসিয়াসকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পানে চোখ মেলে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তাকাল সে। বলল, আপনার সৌভাগ্য কামনা করি হে বন্ধু। আশা করি, আপনি যখন আপনার গৃহে প্রত্যাবর্তন করবেন তখন আমার কথাটা মনে রাখবেন, কারণ আমিই আপনার জীবন প্রথমে রক্ষা করি।
ওডিসিয়াস উত্তর করলেন, হে রাজকুমারী নৌসিকা, সর্বপ্রথমে আমি দেবরাজ জিয়াসের কাছে নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের জন্য কামনা করব, সেদিন যাতে আমার শীঘ্রই আসে। কিন্তু সেদিন যদি আমার সত্যিই আসে তাহলে আমি দেশে ফিরে গিয়ে তোমার কথা কখনো ভুলব না, কারণ তুমিই প্রথম আমার জীবন বাঁচাও।
এই কথা বলে ভোজসভায় গিয়ে রাজা অ্যালসিনোয়াসের পাশে একটি আসনে উপবেশন করলেন ওডিসিয়াস। তখন অতিথিদের আহার্য ও পানীয় বস্তু পরিবেশন করা হচ্ছিল। জনৈক দূত চারণকবি ডেমোডোকাসকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এল। ওডিসিয়াস চর্বিওয়ালা একখণ্ড শূকরমাংস কেটে একজন ভুত্যের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিলেন ডেমোডোকাসের কাছে। তিনি সেই পরিবেশনকারী ভৃত্যকে বললেন, আমার বিষাদগ্রস্ত আত্মার পক্ষ থেকে যে এই মাংসখণ্ড আমার শুচ্ছেচ্ছাসহ দেবে তাকে। পৃথিবীতে এমন কোন মানুষ যে কোন চারণকবিকে শ্রদ্ধা বা সম্মান না করে, কারণ কলাবিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী মিউজ চারণকবিদের স্নেহের চোখে দেখেন থাকেন।
পরিবেশক ওডিসিয়াসের হাত থেকে মাংস নিয়ে ডেমোডোকাসের হাতে দিয়ে দিল। ডেমোড়োকাসও আনন্দের সঙ্গে সে দান গ্রহণ করলেন। ভোজসভার সদস্যগণ এবার পানাহারে মন দিলেন। এইভাব তারা সম্পূর্ণরূপে তৃপ্ত হলে পর ওডিসিয়াস চারণকবিকে সম্বোধন করে বললেন, ডেমোডোকাস, আমি আপনার ভূয়সী প্রশংসা করছি। হয়ত জিয়াসকন্যা মিউজ অথবা অ্যাপোলোর কাছ থেকে আপনি এই সঙ্গীতবিদ্যায় প্রশিক্ষণ লাভ করেছেন। আপনি যেভাবে আপনার সঙ্গীতের মাধ্যমে ট্রয়যুদ্ধে গ্রীকদের দুর্ভাগ্য, দুঃখ, কষ্টভোগ ও তাদের কৃতিত্বের কাহিনী ব্যক্ত করেছেন। তা সত্যই অপূর্ব। আপনার কাহিনী শুনে মনে হচ্ছে আপনি যেন তাদের মধ্যে ছিলেন অথবা এমন একজনের কাছে থেকে শুনেছেন যিনি গ্রীকদের মাঝে ছিলেন। এখন আমার অনুরোধ, আপনি আপনার এই বিষয়বস্তুর পরিবর্তন করে সেই কাষ্ঠনির্মিত অশ্বের কথা বলুন। এই অশ্বটি এপিয়াস নির্মাণ করে এবং আমার প্রভু ওডিসিয়াস ট্রয়নগরী ধ্বংস করার জন্য ট্রয়নগরীতে এই অশ্বটি স্থাপন করার প্রয়াস পান। তিনি চেয়েছিলেন এই বিশাল কৃত্রিম অশ্বটির মাঝে এমন সব বড় বড় যোদ্ধারা লুকিয়ে থাকবে যারা ট্রয়নগরী ধ্বংস করবে। যদি আপনি এ কাহিনী সার্থকভাবে বিবৃত করতে পারেন তাহলে আমি মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করব ঈশ্বর আপনাকে অকৃপণ হস্তে অনন্ত সঙ্গীত প্রতিভার দ্বারা বিভূষিত করেছেন।
ওডিসিয়াসের সূত্র ধরে দেবতার বন্দনা করে সে কাহিনী বলতে শুরু করলেন চারণকবি ডেমোডোকাস। তিনি সেখান থেকে কাহিনী শুরু করলেন যেখানে গ্রীকরা তাদের শিবিরে অগ্নিসংযোগ করার পর জাহাজে করে রওনা হবার উপক্রম করেছে আর ওদিকে ট্রয়বাসীদের দ্বারা আনীত ও ট্রয়নগরীর মধ্যে স্থাপিত সেই অশ্বটির মধ্যে ওডিসিয়াস ও কয়েকজন গ্রীকবীর লুকিয়ে বসেছিলেন। সেই অশ্বটির চারপাশে বৃত্তাকারে বসে ট্রয়বীরেরা তখন আলোচনা করছিল নিজেদের মধ্যে। সেই আলোচনা হতে তিনটি মতের উদ্ভব হলো। একজন বলল, সেই কাষ্ঠনির্মিত আশ্চর্য বিশাল অশ্বটিকে বর্শা ও বল্লম দ্বারা বিদ্ধ করে নষ্ট করে ফেলা হোক। আর একজন বলল, কোন উঁচু পাহাড়ের মাথায় নিয়ে গিয়ে সে অশ্বটিকে ফেলে দেওয়া হোক। আর একজন বলল, এই অশ্বটি দেবতাদের প্রীত করার জন্য নগরমধ্যেই স্থাপিত থাকবে। এই তৃতীয় মতটিই প্রাধান্য লাভ করল শেষে। এটা ছিল বিধিনির্দিষ্ট ব্যাপার। যেদিন সেই কাষ্ঠঅশ্বটি ট্রয়নগরীর প্রাচীরের মধ্যে আনীত হয় সেইদিনই ট্রয়বাসীদের পতন হয়ে ওঠে অনিবার্য, কারণ সুনির্বাচিত বহু গ্রীকবীর সেই অশ্বের গর্ভে লুক্কায়িত ছিল। সঙ্গীতের মাধ্যমে বলতে লাগলেন ডেমোডোকাস, কিভাবে গ্রীকবীরেরা সহসা সেই অশ্বগর্ভ হতে বার হয়ে ট্রয়নগরীর পথে পথে ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা চালিয়ে যেতে লাগল। ওডিসিয়াস মেনেলাসকে সঙ্গে নিয়ে রণদেবতা অ্যারেসের মত দীফোবাসের ঘরে গিয়ে মেতে ওঠে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধে এবং এ যুদ্ধে দেবী এথেনের কাছ থেকে পাচ্ছিলেন প্রভূত সাহায্য।
পূতসিদ্ধ চারণকবি ডেমোড়োকাস যখন এইভাবে গ্রীকদের গৌরবগাথা শোনাচ্ছিলেন তখন চাপা কান্নায় ভেঙে পড়লেন ওডিসিয়াস। তাঁর দুটি চক্ষু হতে নির্গত অশ্রুধারায় প্লাবিত হয়ে উঠেছিল তাঁর গণ্ডদ্বয়। তাঁর প্রিয়তম স্বামী আপন নগর ও পুত্র পরিবার রক্ষা করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে প্রাণপণ যুদ্ধ করে প্রাণ দিলে তার দেহটিকে বাহুবদ্ধ করে যেমন কোন নারী আকুলভাবে ক্রন্দন করতে থাকে এবং উদ্ধত বর্শা উঁচিয়ে তাকে দাসত্বে বশীভূত করলে তার দুঃখ আরো বেড়ে যায় ও তার অশ্রুধারা প্রবলতর হয়ে ওঠে, তেমনি প্রবল হতে প্রবলতর হয়ে উঠল ওডিসিয়াসের অশ্রুধারা। কিন্তু সে অশ্রুধারা একমাত্র রাজা অ্যালসিনোয়াস ছাড়া আর কেউ দেখতে পেল না। কারণ ওডিসিয়াস বসেছিলেন অ্যালসিনোয়াসের পাশে এবং তার ফলে তাঁর চাপা আর্তনাদ ও ক্রন্দনধ্বনি সব শুনতে পাচ্ছিলেন রাজা অ্যালসিনোয়াস।
অ্যালসিলোয়াস এবার ফেসীয় দলপতিদের সম্বোধন করে বলতে লাগলেন, অনুগ্রহ পূর্বক আপনারা শান্ত হোন। এবার স্তব্ধ হোক ডেমোড়োকাসের সঙ্গীত, কারণ উপস্থিত সকলের নিকট শ্রুতিমধুর ঠেকছে না তার সঙ্গীত। আমাদের নৈশভোজনের পর চারণ কবির সঙ্গীত শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এই মাননীয় অতিথি অবিরাম অশ্রু বিসর্জন করেছেন। হয়ত কোন মর্মস্পর্শী দুঃখের তাড়নায় উদগত হচ্ছে এ অশ্রুর ধারা। সুতরাং যাতে আমরা সকলেই সমানভাবে এ উৎসবের আনন্দ উপভোগ করতে পারি তার জন্য চারণকবি গান থামান। আজ আমরা এই সুযোগ্য অতিথির সম্মানার্থেই এই ভোজসভার আয়োজন করেছি এবং তাঁকে এসব আন্তরিকতাপূর্ণ উপহার প্রদান করেছি। যাদের কিছুমাত্র বুদ্ধি আছে তারা সবাই জানে যে বিদেশী অতিথিদের ভাই এর মত দেখতে হয়।
হে মহাশয়, আমি আপনাকেও আমাদের মত বন্ধুভাবাপন্ন হবার জন্য অনুরোধ করছি। আপনি দয়া করে আমার প্রশ্নগুলোর সদুত্তর দান করুন। আপনি সরলভাবে এসব প্রশ্নের উত্তর দান করলে আপনার সৌজন্য প্রকাশ পাবে। আপনি আপনার পরিবারে ও সমাজে যে নামে অভিহিত হতেন সে নাম ব্যক্ত করুন। এই পৃথিবীতে আসার পর থেকে যেকোন মানুষ তার পিতামাতার নামের দ্বারা পরিচিত হয়। আপনি কোন দেশ থেকে আসছেন, আপনি কোন রাজ্যের লোক তা আমাকে বলুন, তাহলে আমাদের নাবিকরা কোন পথে জাহাজ চালনা করবে তা আগে হতে ঠিক করবে। আমাদের জাহাজগুলো জড়পদার্থ হলেও তাদের এমন এক ক্ষমতা আছে যার ফলে তারা নাবিকদের মনোভাব বুঝতে পারে। তারা কোথায় কোন নগর বা উর্বর দেশ আছে তা জানতে পারে এবং কোন বিপদের সম্মুখীন না হয়েই তারা মেঘ ও কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে অনন্ত সমুদ্র নির্বিঘ্নে অতিক্রম করতে পারে। এই প্রসঙ্গে আমি একটি সতর্কবাণী সম্পর্কেও অবহিত করছি আপনাকে।
আমার পিতা নৌসিদোয়াস বলতেন, আমরা সকল বিদেশীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করি বলে পসেডন আমাদের উপর রাগ করেন। আমার পিতা এই বলে এক ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, আমাদের একটি জাহাজ যখন বিদেশ থেকে প্রত্যাবর্তন করবে তখন জলদেবতা পসেডন অনেকগুলো জাহাজের মধ্যে সেই জাহাজটিকে ধ্বংস করবেন এবং আমাদের নগরটিকে এক বিশাল পর্বত দ্বারা আচ্ছন্ন করে রাখবেন। বৃদ্ধ রাজা প্রায়ই বলতেন এবং দেবতা তাঁর ইচ্ছান্যয়ী অবশ্যই কাজ করেন।
এখন আমি আপনাকে অনুরোধ করছি আপনি আপনার সমগ্র ভ্রমণবৃত্তান্ত বর্ণনা করুন। পৃথিবীর কোন অঞ্চলে আপনি গিয়ে পড়েছিলেন, কোন কোন সুন্দর নগরী আপনি দর্শন করেছেন, কোন শ্রেণীর লোক সেখানে বাস করে? আপনি কি কোন বর্বর বন্য আদিবাসী বা উপজাতিদের কবলে পড়েছিলেন অথবা কোন সভ্য বা ধর্মভীরু জাতির আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন? গ্রীক ও ট্রয়যুদ্ধের সকরুণ কাহিনী শোনার সঙ্গে সঙ্গে কোন সে গোপন দুঃখের আঘাতে অশ্রুপাত করেছেন তা ব্যক্ত করুন। কোন এক বিরাট জাতীয় বিপর্যয়ের ঘটনাকে ভবিষ্যৎ কালে মানুষের জন্য এক অক্ষত আখ্যানকাব্য ও সঙ্গীতের বিষয়বস্তুতে পরিণত করে তোলার জন্য দেবতারাই কি দায়ী নন? হয়ত আপনার কোন জামাতা বা শ্বশুর অথবা কোন অন্তরঙ্গ সহকর্মীর মৃত্যু ঘটেছে ট্রয়যুদ্ধে।