০৮. ফেরাউনদের ইতিহাসের নিরিখ

ফেরাউনদের ইতিহাসের নিরিখ

বস্তুতপক্ষে, ফেরাউনদের ইতিহাস থেকে ইহুদীদের মিসরত্যাগের সঠিক বিবরণ লাভের সম্ভাবনা সমধিক। একটি ধারণা দীর্ঘকাল যাবত প্রচলিত রয়েছে যে, ইহুদীরা যখন মিসর ত্যাগ করেছিল, তখন যে ফেরাউন মিসরে রাজত্ব করতেন, তার আসল নাম ছিল মারনেপতাহ। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় রামেসিসের উত্তরাধিকারী। খ্যাতনামা মিসরতত্ত্ববিদ মিঃ মাসপেরো চলতি শতকের গোড়ার দিকে তার ‘ভিজিটর্স গাইড টু দি কায়রো মিউজিয়াম’ পুস্তকে (প্রকাশ ১৯০০ খ্রিঃ) বলেন, “আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রচলিত কাহিনী অনুসারে ইহুদীদের মিসরত্যাগকালে যে ফেরাউন মিসরে রাজত্ব করতেন, তিনি হচ্ছেন খুব সম্ভব মারনেপতাহহ। বলা হয়ে থাকে, তিনি ওই ঘটনায় লোহিত সাগরে ডুবে মারা গিয়েছিলেন।” মিঃ মাসপেরো কোন দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে যে এই অভিমত সাব্যস্ত করে গেছেন, অনেক চেষ্টা-চরিত্র করেও ড. মরিস বুকাইলি তা উদ্ধার করতে পারেননি। কিন্তু, তার মত সুপ্রসিদ্ধ ভাষ্যকারের এই অভিমত, এই গবেষণার বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্বের দাবিদার হয়ে রয়েছে।

পি. মতেঁ ছাড়া খুব কমসংখ্যক মিসরীয়বিদ ও বাইবেল বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, যারা মিঃ মাসপেয়োর উল্লিখিত বক্তব্যের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে গবেষণা চালিয়েছেন। এদিকে গত কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন গবেষকের মধ্যে ধর্মগ্রন্থের যে-কোনো বক্তব্যকে সত্য বলে সাব্যস্ত করতে গিয়ে বিভিন্ন ধারণা গড়ে তোলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে এও লক্ষণীয় যে, ওইসব গবেষক-উদ্ভাবক একইসঙ্গে ধর্মগ্রন্থের অন্যদিক বা ভিন্ন বক্তব্যের ব্যাপারে মোটেও গা-গরজ করেননি। এরফলে, এই দাঁড়াচ্ছে যে, এ ধরনের উদ্ভাবিত একটি ধারণা, উপস্থিতক্ষেত্রে ধর্মগ্রন্থের কোনো একটি বক্তব্যকে হয়তো বা সাব্যস্ত করছে কিংবা সমর্থনও দিতে পারছে। কিন্তু কথা হল, ধর্মীয়-গ্রন্থে (এবং শুধু বাইবেলই একমাত্র ধর্মগ্রন্থ নয়) আরো তো অনেক তথ্য-পরিসংখ্যান রয়েছে। তাছাড়াও, রয়েছে ইতিহাসের তথ্য, স্থাপত্য, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ইত্যাদি।

যাহোক, এ সম্পর্কে এইরকম অদ্ভুত একটা ধারণা গড়ে তুলেছেন জে. দ্য মিসেলি (১৯৬০)। তাঁর এই নবউদ্ভাবিত তত্ত্ব–তাঁর নিজস্ব ধারণা মোতাবেক, সুদৃঢ় ভিত্তির উপরেই নাকি প্রতিষ্ঠিত। অবশ্য মিঃ মিসেলির উদ্ভাবিত এই তত্ত্ব সম্পর্কে এ পর্যন্ত তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। মিসেলি দাবি করেছেন, তিনি ইহুদীদের মিসরত্যাগের সঠিক দিন-তারিখ পেয়ে গেছেন; তারিখটা হচ্ছে খ্রিস্টপূর্ব ১৪৯৫ অব্দের ৯ই এপ্রিল। ক্যালেন্ডার ও দিনপঞ্জির উপর ভিত্তি করেই নাকি মিসেলি এই দিন-তারিখ নির্ণয় করেছেন। তিনি এও দাবি করেছেন যে, মিসরে তখন রাজত্ব করছিলেন দ্বিতীয় টুথমোসিস। সুতরাং, এই দ্বিতীয় টুথমোসিসই হচ্ছেন ইহুদীদের মিসরত্যাগের সাথে সংশ্লিষ্ট সেই ফেরাউন। উল্লেখ্য, মিঃ মিসেলির এই তত্ত্ব গড়ে উঠেছে মিসর অধিপতি দ্বিতীয় টুথমোসিস, এর মমি পরীক্ষার ফলাফলের উপর। এই মমি-পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, দ্বিতীয় টুথমোসিস-এর চামড়ায় ছিল ক্ষতচিহ্ন। উক্ত ভাষ্যকার (কেন, তার কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই) আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন যে, চামড়ার এই ক্ষতচিহ্নের কারণ হল কুষ্ঠরোগ। ভাষ্যকারের অভিমত, বাইবেলে মিসরবাসীদের উপর ফোঁড়ার যে গজব নাজিল হয়েছিল, তা সেই কুষ্ঠরোগ ছাড়া আর কিছু নয়।

কিন্তু এই কষ্ট-কল্পনাকালে উক্ত ভাষ্যকার বাইবেলের আর কোনো বর্ণনার প্রতিই তেমন কোনো গুরুত্ব দেননি। অথচ, এই বাইবেলেই রয়েছে ইহুদীদের রামেসিস নগরী নির্মাণের কথা। এর অর্থ একটিই যে, মিসরে তখন বা তার আগে রামেসিস বা রামেসিস নামে কোনো অধিপতি ছিলেন এবং ইহুদীদের মিসরত্যাগের ঘটনা সেই রামেসিসের রাজত্বের পূর্বের ঘটনা হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। অথচ, মিসরে টুথমোসিস বংশের রাজত্বকাল হচ্ছে রামেসিস-এর পূর্ববর্তী।

আর মমির চামড়ার ক্ষতের কথাই যদি বলা হয়, তা হলেও কিন্তু দ্বিতীয় টুথমোসিস ইহুদীদের মিসর ত্যাগকালীন ফেরাউন হতে পারেন না। কেননা, দ্বিতীয় টুথমোসিসের পুত্র তৃতীয় টুথমোসিস এবং পৌত্র দ্বিতীয় আমেনোফিসের মমির চামড়ায়ও একই ধরনের ক্ষতচিহ্ন বিদ্যমান। মিসরের যাদুঘরে এদের তিনজনেরই মমি সংরক্ষিত রয়েছে। সেসব মমি পরীক্ষা করলেই দেখা যাবে, তাঁদের তিনজনের চামড়াতেই রয়েছে ফোঁড়ার দাগ।

ঠিক একই যুক্তিতে এর আগেকার আরেকটি ধারণাও নস্যাৎ হয়ে যায়। এই ধারণা বা অনুমানকারী হচ্ছেন ড্যানিয়েল রপস্। তার “দি পিপল অব দি বাইবেল’ (প্যারিস, ১৯৭০) পুস্তকের অভিমত হল, দ্বিতীয় আমেনোফিসই ছিলেন ইহুদীদের মিসরত্যাগের সময়কার ফেরাউন। বলাবাহুল্য, এই ধারণাও পূর্বোক্ত ধারণার মতই ভিত্তিহীন। যাহোক, পূর্বোক্ত পুস্তকে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় আমেনোফিস-এর পিতা (দ্বিতীয় টুথমোসিস) ছিলেন যারপরনাই জাতীয়তাবাদী চেতনাসম্পন্ন শাসক। তিনিই ইহুদীদের উপরে নির্যাতন চালাতেন বলে ড্যানিয়েল রপস্ দাবি তুলেছিলেন। তিনি আরো বলেছেন, এই আমেনোফিস এর সত্য সুপ্রসিদ্ধ রানী হাটশেপসুট। রফস্-এর মতে, এই রানী সত্যা-ই হযরত মুসার সাথে প্রতারণা করেছিলেন কিন্তু কেন? তার উত্তর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।

এদিকে, ফাদার ডি ভক্স-এর অভিমত, দ্বিতীয় রামেসিসই ছিলেন ইহুদীদের মিসরত্যাগকালীন ফেরাউন অর্থাৎ মিসরের অধিপতি। তাঁর এই কল্পনার ভিত কিছুটা শক্ত বটে। দি এনসিয়েন্ট হিস্ট্রি অব ইসরাইল’ পুস্তকে (প্যারিস, ১৯৭১) তিনি তার এই অনুমানের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যদিও তাঁর এই অনুমান খোদ বাইবেলের বর্ণনার সাথেই মিলে না তবুও দেখা যায়, তিনি অন্তত একটা বিষয়ে স্বীকৃতি দিচ্ছেন যে, দ্বিতীয় রামেসিসের আমলে তার দ্বারাই রামোসিস ও পিথম’ নগরীদ্বয় নির্মিত হয়েছিল। বাইবেলে এই দুটি নগরী নির্মাণের কথা আছে। এরদ্বারা অবশ্য এ কথাও প্রমাণ হয় যে, দ্বিতীয় রামেসিস-এর আগে এই দুটি নগরী নির্মিত হতে পারে না। এই দুটি নগরীর নির্মাণকাল হচ্ছে ড্রাইটন এবং ভ্যানডিয়ারের ক্রনোলজি অনুসারে খ্রিস্টপূর্ব ১৩০১ অব্দ; আর রাওটানের বিবরণ অনুসারে খ্রিস্টপূর্ব ১২৯০ অব্দ। কিন্তু এই দুই ভাষ্যকারের উভয় অনুমান থোপে টিকছে না শুধু একটি কারণে যে বাইবেলের বর্ণনামতে–দ্বিতীয় রামেসিস ছিলেন সেই ফেরাউন যাঁর রাজত্বকালে মিসরে ইহুদীদের উপর নিদারুণ অত্যাচার চালানো হত।

ফাদার ডি ভক্স মনে করেন, ইহুদীদের মিসরত্যাগের ঘটনা ঘটেছিল দ্বিতীয় রামেসিস-এর রাজত্বের প্রথম অধভাগে কিংবা মধ্যভাগে। কিন্তু, তা হলেও ইহুদীদের মিসরত্যাগের সময়কালের হিসেব ঠিক থাকছে না। কারণ, তিনি নিজেই যে সময়কালের মধ্যে হযরত মুসা ও তাঁর অনুসারী ইহুদীদের কেনানে বসতিস্থাপনের কথা বলছেন, এই সময়টা পড়ে তারমধ্যেই। দ্বিতীয় রামেসিসের উত্তরাধিকারী ফেরাউন মারপেতা যিনি পিতার মৃত্যুর পর সীমান্তে শান্তি কায়েম করেছিলেন বলে মনে করা হয়, তিনি কিন্তু বনী ইসরাইলকে মিসরে ফিরিয়ে এনেছিলেন। এ কথাটা তাঁর রাজত্বের পঞ্চমবর্ষে উত্তীর্ণ এক শিলালিপির বর্ণনা থেকে জানা যায়।

সুতরাং, ফাদার ডি ভক্স-এর সিদ্ধান্তের সমান্তরালে দু’টি পাল্টা যুক্তি দাঁড় করা যেতে পারে। যথা :

(ক) বাইবেলে দেখা যাচ্ছে (যাত্রাপুস্তক ২, ২৩) যে, হযরত মুসা যখন মাদিয়ানে তখন মিসররাজ মৃত্যুবরণ করেন। যাত্রাপুস্তকের বর্ণনামতে এই মৃত্যুবরণকারী মিসররাজ হচ্ছেন তিনিই–যিনি জবরদস্তিমূলকভাবে ইহুদী শ্রমিকদের দিয়ে রামেসিস ও পিথম নগরী দুটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। আর এই ফেরাউন যদি দ্বিতীয় রামেসিস হয়ে থাকেন, তা হলে শুধু তার উত্তরাধিকারীর আমলেই ইহুদীদের মিসরত্যাগ সম্ভব হতে পারে। ফাদার ডি ভক্স অবশ্য দাবি করেছেন যে, বাইবেলের যাত্রাপুস্তকের ২নং অধ্যায়ের ২৩ নং বাণীটি সন্দেহযুক্ত। ‘

(খ) এরচেয়েও বিস্ময়কর ব্যাপার, জেরুজালেমের বাইবেল শিক্ষায়তনের ডিরেক্টর ফাদার ডি ভক্স তাঁর থিওরিতে ইহুদীদের মিসরত্যাগকালীন ঘটনার বর্ণনা-সম্বলিত বাইবেলের দুটি অনুচ্ছেদ বেমালুম এড়িয়ে গেছেন। ইহুদীদের পশ্চাদ্ধাবনকালে মিসররাজ যে মারা পড়েন–তার সত্যতা বাইবেলের উক্ত দু’টি অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাষায় উল্লেখ রয়েছে। এ থেকেও বোঝা যায়, প্রথম রাজা বা প্রথম ফেরাউনের মৃত্যুর আগে ইহুদীদের মিসরত্যাগের ঘটনা ঘটতে পারে না। পুনরাবৃত্তি হলেও বলতে হয় যে, ইহুদীদের মিসরত্যাগকালে মিসররাজ সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হন এবং মারা যান। বাইবেলের যাত্রাপুস্তকের ১৩ ও ১৪ নং অধ্যায়ে স্পষ্টভাষায় বলা হয়েছে : “তখন তিনি আপন রথ প্রস্তুত করাইলেন ও আপন লোকদিগকে (ইংরেজি বাইবেলে আর্মি সেনাবাহিনী) সঙ্গে লইলেন … (যাত্রাপুস্তক ১৪, ৬) … (মিসররাজ ফেরাউন) “ইস্রায়েল সন্তানদের পিছু পিছু ধাবমান হইলেন, তখন ইস্রায়েল-সন্তানেরা ঊর্ধ্বহস্তে বহির্গমন করিতেছিল।” (১৪, ৮)… “জল ফিরিয়া আসিল ও তাহাদের রথ ও অশ্বারূঢুদিগকে আচ্ছাদন করিল, তাহাতে ফেরাউনের যে-সকল সৈন্য তাহাদের পশ্চাৎ সমুদ্রে প্রবিষ্ট হয়েছিল তাহাদের একজনও অবশিষ্ট রহিল না।” (যাত্রাপুস্তক ১৪, ২৮ ও ২৯) এইসব বাণী ছাড়াও বাইবেলের গীত-সংহিতা ১৩৬ নং সংগীতেও ফেরাউনের মৃত্যুর ঘটনার সমর্থন রয়েছে। ফেরাউনের মৃত্যুর জন্য বরং ইহুদীরা এখানে প্রশংসা-গান করছে জেহোভার (সদাপ্রভুর) যিনি “ফেরাউন ও তাহার বাহিনীকে সুফ সাগরে ঠেলিয়া দিলেন।” (গীত-সংহিতা ১৩৬, ১৫)

সুতরাং, হযরত মুসার জীবদ্দশাতেই তিনি যখন মাদিয়ানে ছিলেন, তখন এক ফেরাউনের মৃত্যু হয়, এবং অপর ফেরাউন মৃত্যুবরণ করেন ইহুদীদের মিসরত্যাগের সময়। অতএব, একজন নয়, হযরত মুসার আমলে আমরা পাচ্ছি দু’জন ফেরাউন : একজন নির্যাতনের কালের; অন্যজন ইহুদীদের মিসর ত্যাগের সময়কার। সুতরাং, ফাদার ডি ভক্স-এর এক ফেরাউনের (দ্বিতীয় রামেসিস) থিওরি সন্তোষজনক বলে বিবেচিত হতে পারে না। কেননা, তিনি এতদসংক্রান্ত বর্ণনার সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখেননি। এছাড়াও তাঁর থিওরির বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুক্তি পেশ করা যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *