০৮. ফার্মেসীর নাম উপশম

ফার্মেসীর নাম উপশম।

বিশাল হুলুস্থুল কাণ্ডকারখানা। ফার্মেসীর মালিক আলাদা বসেন। কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে হয়। ভদ্রলোকের নাম দেলোয়ার হোসেন। তবে দোকানের কর্মচারীরাও তাকে পল্টু নামেই চেনে। তাহেরের পল্টু সাহেবকে খুঁজে বের করতে দেরী হল না। পলু সাহেবের সামনে চার পাঁচটা চেয়ার। একজন সেই চেয়ারে পা তুলে বসে আছে। পল্টু সাহেব তাহেরকে বসতে বললেন না। চোখ মুখ কুঁচকে চিঠি পড়তে শুরু করলেন এবং প্রবল বেগে পা নাচাতে লাগলেন। মনে হচ্ছে পা নাচানো তার অভ্যাস। তাহেরের মনে হল পুরো চিঠি তিনি দুবার পড়লেন। তারপর তাহেরের দিকে তাকিয়ে বললেন, আরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? বোস বাস। তুমি করে বললাম, কিছু মনে করো ন। পারুল ছিল আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন। যতদূর মনে হয় তাকে তুই করে বলতাম। সেই হিসেবে তোমাকে তুমি বলছি।

অবশ্যই বলবেন স্যার।

আমাকে স্যার বলবে না। পারুল আমাকে পল্টু ভাই ডাকতো। তুমিও তাই ডাকবে। এবসুলিউটলি নো প্রবলেম। কি খাবে বল?

কিছু খাব না।

কিছু খাবে না বললেতো হবে না। পারুল যদি শুনে তার পল্টু ভাই কিছু না খাইয়ে তার স্বামীকে বিদায় করেছে তাহলে খুব অভিমান করবে।

এক কাপ চা খেতে পারি।

চা তো সবাই সবাইকে খাওয়ায়। তাতে বিশেষ কোন মমতা দেখানো হয় না। লাচ্ছি খাও। গরমের মধ্যে লাচ্ছি ভাল লাগবে। বাজে কটা, দশটা? গুড। পাশেই একটা দোকান আছে, দশটার দিকে গরম গরম সিঙ্গারা ভাজে। কলিজি সিঙ্গারা। একবার খেলে মুখে স্বাদ লেগে থাকে। বয়স হয়েছে, গুরুপাক জিনিস খেতে পারি না। তুমি খাও, ইয়াংম্যান, তোমার এখন লোহা হজম করার বয়স।

পল্টু সাহেব সিঙ্গারা ও লাচ্ছি আনতে দিলেন। হাসি হাসি মুখে তাকালেন। ভদ্রলোকের মাথার চুল ধবধবে শাদা। কিন্তু স্বাস্থ্য এখনো বেশ ভাল। ঠোঁট অবশ্যি ফোলা ফোলা।

তোমার নামটা কি তাতো জানা হল না।

আমার নাম তাহের।

শুধু তাহেরতো নাম হয় না। তাহেরের সঙ্গে আর কি আছে?

আবু তাহের।

ভেরী গুড। আবু তাহের। শুন আবু তাহের, পারুল চিঠিতে লিখেছে একবার তাকে গিয়ে দেখে আসতে। যাব, নিশ্চয়ই যাব। সময় পেলে হুট করে একদিন চলে যাব।

চাকরি বাকরি পাচ্ছ না বলে লিখেছে। আমি চেষ্টা করব। তুমি ছবিসহ বায়োডাটা দিয়ে যেও।

জ্বি আচ্ছ।

চাকরির বাজার খুবই খারাপ। তবু দেখি কি করা যায়। তোমরা যেখানে থাক সেই জায়গার ঠিকানাটা ভাল করে লিখে দাও দেখি। বাসে করে যদি যাই কোথায় নামব।

তাহের বলল, আপনি একা একা যাবেন না। বাড়িতে কুকুর আছে। কুকুরগুলা ভয়ংকর রাগী। আপনি কখন যেতে চান বলবেন, আমি নিয়ে যাব।

সেটাতো সবচে ভাল হয়। তবু তুমি ঠিকানা লিখে দাও। ঐ দিকে ব্যবসায় খাতিরে প্রায়ই যেতে হয়–অসময়ে উপস্থিত হয়ে পারুলকে চমকে দিয়ে আসব, হা হা হা।

তাহের সিঙ্গারা খেল, লাচ্ছি খেল, পান খেল। পল্টু সাহেব আরো ভদ্রতা করলেন। তিনি তাঁর গাড়ি দিয়ে বললেন, তুমি কোথায় যাবে বল। তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে। পারুলের তুমি হাসবেন্ড এইটুকু খাতির তো তোমাকে করতেই হবে।

অফিসে নেমেই তাহের শুনল রহমান সাহেব তার খোঁজ করছেন। বলেছেন তাহের এলেই যেন তার সঙ্গে দেখা করে। খুব জরুরী।

তাহের দেখা করতে গেল। রহমান সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন–কামরুলকে খবর দিতে বলেছিলাম, তুমি দিয়েছ? কাল রাতে হঠাৎ বড় সাহেব বাসায় টেলিফোন করে জানতে চেয়েছেন কুকুরগুলিকে ইনজেকশন দেয়া হয়েছে কি না। আমি না জেনেই বলেছি দেয়া হয়েছে। নয়ত উনি টেনশানে থাকবেন। অফিসে এসে শুনি কামরুল এখনো ইনজেকশন নিতে আসেনি। তুমি কি তাকে বলনি?

বলেছি, স্যার।

তাহলে আসছে না কেন? বড় সাহেব নেই বলে তেল বেশী হয়ে গেছে? চিপে তেল সব বের করে ফেলব—হারামজাদা–

তার শরীরটা খুব খারাপ এইজন্যে বোধহয় আসছে না। আজকেও জ্বর দেখে এসেছি। একটা কাজ করলে কেমন হয় স্যার। আমি ইনজেকশনগুলি নিয়ে যাই–আমি নিজের দায়িত্বে ইনজেকশন দেয়ায়ে দিব।

এটা মন্দ না। কোথায় নিতে হবে জানতো?

জানি স্যার, মহাখালি।

পারবে?

অবশ্যই পারব। অফিসের ভ্যান একটা নিয়ে যাও।

জ্বি আচ্ছা স্যার।

ভ্যান আছে কি-না এখন কে জানে। যখন যেটা প্রয়োজন সেটাতো কখনো থাকে না। দাঁড়াও, আমি দেখি ভ্যান আছ কি-না।

রহমান সাহেব টেলিফোন তুলে ভ্যানের ব্যাপারে জানতে চাইলেন। তাহের তার মুখ দেখে বুঝতে পাল ভ্যান পাওয়া যাচ্ছে না। তাহের বলল, ভ্যান না পাওয়া গেলেও অসুবিধা হবে না স্যার। আমি বরং ডাক্তার সাহেবকে বাড়িতে নিয়ে আসব, তিনি এসে ইনজেকশন দিয়ে দেবেন। আগে একবার দিয়ে গেছেন। তাকে তিনশ টাকা দিতে হবে। আর আপনি যদি বলেন তাহলে বেবীটেক্সী করে নিয়ে যেতে পারি।

যেটা ভাল বুঝ কর। তারপর একটা বিল দিও টাকা দিয়ে দেব। এক কাজ কর ক্যাশিয়ালের কাছ থেকে পাঁচশ টাকা এডভান্স নিয়ে যাও। যা খরচ লাগে কর। বাকিটা ফিরত দিও। এখনই চলে যাও। জিনিসটা আমি ঝুলিয়ে রাখতে চাই না। স্যারের সঙ্গে মিথ্যা কথা বলতে হয়েছে। ভাবতেই আমার খারাপ লাগছে।

স্যার, আমি তাহলে যাই।

দাঁড়াও এক মিনিট–তুমি নাকি মনিকার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছ? আমাদের রিসিপসনিষ্ট মনিকা।

আমি তো স্যার কারুর সঙ্গেই খারাপ ব্যবহার করি না।

আমি অবশ্য মনিকাকে তাই বলেছি। যাই হোক তার সঙ্গে তোমার কথা বলারই দকার নেই। সুন্দরী মেয়ে দেখলেই কথা বলতে হবে?

আমি কি স্যার যাব?

অবশ্যই যাবে।

কুকুরকে ইনজেকশন দিয়ে কি স্যার খবর দিয়ে যাব?

তোমার নিজের আসার দরকার নেই। বরং সন্ধ্যার দিকে একটা টেলিফোন করে জানিয়ে দিও। তাহলে আমি নিশ্চিত হতে পারি।

এখনই আপনি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে যান স্যার। আজ দিনের মধ্যেই আমি ইনজেকশন দেয়া।

গুড।

আমি স্যার রাতে টেলিফোন করে দেব।।

টেলিফোন সন্ধ্যা ৭ টার আগে করবে। টেলিফোন নাম্বার আছে? মনিকার কাজ থেকে আমার একটা কার্ড নিয়ে যাও।

জি আচ্ছা স্যার।

তাহের হাসিমুখে বের হয়ে এল। ক্যাশিয়ারের কাছে ভাউচার সই করে পাঁচশ টাকা নিল। স্টোরের ফ্রীজ থেকে ইনজেকশানের এমপুল নিল। তারপর গেল মনিকার কাছে। হাসি মুখে বলল, ভাল আছেন?

মনিকা তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল। জবাব দিল না।

তাহের বলল, রহমান সাহেব বলেছেন তাঁর একটা কার্ড আমাকে দিতে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে স্যারকে ইটারকমে জিজ্ঞেস করতে পারেন।

মনিকা দুয়ার খুলে কার্ড ডেস্কে রাখল। কথা বলে সে সময় নষ্ট করতে চাচ্ছে না।

তাহের হাই তুলতে তুলতে বলল, স্যারের নামে আমার বিরুদ্ধে কমপ্লেইন করেছেন কেন? যা বলার আমাকে বললেই হত। কমপ্লেইন টমপ্লেইনতো ছেলেমানুষী ব্যাপার। বাচ্চারা করে, বড় বোনের কাছে নালিশ করে, মার কাছে নালিশ করে।

আপনি আমাকে বিরক্ত করবেন না।

কোন কোন মানুষের ভেতর অবশ্যি নালিশ করার অভ্যাস থেকেই যায়। তারা ম্যানেজারকে নালিশ করে, বসকে নালিশ করে। যাদের ম্যানেজার বা বস বলে কেউ থাকে না–তারা আল্লাহর কাছে নালিশ করতে বসে।

মনিকা কঠিন স্বরে বলল, আপনার যদি আমার বিরুদ্ধে কিছু বলার থাকে–স্যারকে গিয়ে বলুন।

আমি তো আগেই বলেছি আমার নালিশ করার অভ্যাস নেই। আমার স্ত্রীরও নেই। এই একটা দিকে আমাদের খুব মিল। অন্য কোনদিকে কোন মিল নেই। যেমন বাচ্চার নামের ব্যাপারটাই ধরুন। বাচ্চা আসতে এখনো অনেক দেরী–এর মধ্যে নাম খোঁজা খুঁজি। নামের জন্য বই কেনা। শেষ পর্যন্ত নাম ঠিক হয়েছে–আনান। আনান শব্দের অর্থ হল মেঘ। নামটা আপনার কেমন লাগছে?

মনিকা তীব্র গলায় বলল, আপনি যদি এক্ষুণী বিদেয় না হন তাহলে আমি স্যারের কাছে বাধ্য হয়ে যাব।

তাহের সহজ গলায় বলল, আমি চলে যাচ্ছি। অল্পতে রেগে যান কেন? মেয়েরা হবে সর্বংসহা। তাদের এত অল্পতে রাগলে চলে?

মনিকার ঠোঁট কাঁপছে। মেয়েটা ভয়ংকর রেগে গেছে। এত সুন্দর একটা মেয়ে কেন অকারণে এত রাগে? তাহের অফিস থেকে বেরুল। বাড়িতে ফিরে যাওয়ার প্রশ্ন উঠে না। কুকুরের ইনজেকশনতো অনেক পরের ব্যাপার। তিন শয়তানকে এক বেবীটেক্সীতে করে নিয়ে যাবে? হাস্যকর একটা কথা না? ম্যানেজার সাহেবের হাস্যকর কথা বিশ্বাস করার রহস্য হল, বিশ্বাস করার কারণে তার দায়িত্ব কমে গেছে। কুকুর নিয়ে মাথা ঘামাতে হচ্ছে না।

তাহের সময়টা কি ভাবে কাটাবে বুঝতে পারছে না। পার্কের কোন বেঞ্চিতে শুয়ে লম্বা ঘুম দেয়া যায়। গতকাল ঘুম এসেছিল বলে আজও যে ঘুম আসবে তা মনে হয় না। ঘুম না এলে সময় কাটানো একটা সমস্যা। সন্ধ্যা ছটার আগে বাড়িতে যাওয়া যাবে না। রহমান সাহেবকে টেলিফোন করতে হবে কাঢ়িায় কাটায় দুটায়। ম্যানেজার। সাহেবকে জানাতে হবে কুকরের ইনজেকশন যথারীতি দেয়া হয়েছে।

এতক্ষণ সময় সে কাটাবে কিভাবে? জসিমের সঙ্গে দেখা করে এলে কেমন হয়? দিনের পর দিন জসিমের বিছানায় সে ঘুমিয়েছে। কৃতজ্ঞতা বোধ বলেওতো একটা-কিছুক থাকা উচিত। বিয়ের পর সে একবারও জসিমের সঙ্গে দেখা করেনি। এতটা নিমক হান্নাম সে হল কি করে? জসিম কোথায় কাজ করে তাহেরের জানা নেই, সে মেসে চলে যাওয়াই ঠিক করল। অফিস শেষ করে মেসেতো সে ফিরে আসবেই।

জসিমকে মেসে পাওয়া গেল না। সে চার মাস হল মেস ছেড়ে দিয়েছে। পাঁচশ টকা বাকি ফেলে গেছে। কোথায় বাসা নিয়েছে সেই ঠিকানা দিয়ে গিয়েছিল। মেসের মালিক বরকতউল্লাহ সেই ঠিকানায় গিয়ে দেখে মিথ্যা ঠিকানা। বরকতউল্লা হতাশ গলায় তাহেরকে বলল–এই হচ্ছে আজকের যুগের ভদ্রলোকের নমুনা। তাকে সাহায্যতা কম করি নাই। দিনের পর দিন লোক জন নিয়ে ডাবলিং করেছে। আপনি নিজে ছিলেন তিন মাস। একটা কথা বলি নাই। বলতে গেলে সারাজীবন সিংগেল ভাড়া দিয়ে ডাবল থেকে গেছে। এই তার ফল। টাকা দিতে পারবে না বলুক–ভাই মাফ করে দেন। অসুবিধায় পড়েছি দিতে পারলাম না। এই কথা বলবে না। ফটকাবাজী করবে। শালা হারামী।

তাহের বলল, গালাগালি করবে না। গালাগালিতে কিছু মীমাংসা হয় না। পান কত আপনি?

পাঁচশ।

জসিম টাকা না দেয়, আমি দেব। আপাতত দুশ টাকা রাখুন। ছেলেবেলার বন্ধু তার সম্পর্কে গালাগালি শুনতে ভাল লাগে না। আমার অনেক উপকার করেছে। সে থাকতে না দিলে থাকতাম কোথায়?

দুশ টাকা আপনি দিবেন?

কি করব বলেন। বন্ধুর অপমানে আমার অপমান। নিল, নোটটা ভাঙ্গায়ে দুশ টাকা রাখুন।

দিচ্ছেন এখন পুরেটিাই দিয়ে দেন।

তাহের দরাজ গলায় বলল–রেখে দিন চারশ রেখে দিন। একশ টাকা শুধু ফেরত দিন। চা পাতা চিনি কিনতে হবে। নয়ত পুরোটাই দিয়ে দিতাম। একশ টাকার নোটটি কাইগুলি ভাঙ্গায় দিন। পাঁচশ টাকার নোটের ভাংতি পাওয়া যায় কিন্তু একশ টাকার নোটের ভাংতি পাওয়া যায় না। বিচিত্র দেশ।

বরকতউল্লাহ একশ টাকা ফেরত দিল। এবং অস্বস্থির সঙ্গে তাহেরকে দেখতে লাগল। তাহের বলল, বাকিটাও দিয়ে যাব। কোন এক ফাঁকে দিয়ে যাব।

টাকাটা দিতে পেরে তাহেরের স্বস্তি লাগছে। কুকুরের জন্যে নেয়া টাকা নিজের জন্যে খরচ করতে খারাপ লাগতো। মানুষ হিসেবে অনেক নিচে সে নেমে গেছে কিন্তু এখনো কুকুর হতে পারে নি।

 

প্রায় দুটা বাজে। গণগণে দুপুর। তাহেরের ক্ষিধে হচ্ছে না। ক্ষিধে হবে রাতে। তার স্বভাব প্রায় কুকুরের মতই হয়ে যাচ্ছে। একবেলা ক্ষিধে হয়। বাসায় ফিরে সে গপগপ করে ভাত খাবে। আপাতত কিছু না খেলেও চলবে। তাহের পার্কের দিকে রওনা হল। খালি বেঞ্চ জোগাড় করে শুয়ে থাকবে। ঘুম এলে ভাল। ঘুম না এলেও ক্ষতি নেই। এরপর থেকে সঙ্গে একটা শতরঞ্জির মত রাখবে। ভাঁজ করে পলিথিনের ব্যাগে বেখে। দেবে। প্রয়োজনে বিছিয়ে নিলেই সুন্দর বিছানা। একটা শতরঞ্জি থাকলে গাছের নিচেও শোয়া যায়। খালি বেঞ্চ খুঁজে বেড়াতে হয় না।

খালি বেঞ্চ পাওয়া গেছে। তাহের বেঞ্চে শুয়ে আছে। লক্ষণ ভাল মনে হচ্ছে না। ঘুম আসছে না। পরিচিত মানুষদের একটা তালিকা সঙ্গে থাকলে ভাল হত। তাদের সঙ্গে দেখা করতে গেলেও সময় কাটে।

 

 

শুধু দেখা হয়েছে। ভদ্রলোকের বোধহয় তাহেরকে মনেও নেই। ভদ্রলোকের নাম তফাতাল হোসেন। বিয়ে করেছেন কি না কে জানে। আশাদা পাড়ায় একবার চলে গেলে মন্দ হয় না। পারুলের দুর সম্পর্কের ভাই পরিচয় দিয়ে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলবে। তফাজ্জল সাহেবকে অবশ্যি বাসায় পাওয়া যাবে না। তিনি নিশ্চয়ই নানান কাজ কর্মে থাকেন। তাকে তাহেরের মত অবশ্যই দুপুরে পার্কে শুয়ে থাকতে হয় না।

একবার মুগদা পাড়ায় গেলে কেমন হয়?

মুগদাপাড়ায় পারুলের হলেও হতে পারত শ্বশুরবাড়ি। পারুলের বিয়ে সেখানে হয়েই যাচ্ছিল–মাঝখানে হুট করে সে ঢুকে পড়ল। ওদের সঙ্গে একটু দেখা করে আসা যেতে পারে। আর পারুলের শ্বশুর হবার কথা ছিল সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে।তাহেরের ভালই থাতির হয়েছিল। বাড়িঘর ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন। তাদের একটা নারকেল গাছে ছিয়াত্তরটা নারকেল হয়েছিল। তাদের ওল্ড মডেলের টয়োটা গাড়ি বিক্রি করে নতুন গাড়ি কেনার কথা ছিল। কিনেছেন কি না কে জানে। এই খবরটাও জান যেতে পারে।

যার সঙ্গে পারুলের বিয়ে হবার কথা ছিল তার সঙ্গে তেমন আলাপ হয়নি, একবার শুধু দেখা হয়েছে। ভদ্রলোকের বোধহয় তাহেরকে মনেও নেই। ভদ্রলোকের নাম তফাজ্জল হোসেন। বিয়ে করেছেন কি না কে জানে। মুগদা পাড়ায় একবার চলে গেলে মন্দ হয় না। পারুলের দুর সম্পর্কের ভাই পরিচয় দিয়ে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলবে। তফাজ্জল সাহেবকে অবশ্যি বাসায় পাওয়া যাবে না। তিনি নিশ্চয়ই নানান কাজ কর্মে থাকেন। তাকে তাহেরের মত অবশ্যই দুপুরে পার্কে শুয়ে থাকতে হয় না।

 

আশ্চর্যের ব্যাপার তফাজ্জল সাহেব বাসাতেই ছিলেন। কোথাও বোধ হয় বের হচ্ছিলেন–গায়ে ইস্ত্রী করা সিল্কের পাঞ্জাবী। সুন্দর করে চুল আঁচড়ানো। তাহের এর আগে ভদ্রলোকের চোখে চশমা দেখেনি— এখন সোনালী ফ্রেমের চশমা দেখা যাচ্ছে। সুন্দর মানিয়েছে চশমায়। যাদের চোখ অসুন্দর, চশমায় তাদের ভাল লাগে। চশমা চোখের ত্রুটি ঢেকে ফেলে। ভদ্রলোকের চোখ কি অসুন্দর? তাহের মনে করতে পারল না।

আপনি কাকে চাচ্ছেন?

আপনাকেই চাচ্ছি। আমার নাম তাহের। আবু তাহের। পারুলের দূর সম্পর্কের মামা।

আমিতো ঠিক চিনতে পারছি না।

না চেনারই কথা। ঐ যে পারুল নামের একটি মেয়ের সঙ্গে এনগেজমেন্ট হল। তারপর বিয়ে হল না।

ও আচ্ছা।

ভদ্রলোকের চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। একটু আগে মানুষটাকে সুন্দর দেখাচ্ছিল–এখন রাগী রাগী দেখাচ্ছে। বিয়ে ভাঙ্গার অপমান বেচারা এখনো ভুলেনি।

আমার কাছে কি ব্যাপার?

আমি আপনাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কি মনে করে যেন ঢুকে পড়েছি। অপরাধ ক্ষমা করবেন। আসলে আপনাদের বাড়ি দেখে পুরানো কথা মনে পড়ে মনটা খারাপ হল। পারুলকে কত বুঝিয়েছিলাম। কত বলেছি–তুই ভুল করছিস, বিরাট ভুল। জীবন দিয়ে সেই ভুলের মাশুল শোধ করতে হবে। এখন তাই করছে। আপনার আবা কেমন আছেন? এরকম ভদ্রমানুষ এ যুগে সচরাচর চোখে পড়ে না। উনাকে আমার সালাম দিবেন।

বাবা বেঁচে নেই। গত নভেম্বরে ইন্তেকাল করেছেন।

বলেন কি? সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠছিলেন–হঠাৎ স্ট্রোকের মত হল–গড়িয়ে পরে গেলেন।

আহা হা। আমি তো দেখেছিলাম খুব ভাল স্বাস্থ্য।

স্বাস্থ্যতো উনার বরাবরই ভাল ছিল। মৃত্যুর আগের দিনও জগিং করেছেন।

তাহের সত্যি সত্যি ব্যথিত হল। সে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ভাই তাহলে যাই। হঠাৎ এসে বিরক্ত করলাম–কিছু মনে করবেন না।

না, না, মনে করার কি আছে?

বিয়ে করেছেন কি?

জ্বি।

আলহামদুলিল্লাহ। শুনে খুব খুশী হলাম। পারুল মেয়েটার উপর কোন রাগ রাখবেন না। দুঃখী মেয়ে এখন হাড়ে হাড়ে বুঝছে। এখন বুঝে আর লাভ কি বলুন? ক্ষতি যা হবার তা তো হয়েই গেছে। ভাই যাই?

বসুন কিছুক্ষণ। চা খান।

আপনি বোধহয় কোথাও বেরুচ্ছিলেন।

দোকানের দিকে যাচ্ছিলাম। কর্মচারীরা আছে–পরে গেলেও হবে। আপনি আরাম করে বসুন। চায়ের কথা বলে আসি। ধুমপানের অভ্যাস আছে?

মাঝে মাঝে খাই।

নিন, আমার কাছ থেকে নিন।

ভদ্রলোক মালবরোর একটা প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরিয়ে দিলেন। খুশী খুশী গলার বললেন, পুরো এক কার্টুন মালবরো সিগারেট আমার এক ফ্রেণ্ড আমাকে প্রেজেন্ট করেছে। এদিকে স্ত্রী দিয়েছে সিগারেট খাওয়া বন্ধ করে। পকেটে সিগারেট নিয়ে ঘুরে বেড়াই। মাঝে মাঝে বন্ধু বান্ধবকে দেই। ওরা আরাম করে খায় দেখতে ভাল লাগে। আপনি চা খাবেন না কফি খাবেন? ভাল কফি আছে।

কফিটাই ভাল হবে।

আমি আগে চা খেতাম। আমার স্ত্রী এসে কফির অভ্যাস ধরিয়ে দিয়েছে। সারাদিনে এখন দশ কাপের মত কফি খাই।

মেয়েরা স্বামীদের কিভাবে যে বশ করে। বিয়ের আগের দিন এক মানুষ। বিয়ের পরের দিন অন্য মানুষ।

তফাজ্জল উৎল্ল গলায় বলল, একশ ভাগ খাঁটি কথা বলেছেন। ট্রুথ অব দ্য সেঞ্চুরী। বসুন কফির কথা বলে আসি।

তাহের আরাম করে সিগারেট টানছে। বুঝা যাচ্ছে তাকে দীর্ঘ সময় কাটাতে হবে। তাফাজ্জল সাহেব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পারুলের কথা জানতে চাইবেন। তার দুঃখের কথা যতই জানবেন ততই ভদ্রলোকের ভাল লাগবে। তাহের যদি ঠিকঠাক বলতে পারে তাহলে যাবার সময় ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন। তাঁর পাঞ্জাবীর পকেটের সিগারেটর প্যাকেটটাও দিয়ে দেবার সম্ভাবনা আছে।

তফাজ্জল সাহেব ফিরে এলেন। তাহেরের সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, তারপর ভাই বলুন–খবরাখবর বলুন।

খবরাখবর বলার মত কিছু নেই।

আপনার যে ভাগ্নির কথা বললেন সে ঢাকাতেই আছে?

জি। ঠিক ঢাকাতে না–ঢাকা থেকে দূরে উত্তরখান, রাজপ্রাসাদের মত এক বাড়ি।

রাজপ্রাসাদের মত বাড়ি?

নকল রাজপ্রাসাদ।

নকল রাজপ্রাসাদ মানে?

রাজপ্রাসাদ ঠিকই আছে–বিশাল বাড়ি। বাড়ির সামনে দাঁড়ালে আক্কেলগুড়ুম হয়ে যাবে তবে …।

তবে কি?

ওরা ঐ বাড়ির কিছু না। পারুলের হাসবেন্ড ও বাড়ির কেয়ারটেকার। দারোয়ানও বলতে পারেন। পারুল তার দায়োরান স্বামীর সঙ্গে থাকে।

কি বলছেন এসব?

পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে। এক ভদ্রলোকের সঙ্গে বিয়ে ঠিক ঠাক হল। পান চিনি হল, তারপর তাদের মুখে চুনকালি দিয়ে লোফার টাইপ একটা ছেলের সঙ্গে বের হয়ে যাওয়া–এই পাপের শাস্তি হবে না!

তফাজল আগ্রহের সঙ্গে বলল, ওর হাসব্যান্ড কি সত্যি দারোয়ান?

একশ ভাগ সত্যি। শিক্ষিত দারোয়ান। এম এস সি পাশ দারোয়ান–হা হা হা।

তফাজ্জল বলল, ভাই হাসবেন না। অন্যের দুঃখ কষ্ট নিয়ে হাসা ঠিক না।

মনের দুঃখে হাসি। আর কিছু না। পারুলের বোকামী দেখে হাসি।

খুব কষ্টে আছে?

কষ্ট কত প্রকার ও কি কি জানতে হলে ওদের দেখতে হয়। স্ত্রীর বাচ্চা হবে। এখন চলছে তিন মাস। এর মধ্যে কোন ডাক্তারের কাছে যায় নি। যাবে কি ভাবে? ডাক্তারতো মাগনা দেখবে না। স্বামীটি হল পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ অপদার্থের একজন। পাঁচ বছর আগে এম. এস. সি. পাশ করেছে–এই পাঁচ বছরে একটা চাকরি জোগাড় করতে পারে না।

ভদ্রলোকের এরকম অবস্থায় বিয়ে করা ঠিক হয় নি।

ওর কথা বাদ দিন। পুরুষ মানুষ। বিয়ের কথা উঠলে পুরুষ মানুষের মাথা ঠিক থাকে না। বৌকে খাওয়াতে পারবে কি পারবে না এটা নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিন্তু  পারুলতো পুরুষ না, পারুল হচ্ছে মেয়ে মানুষ। তার একটা বিবেচনা নেই?

তফাজ্জল বিষণ্ণ গলায় বলল, প্রেম ছিল। প্রেমের সময় বিবেচনা কাজ করে না।

প্রেমতো আর রান্না করে খাওয়া যায় না। খেতে হয় ভাত। প্রেম যদি খাওয়া যেত তাহলেতো কথাই ছিল না। বাড়িতে বাড়িতে প্রেমের পোলাও, প্রেমের কোরমা রান্না হত। দেশে প্রেমের অভাব নেই। দেশে অভাব হচ্ছে ভাতের।

আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন। করেন কি আপনি?

অধ্যাপনা করি। প্রাইভেট কলেজে ম্যাথমেটিকস পড়াই।

পারুল কি ঐ বাড়িতেই থাকে?

জ্বি।

পার্মানেন্টলি থাকছে?

আরে না। পার্মানেন্টলি থাকলেতো ওদের সমস্যার সমাধানই হয়ে যেত। খুবই টেম্পোরারী ভাবে আছে। যার বাড়ি তিনি দেশের বাইরে। পারুলের স্বামীর উপর বাড়ি দেখাশোনার দায়িত্ব। সে এই সুযোগে বউকে নিয়ে তুলেছে। ভদ্রলোক ফিরে ওদের গেট আউট করে দেবে। তখন কমলাপুর রেলস্টেশনের প্লাটফরমে থাকা ছাড়া এদের গতি নেই।

একটা কাজের ছেলে ট্রে হাতে ঢুকল। ট্রেতে কফির পট, পনিরের স্লাইস, জেলী মাখানো বিসকিট। তফাজ্জল বলল, আমার স্ত্রী বাসায় নেই, থাকলে পরিচয় করিয়ে দিতাম। ও গেছে তার খালার বাড়ি। ওর এক খালাতো ভাই এসেছে জাপান থেকে। ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গেছে। খালাতো ভাইটা আবার জাপানী এক মেয়ে বিয়ে করে ফেলেছে।

বলেন কি?

মেয়েটা দেখতে ভাল না। বড়ই গুটার মত সাইজ। বিরাট স্বাস্থ্য। দেখলে মহিলা কুস্তিগীরের মত লাগে। কি মনে করে বিয়ে করল কে জানে।

তাহের কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, প্রেম হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক প্রেম। এই হল ঘটনা।

ঠিক বলেছেন। শুনুন ভাই সাহেব–সময় পেলে মাঝে মধ্যে চলে আসবেন। আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বললে আপনা ভাল লাগবে। একদিন সুযোগ পেলে গান শুনিয়ে দেব।

উনি গনি জানেন নাকি?

অল্প-স্বল্প জানে। রেডিও টিভিতে যায় নি। গেলে চান্স পাবে। তবে আমার ইচ্ছা না। কি দরকার? মাসমিডিয়াতে যাওয়ার?

তাই ভাল–ছাদে বসে ভাবী গান গাইবে, আপনি শুনবেন।

তফাজ্জল সিগারেটের প্যাকেট বের করে বলল, নিন আরেকটা সিগারেট নিন।

তাহের সিগারেট নিল।

প্যাকেটা রেখে দিন। আমার কাছে থাকা না থাকা একই। আমি তো খেতে পারছি না।

খেয়ে ফেলুন একটা। ভাবীতো আর দেখছে না?

ওকে চেনেন না। লুকিয়ে সিগারেট খেলেও ঠিক ধরে ফেলবে।

তাহলে না খাওয়াই ভাল।

তফাজ্জল তাহেরকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিল।

পাঁচটা বাজে।

ম্যানেজার সাহেবকে টেলিফোন করার সময় হয়ে এসেছে। তফাজ্জল সাহেবের বাসায় আরো কিছুক্ষণ থাকলে সেখান থেকে কথা বলা যেত। তবে টেলিফোনের কথাবার্তা তফাজ্জল সাহেব শুনলে সমস্যা হয়ে যেত। অংকের প্রফেসর কুকরের ইনজেকশন নিয়ে ছোটাছুটি করছে… কেমন যেন লাগে।

 

কে কথা বলছেন?

স্যার, আমি তাহের।

ও আচ্ছা, তাহের।

ইনজেকশন দেয়া হয়েছে স্যার।

গুড।

বেবী টেক্সীতে তিনটাকে একসঙ্গে ঢোকানো একটু সমস্যা হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত নিয়ে গেছি।

ভেরী গুড। ডাক্তার ইমুনাইগ্রেশন সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেনতো?

জ্বিনা–কাল এসে নিয়ে যেতে বলেছেন।

দেশের কি অবস্থা। সামান্য একটা কাজ একবারে হয় না। দুবার তিনবার যেতে হয়। তুমি মনে করে কাল সাটিফিকেটটা নিয়ে এসো।

অবশ্যই নিয়ে আসব।

তাহের বলে, স্যার, তাহলে টেলিফোন রেখে দেই?

আচ্ছা। ও শোন–বড় সাহেবের একটা খবর আছে, তোমাকে দেয়া দরকার। খারাপ খবর। ভেরি ব্যাড নিউজ। উনার ক্যান্সার ধরা পড়েছে।

কি বলছেন স্যার?

এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। তবু ক্যান্সার বলে কথা। স্যার চিকিৎসার জন্যে আমেরিকা চলে যাবেন। তোমাকে আরো বেশ কিছুদিন বাড়ি দেখাশোনা করতে হবে বলে মনে হচ্ছে।

কোন অসুবিধা নেই স্যার।

তোমার কাজকর্মে আমি খুশি। বড় সাহেব এলে উনাকে বলে আমি তোমার জন্যে অফিসে পার্মানেন্ট একটা ব্যবস্থা করব। তুমি এম. এ. পাশ আমি জানতাম না। মনিকার কাছে শুনলাম।

থার্ড ক্লাস পেয়েছিলাম স্যার। থার্ড ক্লাস এম. এ. আর মেট্রিক একই।।

কথাটা মন্দ বলনি। যাই হোক, আমি দেখব–আরেকটা কথা–এতদিন যখন তোমাকে থাকতেই হবে–তুমি বরং তোমার স্ত্রীকে নিয়ে এসো। দুজন মিলেই থাক। বাড়ি দেখাশোনা কর।

আপনার দয়ার কথা কোনদিন ভুলব না স্যার।

তাহের কান্নায় মত একটা শব্দ করল। হেঁচকি তুলে ফেলল। যে দোকান থেকে টেলিফোন করা হচ্ছে সেই দোকানের দুজন কর্মচারী অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। তারা। অনেকদিন এমন উৎকৃষ্ট অভিনয় দেখেনি।

টেলিফোনের ওপাশ থেকে রহমান সাহেব কোমল গলায় বললেন, কি মুশকিল, কাঁদছ কেন? যাও, এখনি তোমার স্ত্রীকে নিয়ে আস। বিছানা, টুকটাক জিনিস সব নিয়ে চলে এসো। টেক্সি নিয়ে যাও। অফিসে বিল করে দিও। টেক্সি ভাড়া দিয়ে দেবে।

জ্বি আচ্ছা, স্যার।

টেলিফোনের জন্যে দোকানে পাঁচ টাকা দিতে হয়। তাহের দশ টাকা দিয়ে বলল, বাকিটা রেখে দিন ভাই। চা খাবেন।

 

প্রথম দিন পারুল যখন এ বাড়িতে এসেছিল, ভয়ে সে অস্থির হয়ে গিয়েছিল। আজ আবার কেন জানি ভয় লাগছে। ভয়টা সন্ধ্যা থকে শুরু হয়েছে। মতই সময় যাচ্ছে ততই বাড়ছে। বারান্দায় স্টোভ জ্বালিয়ে ভাতের চুলা বসানোর সময় গ্রিলের পাশে খক খক কাশির শব্দ শুনল। কাশির পর থু করে থুথু ফেলার শব্দ। অবিকল কামরুল যেমন থুথু ফেলত সে রকম। পারুল চোখ তুলে কিছু দেখার চেষ্টা করল না। আগুনের দিকে তাকিয়ে রইল। আগুন মানুষের ভয় কাটিয়ে দেয়, তার ভয় কাটছে না। বরং ভয়টা একটু একটু বাড়ছে। স্টোভ থেকে শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। শব্দটার ভেতরও কিছু আছে। সে কি স্টোভ নিভিয়ে শোবার ঘরে চলে যাবে? দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে? দরজা বন্ধ করে বসে থাকা যাবে না। শোবার ঘর থেকে গেটের শব্দ শোনা যায় না। তাহের এসে গেটে ধাক্কা দেবে, কলিংবেল টিপবে। সে শুনতে পাবে না। কাজেই তাকে বসে থাকিতে হবে বারান্দায়।

কে যেন বরান্দার পেছনে হাঁটছে। পা টেনে টেনে হাঁটছে। পারুলের হাত-পা শক্ত হয়ে আসছে। সে ঢাপা গালায় ডাকল, ফিবো, নিকি, মাইক।

কুকুর তিনটির ছুটে আসার কথা। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে থাকার কথা–কেউ আসছে না। ওরা আসছে না কেন? কেউ কি ওদের বলেছে–না, তোমরা যাবে না, ওদের পরিচিত কেউ?

স্টোভের শব্দ কমে আসছে। পাম্প করতে হবে। আশ্চর্য! পাম্প করার শক্তিও তার নেই। পারুল উঁচু গলায় ডাকল–নিকি, ফিবো, মাইক।

ঝন ঝন করে শব্দ হল। তখনি পারুলের মনে পড়ল, এরা শিকল দিয়ে বাধা। পারুল নিজেই বেঁধে রেখেছে, খুলে দিতে মনে নেই। এরাই হয়ত কাশছিল। কুকুরের ঠাণ্ডা লাগলে এরা অবিকল মানুষের মত কাশে।

গেটে শব্দ হচ্ছে। প্রথম পর পর তিনবার, একটু থেমে আবার দুবার। তাহের চলে এসেছে। এখন মুখ তুলে গ্রিলের বাইরে তাকানো যায়। পারুল কিছু দেখবে ভাবেনি। তারপরেও অস্পষ্টভাবে দেখল–মাটির স্তূপের উপর কে যেন বসে আছে। পাত অটছে। কামরুল না? হ্যাঁ, কামরুলই তো।

চোখের ভুল। অবশ্যই চোখের ভুল। ভয় পেলেই মানুষ চোখে ভুল দেখতে শুরু করে। গেটে শব্দ হচ্ছে। তিনবার–দুবার। তিনবার দুবার। আশ্চর্য! ছায়া ছায়া লোকটাও শব্দ শুনে গেটের দিকে তাকাচ্ছে।

পারুল উঠল। গেটের দিকে রওনা হল। যে তীব্র ভয় শুরুতে লাগছিল এখন তা লাগছে না। পারুলকে দেখে নিকি, ফিবো, মাইক ডাকাডাকি শুরু করেছে। পারুল। আগে তাদের দিকে গেল। ওদের ছেড়ে দিতে হবে। ওরা ছাড়া থাকলে ভয় থাকবে না। এরা বাড়ির চারপাশে চক্কর দেবে। মাটির স্তূপের উপর কাউকে থাকতে দেবে না।

 

তাহের খেতে বসেছে। পাগলের মত খাচ্ছে। মুঠি ভর্তি ভাত মুখে দিচ্ছে। ঠিকমত চিবুচ্ছে না, গিলে ফেলছে। পারুল অবাক হয়ে দেখছে। তাহের লজ্জিত মুখে বলল, রাক্ষসের মত খিদে লেগেছে।

তাই তো দেখছি।

একবেলা খাই তো, মনে হয় এই জন্যে। কুকুর স্বভাব হয়ে গেছে একবেলা আওয়া। হা হা হা।

এরকম অদ্ভুত করে হাসছ কেন।

তাহেরের মুখ ভর্তি ভাত। কখা বলা সমস্যা। তার মধ্যে বলল, একটা অসাধারণ। ভাল খবর আছে। মেসবাউল সাহেবের ক্যান্সার হয়েছে।

পারুল বলল, মুখের ভাত শেষ করে কথা বল। পানি খাও।

তাহের মুখের ভাত গিলে ফেলল। পুরো এক প্রান পানি খেয়ে হাঁপাতে লাগল।

পারুল বলল, কি বলছিলে?

আমার স্বভাব হয়ে গেছে শয়তানের মত। মিথ্যা বলা অভ্যাস হয়ে গেছে। বাইরে এখন বলতে গেলে সারাক্ষণই মিথ্যা বলি। খুব গুছিয়ে বলি।

মিথ্যা সব সময় গুছিয়ে বলতে হয়। সত্য গুছিয়ে বলতে হয় না।

ঠিক বলেছ। ভেরি রাইট। মিথ্যা বলায় এখন এমন এক্সপার্ট হয়েছি, যাকে যা বলি তাই সে বিশ্বাস করে।

মেসবাউল করিম সাহেবের সম্পর্কে কি যেন বলছিলে?

উনার ক্যান্সার হয়েছে। দুঃখজনক খবর, কিন্তু আমি বললাম, কি রকম করে দেখেছ? আমি বললাম–একটা অসাধারণ ভাল খবর আছে …, একেবারে কুকুরের মত হয়ে যাচ্ছি। কিছুদিন পর হতে দেখলে মেঝেতে চার পায়ে হামা দিচ্ছি।

পারুল শান্ত গলায় বলল, মেসবাউল করিম সাহেবের ক্যান্সার হওয়ায় আমাদের কিছু সুবিধা হয়েছে এই জন্যেই তুমি বলেছ–অসাধারণ ভাল খবর। মানুষ মাত্রই নিজের ভালটা আগে দেখে। এটা অপরাধ না। এবং এটা কুকুরের স্বভাবও না। মানুষের স্বভাব। সাধারণ মানুষের স্বভাব।

তাও ঠিক। আরো একটা খবর আছে। সেই খবরটা আরো ভাল। আন্দাজ কর তো খবরটা কি?

পারুল বলল–রহমান সাহেব তোমাকে বলেছেন যে তুমি আমাকে এনে তোমার সঙ্গে রাখতে পার।

আশ্চর্য তো। আসলেই তাই। কি করে বললে?

আমি উনাকে চিঠিতে অনুরোধ করেছিলাম।

চিঠি তো উনাকে দেইনি। চিঠির কথা মনে ছিল। দেয়ার সাহস হয়নি।

চিঠি না পড়েই তিনি আমাকে এখানে থাকার অনুমতি দিলেন?

হ্যাঁ। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আনান-এর জন্ম পর্যন্ত আমরা এ বাড়িতে থাকতে পারব।

তুমি কি পল্টু ভাইয়ের চিঠিটাও তাকে দাও নি?

হ্যাঁ, দিয়েছি।

উনি কি বললেন?

খুব খুশি হয়েছেন। বলেছেন একবার এসে তোমাকে দেখে যাবেন।

কবে আসবেন?

তা বলেননি। বিশিষ্ট ভদ্রলোক। ছবিসহ বায়োডাটা দিতে বললেন। আমার জন্যে চাকরির চেষ্টা করবেন। করবেন না কিন্তু তা জানি–তবুও তো বলল। আজকাল তো মুখের বলটাও কেউ বলে না।

পারুল হাসছে। তার হাসির বেগ বাড়ছে। সে আঁচলে মুখ চাপা দিল। তাহের তাকিয়ে আছে। এ কি বিশ্রী অভ্যাস হচ্ছে পারুলের! হাসির শব্দে আকৃষ্ট হয়ে কুকুর তিনটা এসেছে। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে তাদের লম্বা মুখ ঢুকিয়ে দিয়েছে। পারুল হাসতে হাসতে বলল, খবর শুনেছিস? পল্টু ভাই আমাকে দেখতে আসবেন। বিশিষ্ট ভদ্রলোক। উনি এলে তোদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। উনাকে খুব ভাল লাগবে।

তাহের বলল, কুকুরের সঙ্গে কথা বলছ?

নগর মাছ সব সময়ই তো বলি। নতুন কি?

এইসব লক্ষণ ভাল না। খারাপ লক্ষণ।

খারাপ লক্ষ কেন? তোমার কি বা হাবের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমিও এক সময় করে হয়ে যাব? চার পায়ে হামা দেব? এটা মন্দ না কিন্তু। তুমি আমি দুজনেই হামাগুড়ি দিয়ে ঘরে হাঁটছি–হি হি হি।

তাহের খেতে শুরু করেছে। খাওয়া বন্ধ করে অনেকক্ষণ কথা বলার জন্যে খিদে। মরে গেছে, এখন আর খেতে ভাল লাগছে না। পারুল বলল, এই শোন। তাকাও আমার দিকে।

তাহের তাকালো। পারুল বলল, এখন এ বাড়িতে আমাদের গুছিয়ে বসতে হবে। কাজেই কামরুল যে নেই এটাও তোমাকে অফিসে জানাতে হবে।

কি বলব তাদের? আমরা তাকে মাটিতে পুঁতে রেখেছি, যাতে ফুলের বাগানে ভাল সার হয়?

কি বলবে তা তুমিই ঠিক করবে। একটু আগেই না বললে তুমি গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পার। খুব গুছিয়ে কিছু একটা বলবে। ভাল কথা, তোমাকে যে একটা চিঠি লিখেছিলাম সেটা পড়েছ?

তাহের বিরক্ত মুখে বলল, কিছুই তো সেখানে লেখা নেই। শাদা একটা পাতি। এই রকম ঠাট্টা করার মানে কি? আমি তো ঘাম খুলে হতভম্ব।

পরুল আবার হাসতে শুরু করেছে। তার হাসির বেগ বাড়ছে। এই তো এখন মুখে আঁচল চাপা দিল। তাহের ঘাওয়া বন্ধ করে তাকিয়ে আছে। অবাক হয়ে সে পরুলকে দেখছে। নিকি, ফিবো ও মাইক ওর। ও দেখছে। তবে তারা অবাক হচ্ছে না। পশুদের বিস্মিত হবার ক্ষমতা থাকে না।

এত হাসছ কেন?

আনন্দ হচ্ছে এই জন্যে হাসছি। আচ্ছা শুন কুকর যে হাসতে পারে তা-কি তুমি জান?

কুকুর হাসতে পারে?

হ্যাঁ পারে। আজ সকালে কি হয়েছে শোন–আমি নিকিকে বললাম, এই নিকি তুই দুই স্বামী নিয়ে ঘুরে বেড়াস তোর লজ্জা লাগে না? তখন দেখি নিকি চুপ করে আছে। ফিবো হাসছে।

পারুল তোমার চিকিৎসা হওয়া দরকার?

আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? এই দেখ ফিবো হাসছে। দেখ ভাল করে।

তাহের তাকাল।

সে রকমই তো মনে হচ্ছে। তাহেরের গায়ে কাঁটা দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *