০৮. প্রাক-আধুনিক ও আধুনিক সাহিত্যে গণিকা
প্রাক-আধুনিক যুগের সাহিত্যে এসে গণিকাদের প্রকটভাবে আর পাওয়া যায় না। প্রাক-আধুনিক যুগকে যদি চর্যাপদ ধরি, সেখানে গণিকাদের উপস্থিতি নেই। কেন নেই? হঠাৎ করে সমাজ বদলে যাওয়ার তো কোনো কারণ নেই। সে সময়কার মানুষের জীবনযাত্রা উল্লেখ করার মতো সংযত ছিল, এমন আভাস কোথায়! প্রকট না-হলেও প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত কিন্তু মেলে। কিন্তু ব্রাহ্মণ প্রভৃতি উচ্চবর্ণের নাগরিকেরা যে মাঝেমধ্যে গোপনে রমণীদের সঙ্গে সম্পর্ক করতেন, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে এই পদগুলিতে–“টালত ঘর মোর নাহি পড়বেষী”, উঞ্চা উঞ্চা পাবত তহি বসহি সবরী বালী”, “নগর বাহিরি রে ডোম্বি তোহের কুড়িআ”। এইসব গণিকা-রমণীরা ছিল আর্থিক ও সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত, অস্পৃশ্য ও অবহেলিত। ব্যভিচারিতা বলা যায় না, বরং বলা যায় এটা ছিল হতদরিদ্র নারীদের এটাই ছিল জীবিকার্জনের অন্যতম পথ। বলা যায় এসময় থেকেই গণিকাদের মর্যাদার পতন শুরু। ঘৃণ্য হতে শুরু করল।
ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলের দ্বিতীয় খণ্ড বিদ্যাসুন্দরে জনৈকা হীরামালিনী, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বড়ায়িরা দূতী হিসাবে পরিচিত হলেও সংস্কৃত সাহিত্যে এঁরা গণিকা রূপেই অঙ্কিত। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে গণিকাদের উপস্থিতি যেভাবে প্রকটিত হয়েছিল, মধ্যযুগ তথা প্রাক-আধুনিক যুগে এসে অনেকটাই প্রচ্ছন্ন হয়ে যায়। এহেন পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব হল? আসলে সেসময়টা ছিল নানবিধ উত্থান-পতনে জর্জরিত। গোটা মধ্যযুগ জুড়ে ছিল অস্থিরতা। শক, হুন, পাঠান, মোঘল, এমনকি বর্গি আর ঠগিদের দৌরাত্ম্যে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। চারিদিক যুদ্ধ, হানাহানি, হিংসা, আক্রমণ, প্রতি-আক্রমণের মানুষের মানবিক মূল্যবোধ প্রায় তলানিতে। এহেন অস্থির পরিমণ্ডলে কবি-লেখকদের লেখনী প্রায় স্তব্ধ হয়ে যায়। সম্ভব হয়ে উঠছিল না মননশীল সাহিত্য রচনা। সেইসঙ্গে ব্রাত্য ও অপাঙক্তেয় হল গণিকা। সম্ভবত এই কারণেই প্রাক-আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তেমন একটা গণিকাঁচরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায় না। সমগ্র মধ্যযুগের ভরকেন্দ্র ছিল ধর্ম, বিশেষ করে বঙ্গদেশে। সেসময় যতটা-না সামাজিক সাহিত্য রচিত হয়েছে, তার চেয়ে কয়েকশো গুণ বেশি ধর্মাশ্রিত সাহিত্য রচিত হয়েছে। ফলে সে সময়ের অন্য সাহিত্যে গণিকাদের নিয়ে ভাবার অবকাশ লেখকেরা পাননি। তার মানে এই নয় যে, সেসময়ের সমাজে গণিকারা ছিল না। অবশ্যই ছিল, তবে ধর্মীয় অনুশাসনের বেড়াজালে নারীর জীবন প্রান্তিকায়িত হয়ে গেল।প্রাক্-আধুনিক যুগ ও তারও পরে গণিকাজীবন অবহেলিত থেকে গেল বাংলা সাহিত্যে।
প্রাক্-আধুনিক যুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগে এসে সমাজ ও রাষ্ট্র (সেসময় রাষ্ট্র বলতে সমগ্র ভারত বোঝাত না) খানিকটা থিতু হয়ে এলে বাংলা সাহিত্যে পুনরায় জাঁকিয়ে প্রবেশ ঘটল গণিকাদের। প্রবেশ ঘটল বটে, তাঁদের হৃত সম্মান ফিরে এলো না। এ সময়ে গণিকারা ক্রমশ ঘৃণ্য ও প্রান্তিক হয়ে গেল। কী সমাজে, কী সাহিত্যে। তৎকালীন সমাজের গণিকাদের প্রতিচ্ছবিই সাহিত্যেও প্রতিফলন ঘটেছে। অথচ প্রাচীনকালে ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ জুড়ে ছিল গণিকাদের মাথা উঁচু করে চলার অবাধ ও স্বাধীন বিচরণক্ষেত্র। এখনকার মতো গোপনীয় ও বিপন্নতা ছিল না গণিকাজীবন ও বৃত্তি। সম্মান ও মর্যাদা ছিল সমাজের অন্য পেশার মানুষদের মতো। বরং বলা যায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্য পেশার মানুষদের চেয়েও বেশি সম্মান ছিল। গণিকাদের সমাজ ও জীবন ছিল বিশেষ মনোরম ও উপভোগ্য। এখনকার মতো মোটেই ক্লেদাক্ত জীবন ছিল। তবে প্রাচীন যুগে কখনো-সখনো নিয়মনিষ্ঠ শাস্ত্রকারেরা গণিকাদের সম্পর্কে কঠোর বাক্যবাণ প্রয়োগ করলেও বেদ, মহাকাব্য, পুরাণ সর্বত্রই গণিকাদের গৌরবোজ্জ্বল, রাজকীয়, দৃষ্টিনন্দন পদচারণা অনুভব করা
আধুনিক যুগে এসে গণিকার কথা জানতে পাচ্ছি এক গণিকা কলমে। মানদাদেবীর কলমে। লেখিকা মানদাদেবী নিজে একজন গণিকা। মানদাদেবীর গ্রন্থের প্রথম পর্বে বর্ণিত হল তাঁর জীবনের কৈশোর পেরিয়ে কীভাবে তিনি গণিকা হলেন। এরপর পাই একজন শিক্ষিতা গণিকায় মুখে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা।এমন একটি নির্ভেজাল নির্মোহ গণিকার আত্মচরিত আগে কখনো পাওয়া যায়নি। সেই অর্থে বলা যায় এই দুর্লভ আত্মচরিত সেইসময়কার গণিকাদের জীবন সম্পর্কে আমাদের অনেকগুলো জানালা খুলে দিয়েছে।
আধুনিক যুগের লেখকদের লেখায় ফুটে উঠল গণিকাদের জীবনযাপন, তবে গণিকাদের প্রতি সমাজের ঘৃণ্য ও অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। অনেকক্ষেত্রেই সমাজ কলুষিত করছে এমন অভিযোগ গণিকাদের কাঠগোড়ায় দাঁড় করিয়েছে। গণিকারাও মানুষ, তাঁদেরও যে আর পাঁচটা মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করার অধিকার আছে, স্বপ্ন আছে, সে বিষয়টি লেখকদের লেখায় প্রাধান্যই পায়নি। গণিকারা সমাজে অগ্রহণীয় হয়ে উঠল। গণিকাদের স্বাদ নেওয়া যায়, কিন্তু সমাজে গ্রহণ করা যায় না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা সংকলনে গণিকার চরিত্রায়ণ খুব একটা সুলভ নয়। যেটুকে এসেছে তাও সংস্কৃত ও পালি সাহিত্য চয়ন করা। তাঁর কাব্য ও নাট্যে শ্যামা, বাসবদত্তা নান্মী গণিকা চরিত্রগুলিরই পুনর্নির্মাণ লক্ষ করা যায়। তাঁর সমসাময়িক কোনো গণিকার কথা তাঁর সাহিত্যে উঠে আসেনি। রবীন্দ্র কথাসাহিত্যে গণিকাঁচরিত্রের স্বল্পতার কারণে তাঁর কাব্য-নাট্যে যে চরিত্রগুলি উঠে এসেছে তার আলোচনা প্রায় অনিবার্য হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যজীবনের যে বিশেষ পর্যায়টি অতীতের দিকে মোহমুগ্ধ দৃষ্টিতে ফিরে দেখায়, সেই সময়পর্বে লেখা কবিতাগুলির কথা উল্লেখ করতে পারি। যেমন–অভিসার, পতিতা, পূজারিনী, পরিশোধ, অপমানবর ইত্যাদি। প্রাচীন সাহিত্য, বৌদ্ধজাতক ও অবদান সাহিত্য এবং ভক্তমাল থেকে বিষয়বস্তু গ্রহণ করে তিনি এই কাব্যগুলিতে গণিকা চরিত্রগুলির পুনর্নির্মাণ করেছেন বলা যায়। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের আলোয় তিনি চিনতে চেয়েছেন দুঃখে-দ্বন্দ্বে-ক্রন্দনে সিক্ত গণিকাদের মনোজগৎটিকে। গণিকাদের তিনি শুধু নষ্ট মেয়ে হিসাবে দেখেননি, দেখতে চেয়েছেন আর পাঁচটা ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত সাধারণ নারী হিসাবে। প্রাচীন কাব্যে যে গণিকাদের পাওয়া যেত শাসকের হাতের পুতুল হিসাবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে পড়ে সেই গণিকাদের মধ্যে প্রকাশ পেল তাঁদেরই অন্তর্দ্বন্দ্ব, অনুশোচনা ও আত্মশুদ্ধি এক ব্যক্তিত্বময় অভিব্যক্তি। তিনি কেন প্রাচীন সাহিত্য থেকে আবিষ্কৃত গণিকাদের অন্যভাবে প্রকাশ করলেন, তার জবাব কবি নিজেই দিয়েছেন–“রমণী পুষ্পতুল্য, তাহাকে ভোগে বা পূজায় তুল্যভাবে নিয়োগ করা যাইতে পারে। তাহাতে যে কদর্যতা বা পবিত্রতা প্রকাশ পায়, তাহা ফুলকে বা রমণীকে স্পর্শ করে না–ফুল বা রমণী চিরপবিত্র, চির অনাবিল।… যে সহজ-পূজ্য তাহাকে ভোগ্যের পদবিতে যে নামাইয়া আনে সেও একটা আনন্দ পায় বটে, কিন্তু সে আনন্দ অতি নিকৃষ্ট শ্রেণির। পতিতা হইলেও নারীর স্বাভাবিক পবিত্রতা তাহার ভিতর প্রচ্ছন্ন থাকে। … পাপের অন্যায়ে সে তাহার আত্মাকে কলুসিত করিয়াছে বটে, কিন্তু তাহার আত্মা একেবারে বিনষ্ট হইয়া যায় নাই–তাহার আত্মা বাষ্পচ্ছন্ন দর্পণের ন্যায় ক্ষণিকের জন্য তাহার সহজ স্বচ্ছতা ও শুচিতা হারাইয়াছে।”
রবীন্দ্রনাথের ‘বিচারক’ গল্পে একজন গণিকার কথা পাওয়া যায়। গণিকা ক্ষীরোদা। ক্ষীরোদাই এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। ক্ষীরোদার যে জীবনবৃত্তান্ত এই গল্পের উপজীব্য তাতে গৃহস্থ ঘরের মেয়ে কেন গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করে তার শেষ পরিণতি কী হয় সেই প্রসঙ্গই বিশ্লেষিত হয়েছে কবির কলমে। গল্পটির রচনাকাল উনিশ শতকের শেষ দশকে। উনিশ দশক জুড়ে গণিকা সম্পর্কে যে তাচ্ছিল্য ব্যঙ্গ ঘৃণা বর্ষিত হয়েছে, শেষ দশকে রচিত গণিকা ক্ষীরোদার চরিত্র তা থেকে আলাদা। আলাদা এই কারণে যে, পূর্ববর্তী লেখকেরা সমাজে গণিকাদের প্রবল উপস্থিতিকে স্বীকার করে নিলেও সাধারণভাবে তাঁদের প্রতি মোটেই সহানুভূতিশীল ছিল না। তাঁদের সামাজিক দৃষ্টিকোণ কিছুটা ভিক্টোরিয়ান শুচিতাবোধ, আবার কিছুটা গোঁড়া হিন্দু রক্ষণশীলতায় আচ্ছন্ন। রবীন্দ্রনাথ গণিকাদের দরদি হৃদয় দিয়ে বিশ্লেষণ করেন। এতদসত্ত্বেও রবীন্দ্র কথাসাহিত্যে গণিকা চরিত্র আর সৃজিত হয়নি। আশি বছরের দীর্ঘ জীবনের অর্ধাংশ রবীন্দ্রনাথ কাটিয়েছেন বিশ শতকের দ্রুত পরিবর্তিত আর্থ সামাজিক পরিবেশে। এমতাবস্থাতেও সময়ের প্রেক্ষাপটে গণিকা চরিত্র তাঁর কোনো গল্প-উপন্যাসে চিত্রিত হয়নি।
শরৎসাহিত্যে অবহেলিত, বঞ্চিত, দুর্ভাগা নারীরাই প্রধান উপজীব্য হয়ে উঠেছে। মানবিক রূপ নিয়ে এসেছে পতিতা তথা গণিকাদের কথাও। শরৎ চট্টোপাধ্যায়ের সময়ে পতিতা শব্দের অর্থও গেল বদলে। গণিকা বা পতিতা মানে কেবল দেহোপজীবিনীই নয়, দেহ ছাপিয়ে এই অপবাদ আরও বিস্তার করেছে নারীর জীবনে। শরৎসাহিত্যে গণিকারা হল ‘দেবদাস’-এর চন্দ্রমুখী, শ্রীকান্ত’-এর পিয়ারি বাইজি, ‘আঁধারে আলো’-র বিজলী।
শরবাবুর সময়ে ‘পতিতা’ শব্দটি সামাজিক অর্থে গৃহীত হয়ে গেছে। পতিতা হিন্দুসমাজের দৃষ্টিতে ‘সতী’ শব্দের বিপরীত অর্থবোধক। ভারতীয় নারীদের বিবাহমন্ত্রনির্দিষ্ট স্বামীই একমাত্র গ্রহণীয় পুরুষ। সুতরাং হিন্দুসমাজে নারী দেহ এবং মনে একজন মাত্র পুরুষকে সাধনা এবং কামনা করতে পারবে। অন্যথা সে পতিতা। সমাজের বিচারে স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষকে মনে মনে কল্পনা করলেও সে নারী পতিতা। পতিব্রতা নারীর মর্যাদা নষ্ট হয়। নারী পতিতা হয়। হিন্দুশাস্ত্রে শুধুমাত্র মনে মনে কোনো পরপুরুষকে কামনা করলেও সেই নারী পতিত হয়। রেণুকার কাহিনি সংক্ষেপে দু-চার লাইনে স্মরণ করতে পারি। ব্রাহ্মণ জমদগ্নির স্ত্রী ক্ষত্রিয় রেণুকা। পরশুরাম হলেন তাঁদের পুত্রসন্তান। যিনি স্বাভাবিকভাবেই ব্ৰহ্মক্ষত্রিয়। অন্য চারপুত্ররা হলেন—বসু, বিশ্ববসু, বৃহদ্ভানু ও বৃহৎকশ্ব। যাই হোক, যেটা বলতে চাই সেটা হল–একবার চিত্ররথ নামক এক রাজাকে সস্ত্রীক জলবিহার করতে দেখে পরশুরামের মা রেণুকা কামার্তা হয়ে পড়েন। ধ্যানযোগে এ দৃশ্য দর্শন করে পরশুরামের পিতা জমদগ্নি তাঁর পুত্রদের মাতৃহত্যার আদেশ দেন। বসু, বিশ্ববসু, বৃহদ্ভানু ও বৃহৎকৰ্থ–এই চারপুত্র পিতার আদেশ অগ্রাহ্য করলেও পরশুরাম তাঁর কুঠার দিয়ে মায়ে মাথা-ধড় আলাদা করে দেন। বাকি কাহিনি এখানে বলার প্রয়োজন নেই।
শরৎসাহিত্যে প্রথম পরিচিত গণিকা বা পতিতা হল দেবদাস গ্রন্থের চন্দ্রমুখী। যেভাবে দেবদাসের সঙ্গে চন্দ্রমুখীর প্রথম পরিচয় পর্ব বর্ণিত হয়েছে, তাতে মনে হয় শৌণ্ডিকালয় বা শুড়িখানায় প্রথম পরিচয়ের দ্বিধা, সংকোচ, সংস্কারের আঘাত ও বিবেকের তাড়না যেন লেখকজীবনের বাস্তব ঘটনা। শুধুমাত্র মানসচক্ষে বিচারবুদ্ধি দিয়ে চন্দ্রমুখীর চরিত্রায়ণ এমন জীবন্তভাবে মোটেই সম্ভব নয়। চন্দ্রমুখী শুধুমাত্র শরীরী টানেই দেবদাসকে মুগ্ধ করেনি, ব্যক্তিগত আকর্ষণ দেবদাসের জীবনে কম প্রভাব বিস্তার করেনি। চন্দ্রমুখীর সহৃদয় ব্যবহার, সমাহিত আলাপ, দেবদাসকে সুপথে নিয়ে যাওয়ার আন্তরিক চেষ্টা করেছিল। স্নেহবুভুক্ষু দেবদাসের মনে সবচেয়ে বেশি মোহ বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। দেবদাস যেমন চন্দ্রমুখীর শরীরকে কেন্দ্র করে পিচ্ছিল পথে নেমেছিল, তেমনই প্রেমেও পড়েছিল। যে চন্দ্রমুখী একদিন শুধুমাত্র শরীরের আবেদনে রূপের পসরা সাজিয়ে সমাজের বাইরে দাঁড়িয়েছিল, সেই নারী একসময় দেবদাসকে কেন্দ্র করে একনিষ্ঠ প্রেমের সন্ধানে সমস্ত বিলাস, বিভ্রম ও ঐশ্বর্যকে পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছিল। হিন্দুঘরের বিবাহিতা নারী যেমন বিবাহের পর স্বামীর চরণে নিজেকে নিঃস্ব করে বিলিয়ে দেয়, ঠিক তেমনই চন্দ্রমুখীও দেবদাসকে দেবতার আসনে বসিয়ে নিজেকে নিঃস্ব করে দিয়েছিল। তবুও চন্দ্রমুখীর মলিনত্ব ঘুচল না। কারণ সমাজ তাঁর দুঃখাভিশপ্ত কপালে কলঙ্কতিলক পরিয়ে দিয়েছে। সে তো আর কেউ নয়–গণিকা, বারাঙ্গনা, পতিতা।
শ্রীকান্ত গ্রন্থে এক বাইজিকে পাই, যার নাম পিয়ারী। দেবদাসে চন্দ্রমুখীর ঘরে ঢোকার সময় লেখকের যে জড়তা দেখেছি, শ্রীকান্তে এসে সেই জড়তা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে সে। মজঃফরপুরে বন্ধু মহাদেবের ঘরে পিয়ারী বাইজির সামনে শ্রীকান্ত বেশ অপ্রকৃতস্থ। মাতলামি, মাতালের অর্থহীন প্রলাপ, লাম্পট্যের অভদ্র ইঙ্গিত এবং নর্তকীর বিলোল আভাস শ্রীকান্তকে আর বিভ্রান্ত করে না। পিয়ারি বাইজি সঙ্গে পরিচয়ও প্রগাঢ় হল। পিয়ারী বাইজি ওরফে রাজলক্ষ্মী ছিল শ্রীকান্তের বাল্যকালের খেলার সাথী, আজ সে যৌবনের অভিসারিকা। ব্রাহ্মণকন্যা ভদ্রঘরে জন্ম নিয়েও বিবাহিতা রাজলক্ষ্মী অবস্থার বিপর্যয়ে নর্তকী, গণিকা, দেহবিলাসিনী। পিয়ারী বাইজি আর রাজলক্ষ্মী এক দেহে পৃথক সত্তা। জীবিকার্জনে রাজলক্ষ্মীকে হতে হয়েছিল পিয়ারী বাইজি। দেহ ব্যাবসা নিজের দেহকে সে অপবিত্র করেছে। সমাজে চোখে সে হীনা, আত্মীয়স্বজনের কাছে রুদ্ধদ্বার। যদিও বারবিলাসিনী নর্তকীজীবনকে রাজলক্ষ্মী কখনো স্বচ্ছন্দ মনে গ্রহণ করেনি। তাই সমাজের বাইরে দাঁড়িয়েও রাজলক্ষ্মী কখনো সমাজবন্ধনকে পায়ে দলিত করতে চেষ্টা করেনি। শ্রীকান্ত নানাভাবে রাজলক্ষ্মীকে নিজের দিকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু রাজলক্ষ্মী তাঁর উচ্ছিষ্ট দেহ ধ্যানের দেবতাকে উৎসর্গ করতে পারেনি। নিজের অতীত জীবনের স্মৃতি প্রতিনিয়ত পীড়িত করত লজ্জা দিত রাজলক্ষ্মীকে।
‘আঁধারে আলো’ গ্রন্থে বিজলীও গণিকা। জমিদারপুত্র অনভিজ্ঞ সত্যেনকে বিজলী গঙ্গাতীরে প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করছিল। সুন্দর দেহ বিনিময়ে সে বহুপুরুষকে আকর্ষণ করেছে। দক্ষ মৎস্যশিকারির মতো পুরুষ তুলতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। একদিন ছল করে বিজলী সত্যেনকে তাঁর ঘরে আহ্বান করে। সত্যেন বিজলীর ঘরে ঢুকে জানতে পারল সে এক গণিকার ঘরে উপস্থিত হয়েছে। বিজলী মনে করেছিল সত্যেন আর পাঁচজন পুরুষের মতো দেহলোলুপ। কিন্তু অতর্কিতে বিজলী প্রথম দেখল তাঁর দেহসীমা অতিক্রম করে সত্যেন দাঁড়িয়ে আছে। বিজলীও চন্দ্রমুখীর মতো অমৃতস্পর্শে জেগে উঠেছিল। বিজলী বাইজী পারিজাত স্পর্শে মরেছে। চন্দ্রমুখীও একদিন দেবদাসের স্পর্শে মরেছিল। দানে রাজলক্ষ্মী অতুলনীয়া, চন্দ্রমুখী ত্যাগে গরীয়সী, বিজলী কিন্তু সত্যেনের কাছে কোনোরূপ প্রতিদান প্রার্থনা করেনি। সেই নিস্পৃহ প্রেমই বিজলীকে মহীয়সী করেছে। মোটের উপর শরৎবাবুর তিনজন গণিকার পিছনে ছিল নারীর প্রচ্ছন্ন সত্তা এবং প্রচ্ছন্ন সত্তার বিশ্লেষণ করে তিনি গণিকার নতুন রূপ দেখিয়ে দিয়েছেন।
সর্বোপরি শরৎবাবুর ‘পতিতা’ চরিত্রগুলি পতিতা হিসাবে ততটা পরিস্ফুট হয়নি, যতটা হয়েছে নারীচরিত্র। সেখানে কোনো নারী সামাজিক অর্থে পতিতা না অ-পতিতা, তা সাহিত্যিকের কাছে নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর বিষয়। জীবননাট্যলীলায় তাঁর ভূমিকাটি সাহিত্যিক সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে অঙ্কিত হয়েছে কি না, সেটাই সাহিত্যসমাজে বিবেচ্য বিষয়। শরত্যাবু অবিবাহিত বা বিবাহিত এই প্রশ্নের সমাধান না করেও বলা যায় যে, নারীর প্রতি তাঁর সহজ আকর্ষণ প্রবলতম। নারী-মন সন্ধানে শরত্যাবু নারীজগতের বহু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন। শরৎচন্দ্র ব্ৰহ্মপ্রবাসকালে ‘বেঙ্গল সোসিয়াল ক্লাব’-এ স্বরচিত ‘নারীর ইতিহাস’ পাঠ করেন এবং সাতশত পতিতা নারীর জীবনকাহিনি সংবলিত একটি পুস্তক প্রণয়ন করেছিলেন। ঘটনার বিপর্যয়ে শরৎচন্দ্র প্রথম যৌবনে সমাজচ্যুত হয়েছিলেন। সেই অবসরে নারীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় সাধারণত সমাজের বাইরে।
সেসময়ের সাহিত্যিকদের সাহিত্যে যেমন গণিকারা স্থান পেয়েছিল, ঠিক তেমনইভাবে সাহিত্যিকদের জীবনেও গণিকারা স্থান পেয়েছিল। সুরাপান, গণিকাসক্তি ও রক্ষিতা-পোষণ সেকালে এক ধরনের সামাজিক স্বীকৃতি লাভই করেছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তো গণিকাঁচর্চা গৌরব ও মর্যাদার প্রতীক হিসাবেও বিবেচিত হত। আঠারো-উনিশ শতকে কলকাতার নাগরিক জীবন এমনকি মফসসল শহরেও গণিকাঁচর্চা জীবনযাত্রার অনিবার্য প্রয়োজনীয় অনুসঙ্গ হয়ে ওঠে। ভারতপথিক রাজা রামমোহন রায় নিকির নাচ দেখেই সন্তুষ্ট ছিলেন না, বাঁধা রক্ষিতাও ছিল তাঁর। এই যবনী রক্ষিতার গর্ভে একটি পুত্রসন্তানও ‘উপহার’ দিয়েছিলেন। গণিকা সুকুমারী দত্তের প্রেমে মজেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। মরমি কবি হাসন রাজা তো হর হামেশাই গণিকা-দর্শনে গণিকালয়ে যেতেন। কবি নজরুল ইসলামও বাদ যাননি, তিনি গণিকা কাননবালার ঘরে নিয়মিতই যেতেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনে গণিকা ও বৈধতাও প্রশ্নহীন নয়। সাহিত্যিক জগদীশ গুপ্তও রক্ষিতা পুষতেন। রাজনারায়ণ বসু লিখছেন–“এক্ষণকার লো পানাসক্ত ও পূৰ্ব্বাপেক্ষা বেশ্যাসক্ত। যেমন–পানদোষ বৃদ্ধি পাইতেছে, তেমনি বেশ্যাগমনও বৃদ্ধি হইতেছে। সে কালে লোকে প্রকাশ্যরূপে বেশ্যা রাখিত। বেশ্যা রাখা বাবুগিরির অঙ্গ বলিয়া বিবেচিত হইত, এক্ষণে তাহা প্রচ্ছন্নভাবে ধারণ করিয়াছে, কিন্তু সেই প্রচ্ছন্নভাবে তাহা বিলক্ষণ বৃদ্ধি পাইতেছে। বেশ্যাগমন বৃদ্ধি পাইতেছে, তাহার প্রমাণ বেশ্যাসংখ্যার বৃদ্ধি। পূৰ্ব্বে গ্রামের প্রান্তে দুই এক ঘর দৃষ্ট হইত; এক্ষণে পল্লিগ্রাম বেশ্যার সংখ্যা বিলক্ষণ বৃদ্ধি পাইয়াছে। এমনকি স্কুলের বালকদিগের মধ্যেও এই পাপ প্রবলাকারে ধারণ করিয়াছে।”