প্রবাহণ (স্থান: পঞ্চাল (উত্তরপ্রদেশ)।। কাল: ৭০০ খৃষ্টপূর্ব)
‘একদিকে ঘন নিবিড় সবুজ বন, মহুয়ার মাদক গন্ধ, পাখীর কুজন, অন্যদিকে প্রবাহিণী গঙ্গার স্বচ্ছ ধারা, তীরে আমাদের হাজার হাজার কপিলা-শ্যামা গাভীগুলি চারে বেড়াচ্ছে, আর হুংকার দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিশাল বলিষ্ঠ বৃষভ। প্রবাহণ! এই মনোরম দৃশ্য? দেখে নয়ন তৃপ্ত করা উচিত। তুমি দেখছি দিনরাতই সাম গান (উদ্গীথ) গাইছ, অথবা বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র মন্ত্র আবৃত্তি করছ।’
‘লোপা, তুমি যে চোখ দিয়ে এই দৃশ্য দেখ– আমি তোমার সেই চোখের দিকে তাকিয়েই তৃপ্তি পাই।’
‘হুঁ! কথায় তোমার সঙ্গে পারা মুকিল—খুব কথা বানাতে পারো। যখন তোমার সহপাঠীদের সঙ্গে মারালের মতো সুর করে পুরনো শ্লোক ও মন্ত্রের পাঠ পড়তে দেখি তখন মনে হয় আমাদের প্রবাহণ স্তন্যপায়ী শিশুই থেকে যাবে।’
‘তাই না-কি! প্রবাহণ সম্পর্কে তোমার সত্যিই এই ধারণা?’
‘ধারণা যাই হোক, তবে আমার এ ধারণাও আছে যে, প্রবাহণ আমার আর সব সময়ের জন্যে প্রবাহণ আমারই থাকবে।’
‘এই আশা ও বিশ্বাসেই, লোপা, প্রভূত শ্রম ও বিদ্যার্জনের শক্তি পাই। আমি নিজের মনকে জোর করে সংযত করতে অভ্যস্ত। তা না হলে কতবার আমার মন পুরনো গাথা, মন্ত্র, উদ্গীথগুলি বার বার মুখস্থ করার হাত থেকে রেহাই পেতে চেয়েছে। মন যখন পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, শরীর যখন অবসন্ন, তখন মনে হয় সব কিছু ছেড়ে দিয়ে বসে। থাকি, সেই সঙ্কট মুহূর্তে লোপার সঙ্গে কয়েক মুহূর্ত মিলনের আশাই আমার প্রেরণা জোগায়।’
‘আর এই সময়টার জন্য আমিও সর্বদাই অপেক্ষা করে থাকি।’
লোপার পিঙ্গল চোখ দুটির দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল দূর লক্ষ্যে হাওয়ায় তার দীর্ঘ স্বর্ণাভ কেশরাশি উড়ছিল। মনে হচ্ছিল লোপা যেন কোনো সুদূরে হারিয়ে গেছে। প্রবাহণ। তার চুলগুলির ওপর আঙ্গুল বুলাতে বুলাতে বলল, ‘তোমার তুলনায় নিজেকে আমার বামন মনে হয়?’
‘বামন! না গো না, প্রবাহণ।’ —বলতে বলতে লোপা তার সুডৌল গাল প্রবাহণের গায়ের ওপর রেখে বলতে লাগল, ‘একদিন আমি তোমার ওপর অভিমান করতাম–মনে পড়ে? যেদিন তুমি পিসীমার সঙ্গে এলে আমাদের বাড়ি, আমি আমার শিশু চোখ দিয়ে আর এক আট বছরের বালককে দেখেছিলাম। তখন আমার বয়স তিন কি চার। কিন্তু সেই স্মৃতি সেদিনের শিশু-চিত্তকে রঞ্জিত করতে এতটুকু ভুল করে না। আজও মনে পড়ছে–এখনো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, তোমার সেই স্বর্ণােভ কুঞ্চিত কেশ, টিকোলো নাক, পাতলা রাঙা ঠোঁট, বড় বড় উজ্জ্বল নীল চোখ, আর তপ্ত গৌরবরন দেহ। আমার কেমন লজ্জা হল। মা তোমাকে আদর করে চুমু খেয়ে বললেন, পুত্র প্রবাহণ, এ তোমার মামাত বোন। ওর লজ্জা হয়েছে, ওর লজ্জা দূর কর।’
‘আর আমি তোমার কাছে এগিয়ে গেলাম। তুমি মামীমার সুগন্ধিত কেশরাশির আড়ালে মুখ লুকিয়ে ফেললে।’
‘আমি মুখ লুকালেও মা-র চুলের ফাঁক দিয়ে দেখছিলাম তুমি কি করা। বাড়িতে মা, ও দাসদাসীদের সন্তানেরা ছাড়া আর কেউ ছিল না। বাবার বিদ্যাপীঠ তখনও গড়ে ওঠেনি। আমার একলা মনে হত, তাই তোমাকে দেখে কী খুশীই না হয়েছিলাম!’
‘তবু তুমি মুখ লুকিয়েছিলে। আমি তোমায় দু’চোখ ভরে দেখছিলাম। তোমার শিশুনেত্ৰে ভালোই দেখাচ্ছিল। কাছে গিয়ে তোমার কাঁধে হাত রাখলাম। আমার মনে পড়ে। কি, মা ও মামীম কি বলেছিল? দু’জনেই মুচকি হেসে বলে উঠল, ‘হে ব্ৰহ্মা আমাদের সাধ পূর্ণ কর।’ তখন সাধ পূর্ণ কর প্রার্থনার মানে বুঝিনি।’
‘না প্রবাহণ, আমার মনে পড়ছে না। আমার পক্ষে এইটাই যথেষ্ট যে, আমার কাঁধের ওপর তোমার নরম হাতের স্পর্শ এখনও মনে আছে।’
‘আর তুমি সঙ্কোচে একেবারে জড়সড়ো হয়ে গেলে।’
‘তুমি আমার হাতটা তোমার হাতের মধ্যে নিয়েছিলে, কিন্তু মুখে শব্দ ছিল না, যেন ঠোঁট দুটো সেলাই করা। তখন মা কি বলেছিল মনে আছে?’
‘মামীমার প্রতিটি কথাই মনে আছে, তাঁকে কি আমি কখনও ভুলতে পারি! মা আমাকে গাৰ্গ মুমার কাছে রেখে ফিরে গেল, কিন্তু মামীমার অপার স্নেহ আমার মায়ের স্থান দখল করেছিল। মামীমাকে আমি কেমন করে ভুলব?’ প্রবাহণের চোখে জল ভরে এল, সে লোপার ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলল, ‘লোপা তোমার মতোই মামীমার মুখ ছিল; আমরা দু’জনে এক বিছানায় শুতাম। রাত্রে কতবারই না। আমার চোখের পাতা খুলে যেত, কিন্তু মামীমাকে আসতে দেখলেই আবার চোখ বুজতাম। যখন মামীমার মৃদু নিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর ঠোঁটের স্পর্শ গালে পেতাম তখন চোখ মেলতাম। মামীমা বলত, ‘বৎস জেগে আছে!’। তারপর তোমার গালে চুমু খেত, কিন্তু তুমি বেঁহুস হয়ে ঘুমোতে।’
লোপার চোখও অশ্রুপূর্ণ হয়ে এলো, সে উদাস স্বরে বলল, ‘মাকে আমি এত, কম দেখেছি যে মনেই পড়ে না।’
‘ হ্যাঁ, তুমি যে কথা বলছিলো। যেদিন প্রথম এই বাড়িতে এলাম সেদিনের কথা। আমাকে তোমার সামনা-সামনি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তোমার মা বলল, বৎস! এই তোমার বোন–তুমি ওর সঙ্গে ঘোড়া-ঘোড়া খেল।’
‘ হ্যাঁ, তুমি আমাকে ঘোড়া-ঘোড়া খেলতে ডাকলে। আমি মা-র চুলের ভেতর থেকে আমার মুখ বের করলাম। তুমি তারপর ঘোড়া হলে, আমি তোমার পিঠে চেপেছিলাম।’
‘আর আমি তখনই তোমাকে পিঠে চাপিয়ে বাইরে নিয়ে গেলাম।’
‘আমি খুব দুষ্ট ছিলাম, না?’
‘তুমি সব সময়ই ভয়হীন ছিলে, লোপা! মামার ভয়ে আমি নিজের পড়াশুনায় লেগে থাকতাম আর যখন ক্লান্ত হয়ে পড়তাম তখন তোমার কাছে চলে আসতাম।’
‘তোমাকে দেখার জন্যে আমিও তোমার কাছে এসে বসতে লাগলাম।’
‘আমার মনে হচ্ছে লোপা, তুমি যদি আমার অর্ধেক পরিশ্রম করতে, তাহলে মামার শিষ্যদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হতে পারতে।’
‘কিন্তু তোমার থেকে শ্ৰেষ্ঠ নয়!’ লোপা প্রবাহণের চোখ দুটির দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে বলল, ‘আমি তোমার চেয়ে এগিয়ে যেতে চাই না।’
‘কিন্তু তাতে আমি বেশি খুশী হতাম।’
‘না, আমাদের দু’জনার আপনি আপন পৃথক সত্তা কিছু নেই।’
‘লোপা, তুমি আমায় উৎসাহ দিয়েছ আমার শরীরে শক্তি দিয়েছ। পড়া মুখস্থ করতে এবং অন্যকে দিয়ে মুখস্থ করাতে খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত ভুলে যেতাম। তুমি আমাকে পাঠগৃহের সেই অন্ধকার থেকে জোর করে টেনে বার করতে, কখনও বা উদ্যানে কখনও বা গঙ্গার ধারে নিয়ে যেতে। এ-সব আমার খুবই ভালো লাগত। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে আমি চেয়েছিলাম তিনখানি বেদ ও ব্রাহ্মণের সমস্ত বিদ্যা আয়ত্ত করার কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করতে।’
‘তোমার সে কাজ তো শেষ হয়েছে। বাবা বলেন, প্রবাহণ এখন আমার সমতুল্য।’
‘তা আমিও বুঝতে পারছি। ব্ৰাহ্মণ্য-বিদ্যা আয়ত্ত করতে আর সামান্যই বাকি কিন্তু বিদ্যা শুধু ব্ৰাহ্মণ্যতেই শেষ হয় না।’
‘এই কথা আমিই তোমায় বলতে চাইছিলাম। আচ্ছা, এখনও কি তুমি পলাশ-দণ্ড আর রুক্ষ কেশ নিয়ে চলবে?’
‘কিছু ভাবতে হবে না লোপা! পলাশ-দণ্ড এখন ছাড়লেই হল। আর আমার এই ষোল বছরের রুক্ষ চুলগুলিতে অনায়াসে তুমি সুগন্ধি তেল দিতে পার।’
‘প্রবাহণ, রুক্ষ চুলের ওপর এত বেশি জোর দেওয়া হয় কেন? যদি সংযমের কথা বল–তুমি তো আমার ঠোঁটে চুমু খেতে কখনও ছাড়নি।’
‘তার কারণ ছোটবেলার অভ্যাস।’
‘তাহলে আচার্যকুলের অন্যান্য ছাত্ররা এ ব্ৰত কি কঠোরভাবে পালন করে?’
‘হ্যাঁ লোপা, তা না করে কোনো উপায় নেই বলে করে। এ-সব হল সম্মান প্রতিষ্ঠার জন্য। সাধারণ মানুষ একে ব্ৰাহ্মণ কুমারদের কঠিন তপস্যা বলে মনে করে।’
‘তাই যদি হয় তবে কুরুরাজ আমার বাবাকে জনপদ, হীরে, সোনা, দাস-দাসী, ঘোড়া, রথ উপটৌকন দিয়ে চলেছেন কেন? আমাদের অনেক দাসী আছে, আবার কিছুদিন। আগে কুরুরাজ আরও তিন জন দাসী পাঠিয়েছেন তাদের তো কোনো কাজই নেই।’
‘ওদের বেচে দাও লোপা। ওরা তরুণী। এক-এক জনের জন্য তিরিশ নিষ্ক (স্বর্ণমুদ্রা) পেয়ে যাবে।’
‘আমার আপশোস হয়; আমরা ব্ৰাহ্মণ, শিক্ষিত এবং জ্ঞানী, যেহেতু আমাদের জ্ঞানার্জনের সুযোগ আছে। কিন্তু যখন আমি এ-সব ক্রীতদাসদের দেখি তখন ব্ৰহ্মা, ইন্দ্র বরুণ ও অন্যান্য দেবতাদের ওপর ক্রুদ্ধ হই। আজ দেবকুল, বশিষ্ঠ ভরদ্বাজ, ভুণ্ড, অঙ্গিরা ও ঋষিদের এবং বাবার মতো আজকের সমস্ত শ্রোত্রিয় ব্ৰাহ্মণ মহাশালদের (ধনিক) বিরুদ্ধে আমার ঘৃণা জেগে ওঠে। সর্বত্রই ব্যবসা, দরকষাকষি, লাভ, লোভ। সে দিন কালিদাসীর স্বামীকে বাবা কোশলাদেশীয় এক বণিকের হাতে পঞ্চাশ নিষ্কে বেঁচে দিলেন। কালী আমার কাছে কান্নাকাটি করায় আমি তার হয়ে বাবাকে অনেক বললাম। তিনি বললেন, ‘সমস্ত দাসদের ঘরে রেখে দিলে স্থান সন্ধুলান হবে না। আর যদি বিনা কাজে রাখা হয় তাহলে ঐ টাকাগুলোও লোকসান।’ বিদায়ের পূর্ব রাত্রে তারা স্বামী-স্ত্রী কি কান্নাটাই না কাঁদল। তাঁদের দু’বছরের সেই মেয়েটি-সকলে যাকে দেখলে বলে বাবার চেহারার সঙ্গে মিল আছে সেই বাচ্চাটাও কি কান্নাটা কাঁদল! কিন্তু কালীর স্বামীকে বেচে দেওয়া হল। যেন সে মানুষ নয়, পশু। ব্ৰহ্মা যেন তাকে আর তার শত শত প্রজাকে এই জন্যই সৃষ্টি করেছেন। এ আমি মানতে রাজী নই প্রবাহণ! আমি তোমার মতো বেদ মুখস্থ করিনি। কিন্তু তা শুনে এই বুঝেছি। যে, চোখে দেখতে পাওয়া যায় না, এই রকম বস্তু বা শক্তির প্রলোভন বা ভয় দেখানো। হয়েছে।’
‘প্রবাহণ লোপার আরক্ত গালটি নিজের চোখের সঙ্গে চেপে বলল, ‘আমাদের প্ৰেম, মতভেদ রাখার জন্যই হয়েছে।’
‘মতভেদ আমাদের প্রেমকে আরও গাঢ় করেছে।’
‘ঠিক বলেছ লোপা! অন্যে যদি এ কথাই বলত তাহলে আমি রাগ করতাম, কিন্তু সেই কথাগুলিই যখন দেখি যে তোমার মুখ দিয়ে আমার সমস্ত দেবতা, ঋষি এবং আচার্যদের ওপর তীক্ষ্ণ বাণের মতো নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, তখন তোমার ও অধরে চুম্বন করতে বার বার ইচ্ছা হয় কেন?’
‘তার কারণ হল, আমাদের নিজেদের মধ্যেই দুটো মতের দ্বন্দ্ব চলছে। আমরা এ দ্বন্দের প্রতি সহিষ্ণু, কেননা আমরা একে অপরকে আমাদের অভিন্ন সত্তা বলে মনে করি।’
‘তুমি তো কখনও শিবির দোশালা, কাশীর চন্দন, সামুদ্রিক মুক্ত দিয়ে নিজেকে বিভূষিতা করনি। এ-সবে তোমার এত উদাসীনতা কেন প্রিয়ে?’
‘ওগুলোতে কি আমায় সুন্দর দেখাবে…?’
‘আমার কাছে তুমি সর্বদাই সুন্দর।’
‘তাহলে এই বোঝা চাপিয়ে শরীরকে কষ্ট দিয়ে লাভ কি? সত্যি বলছি, তুমি যখন একটা ভারী বোঝাকে মুকুট বলে মাথায় পর তখন আমার খুবই খারাপ লাগে।’
‘অথচ অন্য মেয়েরা কাপড় গয়নার জন্যে কতই না ঝগড়া করে।’
‘আমি সে রকম মেয়ে নাই।’
‘তুমি হচ্ছে সেই রকম মেয়ে যে পঞ্চাল রাজার হৃদিরাজ্য শাসন করে!’
‘আমি প্রবাহণের স্ত্রী, পঞ্চালদের রাণী নই।’
‘বেশ তাই প্রিয়তমা! কিন্তু এমন দিনের কথা আমরা কল্পনাও করিনি। আমি যে পঞ্চাল রাজপুত্র–এ কথা মামা গোপন রেখেছিলেন।’
‘বেশ তাই প্রিয়তমে! কিন্তু এমন দিনের কথা আমরা কল্পনাও করিনি। আমি যে পঞ্চাল রাজপুত্র–এ কথা মামা গোপন রেখেছিলেন।’
‘সে সময় বাবা আর কি করতে পারতেন? পঞ্চাল রাজার শতেক রাণীর মধ্যে পিসীমা অন্যতমা। আর তোমার চেয়ে বয়সে বড় ছিল পঞ্চাল রাজের দশটি ছেলে। তাই কে ভেবেছিল তুমি একদিন পঞ্চাল রাজ-সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হবে।’
‘আচ্ছা লোপা, এই রাজভবন তোমার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না কেন?’
’যেহেতু, গার্গ্য ব্ৰাহ্মণের প্রাসাদে–যেখানে পড়ানো হত বেদ আর ব্ৰাহ্মণ্য–আমার ক্লান্তি ও বিরক্তি এসেছিল সেখানেই। আমাদের জন্যে ঐ প্রাসাদ ছিল বটে, কিন্তু ক্রীতদাসদাসীদের জন্যে? আর আমাদের সেই বিদ্যাপীঠের প্রাসাদের তুলনায় এই রাজপ্রাসাদ হাজার গুণের বড়। এই প্রাসাদের একমাত্ৰ তুমি আর আমি ছাড়া বাকি সবাই দাসদাসী। দু’জন অদাসের জন্যে দাসদাসীতে ভরা এই ভবন অ-দাস ভবন হয়ে যায় না। কিন্তু প্রবাহণ আমার খুব আশ্চর্য লাগে তোমার কঠোর হৃদয় দেখে।’
‘তাই তো কঠোর বাক্য-বাণ সহ্য করতে পারছি।’
‘না, মানুষের এ রকম হওয়া উচিত নয়।’
‘আমি শুধু মানুষ হতে চাইনি, চেয়েছিলাম যোগ্য মানুষ হতে! যদিও যোগ্যতা অর্জনের সময় এ কথা এক মুহূর্তের জন্যেও মনে হয় নি যে, আমাকে একদিন এই রাজভবনে আসতে হবে।’
‘তোমার অনুশোচনা হচ্ছে না, আমার সঙ্গে প্রেম করার জন্যে?’
‘শিশু জন্মমাত্র বিনা আয়াসে মাতৃস্তন পায়–আমিও বিনা প্রয়াসে তোমার প্রেম লাভ করেছি। তোমার ভালোবাসা আমার প্রতিদিনের অভ্যন্ত জীবন, শরীরের অঙ্গ।‘
‘আমি সংসারী পুরুষ, তবু আমি তোমার প্রেমের কদর বুঝি। মনের গতি সব সময় এক রকম থাকে না। যখন কোনো অবসাদ আসে, জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে দাঁড়ায় তখন তোমার প্রেম ও সুবিচার আমাকে মস্ত সম্বল যোগায়।’
‘কিন্তু আমি তোমার যতটা অবলম্বন হতে চাই–তা যে হতে পারছি না। আর এর জন্যে আমি বেদনা বোধ করি, প্রবাহণ।’
‘তার কারণ, রাজ্যশাসন করার জন্যেই আমার জন্ম হয়েছিল।’
‘কিন্তু একদিন তো তুমি মহাব্ৰাহ্মণ হতে চেয়েছিলে!’
‘তখন আমার জানা ছিল না যে, পঞ্চালপুর রাজভবনের উত্তরাধিকারী আমি।’
‘কিন্তু রাজকার্যের বাইরেও যে তুমি হাত দিচ্ছ, এতে তোমার দরকার কি?’
‘অর্থাৎ ব্ৰহ্মা থেকে ব্ৰহ্মের কল্পনা! লোপী, এটা কিন্তু রাজকার্যের বাইরে নয়। রাজ্যকে অবলম্বন দেওয়ার জন্যেই আমাদের পূর্বপুরুষরা বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রকে এতটা সম্মানের পদে অধিষ্ঠিত করেছিল। এই সমস্ত ঋষিরা-ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ প্রভৃতি দেবতাদের নামে জনগণকে রাজজ্ঞা পালন করতে শেখাত। তখনকার দিনে রাজারা সাধারণের বিশ্বাসভাজন হওয়ার জন্যে বড় বড় ব্যয়সাধ্য যজ্ঞ করত। আজকাল আমরাও করে থাকি এবং ব্ৰাহ্মণকে দক্ষিণা দিই। এই যজ্ঞ ও পুরোহিতদের মূল্যবান জিনিস দক্ষিণা দেওয়ার মধ্য দিয়ে জনগণের মনে দেবতাদের অলৌকিত শক্তির ওপর বিশ্বাস সৃষ্টি করাতে চায়, মানুষের মনে এই ধারণা জন্মাতে চায় যে, সুগন্ধিত তণ্ডুল, গোবৎসের নরম মাংসের সুপ, সূক্ষ্ম বস্ত্ৰ, মুক্তার ভুষণ যা কিছু আমরা ব্যবহার করি এ সমস্তই ঈশ্বরের অনুগ্রহ।’
‘পুরনো দেবতারাই তো যথেষ্ট, তবে এই নতুন ব্ৰহ্মের আমদানির প্রয়োজন কি?’
‘পুরুষানুক্রমে বহু যুগ ধরে কেউ ইন্দ্র, ব্ৰহ্মাকে প্রত্যক্ষ দেখেনি। তাই এখন অনেক লোকের মনেই সন্দেহ হতে আরম্ভ করেছে।‘
‘তা’হলে ব্ৰহ্ম সম্পর্কে সন্দেহ হবে না কেন?’
‘সেই জন্যেই ব্ৰহ্মের রূপ বর্ণনা আমি এমনভাবে করেছি যে, তাকে প্রত্যক্ষ দেখার কথাই উঠবে না। দেবতারা ছিল সাকার-আমার কল্পিত ব্ৰহ্ম নিরাকার। নিরাকার তাই যত্রতন্ত্র সর্বত্রই বিরাজমান–তাই তা দেখবার প্রশ্ন ওঠে কি? প্রশ্ন ওঠে শুধু সাকার দেবতাদের সম্পর্কে।’
‘তুমি যে নিরাকার ব্রহ্মের কথা বলছ তাতে উদ্দালক আরুণির মতো ব্ৰাহ্মণদেরও মতিভ্রম ঘটায়। তোমার মতলবটা কি, তুমি কি প্রজাদের ভ্রমাচ্ছন্ন রাখতে চাও?’
‘লোপা! তুমি তো আমায় জান, তোমার কাছে কি-ই বা লুকোতে পারি? এই যে রাজশক্তি একে হাতের মুঠোর মধ্যে রাখার জন্য এর প্রয়োজন আছে। যারা সন্দেহ করবে তাদের বিদ্যাবুদ্ধিকেই এ দিয়ে খাটো করা যাবে–তাদের নিজেদের জ্ঞান সম্পর্কে নিজেদেরই সন্দেহ জাগবে। কারণ, যারা দেবতার যজ্ঞ বা পূজার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে তারা আমাদের ঘোরতর শত্রু।’
‘কিন্তু তুমিও তো বলছি, ব্ৰহ্ম সত্তাহীন নয়–ব্রহ্মের সত্তা ও দর্শনের কথাও বলছ।’
‘সত্তা আছে, কাজেই অনুভব-গ্ৰাহ্য হওয়া চাই। কিন্তু তা ইন্দ্রিয় দ্বারা নয়, কারণ তাহলেই সন্দেহবাদীরা ইন্বিয় দ্বারা (চক্ষুষ) দেখতে চাইবে। তাই আমি বলেছি, ব্রহ্মের দর্শন পেতে হলে সূক্ষ্ম ইন্দ্ৰিয় দ্বারাই সেটা সম্ভব, আর সূক্ষ্ম ইন্দ্ৰিয় লাভ করতে হলে চাই। সাধনা। আর সাধনার যে ফিরিস্তি দেওয়া হয়েছে তাতে মানুষ ছাপান্না পুরুষ ধরেও বিশ্বাস। অটুট রাখতে পারবে–ভ্ৰমাচ্ছন্ন থাকবে। আমি পুরোহিতদের স্থূল হাতিয়ারকে নিষ্ফলা ভেবেই এ হাতিয়ার আবিষ্কার করেছি। লোপা, তুমি কি কখনও শবরদের পাথর ও তামার হাতিয়ার দেখেছ?’
‘হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের জঙ্গলে গিয়ে দেখেছি।’
‘যমুনার ওপরে আমরা গিয়েছিলাম বটে। আচ্ছা শবরদের পাথর ও তামার হাতিয়ার আমার কালো লোহার সামনে টিকতে পারে?’
‘না, পারে না।’
‘পারে না তো! তাই বলছিলাম, বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্রের পুরনো দেবতারা বা ব্ৰাহ্মণদের যাগ-যজ্ঞ আগেকার বুদ্ধিমানদের যাও বা সন্তুষ্ট করতে পারত এখন তা সন্দেহবাদী তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান জ্ঞানী লোকদের কাছে ব্যৰ্থ।’
‘তাদের কাছে তোমার সৃষ্ট এই ব্ৰহ্ম-তাও কিছু না। তুমি ব্ৰাহ্মণ জ্ঞানীদের ধরে ধরে শিষ্য বানোচ্ছ, তাদের ব্ৰহ্মজ্ঞান শেখাচ্ছ, অথচ তোমারই ঘরে বসে তোমার কথাকে সরাসরি মিথ্যা বলে মনে করি।’
‘কারণ, তুমি আসল ব্যাপারটা আমার আসল রহস্য (উপনিষদ) জান।’
‘ব্রাহ্মণ যদি জ্ঞানীই হবে, তবে কেন তোমার রহস্য তারা জানবে না?’
’সেটা তো তুমিও দেখতে পাচ্ছ। কোনো ব্ৰাহ্মণ হয়ত উপনিষদ পরীক্ষা করে দেখতে পারে, কিন্তু তারাও আমার উপনিষদকে আত্মস্বার্থে উপর্যুক্ত হাতিয়ার বলে মনে করবে। ওদের পৌরোহিত্য ও গুরুগিরির ওপর মানুষের অবিশ্বাস এসে গেছে যার পরিণাম সব রকম দক্ষিণা হতে বঞ্চিত হওয়া। ফলে চড়ার জন্য অশ্বরথ, খাবার জন্য উত্তম খাদ্য, থাকার জন্য প্রাসাদ এবং ভোগের জন্য সুন্দরী দাসী থেকে বঞ্চিত হওয়া।’
‘এ তো ব্যবসা।’
‘ব্যবসা তো নিশ্চয়ই। আর এতে লোকসানের ভয় নেই। এই জন্যই জ্ঞানী ব্ৰাহ্মণ সমিধ (যজ্ঞকাষ্ঠ) হাতে আমার কাছে শিষ্য হতে আসে। আর আমিও ব্রাহ্মণদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তাদের ব্রহ্মজ্ঞান প্রদান করি।’
‘এ অত্যন্ত নিকৃষ্ট চিন্তা, প্রবাহণ!’
‘তোমার কথা স্বীকার করি। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য সব থেকে উপযোগী পন্থা। বশিষ্ঠ এবং বিশ্বামিত্রের নৌকা হাজার বছরও কাজ দেয়নি। কিন্তু প্রবাহণের নির্মিত নৌকায় দু’হাজার বছর পরও পরাধনভোগী রাজা ও সামন্তরা পার হতে পারবে। যজ্ঞরূপী নৌকাকে আমি অদৃঢ় বলে মনে করি, লোপা! তাই আমি এ দৃঢ় নৌকা নির্মাণ করেছি। এর সাহায্যে ব্ৰাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়গণ মিলিতভাবে ঐশ্বৰ্য ভোগ করতে পারবে। কিন্তু, ব্রহ্মের থেকেও বড় হবে আমার দ্বিতীয় আবিষ্কার, লোপা!’
‘কোন আবিষ্কার?’
‘মরে গিয়ে আবার এ পৃথিবীতে ফিরে আসা—পুনর্জন্ম!’
‘এ তো সবচেয়ে বড় জালিয়াতি!’
‘কিন্তু খুব কার্যকরী পন্থা। একদিকে সামন্ত, ব্রাহ্মণ এবং ব্যবসায়ীদের হাতে অপার ভোগরাশি সঞ্চিত হবে, অন্যদিকে সাধারণ প্রজা নিঃশেষ হয়ে যাবে। আবার এ সব নির্ধনদের, যেমন শিল্পী, কৃষক এবং দাসদাসীদের বিক্ষুব্ধ করার জন্যে কিছু লোক প্রচার শুরু করেছে, ‘তুমি তোমার শ্রমশক্তি অন্যকে দিয়ে কষ্ট করছ। ওরা তোমাকে বিশ্বাস করাতে চায় যে, তুমি কষ্ট ও ত্যাগ করলে মরে স্বর্গে যাবে। কিন্তু কেউ স্বর্গে মৃত জীবকে সুখভোগ করতে দেখেনি।’ এরই জবাব হল, এ সংসারে উঁচু-নিচু ভাব, ছোট-বড় জাতি, ধনী নির্ধনের যে প্রভেদ, তা হল পূৰ্বজন্মকৃত ফল। আমি এভাবে পূর্বেকীর সুকর্ম-দুষ্কর্মের ফল প্রত্যক্ষভাবে দেখিয়ে দিয়েছি।’
‘এভাবে চোরও তার চুরি করা জিনিসকে পূর্বজন্মের রোজগার বলতে পারে।’
‘কিন্তু তার জন্য আমরা প্রথম থেকেই দেবতা, ঋষি এবং জনসাধারণের বিশ্বাসের সহায়তা গ্রহণে কৃতকার্য হয়েছি। সে জন্যেই অপহৃত জিনিসকে পূর্বজন্মের রোজগার বলে স্বীকার করা হবে না। বিনা পরিশ্রমলব্ধ ধনকে আমরা প্রথমে দেবতার কৃপায় পাওয়া বস্তু বলে চালতাম। কিন্তু যখন দেখলাম, দেব-কৃপার ওপর সন্দেহ শুরু হয়েছে, তখন আমাদের একটা নতুন ব্যাখ্যা উপস্থিত করা প্রয়োজন হল। ব্ৰাহ্মণদের চিন্তাশক্তিও লোপ পেয়েছে। প্রাচীন ঋষিদের মন্ত্র মুখস্থ করতেই চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর কাটিয়ে দেয়, ফলে অন্য কোনো গভীর বিষয় কখন আর চিন্তা করবে!’
‘প্রবাহণ! তুমিও কি মুখস্থ করতে দীর্ঘ সময় এভাবে কাটিয়ে দাওনি?’
‘মাত্র ষোল বছর। চব্বিশ বছর বয়সে আমি ব্রাহ্মণদের বিদ্যা শেষ করে বইয়ের সংসারে প্রবেশ করেছিলাম। এখানে আমি পড়াশুনার প্রচুর সুযোগ পেয়েছি। রাজ্য শাসনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলি জানার পর আমি দেখলাম, ব্ৰাহ্মণদের নির্মিত পুরনো নৌকা বর্তমানের জন্য অদৃঢ়।’
‘তাই তুমি দৃঢ় নৌকা নির্মাণ করেছ?’
‘সত্যি কি মিথ্যা সেটা আমার প্রশ্ন নয়; আমার প্রশ্ন হল, কার্যোপযোগিতা নিয়ে। সংসারে ফিরে আসা পুনর্জন্মের কথা আজ নতুন মনে হচ্ছে ঠিকই, আর তুমি এর অন্তৰ্গঢ় স্বাৰ্থও জান। কিন্তু, আমার ব্রাহ্মণ চেলারা তো এই নিয়ে এখন থেকেই মাতামাতি শুরু করেছে। পিতরদের এবং দেবতাদের (পিতৃ-যান, দেব-যান) পথ বুঝবার জন্য এখনি মানুষ বার বছর পর্যন্ত গরু চরাতে প্ৰস্তুত। তুমি আমি থাকব না, কিন্তু এমন সময় আসবে যখন সমস্ত দরিদ্র প্রজা এই পুর্নজন্মের আশীয় সারা জীবনের তিক্ততা, কষ্ট এবং অন্যায়কে হাসিমুখে মেনে নেবে। স্বৰ্গ ও নরক বুঝবার এ কেমন সোজা উপায় আবিষ্কার করেছে, বল তো লোপা?’।
‘কিন্তু, নিজের স্বার্থের জন্য মানুষকে চির-সর্বনাশের পথে ঠেলে দিচ্ছ।’
‘বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্ৰও পেটের দায়ে বেদ রচনা করেছিল, উত্তর পঞ্চালের রাজা দিবোদাসের শবর-দুর্গ অধিকারের পর কবিতা রচিত হয়েছিল। পেটের সংস্থান করা অন্যায় নয়। আমরা যখন হাজার হাজার বছরের জন্য আপন পুত্রপৌত্ৰাদি, ভাই-বন্ধুদের পেটের সংস্থান করি তখন শাশ্বত যশের ভাগী হই।(১) প্রবাহণ এমন কাজই করছে, যা পূর্বগামী ঋষিগণও করতে পারেননি–ধর্মের অন্ন ভক্ষণকারী ব্রাহ্মণরাও পারেনি।’
‘তুমি অতি নিষ্ঠুর প্রবাহণ।’
‘কিন্তু আমি আমার কাজ যোগ্যতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছি।’
—————–
(১) ত্বং তদুক্থমিন্দ্ৰ বর্হণাক : প্রয়চ্ছতা সহাসা শূর-দৰ্ষি।
অবগিরেৰ্দাসং শংবরং হন্ প্ৰাবী দিবোদাসং চিত্রভিরূতী।। (ঋগ্বেদ ৬। ২৫। ২৫)।
২.
প্রবাহণের মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু তার ব্ৰহ্মবাদ ও পুর্নজন্ম অথবা পিতৃযানবাদ বিজয়দুন্দুতি বাজিয়ে সিন্ধু থেকে আরম্ভ করে সদানীরা (গণ্ডক) পর্যন্ত জয়ধ্বনি তুলেছিল। যজ্ঞের প্রভাব তখনও কমেনি, কারণ ব্ৰহ্মজ্ঞানীরা তখনও পর্যন্ত এগুলো করতে বিশেষ উৎসাহ পেত। ক্ষত্রিয় প্রবাহণের আবিষ্কৃত ব্ৰহ্মবাদে ব্রাহ্মণরা পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিল এবং এই বিদ্যায় কুরু কুলের যজ্ঞবল্ক্যের খ্যাতি যথেষ্ট ছড়িয়ে পড়েছিল।
এক সময়ে মন্ত্রের কর্তা এবং যজ্ঞের প্রতিষ্ঠাতা বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র এবং ভরদ্ধাজের জন্ম যে দেশ দিয়েছিল–সেই কুরু পঞ্চালেই যাজ্ঞবল্ক্য এবং তার সঙ্গী ব্ৰহ্মবাদী-ব্ৰহ্মবাদিনীদের জয়-জয়কার হল। ব্ৰহ্মবাদীদের পরিষদ ক্রমে যজ্ঞের চেয়ে বেশি খ্যাতিসম্পন্ন হয়েছিল। রাজারা রাজসূয় ইত্যাদি যজ্ঞের সঙ্গে একটি করে ব্ৰহ্মবাদীদের পরিষদ রচনা করত, কখনো বা পরিষদ আলাদা করেও ডাকা হত। তাতে হাজার হাজার গরু ঘোড়া এবং দাসদাসী (বিশেষ করে দাসী, কেননা রাজাদের অন্তঃপুরে প্রতিপালিতাদাসীদের ব্ৰহ্মবাদীরা বেশি পছন্দ করত) পরিষদের এক এক যুদ্ধ বিজেতাদের পুরষ্কার দেওয়া হত।
যাজ্ঞবল্ক্য অনেকগুলি পরিষদে বিজয়ী হয়েছিল। এবার সে বিদেহ (তির্হুত) এর জনক পরিষদে খুব বড় রকমের একটা জয়লাভ করল, এবং তার শিষ্য সোমশ্ৰবা হাজার গরু তাকে দান করল। যাজ্ঞবল্ক্য বিদেহ থেকে আরম্ভ করে কুরু পর্যন্ত সেই গরুগুলিকে হাঁকিয়ে আনার কষ্ট স্বীকার করবে কেন? সেগুলিকে ব্ৰাহ্মণদের মধ্যে ভাগ করে দিল। এ জন্য ব্ৰহ্মবাদী যাজ্ঞবল্ক্যের প্রচুর খ্যাতি হল। হ্যাঁ, হীরে-মুক্তা সোনা, দাসদাসী এবং অশ্বরথএ সমস্ত অবশ্যই সে নিজের সঙ্গে নিয়ে এসেছিল।
ষাট বছর হল প্রবাহণের মৃত্যু হয়েছে তখন যাজ্ঞবল্ক্য জন্মায়নি। কিন্তু একশ’ বছর বয়স অতিক্রম করেও লোপা এখনও কর্মক্ষম আছে, পঞ্চালপুরের বাইরে রাজ-উদ্যানে ললিতা আম-কলা-জাম গাছগুলির ছায়ায় থাকতে সে পছন্দ করত। আজীবন সে প্রবাহণের চিন্তাধারার বার বার বিরোধিতা করেছে, কিন্তু এই সূদীর্ঘ ষাট বছরে সে প্রবাহণের দোষগুলো ভুলে গেছে। আজ তার স্মৃতিপটে জেগে রয়েছে–সারা জীবনের প্রেম। বৃদ্ধার চোখের জ্যোতি ম্লান হয় নি। ব্ৰহ্মবাদীদের ওপর আজও সে খাপ্পা। একদিন পঞ্চালপুরে ব্ৰহ্মবাদিনী গার্গী এসে উঠল। রাজোদ্যানের পাশেই গার্গীকে বিশেষ সম্মানের সঙ্গে থাকতে দেওয়া হল। জনকের পরিষদে যজ্ঞবল্ক্য যেভাবে ধোঁকা দিয়ে তাকে পরাস্ত করেছিল, গার্গী তা ভুলতে পারেনি। যদি আর কোনো প্রশ্ন কর তবে তোমার মাথা থাকবে না, গার্গী!’ গার্গী ভেবেছিল ওটা কথার কথা! ও কাজ শুধু উগ্রলোহিত–পাণিরাই (অপরের রক্তে যে হাত রাঙায়) করতে পারে।
গার্গী লোপার পিতৃকুলের মেয়ে। লোপা তার বিশেষ পরিচিত। যদিও ব্রহ্মবাদ সম্বন্ধে তার মত উলুটো। এ-বার যাজ্ঞবল্ক্য তার বিরুদ্ধে যে রকম নিচ অস্ত্র প্রয়োগ করেছে তাতে গার্গী একেবারে রেগে আগুন। তাই যখন তার প্রপিতামহের পিসীমার কাছে এল, তখন তার মনোভাবের নিশ্চয়ই কিছুটা পরিবর্তন হয়েছিল। লোপা কাছে এলে গার্গীর কপালে ও চোখে চুমু খেয়ে আলিঙ্গন করে জিজ্ঞেস করল, ‘শরীর কি রকম আছে?’
গার্গী বলল, ‘আমি বিদেহ থেকে এসেছি, পিসী!’
‘মল্লযুদ্ধ করতে গিয়েছিলি কি মা?’
’হ্যাঁ, মল্লযুদ্ধই হয়েছে পিসীমা। ব্ৰহ্মবাদীদের পরিষদ মল্লযুদ্ধ ছাড়া আর কিছুই নয়। মল্লযুদ্ধের মতোই ওখানে প্রতিন্দ্বন্দ্বীকে ছলে-বলে পর্যুদস্ত করার চেষ্টা হয়।’
‘তাহলে তো কুরু-পঞ্চলের অনেকেই ব্ৰহ্মবাদী আখড়ায় নেমে থাকবে।’
‘কুরু-পঞ্চাল তো এখন ব্ৰহ্মবাদীদের দুর্গ।’
‘আমার সামনেই ব্ৰহ্মবাদীদের একটি ছোট স্ফুলিঙ্গ নিক্ষেপ করেছিল প্রবাহণ, আর তাও সৎ উদ্দেশ্যে নয়। আজ তা দাবানল হয়ে সমস্ত কুরু-পঞ্চালদের জ্বলিয়ে এখন বিদেহ পর্যন্ত পৌঁছেছে।’
‘পিসীমা আমি তোমার কথার সত্যতা এখন কিছুটা বুঝতে পারছি। বস্তুত, এটা ভোগ অর্জনের একটা প্রশস্ত পথ। বিদেহে যাজ্ঞবল্ক্য লক্ষ-লক্ষ টাকার সম্পত্তি পেয়েছে, অন্য সব ব্ৰাহ্মণেরও প্রচুর ধন-রত্ন নিয়ে এসেছে।’
‘এ যে যজ্ঞের থেকেও বেশি লাভের ব্যবসা, মা! আমার স্বামী একেই রাজা ও ব্ৰাহ্মণদের মজবুত নৌকা বলত। তাহলে যাজ্ঞবল্ক্য জনকের পরিষদে বিজয়ী হল, আর তুমি কিছুই বলতে পারলে না?’
‘যদি বলারই কিছু না থাকত। তবে গঙ্গায় এত দূর নৌকা পাড়ি দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল?’
‘নৌকাতে এলে! রাস্তায় চোর-ডাকাত ধরেনি?’
‘না পিসীমা! নৌকার সারিতে যোদ্ধারা সঙ্গে থাকে। আমরা ব্ৰহ্মবাদীরা কখনো এত মুর্থ নই যে, একলা-দোকলা নিজেদের প্রাণ সঙ্কটময় করে পথ চলব।’
‘যাজ্ঞবল্ক্য তাহলে সকলকেই পরাস্ত করেছিল?’
‘একে পরাস্ত করা বলে না।’
‘কেননা, প্রশ্নকর্তারা যাজ্ঞবল্ক্যের জবাব শুনে চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়েছে।’
‘তুমিও?’
‘হ্যাঁ, আমিও। কিন্তু তার কথার ধমকে আমাকে চুপ করতে হয়েছে।’
‘কথার ধমকটা আবার কি?’
‘ব্ৰহ্ম সম্বন্ধে প্রশ্ন করে যাজ্ঞবল্ক্যকে এমনভাবে নাস্তানাবুদ করেছিলাম যে তার বেরোবার পথ ছিল না। তখন সে আমাকে এমন কথা বলল, যা আমি কখনও তার কাছে শুনব বলে আশা করিনি!’
‘কি কথা গো মেয়ে?’
‘সোজাসুজি আমায় ধমক দিয়ে বলল, গার্গী আবার যদি কোনো প্রশ্ন কর, তা’হলে আর তোমার মাথা থাকবে না।’
‘তুমি ও রকম হবে সে আশা করিনি। কিন্তু আমি সব কিছুই আশঙ্কা করেছিলাম, গার্গী। যাজ্ঞবল্ক্য প্রবাহণের উপর্যুক্ত প্ৰশিষ্য। প্রবাহণের মিথ্যাবাদকে সে ষোলকলায় পূর্ণ করেছে। তুমি যে আর কোনো প্রশ্ন করনি, সেটা ভালোই করেছ।’
‘তুমি কি করে জানলে পিসীমা’।
‘নিজের চোখে তোমার কাঁধের ওপর মাথাটা দেখতে পাচ্ছি।’
‘তাহলে পিসীমা, তুমি কি বিশ্বাস করছ যে, আমি যদি আর কোনো প্রশ্ন করতাম, তবে আমার মাথা পড়ে যেত?’
‘নিশ্চয়ই। তবে, যাজ্ঞবল্ক্যের ব্ৰহ্ম-বলে নয়, অন্য লোকের মাথা যেভাবে পড়তে দেখা যায়, সেইভাবে।’
‘না পিসীমা, তা কি কখনও হতে পারে?’
‘হতে পারে না? তুই এখনও শিশু আছিস, গার্গী। তুই ভাবিস এ ব্ৰহ্মবাদ আর কিছুই নয়। খালি মনের পাখা মেলে কল্পনা, মনের বিলাস। না, গাণী–তা নয়। এর পেছনে রাজারাজড়াদের, ব্ৰাহ্মণ ও পরিশ্রম-ভোগীদের মস্ত বড় স্বাৰ্থ লুকানো আছে। যে লগ্নে এই ব্ৰহ্মবাদ জন্মলাভ করেছিল সেই সময় এর জন্মদাতা আমার পাশেই শয়ন করত। যোদ্ধারহাতে লোহার কৃপাণ যেমন শক্তি যোগায় তেমনি এই ব্ৰহ্মবাদ রাজসত্তাও ব্রহ্মণ্যসত্তাকে দৃঢ় করেছে।’
‘পিসীমা, আমি কিন্তু এইভাবে বুঝিনি।’
‘তুমি কেন, অনেকেই বোঝেনি। তবে বিদেহরাজ জনক এর রহস্য (উপনিষদ) বুঝে। আর যাজ্ঞবল্ক্য এটা ভালোই বুঝে–যেমন আমার পতি প্রবাহণ বুঝত। প্রবাহণ কোনো দেবতা, দেবলোক, পিতৃলোক, যজ্ঞ বা ব্ৰহ্মবাদে নিজে বিশ্বাস করত না। তার অখণ্ড বিশ্বাস ছিল ভোগে, আত্মসুখে। সে নিজের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ভোগেই অর্পণ করেছিল। মরবার তিনদিন আগেও বিশ্বামিত্র কুলের পুরোহিতের সুবৰ্ণকেশী কন্যা তার রূতিগৃহে এসে রাত্রিবাস করেছিল। এদিকে বাঁচবার কোনো আশাই ছিল না, তবু সে বিশ বছরের তরুণী সুন্দরীর সঙ্গে রাত্রিবাস করত।’
‘পরিষদে জয়লাভ করে যাজ্ঞবল্ক্য যে সমস্ত গাভী পেয়েছিল তা দান করে দেয় ব্ৰাহ্মণদের মধ্যে কিন্তু বিদেহ রাজার কাছ থেকে পাওয়া সুন্দরী দাসীদের অন্তঃপুরে নিয়ে এসেছে, পিসীমা।’
‘আমি তো সেই কথাই বলছিলাম, যাজ্ঞবল্ক্য প্রবাহণের পাক্কা চেলা। ও ব্ৰহ্মবাদ দেখলি তো? আর তুই দেখছিস দূর থেকে। যদি কাছ থেকে দেখবার সুযোগ পেতিস বেটি, তাহলে ওদের আসল চরিত্র বুঝতে কোনো মুস্কিল হত না।’
‘তবে কি পিসীমা, তুমি সত্যি সত্যিই মনে কর যে, আমি যদি আর কোনো প্রশ্ন করতাম তাহলে আমার মাথা পড়ে যেত?’
‘নিশ্চয়ই! কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্যের ব্ৰহ্মতেজে নয়। দুনিয়াতে কত মাথাই না নিঃশব্দে দেহত্যুত হয়েছে!’
‘আমার মাথা ঘুরছে।’
‘আজ? আমার মাথা ঘুরছে তখন থেকে যখন আমার জ্ঞান হয়েছে। সমস্ত ছলনা, খালি কথার কারসাজি। প্রজাদের পরিশ্রমার্জিত ফল বিনা পরিশ্রমে ভোগের পথই হল। রাজবাদ, ব্ৰহ্মবাদ ও যজ্ঞবাদের মূল কথা। এই জালিয়াতি থেকে প্রজাদের কেউ বাঁচতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত ওরা নিজেরা সচেতন না হচ্ছে। আর তাদের সচেতন হতে দেওয়া এ স্বাৰ্থবাদীরা মোটেই পছন্দ করে না।’
‘মানব হৃদয় কি আমাদের এ প্রবঞ্চনাকে ঘৃণা করতে প্রেরণা দেবে না?’
‘দেবে মা দেবে! আর আমি একমাত্র সেই আশাতেই বেঁচে আছি।’*
———-
* ১৪৪ পুরুষ আগেকার কাহিনী। এই সময় আদি ঋষিরা-বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র ও ভরদ্বাজ ঋগ্বেদের শ্লোকসমূহ রচনা করেছিলেন। আর পঞ্চালভূমির রাজন্যবর্গ এইসব আর্যপুরোহিতদের সাহায্যে পুরাকালের গণতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার মূলে চূড়ান্তভাবে আঘাত হানতে পেরেছিল।