০৮. প্রচণ্ড বর্ষণ হচ্ছে

প্রচণ্ড বর্ষণ হচ্ছে। বর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া। এই ঝড়-বাদল মাথায় নিয়ে দিলশাদ এগুচ্ছে। রিকশাওয়ালার পর্দাটা ফুটো। বৃষ্টির পানিতে তার শাড়ি মাখামাখি। বৃষ্টির পানিতে গা ভেজানো যায় কিন্তু দ্রুতগামী ট্রাকের চাকা থেকে ছিটকে আসা পানিতে ভিজলে গা ঘিন ঘিন করে।

একটা ট্রাক এসে দিলশাদকে ভিজিয়ে দিয়ে গেছে। তবে দিলশাদের গা ঘিন ঘিন করছে না। সে মূর্তির মতোই রিকশায় বসে আছে। রিকশাওয়ালা মাথায় গামছা বেঁধে নিয়েছে। এতে তার কী উপকার হচ্ছে কে জানে। গামছা থেকে চুঁইয়ে পানি পড়ছে। সে পেছন ফিরে বলল, এমুন দিনে ঘর থাইক্যা বাইর হওন ঠিক না আম্মা। আসমান ভাইঙ্গা পড়ছে। দেহেন অবস্থা।

.

অনেকক্ষণ কলিংবেল বাজার পর দরজা খুলল। ওয়াদুদুর রহমান বলল, আরে তুমি। বৃষ্টিতে একেবারে দেখি মাখামাখি।

দিলশাদ বলল, আসব দুলাভাই?

এসো এসো। তুমি আসবে না তো কে আসবে।

আপনার কার্পেট বোধহয় ভিজিয়ে ফেললাম।

ভিজুক না কত ভিজবে।

দিলশাদ ঘরে ঢুকল। ওয়াদুদুর রহমানের দিকে তাকাল। শান্ত সহজ গলায় বলল, আমি টাকাটার জন্যে এসেছি। আসুন আপনার বাথটাব উদ্বোধন করা যাক।

ওয়াদুদুর রহমান বলল, ও।

ওয়াদুদুর রহমান চোখ সরু করে তাকাচ্ছে। তার ভুরু একটু যেন ঝুঁকে এসেছে। দিলশাদ নিজেই বসার ঘরের খোলা দরজা বন্ধ করতে করতে বলল, আসুন, আপনার বাথটাব উদ্বোধন করা যাক। ময়লা পানিতে শরীর নোংরা হয়ে আছে। নোংরা শরীর নিশ্চয়ই আপনার ভালো লাগবে না। আগে সাবান মেখে ভালো করে গোসল করে নেই।

.

০৯.

আজ বৃহস্পতিবার।

শুক্র-শনি-রবি, এই তিনদিন আমার হাতে আছে। সোমবার আমি চলে যাচ্ছি। সোমবার রাত দুটায় আমাদের বিমান। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার সঙ্গে মা যাচ্ছেন না। যাচ্ছেন বাবা। বাবার জন্যেই টিকিট কাটা হয়েছে।

এরকম একটা কাণ্ড যে শেষ মুহূর্তে মা করবেন তা আর কেউ না জানলেও আমি জানতাম। যেদিন বাবা খুব ব্যস্ত হয়ে তার পাসপোর্ট নিয়ে এসে মাকে বললেন— দিলশাদ, আমিও তোমাদের সঙ্গে ভিসা করিয়ে রাখি। যদি টাকাপয়সা বেশি জোগাড় হয়ে যায় আমিও যাব।

আমি মার দিকে তাকালাম। মা চোখ-মুখ কঠিন করে বললেন, টাকাটা আসবে কোত্থেকে? আকাশ থেকে?

বাবা আমতা আমতা করতে লাগলেন। তার এক বন্ধু আছে জার্মানিতে, তাকে চিঠি লিখবেন– এইসব কী হাবিজাবি বলতে লাগলেন। মা বাবার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন। মার চোখ দেখেই বুঝলাম শেষ মুহূর্তে মা বাবার জন্যেই টিকিট কাটবেন। কারণ মা’র কঠিন চোখে মমতার ছায়া পড়ছিল। বাবা যখন খুব বেশিরকম আমতা আমতা করতে লাগলেন– তখন মার চোখে একধরনের রসিকতা ঝলমলিয়ে উঠল। সেদিন আমি ডায়েরিতে লিখলাম–আমার ধারণা, আমেরিকায় মা আমার সঙ্গে যাবেন না। বাবা যাবেন।

ডায়েরিতে লিখে আমি মনে মনে অপেক্ষা করছি– দেখি আমার কথা ঠিক হয় কি-না। তারপর একদিন মা টিকিট কেটে দুপুরবেলা বাসায় এলেন। বাবা বাসাতেই ছিলেন। তিনি কোত্থেকে যেন একটা ধাঁধা শিখে এসেছেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি পারলাম না। ফুলির মাকে জিজ্ঞেস করলেন- ফুলির মাও পারল না। আমি তখন বাবাকে বললাম, মাকে জিজ্ঞেস কর। মা পারবে। মা’র বুদ্ধি অনেক বেশি। বাবা বললেন, তোর মা পারবে না। যাদের বুদ্ধি বেশি তারা এটা পারে না। যাদের বুদ্ধি বেশি তারা চট করে জবাব দিতে গিয়ে ভুল করে।

যাই হোক, আমি খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি কখন মা আসবে, বাবা মা’কে ধাঁধাটা জিজ্ঞেস করবে।

মা এলেন। খুব ক্লান্ত হয়ে এলেন। এসেই বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে আমার ঘরে এলেন। আমি বললাম, মা, বাবা তোমাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করবে।

মা বললেন, ধাঁধা জিজ্ঞেস করার দরকার নেই।

আমি বললাম, প্লিজ মা। প্লিজ।

মা বাবার দিকে তাকাতেই বাবা ধাঁধা শুরু করলেন– এক বোবা-কালা গিয়েছে পেরেক কিনতে। দোকানদারকে সে হাতে হাতুড়ির মতো ইশারা করে পেরেকের কথা বলল। দোকানদার পেরেকের বদলে হাতুড়ি এনে দিল। তখন সেই বোবা-কালা একহাতে পেরেক ধরার ভঙ্গি করে অন্যহাতে হাতুড়ি মারার মতো করল। তখন দোকানদার বুঝতে পেরে পেরেক এনে দিল। তার কিছুক্ষণ পর দোকানে এক অন্ধ এসে উপস্থিত। তার দরকার একটা কেঁচি। এখন বলো দেখি ঐ অন্ধ কেঁচির কথাটা কীভাবে দোকানদারকে বুঝাবে?

আমি মার দিকে তাকিয়ে আছি। মা কী বলেন- শোনার জন্যে ছটফট করছি। মা ডানহাত উপরে তুলে আঙুল দিয়ে কেঁচির মতো কাটার ভঙ্গি করলেন। আমি এবং বাবা দুজনই হো হো করে হেসে ফেললাম। আমি বললাম, মা, ঐ অন্ধ লোক তো মুখেই বলবে– আমার কেঁচি দরকার। সে আঙুল দিয়ে দেখাবে কেন?

মা চমকে উঠে বললেন, আরে তাই তো?

আমি এবং বাবা দুজনই আবারো হেসে উঠলাম। মা নিজেও সেই হাসিতে যোগ দিলেন। আমার এত ভালো লাগল। কত বছর পর তিনজন মিলে হাসছি। আশ্চর্য!

আমাদের হাসি থামার পর মা হ্যান্ডব্যাগ থেকে টিকিট বের করে বাবাকে বললেন, নাতাশার সঙ্গে তুমি আমেরিকা যাচ্ছে। আমি তোমার টিকিট কেটেছি। কাজেই ওর সব কাগজপত্র তোমাকে খুব ভালো করে বুঝে নিতে হবে। বাবা এমনভাবে মার দিকে তাকাচ্ছেন যেন মার কথা তিনি বুঝতে পারছেন না। যেন মা একজন বিদেশিনী। অদ্ভুত কোনো ভাষায় কথা বলছেন। যে ভাষা বাবার জানা নেই। মা বললেন, তুমি কাপড়চোপড় কী নেবে গুছিয়ে নাও। সময় তো বেশি নেই।

বাবা বিড়বিড় করে বললেন, তুমি যাচ্ছ না?

বললাম তো না। একটা কথা ক’বার করে বলব?

না–মানে, মানে…।

মা উঠে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন এবং দরজা বন্ধ করে দিলেন। বাবা হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে আমাকে কিছু না বলেই দ্রুত বের হয়ে গেলেন। কোথায় গেলেন কে জানে। হয়তো নিজের জিনিসপত্র গোছাতে গেলেন। কিংবা অন্যকিছু। আমি একা একা শুয়ে আছি। আমার ভালো লাগছে না, আবার খারাপও লাগছে না। এটা বেশ অদ্ভুত অবস্থা। আমাদের জীবনটা হয় ভালো লাগায়, নয় খারাপ লাগায় কেটে যায়। ভালোও লাগে না, খারাপও লাগে না এরকম কখনো হয় না। হলেও খুব অল্প সময়ের জন্যে হয়।

আমি আমার খাতাটা হাতে নিলাম। চিঠিগুলি লিখে ফেলা দরকার। কাকে কাকে লিখব? মাকে, বাবাকে, নানিজানকে এবং ফুলির মাকে। ফুলির মা চিঠি পড়তে পারবে না। অন্যকে দিয়ে সেই চিঠি সে পড়িয়ে নেবে। হয়তো মাকে দিয়ে পড়াবে। কেউ যখন চিঠি পড়ে শোনায় তখন ফুলির মা গালে হাত দিয়ে গম্ভীর মুখে বসে থাকে। তখন তাকে দেখে মনে হয় জগতের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সে করছে। এতদিন দেশ থেকে আসা তার সব চিঠি আমি পড়ে শুনিয়েছি। তার হয়ে চিঠি লিখে দিয়েছি আমি। ফুলির মা লেখাপড়া না জানলেও চিঠি লেখার সব কায়দাকানুন জানে। খুব ভালো করে জানে।

আফা, চিডির উফরে সুন্দর কইরা লেহেন সাতশ ছিয়াশি।

সাতশ ছিয়াশি লিখব কেন?

এইটা আফা চিডির দস্তুর। লেহেন সাতশ ছিয়াশি।

লিখলাম।

এহন লেখেন– পাক জনাবেষু, বাদ সমাচার…।

হুঁ লিখলাম।

ফুলির মা’র জন্যে চিঠি লেখা খুবই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কত কী যে সেই চিঠিতে থাকে! তার দেশের কে কেমন আছে সব জানতে চাওয়া হয়। কার অসুখ হয়েছে, কোন মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে… ফুলির মা’র জন্যে চিঠি লিখতে লিখতে সব আমার জানা হয়ে গেছে।

তার গ্রামে আমি যদি কখনো বেড়াতে যাই তাহলে সবাইকেই আমি চিনব।

ফুলির মা’র প্রতিটি চিঠি লেখা হবার পর তাকে পড়ে শুনাতে হয়। সে প্রায় দম বন্ধ করে চিঠি শুনে, তারপর শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে। সাদামাটা চিঠি পড়ে তার চোখে পানি আসে কেন কে জানে।

আমি ঠিক করেছি আমি প্রতিটি চিঠি শেষ করে ফুলির মা’র মতো একটু কাঁদব। এক ফোঁটা হলেও চোখের পানি চিঠির কোনো এক কোনায় মাখিয়ে রাখব। চোখের পানি শুকিয়ে যাবে, কেউ বুঝতে পারবে না। সেই ভালো। আমি চিঠি লিখা শুরু করলাম।

আগে আমি খুব দ্রুত লিখতে পারতাম– এখন পারি না। প্রায় সময়ই চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসে- আন্দাজে লিখতে হয়। হাতের লেখা খারাপ হয়ে যায়। একসময় আমার হাতের লেখা খুব সুন্দর ছিল। আমি নিজে যেমন অসুন্দর হচ্ছি। আমার লেখাও তেমনি অসুন্দর হচ্ছে।

৭৮৬

প্রিয় ফুলির মা বুয়া,

তুমি আমার ভালোবাসা নাও।

তুমি যখন আমার এই চিঠি পড়বে তখন আমি বেঁচে থাকব না। মৃত্যুর পর পর মৃত মানুষটিকে সবাই দ্রুত ভুলে যেতে চেষ্টা করে। সেটাই স্বাভাবিক। যে নেই– বার বার তার কথা মনে করে কষ্ট পাবার কোনো কারণ নেই। তারপরেও যারা অতি প্রিয়জন তারা মৃত মানুষকে সবসময়ই মনে রাখে। এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারে না। মৃত মানুষও হয়তো জীবিতদের মনে রাখে।

তুমি আমার অতি প্রিয়জনের একজন। প্রিয়জন কে হয় তা কি তুমি জানো? প্রিয়জন হচ্ছে সে যে দুঃখ ও কষ্টের সময় পাশে থাকে।

বেশিরভাগ মানুষের স্বভাব হচ্ছে বিড়ালের মতো। তারা সুখের সময় পাশে থাকে। দুঃখ-কষ্ট যখন আসে তখন দুঃখ কষ্টের ভাগ নিতে হবে এই ভয়ে চুপি চুপি সরে পড়ে। তাদের কোনো দোষ নেই– আল্লাহ মানুষকে এমন করেই তৈরি করেছেন।

তারপরেও কিছু কিছু মানুষ আছে যারা দুঃখ-কষ্টের সময় পাশে এসে দাঁড়ায়। দুঃখ-কষ্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো বড় কোনো অস্ত্র তাদের হাতে থাকে না তাদের থাকে শুধু হৃদয়পূর্ণ ভালোবাসা।

তুমি আমার চরম দুঃখের এবং চরম কষ্টের সময়ে আমার পাশে দাঁড়ালে। যেন আমি নাতাশা নামের কোনো মেয়ে না– আমি তোমার ফুলি।

আমার প্রচণ্ড মাথাব্যথার সময় তুমি সব কাজ ফেলে ছুটে এসে যখন দুহাতে আমাকে কোলে তুলে নিতে তখন তোমার মুখটা আমার মার মুখের মতো হয়ে যেত। আমার মা’র গা থেকে যেমন গন্ধ বের হয় তোমার গা থেকেও তখন ঠিক সেই রকম গন্ধ বের হতো। এটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার।

ফুলির মা বুয়া, আমি তোমার কথা মনে রাখব। যে কদিন বাঁচব মনে রাখব। আমার এই মনে রাখা-না-রাখায় কিছু যায় আসে না। কিন্তু এর বেশি তো আমার কিছু করার নেই।

ভালোবাসা ডাবল করে ফেরত দিতে হয়। তোমার ভালোবাসা আমি ডাবল করে ফেরত দিতে পারব না। এত ভালোবাসা আমার নেই। কিন্তু আমি নিশ্চিত, পৃথিবীর মানুষ আমার হয়ে তোমাকে তোমার ভালোবাসা ডাবল করে ফেরত দেবে।

মৃত্যুর পর আমি তোমার মেয়েকে খুঁজে বের করব। তাকে বলব তোমার মা একজন অসাধারণ মহিলা ছিলেন। এই পৃথিবী তাঁর মতো ভালো মহিলা খুব কম তৈরি করেছে। ফুলি এই কথা শুনে নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে।

তাহলে আজ যাই ফুলির মা বুয়া।

যাই কেমন?

ইতি—

তোমার আদরের

টিয়া পাখি নাতাশা।

.

প্রিয় নানিজান,

আসসালামু আলাইকুম।

দেখলেন নানিজান, আপনার কথা আমি ভুলি নি। অনেক দিন আগে আপনাকে একটা চিঠি লিখেছিলাম। আপনি বলেছেন আমাদের ‘নাতু’ এত গুছিয়ে চিঠি লিখে, শুধু একটাই ত্রুটি– চিঠির শুরুতে আসোলামু আলাইকুম লেখে না।

এবার আপনি আর সেটা বলতে পারবেন না। নানিজান, আমার অসুখের পর আপনি শুধু দুবার আমাকে দেখতে এসেছেন। এই দুবারই যে আমার কী ভালো লেগেছিল! আপনি যে কত ভালো তা আপনি নিজে কি জানেন নানিজান? যেই আপনার কাছে আসে তারই মন ভালো হয়ে যায়।

আপনি হাসতে হাসতে গল্প করেন। কুট কুট করে পান খান। সামান্য কথায় হেসে ভেঙে পড়েন। তখন ঠোঁট বেয়ে লাল পানের পিক গড়িয়ে পড়ে। দেখতে কী যে সুন্দর লাগে।

আমরা বইপত্রে সবসময় পড়ি মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। সেই শ্রেষ্ঠ যে আসলে কী তা আপনাকে না দেখলে বোঝা যাবে না। আমাদের বাংলা রচনা ক্লাসে একবার রচনা লিখতে দেয়া হলো তোমার জীবনের আদর্শ মানব। কেউ লিখল মহাত্মা গান্ধী, কেউ লিখল শেখ মুজিবুর রহমান। একজন লিখল, ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল, একজন লিখল মাদার তেরেসা। শুধু আমি লিখলাম—- আমার নানিজান।

বাংলা আপা আমার সেই রচনা ক্লাসে সবাইকে পড়ে শুনালেন। তারপর বললেন, নাতাশা, তোমার নানিজান সারাক্ষণ শুধু হাসেন এইজন্যেই কি তিনি তোমার জীবনের আদর্শ মানব?

আমি বললাম, চরম দুঃখেও তিনি হাসেন।

বাংলা আপা বললেন, তোমার রচনা খুব সুন্দর হয়েছে। দশের ভেতর আমি তোমাকে সাড়ে ছয় দিলাম, কিন্তু নাতাশা, একটা কথা মনে রাখবে- আদর্শ মানব তিনিই হবেন যিনি তার কর্ম নিজের এবং নিজের সংসারের বাইরে ছড়িয়ে দেবেন। বিরাট একটা মানবগোষ্ঠী যাতে উপকৃত হবে। তোমার নানিজান কি এমন কিছু করেছেন যাতে বিরাট মানবগোষ্ঠী উপকৃত হয়েছে?

জি-না।

এইখানেই সমস্যা, বুঝলে নাতাশা। তোমার রচনা পড়ে আমি নিশ্চিত তোমার নানিজান অসাধারণ একজন মহিলা। তাঁকে আমার দেখতেও ইচ্ছা করছে। কিন্তু তিনি তাঁর অসাধারণত্ব বাইরে ছড়িয়ে দিতে পারেন নি। নিজের সংসারের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আটকে রেখেছেন। কাজেই তাকে তুমি আদর্শ মানুষ হিসেবে নিও না।

আমি বললাম, জি আচ্ছা।

বাংলা আপা বললেন, তোমার নানিজানকে বাদ দিয়ে তোমার জীবনে আদর্শ মানব কে এখন বলল দেখি।

আমি অনেক ভাবলাম, তারপরেও মনে হলো– নানিজান। অবশ্যি আপাকে বললাম– বেগম রোকেয়া আপা একটু লজ্জা পেলেন কারণ তাঁর নামও রোকেয়া।

আমি জানি, আপনি আমার চিঠি পড়ে লজ্জা পাচ্ছেন। আপনার প্রশংসা করে কেউ কিছু বললেই আপনি লজ্জা পান। এবং আপনি যখন ভালো কিছু করেন এমনভাবে করেন যে কেউ বুঝতে পারে না ভালো কাজের পেছনের মানুষটা আপনি।

নানাভাই একটা স্কুলে এক লক্ষ টাকা দিয়েছেন। আমার তখনি সন্দেহ হলো এর পেছনে আছেন আপনি। নানাভাই একদিন আমাকে দেখতে এলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, এতগুলি টাকা হঠাৎ স্কুলে দিলেন কেন নানাভাই?

তিনি বিরক্ত মুখে বললেন, আরে তোর নানিজান একদিন ভোরবেলা আমাকে বলে সে আমার বাবাকে স্বপ্নে দেখেছে। তিনি বলছেন– বৌমা, দীর্ঘদিন আমি এই স্কুলে শিক্ষকতা করেছি। আজ স্কুলের ভগ্নদশা দেখে আমার মনটা খারাপ হয়েছে। তুমি স্কুলের সাহায্যের একটা ব্যবস্থা কর।

তখন টাকাটা দিলেন?

আরে না। তোর নানিজানের যা স্বভাব, রোজ কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান ঘ্যান ঘ্যানে জীবন অতিষ্ঠ। টাকাটা দিয়ে ঘ্যানঘ্যানানির হাত থেকে বেঁচেছি।

তখন আমার মনে হলো স্বপ্নের ব্যাপারটাও আপনি বানিয়ে বলেছেন। আপনি কোনো স্বপ্ন-টপ্ন দেখেন নি। আপনার স্কুলে সাহায্য করার ইচ্ছা হয়েছে, তাই মিথ্যা একটা গল্প বলে নানাভাইয়ের হাত থেকে টাকা বের করেছেন।

নানিজান, আমি যখন আমার সন্দেহের কথা আপনাকে বললাম- তখন আপনি হাসতে হাসতে বিছানায় প্রায় গড়িয়ে পড়ে যেতে যেতে বললেন, আল্লাহপাক তোকে এত বুদ্ধি কেন দিল রে নাতু?

নানিজান, আপনার সব কথার মধ্যে শুধু আল্লাহপাক। সুন্দর একটা ফুল দেখেও আপনি বলেন- আহা রে আল্লাহপাক কী সুন্দর করেই না ফুলটা বানিয়েছে! শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।

নানিজান, আপনার মতো আল্লাহ-ভক্ত মানুষ বাংলাদেশে নিশ্চয়ই আরো অনেক আছে, কিন্তু আপনার মতো এত সুন্দর করে আল্লাহর কথা আর কেউ বলে, তা আমার মনে হয় না। শেষবার যখন আপনি আমাকে দেখতে এলেন, তখন আপনাকে আমি একটা কঠিন প্রশ্ন করেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, আপনি সেই প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন না। কিন্তু আপনি হাসিমুখে জবাব দিলেন। আমি বললাম, আচ্ছা নানিজান, আমার এই কঠিন অসুখটা কি আল্লাহ দিয়েছেন? কেন দিলেন? আমি তো কোনো অন্যায় করি নি। কোনো পাপ করি নি। তিনি কেন আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন? আর শাস্তি তো তিনি শুধু আমাকে দিচ্ছেন না, আমার সঙ্গে মা-বাবাকেও শাস্তি দিচ্ছেন এমনকি আপনি শাস্তি পাচ্ছেন। কেন?

আপনি তখন আমার গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, কঠিন যে পাপী তাকে শাস্তি দিতেও আল্লাহপাক দ্বিধাবোধ করেন। তিনি নিজে সুন্দর। যা কিছু তিনি সৃষ্টি করেন তাও সুন্দর। রোগব্যাধি অসুন্দর। আমার মনে হয় না– এই রোগ এই ব্যাধি তার তৈরি। তিনি প্রকৃতি সৃষ্টি করেছেন। তাকে আপন মনে চলতে দিয়েছেন। রোগব্যাধি জন্মেছে। তিনি সেখানে হাত দেন নি। সবকিছুকেই তিনি তাঁর মতো চলতে দিয়েছেন। তাঁর সৃষ্ট জীবন যখন রোগব্যাধিতে কষ্ট পায় তখন তিনিও কষ্ট পান।

সেই কষ্ট তিনি দূর করেন না কেন?

দূর করবেন না কেন– করেন। সেই জন্যেই তো চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। তবে হুট করে তিনি কিছু করেন না। তাতে জগতের নিয়ম ভঙ্গ করা হয়। জগতের আইনকানুনগুলিও তাঁর সৃষ্টি, কিন্তু তিনি তা ভাঙেন না। আইন ভাঙা মানেই অরাজক অবস্থা সৃষ্টি করা। সৃষ্টিকর্তা তা হতে দিতে পারেন না।

তবে ইচ্ছা করলে তিনি পারেন। তাই না নানিজান?

অবশ্যই পারেন। পারেন বলেই তো আমরা সবসময় তার কাছে প্রার্থনা করি। মানুষ যখন মহাবিপদে পড়ে, যখন চরম দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়, তখন তারা আল্লাহর উপর রাগ করে। তাদের দুঃখকষ্টের জন্যে আল্লাহকে দায়ী করে। মানুষের দুঃখকষ্টের দায়িত্ব মানুষের, আল্লাহ দুঃখকষ্ট সৃষ্টি করেন না। তিনি সুন্দরের সৃষ্টিকর্তা। তিনি সুন্দর সৃষ্টি করেন। বুঝতে পারছিস?

হুঁ।

নানিজান, আপনি তখন আমার চুলে বিলি দিতে দিতে আরো অনেক কথা বলতে লাগলেন। আপনি গভীর বিশ্বাস থেকে কথা বলেন বলেই সহজে সেইসব কথা মনে গেঁথে যায়।

আপনার সব কথা সেদিন আমি মনে গেঁথে নিয়েছি। আমার মনটা হালকা হয়ে গেছে। তখন নানিজান, আপনি আমার কানে কানে অদ্ভুত একটা কথা বললেন, আপনি বললেন…।

কী বললেন তা তো আপনার মনেই আছে, তাই না? মৃত্যু আমার পাশে এসে যখন বসবে তখন আপনার কথাগুলি ভেবে আমি মনে সাহস পাব।

নানিজান, আপনি আমাকে যেভাবে সাহস দিলেন, আমার মা এবং বাবাকেও এইভাবেই সাহস দেবেন। আপনার কাছে এই আমার শেষ অনুরোধ।

ইতি

আপনার নাতু

.

প্রিয় বাবা,

বাবা, তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি সেটা কি তুমি জানো? জানো না, তাই না?

আমিও জানি না। ভালোবাসা যদি তরল পানির মতো কোনো বস্তু হতো তাহলে সেই ভালোবাসায় সমস্ত পৃথিবী তলিয়ে যেত। এমনকি হিমালয় পর্বতও।

বাবা, আমি যখন থাকব না তখন তুমি আমার কথা ভেবে কষ্ট পেও না। তুমি কষ্ট পেলে সেই কষ্ট কোনো না কোনো ভাবে আমার কাছে পৌঁছবে। তখন আমার খুব খারাপ লাগবে।

বাবা, তুমি মাকে সাহস দিও। আদর-ভালোবাসা দিয়ে তুমি মা’র মনের সব কষ্ট দূর করে দিও।

মনে রেখো বাবা, তোমাকে অবশ্যই লাল রঙের একটা গাড়ি কিনে আগের দিনের মতো মা’কে পাশে বসিয়ে হাইওয়ে দিয়ে শো শো করে চালাতে হবে। মনে থাকবে তো বাবা?

তোমার টিয়া পাখি।

.

প্রিয় মা-মণি,

মা, আমি তোমাকে ছেড়ে কখনো যাব না। মৃত্যুর পরেও আমি থাকব তোমার খুব কাছে। তোমার আনন্দ দেখে আমি হাসব আবার তুমি যখন দুঃখ পাবে তখন আমিও খুব দুঃখ পাব। কাজেই মা দুঃখ পেও না। মন খারাপ করো না। বাবা যখন লাল গাড়ি কিনবে তখন তুমি বাবার পাশে হাসতে হাসতে বসবে। বাবা যখন শ শ করে গাড়ি চালাবে তখন তুমি চুল বেঁধে রাখবে না, চুল ছেড়ে দিও। বাতাসে মাথার চুল উড়লে খুব সুন্দর লাগবে দেখতে। সেই সুন্দর দৃশ্য আমি একদিন দেখব ভাবতেই ভালো লাগছে।

আদরের মা-মণি! তোমাকে আমি খুব খুব সুখী করব এরকম একটা ইচ্ছা ছিল। তুমি চেয়েছিলে আমি ডাক্তার হব। আমি ভেবেছিলাম খুব বড় একজন ডাক্তার হব। এমন ডাক্তার যে হাসিমুখে রোগীর ঘরে এসে দাঁড়ালেই রোগ অর্ধেক সেরে যায়।

আমি তা পারলাম না মা। রোগে নিজে কষ্ট করলাম, তোমাকে কষ্ট দিলাম। অসুখের চিকিৎসার জন্যে টাকা জোগাড় করতে গিয়ে তুমি কত না অপমানের ভেতর দিয়ে গেলে। তোমাকে আমি এই কষ্ট, এই অপমানে ফেলেছি– তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও, মা।

নানিজান আমাকে বলেছেন- মৃত্যুর ঠিক আগে আগে মানুষ আল্লাহপাকের কাছে অন্যের জন্যে যে প্রার্থনা করে আল্লাহপাক তা শুনেন। শুধু তার নিজের জন্যে যে প্রার্থনা করে তা শুনেন না।

আমি ঠিক করে রেখেছি, মৃত্যুর ঠিক আগে আগে আমি আল্লাহকে বলব হে আল্লাহ, তুমি আমার মার মন থেকে আমার সমস্ত স্মৃতি সরিয়ে নিয়ে যেও। কোনোদিন যেন আমার কথা ভেবে মা কষ্ট না পায়। আল্লাহ নিশ্চয়ই আমার সেই প্রার্থনা শুনবেন।

মা শোন, ফুলির মা বুয়া আমার জন্যে কী যে কষ্ট করেছে। তা শুধু সে জানে। তুমি অবশ্যই তার শেষদিন পর্যন্ত তাকে দেখবে। তার খুব শখ, বিয়ে করে সে ঘরসংসার করে, তার আবার ছেলেপুলে হয়। কতবার যে সে আমাকে তার গোপন শখের কথা বলেছে। মাগো, তুমি দেখো তো এটা পারা যায় কি-না। আর তার বিয়েতে তুমি তাকে লাল রঙের একজোড়া স্যান্ডেল কিনে দেবে। লাল রঙের স্যান্ডেলেরও তার খুব শখ।

আসি মা?

তোমার অতি আদরের

নাতাশা

পুনশ্চ : মা, তুমি কি একবার কষ্ট করে আমাদের স্কুলে যাবে? আমাদের বাংলা আপাকে (মিস রোকেয়া) বলবে গুরু নানকের কথাটা আমি পরীক্ষা করে দেখেছি। খুব সত্যি। আর আমাদের অঙ্ক আপাকে (মিস শাহেদা) বলবে স্কুলের সব মেয়েরা তাকে যমের মতো ভয় করলেও তিনি সবার খুব প্রিয়। সবাই যে তাঁকে ভয় পায় তা তিনি জানেন। কিন্তু তিনি যে সবার খুব প্রিয় তা জানেন না। তার জানা দরকার। এবং এদের দুজনকেই তুমি আমার সালাম দেবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *