৮. পূর্বতসিদ্ধ জ্ঞান কিভাবে সম্ভব
ইমানুয়েল কান্টকে সাধারণত আধুনিক দার্শনিকদের মধ্যে সর্বোত্তম বলে মনে করা হয়। যদিও তিনি সপ্তবর্ষীয় যুদ্ধ ও ফরাসি বিপ্লবের সময় জীবন অতিবাহিত করেছিলেন, তা সত্ত্বেও তিনি পূর্ব প্রাশিয়ার কোনিসবার্গে দর্শন পড়ানো থেকে কখনও বিরত থাকেননি। তাঁর সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অবদান হল সবিচার দর্শনের আবিষ্কার। এটি একটি উপাত্ত যা মনে করে যে বিভিন্ন প্রকারের জ্ঞান আছে, যা খোঁজ নেয় কিভাবে এই জ্ঞান সম্ভব এবং এই খোঁজের উত্তরে জগতের প্রকৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন অধিবিদ্যক ফলও নিঃসৃত হয়েছে। এই ফলগুলো সত্য কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা যেতে পারে। কিন্তু কান্ট নিঃসন্দেহে দুটি বিষয় সম্পর্কে কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন? প্রথমত, এই বিষয়টি অনুধাবন করার জন্য যে আমাদের পূর্বতসিদ্ধ জ্ঞান থাকে যা সম্পূর্ণ বিশ্লেষণাত্মক নয়, অর্থাৎ এটি এমন যার বিপরীতটি স্ববিরোধিতায় দুষ্ট; এবং দ্বিতীয়ত, জ্ঞানতত্ত্বের দার্শনিক গুরুত্বকে প্রকাশ করা।
কান্টের সময়ের পূর্বে, সাধারণত বলা হত যে কোন পূর্বতসিদ্ধ জ্ঞান অবশ্যই বিশ্লেষণাত্মক। এই শব্দটি কি বোঝায় তা প্রকাশ করা যেতে পারে উদাহরণের সাহায্যে। যদি আমি বলি, একটি টাক-মাথা ব্যক্তি হয় একজন ব্যক্তি, একটি সাধারণ মূর্তি হয় একটি মূর্তি, একজন মন্দ কবি হয় কবি, তাহলে আমি বিশুদ্ধ বিশ্লেষণই উপস্থাপিত করছি। যে বিষয় সম্পর্কে বলা হচ্ছে তার অনন্ত দুটি গুণ রয়েছে, যার মধ্যে একটিকে আলাদা করে নির্দিষ্ট করা হচ্ছে। উপরের এই বচনগুলো হল তুচ্ছ এবং এদেরকে বাস্তব জীবনে গ্রহণ করা যায় না কোন বক্তার কুতর্কের পথ প্রস্তুত করা ছাড়া। এই বচনগুলোকে বিশ্লেষণাত্মক বলা হয়, কেননা উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করলেই এর বিধেয়কে পাওয়া যায়। কান্টের পূর্বে ভাবা হত যে সমস্ত বিধান সম্বন্ধে আমরা নিশ্চিত যে সেগুলো পূর্বতসিদ্ধ তা হল এই ধরনের বচন, অর্থাৎ এই সবের মধ্যে একটি বিধেয় আছে যা উদ্দেশ্যের অংশ। যদি তাই হয় তাহলে আমরা নিশ্চিত বিরোধিতার সম্মুখীন হব, যদি আমরা পূর্বতসিদ্ধ সম্পর্কে কোন কিছু জানি না একথা বলতে উদ্যত হই। একজন টাকমাথা ব্যক্তির টাক নেই একইসঙ্গে একই ব্যক্তির টাকযুক্ত হওয়াকে স্বীকার ও অস্বীকার করবে এবং এভাবে নিজেই নিজের বিরোধিতার সম্মুখীন হবে। এভাবে কান্টের পূর্ববর্তী দার্শনিকদের মতে বিরোধবাধক নিয়ম যা স্বীকার করে যে কোন কিছু একই সময়ে কোন বিশেষ গুণের অধিকারী বা অনধিকারী হতে পারে না, তা পূর্বতসিদ্ধ জ্ঞানের সত্যতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য যথেষ্ট।
কান্টের পূর্ববর্তী হিউম (১৭১১-৭৬) জ্ঞানের পূর্বতসিদ্ধ সাধারণ মত গ্রহণ করে আবিষ্কার করেছিলেন যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেগুলোকে আগে বিশ্লেষণাত্মক বলে ধরা হয়েছিল, এবং বিশেষত কারণ ও কার্যের ক্ষেত্রে, সংযোগটি হল আসলে সংশ্লেষণাত্মক। হিউমের পূর্ববর্তী বুদ্ধিবাদীরা অন্তত মনে করেছিলেন যে কার্যটি যৌক্তিকভাবে কারণের থেকে নিঃসৃত করা যায়, যদি আমাদের যথেষ্ট জ্ঞান থাকে। হিউম যুক্তি দেখিয়েছিলেন এবং সঠিকভাবেই দেখিয়েছিলেন যা এখন স্বীকার করা হয় যে এটা করা সম্ভব নয়। এ কারণে তিনি অনেক বেশি সন্দেহপূর্ণ বচন অনুমান করেছিলেন যে কারণ ও কার্যের সংযোগ সম্পর্কে কোন কিছুই পূর্বতসিদ্ধভাবে জানা সম্ভব নয়। কান্ট, যিনি বুদ্ধিবাদীদের ধারায় শিক্ষিত হয়েছিলেন, হিউমের এই সংশয়বাদের দ্বারা বিচলিত হয়েছিলেন। তিনি দেখেছিলেন যে শুধুমাত্র কারণ কার্যের সংযোগই নয়, বরং গণিত ও জ্যামিতির সমস্ত বচন হল সংশ্লেষণাত্মক অর্থাৎ বিশ্লেষণাত্মক নয়। এই সমস্ত বচনে, উদ্দেশ্যের কোন বিশ্লেষণ বিধেয়কে পরিস্ফুটিত করে না। তারা বাধা উদাহরণ হল ৭ + ৫ = ১২ এই বচনটি। তিনি যথার্থভাবে দেখিয়েছিলেন যে ১২ পেতে গেলে ৭ এবং ৫- কে একত্রিত করতে হবে। ১২-র ধারণা এদের মধ্যে নেই, এমনকি দুটি ধারণার একত্রীকরণের মধ্যেও নেই। এভাবে তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে সব শুদ্ধ গণিত পূর্বতসিদ্ধ হলেও তা প্রকৃতপক্ষে সংশ্লেষণাত্মক এবং এই সিদ্ধান্ত একটি নতুন সমস্যার সৃষ্টি করেছিল যার সমাধান খুঁজতে তিনি ব্রতী হয়েছিলেন।
কান্ট তাঁর দর্শনের শুরুতে যে প্রশ্নটি রেখেছিলেন তা হল–কিভাবে শুধু গণিত সম্ভব? এটি একটি চিত্তাকর্ষক এবং দুরুহ প্রশ্ন যার উত্তর প্রত্যেক দর্শন (যা পুরোপুরি সংশয়াত্মক নয়) অবশ্যই খোঁজার চেষ্টা করে। আমরা আগেই দেখেছি যে শুদ্ধ অভিজ্ঞতাবাদীরা যে উত্তর দেয় অর্থাৎ আমাদের গণিতের জ্ঞান বিশেষ ক্ষেত্রের থেকে আরোহের মাধ্যমে প্রাপ্ত, তা দুটি কারণে অপ্রতুলঃ প্রথমত, আরোহের নীতির শুদ্ধতা আরোহের সাহায্যে প্রমাণিত করা সম্ভব নয়; দ্বিতীয়ত, গণিতের সামান্য বচনগুলো যেমন দুই আর দুই সবসময় চার, এটি নিশ্চয়তার সঙ্গে জানা যায় শুধুমাত্র একটি ক্ষেত্র বিবেচনা করে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের গণনা করে কিছু জানা যায় না যেসব ক্ষেত্রে এদের সত্য বলে জানা গিয়েছে। এভাবে আমাদের গণিতের সামান্য বচনের জ্ঞানকে (এই একই বিষয় তর্কবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য) অবশ্যই ব্যবহারিক সামান্যকরণের চেয়ে অন্যভাবে দেখাতে হবে, যেমন– সব মানুষ হয় মরণশীল।
সমস্যাটির উদ্ভব হয় এই বিষয়ের মধ্যে দিয়ে যে এই ধরনের জ্ঞান হল সামান্য, যেখানে সমস্ত অভিজ্ঞতাই হচ্ছে বিশেষ। এটা অদ্ভুত যে আমরা বিশেষ বিষয় সম্পর্কে কিছু সত্যতা পূর্ব থেকে জানতে পারব যার সম্পর্কে এখনও আমাদের কোন অভিজ্ঞতা হয়নি, কিন্তু এটি এত সহজে সন্দেহ করা যায় না যে যুক্তি বিজ্ঞান ও পাটিগণিতে এই বিষয়টি প্রয়োগ করা যাবে। আমরা জানি না ১০০ বছর পরে কারা লন্ডনের বাসিন্দা হবে, কিন্তু আমরা জানি যে এদের মধ্যে যে-কোন দুজন এবং আরও দুজন মিলে চারজন হবে। যে বিষয় সম্পর্কে আমাদের কোন অভিজ্ঞতাই নেই তার সম্পর্কে অনুমান করার এই ধরনের আপাতশক্তি সত্যিই আশ্চর্যজনক। কান্টের এই সমস্যার সমাধান আমার মতে সঠিক না হলেও তা চিত্তাকর্ষক। তবে এই বিষয়টি খুবই দুরুহ এবং বিভিন্ন দার্শনিক একে বিভিন্নভাবে বুঝেছেন, সুতরাং এই বিষয়ে শুধুমাত্র সামান্য রূপরেখা দিতে পারি এবং এটা কান্টের মতের অনুগামী অনেকের কাছে ভুল মন হতে পারে।
কান্ট মনে করেন আমাদের সমস্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে দুই ধরনের বিষয় আছে যাদের মধ্যে পার্থক্য করা দরকার। একটি হল বিষয়ের জন্য (যাকে আমরা বাহ্যবস্তু বলি), আরেকটি আমাদের নিজেদের স্বভাবের জন্য। জড় এবং ইন্দ্রিয় উপাত্ত নিয়ে আলোচনার সময় আমরা দেখেছি যে বাহ্যবস্তু ইন্দ্রিয়-উপাত্তের থেকে আলাদা এবং ইন্দ্রিয়-উপাত্ত হল বাহ্যবস্তু ও আমাদের মধ্যে যোগাযোগের ফল। এই পর্যন্ত আমরা কান্টের সঙ্গে একমত। কিন্তু কান্টের বিশেষত্ব হল তার পথ যেখানে তিনি আমাদের ভূমিকা এবং বাহ্যবস্তুকে ন্যায়সংগতভাবে ও যথোচিতভাবে ভাগ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রাপ্ত স্কুল উপাদান-রঙ, কাঠিন্য ইত্যাদি বিষয়ের থেকে আসে এবং দেশ ও কালের উপস্থাপনা ব্যক্তি কর্তৃক প্রদত্ত হয় এবং সব রকমের সম্বন্ধে ইন্দ্রিয়-উপাত্তের মধ্যে তুলনার ফল বা একটিকে আরেকটির কারণ মনে করা বা অন্য কোন উপায়। তার এই মতের সপক্ষে প্রধান কারণ হল যে দেশকাল, কার্যকারণতত্ত্ব ও তুলনা সম্পর্কে আমাদের পূর্বতসিদ্ধ জ্ঞান থাকে, কিন্তু আসল ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্তত স্থূল উপাদান থেকে নয়। তিনি বলেন, আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে কোন কিছু যা আমরা অভিজ্ঞতায় পাই তা অবশ্যই এমন বৈশিষ্ট্য দেখাবে আমাদের পূর্বতসিদ্ধ জ্ঞানে, কেননা এই বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের স্বভাবের ফল এবং সুতরাং এই বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন করা ছাড়া কোন কিছুই আমাদের অভিজ্ঞতার আসতে পারে না।
বাহ্য বস্তু, যাকে তিনি বস্তু-স্বরূপ১ বলেন, তা তাঁর মতে অজ্ঞেয়। যা আমরা অভিজ্ঞতায় পাই তাই বিষয় হিসেবে জ্ঞাত হয় যাকে তিনি আভাস বলেন। আভাস, আমাদের এবং বস্তুস্বরূপের যুগ্ম ফল হিসাবে অবশ্যই সেই বিশেষত্ব থাকবে যা ব্যক্তির জন্য ঘটে।
আমাদের পূর্বতসিদ্ধ জ্ঞানকে নিশ্চিত করে। এভাবে এই জ্ঞান সব বাস্তব ও সম্ভাব্য অভিজ্ঞতায় সত্য হলেও তা অবশ্যই অভিজ্ঞতার বাইরে প্রয়োগ করা যাবে না। এভাবে পূর্বতসিদ্ধ জ্ঞানের অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও আমরা বস্তুস্বরূপ সম্পর্কে কিছু জানি না অথবা যা বাস্তব ও সম্ভাব্য অভিজ্ঞতার বিষয়ে পড়ে তা-ও জানি না। এভাবে তিনি বুদ্ধিবাদীদের মত এবং অভিজ্ঞতাবাদীদের যুক্তিকে ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত করার চেষ্টা করেছিলেন।
কান্টের দর্শনের ছোটখাটো সমালোচনা ছাড়া একটি প্রধান আপত্তি রয়েছে যা তার পদ্ধতি অনুসরণ করে পূর্বতসিদ্ধ জ্ঞানের সমস্যার ক্ষেত্রে মারাত্মক। আমাদের বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত হবার বিষয়টি অবশ্যই যুক্তিবিজ্ঞান ও পাটিগণিতের অনুমোদন সাপেক্ষ হতে হবে। যুক্তিবিজ্ঞান ও পাটিগণিত ব্যক্তিমনের দ্বারা সমৃদ্ধ, একথা দিয়ে এক ব্যাখ্যা করা যায় না। বাস্তব জগতের মতো আমাদের স্বভাবও হল একটি বিষয়, এবং এ বিষয়, নিশ্চয়তা দেয়া না যে এটি একই থাকবে। কান্টের বক্তব্য সঠিক হলে এটা ঘটা সম্ভব যে আগামীকাল আমাদের স্বভাব এতটাই বদলে যাবে যে দুই আর দুই মিলে পাঁচ হবে। এই সম্ভাবনা তার কখনও মনে হয়নি, কিন্তু একটি হল এমন সম্ভাবনা যা নিশ্চয়তা ও সার্বিকতাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়, যা তিনি পাটিগণিতের বচনের ক্ষেত্রে স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। এটি সত্য যে এই সম্ভাবনা আকারগত দিক থেকে কান্টের মতের সঙ্গে মেলে না যে কাল নিজে হল একটি আকার যা বিষয় আভাসের উপর প্রত্যর্পণ করে যাতে আমাদের আসল আত্মা কালে থাকে না এবং এর কোন আগামীকালও নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাকে মনে করতে হয় যে আভাসের কালক্রম আভাসের পশ্চাতে যা রয়েছে সেই বৈশিষ্ট্যে দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং আমাদের যুক্তির জন্য এটাই যথেষ্ট।
যদি আমাদের পাটিগণিতের বিশ্বাসের কোন সত্যতা থাকে তাহলে গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায় যে তারা অবশ্যই বিষয়ে সমানভাবে প্রয়োগবহুল হবে–আমরা তাদের সম্বন্ধে চিন্তা করি বা না করি। আমরা যখন বলি যে দুই আর দুই চার, তখন বিষয়টি নিশ্চিতভাবে এই পরিধির মধ্যে আসে। এটির সত্যতা হল ঠিক সেইরকম সন্দেহাতীত যেখানে দুই আভাস আর অন্য দুই আভাস মিলে চারটি আভাস তৈরি করে। এভাবে কান্টের সমাধান অযথার্থভাবে পূর্বতসিদ্ধ বচনের পরিধিকে সীমিত করে দেয় এবং এছাড়াও এদের নিশ্চয়তাকেও ব্যাখ্যা করতে অসমর্থ হয়।
কান্ট কর্তৃক বিশেষ মতবাদ গ্রহণ ছাড়াও এটি দার্শনিকদের মধ্যে খুবই প্রচলিত যে যা কিছু পূর্বতসিদ্ধ তা কিছু অর্থে মানসিক, এটি বাহ্য জগতের কোন বিষয়ের থেকে আমরা কি বিষয়ে চিন্তা করব এই পদ্ধতির উপর বেশি প্রযোজ্য। পূর্ববর্তী অধ্যায়ের আমরা তিনটি নীতি দেখেছি যা সাধারণভাবে চিন্তার নিয়ম বলে পরিচিত। যে মতের জন্য তাদের এই নাম তা হল স্বাভাবিক, কিন্তু একথা ভাবার দৃঢ় কারণ রয়েছে যে এটি হল ভুল। আসুন আমরা বিরোধবাধক নীতির একটি উদাহরণ গ্রহণ করি। এটিকে সাধারণত এই আকারে বলা হয় যে কোন কিছু অস্তিত্বসূচক ও অনস্তিত্বসূচক হতে পারে না। এই বিষয়টি যা ব্যক্ত করে তা হল–কোন কিছু একইসঙ্গে একটি গুণের অধিকারী এবং অনধিকারী হতে পারে না। এভাবে, উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি গাছ বীজ হয়, তাহলে এটি একইসঙ্গে বীজ নয় হতে পারে না, যদি আমরা টেবিলটি আয়তাকার হয়, তাহলে এটি আয়তাকার নয় এমনটা হতে পারে না ইত্যাদি।
এখন এই নীতিকে স্বাভাবিকভাবে চিন্তার নীতি বলার কারণ হল এই যে, বাইরের প্রকাশের থেকে চিন্তার মাধ্যমেই আমরা এই বচনের অনিবার্য সত্যতাকে অনুধাবন করি। যখন আমরা দেখি যে গাছটি হল বীজ, তখন আমাদের এই বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য আবার দেখার প্রয়োজন হয় না যে গাছটি বীজ নয়, শুধুমাত্র চিন্তাই আমাদের জানতে সাহায্য করে যে এটি অসম্ভব। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই সিদ্ধান্তটি ভুল যে বিরোধবাধক নিয়ম হল চিন্তার নিয়ম। যখন আমরা এই বিরোধবাধক নিয়মে বিশ্বাস করি তখন তা যা আমরা বিশ্বাস করি এরকম নয় যে আমাদের মন এমনভাবে তৈরি যে এটি অবশ্যই বিরোধবাধক নিয়মে বিশ্বাস করবে। এই বিশ্বাসটি হল মনস্তাত্ত্বিক ভাবনাচিন্তার ফল যা বিরোধবাধক নিয়মের বিশ্বাসটিকে ধরে নেয়। বিরোধবাধক নিয়মে বিশ্বাস হল বিষয়ের বিশ্বাস, এটি শুধুমাত্র মননের বিষয় নয়। এটি এমন নয় যেমন এই বিশ্বাস হল বিষয়ের বিশ্বাস, এটি শুধুমাত্র মননের বিষয় নয়। এটি এমন নয় যেমন এই বিশ্বাস যে যদি আমরা মনে করি কোন একটি গাছ হল বীজ, তাহলে আমরা একই সময় মনে করতে পারি না যে এটি বীজ গাছ নয়। এভাবে বিরোধবাধক নিয়মটি হল বিষয় সম্বন্ধীয় এবং শুধুমাত্র চিন্তা সম্বন্ধীয় নয় এবং বিরোধবাধক নিয়মে বিশ্বাস একটি চিন্তা হলেও বিরোধবাধক নিয়মটি স্বয়ং চিন্তা নয়, এটি হল বাহ্য জগতের বিষয় সম্বন্ধীয় ঘটনা। যদি এটি-যা আমরা বিশ্বাস করি যখন আমরা বিরোধবাধক নিয়মে বিশ্বাস করি–জগতের বিষয় সম্বন্ধে সত্য না হয়, তাহলে আমরা যে একে সত্য বলে প্রতিপন্ন করতে সাহায্য করে না এবং এটি দেখায় যে এই নিয়মটি চিন্তার নিয়ম নয়।
এই একই ধরনের যুক্তি অন্য যে কোন পূর্বতসিদ্ধ বিধানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যখন আমরা বিচার করি যে দুই আর দুই চার, তখন আমরা চিন্তা বিষয়ক কোন বিধান দিই না, বরং সমস্ত সত্য ও সম্ভাব্য জুড়ি সম্পর্কে বিধান দিই। এই ঘটনা যে আমাদের মন এমনভাবে তৈরি যে আমরা দুই আর দুই চার তা বিশ্বাস করি, যদিও এটি সত্য, তা সত্ত্বেও আমরা একটি জোর দিয়ে নির্দেশ করি না যখন আমরা দুই আর দুই চার এই বিষয়টি গ্রহণ করি এবং আমাদের মনের গঠনের কোন বিষয়ই দুই আর দুই চার এই সত্যকে প্রতিপাদন করতে পারে না। এভাবে আমাদের পূর্বতসিদ্ধ জ্ঞান, যদি তা ভ্রান্ত না হয়, শুধুমাত্র আমাদের মনের গঠন সম্পর্কীয় জ্ঞান নয়, বরং জগতে যা কিছু রয়েছে তার সবেতেই প্রযোজ্য হবে, মানসিক এবং অ-মানসিক উভয় ক্ষেত্রেই।
আসলে বিষয়টি হল এই যে আমাদের সব পূর্বতসিদ্ধ জ্ঞান এমন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে যা সঠিকভাবে বলতে গেলে অস্তিত্বসূচক নয়-না মনোজগতে, না বাহ্যজগতে। এই বিষয়গুলো হল এমন যাকে বাক্যের অন্তর্গত পদের দ্বারা নামকরণ করা যায় যেগুলো স্বাধীন নয়, এরা হল গুণ এবং সম্বন্ধ সংক্রান্ত বিষয়। উদাহরণস্বরূপ, মনে করা যাক যে আমি আমার ঘরের মধ্যে আছি। আমি রয়েছি এবং আমার ঘরও রয়েছে, কিন্তু মধ্যে কি অস্তিত্বসূচক? কিন্তু অবশ্যই মধ্যে এই কথাটির একটি অর্থ আছে, এটি একটি সম্বন্ধকে বোঝায় যা আমার এবং আমার ঘরের মধ্যে রয়েছে। এই সম্বন্ধটি হল এমন কিছু, যদিও আমরা বলতে পারি না যে এটি একই অর্থে অস্তিত্বসূচক যে অর্থে আমি এবং আমার ঘর অস্তিত্বসূচক। মধ্যে এই সম্বন্ধটি হল এমন কিছু যা আমরা চিন্তা করতে এবং বুঝতে পারি, কারণ যদি আমরা এটি বুঝতে না পারি, তাহলে এই বাক্যটিও বুঝতে পারবো না যে আমি আমার ঘরের মধ্যে রয়েছি। কান্টকে অনুসরণ করে অনেক দার্শনিক মনে করেন যে সম্বন্ধগুলা হল মনের কাজ, বস্তুস্বরূপের কোন সম্বন্ধ নেই, কিন্তু মন সবকিছুকে চিন্তার সাহায্যে একত্রিত করে এবং এভাবে সম্বন্ধকে তৈরি করে যে সম্বন্ধে এদের মধ্যে রয়েছে।
তবে এই মত একই রকমের আপত্তিজনক যা আমরা পূর্বে কান্টের বিরুদ্ধে তুলেছিলাম। এটি পরিষ্কার যে আমি আমার মধ্যে রয়েছি এই বচনের তুলেছিলাম। এটি পরিষ্কার যে আমি আমার ঘরের মধ্যে রয়েছি এই বচনের সত্যতাকে যা প্রতিপাদন করে, তা চিন্তা নয়। এটা সত্য হতে পারে যে আমার ঘরে একটি কেন্নো (Earwig) রয়েছে যদিও এই সত্য এই সত্যটি শুধুমাত্র কেন্নো এবং ঘর এই দুইয়ের মধ্যেকার এবং এটি অন্য কোন কিছুর উপর নির্ভর করে না। এভাবে সম্বন্ধগুলো, যা আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে ভালোভাবে দেখব, অবশ্যই এমন জগতে থাকবে যা মানসিকও নয় বাহ্যিকও নয়। দর্শনের কাছে এই জগতের বিপুল গুরুত্ব রয়েছে এবং বিশেষভাবে পূর্বতসিদ্ধ জ্ঞানের সমস্যার ব্যাপারে। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা এর প্রকৃতি এবং যে সমস্ত নিয়ে আমরা আলোচনা করছি তার প্রভাব সম্বন্ধে আলোচনা করব।