পুরাণের সমাজ
০১.
আমাকে একটু পড়িয়ে দেবেন? ব্রহ্মার মানসপুত্র সনকুমারকে জিজ্ঞাসা করলেন দেবর্ষি নারদ।
সনকুমার বললেন–আগে কতদূর পড়াশুনো করেছ, কী কী পড়েছ, সব বলে যাও। তারপর আমি বলব–ততস্ত উর্ধ্বং বক্ষ্যামি। বাধ্য ছেলের মতো নারদ কর গুনে গুনে বললেন–আমি ঋগ্বেদ পড়েছি, যজুর্বেদ পড়েছি, সামবেদ, অথর্ববেদ–তাও পড়েছি। পড়েছি জনসমাজে পঞ্চম বেদ বলে স্বীকৃত ইতিহাস এবং পুরাণ-ইতিহাসপুরাণং পঞ্চম।
নারদ এর পরে ভূতবিদ্যা থেকে আরম্ভ করে তিনি যে নাচা-গানা পর্যন্ত সব জানেন, সেটাও বললেন। এ সংলাপটা ছান্দোগ্য উপনিষদের, পণ্ডিতের কুটবিচারে যে লেখা খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম/অষ্টম শতাব্দীর বলে মনে করা হয়। আমাদের বক্তব্য খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতেই তাহলে ইতিহাস-পুরাণের একটা ধারণা ছিল। পণ্ডিতেরা ছান্দোগ্যের ভাষা-টাসা দেখে, ওটাকে আর টেনেটুনে খ্রিস্টজন্মের লাগোয়া কোনও শতাব্দীতে ফেলতে পারেননি। কিন্তু তাই বলে তারা ছাড়বার পাত্র নন। তারা বললেন–তোমরা যেমনটি মৎস্যপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, বায়ুপুরাণ দেখছ–এমনটি মোটেও ছিল না ছান্দোগ্যের যুগে। হা এ কথাটা আমরা মেনে নিয়েছি, কারণ পুরাণ লিখিয়েরাই স্বীকার করেছেন যে, বহুকাল আগে পুরাণ ছিল একটি এবং সেই পুরাণে শ্লোক ছিল নাকি এক কোটি।
পুরাণকারেরা সবাই আমাদের পিতামহের মতো। একেবারে কলিকালের শিশুদের কাছে পুরনো গল্প বলার সময় পুরাণ-পিতামহেরা যে একটু বাড়িয়ে বলবেন, তাতে হয়েছেটা কি? গবেষকদের এই এক দোষ, তারা পিতামহ-মাতামহদের মন বোঝেন না, গল্প বলার রস বোঝেন না। আরে, নাতির ঘরে পুতি সেদিনের কলিকালের ছেলে পরীক্ষিতের কাছে নিজের কালের গপ্পো বলার সময়, সম্পর্কে অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস কি একটুও রসিয়ে বলবেন না? আমাদের ঠাকুরদাদারা পর্যন্ত নেমন্তন্ন বাড়িতে ভুরিভোজনের পর তেত্রিশটি রসগোল্লা খেলে,বলতেন–তিয়াত্তরটা খেয়েছি। আর যদি ঘটনাক্রমে তিয়াত্তরটাই খেয়ে থাকেন, তাহলে আমাদের বলতেন–একশো তিয়াত্তরটা খেয়েছি। আসলে কৃতিত্বের কথায়, ভয় দেখানোর কথায় অথবা নিদেনপক্ষে নোংরা কথায়, পরচর্চা অতিকথন এবং অতিরঞ্জন এসেই যায়। এটা দোষ নয়, গল্প বলার মজা। কিন্তু এই বাড়িয়ে বলার মধ্যেও সত্য কথাটা ঠিক লুকিয়ে আছে, ঠিক যেমন আমাদের ঠাকুরদাদার গল্পে এ কথাটা অবশ্যই বোঝা যাবে যে, তিনি বেশি খেতে পারতেন। অপিচ অন্যের, পরের দশজন ঠাকুরদাদার জবান শুনলে বোঝা যাবে যে, তাদের যুগে খাবার প্রাচুর্য ছিল। সমাজতাত্ত্বিকদের টিপ্পনীটা পড়ে ঠিক এইখানেই। কাজেই পুরাণ যখন বলবে যে, অলক রাজা ছেষট্টি হাজার বছর কিংবা কার্তবীর্যাজুন পঁচাশি হাজার বছর রাজত্ব করেছিলেন, তখন অতিকথনের অংশ ছেড়ে দিয়ে নিদেনপক্ষে ছেষট্টি বছর কি পঁচাশি বছরও রাজত্বকাল বুঝব না; বুঝব তারা অনেককাল ধরে রাজত্ব করেছিলেন। ঠিক একইভাবে পুরাণ যখন বলবে যে, শূদ্র বেদ পড়লে তার মুখে গরম তেল ঢেলে দিতে হবে, কিংবা শূদ্র ব্রাহ্মণের মতো বড় বড় বাণী দিলে তাকে মেরে ফেলতে হবে, তখন বুঝতে হবে শূদ্রের প্রতি ব্রাহ্মণ সমাজের ‘অ্যাটিচুডটা মোটেই ভালো ছিল না। গবেষক যদি স্ত্রী-শূদ্রের ওপর সমস্ত শাস্তির বিধানগুলি একত্রিত করে প্রমাণ দিয়ে বলেন–আক্ষরিক অর্থে এই অত্যাচারগুলি হত, তাহলে আমি বলব পুরাণের অন্যান্য কথাগুলিও আক্ষরিক অর্থে ধরা উচিত। তাতে বিপদ বাড়বে বই কমবে না। আমরা তাই পিতামহ-সমান পুরাণকারদের গল্প থেকে, হাজারো অতিকথন থেকে তাদের কালের স্বাদ-গন্ধ অনুভব করার চেষ্টা করব। তবু যদি আমাদের কথাতেও অতিবাদ এসে যায়, তবে বুঝবেন পুরাণের রস পরিবেশনের জন্যই সেই অতিবাদ ইচ্ছাকৃত।
আসলে পুরাণে সব আছে। আপনি পুত্রের জন্য, কী নিজের বিয়ের জন্য মেয়ে পছন্দ করতে চান, পুরাণের ঠাকুরদাদা পরামর্শ দিয়ে রেখেছেন কেমন মেয়ে আপনার পছন্দ করা উচিত। আপনি বাজার থেকে শাড়ি কিনে এনেছেন, কিন্তু দু-দিন গেলেই আপনার মনে হল–শাড়িটা ঠিক পছন্দসই নয়, কিংবা পরলে বেমানান হবে। আপনি শাড়ি পালটাবেন। শাড়ি কেনার পর আপনার যে এই দ্বন্দ্ব–একে পুরাণকার বললেন–”অনুশয়’–অনুতাপ। তা এখনকার গড়িয়াহাটের দোকানদার আপনার শাটিকা-তপ্ত হৃদয় শান্ত করার জন্য সাত দিনের মধ্যে শাড়ি পালটাবার অনুমতি দেবেন। কিন্তু পুরাণকার আপনাকে আরও তিন দিন বাড়িয়ে দশ দিন সময় দিতেন। কিন্তু দশ দিনের পর গেলে পুরাণের দোকানদার মুচকি হেসে বলতেন–এখন আর পালটাপালটি হবে না, কেননা নিয়ম আছে–পরেণ তু দশাহস্য নাদদ্যান্নৈব দাপয়েৎ। আবার ধরুন–আপনি বাড়িতে কাজের মেয়ে ঠিক করলেন। সে কাল থেকে নাগব’ বলে, এল না। রাত্রে রাখা বাসন আপনাকেই মাজতে হল। এ রকম হলে পুরাণের কালে আপনি কাজের মেয়েকে আট কৃষ্ণল (মুদ্রামান) ফাইন’ করতে পারতেন। আর যদি কাজের মেয়েকে দু মাসের জন্যে রেখে, তাকে যদি দু দিনেই আপনি তাড়িয়ে দেন, তাহলে সেকালে আপনাকেও সমপরিমাণ খেসারতি গুনতে হত রাজার ঘরে। পাঠক! আপনি যদি স্ত্রীলোক হন, তাহলে পুরাণের কালে অবশ্যই রান্নাবান্না, টাকা-পয়সার হিসেব রাখতে হত আপনাকে, কিংবা সামলাতে হত ঘর-গেরস্থালি। ঠিক আছে, কিন্তু আপনি ধরুন, ট্রামে-বাসে কষ্ট করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন এবং একটি লীলাময় পুরুষ এসে আপনার গায়ের সঙ্গে সেঁটে দাঁড়িয়ে ইতিকর্তব্য পালন করতে আরম্ভ করল। এক্ষেত্রে আজকের দিনে অসন্তুষ্ট হওয়া ছাড়া আপনার কিছুই করার নেই। কিন্তু এ যদি পুরাণ-প্রভুদের দিন হত, তাহলে যে ব্যক্তি ইচ্ছে করে স্ত্রীলোকের কোমরে হাতের ছোঁয়া লাগাত কিংবা স্পর্শ করত উত্তমাঙ্গের আবরণ, জঘনদেশ, কিংবা শুধুই চুল, অথবা বারণ করা সত্ত্বেও যে পুরুষ যেখানে-সেখানে আলাপ করতে চাইত মেয়েদের সঙ্গে–এই পুরুষদের তখনকার আন্দাজে দুশো পণ করে দণ্ড দেওয়া হত।
হ্যাঁ, এসব সাধারণ টুকিটাকি কিংবা চমকপ্রদ খবর তো পুরাণে পুরাণে হাজার হাজার আছে। সেগুলি সব আমাদের পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব নয়, কিন্তু কিছু কিছু সামাজিক ব্যবহার আমাদের জেনে নিতে হবে বিভিন্ন পুরাণের ব্যাসেদের ধরে ধরে। অনেক পণ্ডিত বলেন–ব্যাস একটি নয়, ব্যাস অনেকগুলি। আমরা বলি–এটা আর নতুন কথা কি। এ তো পুরাণকারেরা নিজেরাই স্বীকার করেছেন। বিষ্ণুপুরাণের কথক-ঠাকুর পরাশর মুনিই তো অন্তত আটাশ জন ব্যাসের নাম বলে দিয়েছেন। এমনকী তার মধ্যে রামায়ণের কবি বাল্মীকিও নাকি একজন ব্যাস। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের সারথি-জাতের এক শিষ্য ছিল, যার নাম রোমহর্ষণ। রোমহর্ষণ–কেননা, তাঁর গপ্পো বলার ঢঙই এমন যে, শুনলে গায়ের নোম খাড়া হয়ে উঠবে–লোমানি হয়ঞ্চক্রে শ্রোতৃণাং যঃ স্বভাষিতৈঃ। সত্যি কথা বলতে কি, তার এই লোমহর্ষক কথকতার এতই নাম ছিল যে তিনি ব্যাসের শেখানো মূল পুরাণকথার নতুন একটি রূপ নিয়ে তার একটা আধুনিকগন্ধী নাম রেখেছিলেন–’রোমহর্ষণিকা’, ঠিক যেমন চয়নিকা, সঞ্চয়িতা। রোমহর্ষণের তিন শিষ্য অকৃতব্রণ, সাবৰ্ণি আর সাংশপায়ন। এঁরা আবার তাদের গুরুর লেখা ভিত্তি করে নিজেরা এক একটি করে পুরাণ রচনা করেন। এই তিন শিষ্যের পুরাণ এবং রোমহর্ষণিকা–এইগুলি থেকেই পরবর্তীকালে আরও আরও পুরাণ লেখা হতে থাকে। এঁরা সবাই ব্যাস, কিন্তু এক এক পুরাণ যেহেতু এক এক সময়ে বিভিন্ন ব্যাসেদের হাতে তৈরি, পুরাণ সমাজের কথাও তাই কোনও এক সময়ের কথা নয়। পুরাণের মধ্যে লুকিয়ে আছে ভিন্ন ভিন্ন সময়ের দেবতা বিশ্বাস, ভিন্ন ভিন্ন রুচি, ভিন্ন সামাজিক রীতি, ভিন্ন আচার, ভিন্ন বেশবাস এবং ততোধিক ভিন্ন খাদ্যাভ্যাস। আমরা মধুকরবৃত্তিতে একটু একটু করে যে সব কথা বলব, যদিও আমাদের বাচনভঙ্গিতে লোম খাড়া হয়ে ওঠার সম্ভাবনা একেবারেই কম।
প্রথমেই একটা কথা পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো। পুরাণকথায় আপনারা যে দেবতার পরিচয় পাবেন, তাঁদের ব্যবহার কিন্তু মানুষের মতোই। মানুষের মতোই তাদের কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ–সবই আছে। মানুষ যেমন বুড়ো হলে নিজের মৃত্যু-চিন্তায় অবসন্ন হয়, বায়ুপুরাণ লিখেছে, তেমনি দেবতারাও কালবশে নিজেদের অবশ্যম্ভাবী অবলুপ্তির কথা জেনে কাতর হন–অবশ্যম্ভাবিত্বাদ বুধ্ব পর্যায়মাত্মনঃ। এমনকী আমরা যেমন কাজকর্ম করি, কর্মফলের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হই, পুরাণের দেবতারাও তাই। পুরাণের দেবতাদের অবস্থা দেখে পরবর্তীকালের এক কবি তো হেসেই কুটিকুটি। তিনি বলেছেন-এই ব্রহ্মটা ঠিক কুমোরের মতো। কুমোর যেমন ঘটের মাথা-মুণ্ডু জোড়া দিতে সদা ব্যস্ত, তেমনি ব্রহ্মও এই ব্রহ্মাণ্ড-ভাণ্ডটাকে নিয়ে কুমোরের কাজ করে চলেছেন। আবার এই যে বিষ্ণু। আমাদের সমাজে, পরিবারে যেমন বিপদে পড়লেই বড়ো মানুষকে মাথা গলাতে হয় সংকটমোচন করতে, তেমনি বিষ্ণুকে বারবার দশ অবতার সেজে কী সংকটেই না পড়তে হয়েছে মাঝে মাঝে–বিষ্ণু যেন দশাবতারগহনে ক্ষিপ্তঃ সদা সঙ্কটে। কবির ধারণা–এ সব কিছুই ঘটছে কর্মের ফেরে, নইল রুদ্র শিবকে প্রতিদিন ভিক্ষের বাটি হাতে করে ভিক্ষে করতে বেরোতে হয়, নাকি দিনের পর দিন কামাই না দিয়ে সূর্যকে ওঠা-নামা করতে হয়। কাজেই নমস্কার যদি করতে হয়, তো দেবতাকে নয়, নমস্কার সেই কর্মকে যার জন্য দেবতাদেরও এত শাস্তি-তস্মৈ নমঃ কর্মণে।
দেবতাদের সম্মানার্থে পুরাণকারেরা পৃথিবীতে তাদের বাসস্থান নির্ণয় করতে পারেননি; করেছেন স্বর্গ নামক এক কাল্পনিক লোকে। কিন্তু স্বর্গবাসী দেবতাদেরও ইহকালের সময় ফুরোলে পরলোকের চিন্তা এবং বিষাদ–দুই-ই তাঁদের পেয়ে বসে–ইত্যোৎসুক্যবিষাদেন। অন্য দিকে এতকাল যেখানে ছিলেন তার জন্যেও তাদের মায়া হয় মনে মনে-ইহস্থানাভিমানিনঃ। এই রকম চিন্তা-বিষাদগ্রস্ত যে দেবতারা, তাদের যে চেহারাও হবে ঠিক মানুষেরই আদলে, তাতে আশ্চর্য কী। মানুষের না-দেখা দেবতার রূপ-কল্পনায় চার হাত, কি সহস্রবাহু যতই লাগুক না কেন, পুরাণকারেরা বেশ জানতেন দেবতার চেহারা মানুষের মতোই। বায়ুপুরাণ তাই পরিস্কার জানিয়েছে–দেবতাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শরীর সংস্থান–সব মানুষের মতো। ঋষিদের তত্ত্ববোধ এবং দার্শনিক সিদ্ধান্ত এই রকমই–মানুষস্য শরীরস্য সন্নিবেশস্তু যাদৃশঃ। তল্লক্ষণং তু দেবানাং দৃশ্যতে তত্ত্বদর্শনাৎ। তাহলে দেবতায় আর মানুষে তফাত কী রইল? তফাত আছে, দেবতাদের বুদ্ধি বেশি, মানুষের বুদ্ধি কম–বুদ্ধতিশয়যুক্তঞ্চ দেবানাং কায়মুচ্যতে। সত্যি কথা বলতে কি, বুদ্ধি আর ক্ষমতার জোরেই মানুষ দেবতা হয়ে যায়। আধুনিক সমাজে যাঁদের বুদ্ধি বেশি, ক্ষমতা বেশি, তারাই যেমন সমাজের হর্তা-কর্তা-বিধাতা, তেমনি সেকালের সমাজেও যাঁদের ক্ষমতা এবং বুদ্ধি বেশি ছিল, তারাই দেবতা হয়ে গেছেন। ভালো করবার ক্ষমতা যেমন তাঁদের বেশি, মন্দ করবার ক্ষমতাও তেমনি।
আচ্ছা, মনুষ্য-ব্যবহারের বিচারে আমরা যদি দেবতাদের উত্তমোত্তম মানুষ বলি, তাহলে ক্ষতি কী! এখনও সমাজে উত্তমোত্তম তারাই, যাঁরা সাধারণের ভাগ্য বিধান করেন কিংবা যাঁদের হাতে দণ্ড। পৌরাণিক দৃষ্টিতে আধুনিক প্রলেপ দিয়ে আমরা কি দেবতাদের রাজা বলতে পারি? বৈদিক ঋষিরা তো অনেককেই রাজা বলেছেন। আরও একটা জিনিস পুরাণ-ইতিহাসে লক্ষ করার মতো। সেটি হল, স্বর্গের দেবতাদের সঙ্গে পৃথিবীর রাজাদের যে দারুণ যোগাযোগ ছিল। মনুষ্যলোকে যখনই কোনও শক্তিশালী রাজা অসুবিধেয় পড়েছেন, দেবতারা অনেকেই তখন নেমে এসেছেন যুদ্ধজয়ের রক্তাক্ত ভূমিতে, তারই সাহায্যকল্পে। দেবতাদের রাজার প্রতীক ইন্দ্রকেই তো কতবার দেখা গেছে, মনুষ্য রাজার ধ্বজ-পতাকার অন্তরালে। মর্ত্যলোকে গুণী রাজার উপাধিই তো ইন্দ্র-রাজেন্দ্র, ক্ষিতীন্দ্র। আবার
উলটোদিকে, স্বর্গের দেবতারা যখন শত্রুপক্ষের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছেন। না, তখনই দেখি মানুষ রাজা ছুটছেন স্বর্গের দিকে, স্বয়ং দেবরাজের রথ আসছে তাকে নিতে। দশরথ স্বর্গে গেছেন যুদ্ধ করতে, মুচুকুন্দ গেছেন, খট্টাঙ্গ গেছেন, দুষ্যন্ত গেছেন। আরও কত রাজা স্বর্গক্ষেত্রে যুদ্ধজয়ের পর দেবস্থানের ধন্যধ্বনি শুনতে শুনতে স্বর্গের মন্দারমঞ্জরী এনে গুঁজে দিয়েছেন রাজ-রানির খোঁপায়। আবার দেখুন, যখনই পুরাণকাহিনিতে বিষ্ণুর অবতার নেমে এসেছেন ডুয়ে, তখনই তার সাহায্যকল্পে স্বর্গের দেবতারা এসে জন্মেছেন মনুষ্যলোকে রাজরানিদের গর্ভে। মনে রাখা দরকার, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজরানির গর্ভে, ঋষিপত্নীর গর্ভে নয়।
কি পশ্চিমি পুরাণকাহিনির মধ্যে, কি প্রাচ্য পুরাণকথায় এটা প্রায় দেবলোকের বৈশিষ্ট্য বলা যেতে পারে যে, তারা মনুষ্য রমণীর গর্ভ উৎপাদনে বড়োই দক্ষ। আমাদের ঘরের দেবতারাও সোজাসুজি এসে মনুষ্য রমণীর গর্ভাধান করেছেন নির্দ্বিধায়। যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, কর্ণের কথা ছেড়েই দিলাম, ভারতবর্ষের বানরীরাও বাদ যায়নি দেবতার রতিগ্রাস থেকে, যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারাও বানর ঘরের রানি। পুরাণে, ইতিহাসে আবার এ-ও দেখা যাবে যে, ইন্দ্র, চন্দ্র, যম, বরুণ–এই সমস্ত শক্তিশালী দেবতার অংশেই রাজার জন্ম। যে-কোনো রাজাই তাই। আমরা তাই পৌরাণিক দেবতাদের যেমন রাজার জাত বলব, তেমনি মর্ত্যভূমির রাজাদেরও দেবতার জাত বলব। তাহলে আমাদের আগেকার সিদ্ধান্তটা একটু ঘষামাজা করে দেবতা এবং রাজাদেরই আমরা উত্তমোত্তম মানুষ বলব। উত্তমোত্তম এইজন্যে যে, সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির নিরিখে মুনি-ঋষিদের উত্তম’ উপাধি দিতেই হবে। মধ্যম বলব সাধারণ ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়দের–যাঁরা সমাজে সাধারণ সুবিধেগুলি সব সময়ই পেতেন এবং যাদের একাংশ সাধনা, তপস্যার মাধ্যমে ঋষি মুনির পর্যায়ে চলে যেতেন এবং অন্যাংশ ক্ষমতা এবং বুদ্ধির জোরেই রাজপদবি লাভ করতেন। আর সমাজের সবচেয়ে বড়ো অংশ যে ‘পাবলিক’, তারা যেমন গণতন্ত্রের যুগেও কার্যত অধম অবস্থায় আছে, পৌরাণিক রাজতন্ত্রের যুগেও তাই ছিল। কাজেই ‘পাবলিক’-কে অধম বলতে কোনো অসুবিধে নেই।
একথা অবশ্য মানতেই হবে পৌরাণিকেরা আমাদের মতো কুটিল ছিলেন না। এখনকার দিনে সমাজের অধম সাধারণ মানুষকে মৌখিকভাবে গণতান্ত্রিক মূল্য দিয়ে মনে মনে তাদের পাঁঠা ভাবা হয়, পুরণের যুগে কিন্তু এমন ছিল না। যাদের তারা অধম ভাবতেন, তাদের তারা সামনাসামনিই অধম বলতেন। শূদ্রদের তারা অধম ভাবতেন এবং সামনাসামনিই অধম বলতেন। স্ত্রীকে পছন্দ হচ্ছে না, ত্যাগ করো তাকে। আবার যাকে পছন্দ হল, তার সঙ্গফল অবধারিত রতিক্রিয়া। এই সোজাসুজি দৃষ্টি থাকার ফলে তারা এ-ও বুঝেছিলেন যে, সমাজের উচ্চকোটির মানুষ যাঁরা, তাদের বুদ্ধিবৃত্তি, ক্ষমতা এবং মানসিক বলের সঙ্গে দোষও কিছু থাকে। এই সহজ কথাটা সহজে বুঝেছিলেন বলেই পৌরাণিকেরা দেবতা, মুনি কিংবা রাজাদেরও চারিত্রিক ত্রুটিবিচ্যুতি দেখাতে লজ্জাবোধ করেননি।
প্রায় প্রত্যেক পুরাণেই যে বিষয়টি আরম্ভ-সর্গগুলি অধিকার করে আছে, তা হল সৃষ্টি। আমরা জানি যে-কোনো সৃষ্টির মূলে আছে কাম। পণ্ডিতের ভাষায় biological motivating force; মৎস্যপুরাণ জানিয়েছে–ব্রহ্ম যখন বেদাভ্যাসে রত ছিলেন, সেই অবস্থায় তার দশটি মানস পুত্র জন্মায়। এঁরা সবাই মাতৃহীন, অযযানিজ এবং স্থিতধী মুনি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু মজা হল, এই সম্ভ্রান্ত মুনিকুল সৃষ্টির পরেই ব্রহ্মা তাঁর বুক থেকে ধর্ম সৃষ্টি করলেন, হৃদয় থেকে কাম এবং অন্যান্য অঙ্গ থেকে লোভ, মোহ, অহঙ্কার। তার মানে কি সৃষ্টিকারী ব্রহ্ম বুঝতে পেরেছিলেন যে, জীবনে ধর্ম যেমন প্রয়োজন, কামও তেমন প্রয়োজন! সময় বিশেষে লোভ, মোহ, অহঙ্কারও যে জীবনের শক্তি জোগায় এটা বোঝানোর জন্যই বোধহয় এরা ব্রহ্মার পুত্র বলে স্বীকৃত। পৌরাণিক বলেছেন, এই পুত্রগুলির সঙ্গে একটি কন্যাও আছে। সত্যি কথা বলতে কি, এই কন্যা জন্মের প্রসঙ্গেই পৌরাণিকেরা এমন একটি জীবন-সত্য স্বীকার করে নিয়েছেন, যা তারা চিরকাল প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছেন।
প্রজা সৃষ্টির সময় ব্রহ্মা নাকি চতুর্বেদের সার সাবিত্রী-মন্ত্র হৃদয়ে ধারণ করে জপে বসেছিলেন। হঠাৎ তার পবিত্র দেহ ভেদ করে অর্ধেক পুরুষ এবং অর্ধেক স্ত্রী জন্মাল। অর্ধেক মানে এই নয় যে, এরা একটি পুরুষেরও অর্ধেক কিংবা একটি নারীরও অর্ধেক। স্বরূপত, যে-কোনো একটি পুরুষ কিংবা যে-কোনো একটি নারী সৃষ্টি রহস্যের অর্ধাংশমাত্র। এরা মিলিত হলে তবেই না সম্পূর্ণ মানুষটা। আমার বক্তব্য কিন্তু এখানে নয়। পৌরাণিকেরা বলেছিলেন–ব্রহ্মার ভাবটা ছিল যেন, সব তার মন থেকেই তৈরি হচ্ছে–মানসপুত্র–তার মধ্যে কামগন্ধের ছিটেফোঁটাও নেই যেন। তার শরীর ভেদ করে এইমাত্র যে কন্যাটি জন্মাল, তাকে তিনি আত্মজা’ বলে ডেকেছেন, তাঁর নামকরণ করেছেন সাবিত্রী বলে, সরস্বতী বলে, শতরূপা বলে। ঠিক যেমন সুন্দরী রমণীকে প্রথম দেখে আমরা ভাবি–এ আমার হৃদয়ের ধন, মানসরূপিণী, এর সঙ্গে আমার কাম-সম্বন্ধ নেই কোনও; সোচ্ছ্বাসে তার নামকরণ করি প্রিয়া বলে, প্রণয়িনী বলে, মানসী বলে। কিন্তু হঠাৎ করে হৃদয়ের গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসে কীট আর ঠিক ব্রহ্মার মতোই তখন বলে উঠি–আহা কি রূপ, কি রূপ–অহো রূপ অহো রূপমিতি চাহ প্রজাপতিঃ। কন্যার রূপ দেখে বিভু ব্রহ্মা কামনায় পীড়িত হলেন।
ব্রহ্মার মন থেকে আগে যে সব মুনিরা জন্মেছিলেন সেই বশিষ্ঠ প্রমুখ মানসপুত্রেরা পিতার অঙ্গজাত কন্যাকে ‘বোন, বোন’ বলে ডাকতে থাকলেন। কিন্তু ব্রহ্মা খালি কন্যার মুখটি দেখেন আর বলেন–অহহ রূপম্ অহহা রূপ। প্রণামনা সেই কন্যা ব্রহ্মার চারদিকে ঘুরে প্রদক্ষিণ করল, কিন্তু ব্রহ্মার কেবলই ইচ্ছে হতে লাগল নারীরূপ দেখার। লজ্জা! লজ্জা! মানসজাত পুত্রদের সামনে এ কি হল, লজ্জা-পুত্রেভ্যো লজ্জিতস্য–অতএব ব্রহ্মার তপোরুক্ষ মাথার দক্ষিণ দিক থেকে দ্বিতীয় একটি হলদে রঙের মুখ বেরোল–ভালো করে রূপ দেখার জন্য। পশ্চিম দিক থেকে যে মুখটি বেরোল, সেটি তো কন্যার রূপ দেখে বিস্ময়ে স্ফুরিতাধর। বাঁদিক থেকে চতুর্থ মুখ যেটি বেরোল, সেটি একেবারে কামশরাতুর। ঠিক এমন অবস্থাতেও আরও একটি মুখ দেখা গেল ব্রহ্মার এবং সেটিও নাকি তার কামাতুর অবস্থার জন্যই। কথাটা কেমন হল? একটি কামাতুর মুখ, আবার কামাতুরতার জন্য আরও একটি। আসলে মানুষ রূপ দেখে, বিস্মিত হয়, কামনাও জাগে। কিন্তু কামনা জাগার পরে মানুষের যে মুখটি প্রকট হয়ে ওঠে, সে মুখটি তো আর মানুষের মতো থাকে না। কাজেই ব্রহ্মার কামদিহ্ম মুখের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল আরও একটি মুখ–যার লজ্জা নেই, ভাবনা নেই, শুধুই সে নগ্নতার কুতূহলী–আলোকন-কুতূহলাৎ। সৃষ্টিকার্য সম্পন্ন করার জন্য ব্রহ্মার এতদিনের তপস্যা নিজের কন্যার সম্ভোগ বাসনায় সম্পূর্ণ বৃথা হয়ে গেল। ব্রহ্মা তার মানসপুত্রদের প্রজা সৃষ্টির আজ্ঞা দিয়ে নিজে শতরূপাকে বিয়ে করে ফেললেন। তারপর! তারপর কমলকলির মুখ বন্ধ হয়ে গেল। শতরূপার সঙ্গে একশো বছর কেটে গেল–সলজ্জাং চকমে দেবঃ কমলোদরমন্দিরে।
এই গল্পটার মধ্যে নাকি রূপক আছে। চতুরানন ব্রহ্মর চারটে মুখ থেকে চতুর্বেদের জন্ম। বেদসার গায়ত্রী অথবা সাবিত্রী তাই ব্রহ্মর অঙ্গজা। বেদের সঙ্গে গায়ত্রীর সম্পর্ক মিথুনের মতো, বেদস্বরূপ ব্রহ্মার সঙ্গেও তাই–বিরিঞ্চি যত্র ভগবাংস্তত্র দেবী সরস্বতী। কিন্তু ব্রহ্মা এবং সরস্বতীর রূপকের সম্পর্ক যাই হোক আমরা শুধু পৌরাণিকের বাস্তব দৃষ্টিটুকু বোঝাতে চাই। কামনার সূত্রই যে জীবনের প্রথম ইন্ধন–এ কথাটা পিতামহের ব্যবহারে প্রমাণ করে দিয়েই পৌরাণিক যেন আধুনিক উপন্যাস সমালোচনার প্রথম কথাটি বললেন। তাদের এই বাস্তববোধ ছিল যে, সংঘাত ছাড়া, ‘টেনশন’ ছাড়া মানুষের জীবন চলে না। এ বোধ যে কত বড়ো বোধ তা বলে বোঝাতে পারব না। ব্রহ্মার আদেশমতো তাঁর। মানসপুত্রেরা যখন জরা-মরণ-হীন সিদ্ধদের জন্ম দিচ্ছিলেন, তখন ব্রহ্মা বললেন–দেখ বাপু! এই জরা-মৃত্যুবর্জিত কতকগুলি স্থাণু সৃষ্টির মধ্যে কোনো রহস্য নেই–নৈবংবিধা ভবেৎ সৃষ্টিৰ্জরামরণবর্জিতা। জীবনের। মধ্যে শুধু নিরঙ্কুশ শুভই থাকবে–তাহলে জীবনের কোনো অর্থ থাকে না। শুভের সঙ্গে অশুভের সংঘাত হবে বার বার, তবেই না সৃষ্টির মজা–শুভাশুভত্মিকা যা তু সৈব সৃষ্টিঃ প্রশস্যতে। এই শুভ এবং অশুভের গতি অনুসারেই পৌরাণিক সমাজ-জীবনের ধারা নিরন্তর বয়ে চলেছে। দেবতা, ঋষি, রাজা এবং সাধারণ মানুষ–সকলের জীবনেই কাজ করছে এই শুভাশুভের সংঘাত।
একথা অবশ্যই মানতে হবে যে, এখনকার সমাজের সূক্ষ্ম অনুভূতির নিরিখে পৌরাণিক সমাজের নীতি-নিয়ম বিচার করা যায় না। কারণ তখনকার সমাজ ছিল শিথিল, ন্যায়-অন্যায়ের ধারণাও নির্ভর করত বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের ওপর, ইচ্ছার তীব্রতার ওপর। ধরুন আপনার স্ত্রী আপনার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না, আপনি ঘুমোনোর আগেই সে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে, আপনি সরস চুম্বন করলে সে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চুম্বিত স্থানটি পুঁছে দেয়–চুম্বিতা মার্ক্সি বদনং, আপনাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখলে এমন ভাব করে, যেন পাড়ার মুদি মিসে আসছে–এ রকম বউকে আপনি কী করবেন? আজকের দিনের সামাজিক নীতিবোধে আপনি তো তাকে ত্যাগ করতে পারেন না। আপনি তাকে অপছন্দ করতে পারেন, কিন্তু একেবারে ফেলে দিতে পারেন না, দায়িত্বও অস্বীকার করতে পারেন না। কিন্তু এই রকম স্ত্রীর ব্যাপারে আপনি যদি পুরাণজ্ঞ ঋষির পরামর্শ চান, তিনি সহজভাবে বলবেন–ওটাকে বাদ দিয়ে আর একটা বিয়ে করো বৎস, যে তোমাকে ভালোবাসবে–তাং ত্যক্তা সানুরাগাং স্ত্রিয়ং ভজেৎ। পুরাণের কালে সেই সানুরাগা রমণীটি স্বামীর সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করত জানেন? স্বামীকে দেখামাত্রই সে খুশি-খুশি হয়ে উঠতে, কিন্তু স্বামী তার দিকে সানুরাগে তাকালেই তার মুখে ফুটে উঠত লজ্জা-লজ্জা ভাবদৃষ্ট্রেব হৃষ্টা ভবতি বীক্ষিতে চ পরাংমুখী। লজ্জা-লজ্জা ভাব থাকলেও সে রমণী কিন্তু ফালুক-ফুলুক করে তাকাবে। ওদিকে বুকের আঁচল সরে গেলে একটু-আধটু খুলেও রাখবে আবার কুৎসিত দেখা গেলে গোপন অঙ্গ ঢাকা দেবে। স্বামীকে দেখিয়ে দেখিয়ে বাচ্চা ছেলের গালে চুমো খাবে–তদ্দর্শনে চ কুরুতে বালালিঙ্গনচুম্বন। এই ছেলেখেলার ফলাফলে উত্তেজিত স্বামী যদি সেই রমণীকে একবার স্পর্শ করে, তাহলেই তিনি পুলকে, আবেগে একেবারে ভেঙে ভেঙে পড়বেন–স্পৃষ্টা পুলকিতৈরঙ্গৈঃ স্বেদেনৈব চ। ভজ্যতে।
পুরাণের এই বর্ণনা মিলিয়ে সেই মনোহরা রমণীটি আপনি পাবেন না, যদি বা পান দেখবেন বিয়ে করার উপায় নেই তাকে। কিন্তু পৌরাণিককালে আপনার স্ত্রী বর্তমান থাকতেও পুরাণের সুলক্ষণা রমণীটিকে আপনি ঘরে আনতে পারতেন। কারণ, আগেই বলেছি, নীতি-নিয়মের বোধটা ছিল অন্যরকম। পুরাণের ঋষিরা অবশ্য তাদের কালের সমস্ত দুষ্কর্ম কিংবা অন্যায়গুলির দায় চাপিয়ে দিয়েছেন ভবিষ্যৎকালের ওপর। ঠিক এই কারণেই প্রায় প্রত্যেকটি প্রাচীন পুরাণেই কলিকালে কী ঘটবে তার একটা বর্ণনা আছে। অথচ কলিকালে যা ঘটবে বা যা এখন ঘটছে, তার অনেক কিছুই ঘটত সেই দেবতা, ঋষি বা রাজাদের যুগে। পৌরাণিকেরা একদিকে তত্ত্বগতভাবে এক আদর্শ সমাজের কথা বলছেন, অন্য দিকে আখ্যান এবং উপাখ্যানের মাধ্যমে তারা যা জানাচ্ছেন তাতে ফুটে উঠছে আদর্শচ্যুতির সম্ভাবনা। বিভিন্ন উপাখ্যানের সঙ্গে তাদের উপদেশের মিল। থাকছে না। বস্তুত পৌরাণিক ঋষিদের যুগে যা ঘটছিল এবং যা তারা ঘটুক বলে চাইছিলেন না, তারই ছায়া পড়েছে তাদের কলিকালের ভবিষ্যবাণীতে। অনীপ্সিত এই কলিযুগ আসলে তাদেরই কালের ত্রুটিবিচ্যুতির প্রতিবিম্ব। পৌরাণিক যুগের কথা বলতে গিয়ে পুরাণ বিশেষজ্ঞ রাজেন্দ্রচন্দ্র হাজরা তাই লিখেছেন–The Puranic chapters on the Kali age are the records of the state of society during the period with which we are concerned here. প্রধান তথা পুরনো। পুরাণগুলির মধ্যে বায়ু, মৎস্য, বিষ্ণু, কুর্ম, ব্রহ্মাণ্ড এবং ভাগবত পুরাণের মধ্যে কলিকালের ধর্ম, আচার, আচরণ ব্যাখ্যা করা আছে। ভারত ইতিহাসের অন্যান্য পুঁজি এবং উপাদানগুলি নিপুণভাবে পরীক্ষা করলে আমরা দেখতে পাব সমাজের যে ছন্দোভঙ্গ এই কলিধর্মে বর্ণনা করা হয়েছে, তা অনেকটাই পৌরাণিক সমাজের প্রতিচ্ছবি। পৌরাণিক সমাজের টুকিটাকি জোগাড় করতে গেলে এই কলিকালকে বাদ দিলে মোটেই চলবে না।
আশি বছরের বুড়ি ঠাকুমা যদি নাতনিকে মিনি-ম্যাক্সি পরতে দেখেন তাহলে প্রথমে চমকে যান, তারপর অনুযোগের সুরে বলেন–কালে কালে কত কী দেখছি, আর কত কিই বা দেখতে হবে। ঠিক একইভাবে পুরাণ-যুগের কোনো বৃদ্ধ-বৃদ্ধা হয়তো সেকালের কোনো আধুনিক নাতনিকে চুলের কায়দা করতে দেখেছিলেন। ফলে অবধারিত মন্তব্য শোনা গেছে–কলিকালের মেয়েরা শুধু চুলের কায়দা দেখাবে–কলৌ স্ত্রিয়ো ভবিষ্যন্তি তদা কেশৈরলংকৃতাঃ। সেই যুগে হয়তো সেই প্রথম মেয়েদের চুলে কাটা গুঁজে খোঁপা করার চল উঠেছিল। ব্যাস, বৃদ্ধা নাক সিটকে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছেন-কলিকালের মেয়েগুলো সব মাথায় লোহার কাঁটা দিয়ে ঘুরে বেড়াবে, ঢঙ কত–প্রমদাঃ কেশশূলাশ্চ ভবিষ্যন্তি কলৌ যুগে। বৃদ্ধ স্থবিরের কাছে তাদের কালের আধুনিকতাই আশঙ্কার রূপ ধরে কলিকালের ধর্মে ঢুকে পড়েছে। পুরাণে বর্ণিত কলিকাল অতএব তাদেরই কলি।
আগে বলেছি–কলির সর্বগ্রাসী হাঁ-মুখটাকে মাত্র পাঁচ জায়গায় সীমায়িত করতে পেরে এবং একপেয়ে ধর্মকে আপাতত বাঁচাতে পেরে পরীক্ষিৎ খুব খুশি হলেন বটে কিন্তু অনভিজ্ঞ পরীক্ষিৎ কলির সন্ধ্যা’ কথাটির অর্থ বোঝেননি। তিনি বোঝেননি সকালবেলায় রাত্রিদিনের সন্ধিক্ষণে দিনের ভাগ যতটুকু থাকে, রাতের ভাগও ততটুকুই থাকে। তিনি বোঝেননি যে কলি-মহারাজকে চাক্ষুষ দেখাটাই কলির আরম্ভ নয়–গোলমালটা আরম্ভ হয়েছে দ্বাপর যুগ থেকেই। এমনকি তিনি এ-ও বোঝেননি যে, তার বাপ-পিতামহেরাও ছিলেন কলির পোষ্য। একটা কথা জনসমাজে চালু আছে যে, কৃষ্ণ দ্বাপর যুগের লোক। মোটেই নয়। কৃষ্ণ আমাদের মতোই কলিযুগের মানুষ, একেবারে আক্ষরিক অর্থের কলির কেষ্ট’। হরিবংশে লক্ষ করবেন–দানবরাজ কাল্যবনকে হত্যা করার জন্য কৃষ্ণ তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে মুচুকুন্দের সামনে নিয়ে এসেছেন। কালযবন মথুরাবাসীর অবধ্য ছিল এবং মুচুকুন্দের ওপর দেবতাদের আশীর্বাদ ছিল যে, তার ঘুম ভাঙালেই তার চোখের সামনে যে আসবে, সেই পুড়ে যাবে। কৃষ্ণ ঘুমন্ত মুচুকুন্দের আলো-আঁধারি গুহায় প্রবেশ করলেন, পেছন পেছন কালযবন। কৃষ্ণ মুচকুন্দের চোখ এড়িয়ে দূরে দাঁড়ালেন। এদিকে কালযবন মুচুকুন্দকে কৃষ্ণ মনে করে তার ঘুম ভাঙালেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই ভস্মসাৎ। কিন্তু এবারেই হল আসল মজা। ঘুম ভেঙে মুচুকুন্দ কৃষ্ণকে দেখে ভাবলেন–ব্যাপারটা কী? এরকম একটা খুদে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে–বাসুদেবমুপালক্ষ্য রাজা হ্রস্বং প্রমাণতঃ। মুচুকুন্দ বললেন–আপনি কে? আপনি কি বলতে পারেন ঘুমন্ত অবস্থায় আমার কতদিন কেটেছে? কৃষ্ণ বললেন, আজ্ঞে, আমি যদুবংশের ছেলে, আমার নাম কৃষ্ণ বাসুদেব। আপনি সেই ত্রেতা যুগ থেকে ঘুমোচ্ছেন–এখন কলিযুগ চলছে, এবারে বলুন আপনার জন্য কী করতে পারি–ইদং কলিযুগং বিদ্ধি মিন্যৎ করণি তে।
ঘুমচোখ ঘষে মুচুকুন্দ গুহা থেকে বেরিয়ে এলেন কলিযুগের প্রকৃতি দেখবার জন্য। দেখলেন পৃথিবী বেঁটে আর খুদে মানুষে ভরে গেছে–ততো দদর্শ পৃথিবী আবৃতাং হ্রস্বকৈরৈঃ। তাদের উৎসাহ, শক্তি, পরাক্রম সবই কেমন কম কম। তিনি আর এই স্বল্পবল পৃথিবীতে বাসযোগ্য মনে করলেন না, চলে গেলেন হিমালয়ে! অবতারবাদী সংরক্ষণশীলেরা মনে করেন এই যে কৃষ্ণের মুখে পষ্টাপষ্টি কলিযুগের কথা শোনা গেল এটা নাকি দ্বাপর-কলির সন্ধিলগ্ন। আমরা বলি ইদং কলিযুগং’ বললে কি কোনো সন্ধিলগ্ন বোঝায়? তাছাড়া প্রমাণ তো আরও রয়ে গেছে। স্বনামধন্য পরশুরাম বিষ্ণুপুরাণের যে অংশ অবলম্বনে রেবতীর পতিলাভ’ গল্পটি লিখেছিলেন, সেখানেও রেবতীর বাবা ব্রহ্মার আসরে নাচ-গান শুনে এসে দেখেন পৃথিবীতে কলিকাল এসে গেছে–আসন্নো হি তৎ কলিঃ। তার অবস্থাও হয়েছিল মুচুকুন্দের মতোই। বেশ কিছুদিন ‘স্পেসে কাটিয়ে পৃথিবীতে ফিরে রৈবত কুকুষ্মী দেখলেন–তিনি একেবারে একা হয়ে গেছেন আর পৃথিবী অল্পশক্তি ক্ষুদে মানুষে ভরে গেছে–দদর্শ হ্রস্বান্ পুরুষান্ অশেষা/অতেজসঃ স্বল্পবিবেকবীর্যান্।
তাহলে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি কৃষ্ণ, বলরাম, পাণ্ডব, কৌরব–এরা সবাই আমাদের মতো বেঁটে-খাটো কলিযুগের মানুষ এবং পুরাণের ইতিহাস মানে প্রায় কলিযুগেরই ইতিহাস। নৃতাত্ত্বিকেরা কী বলবেন জানি না তবে পুরাণজ্ঞ ঋষিদের ধারণা ছিল–মানুষের চেহারা ক্রমেই বেঁটে হয়ে যাচ্ছে। তবে বেঁটে-খাটো হলে হবে কি, এদের বুদ্ধি কম ছিল না। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি–এই চতুর্যুগের ভাবনা ভারতবর্ষ ছাড়া অন্যত্র কোথাও নেই–অন্যত্র ন ক্কচিৎ। তবে নিবিষ্ট মনে পুরাণগুলি দেখলে বোঝা যায় যে, সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি–আসলে মনুষ্যত্বের ক্রম-ক্ষীয়মাণ ইতিহাস অথবা উলটোদিক দিয়ে জটিলতার ক্রমবর্ধমান ইতিহাস। আমাদের কালের প্রাচীনদের কাছে প্রায়ই শুনি যে, তাদের যুগটা ছিল অন্য রকম। লোকের ধর্মভীতি ছিল, শৌচ, আচার ছিল, আর মেয়েরা ছিল সব দারুণ ভালো। আমাদের পৌরাণিকেরা ঠিক একইভাবে বলেছেন যে, সত্যযুগে যেমন সুদিন ছিল, ত্রেতাযুগে তা ছিল না, দ্বাপরের অবস্থা বেশ খারাপ আর কলিকালের তো কথাই নেই।
পুরাণকাহিনিতে সত্যযুগের কল্পনায় যে অনন্ত মাহাত্ম্য আছে তাতে মনে হয় যে সমাজটা ছিল একেবারে বিকারহীন, একেবারে নিরেট। মানুষ ভালো, মন ভালো, আচার আচরণ সব ভালো। শোক-তাপ, দুঃখ-কষ্ট, লোভ-মাৎসর্য, ধর্মাধর্ম কিছুই নেই। এই কাল্পনিক সমাজ খুব ভালো হতে পারে, তবে বিকারহীনতা জড়তারই নামান্তর। সত্যযুগের এত মাহাত্ম্যের মধ্যেও কূর্মপুরাণ লক্ষ করছে যে, সে যুগের মানুষেরা ছিল নির্জনতাপ্রিয় এবং তাদের বাসস্থান বলে সঠিক কিছু ছিল না–অনিকেতাঃ। সমুদ্রতীর আর পর্বতের গুহাই ছিল তাদের থাকবার জায়গা-পর্বতেদধিবাসিন্যঃ। পুরাণের মতে, সমস্ত জটিলতার সূত্রপাত ঘটে ত্রেতা যুগে। এই জটিলতার সঙ্গে যে অর্থনৈতিক কারণের যোগ ছিল, সেটাও কূর্মপুরাণ লক্ষ করেছে। আগে হাজার হাজার গাছই মানুষকে জীবন ধারণে সাহায্য করত, কিন্তু হঠাৎ তাদের মধ্যে কামনা আর লোভ দেখা গেল-কামলোভাত্মকো ভাব স্তদা হ্যাঁকস্মিকো ভবৎ। কূর্মপুরাণ বলেছে, এই কামনা আর লোভের ফলেই মানুষের সমস্ত বৃক্ষবাসগুলি নষ্ট হয়ে গেল। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, এ হল সেই যুগ, যখন বিভিন্ন আর্যগোষ্ঠীরা এক বনের খাবার শেষ করে আরেক বনে পৌঁছচ্ছিলেন। কারণ পুরাণের বার্তামতো মানুষের অনুতাপে আবার বনবৃক্ষেরা তাদের ঘরবাড়ি দিয়েছে, খাবার ফল দিয়েছে, দিয়েছে লজ্জাবস্ত্র–বষ্কলবাস। গাছের পুটকে পুটকে মধু’–ভালোই ছিল প্রজারা। কিন্তু পুরাণ বলছে–কালক্রমে আবার মানুষের মধ্যে লোভ দেখা গেল। মানুষেরা জোর করে যে গাছ থেকে যত মধু পাবার নয়, তার চেয়ে বেশি মধু সংগ্রহ করা আরম্ভ করল–বৃক্ষাংস্তান্ পর্যগৃহ্নন্ত মধু চামাক্ষিকং বলাৎ। এ-মধু মধুমক্ষিকা সংগৃহীত নয়, অমাক্ষিক মধু। খাবার।
যতটুকু ব্যবহারে গাছ জীর্ণ হয় না, তার চেয়ে বেশি ব্যবহার করার ফলেই বনগুলির মরণদশা উপস্থিত হচ্ছিল। আর এই যে বারবার গাছেরা জন্মাচ্ছে, লুপ্ত হচ্ছে, আবার জন্মাচ্ছে–এই বর্ণনা পশুপালী যাযাবর আর্যজাতির আরণ্যক স্মৃতিমাত্র। কূর্মপুরাণ বুঝিয়ে দিয়েছে শুধুমাত্র গাছের ছায়া আর বনের ফলের অপ্রতুলতার জন্যই মানুষ পাকাপাকিভাবে বাড়িঘর বানানোর প্রেরণা পেল; শীত, বর্ষা আর রোদের কবল থেকে বাঁচতে এবার তারা আবরণ চাইল এবং তা বানিয়ে দিল গাছেরাই–চক্রুরাবরণানি চ। বায়ুপুরাণ বলেছে–মানুষ আগে গাছের আশ্রয়ে থাকত বলে গাছের কাছেই তারা বাড়ি তৈরির কায়দা শিখেছে। গাছের ডাল যেমন একটা সামনে, একটা পেছনে, একটা এপাশে, একটা ওপাশে বেড়ে উঠে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক সেই বুদ্ধিতেই মানুষ বাড়ি বানানো শিখেছে। গাছের শাখার শিক্ষা থেকে বাড়ি তৈরি হয় বলেই বাড়ির নাম শালা’-বুব্বান্বিষ্যংস্তথা ন্যায়ো বৃক্ষশাখা যথা গতাঃ। তথা কৃতাস্তু তৈঃ শাখাঃ…। গাছগুলি একের পর এক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে–এই বিনাশের আশঙ্কার মধ্যেই জন্ম নিল কৃষিকর্মের সুপরিকল্পিত ভাবনা, পশুপালনের চিন্তা-বার্তোপায়মচিন্তয়। তবে ত্রেতা যুগের প্রথম কৃষিকর্মে নাকি লাঙল লাগত না, বীজও লাগত না–অফাল কৃষ্টাশ্চানুপ্তা। আসলে পৌরাণিকের রূপকথায় লাঙল ব্যবহারের চেষ্টা, অপচেষ্টা এবং অবশেষে সার্থকতার ইতিহাসটুকু বেমানান। তাই লাঙল আর বীজ ছাড়াই সেখানে কৃষিকর্ম সম্পন্ন হয়।
ঠিক এই রকম একটা সময়েই মানুষের মধ্যে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত সম্পত্তির চেতনা জন্মাল। কেননা পুরাণ বলেছে–ত্রেতাযুগের কালধর্মে মানুষের মধ্যে আবার লোভ জন্মাল এবং তারা জোর করে নদী, পাহাড়, জমি, গাছপালা, ওষধি–একের পর এক দখল করতে লাগল–ততস্তে পর্যগৃহ্নস্ত… প্ৰসহ্য তু যথাবলম্। ঠিক এই গোষ্ঠীগত অধিকারের পালা যখন চরম আকার ধারণ করল, তখনই বোধহয় সেই মানুষটা জন্মালেন, যাঁর নাম পৃথু। এঁর নাম থেকেই এই মর্তভূমির নাম পৃথ্বী অথবা পৃথিবী। বস্তুত পৃথুই ভারতবর্ষের প্রথম রাজা, যিনি সাধারণের মধ্যে শৃঙ্খলা নিয়ে আসেন এবং পৃথিবীর গর্ভ থেকে শস্য বার করে নিয়ে আসেন।
ত্রেতাযুগের যে সময়টাতে মানুষ ভীষণ লোভী হয়ে উঠেছিল এবং যে সময়ে তারা ঘরবাড়ি তৈরি করতে এবং শস্য উৎপাদন করতে শিখে গেল, এই সময়টার সঙ্গে পৃথু মহারাজের অবশ্যই একটা যোগ আছে। একটা কথা বোঝা দরকার, পৃথুর কথা সমস্ত নামি পুরাণগুলিতে পাওয়া যাবে। কেননা তিনি স্বেচ্ছাচালিত দখলদারির মধ্যে প্রথম শৃঙ্খলা এবং সভ্যতা নিয়ে আসেন। আরও লক্ষ্য করার বিষয় হল, পুরাণগুলি যেখানে পৃথুকে ভগবানের অবতার বলতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি সেই অবতারপুরুষ আদি ধর্মরাজের জন্ম কিন্তু প্রায় জীবন্ত এক অধর্মপুরুষের দেহ থেকে। পৃথুর বাবার নাম বেণ, যার প্রথম পরিচয় ছিল তিনি ধর্ম মানতেন না। স্বেচ্ছাচার এবং লোভই ছিল তার একমাত্র বিলাস–স ধর্মং পৃষ্ঠতঃ কৃত্বা কামাল্লোভে ব্যবৰ্ত্তত। ঠিক এই ব্যবহার আমরা সম্পত্তিগ্রাসী মানুষগুলির মধ্যেও পেয়েছি। নদী, পাহাড়, জমির দখলদারি নিয়ে যে চরম অবস্থা হয়েছিল তার একটা প্রতীকী আচরণ আছে এই বেণের মধ্যে। বেণ নাকি বলতেন–আমার চেয়ে বড়ো আবার কে আছে, আমি ছাড়া আর কেই বা আছে যাকে আরাধনা করা যায়–মত্তঃ কো’ভ্যধিকো’ন্যোস্তি যশ্চারাধ্যো মোপরঃ। সমস্ত যজ্ঞে পুজো করতে হবে আমাকেই–অহমিজ্যশ্চ পূজ্যশ্চ। এটা বুঝতে হবে যে, সভ্যতার প্রথম লগ্নে বিশৃঙ্খল জনতার মধ্যে যিনি সবচেয়ে বলশালী তাঁর কাছে এই ব্যবহার অপ্রত্যাশিত নয়। দু-একটি পুরাণ বলেছে প্রথম রাজা হওয়ার কৃতিত্ব নাকি বেণেরই, পৃথুর নয়। তবে সব পুরাণই এ ব্যাপারে এককাট্টা যে, বেণের স্বেচ্ছাচার চরমে উঠলে ঋষিরা সব একজোট হলেন। আমরা অবশ্য ঋষিদের কথা বলি না, বলি, শুভকামী মানুষেরা সংঘবদ্ধ হলেন। একথা বলি এইজন্যে যে, সব পুরাণের মতোই পৃথুর পূর্ববর্তী সময়ে কোনো সভ্যতা ছিল না। এমনকী পৃথিবীর মাটি পর্যন্ত ছিল অসমান–বিষমাসী বসুন্ধরা। পৃথুর আগে গ্রাম-শহরের কোনো বিভাগ ছিল না, ছিল না কৃষিকর্ম। শস্য কিংবা পশুপালন। ব্যবসাবাণিজ্যের তো কথাই নেই–ন শস্যানি ন গোরক্ষা ন কৃষির্ন বণিকপথঃ। ঠিক এই অবস্থায় কোথায় বা যজ্ঞ, কোথায় বা ঋষি। তাই বলেছি শুভকামী মানুষেরা একজোট হলেন। পৌরাণিকেরা বলেছেন ঋষিরা বেণ-রাজাকে শাপদন্ধ করে জীবন্ত অবস্থাতেই তার বাহু দুটি মন্থন করতে থাকলেন। বাঁ হাতটি মন্থনের ফলে জন্মাল নিষাদেরা, আর ডান হাত মন্থনের ফল হলেন পৃথু।
জনসাধারণের বিপ্রতীপ স্বার্থপর আচরণের প্রতীক বেণ তো ধ্বংস হলেন। পৃথুও ব্রহ্মার আদেশে গোরূপা পৃথিবী দোহন করে তাকে শস্যশালিনী করে তুললেন। কিন্তু মুশকিল হল, এতে সবার অন্ন-পানের ব্যবস্থা হলেও জমি নিয়ে ঝগড়াটা বোধহয় চলছিলই। কূর্মপুরাণের পরবর্তী বচন থেকে সেটা বোঝাও যায়। সম্পদ এবং তার মালিকানা নিয়ে যে অর্থনৈতিক অভিসন্ধির কথা পণ্ডিতেরা ব্যাখ্যা করেন তার মূল বোধটা এসেছিল বোধহয় জমি আর স্ত্রীলোক নিয়েই। পুরাণের অন্যত্র সমস্ত স্ত্রীলোকেরাই অবশ্য এক ধরনের জমি বলেই স্বীকৃত। পৃথু মহারাজের জমানায় পৃথিবী দোহন করে অন্ন-বস্ত্র পাওয়া গেলেও স্ত্রীলোক আর ধনসম্পত্তি নিয়ে লড়াই চলছিল। এমনকী যাদের স্ত্রী এবং ধনসম্পত্তি দুই-ই ছিল, তারাও ছিল এই লড়াইতে সমান অংশীদার। তারা পরস্পরের জমি এবং বউ নিয়ে কাড়াকাড়ি আরম্ভ করেছিল–ততস্তা জগৃহুঃ সর্বা হ্যন্যোন্যং ক্রোধমূচ্ছিঃ। আপ্তদারধনাদ্যাস্তু বলাৎ কালবলেন চ৷৷ পুরাণ লিখেছে–ঝগড়াটা হচ্ছিল কালবশে, গা-জোয়ারি করে, কিন্তু আমরা বলব ঝগড়ার মূলটা মহাকালের গভীরে নয়, মালিকানার তত্ত্ববোধে। ঠিক এই কারণেই দুটো নিয়ম করতে হল এবং তা করতে হল স্বয়ং ব্রহ্মাকে।
প্রথম বিধান অবশ্যই স্ত্রীসংক্রান্ত। সৃষ্টির আরম্ভেই প্রজাপতি ব্রহ্মার কন্যাগনের সংবাদে যদি কোনো রূপকই থাকে, তবুও সভ্যতার আদিতে সাধারণের মধ্যে যে মৈথুন সংক্রান্ত কোনো বিধি-বিধান ছিল না, বরঞ্চ দারুণ শিথিলতা ছিল, এটা ভাবাই স্বাভাবিক। পৌরাণিকেরা বলেছেন ব্রহ্মার দেহটি দু-ভাগ হয়ে একটি পুরুষ আর একটি স্ত্রীরূপ তৈরি হল। ঠিক এই অবস্থায় দ্বিধাভিন্ন অর্ধেক মানুষ হয়ে জন্মাবার ফলে এদের পারস্পরিক মিলনের টান তাই রয়েই গেল, রয়ে গেল সম্পূর্ণ হওয়ার ইচ্ছে। দুইয়ের এই পারস্পরিক মিমীলিষা বা মিলনের ইচ্ছেই হল কাম, যে কামনা রূপ ধারণ করেছে শিবের অর্ধনারীশ্বর মূর্তিকলায়।
পুরাকালে বিবাহ বলে কোনো সামাজিক বন্ধন ছিল না। যা ছিল তা অথর্ববেদের কায়দায়–এ মেয়েমানুষ, এ পুরুষমানুষ, একজন যুবক, অন্যজন যুবতী–এও যৌন মিলন করেনি, অন্যজনও নয়–ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি ত্বং কুমার উত বা কুমারী। দুজনে মিলনের জোড় বাঁধলেই মিথুন এবং তাদের মিলনকর্ম মৈথুন। ব্রহ্মা নিজকন্যা সরস্বতীর সঙ্গে মিলন সম্পূর্ণ করে–হ্যাঁ মিলন সম্পূর্ণ করেই–মিলনের দেবতাকে শাপ দিয়ে বললেন–তুমি শিবের চোখের আগুনে ভস্ম হবে। কাম বললে–সে কি কথা! আপনিই না আমাকে এরকম করে স্ত্রী-পুরুষের ইন্দ্রিয়ক্ষোভ জন্মাতে বলেছেন। আপনি আমাকে বলেননি-পুরুষ আর রমণী হলেই হল–স্ত্রীপুংসোরবিকারেণ–দুজনের মন একেবারে উথাল-পাথাল করে দেবে- ক্ষোভ্যং মনঃ প্রযত্নেন ত্বয়ৈবোক্তং পুরা বিভো! এখন আপনিই আমাকে দুষছেন? সত্যিই তো সৃষ্টির আদিতে কামনার দেবতা কী করে মনুষ্য সম্পর্কের কথা বুঝবে! মাতা, কন্যা, পিতা, পুত্র–এ সব সামাজিক সম্পর্ক অনেক পরের ব্যাপার। পৌরাণিকদের বিশ্বাস ছিল পুরাকালে ব্রহ্মা নাকি জোড়ায় জোড়ায় নারী-পুরুষ তৈরি করেছিলেন। তাদের মনে নাকি অদ্ভুত এক আনন্দ হওয়ায়–ততো বৈ হর্ষনাস্তে–তারা কামনায় পরস্পর মৈথুনে প্রবৃত্ত হল–অন্যোন্যা হৃচ্ছয়াবিষ্টা মৈথুনায়োপচক্রমে। তাদের সুবিধে ছিল বিরাট। তারা যত মৈথুনই করুক, তাদের ছেলেপুলে হত না, কারণ তখন নাকি রমণীদের মাসে মাসে ঋতুকাল ছিল না। কাজেই প্রচুর মৈথুনের পরেও–সবিতৈরপি মৈথুনৈঃ-রমণীরা পুত্র-কন্যা প্রসব করত না। সেই মিথুনজাত মানুষেরা নাকি আয়ুশেষে একেবারে আরও একটি যুগল ছেলে-মেয়ের জন্ম দিয়ে স্বর্গত হত।
তবে এ সব সত্য যুগের কথা। ত্রেতা যুগেই লোকজন প্রচুর বেড়ে যাওয়ায় পৌরাণিকেরা বুঝতে পেরেছেন–মাসে মাসেই স্ত্রীলোকের ঋতুকাল ঘুরে আসে আর মাসে মাসে মিলনের ফলেই–মাসি মাসুপগচ্ছতা–গর্ভেৎপত্তিও হয়। কিন্তু এই গর্ভেৎপত্তির মধ্যে শৃঙ্খলা আসেনি তখনও। সমাজে বিবাহ বস্তুটা কি অথবা নিদেনপক্ষে মৈথুন-বদ্ধ পুরুষ কিংবা নারী পরস্পরের কাছে দায়বদ্ধ কিনা–সেই সামাজিক সমস্যা তখনও তৈরি হয়নি। পুরাণকারেরাও প্রায় কোথাও নির্দিষ্ট করে বলেননি, যে, স্ত্রী-পুরুষের পারস্পরিক মিলনে শৃঙ্খলা ব্যাপারটা কী করে এল। তবে হ্যাঁ, খোদ মহাভারতের মধ্যে পৌরাণিক কথাবার্তা কিছু আছে। আমরা যদি সেখান থেকে স্ত্রী-পুরুষের প্রাথমিক ব্যবহারের একটা হদিশ পাই, তাতে পুরাণের মর্যাদা কিছু কমে না।
মহাভারতে মহারাজ পাণ্ডু যখন ‘ছেলে হল না, ছেলে চাই’ বলে পাগলাপারা হয়ে উঠলেন, তখন কুন্তী অনেক ধর্মকথা শোনালেন। দোষের মধ্যে পাণ্ডু বলেছিলেন–একজন উপযুক্ত ব্রাহ্মণের সঙ্গে সংগত হয়ে একটি পুত্র জন্মের সাধন কর, কুন্তী। কুন্তী বড় দুঃখিত হয়ে এক পতিব্রতার কাহিনি শোনালেন বটে, তবে ভুলেও তাঁর কুমারীকালের সূর্য-সম্ভোগ বর্ণনা করলেন না। পাণ্ডু তখন ভালো মানুষের মেয়ে কুন্তীকে বললেন–দেখ বাপু, তুমি কি জানো যে, এককালে মেয়েদের দুয়োর ছিল সবার জন্য খোলা-অনাবৃতাঃ কিল পুরা স্ত্রিয় আসন্ বরাননে। তারা ছিল স্বতন্ত্র, স্বেচ্ছাবিহারী। তারা যে-কোনো পুরুষের সঙ্গে মিলিত হতে পারত এবং তাতে কোনো অধর্ম ছিল না, বরঞ্চ সেইটাই ছিল ধর্ম–স হি ধর্মঃ পুরাভবৎ। পাণ্ডু বললেন-কুন্তী। তুমি হয়তো আমার কথা মানতে চাইবে না, কিন্তু প্রমাণ দিলে তো তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে। তুমি খোঁজ নিয়ে দেখ–এখনও উত্তরকুরু দেশে এমনি প্রথাই চালু আছে–উত্তরে চরম্ভোরু কুরুষু অদ্যাপি পূজ্যতে। তবে হ্যাঁ, জিজ্ঞাসা করতে পার, কবে থেকে এসব নিয়ম চালু হল যে, মেয়েরা স্বামীর ঘরেই থাকবে।
পাণ্ডু বলতে থাকলেন। পাণ্ডু যা বললেন, তা তার কালের পুরাণ কথা। অবশ্য পাণ্ডু যে সময়ের কথা বললেন, তাতে দেখা যাচ্ছে তখন স্ত্রীলোক একটি পুরুষের সঙ্গে ঘর বাঁধা আরম্ভ করেছে। পাণ্ডু বললেন–মহর্ষি উদ্দালকের ছেলে হলেন শ্বেতকেতু। পাঠক! এই দুজনেই উপনিষদের নামকরা মুনি, কাজেই পাণ্ডু হয়তো উপনিষদের যুগের বৃত্তান্ত বলছেন, তাও হতে পারে। পাণ্ডু বললেন–পুত্র শ্বেতকেতু একদিন দেখলেন, তার মাকে তাঁর বাবার সামনেই আরেক বামুন এসে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বামুন এসে তার মার হাত ধরে বলল, চল, আর মাও চললেন। জোর করে নয়, এমনিই। কিন্তু পুত্র শ্বেতকেতুর মনে হল যেন জোর করেই তার মাকে নিয়ে গেল ওই বিটলে বামুনটা–নীয়মানাং বলাদিব। কিন্তু জোর করে যে নয়, তার প্রমাণ দিলেন স্বয়ং তার বাবা। ক্রুদ্ধ শ্বেতকেতুকে দেখে তার বাবা বললেন–এত রাগের কি হয়েছে বাছা! এই তো চিরকালের ধর্ম-মা তাত কোপং কার্ষীঃ ত্বমেষ ধর্মঃ সনাতনঃ। তুমি কি জান না বাবা, মেয়েরা হল সব ছাড়া-গোরুর মতো–যথা গাবঃ স্থিতাস্তাত। যখন যে ইচ্ছে, যে-কোনো বর্ণের পুরুষ-পুঙ্গব যে-কোনো স্ত্রীলোককে ভোগ করতে পারে-অনাবৃতা হিসর্বেষাং বর্ণানাম্ অঙ্গনা ভুবি। শ্বেতকেতুর বাবা উদ্দালক যে যৌন ব্যাপারে খুব উদার ছিলেন সেটা বোঝা যায়। কেননা এই উদ্দালক উপায় থাকা সত্ত্বেও শিষ্যকে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে মিলনের সুযোগ দিয়ে শ্বেতকেতুর জন্ম দিয়েছিলেন–উদ্দালকঃ শ্বেতকেতুং জনয়ামাস শিষ্যতঃ।
শ্বেতকেতু সব শুনলেন বটে কিন্তু সেদিন থেকেই তিনি এই নিয়ম বেঁধে দিলেন যে, কোনো মেয়েই তার স্বামীকে অতিক্রম করে অন্য পুরুষের সঙ্গ করতে পারবে না। পাণ্ডু বললেন–শ্বেতকেতুর এই বচনের পর থেকেই সমাজে এটা পাপ বলে গণ্য হচ্ছে–অদ্য প্রভৃতি পাতকম্। নচেৎ পাণ্ডুর ভাবটা এই যে, অন্য পুরুষের সঙ্গ কিছু দোষের নয়। বিশেষত পুত্রার্থে। বিশেষত স্বামীই যখন এই নিয়োগে অনুমতি দিচ্ছেন। সত্যি কথা বলতে কি, পাণ্ডু যেখানে কুন্তীকে উত্তরকুরু দেশের রমণীকুলের দৃষ্টান্ত দিয়ে আপন স্ত্রীর পতিব্রতা-বাতিক ভাঙার চেষ্টা করেছেন, তাতে বেশ বুঝি তার কালে এই ধরনের সামাজিক শিথিলতা ছিল। আমাদের আলোচ্য প্রধান পুরাণগুলির মৌলাংশও যেহেতু মহাভারতের যুগের বেশি পরে লেখা নয়, তাতে এই সিদ্ধান্ত অবশ্যই করা যেতে পারে যে, পুরাণের যুগেও সামাজিক শিথিলতা ছিল যথেষ্ট, যদিও সাধারণ মেয়েমানুষকে পতিব্রতার দীক্ষা দিতে পৌরাণিকেরা ছিলেন শুধুমাত্র মৌখিকভাবে দায়বদ্ধ। পুরুষ মানুষেরা স্ত্রীসংক্রান্ত বিষয়ে নিজেরা দায়হীন, আচরণহীন, অথচ স্ত্রীলোকের কর্তব্য বিষয়ে তাদের এই যে মৌখিকতা–এ মৌখিকতার একমাত্র কারণ হল–তারা নিজেরা বুঝতে পারছিলেন যে, তাদের নিজেদের স্ত্রীরা অন্য পুরুষের মোহগ্রস্ত হলে মানসিক স্থিরতা নষ্ট হয় বটে। তবু বলব এই যে শিথিলতা–এর বেশির ভাগটাই পৌরাণিকদের নিজেদের কালের নয়, এ তাদেরও পূর্বকালের। মৎস্যপুরাণ থেকে একটি কাহিনি উদ্ধার করলেই এ কথার প্রমাণ পাওয়া যাবে।
মৎস্যপুরাণের এই ঘটনা মহাভারতে আছে, এমনকি ঋগ্বেদেও আছে। কাজেই এই শিথিলতা পৌরাণিকদের পূর্বকালের, যা তারা তাদের কালেই পুরানো ঘটনা বলে লিপিবদ্ধ করেছেন। আমরা একই বংশে পর পর দুটি শিথিলতার উদাহরণ দেব। তবে সমাজ এখন সেই পর্যায়ে নেই, যেখানে রমণীরা গাভীর মতো উন্মুক্ত। সমাজে এখন বিবাহাদি চালু হয়ে গেছে এবং পরপুরুষের আনাগোনায় নারীরাও বিব্রত বোধ করতে আরম্ভ করেছে। ঊশিজ মুনির স্ত্রীর নাম মমতা আর উশিজের ছোটো ভাই স্বনামধন্য বৃহস্পতি। বিবাহিত মহিলা হলেও মমতার চেহারা ভারী সুন্দর-মমতা বরবৰ্ণিনী। একদিন বড়দাদা উশিজের অনুপস্থিতিতে উতলা বাতাস আর যৌবনের অভিসন্ধিতে বৃহস্পতি মমতার মিলন কামনা করলেন-মমতামেত্য কামতঃ। মমতা-বউদি বললেন–সে কি কথা ঠাকুরপো, আমি তোমার বড়োভাইয়ের বউ না! তার ওপরে এখন আমি গর্ভবতী, এখন তুমি ক্ষ্যামা দাও–অন্তর্বত্মস্মি তে ভ্রাতুর্জ্যেষ্ঠস্য তু বিরম্যতাম্। যতখানি অনভিলাষে তার থেকেও অনেক বেশি গর্ভপাতের ভয়ে মমতা ভাবী ছেলের গুণরাশি কীর্তন করে বললেন–জানো! ছেলে আমার গর্ভে থেকেই সাঙ্গ বেদ উচ্চারণ করছে। ঠিক এই অবস্থায়, না, না, তোমার শক্তিও যে অমোঘ বৃহস্পতি। এই সময়টা তুমি পার হতে দাও, তার পরে আমার সঙ্গে যা ইচ্ছে কোর তুমি–অস্মিন্নেব গতে কালে যথা বা মন্যসে বিভো।
মহাতেজা বৃহস্পতি শুনলেন না মমতার অনুনয়, কারণ মহাত্মা হলেও সেই মুহূর্তে তিনি কামাত্ম হয়ে পড়েছেন–কামাত্মা সা মহাত্মাপি। মনকে দমন করতে না পেরে তিনি মমতার তাৎক্ষণিক অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার সঙ্গে মিলিত হলেন। চরম মুহূর্ত যখন এগিয়ে এল তখন বাধা দিল স্বয়ং মমতার গর্ভস্থ সন্তান। গর্ভেই যে বেদ উচ্চারণ করছে, সে গর্ভ থেকেই বলে উঠল–ওগো বাক্যে বৃহস্পতিবাচামধিপ–এই গর্ভে দুজনের স্থান হবে না। আপনার শক্তিক্ষয় বৃথা হবে না নিশ্চয়, কিন্তু আমি যে এখানে পূর্বের অতিথি–পূর্বঞ্চাহমিহাগতঃ। বড়ো ভাইয়ের ছেলের ছোটো মুখে বড়ো কথা শুনে ক্রুদ্ধ বৃহস্পতি যা বললেন তা পঞ্চানন তর্করত্ন মশায়ের বঙ্গানুবাদে শুনুন। বৃহস্পতি বললেন, “তুই গর্ভে থাকিয়া যখন আমার ঈদৃশকালে বীর্যপাত করিতে নিষেধ করিতেছিস; তখন তুই দীর্ঘ তমোরাশির মধ্যে প্রবেশ করিবি।” মৎস্যপুরাণ বলেছে বৃহস্পতির এই শাপে মমতার ছেলেটি দীর্ঘতমা নামে জন্ম নিল। শাপের ফলে ঋষির নাম দীর্ঘতমা হল–শুধু এইমাত্র হতে পারে না। আমরা বেদ, মহাভারত ইত্যাদির প্রমাণে জানি এই ঋষি অন্ধ হয়েই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার জীবনে অন্ধকার ছাড়া কিছু ছিল না বলেই তিনি দীর্ঘতমা।
দীর্ঘতনা বড়ো হয়ে বৃহস্পতির মতোই হয়ে উঠলেন। তবে গর্ভাবস্থাতেই যিনি বেদমন্ত্রের সঙ্গে কামপ্রবৃত্তিও দেখেছেন তার পরবর্তী জীবনে কিছু বিকার ঘটবে এইটাই স্বাভাবিক। পুরাণকার অবশ্য এই বিকারের জন্য একটি গল্প বলেছেন। দীর্ঘতমা তখন ছোটো ভাইয়ের আশ্রমে থাকেন। হঠাৎ সেখানে একদিন একটি ষাঁড় এসে উপস্থিত হল এবং যজ্ঞের কুশ-টুশ মাড়িয়ে লণ্ডভণ্ড করে দিল। দীর্ঘতমা ষাঁড়ের শিং-দুটো ধরে টানতে থাকলেন এবং ষাঁড় যখন আর কোনক্রমে এঁটে উঠতে পারল না তখন ষাঁড় বলল–আমি তোমায় বর দেব। দীর্ঘতমা বললেন–নচ্ছার কোথাকার, পরের বাড়িতে খাওয়া ষাঁড়, তোকে কিছুতেই ছাড়ব না। ষাঁড় বললে–আমাদের কোনো পাপ নেই, চুরির দোষও আমাদের গায়ে লাগে না। ধর্ম জিনিসটা তোমাদের ব্যাপার, যারা দুপেয়ে প্রাণী। চতুষ্পদ জন্তুর ধর্ম অধর্ম, খাওয়া-দাওয়ার বিধিনিষেধ মৈথুনের বিচার কিছুই নেই। দীর্ঘতমা তখন সেই ষাঁড়ের কাছে আচ্ছা করে গো-ধর্ম শিখে নিলেন। গো-ধর্ম মানে ষাঁড় কিংবা গোরু যেভাবে জীবনযাপন করে, সেই ধর্ম শিখে নিলেন এবং এই বিদ্যা তার বেশ পছন্দ হল।
গো-ধর্ম শিক্ষার প্রথম প্রয়োগের জন্য দীর্ঘতমা বেছে নিলেন তার ছোটো ভাইয়ের বউকে, যিনি মহর্ষি গৌতমের পত্নী। ভ্রাতৃবধূর মিলন কামনা করলে সে তো ভারী ক্ষুব্ধ হল। সে কোনো মতে ভাসুর-ঠাকুরকে প্রত্যাখ্যান করল বটে কিন্তু যে দীর্ঘতমা ষাঁড়ের ব্যবহার শিখেছেন, তিনি করলেন কি, যেখানে ভাই-বউ যায়, সেখানেই ষাঁড়ের কায়দায় উপস্থিত হতে লাগলেন-সো’নড়ানিব। গৌতমের বউ তখন তাকে খুব একচোট গালাগালি দিয়ে ভবিষ্যতের কথা ভেবে তার হাত দুটো ধরলেন চেপে। বললেন-তুমি এ রকম উলটো ব্যাভার করছ কেন, আমি যেখানেই যাচ্ছি। সেখানেই আমার পেছন পেছন ধাওয়া করছ ষাঁড়ের মতো–অনড়ানিব বৰ্ত্তসে। তোমার কি গম্যাগম্যের ভেদবুদ্ধি এমন নষ্ট হয়ে গেছে যে, মেয়ের সমান ভাইবউয়ের সঙ্গ কামনা করছ–গোধর্মাৎ প্রার্থয়ন্ সুতাম্। উত্ত্যক্ত, বিরক্ত গৌতমপত্নী শেষ পর্যন্ত রেগে বললেন–দাঁড়াও তোমায় দেখাচ্ছি। মজা, বদমাশ। তোকে আজকে ঘরছাড়া করব-দুবৃত্তং ত্বং ত্যজাম্যদ্য। বেটা কানা, বুড়ো! দুরবস্থায় ঘরে বসে খাওয়াচ্ছি পরাচ্ছি–যস্মাৎ ত্বমন্ধো বৃদ্ধশ্চ ভর্তব্যো দুরধিষ্ঠিতঃ–তার এই ব্যাভার! গৌতমপত্নী এবার গোধর্মী দীর্ঘতমাকে ধরে একটা প্যাটরার মধ্যে পুরে ফেলে দিলেন গঙ্গায়। দীর্ঘতমা ভাসতে ভাসতে চললেন।
এই পুরাকাহিনিতে একটা ঘটনা বেশ প্রমাণ হল। প্রমাণ হল–যে সমাজে রমণীরা ছাড়া-গোরুর মতো বলে পুলকিত বোধ করছিলেন। উদ্দালক ঋষি, সেই সমাজে পুরুষেরাও অনেকে ছিলেন ষাঁড়ের মতো। বোঝা যাচ্ছে রমণীরা কেউ বিব্রত বোধ করছে, কেউ বা সাংঘাতিকভাবে বাধা দিচ্ছে তবু ষাঁড়ের মতো পুরুষ মানুষও সমাজে থাকেই। অন্তত দু-একজনে যে কতখানি ষাঁড়ের মতো তার প্রমাণ মিলবে ওই দীর্ঘতমারই পরবর্তী আচরণে। গঙ্গায় ভাসতে ভাসতে দীর্ঘতমা কোথাও তীরে এসে ঠেকলেন। তাকে তুলে নিলেন প্রহ্লাদের নাতি দৈত্যরাজ বলি। বলির স্ত্রী সুদেষ্ণা, তার ছেলে হয় না। তখনকার দিনে ছেলে না হলে, যেন তেন প্রকারেণ ছেলে অবশ্যই চাই। আর কে না জানে নিয়োগ প্রথায় ছেলে জন্মাবার ব্যাপারে ব্রাহ্মণ বড়ই উপাদেয়। বলি ভাবলেন, ব্রাহ্মণ উপস্থিত, এই সুযোগ। আমরা বলি, প্রবলপ্রতাপ দৈত্যরাজের রাজ্যের ভেতরে বাইরে আর কি কোনো ব্রাহ্মণ ছিলেন না। তবে এ কথা ঠিক, যে-কোনো কালের যে-কোনো পুরুষমানুষই স্ত্রীকে অন্য পুরুষের কাছে পুত্রার্থে নিয়োগ করুন না কেন, তার মনে কিঞ্চিৎ বিকার হবেই। এ ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ কানা বলে রাজা হয়তো ভেবেছিলেন যৌবনবতী স্ত্রীর রূপই সে দেখতে পাবে না, উপরন্তু যে বৃদ্ধ তাকে দিয়েই কর্তব্য-নিষেকটুকু করা ভালো। কিন্তু গোধর্মী দীর্ঘতমা অত বোকা নন। চোখ না থাকলে তার অন্য ইন্দ্রিয় বেশি সজাগ থাকে, বিশেষত সে অনুভবে সব পেতে চায়–রূপ, রস, যৌবন–সব।
নিয়োগ প্রথার নিয়ম হল–যে পুরুষ গর্ভাধান করবেন তিনি রাতের আঁধারে এই কাজ করবেন, দিনে নয়। তার ওপর তিনি নিজের গায়ে বেশ খানিকটা ঘি মেখে নেবেন এবং মৌনী থাকবেন–ঘৃতাক্তো বাগযতো নিশি। এ সব নিয়মর কোনো ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে, কিন্তু আমরা বুঝি যে ঘিয়ে জ্যাবজ্যাবে পুরুষের সঙ্গে রতিতে কোনো স্ত্রীই যাতে আনন্দ না পায় সেই জন্যই এই ব্যবস্থা। তার ওপরে তার সঙ্গে প্রেম সম্ভাষণও যাতে সম্ভব না হয় তার জন্যই বোধহয় পুরুষটির মৌনী থাকার ব্যবস্থা। যাতে তার রূপ দেখে ভালো না লাগে সেই জন্য রাত্রের ব্যবস্থা। কিন্তু এত নিয়ম সত্ত্বেও স্ত্রীরা পুরুষের চেহারা বুঝে ফেলত, কথাও যে হত না, তা নয়। রাজমহিষী সুদেষ্ণা কানা-বুড়ো দীর্ঘতমাকে দেখেই আর তার কাছে ঘেষলেন না–অন্ধং বৃদ্ধং তং জ্ঞাত্বা ন সা দেবী জগাম হ। তিনি দীর্ঘতমার কাছে পাঠিয়ে দিলেন শূদ্রা ধাত্রীকে। ঋষি শূদ্রা-সঙ্গে বেশ। কয়েকটি পুত্র উৎপাদন করলেন যাঁরা পরবর্তীকালে ব্রহ্মবাদী মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি বলে পরিচিত। রাজা বলি ঋষিধর্মে প্রবীণ এতগুলি ছেলেপুলে দেখে পরম পুলকিত হয়ে দীর্ঘতমাকে বললেন–বাঃ! তাহলে এইগুলিই আমার ছেলে। দীর্ঘতমা বললেন–মোটেই নয়, এগুলি আমারই ছেলে। রাজমহিষী সুদেষ্ণাকে পাননি বলে দীর্ঘতমার মনে বা কিছু ক্ষোভও ছিল। রাজাকে তিনি তাই দগ্ধ হৃদয়ে বললেন–তোমার স্ত্রী আমাকে অন্ধ-বুনো জেনে অপমান করেছে, তোমার নিয়োগমতো রানি সেখানে আসেননি, এসেছিল তার শূদ্রা ধাত্রী! এগুলি তাই আমারই ছেলে। দানব রাজা তো মুনির কথা শুনে সুদেষ্ণাকে খুব বকলেন–ভার্যাং ভৎর্সয়মাস দানবঃ। রাজা আবার তাকে সালংকারে মনোমোহিনী সাজে সাজিয়ে ঋষির কাছে পাঠালেন। সজ্জিতা রমণীকে অনুভবে কাছে পেলেন ঋষি। নিয়োগের প্রথামতো মুনির দেহ কিন্তু ঘিয়ে ভেজানো দেখছি না; তার দেহে লেপন করা হয়েছে দই, একটু লবণ এবং মধু দিয়ে–দা লবণমিশ্রেণ ত্বভ্যক্তং মধুকেন তু। অর্থাৎ পঞ্চামৃতের দুই অমৃতে একটু নুন পড়েছে। গোধর্মে শিক্ষিত ঋষি চোখে দেখতে পান না বটে তবে প্রতি অঙ্গে রানিকে অনুভব করবার জন্য সুদেষ্ণাকে তিনি কি বললেন জানেন? মুনি বললেন–আমার এই দই-লবণ আর মধুমাখা দেহখানি একটুও ঘেন্না না করে সব জায়গায় চাটতে থাক দেখি–লিহ মাম্ অজুগুপ্সন্তী আপাদতলমস্তকম্। যদি এইভাবে লেহন করতে পার তবেই পুত্র পাবে তুমি।
পুত্র জন্মানোর নিয়োগে বৃত হয়েছে বলে এত ঘৃণিত আচরণ আর কেউ করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। এটা অবিশ্বাস্য নয় এই জন্যে যে, ঋষি অন্ধ এবং গোধর্মী বলেই এত বিকার সম্ভব হয়েছে। তখনকার সামাজিক কাঠামোয় যে স্ত্রীলোককে নিয়োগের চেঁকি গিলতে হচ্ছে, তিনি রাজরানি হলেও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না বিকৃত রুচির এই ঋষিকে বারণ করার। অতএব সুদেষ্ণা মুনির দেহ চাটতে থাকলেন। চাটতে চাটতে সুদেষ্ণা কোনো অঙ্গই বাদ দিলেন না বাদ দিলেন শুধু মুনির উপস্থদেশ-লজ্জায় অথবা ঘেন্নায়। মুনি বললেন–তুমি যখন এই অঙ্গ বাদ দিলে, তখন তুমি গুহ্যদেশহীন এক পুত্র পাবে। সুদেষ্ণা বললেন–আপনি এ কি বললেন মুনিবর! আমি যথাসাধ্য যথাশক্তি আপনাকে তুষ্ট করার চেষ্টা করেছি, আপনি প্রসন্ন হোন। রানির অনুনয়ে মুনি প্রসন্ন হলেন। হবেনই বা না কেন, ভাইবউয়ের সঙ্গে গোধর্ম করতে গিয়ে লাথি-ঝাটা খেয়েছেন, সেই মানুষের গা চেটে আনন্দ দিয়েছেন রাজরানি। মুনি বললেন–ঠিক আছে আমার কথাটা তোমার ছেলের ব্যাপারে না লেগে তোমার নাতির ক্ষেত্রে লাগবে এবং গুহ্যহীন হলেও তার কোনো অসুবিধা হবে না। এবারে পুলকিত হয়ে বললেন–তুমি যখন আমার লিঙ্গটি ছাড়া আর সব অঙ্গই লেহন করেছ–প্রাশিতং যৎ সমগ্ৰেষুন সোপস্থং শুচিস্মিতে–অতএব তুমি দেবতাদের মতো পাঁচ ছেলে পাবে–ধার্মিক সুচরিত্র। এই ছেলেরাই নাকি অঙ্গ, বঙ্গ, সুহ্ম, কলিঙ্গ এবং পু।
বাংলাদেশ এবং তার চারপাশের ভাগ্য মূল থেকেই এই বিকৃতরুচি মুনির সঙ্গে জড়িয়ে আছে, থাকুক। কিন্তু এই বিকৃতি এসেছিল সেই দিন থেকে, যেদিন শ্বেতকেতুর দাম্পত্য আইন চালু হয়েছিল। পুরাণে এবং মহাভারতে নিয়োগ ব্যবস্থার অন্ত নেই, কিন্তু মনুর সময়েই দেখছি ধর্মশাস্ত্রকারেরা আর নিয়োগের পক্ষপাতী নন। একেবারে নিরুপায় অবস্থায় মনু নিয়োগের কার্যকারিতা স্বীকার করেছেন বটে, কিন্তু সব সময় মনু মহারাজ এই প্রথার বিপক্ষে। হয়তো মনুর সময়ে তার প্রয়োজনও ছিল না। আর্যায়ণের প্রথম পর্যায়ে পুরুষ-বৃদ্ধির প্রয়োজন যত ছিল, পরবর্তী সময়ে তা ছিল না। এই কারণেই সমাজে শৃঙ্খলা, বিশেষত নারী-পুরুষের দাম্পত্য শৃঙ্খলা, বাড়বার সঙ্গে সঙ্গেই সামাজিক শিথিলতা নিন্দিত হতে আরম্ভ করে। অবশ্য পুরাণকারদের মৌখিক উপদেশে শৃঙ্খলার কথা যথেষ্ট আছে, কিন্তু তাদের সমাজের বাস্তবতা ছিল অন্যরকম। তারা তত্ত্বগতভাবে যে জিনিসটা হওয়া উচিত বলে মনে করতেন তার সঙ্গে মিল ছিল না যা ঘটত তার। এর জন্যে পৌরাণিকের মিথ্যাবাদিতার দায় নেই, কেননা যে-কোনো সমাজেই এটা হয়। এমনকী আজকের দিনেও যে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিন্যাস আমাদের ইঙ্গিত, যে সব সংস্কারের জন্য আমরা আন্দোলন করি, লেখালেখি করি, বক্তৃতা দিই, সেগুলির সঙ্গে প্রায়ই যোগ থাকে না, যা বাস্তবে ঘটে, বা ঘটে চলেছে তার। পুরাণকারদের সমাজব্যবস্থা বুঝতে গেলেও এই বাস্তববোধটুকু থাকা দরকার।
এ কথাটা প্রথমে বোঝা প্রয়োজন যে, সমাজ বলে যে কথাটা প্রচলিত, সেটা সব সময়েই একটা সচল ব্যাপার। এই সচলতার কারণেই সমাজকে ধরে রাখার জন্য যে নিয়মগুলি করা হয়, তার বিপর্যয়ও ঘটে। নিয়ম এবং তার বিপর্যয়–এইটাই সুস্থ এবং সচল সমাজের লক্ষণ। যাঁরা মনে করেন এই কলিযুগে সব কিছু ওলট-পালট হয়ে গেছে, ত্রেতা যুগে কিংবা দ্বাপর যুগে বড়ো ভালো সময় ছিল, তারা ভুল ভাবেন। যাঁরা ভাবেন দ্বাপর-ত্রেতায় বর্ণাশ্রম ধর্ম একেবারে নিখুঁতভাবে মানা হত, পুরুষেরা সব সদাচার পালন করত আর মেয়েরা ছিল সতী-সাধ্বী, কোনো অনাচার কু-আচার কিছু ছিল না–তারাও ভুল ভাবেন। সত্যি কথা বলতে কি–এই অনাচারহীন সদাচার-পরায়ণ যুগকল্পনা একটা উটোপিয়া মাত্র, সুস্থ সমাজ কখনও কাল্পনিক সমাজের কায়দায় চলে না। বস্তুত যে ত্রেতাযুগে বর্ণাশ্রম ধর্মের প্রচলন হয়, সেই ত্রেতাযুগেই বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার বারোটা বেজে গিয়েছিল। বায়ুপুরাণ সাক্ষী দিয়ে বলবে–ব্রহ্মা লোকহিতার্থে ত্রেতাযুগে বর্ণাশ্রমের নিয়ম তৈরি করলেন বটে কিন্তু জনসাধারণ তা মোটেই মানল না–এবং বর্ণাশ্রমাণাং বৈ প্রবিভাগে কৃতে তদা। যদাস্য ন ব্যবৰ্ত্তন্ত প্রজা বর্ণাশ্রমাত্মিকাঃ। কাজেই যাঁরা ভাবছেন, ত্রেতাযুগের রামচন্দ্র শূদ্র শম্বুকের তপস্যায় বর্ণবিধির লঙ্ঘন দেখে তাকে হত্যা করলেন আর বর্ণ এবং আশ্রম সব একেবারে ঠিকঠাক হয়ে গেল–তারাও ভুল ভাবছেন। পুরাণের মধ্যে দেখবেন বার বার ব্রহ্মা মানসী প্রজা সৃষ্টি করছেন। এই মানসী প্রজা সৃষ্টি কাল্পনিক বর্ণাশ্রম বিভাগের তাগিদে। বাস্তবে সব সময় বর্ণবিপর্যয়, বর্ণসংকট ঘটেছে। একটা জিনিস লক্ষ করবেন। পৌরাণিকেরা বার বার বলছেন সত্যযুগে যে মানুষেরা ছিলেন, ত্রেতাতেও তারাই আছেন, দ্বাপরেও তারাই আছেন এবং কলিতেও তাঁরাই থাকবেন। কী প্রথম কী শেষ, সমস্ত মন্বন্তরেই মানুষের সুকর্ম কুকর্ম, সুখ দুঃখ, খ্যাতি প্রতিপত্তি এমনকী রূপ-গুণও একই রকম থাকে–কুশলাকুশলপ্রায়ৈঃ কর্মভিস্তৈঃ সদা প্রজাঃ।
সাধারণ তত্ত্বগুলিকে এই নিরিখে দেখলে পরিষ্কার বোঝা যাবে যে, মুনি ঋষি দেবতা বলে পরিচিত মানুষেরা যে অপকর্মগুলি করছেন সেগুলি সচল সমাজের অঙ্গ। অর্থাৎ এখন যেমন আছে, তখনও তেমনি। আর এই তো স্বাভাবিক। ব্রাহ্মণকুলের চূড়ামণি কোনো ঋষি হলেই শূদ্র বর্ণের পরমা সুন্দরী কন্যাকে তার পছন্দ হবে না, কিংবা সাময়িক ধৈর্যচ্যুতিতে তাকে বলাৎকার করবেন না–এ তো সচল সমাজের মনুষ্যধর্মের লক্ষণ নয়। ঠিক এই কারণেই পরাশর-সত্যবতী কিংবা বশিষ্ঠ-অক্ষমালাকে আমরা ক্ষমা করব। কারণ সেক্ষেত্রে তারা বেশি তেজী বলে তাদের দোষকে জাস্টিফাই’করার কোনও প্রয়োজন থাকবেনা। লোভ, হিংসা, লোকঠকানো, মেয়ে মানুষের রূপে মজা, পরস্ত্রী ধর্ষণ–এ সব যেমন এখনও চলছে, তখনও চলত। তাই বলে কি ভালো কিছুই ছিল না? হ্যাঁ তাও ছিল। বার বার যে পুরাণের ঋষিরা আচরণীয় কর্তব্য সম্বন্ধে উপদেশ করেছেন–সেও তো বৃথা নয়। বেশিরভাগ মানুষই সে কর্তব্য পালন করার চেষ্টা করে। গেছেন–আবার মনুষ্য ধর্ম অনুসারে তার থেকে চ্যুতিও ঘটেছে। কাজেই আদর্শ এবং বিচ্যুতি–এই দুইয়ে মিলে সে কালের সমাজটা এখনকার মতোই সজীব, এখনকার মতোই কৌতূহলজনক। এই অল্প পরিসরে পৌরাণিকের সব টুকিটাকি, মানুষের সব ইচ্ছে-অনিচ্ছে, কাজ-অকাজ, রস-রসাভাস–সব এক জায়গায় তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবু যাগ-যজ্ঞ, দেবতা, ব্রাহ্মণ্য ছাড়াও সেকালের সমাজে আরও যা কিছু ছিল, তার সামান্য স্বাদ-গন্ধ আমরা পেতেই পারি।
ধরুন আপনি যদি পুরাণের কালে জন্মাতেন, তাহলে সকালে উঠেই আপনাকে কিছু পূজার্চনা করতে হত। হ্যাঁ, পুরাণকারেরা হোম-যজ্ঞ ইত্যাদির কথা অনেক শোনাবেন বটে, তবে ওসব ঝামেলা তাদের যুগে অত ছিল না। পুরাণ মানেই এক এক দেবতার মাহাত্ম্য এবং ব্রত, উপবাস। শিব, কৃষ্ণ কিংবা দেবী দুর্গার কথা যখন পুরাণে শুনি তখন দেখা যাবে এঁদের এক একজনের নাম করলেই শত যাগ-যজ্ঞের পুণ্য হত। কাজেই একটু পূজার্চনা এবং হরির নাম স্মরণ করেই পৌরাণিক গৃহস্থ কিন্তু দিনের কাজে নেমে পড়তে পারতেন। পুরনো দিনের মানুষ হলে কী হবে, পৌরাণিক গৃহস্থ কিন্তু শৌখিন কম ছিলেন না। স্বয়ং বিষ্ণুপুরাণ তাকে উপদেশ দিয়েছে ছেঁড়া কাপড় না পরতে-সদানুপহতে বস্ত্রে চ। উত্তমাঙ্গে একটি উত্তরীয় এবং অধমাঙ্গে একটি কাপড়–এই দুই খণ্ড বস্ত্রের জন্য পুরাণের দেবতা ব্রহ্মাকে কাঁপাস তুলো তৈরি করতে হয়েছে, যেন কাঁপাস গাছও ছিল না আমাদের দেশে। অবশ্য কাঁপাস তুলো নাকি প্রথম সৃষ্টি করতে হয়েছিল ব্রাহ্মণের পৈতে বানানোর জন্য কার্পাসমুপবীতার্থং নির্মিতং ব্ৰহ্মণা পুরা। কূর্মপুরাণ বড় আশা করে বলেছে–ব্রহ্মচারী যুবক যেন রঙে না ছুপিয়ে, সাদা কাপড় পরে; আর কাঁধে যেন জড়ায় কৃষ্ণসার হরিণ-চামড়ার চাদর। কিন্তু এতে কি ব্রহ্মচারীর মন মানে? গুরুগৃহের হাজারো কাজকর্মের ফাঁকে সে যদি কোনোদিন একটি নীল কাপড় পরে ফেলে তাহলেই পুরাণের গুরু ঠাকুর আদেশ দেবেন–দেখ বাপু মেয়েদের গায়ে ছোঁয়া লাগলে অথবা নীল কাপড় পরলে স্ত্রীণামথাত্মনঃ স্পর্শে নীলীং বা পরিধায় চ–জল কিংবা ভূমি স্পর্শ করে শুদ্ধ হবে। নিয়ম ভেঙে কোনওদিন নীল-কাপড় পরলেই রঙিন কোনো আকর্ষণে রসবতী রমণীর স্পর্শদোষ ঘটত কিনা, এসব বাজে খবরে আমাদের দরকার নেই, কেননা পুরাণ-গুরু গুরুগৃহে-থাকা যুবককে বলেছেন–বৎস, মেয়েদের দেখে কটাক্ষ করা, কিংবা তাদের জড়িয়ে ধরা–স্ত্রীপ্রেক্ষালম্ভনং তথা-খবরদার, খবরদার, এসব যেন কখনো কোরো না–প্রযত্নেন বিবর্জয়েৎ।
আমাদের দেশের পৌরাণিক গৃহস্থ জীবনে সব ‘ডোজ’গুলিই অত্যন্ত বেমানানভাবে কড়া। কোনো অবস্থাতেই উশুম-কুশুমভাবে মানিয়ে নেবার ব্যবস্থা নেই। এই তুমি ব্রহ্মচারী আছ, তো অমুক করবে না, তমুক করবে না অর্থাৎ ব্রহ্মচারী যুবকের যা যা ভালো লাগবে, তা করবে না। গান-বাজনা নয়, নাচ নয়, তাস-পাশা নয়, এমনকী যুবকের যা কিছু সহজ ধর্ম তা সব করা বারণ। রমণীর সঙ্গে কথা বলা বারণ, কটাক্ষ বারণ। এমনকী গুরুপত্নী যুবতী হলে তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা পর্যন্ত বারণ–গুরুপত্নীহ যুবতী নাভিবাদ্যেহ পাদয়ো। অথচ একই বাড়িতে, যেখানে ছাত্র-শিষ্য প্রায় পশুর মতো খাটবে, সেখানে গুরু থাকবেন রাজার মতো। তার আর্থিক অবস্থা যাই হোক না কেন, তার আচার-ব্যবহার, ক্ষমতা সবই রাজোচিত। বেশির ভাগ পুরাণ-প্রমাণে বোঝা যায় যে, ব্রাহ্মণ গুরুর স্ত্রী থাকত একাধিক। ধর্মরক্ষার জন্য তিনি একটি সবর্ণা ব্রাহ্মণী বিবাহ করতেন বটে কিন্তু কামপূর্তির জন্য অন্য জাতের সুন্দরী রমণী বিয়ে করে আনা ছিল তাদের অভ্যাস। স্বয়ং মনু এ ব্যাপারে অনুমোদন দিয়েছেন। কিন্তু গুরুর সংসারে এই অসবর্ণা রমণীদের দিয়ে তার কামপূর্তি হলেও, তাদের সম্মান বলে কিছু ছিল না। ব্রাহ্মণ শিষ্য পর্যন্ত তাদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করত না, গুরুর স্ত্রী বলেই তারা শুধু অভিবাদন লাভ করতেন মাত্র–অসবর্ণাস্তু সম্পূজ্যাঃ প্রত্যুত্থানাভিবাদনৈঃ। এই যে একই গুরুগৃহের মধ্যে ভিন্নধর্মী চরম আচরণ–গুরু সব করতে পারতেন, শিষ্য স্বেচ্ছায় কিছুই পারে না–এই আচরণ বহু জায়গায় বহু জটিলতার সৃষ্টি করেছে। বিশেষত রমণী বিষয়ে অতিরিক্ত সাবধানতা অনেক ক্ষেত্রেই শিষ্যদের রসান্বিত করে তুলত গুরুপত্নীর সঙ্গ লাভ করতে। ইন্দ্র তাই অহল্যার সর্বনাশ করেছিলেন, চন্দ্র গুরু বৃহস্পতির স্ত্রীকে হরণ করেছিলেন–এ সব উদাহরণ পুরাণেই সবিস্তারে লেখা আছে। সমাজের বড় মানুষ এবং তেজি লোকের যা ইচ্ছে তাই করার স্বাধিকার থাকায় সাধারণের মানসিকতা কী হত, তার একটা উদাহরণ আছে পদ্মপুরাণের ভূমিখণ্ডে।
পূর্বকালে যমের মেয়ে সুনীথা অরণ্যবাসী এক গন্ধর্ব-তপস্বীর তপস্যায় বিঘ্ন করেছিল। তপস্যা করার সময় গন্ধর্ব সুশঙ্খকে সুনীথা মাঝে মাঝেই গিয়ে খোঁচাত। এতে রেগে গিয়ে সুশঙ্খ শাপ দেন যে, সুনীথার ছেলে হবে দস্যি, পাপাচারী। সুনীথা ভয় পেলেন এবং বাবা যমকে গিয়ে সব নিবেদন করলেন। যম বললেন, তুমি খুব অন্যায় করেছ, একমাত্র পরম সত্যের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আর কোনো গতি নেই তোমার। সুনীথা সব শুনে নির্জন বনে তপস্বিনী হলেন। নবীন তপস্বিনীকে দেখে সুনীথার অল্পবয়েসি বন্ধুরা মনে বড় দুঃখ পেল। সখীরা খেলতে এসে তাকে না। পেয়ে শেষ পর্যন্ত বনেই তার সঙ্গে দেখা করত গেল। তারা বলল–কী হয়েছে তোর এত চিন্তা কীসের? কী হয়েছে, আমাদের খুলে বল। সুনীথা সুশঙ্খের অভিশাপের কথা বললেন। বললেন–তবুও আমার বাবা সব চেপেচুপে দেবতা, মুনি সবাইকে অনেক সাধ্যসাধনা করেছেন আমার বিয়ের জন্য। কিন্তু মুনির শাপ মাথায় রেখে কেউই আমাকে বিয়ে করতে রাজি নয়। কারণ পাপাচারী পুত্রের জন্ম হলে সমস্ত কুল মজবে–এই ভয়ে তারা সবাই আমার বাবাকে বলেছেন–অন্য কোথাও এর বর খুঁজুনগে, যান–অন্যস্মৈ দীয়তাং গচ্ছ দেবৈরুক্তঃ পিতা মম। সুনীথা বললেন–আমার আর কোনো উপায় নেই, তপস্যার মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করা ছাড়া। সব শুনে সুনীথার সখীরা এবার যে কথাটি বলল, সেইটেই হল তৎকালীন বাক্যবাগীশ সমাজের প্রতি যুবক-যুবতীর আসল মনোভাব। সখীরা বলল–বংশ, কুল–এসব বড়ো বড়ো কথা রাখ তো। কার বংশে দোষ নেই একটু বলবি–দেবতারাও কেউ ধোয়া তুলসীপাতা নয়–নাস্তি কস্য কুলে দোষো দেবৈঃ পাপং সমাশ্রিত। তুই কি জানিস না, স্বয়ং ব্রহ্ম একবার ভগবান শ্রীহরির সামনে ফালতু মিথ্যে কথা বলেছিল, তাতে কি সমস্ত দেবতারা তাকে ত্যাগ করেছে, নাকি দেব-সমাজে তার পরম পূজ্য স্থানটি চলে গেছে–দেবৈশ্যাপি ন হি ত্যক্তো ব্রহ্মা পূজ্যতমো’ ভবৎ? সুনীথার সখীরা এবার বলল–স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রের কথাটাই ধর না। ব্রহ্মহত্যার পাপ করেও দিব্যি স্বর্গ মর্ত্য পাতাল শাসন করে যাচ্ছে। তাছাড়া গুরু গৌতমের প্রিয়া পত্নী অহল্যাকে ধর্ষণ করেও সেই পরস্ত্রীকামী ইন্দ্র দিব্যি দেবত্বে প্রতিষ্ঠিত, সবাই তাকে এখনও দেবরাজ বলেই জানে। পরস্ত্রীগমন করে তার কিছু ক্ষতি-বৃদ্ধি হয়েছে কি-পরদারাভিগামী স দেবত্বে পরিবর্ততে? স্বয়ং মহেশ্বর শিব ব্রহ্মহত্যার মতো পাপ করে এখনও বহাল তবিয়তে আছেন–দেবতারাও তাকে নমস্কার করেন, ঋষিরাও করেন–দেবা নমন্তি তং দেবম্ ঋষয়গা বেদপারগাঃ।
সুনীথার বন্ধুরা কাউকেই ছাড়লে। তারা বলল–অন্যায় করে সূর্য দেবতার তত কুষ্ঠ রোগ ধরেছিল, তাতে কি তার সম্মান কমেছে! জগতে কার দোষ নেই বল তো? এই তো কৃষ্ণ ঠাকুর ভার্গব ঋষির শাপ ভোগ করে চলেছে। জগতের এত আহ্লাদ জন্মায় যে চাঁদ, সেও গুরুপত্নীর বিছানায় উঠে পড়েছিল। তার জন্যেই নাকি তার রাজ-যক্ষ্মা হয়ে কলাক্ষয় আরম্ভ হয়, কিন্তু তাতে কী আসে যায়? আবার তো সে পূর্ণিমায় জ্বল জ্বল করে তেজি হয়ে ওঠে। অত বড়ো মানুষ যে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির, সেও গুরুকে মারবার জন্য মিথ্যে কথা বলেছিল। কাজেই বড়ো মানুষদের কথা আর বলিস না, সুনীথা। দোষ ছাড়া মানুষ নেই, দেখাতে পারবি না এমন বড়ো মানুষ, যার গায়ে নোংরার দাগ লাগেনি একটুও–বৈগুণ্যং কস্য বৈ নাস্তি কস্য নাস্তি চ লাঞ্ছন। সুনীথার সখীরা এবারে স্ত্রীলোকের গোপন রহস্যটি বলল। বলল–সুনীথা। যাঁদের কথা বললাম, তাদের দোষ তো এত বড়ো বড়ো। সে আন্দাজে তোর দোষ তো এইটুকুনি। আর ছাড় তো ওসব বড়ো বড়ো কথা, মেয়েছেলের গতর আছে, তো সব আছে। রূপ আছে তো সব আছে–রূপমেব গুণঃ স্ত্রীণাং প্রথমং ভূষণং শুভে।
সুনীথার সখীরা বলল–তোকে পুরুষের মন-মজানো একটা বিদ্যা দেব। এতে দেবতা থেকে আরম্ভ করে সবাইকেই তুই মোহিত করে দিতে পারবি। সুনীথা কি বিদ্যা পেলেন জানি না, তবে যে-বিদ্যায় তাঁর কাজ হয়েছিল, সে তার রূপ। তার বীণার গান শুনে আর রূপে মজে তপস্যা ছেড়ে উঠে এলেন সূর্যের মতো রূপবান ব্রাহ্মণ অঙ্গ। তিনি কাম-ক্রোধ ত্যাগ করে ভগবান জনার্দনকে ধ্যান করছিলেন। সেই অবস্থায় সুনীথার রূপ লাবণ্য দেখে তার এমন মোহ হল যে, ধ্যান-জপ মাথায় উঠল। ঘেমে, কেঁপে, হাই তুলে ঋষিপুত্র অঙ্গ কেবলই সুনীথাকে কাছে পেতে চাইলেন, বিয়ে করতে চাইলেন। শুধু তাই নয়, অঙ্গ বললেন-কন্যে তুমি যা চাও তাই দেব, তোমার সঙ্গে সঙ্গমের প্রতিদান হিসেবে যা মানুষকে দেওয়া যায় না–তাও দিতে রাজি আছি–দেয়ং বাদেয়মেবাপি তস্যাঃ সঙ্গম-কারণা।
পুরাণের রাজ্যে এই এক অদ্ভুত জিনিস। আমরা বলেছিলাম–গুরুগৃহের অতিরিক্ত কড়াকড়ি অনেক সময় ব্রহ্মচারী শিষ্যের মনে নানা জটিলতা তৈরি করত। ফলে অনেক সময়ে তাঁরা স্বয়ং গুরু-মার ওপরেই আসক্ত হয়ে পড়তেন এবং রুক্ষ গুরুর সংসার-ঠেলা উপবাসিনী গুরুপত্নীরাও যে স্বেচ্ছায় শিষ্যের বাহু-বন্ধনে ধরা দিতেন, তার প্রমাণও আমরা অন্য প্রবন্ধে দিয়েছি। বস্তুত পুরাণ-প্রবন্ধের সমাজটি কিন্তু এক অদ্ভুত উপদেশ এবং ততোধিক বিপ্রতীপ বাস্তবতার সূত্রে বাঁধা। তারা যা উপদেশ দেন, তা ঘটে না, বরঞ্চ যা ঘটে, তা থেকে কেবল আরও একটি মৌখিক উপদেশ তৈরি হয়–এমনটি কিন্তু কোরো না। বিপদে পড়লেই তাদের ব্রহ্মশাপ আছে, প্রারব্ধ কর্ম আছে, আছে দেবদ্বিজের কাছে অন্যায়। এই যে সুনীথা ঋষিপুত্র অঙ্গকে রূপে মজাল, পুরাণে এমনিতর কাহিনি তো হাজারো আছে। অথচ পুরাণজ্ঞ ঋষিরা সব সময়েই স্ত্রীলোকের রূপে মজতে বারণ করেছেন। আবার দেখুন ওই যে সুনীথা আর অঙ্গের মিলনে একটি ছেলে জন্মাল আমরা প্রাচীন পুরাণ থেকে আগেই তার পরিচয় দিয়েছি–তার নাম বেণ। বেণ এমনিতেই দুষ্টপ্রকৃতির ছিল। কিন্তু পরবর্তী কালের পুরাণ পদ্মপুরাণে বেণকে দুষ্ট প্রমাণ করার জন্য প্রথমে তো সুশঙ্খ ঋষির শাপ লেগেছে। কিন্তু সে শাপ সত্ত্বেও বেণ নাকি ভালোই ছিলেন, এমনকী বেশ ধর্মপ্রাণ। কিন্তু এইবার বেণের গায়ে লাগল পদ্মপুরাণের নিজের কালের হাওয়া। সে আমলে জৈনধর্মের প্রকোপ বেড়েছিল অতএব পদ্মপুরাণে ঋষির শাপে এবং কালবশে জৈনরা এসে উপস্থিত হল ধর্মানুরাগী বেণের রাজসভায়। বেণ মহারাজ তাদের ধর্ম এবং দার্শনিক প্রস্তাব শুনে পাপাচারী হলেন। দেব-দ্বিজে ভক্তি উচ্ছন্নে গেল।
ব্যাপারটা এইরকমই। পৌরাণিকের নিজের কালের হাওয়া সব সময় লেগেছে তার কালের পুরানো গল্পে। ফলে পুরানো, আরও পুরানো কালের বৃত্তান্ত বিভিন্ন পুরাণকারের কালের গন্ধে নতুনভাবে সঞ্জীবিত হয়েছে। তবে একটি ব্যাপারে সর্বত্র বড় মিল, সে রমণী। আমার এক নতুন পরিচিত বন্ধু আমাকে ধিক্কার দিয়ে বলেছিলেন–তোমরা যে সব সময় প্রাচীন ভারতের তাবৎ-রমণীকুলের ওপর পুরুষ মানুষের অত্যাচার দেখতে পাও, তাই নিয়ে আবার প্রবন্ধ লেখো-এ ভারী অন্যায়। আমি বললুম–কেন, কেন, এই তো গবেষণালব্ধ জ্ঞান, তুমি বললে তো হবে না। প্রাচীন ঋষি, মুনি, নাগরিকেরা স্ত্রীলোকের সম্বন্ধে কিই না বলেছেন-নরকের দ্বার থেকে আরম্ভ করে ছলাকলার সবচেয়ে বড়ো যন্ত্র। বন্ধুবর বললেন–রাখো তোমার গবেষণা। প্রাচীন ভারতের পুরাণ-ইতিহাসের বৃত্তান্ত থেকে এইটেই প্রমাণ হবে যে, মেয়েরাই ছিল বেশি শক্তিশালী, তারাই ছেলেদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাত এবং প্রচুর রঞ্জু-ভ্রমণের পর ছেলেরা বলত–মাগী ছলাকলায় আমাকে ভুলিয়ে এতকাল ঘুরিয়েছে; আমার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু রূপের নেশায় আমি ছিলাম নাচার। অতএব শুন ভাই সাধু, তোমরা মেয়েছেলে দেখে ভুলো না, নারী নরকের দ্বার। পুরুষ শুনত এবং আবার ভুলত।
বন্ধুর কথা শুনে আমি ভাগবত পুরাণের কলিকালের বর্ণনা স্মরণ করলাম। আমি বললাম–ধুর, আপনি যা বলছেন, সে সব ঘটবে। কলিকালে। ঋষিরা বলেছেন–কলিকালে পুরুষেরা হবে সব মেনিমুখো স্ত্রৈণ–দীনাঃ স্ত্রৈণাঃ কলৌ নরাঃ। কলির পুরুষেরা সব বাপ-ভাই ছেড়ে, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে–পিতৃ-ভ্রাতৃ-সুহৃদ-জ্ঞাতী হিত্বাবউয়ের আঁচল ধরে শুধু শালা-শালীর খোঁজ নিয়ে বেড়াবে–ননান্দ্ব-শ্যালসংবাদা দীনাঃ স্ত্রৈণাঃ কলৌ নরাঃ। বন্ধু বললেন–বেড়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন আপনার ঋষি। কেন, দ্বাপর-ত্রেতার চেহারাটা কি অন্যরকম ছিল। খোঁজ নিয়ে দেখুন তো দ্বাপর যুগের পুরুষেরা কি শালা-শালীর খবরই রাখতেন না। মনে করতে পারেন কি-কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মহামতি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সেনাবাহিনীর প্রথম এবং প্রধান সেনাপতি কে ছিলেন? গাণ্ডীবধারী ভাই অর্জুনও নয়, গদাধর ভাই ভীমও নয়। সেনাপতি ছিলেন পাঁচ ভাইয়ের এক শালা ধৃষ্টদ্যুম্ন। তাছাড়া বিরাট-রাজার শালা কীচকের প্রতি বিরাট রাজার কীরকম প্রীতি ছিল, অর্জুনের শালা কৃষ্ণের ওপর অর্জুনের কীরকম গদগদ ভাব ছিল, সেটাও কি বলে দিতে হবে। আর কথা বাড়াবেন না। এত বড় মানুষ, অর্জুনের ছেলে অভিমন্যুটা পর্যন্ত বাবার বাড়িতে মানুষ হয়নি, হয়েছে তার মামা-বাড়িতে। কেন হস্তিনাপুরে কি আর পাঁচটা ছেলে মানুষ হয়নি, তার বাপেরা মানুষ হয়নি। যাই বলুন, এও শালা-প্রীতি। আর কথা বাড়াবেন না।
আমি আর কথা বাড়াইনি। ভাবলাম শালা-শালীর কথাটা ও যুগেও সত্যি হতে পারে। কিন্তু স্ত্রৈণতা? কিংবা ভাগবত পুরাণ যে বলেছে–কলিকালে শুধু কামনার কারণেই মেয়েদের সঙ্গে মিশবে পুরুষেরা–সৌরতসৌহৃদাঃ–এ ব্যাপারটা? মনে মনে ভেবে প্রমাদ গনলাম। বিভিন্ন পুরাণে পাতায় পাতায় অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন দেবতা এবং কাম-লোেভ বর্জিত মুনিদের স্ত্রীসঙ্গ পাবার জন্য যে ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে, তা ভাবতে ভয় করে। আর তাদের কামনা জানাবার যে ভাষা, সে ভাষার মধ্যে ভালোবাসার কোনো ব্যঞ্জনা নেই, আছে শুধু রমণীর প্রত্যঙ্গ-স্তুতির সঙ্গে দুরবাধ সঙ্গমেচ্ছা–সে ভাষা আর উচ্চারণ করে কলিকালের কচি-কাঁচাঁদের পাকিয়ে তুলতে চাই না। কবিবর যে লিখেছিলেন–মুনিগণ ধ্যান ভাঙি দেয় পদে তপস্যার ফল, তোমারি কটাক্ষঘাতে ত্রিভুবন যৌবনচঞ্চল’-এ শুধু উর্বশীর একার ক্ষমতা নয়, পুরাণ কাহিনিতে যে-কোনো রমণীর রূপ দেখে কাম-গন্ধহীন মহাপুরুষেরাও মুহূর্তে কামোন্মত্ত হয়ে উঠেছেন। কাজেই শুধুমাত্রা যৌন সম্বন্ধের ইচ্ছাতেই স্ত্রীলোকের সঙ্গে মেশামেশি–এ কিন্তু যতখানি পৌরাণিক যুগের বৈশিষ্ট্য, কলিকালের ততটা নয়। পুরাণকারেরা তাদের কালের দুষ্কর্মগুলি চাপিয়ে দিয়েছেন কলিকালের কাঁধে।
এই যে উর্বশীর কথা বললাম, সে তো স্বর্গের বেশ্যা বলে পরিচিত। স্বর্গের বেশ্যা মানেই কিন্তু তার রূপ, যৌবন, ক্ষমতা–কোনোটাই সাধারণ বেশ্যার মতো নয়। বিশেষত কালচার’, বিদগ্ধতা, শিক্ষা–এসব গুণ তখন শুধু গণিকাদেরই থাকত। তার ওপরে উর্বশী হলেন, স্বর্গের বেশ্যা, তার খানদানই আলাদা। পুরাণগুলির মধ্যে উর্বশীকে একাধিকবার পাঠানো হচ্ছে। শুধু ইন্দ্রিয় সংযত সিদ্ধবর্গের সুপ্ত কামনায় সুড়সুড়ি দেওয়ার জন্য। আর কী আশ্চর্য, তিনি সব সময়ই সফল। এই যে সুপ্রসিদ্ধ চন্দ্রবংশ, যে বংশের অধস্তন কৌরব-পাণ্ডবেরা কত পুরাকীর্তি স্থাপন করে গেলেন, ভাবতে পারেন, সে বংশের মূলেও বংশ বংশ ধরে রমণী-দর্শনমাত্রে কাম-সম্বন্ধ ঘটেছে। ভাবতে পারেন সে বংশের এক মহ গ্রন্থিতেও জড়িয়ে আছেন স্বর্গ-বেশ্যা উর্বশী। চন্দ্রবংশের প্রথম পুরুষ চন্দ্র শুধু গুরুপত্নীকে ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হননি। গুরুপত্নীর গর্ভে তার একটি পুত্র হয়েছিল এবং সে পুত্র সুস্থ সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছিল। যদিও ধর্ষণজাত এই পুত্রটির সামাজিক স্বীকৃতি পুরাণগুলিতে লেখা হয়েছে নক্ষত্র-জন্মের প্রতাঁকে, তবু গুরু বৃহস্পতির সামনেই তার স্বেচ্ছায় ধর্ষিতা স্ত্রী একটুও বলতে লজ্জাবোধ করেননি যে, তাঁর পুত্র বুধ ধর্ষণকারী চন্দ্রের জাতক। আবার পরবর্তী সময়ে বুধ যখন এক রমণীকে প্রলুব্ধ করার জন্য ব্রাহ্মণ বেশ ধারণ করেছেন, তখন তিনি নিজের কুল পরিচয় দিচ্ছেন বৃহস্পতির ছেলে বলে-পিতা মে ব্রাহ্মণাধিপঃ।
কাজেই দেখুন ভাগবত পুরাণ যে বলেছিল–সঙ্গম বাসনাতেই কলিকালে স্ত্রীলোকের সঙ্গে মেলামেশি করবে লোকেরা, সে ট্র্যাডিশন’ বহু কালের। চন্দ্র তো গুরুপত্নীর গর্ভে বুধের জন্ম দিলেন, কিন্তু বুধ কী করলেন? তিনি মোহিত হয়েছিলেন এমন এক মহিলাকে দেখে, যে মহিলা পূর্বে পুরুষ ছিলেন। পুরাকালে ‘সেক্স-চেঞ্জ করার কোনো শৈলী বা শৈল চিকিৎসা চালু ছিল কিনা জানি না, কিন্তু মনুর ছেলে ইল রাজা মহাদেব আর পার্বতীর ক্রীড়াকানন শরবনে ঢুকে স্ত্রীলোক হয়ে গেলেন। মহাদেব নাকি এই নিয়ম করেছিলেন যে, পুরুষ মানুষ তার বিহারস্থানে ঢুকলেই মেয়ে হয়ে যাবে। মহারাজ তাই মেয়ে হয়ে গেলেন, তার নাম হল ইলা। মৎস্য পুরাণ লিখেছে মেয়ে হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার স্তন যুগল হয়ে উঠল পীনোন্নত, জঘনদেশও তাই-সাভবন্নারী পীনোন্নতঘনস্তনী। চাঁদের মতো মুখে এল বিললাল কটাক্ষ; ইলার দেহে এল আরও সব অস্ত্র, যা রমণীর দেহ-তুণে থাকে। রমণী হবার সঙ্গে সঙ্গে ইলার মনে হল–কেই বা আমার বাবা, কেই বা মা, কোন স্বামীর হাতেই বা আমি পড়ব? এত সব চিন্তা করতে করতে মোহময়ী রমণী যখন নির্জন বনপথে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে থাকল, তখনই চোখে পড়ে গেল চন্দ্রপুত্র বুধের। এই মুহূর্তে মৎস্য পুরাণের ভাষা হল-রমণীকে দেখামাত্র বুধের মন জর্জরিত হয়ে উঠল এবং তিনি কামপীড়িত হয়ে, কী করে এই রমণীকে লাভ করা যায় সেই উপায়ে মন দিলেন–বুধঃ তদাপ্তয়ে যত্নম্ অকরো কামপীড়িতঃ। এর পরেই বুধের ব্রাহ্মণবেশ। ইলার হঠাৎ স্ত্রীত্ব-প্রাপ্তিতে থতমত ভাবটা তিনি জানতেন বলে কৌশল করে আচমকা তাকে বললেন–আমার অগ্নিহোত্রের কাজকর্ম ফেলে কোথায় পালিয়েছিলে, সুন্দরী! এখন সন্ধে হল, এই তো রমণীয় বিহারের সময়–ইয়ং সায়ন্তনী বেলা বিহারস্যেহ বৰ্ত্ততে। তুমি ঘরদোর মুক্ত করে ফুল-সজ্জা কর আমার ঘরে। আর কি, ইলা বুধের মায়া-ভবনে ঢুকলেন। তারপর বছরের পর বছর কেটে গেল রসে, রমণে–রেমে চ সা তেন সমম্ অতিকাল ইলা ততঃ।
তাহলে ভাগবত পুরাণের কলিকালের ভবিষ্যদ্বাণী খাটল গিয়ে অতীত কালে। চন্দ্র গেল, বুধ গেল, তার ছেলে পুরূরবাও মুগ্ধ হলেন স্বর্গ-সুন্দরী উর্বশীকে দেখে। ভাগবত পুরাণের মন্তব্য বিরুদ্ধভাবে সপ্রমাণ করার জন্য আমরা বিষ্ণুপুরাণের টিপ্পনীটা বজায় রাখব। বলব–দুজনে দুজনকে দেখা মাত্রই মোহিত হলেন। বিশেষত রাজা, যাঁর পক্ষে অন্য দরকারি কাজ ফেলে রাখা চলে না, তিনি সব বাদ দিয়ে প্রগল্ভতায় ভরপুর উর্বশীকে বললেন–সু, আমি কামনা করি তোমাকে–ত্বামভিকামো’স্মি। তাই আশা করব তুমিও অনুরাগ উপহার দেবে আমাকে। পুরূরবা এবং এই স্বৰ্গবেশ্যা উর্বশীর মধ্যে পারস্পরিক কামনার ব্যাপার যাই থাকুক, একথা কিন্তু মানতেই হবে যে, ভারতবর্ষের উপন্যাস, নাটক বা রোমান্টিক প্রেমের আরম্ভবিন্দু হল এই পুরূরবা-উর্বশীর মিলন কাহিনি, যে কাহিনির আরম্ভ ঋগবেদে এবং পরিণতি কালিদাসের ‘বিক্রমোর্বশীয়’ নাটকে। পাঠকের জ্ঞাতার্থে আমি স্বল্পক্ষণের জন্য মৎস্যপুরাণ স্মরণ করব, কারণ অন্যান্য পুরাণের চেয়ে মৎস্যপুরাণের কাহিনিতেই রোমান্টিকতার সুবাস লেগেছে বেশি।
দানবরাজ কেশী স্বর্গ আক্রমণ করে স্বর্গের শোভা উর্বশীতে হরণ করে নিয়ে যাবার সময় পুরূরবার চোখে পড়েন। বহুবার স্বর্গে যাতায়াত করার ফলে পুরূরবা উর্বশীকে চিনতেন এবং উর্বশীকে হারালে স্বর্গের কী ক্ষতি হবে, দেবরাজের মন কতটা ভেঙে পড়বে তাও তিনি বুঝতেন। পুরূরবা মাঝপথে কেশীকে আক্রমণ করে উর্বশীকে তুলে নিয়ে পৌঁছে দেন দেবরাজের কাছে। কৃতজ্ঞ দেবরাজের সঙ্গে পুরূরবার বন্ধুত্ব আরও বেড়ে যায়। উর্বশী উদ্ধারে সমস্ত দেবতারাও দারুণ খুশি। এমন একটা ঘটনা ‘সেলিব্রেট করার জন্য স্বর্গমঞ্চে একটি নাটক করার কথা হল, যার নাম লক্ষ্মীস্বয়ংবর, পরিচালক স্বনামধন্য নাট্যশাস্ত্রকার ভরতমুনি। বহু নাটকের নায়িকা উর্বশী লক্ষ্মীর ভূমিকায় অভিনয় করছিল। প্রথম থেকেই নাটকের যেখানে সেখানে সে পুরূরবার কীর্তিকথা গান করতে থাকে, এবং স্বয়ং পুরূরবা তখন দর্শকাসনে উপবিষ্ট। পরিচালক ভরতমুনি তবুও কিছু বলেননি। কিন্তু এবার মেনকা রম্ভা এবং উর্বশীর নেচে নেচে গান করবার কথা। পুরূরবাকে দেখে নৃত্যপরা উর্বশী ভরতমুনির শেখানো লক্ষ্মী স্বয়ংবরের পার্ট ভুলে গেল। নেমে আসল অভিশাপ, বিজন বনে লতা হয়ে থাকার অভিশাপ।
কালিদাস এই অভিশাপকে কাজে লাগিয়েছেন কবিকল্পে, উর্বশীর জন্য বিরহী পুরূরবার বিলাপে। কিন্তু আমরা জানি উর্বশীর ওপর আরও একটা অভিশাপ ছিল, যা তাকে সাহায্য করেছিল পুরূরবাকে পেতে। মিত্র আর বরুণ–এই যমজ দেবতা বদরিকাশ্রমে বসে তপস্যা করছিলেন। সেই অবস্থায় আশ্রমের বাগান থেকে নানা ভঙ্গিতে ফুল ভোলা আরম্ভ করল উর্বশী। প্ররোচনার জন্য দেহ-সৌষ্ঠব এমন এক স্কুটাস্ফুট সীমারেখায় এসে পৌঁছেছিল যে তপস্যারত দুই দেবতা আর তাকে না দেখে পারছিলেন না-সুসূক্ষ্মরক্তবসনা তয়োদৃষ্টিপথং গতা। ফলে ভাগবত পুরাণের কলিকাল মিথ্যা করে দুই দেবতা মোহিত হলেন এবং তাদের তেজ পতিত হল ত্রেতা কিংবা দ্বাপরযুগের তপস্যার আসনে–তপস্যতোস্তয়োবীর্য অস্থলচ্চ মৃগাসনে। মৎস্যপুরাণ লিখেছে–দুই দেবতাই পরস্পরের শাপভয়ে নিজেদের সামলালেন বটে কিন্তু উর্বশীর ওপরে শাপের কথাটা এখানে পুরাণ বলেনি। বিষ্ণুপুরাণ কিংবা বায়ুপুরাণে দেখছি মিত্রবরুণের শাপের কথা উর্বশীর মনে আছে এবং বিদগ্ধা রমণী ভাবছে–শাপের ফলে যখন মর্ত্যলোকেই বাস করতে হবে, তবে সেই মর্ত্যরাজা পুরূরবার সঙ্গেই থাকব। বিষ্ণুপুরাণ লিখেছে পুরূরবাকে দেখেই উর্বশী তার স্বর্গের অহংকারে জলাঞ্জলি দিয়ে সমস্ত স্বর্গসুখ পায়ে ঠেলে–অপহায় মান, অপাস্য স্বর্গসুখাভিলাষং–উর্বশী আত্মনিবেদন করল রাজার কাছে। আর পুরূরবা। তিন ভুবনের সেরা স্বর্গসুন্দরীর রূপ, বিলাস আর হাসি দেখে মুগ্ধ পুরূরবা বললেন–আমি তোমাকেই চাই–ত্বা অভিকামো’স্মি। লজ্জায় যেন নুয়ে পড়ে স্বর্গের গণিকা জবাব দিল–থাকতে পারি তোমার সঙ্গে, কিন্তু শর্ত আছে। মোহিত রাজা তখন যে-কোনো শর্তেই রাজি। উর্বশী বলল–আমার বিছানার কাছে দুটি মেষ-শাবক থাকবে, যাদের আমি ভালোবেসে পালন করি; ও দুটিকে কখনও সরানো চলবে না। দ্বিতীয় শর্তে উর্বশী বলল-মহারাজ। আমি যেন আপনাকে কখনও উলঙ্গ না। দেখি–ভবাংশ্চ ময়া নগ্নো ন দ্রষ্টব্যঃ। স্বর্গের সংস্কৃতিতে এই হয়তো বিদগ্ধা মহিলার রুচি কিন্তু মৎস্যপুরাণ বিপদ বুঝে উর্বশীকে শুধরে দিয়ে বলেছে–মহারাজ। মৈথুনের সময় ছাড়া অন্য সময় যেন আপনাকে নগ্ন না দেখি–অনগ্নদর্শনঞ্চৈব অকামৎ সহ মৈথুন। উর্বশীর তৃতীয় শর্ত ছিল, যতদিন সে রাজার কাছে থাকবে, ততদিন তার আহার হবে শুধু ঘি-ঘৃতমাত্রং তথাহারঃ।
শুধুমাত্র ঘি খেয়ে জীবনধারণ। এ আমরা কলিকালের লোকেরা ভাবতে পারব না, কিন্তু পুরাণের অঙ্কে রাজা নাকি ভোগে, সুখে উর্বশীর সঙ্গে ষাট হাজার বছর কাটিয়েছিলেন। আর মাটির রাজার রতিসুখে উর্বশী, স্বৰ্গবেশ্যা উর্বশী নাকি ভেবেছিল–ছাই অমন স্বর্গের মুখে, আর স্বর্গে ফিরে যাব না–প্রতিদিন-প্রবর্ধমানানুরাগা অমরলোকবাসেপি ন স্পৃহাং চকার। এর পরের সব ঘটনা আর ব্যক্ত করতে চাই না। মোট কথা স্বর্গের চাতুরিতে উর্বশী রাজাকে উলঙ্গ দেখতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু এর পরেও রাজার প্রেমের টানে উর্বশীকে প্রতি বছরে এক রাত অন্তত পুরূরবার বাহুবন্ধনে ধরা দিতে হত।
আমি অবশ্য এখানে পুরূরবা-উর্বশীর প্রেমকাহিনি শোনাতে বসিনি। আমি চন্দ্রবংশের তিন মূল পুরুষের কাহিনি উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, সুন্দরী রমণীর দর্শনমাত্রেই পুরুষের যে বাঁধভাঙা উন্মাদনা, সে যদি কলিকালেও সত্যি হয়, তবে তা দ্বাপর-ত্রেতাতে আরও বেশি সত্যি, কারণ কলিকালের ভদ্রলোকেরা যা করে, রয়ে সয়ে করে, কিন্তু পৌরাণিক কাহিনিতে হঠাৎ করেই, অথবা যাচ্ছেতাইভাবে সবই করা যেত। দেখামাত্রই সেখানে স্পৃহা এবং স্পৃহামাত্রই চ্যুতি, ধৈর্যচ্যুতি থেকে আরম্ভ করে সর্বচ্যুতি। আসল কথা মানুষের মূল চরিত্র কখনওই প্রায় বেশি পরিবর্তিত হয় না। পুরাণকারেরা ঘোর কলি বলে যা যা বলেছেন, তা সব তাদের কালেও একভাবে ছিল। অন্যদেশীয় চালে কথাবার্তা বলা আধুনিক বিনোদিনীকে নাই বা দেখলেন তারা, কিন্তু হালকা কাপড়-পরা উর্বশী-রম্ভাই বা কম কীসে? বড় ঘরের অতিযৌবনা সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে শীর্ণকায় সাধারণ মানুষের প্রেম দেখলে, আমরা যেমন সদুপদেশ দিই–দে ভাই, এ সব বস্তু আমাদের জন্যে নয়, এদের জন্যে তৈরি বরপুরুষ আছে অন্য জায়গায়, আমাদের মতো সাধারণ ঘরে নয়, তেমনি সে যুগের কবিরাও রব তুলেছেন–আরে, রম্ভার মতো স্বর্গসুন্দরীর সঙ্গে সম্ভোগ করতে কত ক্ষমতা গে, সে জানেন শুধু দেবরাজ। যারা সব সময় ছোঁক ছোঁক করছে, এই সব চেড়ির মতো বিটলে পুরুষেরা কি ক্ষমতায় বুঝবে স্বর্গসুন্দরীর স্বাদ–ঘটচেটীবিটঃ কিংস্বিদ জানাত্যমরকামিনীম্।
আমাদের বলা পুরাণকাহিনির এই সব নমুনা থেকে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, সেকালে কোনো সজ্জন পুরুষ ছিলেন না, ছিলেন না সতীসাধ্বী মহিলারা। বরঞ্চ তারা এতই ছিলেন এবং এতকালের সমস্ত আলোচনায় তারা এত বিপুলভাবেই সংবর্ধিত হয়েছেন যে, আলাদা করে এই মুহূর্তে তাদের স্মরণ করার প্রয়োজন বুঝি না। আমি শুধু বলতে চেয়েছি যে, সেকালের দুনিয়াটা যদি শুধু সাধু, সজ্জন আর সাধ্বী মহিলায় ভরা থাকত, তাহলে সমাজটা স্থাণু হয়ে যেত। আমি বলতে চেয়েছি, কলিকালের সব দোষই কোনো না কোনোভাবে পৌরাণিক সমাজেও ছিল এবং সে সমাজটাও ছিল ভালো-মন্দে সচল। শুধু বড় ঘরের মেয়ে সম্বন্ধে কৌতূহলই নয়, শুধু পছন্দসই মেয়ে দেখামাত্রই স্পৃহালুতা নয়, বিদগ্ধা সুন্দরীর হালকা প্ররোচনামূলক পরিধানই নয়, সে কালের অনেক কিছুর মধ্যেই পাব কলিকালের আধুনিক চলন-বলনের ভঙ্গি, যদিও সে ভঙ্গি পুরাতন সরল সমাজে অবশ্যই অন্যরকম। কিন্তু তারা জানতেন, সবই জানতেন। প্রাকৃবিবাহ পর্বে প্রেম করাও জানতেন, লুকিয়ে দেখা করাও জানতেন, আবার বিয়ের পর হনিমুনে যাওয়ার কথাটাও জানতেন। তবে হা বিয়ের আগে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করার জন্য তাদের সুবিধে ছিল অনেক বেশি। শত শত কুঞ্জ বন আর রেবা-নর্দমার তীরভূমি ছেড়েই ছিলাম, ছেড়েই দিলাম ভাঙা দেউল আর হাজারো নির্জন স্থান। স্বয়ং কৃষ্ণ ঠাকুর যে জায়গাটি দেখিয়ে দিয়েছেন, প্রেম করার জন্য, সে জায়গার হদিশ পেলে আধুনিক প্রেমিক-প্রেমিকারা প্রমাদ গুনবেন। নররূপী ভগবান কৃষ্ণ সহস্র প্রেমিকাকে সুখী করার জন্য শ্মশানে নিয়ে গেছেন নির্জনে রসাস্বাদন করতে। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের এই পৌরাণিক ক্ষেত্রটি আধুনিক প্রেমিক-প্রেমিকারা স্মরণে রাখতে পারেন, কেননা আধুনিক জনসংকুল শহরগুলিতে শ্মশান জায়গাটিতে অন্যলোকের ভিড় থাকলেও নেহাত আপনার আত্মীয়-গুরুজন গতায়ু না হলে ধরা পড়ার কোনো ভয় নেই। বিয়ের পরে যে হনিমুন’, তারও কিছু নমুনা পাওয়া যাবে পুরাণে। সেই যে পুরূরবা, তিনি উর্বশীকে বিয়ে করে কত জায়গায় ঘুরেছিলেন জানেন? কখনও চৈত্ররথ বনের মতো রিজার্ভ ফরেস্ট’, কখনও মন্দাকিনীর তীরে, কখনও কামনার মোধাম অলকায় কখনও ঐতিহাসিক নগরী বিশালায়–অলকায়াং বিশালায়াং নন্দনে চ বনোত্তমে। রাজার ভ্রমণসূচিতে গন্ধমাদন পাহাড়ের নিম্নভূমি কিংবা নাম করা হিল-স্টেশন’ মেরুশৃঙ্গও বাদ যায়নি। বাদ যায়নি দূরপাল্লার দেশ উত্তর কুরু কিংবা ছায়া-সুনিবিড় কলাপ গ্রাম। এই সব জায়গায় রাজা উর্বশীকে নিয়ে পরম সুখে রমণ করেছেন-উর্বশ্যা সহিতো রাজা রেমে পরময়া মুদা।
পরাশর বলেছিলেন–কলিকালের বিয়ে-করা বউরা যদি একটুও অনাদর পায় তাহলে নাকি তারা মাথা চুলকোতে চুলকোতে অনায়াসে স্বামীদের কথা উড়িয়ে দেবে–উভাভ্যামেব পাণিভ্যাং শিরঃ কণ্ডুয়নং স্ত্রিয়ঃ। কুন্ত্যো গুরুভর্তৃর্ণামাজ্ঞাং ভেৎস্যন্তানাদৃতাঃ। আহা, পরাশর-ব্যাসের যুগে বোধ হয় অনাদর পেলে মেয়েরা যেন সব স্বামীদের মাথায় তুলে চুমো খেত। সেই যযাতি রাজা ক্ষণিকের কামনায় ভুলে শর্মিষ্ঠার একটু গর্ভ উৎপাদন করেছিলেন বলে (যা সে যুগের নিরিখে এমন কিছু অপকর্ম নয়) তার নিজের স্ত্রী দেবযানী বাবাকে বলে তাঁর দেহে হাজার বছরের বার্ধক্যের ব্যবস্থা করেছিলেন। বোকা যযাতি জানতেন না যে, সমস্ত পুরাণগুলি একযোগে ব্যবস্থা দিয়েছে যে শ্বশুর-শাশুড়িকে পিতা-মাতার মতো, গুরু-গুরুপত্নীর মতো সম্মান করবে। তাও আবার দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের মতো ক্ষমতাবান শ্বশুর। যযাতি শ্বশুরের কথা শোনেননি, তার ফলও ভোগ করেছেন।
তবে এও মানতে হবে এই শুক্রাচার্য পুরাণগুলির মধ্যে এক বিচিত্র চরিত্র। আমাদের বিশ্বাস সেকালের ব্রাহ্মণ-সমাজে শুক্রাচার্যের মতো ব্রাহ্মণ আরও অনেকেই ছিলেন, যদিও তার চরিত্রটি পুরাণ-কথিত ব্রাহ্মণ-সমাজের আচরণীয় চরিত্রের সঙ্গে মেলে না। যেমন ধরুন ব্রাহ্মণের পক্ষে সুরা পান এক্কেবারে বারণ। এমনকী যে ব্রাহ্মণ সুরা পান করে ফেলেছেন তাকে শাস্ত্রমতে দৈহিক কৃচ্ছসাধন করে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। শাস্ত্রীয় শাস্তির বহর থেকেই বুঝি মদ্যপানের অপরাধ তখনকার ব্রাহ্মণদের মধ্যে অনেকেই করতেন। আমাদের শুক্রাচার্য কিন্তু ভালোরকম মদ্যপান অভ্যেসকরেছিলেন। স্বয়ং ভগবান বিভূতিযোগে নিজেকে শুক্রাচার্যের মতো পণ্ডিত বলে কল্পনা করেছেন, অথচ অসুরগুরু হওয়ার সুবাদে প্রতিদিনই সেই পণ্ডিতের মদ না হলে চলত না। এই অভ্যাস ছিল বলেই অসুরেরা একদিন বৃহস্পতি-পুত্র কচকে পুড়িয়ে গুঁড়ো করে তার পানপাত্রে মদের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল এবং শুক্রাচার্য প্রেমানন্দে সেই মদ পান করে কচকে গলাধঃকরণ করেছিলেন। কচ সঞ্জীবনী বিদ্যা শিখে গুরুর পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে আবার শুক্রাচার্যকে বাঁচালেন বটে, কিন্তু মদ খেয়ে তার কী অবস্থা হয়েছিল, সে অবস্থাটার একটা ইঙ্গিত দিয়েছে পুরাণকার। মৎস্যপুরাণ লিখেছে তিনি অসুরদের প্রবঞ্চনায় মদ খেয়ে একেবারে মাতাল হয়ে গিয়েছিলেন–সুরাপানা বঞ্চনং প্রাপয়িত্ব, সংজ্ঞানাশং চেতসশ্যাপি ঘোর। পুরাণকার শেষ পর্যন্ত এক কৌশল করেছেন। ব্রাহ্মণের যেহেতু মদ খাওয়া বারণ এবং শুক্রাচার্য যেহেতু মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়েছেন, অতএব পরবর্তী সমস্ত ব্রাহ্মণ-সমাজকে বাঁচানোর জন্য মৎস্যপুরাণ বলেছে যে, শুক্রাচার্যই রেগে-বেগে নিয়ম করলেন–ব্রাহ্মণের পক্ষে এর পর থেকে সুরাপান নিষিদ্ধ হল। যেন তার পরে আর কোনো ব্রাহ্মণ সুরাপান করেনি।
পুরাণগুলিতে আপ্ত মুনি-ঋষিদের উপদেশাবলি শুনলে মনে হবে যে, সেকালের আর্যপুরুষেরা ছল, জুয়োচুরি, রাহাজানি এসব কিছুই যেন জানতেন না। কিন্তু এক এই শুক্রাচার্যের কাহিনিতেই এই সমস্ত অপরাধের অনেকগুলি উদাহরণ পাব। এমনকী শ্রেষ্ঠ বলে পরিচিত দেবসমাজ, বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণও এই ছলনায় এমনভাবে অংশ নিয়েছিলেন যে, আজকাল হিন্দি সিনেমার অনেক চিত্রাংশ এই কাহিনির কাছে ঋণী থাকবে। দেবতা আর তাদের সত্তাই দৈত্যদের যুদ্ধ-বিগ্রহ তখন প্রায়ই লেগে ছিল। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য আরও সিদ্ধাই পাওয়ার জন্য ধূমব্রত পালন করে মহাদেবের তপস্যা করছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্র স্বভাবতই প্রমাদ গুনলেন। কিন্তু বিপদ-মুক্তির জন্য বড় ঘরের ব্যবসাদারের মতো তিনি কাজে লাগালেন নিজের মেয়ে জয়ন্তীকে। জয়ন্তীর উদ্দেশে পিতার উপদেশ ছিল–শুক্রাচার্যকে হাত করতে হবে তোমায়–গচ্ছ সংসাধয়স্বৈন। তার মনে যেমনটি চায় সেই সমস্ত স্ত্রীলোকের উপচারে সেবা করতে হবে। তোমায়। জয়ন্তী গেলেন। প্রথমে মধুর কথা, সেবার ইচ্ছে দিয়ে কাজ আরম্ভ হল, পরে তপঃক্লান্ত মুনির গা-হাত-পা টিপে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পর্শসুখও দিতে থাকলেন জয়ন্তী–গাত্রসংবাহনৈঃ কালে সেবমানা ত্বঃ সুখৈঃ–শুক্র কিন্তু তপস্যা ছাড়েননি, মহাদেবের বরলাভও সম্ভব হল তার ফলে। জয়ন্তী ততদিনে শুক্রাচার্যের প্রেমে পড়ে গেছেন। বরলাভ করার সঙ্গে সঙ্গেই শুক্র ফিরে তাকিয়েছেন জয়ন্তীর দিকে। বললেন-তুমি কে, কী চাও, কেনই বা এত কষ্ট করছ আমার জন্যে, তোমার ভালোবাসায় আমি খুশি, বল কী চাই–স্নেহেন চৈব সুশ্রোণি প্রীতোস্মি বরবৰ্ণিনি। শুক্রের কথা শুনে সলজ্জে জয়ন্তী বললেন–আমার মনে কি আছে, তা তুমি ধ্যানযোগেই জেনে নাও, মুনি–তপসা জ্ঞাতুমহসি। আমি বলতে পারব না।
জয়ন্তী পুরো দশ বছর শুক্রাচার্যের সঙ্গে বিহার করতে চেয়েছিলেন। এতকাল তপস্যার পরিশ্রমের পর এমন মধুর নিবেদন শুনে শুক্র সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলেন। বললেন–”এবমস্তু’ সুন্দরী, আমাদের ঘরে চল। পুরাণকার লিখেছেন–তারপর শুক্রাচার্য জয়ন্তীকে বিয়ে করে দশ বচ্ছর ধরে মায়াবৃত হয়ে সকলের অদৃশ্য হয়ে থাকলেন–অদৃশ্যঃ সর্বভূতানাম্। আমরা জানি–নিয়মব্রতে এতকাল উপবাসী শুক্রাচার্য প্রায়ই আর ঘরের দরজা খোলেননি। তবে এই দশ বচ্ছর অদৃশ্য থাকার ফল হল পুরাণের অন্যতমা নায়িকা দেবযানীর জন্ম–সময়ান্তে দেবযানী তদোপন্ন ইতি শ্রুতিঃ।
কিন্তু আসল মাথাব্যথাটা দেবানীর জন্ম নিয়ে নয়। অসুরেরা শুনেছিল, তাদের গুরু তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করেছেন, কিন্তু বাড়ি গিয়ে তারা তাকে পেল না। মায়া-ফায়ার ব্যাপার যে কিছু ছিল না তা কিন্তু পুরাণের একটা খবর শুনেই বোঝা যায়। পুরাণ লিখেছে, মায়াবৃত গুরুকে দেখতে না পেয়ে তার ভাবগতিক বুঝে-লক্ষণং তস্য তদ বুধ্ব-অসুরেরা ফিরে এল। এই যে ভাবগতিকের’ ব্যাপারটা–এটা শুক্রাচার্যের ক্ষেত্রে বড় বেশি সত্যি। তিনি বড্ড বেশি মেজাজি মানুষ; তিনি ইচ্ছে করেছেন দশ বছর ফুর্তিতে কাটাবেন, অতএব কারও সাধ্য হবে না, তাকে ফেরাবে। তিনি ইচ্ছে করেছিলেন শত্রুপক্ষের ছেলে কচকে বিদ্যা শেখাবেন, সেখানে অসুরদের হাজার বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি টলেননি। অসুর গুরু শুক্রাচার্যের মধ্যে এই খাঁটি ব্যাপারটা ছিল, তার পাঠশালাতে এখনকার ছাত্রদের নিয়মে পাঁঠার ইচ্ছেয় কালীপুজো হত না, যা দেবসমাজে হত। যেমন অসুর গুরুর দশ বছরের নেশা বুঝেই ইন্দ্র দেবগুরু বৃহস্পতিকে পাঠালেন কার্যসিদ্ধি করতে। দেবগুরু নির্দ্বিধায় চলে এলেন অসুরদের ছলনা করার জন্য। পুরাণকারও পরমানন্দে জানালেন–বোকা অসুররা কীভাবে ছলিত হল। কিন্তু আমাদের ধারণা দেবসমাজের বিরুদ্ধপক্ষে থাকতে হত বলেই যা কিছুই অসুরদের আয়ত্ত করতে হয়েছে, তা নিষ্ঠাভরেই আয়ত্ত করতে হয়েছে। ছলনা ব্যাপারটা তাদের শুক্রাচার্যের পাঠক্রমে ছিল না বলেই তারা দেবগুরুর ছলনা বুঝতে পারল না। দেবগুরু শুক্রাচার্যের বেশ ধরে এলেন এবং অসুরদের পটিয়ে-পাটিয়ে উলটো বিদ্যা শেখাতে থাকলেন।
এদিকে দশ বছর শেষ হয়েছে। স্ত্রী জয়ন্তীকে বিদায় জানিয়ে শুক্রাচার্য উপস্থিত হলেন তার যজমান, ভক্ত অসুরদের কাছে। শুক্রাচার্য এসে দেখলেন দেবগুরু তার অনুপস্থিতিতে আসর জমিয়ে নিয়েছেন এবং অসুরেরা কিছুই বুঝতে পারছে না, শুধু প্রতারিত হচ্ছে। দৈত্যগুরু হাঁক দিয়ে বললেন–তোরা করেছিস কী? আমি হলাম শুক্রাচার্য, আমিই তপস্যায় মহাদেবকে তুষ্ট করে এসেছি। অসুরেরা একবার এদিক তাকায় একবার ওদিক তাকায়, কিন্তু কিছুতেই বোঝে না কোনটা আসল শুক্রাচার্য। শুক্র বললেন-ওরে আমিই তোদের গুরু, কবির কবি শুক্রাচার্য। আর এই যাকে দেখছিস, ইনি দেবগুরু বৃহস্পতি। তোরা আমার পথে আয়; বঞ্চিত না হতে চাস তো বৃহস্পতিকে ত্যাগ কর। অসুরেরা আবার তাকিতুকি শুরু করল, কিন্তু আসল শুক্র আর নকল শুক্রের মধ্যে কোনো তফাত বুঝতে পারল না। ঠিক এই সময়ে দেবগুরু বৃহস্পতি কী করলেন জানেন! তিনি শুক্রাচার্যের মেজাজ নিয়ে বললেন–ভাই সব, আমিই তোমাদের গুরু শুক্রাচার্য। আর এই যে আজকে যিনি উড়ে এসে জুড়ে বসতে চাইছেন–ইনিই আসলে দেবগুরু বৃহস্পতি, শুক্রাচার্যের রূপে আমাদের সবাইকে প্রতারণা করতে চাইছেন। বৃহস্পতির প্রত্যয়-মাখানো কথা শুনে অসুরেরা পুরো দেহাতি কায়দায় বৃহস্পতির দিকে আঙুল দেখিয়ে শুক্রকে বলল-ইনিই আমাদের দশ বছর ধরে শিক্ষা দিচ্ছেন, ইনিই আমাদের অন্তরের গুরু। অসুরেরা এবার চোখ লাল করে শুক্রাচার্যকে বলল–ভাগুন আপনি এখান থেকে, আপনি মোটেই আমাদের গুরু নন–গচ্ছ ত্বং নাসি নো গুরুঃ। ইনি বৃহস্পতিই হোন আর শুক্রই হোন, ইনিই আমাদের গুরু, আপনি মানে মানে কেটে পড়ুন এখান থেকে–সাধু ত্বং গচ্ছ মাচিরম্। দেবতা, দেবগুরু এবং ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ বৃহস্পতির প্রবঞ্চনা অবশ্য শেষ পর্যন্ত টেকেনি, মহামতি প্রহ্লাদের মধ্যস্থতায় ব্যাপারটা মিটে যায়; কিন্তু অসুরদের প্রতারণা করে দেবগুরু যে আপনার কৌশলে মুগ্ধ হয়েছিলেন–কৃতার্থঃ স তদা হৃষ্টঃ–এই ছলনা বিভিন্নভাবে ঢুকে পড়েছে পৌরাণিক ব্রাহ্মণ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সে ছলনাও যদি বৃহস্পতির মতো সোজাসুজি হত, তা হলেও আমাদের বলার কিছু ছিল না, কিন্তু ব্রাহ্মণ সমাজের নিজের ওপর আস্থা যত কমেছে, ত্যাগের আসন থেকে ব্রাহ্মণ যখনই নামতে আরম্ভ করেছে, এই কৌশলে ছলনা বেড়েছে তত বেশি। এতে ব্রাহ্মণ সমাজের স্বার্থকল্যাণ যতই হোক, নিম্নবর্ণের ওপর, সাধারণ স্ত্রীলোকের ওপর নিপীড়ন বেড়ে গেছে। আর এই ছলনার কৌশল বড় অদ্ভুত। অশিক্ষিত জনসাধারণকে শুধু পরলোকের ভয় দেখিয়ে, শাস্ত্রের নামে অদ্ভুত অদ্ভুত নিয়ম করে এমন কতকগুলো ব্রত-উপবাস লোকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা ভাবলে ভয় করে।
হ্যাঁ কতকগুলি জায়গায় ভয় দেখানোর অর্থ আছে, সেটা আমরা বুঝি, কারণ তাতে সমাজের কল্যাণ নিহিত আছে। কিন্তু কতকগুলি ভয় দেখানোর ফল হয়েছে শুধুই নিপীড়ন। কথাটা একটু বুঝিয়ে বলি। বলেছি না, শাস্ত্রকারেরা জানতেন সবই। তবে কি না তাদের কতকগুলি উপদেশ আমরা কলিযুগের লোকেরা উলটো বুঝি। যেমন ধরুন পুরাণকারেরা খুব ঘটা করে বললেন–ব্রাহ্মণ! তুমি যেন খবরদার সুরা পান কোরো না। আমরা বুঝব–তা হলে নিশ্চয়ই ব্রাহ্মণ সময়ে অসময়ে সুরাপান করতেন, তার ফলেই না এত বারণ। আর কী আশ্চর্য, কোনোদিন যাঁরা বেশ্যা গমন করেনি, বেশ্যার নাম শুনলে যাদের কুম্ভীপাক নরকে ডোবার কথা তারা বেশ্যা কয় প্রকার এটা খুব ভালো জানেন। দেবীভাগবত পুরাণের বেশ্যা প্রসঙ্গে বাঙালের গালাগালি ‘পুঙ্গীর ভাই’ কিংবা পুঙ্গীর পুত’-এর রহস্য পর্যন্ত জানানো হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি ‘পুঙ্গী’ কথাটা ছোটোবেলায় অনেক শুনেছি, কিন্তু আমাদের যারা পাকানোর ভার নিয়েছিলেন তারা পর্যন্ত এই শব্দের সঠিক পাঠ দিতে অসমর্থ হয়েছিলেন। শেষে দেবীভাগবত পুরাণে দেখি–এক স্বামীতেই যার সন্তুষ্টি সে নাকি পতিব্রতা, কিন্তু একটি মাত্র উপপতিতেই স্ত্রী কুলটা। স্বামী ছাড়াও যদি আর দুটি গভীর শরীরী প্রণয় থাকে তবে সেই স্ত্রী ধর্ষিণী’। পুরাণকার ভেবেছেন–তিনটি পুরুষের সঙ্গে যে ক্রমান্বয়ে চালাতে পারে সে রমণীর মধ্যে ধর্ষণ ক্ষমতা আছে। চারজন পুরুষকে যে সঙ্গ দিতে পারে, সে রমণীর সম্বন্ধে পুরাকালের ধারণা–সে পুরুষ দেখলেই ছোঁক ছোঁক করবে অর্থাৎ সে পুংশ্চলী। পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ পুরুষ বরণ করার পর তার উপাধি জুটবে বেশ্যা আর সাত-আট জন হয়ে গেলেই পুঙ্গী–বেশ্যা চ পঞ্চমে ষষ্ঠে পুঙ্গী চ সপ্তমে’ষ্টমে। আর যার কোনো বাছ-বিচার নেই, সবই জলভাত–তিনি মহাবেশ্যা।
বিভিন্ন কলাবিলাসে রমণীর বিভিন্ন পদবি না হয় বোঝা গেল, কিন্তু যে পুরুষ-প্রবরেরা এদের প্রতি আসক্ত হবেন, তাদের কিন্তু সংজ্ঞা নেই কোন। তবে হ্যাঁ পরলোকে তাদের একটা ব্যবস্থা হয়েছে। অর্থাৎ আপনি যদি সকালে উঠে তিত্তিরি পক্ষী দেখেন তাহলে বুঝবেন, এটি পূর্বজন্মের এক ব্রাহ্মণ যিনি স্বামীর অতিরিক্ত সেই উপপতি, কুলটাগমনের ফলে যে আজ তিত্তিরি হয়ে জন্মেছে। দ্বিতীয়ত পুরাণবচন যদি সত্যি হয় তাহলে সমস্ত ভারতবর্ষের যত কাক আছে, এই সমস্ত কাকই ছিল কোনো জন্মের ধর্ষিণী-গামী ব্রাহ্মণ। এর মধ্যে পুংশ্চলীগামীদের ‘পোজিসনটা একটু ভালো, কেননা পুংশ্চলীগামীরা পরজন্ম সত্য হলে কুহুকণ্ঠী কোকিল হয়ে জন্মাবেন অর্থাৎ পুংস্কোকিল। বেশ্যাগামী হলে পরজন্মে নেকড়ে, আর পুঙ্গীর ছোঁয়া পেলে পরজন্মে সে ব্রাহ্মণ শুয়োর হয়ে জন্মাবে, তাও একজন্ম নয়, সাত জন্ম–পুঙ্গীগামী শূকরশ্চ সপ্তজন্মনি ভারতে। এই নিরিখে উলটোদিক দিয়ে দেখতে গেলে ভারতবর্ষের সমস্ত শুয়োরেরা পূর্ব পূর্ব ব্রাহ্মণ-জন্মে কী পরিমাণ পুঙ্গীগমন করতেন ভাবলে শিহরিত হতে হয়।
ব্রাহ্মণেরা ভয় পাবেন না। আমরা জানি ব্রাহ্মণেরা যাতে বেশ্যা কিংবা পুঙ্গীর ব্যাপারে সাবধান থাকেন,সেই জন্যেই এই সাবধানবাণী, সেই জন্যেই পরজন্মে কাক, কোকিল কিংবা শুয়োর হবার ভয় দেখানো। বিশেষত ভারতবর্ষের যত তিত্তিরি, কাক-কোকিল, নেকড়ে এবং শুয়োর আছে, তারা কোনো কোনো সময়ে অবশ্যই নিজপত্নী ছাড়াও অন্য দুষ্টা স্ত্রীতে উপগত হয়ে থাকবেন। কাজেই আমরা ব্রাহ্মণ সমাজের গৌরবের স্বার্থে এই কদাচার এবং কদাকার পশু-পক্ষিচক্রে বিশ্বাস করি না, বা করতে চাই না। কিন্তু এই বিশ্বাস না করার একটা বিপদ আছে এবং সে বিপদ যদি আপনি গণনার মধ্যে না আনেন তাহলে আবার ব্রাহ্মণ সমাজের দিক থেকে মিথ্যা বিধান দেবার প্রসঙ্গ আসে–এবং সেটাও পরলোক বিষয়েই। পুরাণকথিত পরলোকের একটি পরিণতি আপনি উড়িয়ে দেবেন, এবং আরেকটি পরিণতিতে আপনি পরম বিশ্বাসী হবেন–এই দ্বিচারিণী মনোবৃত্তি সদাচার বিরোধী। বিপদটা কোথায় বলি।
বরাহ পুরাণে নিমির ছেলে মারা গেছেন। এই নিমি কিন্তু ইক্ষাকুর ছেলে নিমি নয়। ইনি ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ এবং এঁর যে ছেলেটি মারা গেছে তারও বয়স হয়েছিল। কিন্তু বয়সের যুক্তিতে যেহেতু কোনো মৃত্যুশোকই লঘু করা যায় না, তাই নিমি পুত্রশোকে অধীর হয়ে ঠিক করলেন–ছেলে যা কিছু খেতে ভালোবাসত সব জোগাড় করে সাতজন ব্রাহ্মণকে খাওয়াব। মাটিতে কুশ বিছিয়ে তার ওপরে পিণ্ড দেব, জল দেব। নিমি, পুত্রশোকে বিহ্বল নিমি যা যা ভেবেছিলেন, সব করলেন। কিন্তু এত সব ক্রিয়াকর্ম করবার পর যখন তার শোকের বেগ কিছুকমল, তখন তিনি ভাবলেন–আমি এ কি করলাম, আজ পর্যন্ত কেউ তো এমন করেনি! এই পিণ্ডদান জলদান, ছেলে খাচ্ছে বলে ব্রাহ্মণ খাওয়ানো–এ তো কেউ করেনি। শোকের বশেই আমি অনার্যোচিত কাজ করেছি–শোকস্য তু প্রভাবেন এতৎ কর্ম ময়া কৃতম্। দেবতা, ব্রাহ্মণ, ঋষিকেউ তো আগে আমার মতো শ্রাদ্ধকৰ্ম করেননি, এমনকী জীবনে শুনিওনি এমন কাজের কথা, যা আমি করেছি–ন চ তং ময়া পূর্বং ন দেবৈ ঋষিভিঃ কৃতম্। নিমি ভাবলেন, শোকে আমার বুদ্ধিশুদ্ধি সব গেছে, এখন যা করেছি এর ফলে হয়তো মুনিরা আমাকে অভিশাপই দেবেন। দেবেন হয়তো ভস্ম করে।
নিমি এত সব ভাবছেন এর মধ্যে সেখানে উপস্থিত হলেন সমস্ত কর্মে মুশকিল আসান নারদ মুনি। কিন্তু পাঠক! আপনি অবহিত থাকবেন। শ্রাদ্ধ বলে কোনো কিছু অতি প্রাচীন কালে ছিল না, থাকলেও এখনকার আকারে ছিল না। কিন্তু নিমি পুত্রশোকে একটা ব্যাপার, ক্রিয়াকাণ্ড করে ফেলেছেন। ক্রিয়াকাণ্ডের ধুমধামে, জোগাড়যন্ত্রে এবং সবার ওপর পাঁচ-সাত জন যাঁরা খেতে আসছেন, তাঁদের কাছে মন হালকা করার ফলে শোকাতুর হৃদয়ের শোক যেমন কমেছে, তেমনি অভ্যাগতদের মাধ্যমে প্রয়াত ব্যক্তির সুখ কল্পনার ফলে তদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যও উপরি পাওনা হিসাবে দেখা দিল। কাজেই এই শ্রাদ্ধের ব্যাপারটায় দুপক্ষেরই–একপক্ষের মানসিক, অন্যপক্ষের ব্যবহারিক সুবিধা দেখা দেওয়ায় এই প্রথার একটা স্যাংশন’ প্রয়োজন ছিল। পাঠক! আমরা আপনাকে সেই কারণেই অবহিত হতে বলছি। নারদ এলেন এবং নিমি তার শোকের কথা এবং শোকের ফলে যা যা তিনি করে ফেলেছেন, তাও বললেন। সব কথা শুনে নারদ বললেন–তোমার ক্রিয়াকলাপগুলো নতুন ধরনের বটে, তবে সেটা যে অধর্ম, তা আমার মনে হচ্ছে না।
তবু নারদ এ ব্যাপারে নিজে সম্পূর্ণ মত না দিয়ে নিমিকে বললেন তার স্বর্গত পিতাকে স্মরণ করতে। একথা তো সত্যি যে, পারলৌকিক ব্যাপারে স্বর্গত পিতৃপুরুষের কথার দাম বেশি। স্মরণমাত্রই পিতা উদয় হলেন এবং বললেন–বৎস নিমি তুমি যা করেছ, এটাকেই পিতৃযজ্ঞ বলে, স্বয়ং ব্রহ্মা এই ধর্ম নির্দেশ করছেন–পিতৃযজ্ঞেতি নির্দিষ্টো ধর্মো’য়ং ব্ৰহ্মণা স্বয়ম্। তাহলে নিমির হঠাৎ-করা শ্রাদ্ধ, নারদের সম্মতি, স্বয়ং পিতার উদয় এবং এবং সবার ওপর ব্রহ্মার নির্দেশ–সব কিছু মিলে শ্রাদ্ধ চালু হয়ে গেল।
শরীরটাকে জীর্ণ বসন বানিয়ে গীতার দার্শনিক আত্মাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে করে রেখেছেন। ফলে পৌরাণিকেরা অসুবিধেয় পড়লেন বইকি। যে যুগের রাজা মহারাজাদের ক্ষমতাও ছিল; যখন তখন মহা-মহর্ষিরা চলে আসতেন রাজাদের ঘরে। জীর্ণ শরীর ছেড়েও পিতৃপুরুষেরাও দেখা দিতেন পুত্রের চোখের সামনে; লোকপিতামহ ব্রহ্মার মতামতও যখন তখন পাওয়া যেত। কাজেই শ্রাদ্ধ চালু হয়ে গেল। আর শ্রাদ্ধ যখন চালুই হল, তখন পৃথিবীতে মৃতের জীর্ণ শরীর ভস্মীভূত হলেও পরলোকে তাঁর চলা-ফেরার সুবিধের জন্য কতকগুলি ব্যবস্থা আপনাকে রাখতেই হবে। কারণ সেখানে যাবার পথে কোথাও নাকি আগুনের বর্ষা হচ্ছে, কোথাও শিলাবৃষ্টি হচ্ছে, কোথাও বা গরম জলের ধারা নামছে অজানা গহ্বর থেকে–অগ্নিবর্ষং তপ্তং তত্র জাদ। কাজেই যারা বেঁচে রইলেন, পিতৃপুরুষের চলার কষ্ট লাঘব করার জন্য তারা একজোড়া জুতো এবং ছাতার ব্যবস্থা করবেন–কারণ যমের বাড়ির পথ চলতে প্রেত-পুরুষের পা যেন পুড়ে না যায়–পাদৌ চ ন দহ্যেত যমস্য বিষয়ং গতে। বৃষ্টি-বাদলা হলে স্বয়ং সূর্যদেবতাকে ছাতার আশ্রয়ে যমলোক পর্যন্ত নিয়ে যাবেন এবং নিবারণং ছত্রমাদিত্যেন কৃতং পুরা। এইভাবে মৃতের তরফের দানসামগ্রীতে খাট-পালঙ্ক, গোরু-ষাঁড়, বাসন-কোসন সব কিছুরই একটা ব্যবহারিক অর্থ খুঁজে পাওয়া যাবে, যা দান-গ্রহীতা ব্রাহ্মণের পক্ষেও উপযোগী। পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে আপনি যে দান করবেন, তার ফল কী? আপনি যদি ব্রাহ্মণদের শুধুমাত্র পেটভরে খাওয়ান, তাহলে আপনি স্বর্গত হলে সেখানে সোনার ‘এরোপ্লেন’ পাবেন। আর যদি ফুল সাজিয়ে একটি ফুল-শয্যা দিতে পারেন ব্রাহ্মণকে তাহলে এখানে আপনার নিজের বাড়ি না থাকলেও স্বর্গে গিয়ে নন্দনমুখী একখানি বাড়ি পাবেন আপনি। আর আপনিই যদি একখানা বাড়ি দেন উত্তম ব্রাহ্মণকে, তাহলে স্বর্গে গিয়ে এমন একখানি মণিরত্নখচিত বিমান পাবেন আপনি, যে বিমান চলবে আপনার মনের গতিতে। আর সে বিমানে আপনি সঙ্গ পাবেন দারুণ সব স্বৰ্গকামিনীদের এবং কখনও যদি বা তাদের গোলাপ জলের মৃদু-সেকে, মৃদু-গীতে ঘুমিয়েও পড়েন তাহলেও আপনার ঘুম ভাঙবে অবিবাহিতা কন্যা বা যুবতীদের মনোহর গানে-কন্যা যুবতয়ো মুখ্যাঃ সহিতাশ্চাঙ্গরোগণৈঃ। সুস্বরৈস্তে বিবুধ্যন্তে…। এক কথায় ভালো দান-করা শ্ৰাদ্ধর ফল মৎস্যপুরাণ বলেছে–দারুণ রতিশক্তি, সুন্দরী স্ত্রী, অপূর্ব খাওয়া-দাওয়া এবং খাওয়ার ক্ষমতা এবং আরও অনেক কিছু রতিশক্তিঃ স্ত্রিয়ঃ কান্তা ভোজ্যং ভোজনশক্তি।
মজার কথা হল এই যে, শ্রাদ্ধের ক্রিয়াকর্মে এত যে দানের পুণ্য বলা হল, তবু এই দান গ্রহণ করার জন্য সদ্ ব্রাহ্মণ পাওয়া যেত না। এর মধ্যে কোনো অসত্য নেই যে, সেকালে এমন ব্রাহ্মণ অনেক ছিলেন, যাঁরা শ্রাদ্ধ কেন, কোনো দানই নিত না। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও এমন ব্রাহ্মণ দেখেছি, যাঁরা ক্রিয়াকর্ম করাতেন ঠিকই, কিন্তু দান গ্রহণ করতেন না। অবশ্য দান গ্রহণ করার জন্য এঁদেরই ছায়ায় আরও একদল ব্রাহ্মণ তৈরি হয়েছিলেন, যাঁরা মূল যাজকের ক্রিয়াকর্ম গুছিয়ে দিতেন এবং শ্রাদ্ধের সতিল পিণ্ড খাওয়া থেকে আরম্ভ করে সমস্ত দান নিয়ে বাড়ি যাওয়া–এই ছিল তাদের কাজ। নির্ধন অথচ শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণসমাজে এই দান পাওয়া অগ্রদানী ব্রাহ্মণেরা ছিলেন হেয়। প্রধানত এদের কল্যাণেই পুরাণে দানের লিস্টি এবং ফরমাস বাড়তে থাকে, ফলশ্রুতির ছলনাও সেই সঙ্গেই বাড়তে থাকে। কিন্তু একে একে কেন দানের সামগ্রী শুধু বাড়তেই থাকে তার যে একটা অর্থনৈতিক কারণ ছিল সেটা বলেছে অগ্নিপুরাণ। প্রথম পর্যায়ে ব্রাহ্মণ কাজ করত না, পরের পর্যায়ে লোকে তাকে কাজ দিতে ভয় পেত। ফলে অগ্নিপুরাণকে লিখতে হয়েছে–ব্রাহ্মণ সবার কাছ থেকে দান নেবে–সর্বতঃ প্রতিগৃহীয়াৎ। কেননা ব্রাহ্মণের কোনো জীবিকা নেই, তাই ব্রাহ্মণের বড় কষ্ট–অবৃত্তাকর্ষিতা দ্বিজঃ। এই সহজ সরল স্বীকারোক্তির পর আর কথা চলে না। সত্যিই তো, জীবিকাহীন ব্রাহ্মণের চলবে কী করে?
আমাদের ধারণা, ব্রাহ্মণদের বাঁচাতেই বর্ণব্যবস্থা। তারা যত মাননীয়ই হোন না কেন,বর্ণব্যবস্থার মূল স্তম্ভ ছিলেন ক্ষত্রিয়রা। কেননা সমস্ত মানুষের সম্মানরক্ষা এবং কোনো মানুষের সীমা কতখানি সেটা বোঝানোর জন্যই নাকি ক্ষত্রিয়ের সৃষ্টি হয়েছিল–মর্যাদায়াঃ প্রতিষ্ঠার্থ। আসল কথা সভ্যতার কল্পে সবচেয়ে জরুরি ছিল শৃঙ্খলা–সেই জমির মালিকানার ব্যাপারেই হোক, কিংবা যে-কোনো অধিকার নিয়েই। এই শৃঙ্খলার সূত্রে কিন্তু সমস্ত জমির মালিকানা এসে গেল ক্ষত্রিয়ের হাতে। যাঁরা মনে করেন ব্রাহ্মণেরা সেই পুরাণ-পুরুষের মুখ থেকে, ক্ষত্রিয়েরা বাহু থেকে–সব স্বয়ম্ভর মতো জন্মালেন, তাঁরা জানবেন–বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা অতি প্রাচীনকালে চালুই ছিল না। নিছক শৃঙ্খলার প্রয়োজন বোধেই এই ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এবং কীভাবে হয়েছে তা বায়ুপুরাণ থেকে শোনা যেতে পারে। তবে তার আগে একটু অন্য কথা আছে।
আমরা এর আগে পুরাণ প্রমাণে বলেছি যে, মানুষ কেমন করে বনবৃক্ষের কাছে বাড়ি তৈরির একটা কায়দা শিখেছিল। যেটা বলিনি, সেটা হল–কিছুদিনের মধ্যে তারা বাড়িঘর তৈরির একটা মাপজোকের অঙ্ক তৈরি করে ফেলেছিল। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও যে আমরা হাতের পরিমাণে মাপজোক করতাম তার মূলটাও নাকি ত্রেতাযুগে। এতে বেশ বুঝি ত্রেতাযুগ কলিকাল থেকে খুব বেশি পিছিয়ে নয়।
তবে মাপজোকের সাধারণ মানটা কিন্তু হাতের থেকেও ছোটো, অর্থাৎ হাতের আঙুল দিয়েই প্রকাশ করা হত। শুধু গ্রাম নয়, নগর, এবং অন্তঃপুর পর্যন্ত তৈরি হত এই আঙুলের হিসেবেই–মিত্বা মিত্বাত্মনোঙ্গুলৈঃ। বায়ুপুরাণ বলেছে সমস্ত মানুষের মধ্যে যাঁরা ছিলেন বলবান, সত্যবাদী এবং জিতেন্দ্রিয় তারাই নাকি থাকতেন নগরে–নিবসন্তি স্ম তেষু বৈ। অর্থাৎ ক্ষত্রিয় রাজারাই ছিলেন নগরবাসী। আর যারা ক্ষমতায় ক্ষত্রিয়দের থেকে দুর্বল তারা ক্ষত্রিয়দেরই দান গ্রহণ করে বেঁচে থাকতেন–প্রতিগৃহ্নন্তি কুন্তি। এঁরাই ব্রাহ্মণ। আবার তাদের থেকেও দুর্বল শ্রেণির লোকেরা রাজাদের কাজকর্ম করে বেঁচে থাকতেন। অর্থাৎ বৈশ্যেরা, যাঁরা কৃষি, পশুপালন এবং ব্যবসার ওপর জীবন ধারণ করতেন। আর সবচেয়ে দুর্বলশ্রেণির লোকেদের বলা হত শূদ্র, যারা ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ এবং বৈশ্য–এই সব জাতেরই পরিচর্যা করে দিন কাটাত পরিচর্যাসু বৰ্ত্তন্তে তেভ্যশ্চান্যে’ল্পতেজসঃ। এঁরা দুর্বল এই জন্যে যে, এঁরা মাথার কাজ করতে পারতেন না একটুও, অল্পেই ভেঙে পড়তেন–শোচন্তশ্চ দ্রবন্তশ্চ–অতএব দৈহিকভাবে ত্রিবর্ণের সেবা করা ছাড়া আর কোনো গতি ছিল না তাদের। বায়ুপুরাণ পরিষ্কার বলেছে–ভালো কাজ আর মন্দ কাজের গুরুত্ব এবং লঘুত্ব দিয়েই পূর্বকল্পের জাতিবিভাগ-ভাবিতাঃ পূর্বজাতিষু কর্মভিশ্চ শুভাশুভৈঃ। ভগবদ্গীতায় ঠিক এই কথাটাই আরও সূক্ষ্ম করে বলা হয়েছে ভগবানের মুখে–আমি মানুষের গুণাগুণ আর কাজকর্মের নিরিখে চতুর্বর্ণের বিভাগ তৈরি করেছি।
বাস্তবিকপক্ষে গুণ এবং কর্মের রকমফেরেই যে জাতি বিভাগ–সে কোনোকালে নেই। এখনকার মন্ত্রী, আমলা, করণিক, ব্যবসাদার এবং গৃহসেবী মানুষগুলোর মধ্যে নতুন করে জাতিভেদ করলে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্রের মার্কা মারতে দেরি লাগবে না। বায়ুপুরাণ শূদ্রদের কথা বলতে গিয়ে একটা জব্বর বিশেষণ দিয়েছে, যে বিশেষণ আমরা প্রায় কোথাও আর পাই না। বায়ুপুরাণ বলেছে–ত্রেতাযুগে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য আর শূদ্রের বিভাগ করা হল বটে, কিন্তু শূদ্রেরা নাকি সব সময় তিন বর্ণের ওপর খেপে থাকত–শূদ্রা দ্রোহিজনাস্তথা। কথাটা সাংঘাতিক বাস্তব। ক্ষত্রিয় বলুন, কিংবা বৈশ্যই বলুন–এই তিন বর্ণেরই সত্তা এবং জীবিকা ছিল রাজনির্ভর। ফলে সমাজের সারবস্তুগুলি এঁদের ভাগেই পড়ত। কিন্তু কপালদোষে লেখাপড়া কিংবা কিছুই না শিখে যাদের শুধু পরের বাড়িতে খেটে মরতে হত–তারা যে উচ্চবর্ণের ওপর সব সময়েই চটে থাকবে, এতে আর আশ্চর্য কী! পরবর্তীকালে শাস্ত্রকারদের তাই বার বার বিধান দিতে হয়েছে যাতে শূদ্রেরা কখনোই উচ্চবর্ণের বিরোধিতা না করে। কেননা বিরোধিতা করলে তিন বর্ণেরই অসুবিধে, ঠিক যেমন বাড়িতে কাজের লোক না থাকলে অসুবিধে হয়। ব্রাহ্মণ্য যখন বংশগত হয়ে গেল তখন শূদ্রদের সেবাবৃত্তি ধর্মের সংজ্ঞা লাভ করল। অথচ পুরাকল্পে বর্ণবিভাগ ছিল পুরোটাই ব্যক্তিগত গুণ এবং কর্মদক্ষতার ওপর–কর্মভিশ্চ শুভাশুভৈঃ।
যাক, এই বর্ণবিভাগ হল নতুন নিয়ম। অরাজক জনপদে সবার জীবনবৃত্তির প্রথম সোপান। এই নিয়মে সমস্ত জমিগুলি চলে গেল ছোটো ছোটো রাজাদের হাতে, কারণ তারা সবচেয়ে বলবান–যে বৈপরিগ্রহীতারঃ… ইতরেষাংকৃতত্রাণাঃ। আর ব্রাহ্মণেরা। হ্যাঁ তারা সত্যবাদী, ব্রহ্মবাদী সব বটে, কিন্তু তাদের প্রথম বিশেষণ হল–তারা সব সময় রাজার বাড়ি ঘোরাফেরা করতেন–উপতিষ্ঠন্তি যে তান্ বৈ। বস্তুত পুরাণ-ইতিহাসের যুগে ব্রাহ্মণেরা বেশির ভাগই ছিলেন রাজাদের মন্ত্রী। আপনারা রামায়ণের দশরথের মন্ত্রিসভা থেকে আরম্ভ করে যে-কোনো বড়ো রাজার মন্ত্রিসভার সদস্যদের দিকে দৃকপাত করলেই টের পাবেন ব্রাহ্মণেরা কী পরিমাণে রাজকার্যে অংশ নিতেন। ফলে যে ব্রাহ্মণেরা মন্ত্রিসভায় নাও থাকতেন তারাও এই মন্ত্রণাদাতা ব্রাহ্মণমণ্ডলীর জাত হওয়ায় রাজার অনুগ্রহ পেতে তাঁদের দেরি হত না। চক্রবর্তী যদি চক্রবর্তীকে না দেখিবে–এই নিয়মে। পৌরাণিকেরা বৈশ্যের সংজ্ঞাটি দিয়েছেন ভারি চমৎকার। তারা বলেছেন–যারা নাকি ক্ষত্রিয়দের থেকে দুর্বল কিন্তু দারুণ দুষ্টবুদ্ধি আর যমের মতো যাদের ব্যবহার, যারা নাকি নিজের স্বার্থ সাধনের জন্য নিরলসভাবে সমস্ত প্রজাবর্গকে চুষে খেত–তারাই হল ব্যবসাদার বৈশ্য-বৈশ্যানেবতু তানাহুঃ কীনাশান্ বৃত্তসাধকান্। শূদ্রদের কথা আগেই বলেছি, কাজেই সাধারণের মধ্যে শৃঙ্খলা রক্ষায় নতুন বিধান কী হল সেইটে এবার বলি।
.
০২.
আজ থেকে একশো বছর আগে যখন ব্রাহ্মধর্মের রমরমা চলছে, তখন আমরা বলেছি–বেদ ব্রাহ্মণ সব গেল। পঞ্চদশ-ষোড়শ খ্রিস্টাব্দে যখন চৈতন্যদেব বৈষ্ণব-ধর্মের জোয়ার এনেছিলেন তখনও আমরা শ্লোক বেঁধে বলেছি-কলির প্রকোপভীষণ বেড়ে গেছে–বলী কলিপরাক্রমঃ।নিত্যানন্দের কীর্তনরসে বেদ-ব্রাহ্মণ সব গেল–বিগতবেদবাদো’ধুনা। আবার দেখুন দশম-একাদশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে প্রখ্যাত প্রাচীন নৈয়ায়িক উদয়নাচার্য লিখেছেন–ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থা এখন কামনা-বাসনা আর ক্রোধ-লোভের শত কাটায় ঝাঁঝরা হয়ে গেছে–কামক্রোধাদি-কণ্টকশতজৰ্জরঃ। সর্বত্রই আচার্য নৈয়ায়িক কেবলই স্থলন দেখতে পাচ্ছেন–ইতস্ততঃ স্থলগ্নিব উপলভ্যতে। অর্থাৎ তিনিও বলছেন–বেদ-ব্রাহ্মণ সব গেল। আমরা তিন যুগের সন্ধিতে এই যে গেল গেল রব শুনলাম, এই রব পুরাণগুলির মধ্যে বহুবার শোনা গেছে। যে দ্বাপরযুগের শেষ অংশে পুরুষোত্তম কৃষ্ণ জন্মেছিলেন বলে, লোকে বলে সেই দ্বাপর যুগের আদিতেই নাকি সব গেল গেল’ হয়েছিল। বেদ এক ছিল, তাকে চার ভাগ করতে হয়েছে দ্বাপর যুগে, কেননা ব্রাহ্মণেরা আর বেদ ধরে রাখতে পারছিলেন না। বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা দ্বাপর যুগে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে দ্বাপরেষু প্রবর্তন্তে ভিন্নবৃত্তাশ্ৰমা দ্বিজাঃ। ধর্ম হয়ে পড়েছে ব্যাকুল তার ওপর বেদের ওপর এত ব্যাখ্যা, এত টীকা-টিপ্পনী চালু হয়ে গেছে যে, মানুষ ধর্ম বলে কোনটা মানবে, তা ভেবেই পাচ্ছে নামতিভেদাস্তথা নৃণা। ভেদ, প্রভেদ, আর বিকল্পে মানুষ দ্বাপরেই জর্জর। ফলে বর্ণাশ্রম ধ্বংস হয়ে গেছে–বর্ণাশ্রমপরিধ্বংসাঃ। কামনা, লোভ, অধৈর্য, যুদ্ধ এবং ধর্মের মধ্যে পর্যন্ত সংকর এসে গেছে। আমাদের বক্তব্য দ্বাপর যুগের অবস্থাই যখন এই রকম, তখন আর কলিযুগে বেশি কী হবে। ঋষিরা কলিযুগে ঘটবে বলে যে ভয়াবহ বর্ণনা করেছেন তাতে আমরা বেশ বুঝি কলিযুগই পৌরাণিকদের আপন যুগ কারণ দ্বাপরের যুগধর্মের সঙ্গে তার পার্থক্য বেশি কিছু নেই। আমরা এবার সেই পথে এগোব।
পুরাণকারদের দ্বাপর যুগ বর্ণনায় একটা মোক্ষম কথা বেরিয়ে এসেছে। তারা বলেছেন–দ্বাপরযুগে সমস্ত মানুষের মধ্যে শ্রমজীবীর সংখ্যা বেড়ে যায়–দ্বাপরে সর্বভূতানাং কায়ক্লেশপুরস্কৃতা। জীবিকা নির্বাহের জন্য এখন সবাইকেই হয় শরীরের, নয়, মনের, নয়তো বাক্যের ক্লেশ সহ্য করতে হয়। বস্তুত ব্রাহ্মণেরা পূর্বযুগে যেমন যজন-যাজন অধ্যয়নে দিন কাটাতে পেরেছিলেন, এখন আর তা পারছেন না। ক্ষত্রিয়েরাও যে বিনা ক্লেশে শুধুমাত্র রাজধর্মের মাহাত্মে রাজ্যশাসন করে আসছিলেন সেটাও আর তত সহজে সম্ভবপর হচ্ছিল না। সমাজের ওপরে উঠে আসছিল খেটে-খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ–যারা শূদ্র বলে পরিচিত। পৌরাণিকদের কাল্পনিক ক্ষত্রিয় পুরুষেরাই একমাত্র রাজা হবার অধিকারী। কিন্তু বাস্তবে কি তাই হয় নাকি। যে ক্ষমতাশালী সেই রাজা হয়। শূদ্রেরাও রাজা হচ্ছিলেন, অন্তত যখন পুরাণ সংহিতাগুলি রচিত হচ্ছিল তখন তো অবশ্য শূদ্রেরা রাজা ছিলেন। ফলে ভবিষ্যৎকলিযুগের কথায় বার বার পৌরাণিকেরা বলেছেন–কলিকালে শূদ্র রাজাই দেখা যাবে বেশি–রাজানঃ শূদ্রাভূয়িষ্ঠাঃ। আর এটা তো খুব স্বাভাবিক যে, শূদ্র যদি রাজা হন, তাহলে জাতি হিসেবে এতকাল যাঁরা ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের পদসেবা করে এসেছেন, তাঁরা রাজা হবার পর ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়কে ভালো চোখে দেখবেন না। তাছাড়া ব্রাহ্মণেরা পূর্বে যেরকম বিনা ক্লেশে ক্ষত্রিয় রাজার ভাত-কাপড় পেয়ে মুকুলিত নেত্রে। বেদমন্ত্র উচ্চারণ করায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, শূদ্র রাজা হলে তাঁদের যে পুরাণোক্ত কায়দায় শারীরিক, মানসিক কষ্ট উপস্থিত হবে এবং নিজেদের প্রতিষ্ঠার জন্য যে বাঁচিক ক্লেশও বেড়ে যাবে অর্থাৎ কথাও যে বেশি খরচা করতে হবে, তাতে আশ্চর্য কী! পুরাণকারকে তাই বলতে হয়েছে–মনসা কর্মর্ণা বাঁচা কৃচ্ছ্বাদ বার্তা প্রসিধ্যতি–কষ্ট করে জীবিকানির্বাহ করতে হবে এবং তা সব বর্ণকেই।
ধর্মীয় এবং সামাজিক দিক দিয়ে দেখতে গেলে দেখা যাবে পুরাণকারদের যুগেই তো শৈব, বৈষ্ণব, শাক্ত, পাশুপত, কাঁপালিক–এই সব নানান ধর্মতন্ত্র তৈরি হয়ে গেছে। এর ওপরে আছে বৌদ্ধ এবং জৈনধর্মের জয়জয়কার। বৌদ্ধ রাজা অশোক পর্যন্ত যেতে হবে না, শূদ্র রাজা মহাপদ্ম নন্দই যথেষ্ট। মহামতি আলেকজান্ডার পর্যন্ত যে রাজাকে সমীহ করেছেন, সেই রাজা যদি শূদ্র হন তাহলে পুরাণকারকে লিখতেই হবে–কলিকালে বোকা-পাঁঠারাও আসনে বসা বামুন দেখলে মস্করা করে–আসনস্থা দ্বিজান্ দৃষ্টা চালয়ন্তি অল্পবুদ্ধয়ঃ। বামুন এতকাল ক্ষত্রিয়রাজার ছত্রছায়ায় বসে শূদ্রদের গালাগালি দিয়েছেন। এখন শূদ্রদেরই কেউ রাজা হলে তাদের দাস-দাসীরা যে বামুনদের চেটে তুলবেনা সেটা বুঝতে পেরেই পৌরাণিকেরা লিখেছেন রাজকর্মচারী শূদ্রেরা–(মনে রাখবেন এই শূদ্রদের পেছনে রাজার অভয় আছে)–ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠকেও তাড়না করতে ছাড়ে না–তাড়য়ন্তি দ্বিজেন্দ্রাংশ্চ শূদ্রা রাজোপজীবিনঃ। আর ব্রাহ্মণেরা কী করেন? কুর্মপুরাণ বলেছে–আসলে যে ব্রাহ্মণেরা বেশি পড়াশুনো করেনি, যাদের ধনসম্পত্তির ভাগ্যও ভালো নয়, শক্তিও কম–তারা ফুল-বেলপাতা আর মাঙ্গলিক দ্রব্যের পসরা সাজিয়ে শূদ্রদের অর্থাৎ শূদ্র রাজার পরিচর্যা করে–শূদ্রান্ পরিচরন্তি অল্পতভাগ্যবলান্বিতাঃ।
ভারতবর্ষের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত ব্রাহ্মণেরা চিরকালই সমস্ত বিচ্যুতির জন্য দায়ী হয়েছেন। এই যে বলা হয় ব্রাহ্মণেরা কলিতে শূদ্ৰান্নভোজী হবে, শূদ্রের যজন করবে–এসব কেন বলা হয়? বড় মানুষ ব্রাহ্মণদের যেখানে রাজভোেগ জুটত, সেখানে নিম্নবিত্ত ব্রাহ্মণদের অন্নচিন্তায় শাস্ত্রবিরুদ্ধ আচরণ করতেই হত। কিন্তু অনেক নিপীড়িত হবার পর যদি শূদ্র বসেন রাজাসনে তাহলে তারা পূর্ব ব্যবহারের প্রতিক্রিয়ায় ব্রাহ্মণদের সঙ্গে কী ব্যবহার করবেন? এই ব্যবহারের চিত্র ধরা পড়েছে। পুরাণের কলি বর্ণনায়। পুরাণ বলেছে-ফুল-বেলপাতা দিয়ে যতই তেল দেওয়া হোক না কেন শূদ্রেরা তবুও ব্রাহ্মণদের দিকে ফিরেও তাকাবেন নান প্রেক্ষন্তে অর্চিতাশ্চাপি শূদ্রা দ্বিজবরান্ নৃপ। ব্রাহ্মণেরা তবু দাঁড়িয়ে থাকবেন শূদ্ররাজার রাজমহলের দরজায়–যদি রাজার কৃপাদৃষ্টি হয়–সেবাবসরমালোক্য দ্বারে তিষ্ঠন্তি চ দ্বিজাঃ। সত্যি কথা বলতে কী শূদ্রের এই ব্যবহারকে ভাবী কলির ব্যবহার বলে ভুল করার কোনো কারণই নেই। এটা মনে রাখতে হবে শূদ্র রাজারা অনেকেই রাজা হয়ে ব্রাহ্মণ্য কায়দায় বৈদিক যাগযজ্ঞ করে নিজেদের উচ্চতা প্রমাণ করছিলেন। ভাগবত পুরাণে দেখা যাবে অন্ধরাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জাতিতে শূদ্র। তিনি কান্থ সুশর্মাকে হত্যা করে রাজা হয়েছিলেন–তভৃত্যো বৃষলো বলী। গাং ভোক্ষত্যক্কজাতীয়ঃ…। আবার শিলালিপির প্রমাণে দেখতে পাচ্ছি অন্ধ রাজারা অশ্বমেধ, গবাময়নের মতো বিশাল বৈদিক যজ্ঞ বিনা বাধায় সম্পন্ন করেছেন। যবন রাজা ডেমিট্রিয়াস, যাঁর সংস্কৃত নাম ত্রিমিত্র, তিনি পর্যন্ত এক যজ্ঞশালার উদ্বোধন করেছিলেন, তার প্রমাণ দিয়েছেন স্বয়ং ভাণ্ডারকর। বেশ বোঝা যাচ্ছে পুরাণকার ব্রাহ্মণদের মতে যাঁরা শূদ্র, যবন, ম্লেচ্ছ, তারাই তাদের সময় রাজ্যাধিকার পাওয়ায় পুরাণকারেরা কলিযুগের বর্ণনায় ঢালাও বলে দিয়েছেন যে কলিকালে পতিত ব্রাহ্মণ, আভীর শূদ্র, ম্লেচ্ছ, ব্রাত্য, শক, কৈবর্ত, পুলিন্দ–এই সব নিম্নবর্ণের রাজারাই রাজ্যশাসন করবে।
আমি রাজা-রাজড়া আর ব্রাহ্মণদের বিপর্যয় নিয়ে আর সময় কাটাব না। কারণ ইতিহাসে এই বিপর্যয় ঘটে আবার বিপর্যয় কেটেও যায়। ফলে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের প্রভাব শেষ হলে যেমন শূদ্রের বাড়বাড়ন্ত হয়, তেমনি তারাও চলে যায়, আবার চাড়া দিয়ে ওঠে বেদ-ব্রাহ্মণ্যের জয়ঘোষ। ভারতের ইতিহাসে এই চক্র বারবার চলেছে কিন্তু সমাজ চলেছে তার আপন নিয়মে। পৌরাণিক বলেছেন–কলিযুগে বর্ণাশ্রমের বারোটা বেজে যাবে আর বর্ণসংকর ঘটবে ভূরিভূরি–বর্ণাশ্রম-পরিভ্রষ্টাঃ সংকরং ঘোরমাস্থিতাঃ। কিন্তু আমরা বলি-বর্ণসংকর কলিযুগের কোনো নতুন সৃষ্টি নয়। উঁচু জাতের সঙ্গে নিচু জাতের বিয়ে অথবা নিচু জাতের সঙ্গে উঁচু জাতের বিয়ে–এ তো বর্ণাশ্রম চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চলছে। মজা হল, বামুন আর ক্ষত্রিয়েরা যে নিজেদের মধ্যে বিয়ে-থার ব্যাপারে তলায় তলায় রফা করে নিয়েছিলেন, তার জোরালো প্রমাণ আছে। ক্ষত্রিয় রাজা যযাতি যখন দেবযানীকে বামুনের মেয়ে বলে বিয়ে করতে ভয় পেলেন, তখন দেবযানী লজ্জার মাথা খেয়ে বলেছিলেন–বামুনের সঙ্গে ক্ষত্রিয়ের, ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে বামুনের কত বিয়ে হয়েছে। বামুন-ক্ষত্রিয়ের বর্ণসংকর সমাজে বেশ চলে–সংসৃষ্টং ব্ৰহ্মণা ক্ষত্রং ক্ষত্রেণ ব্ৰহ্ম সংহিত। দেবযানী বললেন–কত উচ্ছিন্ন ক্ষত্রিয়বংশ ব্রাহ্মণদের সরসতায় সজীব হয়ে উঠেছে। এ কথার অর্থ পরিষ্কার। নিয়োগ প্রথায় ব্রাহ্মণের ছিল একচ্ছত্র অধিকার। ক্ষত্রিয়ের বাড়িতে ছেলেপুলে না হলেই ব্রাহ্মণদের ডাক পড়ত এবং তারা বাড়িতে একবার এলে ক্ষত্রিয় রানি থেকে বাড়ির ঝি সবাই শুদ্ধ নিয়মমতে আপন আপন গর্ভাধান করিয়ে নিতেন। শূদ্রা রমণীর গর্ভে ব্রাহ্মণ কিংবা ক্ষত্রিয়ের পুত্র জন্মালে তাদের যে সমাজে কোনো খারাপ অবস্থা হত তাও নয়।বিদুর, যুযুৎসু কিংবা দীর্ঘতমার ছেলে কাক্ষীবান–এঁদের জীবনযাত্রায় কোনো অসুবিধে হয়নি পৌরাণিক সমাজে। তবে আসল কথা হল–সমস্ত বর্ণের রমণীর ওপর ব্রাহ্মণের অনুলোম অধিকার থাকায় ব্রাহ্মণদের যে কী চরম অবস্থা হয়েছিল, সেটা একটা উদাহরণ দিয়ে নিবেদন করি।
পদ্মপুরাণের সৃষ্টিখণ্ডে ব্রহ্মা একবার ভগবান মহাদেবকে বললেন–প্রভু আমি বর্ণাশ্রম সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছি, এবারে একটু বেশ্যাদের আচার-বিচার সম্বন্ধে শুনতে চাই–পণ্যস্ত্রীনাং সমাচারং শ্রোতুমিচ্ছামি তত্ত্বতঃ।মহাদেব প্রথমে ব্রহ্মকে একটুকৃষ্ণকথা শুনিয়ে নিয়ে বললেন–সেই যে দ্বারকাপুরীতে কৃষ্ণের ষোলো হাজার রমণী ছিল, মনে আছে তো! একদা বসন্তকালে তাদের সঙ্গে কৃষ্ণের বিহার চলছে। এমন সময় কৃষ্ণেরই ছেলে শাম্ব এসে দাঁড়ালে, সেই সব রমণীদের যে একটু ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল, তাও নিশ্চয়ই তোমার জানা আছে। কৃষ্ণের শাপে পরবর্তীকালে দস্যুরা কৃষ্ণপত্নীদের হরণ করে এবং অর্জুনও তাদের রক্ষা করতে পারেননি। দস্যুরা যখন কৃষ্ণ-রমণীদের জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে ভোগ করতে লাগল তখন তাদের কাছে দালভ্য ঋষি এসে উপস্থিত হলেন। কৃষ্ণ-পত্নীরা দালভ্যকে বললেন–মুনিবর! আমরা পূর্বে ভগবানের সঙ্গ পেয়েও এখন বেশ্যা বনে গেলাম কেমন করে–কস্মাদীশেন সংযোগং প্রাপ্য বেশ্যাত্বমাগতাঃ। যাই হোক, আপনি এখন বলুন বেশ্যারাই বা কি ধর্ম পালন করতে পারে? ঋষি তাদের বেশ্যা হবার কারণ দেখিয়ে একটি ব্রত করতে বললেন যার নাম বেশ্যাব্রত। মৎস্যপুরাণে এটি অনঙ্গব্রত। বেশ্যাব্রতের নিয়ম হল–যে রবিবারের সঙ্গে হস্তা, পুষ্যা বা পুনর্বসু নক্ষত্রের। যোগ হবে, সেই রবিবারে স্নানটান করে বেশ্যারা প্রথমে ভগবান শ্রীহরির পূজা করবে। হরি-পূজার শেষে একজন ধর্মজ্ঞ এবং বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ডেকে আনতে হবে। এই ব্রাহ্মণ কিন্তু বিকলাঙ্গ হলে চলবে না। যা হোক, এই বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে ঘি-পাকানো শালিধানের ভাত খাইয়ে বেশ্যারা এবার তাঁকে রতিক্রিয়ায় আমন্ত্রণ করবে। কিন্তু হা রতিক্রীড়ার সময় সেই বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে একেবারে কামদেব বলে ভেবে নিতে হবে। কেননা ওই বিশেষ রবিবারে ভগবান শ্রীহরির ওপর কামদেবের আবেশ হয়। অতএব যে ব্রাহ্মণের সঙ্গে রতিক্রীড়া করা হচ্ছে তাকেই ভাবতে হবে ইনি স্বয়ং কামদেব–রত্যর্থং কামদেবোয়মিতি চিত্তে চ ধারয়েৎ। এইজন্যেই বুঝি ব্রাহ্মণটি বিকলাঙ্গ হলে চলে না। রতিক্রীড়ার সময় ব্রাহ্মণ যা ইচ্ছে করবেন, বিলাসিনী বেশ্যা তার সঙ্গে সেই ব্যবহারই করবেন–য য ইচ্ছতি বিপ্ৰেন্দ্ৰ স্তৎ তৎ কুৰ্য্যা বিলাসিনী। তিনি যেভাবে চান, মুচকি হেসে আধোভাবে, বেশ্যা সেইভাবেই সেই ব্রাহ্মণের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন–সর্বভাবেন চাত্মানম্ অর্পয়েৎ স্মিতভাষিণী। এরপর আর কি, প্রচুর দান-ধ্যান করে বেশ্যাব্রতের সমাপ্তি। অবশ্য হ্যাঁ, দানের মন্ত্র কিন্তু–আমি যেমন কাম আর কেশবের তফাত করি না, তেমনি হে বিপ্র! আমারও সর্বকাম সিদ্ধি হোক। ব্রাহ্মণ তথাস্তু বলে উপনিষদের মন্ত্রে শান্তিবাক্যে বলবেন–কামই দিল, কামই নিল। কামই দাতা, কামই প্রতিগ্রহীতা। ভাবটা এই–আমি কে? কামদেবই সব। আমার মধ্যে দিয়ে কামদেব রতি করলেন, বেশ্যার মধ্যে থেকে কামদেবই রতি গ্রহণ করলেন। এরপর ব্রাহ্মণ জিনিসপত্র বেঁধে বিদায় নেবেন। কিন্তু এই ব্রতের বেশ্যার কাজ এবং কর্তব্য হবে এই যে–ওই রবিবারের পর থেকে যে-কোনো রবিবারে যদি অন্য কোনো ব্রাহ্মণ ওই বেশ্যাবাড়িতে রতিক্রীড়ার জন্য আসেন–ততঃ প্রভৃতি যো’ নোপি রত্যর্থং গেহমাগতঃ–তাকেও একইভাবে বেশ্যা রতিদান করবে। এইভাবে তেরো মাস পর্যন্ত যদি উত্তম ব্রাহ্মণদের রতি-রহস্যে সন্তুষ্ট করা যায় তাহলে সেই সেই ব্রাহ্মণদের অনুজ্ঞা লাভ করে অন্যান্য রূপবান মানুষেরাও এরপর সেই বেশ্যার ঘরে আসতে থাকবে–তদনুজ্ঞানুরূপন্তু যাবদন্যাগমো ভবেৎ।
ব্যাপারটা যা দাঁড়াল তাতে এই বেশ্যাব্রতের অর্থ একটাই হতে পারে। এককালে কৃষ্ণের সঙ্গ-পাওয়া এইসব বেশ্যা রমণীরা এই বেশ্যাব্রত কতটা পালন করেছিলেন, পদ্মপুরাণ তা বলেনি। তবে বেশ্যাব্রতের নিয়ম-কানুন শুনে মনে হয়, বেশ্যারা যে তাদের রূপের উপজীবিকা আরম্ভ করবে, তাও এক ব্রাহ্মণকে দিয়ে বউনি করে। আর তেরো মাসের ব্যাপারটাও কিছু নয়। তেরো মাসে চার তেরং বাহান্নটা রবিবার বাহান্ন জন ব্রাহ্মণকে দেহদান করার পর সেই প্রসাদী দেহ অন্যের ভোগে লাগবে। অর্থাৎ পয়সা রোজগার করার জন্য একটি বেশ্যাকে পুরো এক বছর ব্রাহ্মণের কাছে দেহ খাটাতে হবে, তারপর তাদের আদেশ হলে অন্য পুরুষের সমাগম ঘটবে বেশ্যার বাড়িতে।
বলতে পারেন–উদাহরণটা আমি বড় কড়া দিয়ে ফেলেছি। দিয়েছি এইজন্যে যে সমাজের ব্রাহ্মণেরা আস্তে আস্তে এই পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন। যে উদাহরণ আমরা দিয়েছি, সেটি পদ্মপুরাণের বলেই নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে প্রাচীন পুরাণগুলির মূল পর্বে এত ব্রত, নিয়ম ছিল না। আস্তে আস্তে পুরাণকথার মধ্যে ধর্মশাস্ত্র এবং স্মৃতির প্রক্রিয়াগুলি ঢুকে যাওয়ায় পুরাণের মধ্যে বেদোক্ত যজ্ঞকর্ম এবং উপনিষদের ব্রহ্মভাবনা কমতে থাকে। সহজে এবং সস্তায় বেশি পুণ্যপুষ্টির জন্য জনসাধারণ তখন সাধারণ ব্রত, নিয়ম পালনের বড়াই করতে থাকে এবং ব্রাহ্মণেরা ব্রাহ্মণভোজন এবং দানসামগ্রীর লোভে এইসব ব্রত-পার্বণের মাহাত্ম ঘোষণা করতে থাকেন। যার ফলে বেশ্যাবাড়ির নথভাঙার অনুষ্ঠানও ব্রাহ্মণকে দিয়ে প্রথমে করাতে হয়। আমরা সম্পূর্ণ অবহিত আছি যে, ব্রাহ্মণেরাই এককালে তাদের ত্যাগ এবং শৌচাচারের নিরিখে সমাজের মূর্ধন্যভূমিতে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। আমরা অবহিত আছি ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক ছিলেন ব্রাহ্মণেরা। আমরা এও জানি ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়েরা না থাকলে ভারতের দার্শনিক, মানবিক এবং সাহিত্যিক চিন্তাধারা অন্যরকম হত। অন্যরকম হত বলছি এইজন্যে যে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে সঙ্গে যদি বৈশ্য এবং শূদ্রেরাও সমানাধিকার পেতেন তাহলে ভারতের সংস্কৃতির চলমানতা বাড়ত বই কমত না–কেননা সংস্কৃতি কোনো স্থাণু পদার্থ নয় এবং কোনো দেশে সংস্কৃতির প্রবাহ কোনো বিশেষ একটি জাতির ওপর নির্ভর করে না। উপরের উদাহরণ দিয়ে আমি শুধু দেখাতে চেয়েছি যে, ক্রমাগত সামাজিক মূল্য পেতে পেতে ব্রাহ্মণেরা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন যখন সভ্যতার চোখে ব্রাহ্মণের মূল্য কমতে আরম্ভ করেছিল। ব্রাহ্মণদের মধ্যেও তৈরি হয়ে গিয়েছিল এমন এক বিভাগ যাতে এক ভাগ তাদের শিক্ষা, দীক্ষা, উদারতা এবং কর্মগুণে সবার সম্মান পেতেন। আরেকভাগ, বেদ-উপনিষদ, ব্রহ্মভাবনা সব ভুলে শুধু ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মেছি বলে গর্ব করতেন। আর তেজোহীন ব্ৰহ্মণ্যের নির্বিষ খোলসখানি গলায় ঝুলিয়ে শুধু সম্মান পেতে চাইতেন দানসামগ্রীর স্বার্থে।
একটা গল্প বলি বিষ্ণুপুরাণ থেকে। এক সময়ে ঋষিরা এক জায়গায় বসে একটা সমাজ কিংবা এখনকার ভাষায় একটা ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করলেন। ইউনিয়নের নাম ‘মহামেরু’ ইউনিয়ন। ব্রাহ্মণেরা সিদ্ধান্ত করলেন-যে ঋষি এই মহামেরু সমাজে আসবেন না, তিনি সাত রাতের পর ব্রহ্মহত্যার পাতকে পাতকী হবেন। ইউনিয়নের ভয় কার না থাকে। সমস্ত ঋষিরাই কোনো না কোনো সময়ে মহামেরু সমাজে তাদের নাম লিখিয়ে গেছেন। শুধু মহর্ষি বৈশম্পায়ন এই ইউনিয়নের ধার ধারেন না, তিনি আসেনও না। ফল, মেরুসমাজের ঋষিদের শাপ এবং তার ফলে তিনি তার বাচ্চা-বয়েসি ভাগনেকে পা দিয়ে মাড়িয়ে দিলেন এবং সে মারা গেল। কিন্তু বালক হলে কী হবে সেও তো ব্রাহ্মণ বটে, অতএব ব্রহ্মহত্যার পাপ লাগল। বৈশম্পায়ন তখন শিষ্যদের ডেকে বললেন-বাপু হে, আমার ব্রহ্মহত্যার পাপ যাতে নষ্ট হয়, তার জন্য নির্দিষ্ট ব্ৰত উদ্যাপন করো। মজা হল এই শিষ্যদের মধ্যে ঠোঁটকাটা যাজ্ঞবল্ক্যও ছিলেন। তিনি বললেন–গুরুমশাই! খুব তো বললেন ব্রত করো, কিন্তু এই ফালতু বামুনগুলোকে দিয়ে ব্রত করিয়ে কী হবে–কি এভিভগবন্ দ্বিজৈঃ। এদের ক্ষমতা খুব কম, একটু আধটু ব্ৰত-নিয়ম করলেই এরা মুষড়ে পড়ে–ক্রেশিতৈরঙ্গুতেজোভিঃ… কিমেভির্ভগবন্ দ্বিজৈঃ। তার চেয়ে আমি একাই এই ব্রত পালন করছি। বৈশম্পায়ন নিশ্চয় ভাবলেন–একবার মেরুসমাজের ব্রাহ্মণদের চটিয়ে ভাগনে মারা পড়েছে, আবার শিষ্য ব্রাহ্মণ চটানো! তিনি রেগে যাজ্ঞবল্ক্যকে বললেন–শিষ্য হয়ে তোর এত বড়ো কথা! তুই তো সব ব্রাহ্মণদের নিস্তেজ বলছি। দে, আমায় ফিরিয়ে দে, এতকাল ধরে তোকে যা পড়িয়েছি, বেদবিদ্যা সব ফিরিয়ে দে। যাজ্ঞবল্ক্য গুরু বৈশম্পায়নকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতেন, কেননা পুরাণ তার আখ্যা দিয়েছে–শিষ্যঃ পরমধর্মজ্ঞঃ গুরুবৃত্তিপরঃ সদা। সেই যাজ্ঞবল্ক্য যখন দেখলেন যে, তার গুরু কতখানি ফালতু ব্রাহ্মণকে ব্রাহ্মণপুঙ্গব বলে ঘোষণা করছেন–নিস্তেজসো বদস্যেতা যন্ত্বং ব্রাহ্মণপুঙ্গবা–তখন যাজ্ঞবল্ক্যও ভীষণ রেগে বললেন–দেখ ঠাকুর! যা বলেছি, তোমার ওপর যথেষ্ট ভক্তি ছিল বলেই বলেছি–ভক্ত্যৈতত্তে ময়োদিত। এখন তুমি যদি বিদ্যে ফিরিয়ে নিতে চাও, তাহলে বলছি–তোমার মতো গুরুতেও আমার প্রয়োজন নেই, যা এতকাল শিখেছি এখনই নাও ফিরিয়ে–মোপ্যলং ত্বয়াধীতং যন্ময়া তদিদং দ্বিজ। এই বলে সাঙ্গ যজুর্বেদ তিনি রক্তবমি করে উগরে দিয়ে সেখান থেকে সোজা চলে গেলেন–ছাদয়িত্ব দদৌ তস্মৈ যযৌ চ স্বেচ্ছয়া মুনিঃ।
বেদের মতো জিনিস উগরানোর জন্যই যাজ্ঞবন্ধ্যের বমির সঙ্গে একটু রক্ত পড়েছিল হয়তো। কিন্তু এই ঘটনাটা হল অল্পবীর্য নিষ্কর্মা, নিস্তেজ ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে যাজ্ঞবন্ধ্যের প্রতিবাদ। প্রতিবাদ যে ঠিক ছিল, তার প্রমাণ তিনি সেখান থেকে চলে গিয়ে সূর্যেপাসনা করে যজুর্বেদের পাঠ এতটাই রপ্ত করেছিলেন, যা তার গুরুও জানতেন না–যানি বেত্তি ন ত গুরুঃ। বস্তুত বামুনের কোনো গুণ না থাকা সত্ত্বেও এই যে বৈশম্পায়নের মতো মাথায় তুলে দেওয়া, এই মাথায় তোলার ব্যাপারটা পুরাণকার এবং ধর্মশাস্ত্রকারদের যুগেই ঘটেছে বেশি। ব্রাহ্মণের গুণ এবং বিশিষ্ট কর্ম না থাকা সত্ত্বেও জন্মসূত্রে পাওয়া ব্রাহ্মণ্যকে সম্মান দিতে হবে–এই তাগিদ থেকেই ব্রাহ্মণকে বউনির খদ্দের হতে হয়েছে বেশ্যাব্রতে, আবার একই তাগিদে ব্রাহ্মণ ঠাট্টা-মস্করার পাত্র হয়েছে প্রাচীন কাল থেকেই। মনে রাখবেন গো-ব্রাহ্মণের চরম পৃষ্ঠপোষক কৃষ্ণের ঘরেই ব্রাহ্মণদের নিয়ে মস্করা হয়েছিল। যদুকুলের কুমারেরা শাম্বকে গর্ভবতী মেয়ে সাজিয়ে ব্রাহ্মণদের জিজ্ঞাসা করেছিল–বলুন তো ঠাকুর, এর ছেলে হবে না মেয়ে? ব্রাহ্মণেরা মুষল প্রসবের শাপ দিয়েছিলেন। আমরা বলি-ইয়ার্কিঠাট্টা কি লোকে করে না। ব্রাহ্মণেরা সব কথাতেই বাণী দিতেন, প্রচুর ভবিষ্যৎ ঘোষণা করতেন, সে নিরিখে ফাজিল ছেলেরা হয়তো একটু ঠাট্টাই করেছে, তাতেই বংশধ্বংসের অভিশাপ। আমরাও তো জ্যোতিষীকে পরীক্ষা করার জন্য কত মিথ্যে মস্করা করি। কিন্তু বংশধ্বংসের অভিশাপেও স্বয়ং কৃষ্ণের মতামত কী বলুন তো! প্রথমত ভাগবত পুরাণকার লিখেছেন–ঈশ্বর হওয়ার কারণে তিনি ইচ্ছে করলে কিছু করতেও পারতেন অথবা অন্যথাও করতে পারতেন। কিন্তু ব্রাহ্মণের অভিশাপ সত্য করার জন্যই তিনি নাকি এক্ষেত্রে চুপচাপ রয়ে গেলেন। কারণ তার মত হল–বামুনেরা যদি রেগেও যায়, রেগে গিয়ে যদি শাপও দেয়, এমনকী হত্যাও করে তবু তাকে নমস্কার করে যেতে হবে–ঘন্তং বহুশপন্তং বা নমস্করুত নিত্যশঃ। এই নমস্কারের ফল হয়েছে এই যে, পদ্মপুরাণে দেখি-মন্দিরে ধ্যানমগ্ন এক পরমহংস ব্রাহ্মণ যখন সন্ধ্যাকালে অভিসারিণী পতিব্রতা যুবতাঁকে দেখে কামার্ত হয়ে ওঠেন, পুরাণকার তখনও সেই ব্রাহ্মণের বিশেষণ দেন–ভগবান্ বিপ্রঃ। যদিও শ্লোকের অন্য অর্ধে পৌরাণিককে বলতেই হয় যে ভগবান বিপ্র যুবতীতে দেখে কামার্ত হয়ে পড়লেন–দৃষ্টা তাং ভগবান্ বিপ্রো মন্মথস্য ভয়ার্দিতঃ। পরে যে ঘরে ওই রমণী আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই অর্গলরুদ্ধ ঘরের গবাক্ষপথে ঢুকতে গিয়ে ব্রাহ্মণ পরমহংস মারা যান–প্রবিষ্টং ন পুনশ্চৈতি পঞ্চত্বমগমত্তদা। উদ্দেশ্য পরিষ্কার জলবৎ।
পুরাণের ইতিহাস তাই ব্রাহ্মণদের মাথায় তোলার ইতিহাস। এই ঐতিহাসিকতাতেই ব্রাহ্মণকে যা দান করা যায় তাই সোনা হয়ে ফিরে আসে। মনু লিখেছিলেন ব্রাহ্মণের মুখাগ্নিতে যে ধনসম্পত্তির আহুতি দেবে সে দান হবে অক্ষয়। ঠিক এই জায়গায় টীকাকার লিখেছেন, ব্রাহ্মণের মুখ বলতে মুখ বুঝো না, ব্রাহ্মণের মুখ’ মানে ব্রাহ্মণের হাত-পাণাস্যো হি দ্বিজঃ স্মৃতঃ। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ হাতে করে নিলেই হল, সে পুণ্য অক্ষয়। আমরা জিজ্ঞাসা করি কী পেতেন ব্রাহ্মণেরা যার জন্য সর্বত্যাগী অযাচকবৃত্তি, ব্রহ্মবাদী ব্রাহ্মণ এত লোভী হয়ে পড়ল। আমরা কোনো উত্তর দেব না। হাজারো ব্রত থেকে আরম্ভ করে মানুষের জন্ম, যৌবন, শ্রাদ্ধ পর্যন্ত ব্রাহ্মণেরা যা পেতেন, তার হিসেব আছে পুরাণে। সোনা-দানা, মণি-মুক্তো, বাক্স-প্যাটরা, খাট-বালিশ ছেড়েই দিলাম কিন্তু দানসামগ্রীর মধ্যে ভোগ্যা দাসী এবং শূদ্র দাস এই দুটি সজীব বস্তুর দানই আমাদের আধুনিক হৃদয়কে কিঞ্চিৎ অবাধ্য করে তোলে।
যাক ব্রাহ্মণের কথা। ব্রাহ্মণের কথায় যেন সেকালের আর সব কিছু হারাতে বসেছে। হারাবেই। কেননা ব্রাহ্মণেরাই সেকালের ইতিহাসের অর্ধেক। সেকালে যা কিছু ভালো তার অনেক কিছুরই মূলে ব্রাহ্মণেরা থাকায় অন্যদের কৃতিত্ব হ্রাস পেয়েছে বইকি। তার ওপরে সমস্ত রাজকর্ম এবং রাজনৈতিক কর্মের সঙ্গে ব্রাহ্মণের যোগ থাকায় অন্যদের গুরুত্ব আরও কমে গেছে। একথা আগেই বলেছি যে, তখনকার দিনের রাজমন্ত্রীদের মধ্যে সর্বপ্রধান স্থান ছিল ব্রাহ্মণ মন্ত্রীদের। রাজার অবর্তমানে তারাই রাজত্ব চালাতেন এবং আক্ষরিক অর্থে কিংমেকার’বলতে যা বোঝায় তাও ছিলেন ব্রাহ্মণেরাই। মহাভারত যেমন পরিষ্কার মন্তব্য করেছে যে, ব্রাহ্মণদেরই বেশির ভাগ মন্ত্রিত্ব দিতে হবে–মস্ত্ৰিণশ্চৈব কুবীথা দ্বিজান্ বিদ্যাবিশারদা–তেমনি প্রাচীন পুরাণগুলিরও একই মত। এমনকী সেনাপতির মতো বীরত্বপূর্ণ দায়িত্বেও যে ব্রাহ্মণদেরই বসানো হত, তারও উদাহরণ আছে ভূরিভূরি। স্বয়ং মৎস্যপুরাণ বলেছে, সেনাপতি করতে হয়, তো ব্রাহ্মণকে করো, নয়তো ক্ষত্রিয়কে–রাজ্ঞা সেনাপতিঃ কার্যো ব্রাহ্মণঃ ক্ষত্রিয়ো’থবা। আরও আশ্চর্য, পৌরাণিকেরা সাধারণ সৈন্যগঠনের সময়েও ব্রাহ্মণদের নিয়ে গঠিত সেনাবাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ করেছেন। গোপনে গোপনে যে এতটা হয়েছিল, তা আমরা জানতেও পারতাম না, যদি না অর্থশাস্ত্রকার কৌটিল্য তার পূর্বতন আচার্যদের মত উল্লেখ করে বলতেন যে, আচার্যরা মনে করেন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র সেনাবাহিনীর মধ্যে তেজে এবং সদ্গুণে ব্রাহ্মণ-সেনাই শ্রেষ্ঠ। কৌটিল্য এই মত উড়িয়ে দিয়ে মোটা গলায় বলেছেন–মোটেই নয়–নেতি কৌটিল্যঃ। নিজে ব্রাহ্মণ হওয়ার গুণে কৌটিল্যের সবিশেষ ধারণা ছিল যে, ব্রাহ্মণেরা উপযুক্ত তৈলনিষেকে সব ভুলে যান। তাই কৌটিল্য বলেছেন–শত্রুপক্ষের সৈন্যেরা যুদ্ধ ছেড়ে বামুন-বাহিনীর পায়ে লুটিয়ে পড়ে ব্রাহ্মণ-সৈন্যদের যে-কোনো মুহূর্তে নিজের অধীন করে ফেলতে পারে–প্রণিপাতেন ব্রাহ্মণবলং পরোভিহারয়েৎ। অতএব কৌটিল্যের মতে–বরং বীরপুরুষ বৈশ্য কিংবা শূদ্রদের সেনাবাহিনীও ভালো, কিন্তু ব্রাহ্মণ নৈব নৈব চ। আসলে কৌটিল্য চান যুদ্ধবাজ ক্ষত্রিয়বাহিনী। যার যা। যুদ্ধ করবে ব্রাহ্মণ?
কিন্তু কৌটিল্য না চাইলে কী হবে, সেকালে রাজার নামে অনেক ক্ষেত্রে যে ব্রাহ্মণেরাই বেশিরভাগ রাজকার্য চালাতেন, তার প্রমাণ পুরাণে অনেক জায়গাতেই আছে। রাজা এবং রাজপুত্রদের যুদ্ধবিদ্যার ভারও ন্যস্ত ছিল ব্রাহ্মণদের ওপরেই। তারা ব্রাহ্মণদেরও যুদ্ধবিদ্যা শেখাতেন, ক্ষত্রিয়দেরও শেখাতেন, কেননা-ধনুর্বেদে গুরবিপ্রঃ প্রোক্তো বর্ণদ্বয়স্য চ। কাজেই দ্রোণাচার্য অশ্বত্থামাকেও ধনুক চালানো শিখিয়েছেন, কৌরব-পাণ্ডবকেও শিখিয়েছেন, কিন্তু একলব্য কিংবা কর্ণকে যে শেখাননি, তার কারণ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় ছাড়া অন্য কাউকে বিদ্যা শেখালে দ্রোণাচার্যের ‘প্রেস্টিজ’ চলে যেত। মৎস্যপুরাণ বলেছে রাজ্যের চিফ জাস্টিস’ও হবেন একজন ভালো বংশের ব্রাহ্মণ–বিপ্রমুখ্যঃ কুলীনশ্চ ধর্মাধিকরণে ভবেৎ। তাহলে যা দেখা যাচ্ছে, তা হল–পুরোহিত, মন্ত্রী, রাজগুরু, সেনাপতি, চিফ জাস্টিস–এতগুলি পদ যদি ব্রাহ্মণদের কোটাতে চলে যায়, তাহলে ব্রাহ্মণেরাই সমাজের অর্ধেক হলেন না তো কী? পরবর্তী পুরাণগুলিতে এ ব্যবস্থা খানিকটা ভেঙে পড়েছে অবশ্যই। এই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের মধ্যেও যে বিভিন্ন রাজকার্যে অন্য জাতীয়েরা প্রবেশ করে ফেলেছে এবং তা যে করেছে প্রয়োজনের তাগিদেই তার ছায়া পড়েছে তুলনায় অর্বাচীন পুরাণগুলির মধ্যে। এই পুরাণগুলি নীতিগতভাবে বড়ো বড়ো রাজকার্যে ব্রাহ্মণদের কার্যকারিতা মেনে নিলেও একমাত্র পুরোহিত এবং জ্যোতিষী বাদে আর সব জায়গাতেই অন্য মানুষদের চাইছিলেন। বিশেষত যুদ্ধে সেনাপতি ক্ষত্রিয় থাকুন আপত্তি নেই, কিন্তু অর্বাচীন পুরাণগুলিতে শূদ্রকে যুদ্ধের অধিকার দেওয়া হচ্ছে–যুদ্ধাধিকারঃ শূদ্রস্য। দেশের সংকর বর্ণকে বলা হচ্ছে–তোমরা রাজার যুদ্ধে সহায়তা করো–দেশস্থৈঃ সংকরৈ রাজ্ঞঃ কাৰ্য্যা যুদ্ধে সহায়তা। আমরা বলি হঠাৎ এই উদারতার কারণ কী? ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ের হলটা কী? প্রাচীন পুরাণে শুনেছি–যে দেশে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় বেশি নেই সে দেশে খবরদার থাকবে না। কিন্তু পরবর্তীকালের অগ্নি পুরাণে দেখছি–যে দেশে শূদ্রেরা আছে, শিল্পী আছে, বণিক আছে, কৃষক আছে, যে দেশে ভালো ভালো কাজকর্ম হয় এবং যে দেশে নানা দেশের লোকেরা আছে সেই জনপদই শ্রেষ্ঠ–শূদ্রকারবণিক প্রায়ো মহারম্ভঃ কৃষীবলঃ নানাদেশ্যৈঃ সমাকীর্ণঃ… ঈদৃক জনপদঃ শ্রেষ্ঠঃ।
শূদ্র শিল্পী এবং বণিকদের প্রতি পুরাণকারদের অনেক করুণা ছিল অস্বীকার করি না। কিন্তু এও মনে রাখতে হবে যে, দিনে দিনে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়েরা অনেকেই বড়োলোক হয়ে গিয়েছিলেন। সাধারণ ক্ষত্রিয়দের যুদ্ধ করার কষ্ট যত বাড়ছিল, সেনাবাহিনীতে শূদ্র এবং সংকরজন্মাদের প্রবেশ তত ত্বরান্বিত হচ্ছিল। তাছাড়া রাজাদের মধ্যেও যেখানে অনেক শূদ্র রাজা এসে গিয়েছিলেন, সেখানে শূদ্রদের যুদ্ধে অধিকার না দিয়ে উপায় আছে কোনো? আর যে দেশে শূদ্র, শিল্পী এবং কৃষকদের বাস, সে দেশের যে এত প্রশস্তি হয়েছে, পরবর্তীকালে তারও কারণ খোঁজা অন্যায় হবে না। একটা জিনিস মনে রাখতে হবে যে, ব্রাহ্মণেরা সাধারণ জীবনযাপন এবং উচ্চ চিন্তার আদর্শে বিশ্বাসী হলেও ক্রমান্বয়ে দান পেতে পেতে তারাও স্ফীত হয়ে উঠছিলেন। অতি দুঃস্থ আত্মীয়কে অর্থ সাহায্য করে যেমন তার অবস্থার উন্নতি করা যায় না অথচ ওই ধন যেমন তাকে কর্মজগতের বিশাল ক্ষেত্রে পঙ্গু করে দেয়, তেমনি দরিদ্র ব্রাহ্মণের আর্থিক উন্নতির জন্য রাজারা যে অশেষ দান করতেন তাতে তার ধর্মনির্ভরশীলতা যতখানি বাড়ছিল কর্মক্ষমতা তত নয়। পুরাণ বলেছে–রাজার পক্ষে সোনা, জমি আর আট বছরের মেয়ে ব্রাহ্মণকে দান করার মতো পুণ্য আর নেই–হ্যাটক-ক্ষিতি-গৌরীণাং সপ্তজন্মানুগং ফল। তা, আট বছরের গৌরী মেয়েটিকে না হয় ব্রাহ্মণ সময় মতো তৈরি করে নেবেন, সোনা দিয়ে না হয় প্রথমা ব্রাহ্মণীর আট-নরি হার গড়িয়ে দিলেন, কিন্তু জমি? জমি ব্রাহ্মণ নিজে চাষ করতে পারবেন না, করলে জাত-ধর্ম সব যাবে। তাই রাজারা কী উত্তম ব্যবস্থা করেছিলেন দেখুন।
পূর্বকালে জমি দেওয়ার একটা নিয়ম ছিল এবং তার কারণও ছিল। যে জমি দেওয়া হত সেটা অকর্ষিত, অনাবাদী জমি, যার পারিভাষিক নাম খিলভূমি, অথবা একেবারে হাল-না-লাগানো জমি, যাকে বলে অপ্রতিহত ভূমি। এই জমি যাকে দেওয়া হত সে চাষের দায়িত্ব নিয়ে জমিতে শস্য ফলাত। এতে যেমন দানের পুণ্যও হত অন্যদিকে জমিটাও আবাদযোগ্য হয়ে যেত। কিন্তু পুরাণ বলছে–যে গ্রাম রাজা ব্রাহ্মণকে দিয়ে পুণ্যভোগী হবেন, সে গ্রামের জমি হবে শস্যযুক্ত–গ্রামং বা শস্যশালিন। এমন জমি, যে জমিতে সব জাতের শস্য ফলানো যায়–সর্বশস্যপ্ররোহিণী। এখানে যেটা অনুক্ত আছে সেটা হল–যে খেট, খট বা গ্রাম ব্রাহ্মণকে দেওয়া হচ্ছে, সেই গ্রামের অধিবাসী যত কুলি-কামিন, মজুর-কৃষক সবই কিন্তু ব্রাহ্মণকে দেওয়া হচ্ছে। কেননা অন্যত্র পুরাণ বলেছে–জমিই যদি দাও তবে তার সঙ্গে কটা বলদ আর কাঠের তৈরি দশটা লাঙল দিলে একেবারে স্বর্গলাভ হবে–সংযুক্ত হল পংজ্ঞ্যাখ্যং দানং সর্বফলপ্রদ। আপনারা ভাবছেন পৌরাণিকদের কি লজ্জাশরম কিছুই নেই? আছে, যথেষ্ট আছে। সেই জন্যেই তারা এক জায়গায় গ্রামদানের কথা বলছেন, আরেক জায়গায় বলদ এবং লাঙল দেওয়ার কথা বলেছেন, আবার আরেক জায়গায় বলেছেন–এর সঙ্গে যদি দাস, দাসী, অলংকার, ভূমি, গোরু, ঘোড়া আর হাতি দাও, তাহলে স্বর্গের পথ একেবারেই পরিষ্কার-দাসীদাসমলংকারং গোভূম্যশ্বগজাদিক। দেবায় দত্ত্বা সৌভাগ্যং ধনায়ুস্মান্ ব্ৰজেদ্দিবম৷
এবার বলি দানের লিস্টি থেকে যদি জমি, বলদ, হাল-লাঙল, আর দাস-দাসীদের এক জায়গায় নিয়ে আসি তাহলে এই দাঁড়ায় যে, গ্রামের শূদ্র-বর্ণ যারা কৃষিকর্মের ওপরেই জীবিকা নির্বাহ করতেন, সেই শূদ্র বা দাসেরা জমির সঙ্গে সঙ্গেই অন্য ব্রাহ্মণ মালিকের অধীনে চলে যেতেন, ঠিক যেমনটি জমির সঙ্গে সমস্ত অধিবাসীরা চলে যেত মধ্যযুগীয় ইউরোপের চার্চগুলির অধীনে। কারণ দেবতা, মঠ কিংবা মন্দিরে যদি এইভাবে জমি দান করা হয়, তাহলে তার ফলভোক্তা হতেন সেবায়েত ব্রাহ্মণেরাই। ঠিক এই নিরিখে দেখলে বোঝা যাবে কেন সেই জনপদকে প্রশস্ত বলা হয়েছে, যেখানে শূদ্র, শিল্পী এবং বণিকরা থাকে। যে গ্রামের মালিকানা ব্রাহ্মণের হাতে এল, সেখানকার শূদ্র, শিল্পী এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের চরম মালিকানা ব্রাহ্মণের হাতে থাকত বলেই পরবর্তী পুরাণগুলিতে শূদ্র এবং বণিকদের কিছু পাত্তা দেওয়া হয়েছে, নইলে তাদের কে পোঁছে? এইভাবে কিন্তু রাজার রাজকোষের কোনো উন্নতি হয়নি, কারণ জমিদার ব্রাহ্মণেরা ছিলেন সর্বদাই করমুক্ত। ব্রাহ্মণেরা নাকি তাদের তপস্যার ভাগ দিয়ে রাজাকে কর দিতেন। একের ছয় ভাগ তপস্যার ফলের বিনিময়ে ব্রাহ্মণ সামন্তেরা যেভাবে বেড়ে উঠেছিলেন, ভারতবর্ষের সমাজ এখনও তার ফল ভোগ করছে।
ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের রাজোচিত রমরমায় যাঁদের সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি হয়েছে তারা হলেন বৈশ্য, শূদ্র এবং স্ত্রীলোক। স্ত্রীলোকের কথা পরে হবে, তবে সৃষ্টির আদি থেকেই যেন বৈশ্যদের ওপর পৌরাণিকদের একটা জাতক্রোধ আছে। একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে শূদ্রদের বাদ দিলে একমাত্র বৈশ্যেরাই ছিলেন সমাজের সবচেয়ে বড়ো অংশ। প্রাথমিকভাবে তাদের কাজ ছিল কৃষিকর্ম কিন্তু চাষের সঙ্গে প্রধানত শূদ্রদের যোগ থাকায় বৈশ্যেরা চাল এবং অন্যান্য উৎপন্ন শস্যের ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছিলেন বলে মনে হয়। যে ব্যবসা করে সে এক ব্যবসা নিয়ে বসে থাকে না। কাজেই পরবর্তীকালে সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্যেই একচেটিয়া অধিকার এল বৈশ্যদের। আগেই বলেছি যে বায়ুপুরাণ বৈশ্যদের মধ্যে স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায়নি এবং তাদের টাকা-পয়সা রোজগারের কায়দা-কানুন দেখে বায়ুপুরাণ তাদের উপাধি দিয়েছে যম’বলে-বৈশ্যানেব তু তানাহুঃ কীনাশান্ বৃত্তসাধকান্। পৌরাণিকদের মুখ আছে, তারা বাণী দেবেন, তাতে অসুবিধে কোথায়? কিন্তু এঁরা ভুলে যান যে, একটা রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নতি সম্পূর্ণ নির্ভর করত এই বৈশ্যদের ওপর। ব্রাহ্মণেরা বেদমন্ত্র উচ্চারণের মন্ত্রবলে করমুক্ত; ক্ষত্রিয়েরা বেশির ভাগই রাজপুরুষ–রাষ্ট্রের ওপরেই তাদের জীবিকা–তাঁদের অর্ধেক সামন্ত, অর্ধেক চাকুরিজীবী। শূদ্রেরা শুধু জন খাটে। এ অবস্থায় রাজকোষে যে বিরাট টাকা জমা পড়ত সেটা আসত কিন্তু এই বৈশ্যদের কর্মবলেই। এই বৈশ্যেরা হলেন সেই মানুষ, যাঁরা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের অনেক অবমাননাকর মন্তব্য শুনেও ঘরে বাইরে ব্যবসা-বাণিজ্য ছড়িয়ে দিয়ে রাষ্ট্রের উন্নতি বিধান করে গেছেন। ভারত যে বহির্বিশ্বে স্বদেশ-জাত দ্রব্যগুলি রপ্তানি করতে পেরেছিল তাও কিন্তু এই বৈশ্যদের করুণাতেই। কৃষিজাত পণ্যের লেনদেন তথা ব্যবসা-বাণিজ্যের খাতিরে শ্রমজীবী শূদ্র দাসেদের সঙ্গে বৈশ্যদের বেশি মেলামেশা করতে হত। অন্যদিকে বহির্বিশ্বে ব্যবসার জন্য তাদের যবন-সংস্পর্শও ঘটত বেশি। এই স্পর্শদোষই কিন্তু চিরকাল তাদের হেয় করে রেখেছে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের চোখে।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ব্যবসার জন্য বৈশ্যদের অনেক অন্যায় কর্ম করতে হত এবং সে অন্যায় দিনে দিনে বেড়েছে। তবে এও তো সত্যি যে, ব্যবসা করতে গেলে মিথ্যেও বলতে হয় অন্যায়ও করতে হয়। কিন্তু বায়ুপুরাণের মতো প্রাচীন পুরাণেই দেখতে পাচ্ছি যে সচ্চরিত্র ব্রাহ্মণেরা ব্যবসা করার প্রাথমিক আদব-কায়দাকেও মিথ্যাচারিতা বলে মনে করেছেন। তাঁরা বলেছেন, ভদ্রলোকের কোনো শ্রাদ্ধ-বাসরে বৈশ্যদের যেন নেমন্তন্ন না করা হয়–ন বণিক শ্রাদ্ধমৰ্হতি। কেন, তাদের অপরাধ কী? না, তারা বিক্রেয় জিনিসটি কেনবার সময়–দূর! তোমার মাল খারাপ, বিক্রি করাই কঠিন হবে–এইসব কথা বলে জিনিসটার নিন্দা করে। আবার বিক্রি করবার সময় ওই জিনিসেরই এমন প্রশংসা করে, যেন বাজারে তার জোড়া মিলবে না। কাজেই নিন্দে করে জিনিস কেনা, আর প্রশংসা করে সেটা বিক্রি করা–নিন্দ ক্ৰীণাতি পণ্যানি বিক্রিণংশ্চ প্রশংসতি–এই মিথ্যাবাদী বণিককে খবরদার শ্রাদ্ধে নেমন্তন্ন করবে না। ব্যবসার এই প্রথম চালটাকেই যদি মিথ্যে বলি, তাহলে ব্রাহ্মণেরা যে যজ্ঞকর্মের গুণ বাড়িয়ে বলে যাগ-যজ্ঞে মানুষের প্রবৃত্তি ঘটাতেন, যাকে তারা নিজেরাই বলেছেন মিথ্যে অর্থবাদ, তাহলে তাদেরও তো শ্রাদ্ধে নেমন্তন্ন করা চলে না। আসলে এই এক জাতক্রোধ। যাঁরা ভাবতেন ব্যবসায়ীকে দান করা মানে ইহকাল পরকাল সব ঝরঝরে–যচ্চ বাণিজ্যিকে চৈব নেহ নামুত্র তদুভবেৎ-তারা যে ব্যবসায়ীর সত্যি অন্যায়গুলো আরও বড়ো করে দেখবেন, তাতে সন্দেহ কি? অন্যদিকে যাকে নিন্দা করা হচ্ছে, সেই নিন্দিত ব্যক্তির মনস্তত্ত্ব হল–আমার যখন এইটুকুতেই এত নিন্দা, তখন আরও অন্যায়ে দোষ কী! এতে অন্যায়টা বেড়ে যায়, বৈশ্যদেরও অন্যায় বেড়েছে।
পরবর্তী পুরাণগুলিতে দেখা যাচ্ছে যে, বৈশ্যেরা শুধু কৃষি আর বাণিজ্য নিয়ে নেই, তারা মহাজনি ব্যবসায় চড়া সুদে টাকা ধার দেয়–কৃষ্যাদিবৃত্তয়ো জ্ঞেয়াঃ কুসীদং বৃদ্ধিজীবিকা। শুধু এই নয়। আজকের দিনে যেমন পণ্য মজুত করে পরে দাম বাড়লে বিক্রি করার ঝোঁক বেড়েছে কিংবা দাঁড়িপাল্লা বাটখারায় কারচুপি করে ক্রেতাকে ওজন কম দেওয়ার প্রবৃত্তি বেড়েছে এইসব অসাধুতা তখনও ছিল এবং প্রাচীন কাল থেকেই ক্রমান্বয়ে তা বাড়ছে। পুরাণগুলি ব্যবসায়িক অসাধুতার ব্যাপারে রাজপুরুষকে সদা সজাগ থাকতে বলছে এবং তাদের দণ্ডবিধির ধারা থেকেই বোঝা যাবে–কী কী ধরনের অসাধুতা চলছিল। পুরাণ বলেছে–যে বণিক ধান কিংবা কার্পাস তুলো মাপার সময় দাঁড়িপাল্লা (কুটমান) কিংবা বাটখারায় (কূটতুলা) কারচুপি করে–মানেন তুলয়া বাপি–তাকে বাইশ পণ দণ্ড দিতে হবে। এখনকার দিনে যেমন ওষুধ থেকে আরম্ভ করে ভোজ্য তেল এবং অন্যান্য খাবার জিনিসে ভেজাল মেশানো হয়–এই পরম্পরা বৈশ্য-বণিকেরা পুরাণের সময় থেকেই রপ্ত করেছে, কেননা পুরাণ বলেছে–ওষুধ, তেল-ঘি,নুন, সেন্ট, ধান, গুড়–এসব জিনিসে যে ভেজাল মেশাবে-পণ্যেষু প্রক্ষিপ হীনং–তার ষোলো পণ দণ্ড হবে। এমনকী ব্যবসায়ীরা যে সেল-ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য বেশি জিনিস মজুত করে কম জিনিস দেখাত, কিংবা কর আদায়ের জায়গা থেকে কেটে পড়ত–তার প্রমাণও পুরাণেই রয়েছে–মিথ্যা বদন্ পরীমানং শুল্কস্থানা অপক্রম। মোটামুটি সপ্তম-অষ্টম খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, ব্যবসায়ী সমাজ এত উন্নতি করেছিল যে পার্টনারশিপ বিজনেস পর্যন্ত চালু হয়ে গিয়েছিল–সমবায়েন বণিজাং লাভার্থং কর্ম কুর্বর্তাম্। পার্টনারশিপে’ কে কত পাবে তা ঠিক হত, কে কত মূলধন খাঁটিয়েছে তার ওপর–লাভালাভৌ যথা দ্রব্যং যথা বা সংবিদা কৃতৌ। আবার পার্টনারশিপ বিজনেসে’ কোনো একজন পার্টনার যদি জয়েন্ট মিটিং না করে ব্যক্তিগতভাবে জিনিস বিক্রি করে লস’ খায়, সে দায় সেই ব্যক্তিগত অংশীদারের–স দদ্যা বিপ্লবাচ্চ। আর একইভাবে ব্যক্তিগত অংশীদার যদি লাভ করতে পারে তবে সে লাভের অংশের দশভাগ কমিশন’ পাবে।
বোঝা যাচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য কোন পর্যায়ে গেলে এতদূর চিন্তা-ভাবনা আসে; কিন্তু এই সঙ্গে ভাবতে হবে যে, উন্নতি যতই হোক না কেন বৈশ্যবণিকদের করও দিতে হত সাংঘাতিক পরিমাণ। প্রথমত ব্যবসায়িক দ্রব্যের বিক্রয়মূল্য রাজাই বেঁধে দিতেন এবং বণিককে কর দিতে হত কখনও বা বিক্রয়মূল্যের বিশ ভাগ। এই পরিমাণ কর দিতে গেলে বণিককে অসাধু হতেই হবে এবং কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য বিভিন্ন রাজপুরুষকে ঘুস দিতে হবে। প্রাচীনকাল থেকে তাই হয়েছে। সুপ্রাচীন গ্রন্থ কথাসরিৎসাগরে দেখা যাবে যে, বণিকেরা কাস্টমস ডিউটি’ ফাঁকি দেওয়ার জন্য কেমন করে সাধারণ মানুষের চলার পথ ছেড়ে দিয়ে নির্জন পার্বত্য পথ, কিংবা অরণ্যের পথ ধরেছে–বণিকস্বার্থঃ পুরস্কৃত্যাটবীপথ, বহুশুল্কভয়াৎ ত্যক্তমার্গান্তরজনাশ্রিত। এ ব্যাপারে বণিকদের সবচেয়ে সুবিধে দিতেন রাজার ফরেস্ট অফিসারেরা এবং সেই কারণেই আটবিক পুরুষেরা অনেকেই ছিলেন রাজতন্ত্রের কাটার মতো। রাজারা এদের থেকে সবসময় সাবধান থাকার চেষ্টা করেও ফল পেতেন না। অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের কাজ গুছিয়ে নিই।
তবে আজকের দিনে আমরা বুঝি যে, ব্যবসায়ীদের অসাধুতার পেছনে তাদের আরও লাভ করার খাই যতটা ছিল, তারও পেছনে ছিল রাজকরের সমস্যা। একটি রাজ্যের রাজকোষ যদি অনেকাংশেই নির্ভর করে বৈশ্য-বণিকের লাভের ওপর, তাহলে একদিকে তারা কষ্ট করেও সুখী হতে পারে না, অন্যদিকে ব্রাহ্মণসজ্জনেরা বাজারে গিয়ে আগুন দাম আর ভেজাল দেখে কেবলই বৈশ্যদের বায়ুপুরাণের ভাষায় গালাগালি দিতে থাকেন–বেটা যম, সুদখোর। কেবলই নিজের স্বার্থসিদ্ধি করে বেড়ায়–কীনাশাবৃত্তসাধকান্।
কাজ গুছিয়ে দেওয়ার জন্য এখনকার মতোই ঘুসখোর রাজপুরুষেরাও অবশ্য ছিলেন।ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনে এবং তাদের সময়মতো রাজপুরুষদের খাটানোর জন্য অপ্রয়োজনে রাজা মহারাজার পেছন পেছন যেতেন। রাজার ঘরে আনন্দের দিনে তো অবশ্যই। ব্ৰহ্মপুরাণে দেখবেন–রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন উজ্জয়িনী নগরী থেকে ভগবৎ-সেবার ইচ্ছেয় বেরিয়েছেন। সেখানে তার অনুগমনকারীদের মধ্যে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের যতটা না দেখা যাবে, তার চেয়ে অনেক বেশি দেখা যাবে বৈশ্যদের। পুরাণকার সেখানে একটি একটি করে বিভিন্ন কর্মকর বৈশ্যদের নাম করেছেন, আর বলেছেন তাঁরাও রাজার পেছন পেছন চলেছে। কিন্তু এই যে বণিকেরা চলেছে, সে তেলের ব্যবসাদারই হোক কিংবা কাপড়ের, সে তাতিই হোক কিংবা কামার, কিংবা এমন কোনো ব্যবসাদার যার ব্যবসার অর্থই আজকে হারিয়ে গেছে–কুন্দকার, রুঠক–এরা সবাই কিন্তু টাকা-পয়সা, সোনার মোহর সঙ্গে নিয়ে চলেছে–বণিগ্রামগণাঃ সর্বে নানাপুরনিবাসিনঃ। ধনৈ ররৈ সুবর্ণৈশ্চ…। কই ব্রাহ্মণেরা কজন কোষাকুষি আর কমণ্ডলু নিয়ে যাচ্ছিলেন? কিন্তু অন্যত্র বৈশ্যদের কোনো এলেম না থাকলেও এখানে একটি করে সমস্ত ব্যবসাদারদের নাম করা হয়েছে। কেন? একটু পরেই যে মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন পুরীতে সেই বিশাল জগন্নাথের মন্দিরটি তৈরি করবেন। মন্দিরে পুজো করতে নিশ্চয়ই ব্রাহ্মণ সজ্জনদের দরকার হবে, কিন্তু মন্দিরটি বানাতে কাদের দরকার হবে? অবশ্যই বণিকদের। মন্দিরের সেবাপূজা চলবার জন্য রাজা মন্দিরের কাছাকাছি যেমন ব্রাহ্মণদের বসত বানিয়েছেন, তেমনি বৈশ্যদেরও বসত বানিয়েছেন–ব্রাহ্মণানাঞ্চ বৈশ্যানাং নানাদেশসমীয়ুষা। কারয়ামাস বিধিবচ্ছালাস্তত্রাপ্যনেকশঃ। বেশ বোঝা যায় মন্দির বানানোর টাকা এবং তার সেবাপূজা চালাবার টাকাও প্রধানত আসত এই বণিক-বৈশ্যদের কাছ থেকেই, যা এখনও একইভাবে আসে। ব্রহ্মপুরাণে মাঝে মাঝেই ব্রাহ্মণদের সঙ্গে একই শ্লোকে বৈশ্যদের উল্লেখ দেখতে পাচ্ছি। বৈশ্যদের আর্থিক দিক দিয়ে সামাজিক মূল্য বাড়ছিল বলেই ব্ৰহ্মপুরাণের মধ্যে বিভিন্ন দেশের বৈশ্যগোষ্ঠীরও নাম পাচ্ছি। তার ওপরে বিভিন্ন পুরাণে বৈশ্যদের জাত-ব্যবসা ধরতে ব্রাহ্মণকে যে বারবার নিষেধ করা হচ্ছে, তা থেকেও বুঝি যে বৈশ্যবৃত্তিতে অর্থলাভ উচ্চতর বর্ণের কাছেও লোভনীয় ছিল। অনেকেই সে বৃত্তি গ্রহণ করেছিলেন এবং যারা সরাসরি সে বৃত্তি নিতে পারছিলেন না, তারাই সামাজিক উচ্চতা প্রতিষ্ঠা করে বৈশ্যদের গালাগালি দিচ্ছিলেন।
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য–এই তিন বর্ণের পরে শূদ্রদের সম্বন্ধে আর কোনো কথা আমরা বলব না। বলব না এই জন্য যে, ভারতবর্ষের ইতিহাসে এর থেকে কলঙ্কজনক অধ্যায় আর নেই এবং আমার লেখনীতে ব্রাহ্মণ-শূদ্র সংবাদ লিখতে গেলে উচ্চকুলশীল ব্রাহ্মণেরা শুধু লজ্জা পাবেন না, তারা এক কথায় হীন এবং নীচ বলে প্রমাণিত হবেন। পুরাণগুলির মধ্যে যে শাক্ত কিংবা বৈষ্ণব আচরণের নিরিখে শূদ্রকে খানিকটা সামাজিক মর্যাদা দেওয়া হচ্ছিল, তাও উদ্দেশ্যবিহীন নয়। নূতন ধর্ম, বৈষ্ণবতন্ত্র, শাক্ততন্ত্র কিংবা সাত্ত্বত-পঞ্চরাত্র ধর্মবাদীরা ব্রাহ্মণ্য সমাজের বিরোধিতায় সম্মুখীন হয়েছিল বলেই সমাজের যে বহুলাংশ, সেই শূদ্রদের সমর্থন তাদের প্রয়োজন ছিল এবং সেইজন্যেই অন্তত মৌখিকভাবে হরিভক্তিপরায়ণ চণ্ডাল, ব্রাহ্মণের থেকে মহত্তরের অর্থবাদ লাভ করেছে; কার্যত ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণই থেকে গেছেন, পুরাণগুলি তাদের সর্বশ্রেষ্ঠতার মর্যাদা না দিয়ে পারেনি।
আমার দুঃখ লাগে একটাই। দিনের পর দিন একের নিষ্পেষণে এবং অপরের বহুমাননেও, একের মানসিক পীড়নে এবং অপরের শ্রেয়োলাভেও সমগ্র ব্রাহ্মণ্য সমাজ কেমন করে এত নির্বিকার রয়ে গেল। তারা তো একবারের তরেও বর্ণ’ শব্দটির আসল অর্থ বললেন না। না হয় বেদ থেকে আরম্ভ করে প্রাচীন গ্রন্থগুলি বলেইছে যে–ব্রাহ্মণোস্য মুখমাসী বাহ্ রাজন্যঃ কৃতঃ। ঊরূতদস্য যদ্বৈশ্যঃ পদ্যাং শূদ্রোজায়ত ৷৷ কিন্তু যজুর্বেদের এই মন্ত্রের অর্থও তো সংরক্ষণশীলেরা যা করেন, তা এর মানেই নয়। তারা এমনভাবে বলেন যেন–সেই পরম পুরুষের মুখ থেকে ব্রাহ্মণ জন্মাল, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য আর পা থেকে শূদ্র জন্মাল। আসলে জন্মানোর কথাটা শূদ্রের বেলাতেই শুধু আছে। ব্রাহ্মণের কথা আছে এইভাবে যে, ব্রাহ্মণ সেই পরমপুরুষের মুখ হল। আর ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যকে তার বাহু এবং ঊরু করা হল–কৃতঃ। তাহলে আক্ষরিক অর্থে এক এক জায়গা থেকে এক এক জাতের জন্মের প্রশ্নই আসে না। আসলে ভাগের সুবিধের জন্য এটা একটা ভেদ কল্পনা। শতপথ ব্রাহ্মণ বলেছে–ব্রাহ্মণেরা জ্ঞানে-গুণে সমাজের মুখ্য ছিলেন বলেই মুখ থেকে ব্রাহ্মণের সৃষ্টি কল্পনা–যস্নাদেতে মুখ্যাস্তস্মাৎ মুখতো’সৃজ্যন্ত। বাহুতে শক্তির কল্পনা বলেই বাহুর্বৈ বীর্য–ক্ষত্রিয়দের বাহু বলা হয়েছে। উরু হল যাওয়া-আসা, ঘোরাঘুরির প্রতীক, ব্যবসার জন্য যা করতেই হয়, অতএব বৈশ্যেরা হলেন তার উরুস্থানীয়। আর পা হল খাটুনির প্রতীক, পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থেকেই চাষ-আবাদ, কী, অন্য লোকের সেবা করতে হয়, তাই শূদ্র হল পদস্থানীয়। শতপথ বলেছে–যে ভগবান থেকে বিশ্বের উৎপত্তি তাকে কী কী ভাবে কল্পনা করা যায়, কত রকম ভাবে কল্পনা করা যায়–যৎ পুরুষং ব্যদুধঃ কতিধা ব্যকল্পয়ন? না, চার ভাবে কল্পনা করা যায়। ঠিক এই জায়গাতেই ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় এই চার জাতির কল্পনা মুখ-বাহু ইত্যাদির আদর্শে। সত্যি কথা বলতে কী ভারতবর্ষে তুলনামূলক ভালো মন্দের কল্পনায় অনেক ক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়ের আরোপ করা হয়েছে। এমনকী যে বিষ রসায়নের কর্মকাণ্ডে লাগে তাকে ব্রাহ্মণ বিষ বলা হয়েছে দ্রব্যগুণের সীমা নির্দেশ করতে। আবার যে বিষ দেহপুষ্টির কাজে লাগে, সেটা ক্ষত্রিয় বিষ; বৈশ্য-বিষ শুধু কষ্ট লাঘব করে আর শূদ্র-বিষের কাজ একেবারে মেরে ফেলা। পুরাণকারেরা কেউ তো এমন করে বর্ণবিভাগের কথা চিন্তা করলেন না। পুরাণের ব্যাসের আগে যে মহাভারতের ব্যাস; তাঁকেও তো একটু মনে রাখা যেত। তিনি তো বলেছিলেন–সে চতুর্বর্ণাত্মক পরম-পুরুষকে আমি নমস্কার করি। কী রকম পরম পুরুষ? না, ব্রাহ্মণ যাঁর মুখ, ক্ষত্রিয় যাঁর বাহু, বৈশ্য যাঁর পেট থেকে উরু পর্যন্ত, আর পা দুখানি যাঁর শূদ্র–সেই চতুর্বর্ণাত্মক পুরুষকে নমস্কার করি। পরিষ্কার কথা। একটি মানুষের দেহের কল্পনায় মানব সমাজের কল্পনা। যাঁরা বিদ্বান, শিক্ষিত, বিদগ্ধ–তারা তখনও যেমন ব্রাহ্মণ ছিলেন, তেমনি এখনও সমাজের ব্রাহ্মণ, নরদেহের মুখ। যাঁরা শক্তিমান, রাষ্ট্রশক্তি ধারণ করেন নিজের হাতে, তারা তখনও যেমন ক্ষত্রিয় ছিলেন, আজও তেমনি ক্ষত্রিয়, দেহের শক্তির প্রতীক, বাহু। যাঁদের উদয়াস্ত ঊরুশক্তিতে মানুষের পেট চলে, তিনি তখনও ব্যবসাদার বৈশ্য, এখনও তাই। নরদেহের পেট এবং ঊরু। আর সারাদিন পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে-থাকা, খেটে-খাওয়া মানুষগুলি, যাঁরা মানব সমাজের দাঁড়িয়ে থাকার অবলম্বন–পা দুখানি, তারা পূর্বেও শূদ্র ছিলেন, এখনও শূদ্র। পুরাণের বেদব্যাসেরা অন্তত বিষ্ণুর পা থেকে জন্মেছে বলে–ত বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ-বলে নমস্কার করতে পারতেন এই শূদ্র-বর্ণকে, তা তারা করেননি। বহু বৈদিক ক্রিয়াকলাপ তারা যেমন নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করে উদারতা দেখিয়েছেন, তেমনি বলতে পারতেন–বৃ’ ধাতু মানে বরণ করা, সেই ধাতু থেকেই তো বর্ণ। অতএব বর্ণ-ব্যবস্থা মানে–বিভিন্ন কাজের জন্য এই বিরাট মনুষ্য সমাজের বিভিন্ন মানুষকে বরণ করা। কিন্তু এ ব্যাখ্যাও তাঁরা করেননি। অতএব বর্ণবিভাগের ব্যাপারে ব্রাহ্মণ্য সমাজের নিতান্ত স্বার্থপর অর্থবাদের জন্য পুরাণকারদেরও আমরা একভাবেনমস্কার জানাচ্ছি। দুঃখের বিষয় নমস্কারটা সম্পূর্ণ সশ্রদ্ধ হল না, এই যা।