অষ্টম পরিচ্ছেদ
পরের দিন সকালের দিকেই কাজল নারদ ঘাটের ঠিকানাটায় খোঁজ করিতে গেল।
এবার অবশ্য ঠিকানা বাহির করিতে অসুবিধা হইল না। রাস্তার উপরেই বেশ বড়ো বাড়ি। সামনে লোহার কারুকার্য করা ফটক। দেখিলেই মনে হয় বেশ ধনীর বাড়ি—যদিও এখন কিঞ্চিৎ শ্রীহীন। ভিতরে লোকজনও বিশেষ আছে বলিয়া মনে হইল না। ফটকের ভিতরেই একজন বিহারী দারোয়ান বসিয়া খৈনি ডলিতেছে। কাজল তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল–বাবু আছেন?
নিচের ঠোঁটটা টানিয়া চূর্ণীকৃত খৈনি সেই গহ্বরে নিক্ষেপ করিয়া দারোয়ান বলিল—ববালিয়ে বাবুসাহেব, কিত্সকো চাহিয়ে?
—মিঃ রায়চৌধুরী আছেন? আমি তার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই।
—জী, আইয়ে—
পুরাতন ধরনের আসবাবে সাজানো ড্রয়িংরুমে তাহাকে বসাইয়া লোকটা ভিতরে খবর দিতে গেল। ঘরে বিচিত্র গঠনের সেকেলে মেহগনি কাঠের চেয়ার, মেঝেতে বহু ব্যবহারে জীর্ণ সূতা বাহির হওয়া কার্পেট, কাঁচের টপ সমন্বিত ভারি টেবিল, দেওয়ালের সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো বিলাতি ল্যান্ডস্কেপ-সমস্তই এই পরিবারের হৃত গৌরবের সাক্ষ্য দিতেছে। তাহার বাবার সহিত ইহাদের কীরূপ যোগাযোগ ছিল?
ভিতরের দরজা দিয়া একজন অত্যন্ত সুপুরুষ বছর পঞ্চাশ-বাহান্নর ভদ্রলোক ঘরে ঢুকিয়া একটু বিস্ময়ের সঙ্গে কাজলের দিকে তাকাইলেন।
কাজল দাঁড়াইয়া নমস্কার করিয়া বলিল–আমি একবার মিঃ রায়চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে চাই—
প্রতিনমস্কার করিয়া ভদ্রলোক বলিলেন–আমিই বিমলেন্দু রায়চৌধুরী। কী দরকার বলুনতো? আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি বলে মনে হচ্ছে-বসুন!
বসিয়া কাজল বলিল—আমাকে বোধহয় কোথাও দেখেন নি। এবার কাশীতে আসার সময় ট্রেনে একজন সাংবাদিক ভদ্রলোকের সঙ্গে আপনার আলাপ হয়েছিল, তার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে আসছি–
বিমলেন্দু বলিলেন—ট্রেনে! ওঃ হ্যাঁ, নির্মল চট্টোপাধ্যায় বলে এক ইয়াং ভদ্রলোক-তাঁর কাছ থেকে ঠিকানা পেয়েছেন? আমি কী আপনার কোনও কাজে আসতে পারি?
কথা বলিতে বলিতে কাজল ভদ্রলোককে লক্ষ করিতেছিল। প্রৌঢ়ত্বের প্রথম ধাপে দাঁড়াইয়াও মানুষটি দেখিতে আশ্চর্য রকমের সুন্দর। যৌবনেও লোকে এত রুপবান হয় না। কাব্যে নারীসৌন্দর্যের জয়গান আছে, কিন্তু পুরুষও যে এত সুন্দর হইতে পারে তাহা সে এই প্রথম দেখিল।
কাজল বলিল—আমি কোনও কাজ নিয়ে আপনার কাছে আসিনি, কেবল একটা বিষয় জানবার খুব কৌতূহল হওয়ায় এসেছি। সেদিন ট্রেনে আপনি আর নির্মলবাবু সাহিত্যিক অপূর্বকুমার রায়ের প্রসঙ্গে আলোচনা করছিলেন, তাই না? আপনি বলেছিলেন অপূর্ব রায়ের সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, সেই পরিচয়ের ব্যাপারটা আমি একটু জানতে চাই–
বিমলেন্দু বলিলেন—আপনিও কী সাংবাদিক? আর্টিকেল লিখবেন?
–আজ্ঞে না।
–তবে? এ প্রসঙ্গে আপনার উৎসাহের কারণ কী?
কাজল একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল—আমি অপূর্বকুমার রায়ের ছেলে, আমার নাম অমিতাভ রায়।
বিমলেন্দু প্রথমে স্থির হইয়া বসিয়া রহিলেন, যেন কাজল কী বলিয়াছে তিনি শুনিতে পান নাই। তাহার পর তাহার মুখের উপর দিয়া পরপর অনেকগুলি ভাবের ঢেউ খেলিয়া গেল। সটান দাঁড়াইয়া উঠিয়া তিনি বলিলেন—আপনি—তুমি অপূর্ববাবুর ছেলে! অই তোমাকে দেখে প্রথমেই তোমাকে কেউ বলেনি তোমার চেহারা অবিকল তোমার বাবার মতো? কেবল মনে হচ্ছে কোথায় দেখেছি—এখন বুঝলাম। এই বয়েসে তোমার বাবা ঠিক এইরকমই দেখতে ছিলেন। তুমি কাশীতে কী করছো?
বেড়াতে এসেছি। ছোটবেলায় বাবা কাশীতে থাকতেন জানেন বোধহয়, বাবার ডায়েরি থেকে ঠিকানা পেয়ে সে বাড়িটা দেখতে এসেছিলাম। সেখানেই তো নির্মলবাবুর সঙ্গে পরিচয়। উনি আপনার কথা বললেন–
বিমলেন্দু অস্ফুটস্বরে বলিলেন—কী আশ্চর্য যোগাযোগ! আমার সঙ্গে ট্রেনে নির্মলবাবুর আলাপ হওয়া, তোমার কাশী আসা–আবার তোমার সঙ্গে নির্মলবাবুর দেখা হওয়া—জানো, এইসব কারণে মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয় ভগবান আছেন।
কাজল বলিল–কিন্তু আপনার সঙ্গে বাবার পরিচয় কীভাবে হয়েছিল তা তো বললেন না?
প্রশ্নটা শুনিয়া বিমলেন্দু কিছুক্ষণ কাজলের দিকে তাকাইয়া রহিলেন, তারপর বলিলেনতোমার বাবার প্রথম উপন্যাসখানা যে আত্মজীবনীমূলক সেটা নিশ্চয় জানো?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
—তাতে লীলা বলে একজনের কথা আছে জানো?
কাজলের বুকের মধ্যে রক্ত চলকাইয়া উঠিল, সে বলিল–জানি।
–লীলা আমার দিদি।
কাজলের মাথার ভিতর কেমন করিয়া উঠিল। লীলার ভাই বিমলেন্দু! তাই বটে, বাবার বইয়েও নাম বিমলেন্দুই আছে। লীলা! বাবার উপন্যাস পড়িয়া, ডায়েরি পড়িয়া কাজল বুঝিয়াছে লীলার সহিত তাহার বাবার কী গভীর সম্পর্ক ছিল। রক্তমাংসের মানব-মানবীর সাধারণ পারস্পরিক আকর্ষণ নয়, তাহা হইতে অনেক উচ্চস্তরের এক সম্পর্ক—বোঝা যায়, কিন্তু বোঝানো যায় না। সেই লীলার ভাই ইনি!
কাজল অগ্রসর হইয়া বিমলেন্দুকে প্রণাম করিল।
হৃদয়াবেগ কিছুটা প্রশমিত হইলে বিমলেন্দু বলিলেন—অপূর্ববাবু বিয়ে করেছেন জানতাম, কারণ বিয়ের পর একবার আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এই বাড়িতেও উনি এসেছেন–তোমার মায়ের মৃত্যুর পর। কিন্তু তোমার কথা উনি আমাকে বলেন নি। তুমি কী করছে এখন?
—আমি এইবার এম.এ. দেব। ইংরিজিতে—
–বাঃ, খুব ভালো কথা। তারপর কী করবে কিছু ভেবেছো?
কাজল সসংকোচে জানাইল—এ বিষয়ে সে কোনও সিদ্ধান্ত নেয় নাই।
কিছুক্ষণ কথা বলিবার পর বিমলেন্দু বলিলেন–বোসো একমিনিট, তোমার জন্য একটু জলখাবারের কথা বলে আসি–
কাজল আপত্তি করিতে যাইতেছিল, বিমলেন্দু তাহাতে কর্ণপাত না করিয়া ভিতরে চলিয়া গেলেন। মিনিট-দুই পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন—বাড়িতে যা রয়েছে তাই দিতে বললাম। এ বাড়ি আমার মায়ের, বৃদ্ধা অবস্থায় মা মারা গিয়েছেন আজ মাসদুই হল। আমি তখন বিলেতে, আমার ফিরে আসতে আসতে শ্রাদ্ধশান্তি সব চুকে গিয়েছিল। আমি হচ্ছি ডিজাইনিং আর্কিটেক্ট, বুঝলে? একটা কনট্রাকটর চাকরি নিয়ে বিলেত গিয়েছিলাম, তার মেয়াদ ফুরোতে এখনও বছর-দুই বাকি। সামনের মাসেই আমি আবার ফিরে যাচ্ছি লন্ডনে, এবার একেবারে চাকরি শেষ করে তবে ফিরব। এ বাড়ি ততদিন তালাবন্ধ থাকুক, পরে যাহোক ব্যবস্থা করা যাবে।
এইসময় জলখাবারের থালা হাতে ঘরে ঢুকিল আঠারো-উনিশ বৎসর বয়েসের একটি মেয়ে। ভদ্রতাবিরুদ্ধ হয় বলিয়া কাজল একবার তাকাইয়াই চোখ নামাইয়া লইল বটে, কিন্তু তাহার ইচ্ছা হইতে লাগিল আর একবার তাকাইয়া দেখে। মেয়েটি ভারি সুন্দরী, গাঢ় বেগুনী রঙের শাড়ি চাপাফুল গাত্রবর্ণের সঙ্গে মানাইয়াছেও ভালো।
বিমলেন্দু বলিলেন—খাবার টেবিলে রাখ, তারপর একে প্রণাম কর—এ আমাদের পরিবারের খুব পুরোনো বন্ধুর ছেলে, আমাদের আপনার লোক।
মেয়েটি সলজ্জ ভঙ্গিতে আগাইয়া আসিয়া কাজলকে প্রণাম করিল। প্রণাম পাইবার অভ্যাস নাই, অভিজ্ঞতাটা এতই অভিনব যে বাধা দিবার আগেই ঘটিয়া গেল।
প্রণাম করিয়া উঠিবার সময় মেয়েটি চোখ নিচু করিয়া ছিল, কাজল লক্ষ করিল মেয়েটির চোখের পাতা আশ্চর্যরকম লম্বা।
বিমলেন্দু বলিলেন—এ হচ্ছে তুলি, দিদির মেয়ে।
উদ্বেগ, অজানা কী এক আবেগে কাজলের গলার কাছে গুটলি-গুটলি কী যেন আটকাইয়া যাইতে লাগিল। লীলার মেয়ে। ছোটবেলায় বাবার ডায়েরিতে ইহারই সঙ্গে তাহার বিবাহের প্রসঙ্গে বাবার ইচ্ছার কথা সে পড়িয়াছে। না না, ও কথা মনে রাখা উচিত নয়। সে অনেকদিনের কথা, সেসব কথা নিশ্চয় বাবা কাহাকেও বলে নাই, কেবল ডায়েরিতে লিখিয়াছিল মাত্র।
সাম্প্রতিক মানসিক দুর্যোগ এড়াইবার জন্য সে খাবারের প্লেটটা হাতে তুলিয়া যা হোক একটা কী হাতে লইয়া খাইতে শুরু করিল।
বিমলেন্দু বলিলেন–তুলি, তুই একটু অমিতাভর কাছে বোস। আমি লালুয়াকে কয়েকটা চিঠি পোস্ট করতে দিয়ে আসি, এরপর আবার ডাক ধরতে পারবে না
বিমলেন্দু চলিয়া গেলেন। মেয়েটি দাঁড়াইয়া ছিল, কাজল বলিল–দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? বসুন না! আমার পরিচয়টা না দিয়েই অবশ্য আপনার মামা চলে গেলেন
টেবিলের অপর দিকে একটা চেয়ারে বসিয়া তুলি বলিল–আমি মামার কাছে শুনেছি।
ইউনিভার্সিটিতে নিমন্ত্ৰণবাড়িতে কাজল সুন্দরী মেয়ে কম দেখে নাই, কিন্তু তুলির দিকে ভালো করিয়া তাকাইয়া কাজল অবাক হইয়া গেল। ভালো করিয়া দেখিতে বাধা নাই, তুলি চোখ নিচু করিয়া আছে। একমাথা ঘন চুল, যেন শিল্পীর আঁকা দুই ভূ, পুরন্ত ঠোঁটের নিচে চিবুকের সুন্দর খাঁজ, তাছাড়ানাঃ, এভাবে কোনও বিচার হয় না, আসলে মেয়েটির এমন একটা শ্ৰী আছে যাহা বুঝাইয়া বলা যায় না-বুঝিতে গেলে দেখিতে হয়। নিজের সমস্ত উপস্থিতির দ্বারা মেয়েটি অনন্য।
কাজল বলিল—মামার কাছে কী শুনেছেন? আমাদের সম্বন্ধে আগে জানতেন আপনি?
তুলি তাহার ডাগর শান্ত চোখ তুলিয়া বলিল—আমি-আপনার বাবাকে দেখেছি। তখন আমি খুব ছোট, এই বাড়িতে। ওঁর সব বই আমার অনেকবার করে পড়া–
তারপর আবার চোখ নামাইয়া বলিল—আমাকে আপনি বলবেন না–
খাবারের শূন্য প্লেট নামাইয়া কাজল বলিল–বাবার কোন্ বইটা তোমার সবচেয়ে ভালো লাগে?
সব বই-ই ভালো লাগে। তবে সবচেয়ে ভালো লাগে ওঁর লেখা প্রথম বইখানা।
পরে একটু বিষয় হসিয়া বলিল—ওতে আমার মায়ের কথা আছে—
তুলির বিষণ্ণ হাসিটা কাজলের হৃদয়ের মর্মস্থানে আঘাত করিল। বেচারা! ও নিশ্চয় নিজের মায়ের শূন্যতাময়, ব্যর্থ জীবনের কথা জানে। সে বলিল—তুমি কী এইখানেই থাকো?
-হ্যাঁ। দিদিমা এই বাড়িতে থাকতেন, মা মারা যাবার পর দিদিমার কাছেই আমি মানুষ হয়েছি। দিদিমাও মারা গিয়েছেন আজ দু-মাস। এবার হয়তো কলকাতা চলে যাব
-ভবানীপুরের বাড়িতে থাকবে?
তুলি অবাক হইয়া তাকাইল—ভবানীপুরের বাড়ির কথা আপনি জানেন?
-জানি। বাবার ডায়েরিতে পড়েছি। তোমাদের-তোমার মায়ের অনেক কথা আছে তাতে–
তুলি আগ্রহের সঙ্গে বলিল—মায়ের কথা। আমাকে সে ডায়েরি একবার পড়াবেন?
-বেশ তো। তুমি কলকাতায় গিয়ে তোমাদের ঠিকানা আমাকে জানিও, আমি তোমাকে পড়তে দিয়ে আসবো। আমার ঠিকানা তোমার মামার কাছে দিয়ে যাচ্ছি।
তুলি ঘাড় কাত করিয়া সম্মতি জানাইল, তারপর বলিল—ভবানীপুরের বাড়ি কিন্তু আর নেই, বিক্রি হয়ে গিয়েছে। বড়োমামার কথা জানেন কিনা, তব নাম রমেন, তিনি নানারকম বদখেয়ালে সমস্ত সম্পত্তি নষ্ট করে ফেলেছেন। কেবল বর্ধমানের বাড়িটা আছে, তাও হয়তো শিগগিরই দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে যাবে। ছোটমামা, এই মামা, তিনি কিছু নেন নি। পড়াশুনো করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। আপনার বাবার বইতে আমাদের কথা যেমন পড়েছেন, আমরা এখন কিন্তু আর তেমন নেই—এখন আমরা গরিব হয়ে গিয়েছি।
কাজল বলিল—আমাকে তুমি এসব কথা বলছো কেন তুলি? আমাদের সঙ্গে তোমাদের সম্পর্কটা অন্যরকম, তোমরা গরিব কি বড়োলোক তাতে কিছু এসে যায় না।
পরে আলোচনার মোড় অন্যদিকে ফিরাইবার জন্য বলিল—তুমি পড়াশুনো করো তো?
–ছোটবেলায় স্কুলে পড়েছি, বড় হবার পর বাড়িতে মাস্টারমশাই এসে পড়িয়ে যান। এখানে বাঙালি মেয়েদের পড়বার মতো তেমন ভালো ইস্কুল নেই কিনা। ইচ্ছে আছে এইবারে কলকাতায় কোথাও ভর্তি হয়ে ম্যাট্রিকটা দিয়ে দেব–
এইসময় বিমলেন্দু ফিরিয়া আসিলেন।–তোমার খাওয়া হয়ে গিয়েছে দেখছি, চা খাবে? কাজল জানাইল-এইসময়ে সে চা খায় না।
—তুমি আসায় আমি যে কত খুশি হয়েছি তা বলতে পারি না। দেখা যখন হল, এবার থেকে মোগাযোগ রাখবে, কেমন? তোমার ঠিকানাটা দাও দেখি–
কাজল নিজের ঠিকানা লিখিয়া দিয়া বিমলেন্দুকে বলিল—আপনার ঠিকানাটা?
—আমি কিছুদিনের মধ্যেই কাশী থেকে চলে যাচ্ছি, কলকাতায় কোথায় উঠব এখনও কিছু ঠিক হয়নি। মাসখানেকের মধ্যে চিঠি দিয়ে তোমাকে জানাব–
বিদায় দিতে আসিয়া ফটকের কাছে বিমলেন্দু বলিলেন—অনেক কথা তোমায় বলবার আছে, বাবাকে তুমি বেশিদিন পাও নি, তোমারই দুর্ভাগ্য। আর একটু বেশি বয়েস পর্যন্ত তার সাহচর্য পেলে সেটা তোমার জীবনের অক্ষয় সৌভাগ্য হয়ে থাকত। অমিতাভ, আমি জোর গলায় বলছি—অমন মানুষ হয় না। সে সব কথা একদিন তোমাকে বলব–
—আপনি আর কদিন আছেন কাশীতে?
—দিন-পনেরো খুব বেশি হলে। তুমি?
–আমার তেমন কিছু ঠিক নেই, তবে হপ্তাখানেকের বেশি হয়ত্বে থাকবো না—
বিমলেন্দু বলিলেন–সন্ধের দিকে আমি রোজই একবার দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে বেড়াতে যাই। ওখানে যদি ওইসময়ে কখনও আসে, তাহলে দেখা হতে পারে।
ধর্মশালায় ফিরিতে ফিরিতে কাজলের মনে হইল আকাশ-বাতাসের রঙ যেন বদলাইয়া গিয়াছে। এক ধরনের ঘটনা আছে, যাহা ঘটিয়া গেলে জীবনের অর্থ সম্পূর্ণ বদলাইয়া যায়—কিছুই আর যেন পুর্বের মতো থাকে না। তুলির সহিত দেখা হওয়াটা ঠিক সেইরকমের ঘটনা। ডায়েরিতে বাবার গৃঢ় ইচ্ছাটা পড়িয়া থাকিবার জন্যই হোক বা প্রথম যৌবনের আশীর্বাদপূত অলৌকিক বয়েসে সুন্দরী একটি মেয়ের সহিত পরিচয় ঘটিয়া যাইবার জন্যই তোক, তাহার ভিতরে এতদিনকার ঘুম ভাঙিয়া কে যেন জাগিয়া উঠিল। সবই ঠিক আছে, সে সেই পুরাতন অমিতাভই রহিয়াছে, তবু সে যেন ঠিক পুরাতন মানুষটা নহে।
রাত্রিতে বিছানায় শুইয়া ঘুম আসিতেছিল না। ধরমদাস আর রামচরণ আজ নৌকায় করিয়া রামনগর গিয়াছিল। সেখানকার রাজবাড়ি দেখিতে যাইবার পথে এক সাধুর দর্শন পায়। সেই গল্প ধরমদাস উৎসাহের সহিত করিয়া চলিয়াছে। খুব ভারি সাধু, কেবল মুখের দিকে তাকাইয়া ভূতভবিষ্যৎ বলিয়া দিতে পারেন, হাত অবধি দেখিবার প্রয়োজন বোধ করেন না। ধরমদাসের যে বর্তমানে সময়টা ভালো যাইতেছে না, আর রামচরণের ছোটবেলায় বসন্ত হইয়াছিল—এসব তো তাহারা গিয়া বসিবামাত্র বলিয়া দিলেন। অনেক ভাগ্যে এমন সাধুর দর্শন মেলে।
শুনিতে শুনিতে কাজল অন্যমনস্ক হইয়া গেল। তুলিকে তাহার এত ভালো লাগিল কেন? সুন্দরী বলিয়া? কিন্তু সুন্দরী মেয়ে তো সে অনেক দেখিয়াছে—অবশ্য তুলি সত্যই অদ্ভুত সুন্দরী, তাহার দেখা অনেকের অপেক্ষা বেশি, তবু বোধহয় কেবল বাহিরের সৌন্দর্য তাহাকে মুগ্ধ করে নাই। লীলার মেয়ের সহিত তাহার বিবাহ হইবার যে সম্ভাবনার কথা বাবা ডায়েরিতে প্রকাশ করিয়াছে সেই মধুর সম্ভাবনার ইঙ্গিত মনের জানালা দিয়া তাহার চেতনার গভীরে প্রবেশ করিবার উদ্যোগ করিল। আর একটা বড়ো কারণ—তুলির বর্তমান জীবনের অসহায়তা। লীলার হীরক রায়ের সঙ্গে গৃহত্যাগের ঘটনা কাজল জানে, তাহা লইয়া সমাজে বিশ্রী ঘোট হইয়াছিল তাহাও তাহার অজানা নাই। সত্যই তুলির বিবাহ হওয়া কঠিন। যতই সুন্দরী হোক, অমন মায়ের মেয়েকে কেহ গৃহবধূ করিয়া ঘরে তুলিয়া লইবে না। কিন্তু বাবার বই পড়িয়া মনে মনে সে লীলাকে দেবীর আসনে বসাইয়াছে। মনের দেবমন্দিরে প্রতিষ্ঠিত সেই মূর্তির গায়ে কোনো কলঙ্কের দাগ পড়িতে পাবে না। সমাজ যাহাই বলুক, লীলাকে বিচার করিবার দায়িত্ব তাহার উপর ন্যস্ত নাই, সে অধিকারও তাহার নাই।
অকস্মাৎ তাহার চমক ভাঙিল। নাঃ, মনে একটা গুরুতর পরিবর্তন আসিয়াছে বটে! এতক্ষণ ধরিয়া সে কেবলই তুলির কথা চিন্তা করিয়াছে, অথচ গতকাল এইসময়ে শুইয়া সে মায়ের কথা ভাবিতেছিল। জীবন এমনভাবেও বদলায়!
ধরমদাস এবং রামচরণের নিকট হইতে বিদায় লইয়া চারদিন পর কাজল দিল্লির ট্রেন ধরিল। ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস তাহাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে। মহাভারতের যুগ হইতে দিল্লি ভারতীয় সংস্কৃতি এবং প্রাণস্রোতের প্রধান কেন্দ্র, তাহা দেখা না হইলে দেশের ইতিহাস অজানা থাকিয়া যাইবে।
দিল্লি পৌঁছিয়া কাজল লাল দরওয়াজার কাছে একটা ভদ্র অথচ কম খরচের বাঙালি হোটেল খুঁজিয়া বাহির করিল। মালিকের নাম তিনকড়ি দাস, মধ্যবয়স্ক এবং অতীব বিনয়ী। দুই হাত ঘষিয়া তিনি বলিলেন–ছাত্র কিনা? বেড়াতে এসেছেন? দেখুন ঠিক ধরেছি! আপনার বয়েসী বাঙালি যাত্রী যাঁরা দিল্লি বেড়াতে আসেন তারা অধিকাংশই আমার এখানে ওঠেন কিনা। তা যাই হোক, চাকর আপনার ঘর দেখিয়ে দিচ্ছে, মান-টান সেরে বিশ্রাম করে খেয়ে নিন, তারপর টানা একখানা ঘুম দিন। ওবেলা কাছাকাছি দু-একটা জায়গা ঘোরবার ব্যবস্থা করে দেব। কাল থেকে সত্যিকারের বেড়াবেন–
হোটেলের অপর একদল অতিথির সহিত তিনকড়িবাবু তাহার টাঙায় ঘূরিবার আয়োজন করিয়া দিলেন। ব্যবস্থাটা বিশেষ মনঃপূত না হওয়া সত্ত্বেও কাজল মানিয়া লইল। ধরমদাস এবং রামচরণ বরং সঙ্গী হিসাবে ইহাদের অপেক্ষা ভালো ছিল, তাহারা অশিক্ষিত হইলেও সরল এবং উদার। এই বাঙালি পরিবারটির ক্রমাগত লম্বা-চওড়া কথায় আর চালবাজিতে কাজল অবিলম্বে বিরক্ত হইয়া উঠিল। কুতবের পাশে ইলাহি মিনার দেখিয়া এবং পরে পুরানা কিল্লার পাশে দাঁড়াইয়া দলের একজন বলিলেন–নাঃ, এই ভাঙাচোরা ইট-পাথরের স্তূপ দেখতে লোকে এত পয়সা খরচ করে বেড়াতে আসে কেন বুঝি না! হুমায়ুনের কবরটা তবু ভালো—
কাজল থাকিতে না পারিয়া বলিল—দেখুন, ঐতিহাসিক নগরী তো আর সবটা হীরে-মুক্তো দিয়ে গাঁথা হবে না, এর ইতিহাসটাই আসল। এখানে দাঁড়িয়ে আপনার পুরোনো দিনের কথা ভেবে অবাক লাগছে না?
লোকটি মৃদু বিদ্রূপের হাসি হাসিয়া বলিল—কী জানি মশাই, আপনারা হলেন একালের লেখাপড়া জানা আধুনিক মতের ছেলে, আমরা চোখের ভালো লাগাটাকে অনেক দাম দিইএককাড়ি টাকা খরচ করে ফ্যামিলি নিয়ে এলুম কী এই দেখতে? এর চেয়ে আমাদের কলকাতায় ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল কিংবা পরেশনাথের মন্দির খারাপ কী?
কাজল কথা বাড়াইল না। এ ধরনের কল্পনাশক্তির লেশহীন মানুষ সে আরও কয়েকজন দেখিয়াছে। ইহাদের বুঝাইবার চেষ্টা করা বৃথা। বাল্যসঙ্গী চনুর কথা মনে পড়ে। জ্যোৎস্নারাত্রিতে তাহার কোনও বিচিত্র অনুভূতি হয় কিনা জিজ্ঞাসা করাতে সে অবাক হইয়া না-বুঝিবার দৃষ্টিতে তাকাইয়া ছিল। সেই প্রথম শিশুবয়েসের অপরিণত বুদ্ধিতেও কাজল পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের চিন্তাধারার সহিত তাহার পার্থক্য আরছা আন্দাজ করিয়াছিল। বড়ো হইয়া উঠিবাব সঙ্গে সঙ্গে সে বুঝিতে পারিয়াছিল তাহার জীবন খুব সুখের হইবে না। মানুষ কেবলমাত্র খাইয়া-পবিয়া বাঁচে না, তাহার মনের সঙ্গীব প্রয়োজন হয়। আর নিজের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে কাজল বুঝিয়াছে-তেমন সঙ্গী পৃথিবীতে খুবই কম।
হুমায়ুনের সমাধি দেখিতে গিয়া তাহার খুবই ভালো লাগিল। তখন বিকাল হইয়া আসিয়াছে। নির্জন নিজামউদ্দিন দিনাবসানের শান্ত ছায়ায় ঝিমাইতেছে। একজন বৃদ্ধ মুসলমান গাইড তাহাদের সবকিছু ঘুরিয়া দেখাইল। হুমায়ুনের পাথরে বাঁধানো কবর দেখাইয়া বৃদ্ধটি বলিল—এটা কিন্তু নকল কবর বাবু, আসল কবর রয়েছে এর নিচে, মাটির তলায়, যাবেন?
সঙ্গীরা কেহ রাজি হইল না। অজানা জায়গা, তাহার উপর নিজামউদ্দিন এমনিতেই নির্জন স্থান, অপরিচিত মুসলমান বৃদ্ধের সহিত মাটির নিচে তিনশত বৎসর পূর্বে মরিয়া ভূত হইয়া যাওয়া মোগল সম্রাটের সমাধি দেখিতে যাইবার উৎসাহ নাই কাহারও। কাজল একাই চলিল। আসল সমাধিতে পৌঁছিতে হইলে স্মৃতিসৌধের ভিত্তির নিচে একটি সুড়ঙ্গ দিয়া অনেকটা পথ যাইতে হয়। সুড়ঙ্গের মধ্যে ঘোর অন্ধকার, পথপ্রদর্শক বৃদ্ধটি একটি ছোট দুই-পয়সা দামের মোমবাতি জ্বালাইয়া হাতে লইয়াছে। পায়ের নিচে জমি উঁচুনিচু, সর্বত্র সমান নহে, সাবধানে না চলিলে হোঁচট খাইবার সম্ভাবনা। অনেকগুলি বাঁক পার হইয়া বৃদ্ধ তাহাকে পথ দেখাইয়া লইয়া চলিল। শেষে একটি অন্ধকার, বাদুড়ের ডানার শব্দে পূর্ণ চতুষ্কোণ ছোট্ট ঘরে আসিয়া যাত্রা শেষ হইল। অনাড়ম্বর একটি কবর দেখাইয়া বৃদ্ধ বলিল—য়হ বাদশা হুমায়ুন শোয়ে হয়ে হে
কাজল যুক্তকরে নমস্কার করিল। কে জানে হুমায়ুন প্রকৃতপক্ষে মানুষ হিসাবে কেমন ছিলেন, প্রণামের যোগ্য ছিলেন কিনা! তাহার প্রণাম প্রাচীনত্বের প্রতি, একজন স্বাধীন সম্রাটের প্রতি। বৃদ্ধ মুসলমান কাজলের প্রণাম লক্ষ করিয়া খুশি হইয়াছিল, উৎসাহের প্রাবল্যে সে ফিরিবার পথে উর্দুতে মোগল আমলের কত ইতিহাস শানাইতে লাগিল। কাজল তাহার কিছু বুঝিল, কিছু বুঝিল না।
দলের সকলে বাহির হইবার মূল দরজার কাছে অপেক্ষা করিতেছিল। কাজলকে অক্ষতদেহে সুড়ঙ্গ হইতে বাহির হইতে দেখিয়া তাহারা যেন ভারি অবাক হইল। টাঙায় উঠিয়া দলের চালাক সদস্যটি বলিল—ধন্য আপনার সাহস মশায়! কী বলে একটা অচেনা মুসলমানের সঙ্গে ওই অন্ধকূপে ঢুকলেন? জানেন, ওরা আগে থেকে ওইসব জায়গায় গুপ্তা বসিয়ে রাখে, তারপর নিরীহ যাত্রীকে ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে তার টাকাকড়ি কেড়ে নেয়—দিতে আপত্তি করলে ছুরি মারে!
কাজল হাসিয়া বলিল–মুসলমান মানেই খারাপ লোক নয়, যেমন হিন্দুরা সবাই দেবতুল্য নয়। তাছাড়া আমার কাছে ছিলই বা কত? মেরে ওদের লাভ কী? বরং ভয় করলেন বলে ভালো একটা জিনিস দেখা থেকে বাদ পড়লেন
ভদ্রলোকের মুখ দেখিয়া মনে হইল কাজলের কথা তাহার মনে ধরে নাই। তিনি বলিলেন— তা হোক মশাই, তবু ওদের বিশ্বাস নেই—
কাজল চুপ করিয়া রহিল।
হোটেলে ঢুকিতেই তিনকড়ি দাস বলিলেন—এই যে সব ফিরেছেন দেখছি। তা বেড়ানো কেমন হল বলুন? ভালো লাগছে দিল্লি শহর?
কাজল বলিল—ভাল লাগছে বইকি। ছোটবেলা থেকে ইতিহাসের বইতে যা পড়েছি সে-সব চোখের সামনে দেখলে রীতিমতো রোমাঞ্চ হয়
-আর অমরবাবু? আপনার?
অমরবাবু অর্থাৎ কাজলের সঙ্গী সেই ভদ্রলোক, বিবক্তমুখে চুপ করিয়া রহিলেন। কাজল বলিল—ওঁর বোধহয় বিশেষ ভালো লাগছে না। কুতবের চাইতে নাকি ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল ভালো
অমরবাবু রাগিয়া বলিলেন–কথা ঘোরাবেন না, কুতবের কথা আমি মোটেই বলিনি, ভাঙা ইটের গড়টার কথা বলেছি
তিনকড়িবাবু সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কাজলের দিকে তাকাইতে সে বলিল—পুরানা কিল্লা ওঁর পছন্দ হয়নি।
খরিদ্দার লক্ষ্মী এবং খরিদ্দার সবসময়ই সঠিক—তাহার সহিত তর্ক করিতে নাই, ইহাই ব্যবসার মূলমন্ত্র। কাজেই তিনকড়িবাবু অচিরাৎ প্রসঙ্গ বদলাইয়া বলিলেন—যান, আপনাবা ফ্রেশ হয়ে নিন, আজ শনিবার—প্রতি শনিবাব আমাদের হোটেলে স্পেশাল ফিস্ট হয়। আজ পোলাও হচ্ছে, সঙ্গে এলাহাবাদের বড়ো বড়ো পাবদা মাছের তেলঝাল, কষা মাংস, মাছের পুর দিয়ে পটলের দোলমা। শেষপাতে রাবড়ি-কেমন?
অমরবাবু সুরুৎ করিয়া শব্দ করিযা সপরিবারে দোতলায় নিজের ঘরের দিকে চলিয়া গেলেন। কাজল বলিল—এতসব আয়োজন করেছেন, প্রতি শনিবাবেই হয় নাকি?
হয়, তবে এতটা নয়। মাংস আর পোলাওটা করবার চেষ্টা করি মাঝে মাঝে, যখন অনেক বাঙালি অতিথি থাকে তখন একটু ভালো রান্নাবান্না হয়। বসুন, দুটো কথা বলা যাক—সিগারেট চলে?
তিনকড়ি দাস কাজলকে একটা কঁচি সিগারেট দিয়া নিজেও একটা ধরাইলেন।
–বসুন ভালো করে। আজ থেকে বাইশ বছর আগে পেটের ধান্দায় ঘুরতে ঘুরতে দিল্লি এসে পৌঁছেই, বুঝলেন? হুগলী জেলার তারকেশ্বরের কাছে এক গ্রামে আমার আদি বাড়ি। বাপ-মা মারা গেলেন হোটবেলাতেই, জমিদার মহাজন এসে ঘরবাড়ি, জমি আর গরু ক্রোক করে নিয়ে গেল দেনার দায়ে। কে জানে সত্যি দেনা ছিল কিনা, আমি তখন ছোট, কে আর দেখতে গিয়েছে? কোনও আত্মীয়স্বজন আমাকে রাখলেন না মশাই, বুঝলেন? কে যেচে পরের হ্যাপা ঘাড়ে নেয়? চাকরের কাজ করে, জুতো পালিশ করে, কুলিগিরি করে পেট চালিয়েছি কবছর। তারপর ভাসতে ভাসতে এই দিলি।
-তারপর এই হোটেল দিলেন কী করে? মূলধন কোথায় পেলেন?
—সেও এক কাহিনী। এখানে ছিল একটা মিঠাইয়ের দোকান, এদেশি মেঠাই-বঁদের লাচ্ছু, ক্ষীরের বরফি এইসব। মালিকের নাম লোচন সিং। সে আমাকে ছোট কারিগরের কাজ দিল। আসল কারিগর যাকে সবাই ওস্তাদ বলে ডাকত সে জিনিসটা বানিয়ে দিত—আর আমি গোল করে পাকিয়ে দিতাম বা সাইজ মাফিক কেটে দিতাম। লোচন সিং-এর বৌ-ছেলেপুলে ছিল না, সব মরে গিয়েছিল, দোকানের পেছনের একটা ঘরে তার সঙ্গে আমি থাকতাম। কিছু মাইনে পেতাম আর তার কাজকর্ম করে দেবার জন্য খেতে পেতাম। দুবছর কাজ করার পর এই অঞ্চলে চেচকের মহামারী হয়। চেচক, বুঝলেন তো, বসন্ত। অনেকদিন দেশছাড়া, আমার কথার ভেতর আজকাল প্রায়ই হিন্দি ঢুকে যায়। একদিন লোচন সিং দোকান বন্ধ করে ঘরে এসে বলল—তবিয়ত ভালো লাগছে না, রাত্রে কিছু খাব না, তুই নিজের মতো অল্প রান্না কর।
দুদিন বাদে লোচন সিংয়ের গায়ে বসন্তের গুটি দেখা দিল। জলবসন্ত নয়—একেবারে আসল বসন্ত। ভয়ানক ছোঁয়াচে আর মারাত্মক জিনিস। খবর রটে যাওয়া মাত্র দোকানের অন্য দুজন কর্মচারী আর বড়ো কারিগর পালিয়ে গেল বাকি মাইনের মায়া না করেই। আমিও একবার ভাবলাম—যাই পালিয়ে। তারপর লোকটার দিকে তাকিয়ে মাযা হল। বেচারা! কেউ দেখবার নেই ওর—আমি সেবা না করলে বেঘোরে মারা যাবে। আমার বাবা খুব সেবাপরায়ণ লোক ছিলেন, ছোটবেলায় তাকে রাত জেগে টাইফয়েড বা কলেরার রোগীকে যত্ন করতে দেখেছি, তার ছেলে হয়ে অসুখের ভয়ে অন্নদাতাকে ফেলে পালিয়ে যাব? না, থেকেই গেলাম।
কী ভয়ানক অবস্থাই হল লোচন সিংয়ের সমস্ত গায়ে বড়ো বড়ো গুটি গলে একসঙ্গে মিশে দগদগে ঘা হয়ে গেল। মুখের মধ্যেও ঘা, জল পর্যন্ত খেতে পারে না। চোখ করমচার মতো লাল। সারাদিন বিকারের ঘোরে পাগলের মতো চিৎকার করছে। গা দিয়ে রস গড়াচ্ছে দরদর করে। শেষে সমস্ত শরীরের মাংস ফেটে ফেটে যেতে লাগল। আসল বসন্তের রোগী অনেক দেখেছি, কিন্তু এমন সাংঘাতিক দশা হতে দেখিনি কখনও। এর আগেও না, পরেও না। আমার তখন একটা নেশাগ্রস্ত অবস্থা। মনে ঘেন্না নেই, ভয় নেই, আপ্রাণ সেবা করছি মানুষটার। তুলো দিয়ে গড়িয়ে পড়া রস মুছিয়ে দিই, কবিরাজী তেলে ভেজানো ন্যাকড়ার পটি দিয়ে দিই ঘায়ের ওপরে-যন্ত্রণা আর কমে না।
একদিন বিকেলে লোচন সিং আমাকে ডেকে বলল–তিনু বেটা, পরমাতমার ডাক এসেছে, এবার আমাকে চলে যেতে হবে। তার আগে একটা কাজ করে যেতে চাই। তুমি গিয়ে মহল্লা থেকে কয়েকজন ভদ্রলোককে আমার নাম করে ডেকে আনো–
-কেন মালিক, লোক দিয়ে কী হবে?
–সে দেখতেই পাবে। যাও, দেরি কোরো না–
কেউ কী আসতে চায়? অনেক ঘুরে লোচন সিংয়ের যিনি চিকিৎসা করছিলেন সেই হেকিম সাহেব আর গঙ্গানাথ তেওয়ারী নামে একজন উকিলবাবুকে ধরে নিয়ে এলাম। তারা ঘরে ঢুকলেন, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন। লোচন সিং বিছানা থেকেই যতদূর সম্ভব গলা উঠিয়ে বললহেকিম সাহেব, ভকিলবাবু, ভগবান আমাকে ডেকেছেন—এবার আমি চলে যাব। আমার বালবাচ্চা কেউ নেই, চাকরবাকরও আমাকে ফেলে ভয়ে পালিয়েছে। কেবল এই বাঙালি লেড়কা আমাকে নিজের ছেলের চাইতেও বেশি সেবা করেছে। আমার এই দোকান আমি এক দিয়ে যেতে চাই। লেখালেখি করবার আর সময় নেই, আপনারা মহল্লার ইমানদার আদমি, আপনারা সাক্ষী রইলেনও যেন সম্পত্তির দখল নিতে পারে।
ওঁরা দু-জন রোগীকে আশ্বস্ত করে বিদায় নিলেন। সেদিনই মাঝরাত্তিরের একটু পরে লোচন সিং মারা গেল।
দু-একজন পাজী লোক মিঠাইয়ের দোকানের মালিকানা পাবার পথে বাধা সৃষ্টি করবার চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু হেকিম সাহেবের এক ধমকে সবাই ভয় পেয়ে থেমে গেল। পথের ভিখিরি আমি, সত্যি সত্যি একটা দোকানের মালিক হয়ে বসলাম।
কাজল মুগ্ধ হইয়া তিনকড়ি দাসের গল্প শুনিতেছিল। বিভিন্ন অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়া যে লোক ক্রমাগত নিজের আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের দিকে অগ্রসর হইতেছে, সে মানুষ যতই সাধারণ হউক না কেন, তাহার সহিত নেপোলিয়ন কিংবা কলম্বাসের বিশেষ পার্থক্য নাই। পার্থক্য কেবল সামাজিক প্রতিষ্ঠা এবং আর্থিক অবস্থার। কাজের উৎসাহ এবং সাফল্যের আনন্দ উভয়ের ক্ষেত্রেই এক।
সে প্রশ্ন করিল–মিঠাইয়ের দোকান হোটেল হল কী করে?
—প্রথম দুতিন বছর মিঠাইয়ের ব্যবসাই চলছিল। মাঝে মাঝে বাঙালি যাত্রী এসে অন্য কোথাও থাকবার সুবিধা না পেলে আমার দোকানে থাকতে চাইত। থাকতে দিতাম—যাবার সময় তারা ঘরের ভাড়া হিসেবে কিছু কিছু টাকা দিয়ে যেত। এইভাবে একটা খ্যাতি রটে যাওয়াতে এত বেশি অতিথি আসতে লাগল যে আস্তে আস্তে মিঠাইয়ের দোকান তুলে দিয়ে পুরোপুরি হোটেলের ব্যবসাতে নেমে পড়লাম। তা চলছে মন্দ নয়—
রাত্রের খাওয়া গুরুতর রকমের হইল। কাজল ভালো জিনিস খাইতে ভালোবাসে বটে, কিন্তু বেশি পরিমাণে খাইতে পারে না। তাহার পাশে বসিয়া অমরবাবু প্রাণের আনন্দে ভোজ খাইলেন। নিজের আহার শেষ করিয়া কাজল বহুক্ষণ বসিয়া অবাক বিস্ময়ে তাহার খাওয়া দেখিল। খাইতে খাইতে অমরবাবু অকারণ কৈফিয়তের সুরে বলিলেন—খেতে বসে লজ্জা করা কোনও কাজের কথা নয়। তাছাড়া এ তো হোটেল, পয়সা দিচ্ছি-খাওয়া বুঝে নিচ্ছি। কুটুমবাড়ির নেমন্তন্ন তো নয় যে লজ্জা করে খাব—
অমরবাবু যে প্রকৃতই কিছুমাত্র লজ্জা করিলেন না তাহা স্পষ্ট প্রমাণিত হইল। রাত্রে কিছুক্ষণ না পড়িলে কাজলের ঘুম আসে না। আজও সে হ্যাজলিটের টেবল্ টকখানা হাতে লইযা বিছানায় শুইল। সারাদিন ঘুরিয়া শরীর ক্লান্ত ছিল, কখন যে সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে তাহা সে নিজেই টেব পায় নাই। অনেক রাত্রিতে দরজায় ধাক্কাব শব্দে তাহার ঘুম ভাঙিল। বিছানা হইতে উঠিতে উঠিতে সে বলিল—কে?
নারীকণ্ঠে উত্তর হইল—একবার দরজাটা খুলুন না?
কাজল প্রথমটা বিস্মিত হইল, একটু ভয়ও হইল। এখানে সে বেড়াইতে আসিয়াছে, কেহ তাহাকে চেনে না। কোন মহিলা এত রাত্রে তাহার দরজায় ধাক্কাচ্ছে—শেষে একটা গোলমালে না জড়াইয়া পড়ে।
আবার দরজায় করাঘাত—দয়া করে তাড়াতাড়ি খুলুন, বড়ো বিপদ। সাহস করিয়া দরজা খুলিতেই কাজল অবাক হইয়া গেল। সামনে দাঁড়াইয়া অমরবাবুর স্ত্রী। কাজলকে দেখিয়াই তিনি বলিলেন–একবার আমাদের ঘরে আসবেন? আপনার দাদা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন
একটা শার্ট গলাইতে গলাইতে কাজল বলিল—ভয় নেই, চলুন যাচ্ছি। কী হয়েছে অমরবাবুর?
অশ্রুরুদ্ধ গলায় মহিলাটি বলিলেন কী জানি! শুয়ে বহুক্ষণ বকছিলেন, কিছুতেই ঘুমোন না। এই অল্প আগে থেকে বলছেন—দম আটকে আসছে, বুকে ব্যথা–কী হবে ভাই?
–কোনো ভয় নেই, চলুন যাই দেখি–
ঘরে ঢুকিয়া কাজল দেখিল খাটের উপর অমরবাবু শুইয়া বেজায় ছটফট করিতেছেন, মুখ বেদনায় বিকৃত। কপালে এবং সারা গায়ে সামান্য ঘাম। সে জিজ্ঞাসা করিল–কী হয়েছে? কী হচ্ছে আপনার?
উত্তরে অমরবাবু হাত দিয়া বুক দেখাইলেন।
কাজল মনে মনে ভয় পাইল। বুকে ব্যথা, নিঃশ্বাসের কষ্ট এবং গায়ে ঘাম লক্ষণগুলি ভালো নহে, হৃদরোগের ইঙ্গিত দেয়। তাহার বাবারও ঠিক এমনি হইয়াছিল। এই বিদেশে লোকটার হঠাৎ কিছু হইলে ইহার স্ত্রী-পুত্র এবং দলের অন্যান্যরা মহা বিপদে পড়িবে।
সে অমরবাবুর স্ত্রীকে বলিল—দিদি, আপনি বরং ওঁর বুকে হাত দিয়ে মালিশ করে দিন, আর মাথায় হাওয়া করুন। আমি তিনকড়িবাবুকে বলি একজন ভালো ডাক্তার ডেকে আনতে।
হোটলের কারবার করিলেও তিনকড়ি দাস আদ্যন্ত ব্যবসায়ী নহেন। ব্যাপার শুনিয়া অত রাত্রে তিনি নিজেই বাহির হইলেন ডাক্তার ডাকিতে। কাজল সঙ্গে যাইতে চাহিয়াছিল, তিনি বারণ করিলেন।
আধঘণ্টাখানেক বাদে তিনকড়ি ডাক্তার লইয়া ফিরিলেন। সাহেবী পোশাক পরা লম্বা মানুষটি, পেটা স্বাস্থ্য, ফরসা রঙ। মুখে একটা স্বাভাবিক সহৃদয়তার ছাপ রহিয়াছে। মিনিট দুই রোগীকে পরীক্ষা করিয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন—ইনি রাত্তিরের খাবার কী খেয়েছিলেন?
চিকিৎসকের কাছে সত্য গোপন করিয়া লাভ নাই, কাজল ডাক্তারকে অমরবাবুর নৈশাহারের আনুপূর্বিক বর্ণনা দিল। শুনিয়া ডাক্তার ব্যাগ হইতে ঔষধ বাহির করিতে করিতে বলিলেন—টারটার এমেটিক দিচ্ছি, এখুনি খুব বমি হতে শুরু করবে, মেয়েদের ভয় পেতে বারণ করুন
কথাবার্তা উর্দু এবং ইংরেজিতে মিশাইয়া হইতেছিল, ডাক্তারের বক্তব্য বুঝিতে না পারিয়া অমরবাবুর স্ত্রী কাজলের দিকে তাকাইলেন। কাজল ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইয়া দিতে তিনি কাঁদিয়া ফেলিয়া ডাক্তারের দিকে তাকাইয়া বলিলেন—আপনাকে বাবা বলে ডাকছি, আমি আপনার মেয়ে। আমার স্বামী বাঁচবেন তো?
ডাক্তার বলিলেন–ভয় নেই। বেশি পরিমাণে রিচ ফুড় খাওয়ায় অ্যাসিড আর গ্যাস ফর্ম করে এমনটা হয়েছে। বমি হয়ে গেলে অনেকটা রিলিফ পাবেন। নিন এটা খাইয়ে দিন
টারটার এমেটিকের প্রভাবে অমরবাবু অবিলম্বে ঘর ভাসাইয়া বমি করিতে শুরু করিলেন। বমি করিবার আবেগে দম আটকাইয়া আসে আর কী!
অমরবাবু প্রাণপণে ডাক্তারের হাত আঁকড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন–ডাক্তারবাবু, আমার শরীরের মধ্যে কেমন করছে, আমি আর বাঁচবো না–
ডাক্তার ততোধিক জোরে তাহার হাত চাপিয়া বলিলেন—ডোন্ট ওরি, আপনার কিছু হয়নি, বমি করতে থাকুন–
সব প্রলয়েরই সমাপ্তি আছে, কিছুক্ষণ ধরিয়া অনর্গল বমি করিবার পর অমরবাবু নিশ্রুপ হইয়া পড়িলেন। ডাক্তার ব্যাগ হইতে আর একটা কী ঔষধ তাঁহাকে খাওয়াইয়া কাজলকে বলিলেন—ইনি এখন ঘুমোবেন। আর ভয় নেই, আমি সকালে আবার এসে দেখে যাব–
অমরবাবুর স্ত্রী বলিলেন–বাবা, আপনার ভিজিট–
-ও সকালে এসে একেবারে নেব–
ডাক্তার বিদায় লইলে অমরবাবুর স্ত্রী বলিলেন—ভাই, আপনি ছিলেন বলে আজ খুব রক্ষে হল। আমি গেরস্তঘরের বৌ, কোনোদিন বিদেশে বেরুই নি, তারপর এসব জায়গার ভাষা মোটে বুঝিনে। আপনি না থাকলে–
কাজল বলিল—ওসব কথা বলবেন না। আপনাকে দিদি বলে ডেকেছি ভাই তো বোনের জন্য এটুকু করবেই
-দেখুন তো দেখি কী কাণ্ড! বরাবরই ওইরকম লোভী মানুষ, খেতে ভালোবাসেন। ভালো রান্নাবান্না হলে আর খেয়াল থাকে না। অম্বল, পেটের অসুখ আর বায়ুতে কষ্ট পান-কত বলি! বয়েস হচ্ছে, এবার একটু সামলে চল—তা কে কার কথা শোনে! তবে এত বাড়াবাড়ি কখনও হয়নি।
পরদিন সকাল আটটা নাগাদ ডাক্তার নিজেই কথামত আসিয়া হাজির। অমরবাবু কিছুক্ষণ হইল উঠিয়া সমবেত পরিজনের তিরস্কার সহ্য করিতেছেন। দেখিয়া ডাক্তার বলিলেন—ফাইন! এই তো রোগী উঠে বসেছে-কী মশায়, কাল রাত্তিরে সবাইকে অমন ভয় লাগিয়ে দিয়েছিলেন কেন? আর কখনও ঠেসে রি খাবার খাবেন না! খাবার অন্যের, শরীর তো আপনার নিজের না কী? অমরবাবুর স্ত্রী কিছু টাকা কাজলের হাতে খুঁজিয়া দিয়াছিলেন, সে তাহা দিতে গেলে ডাক্তার অমরবাবুর স্ত্রীর দিকে ফিরিয়া হাসিয়া বলিলেন–না, আপনি আমাকে বাবা বলে ডেকেছেন এমনিতে এই মহল্লায় আমি অনেক বোজগার করি, জামাইয়ের চিকিৎসা করে আর টাকা নেব না।
অমরবাবু চিঁ-চিঁ করিয়া বলিলেন—আপনি আমার প্রাণদাতা, আপনার নামটা তো জানা হল–আবার কখনও দিল্লি এলে দেখা করবো
ডাক্তার বলিলেন—আমার নাম মহম্মদ ইলিয়াস আজম।
ডাক্তার বিদায় লইলে কাজল মৃদু হাসিয়া অমরবাবুকে বলিল কী দাদা, তাহলে মুসলমান মাত্রেই খাবাপ লোক নয়, কী বলেন?
অমরবাবু লজ্জিত মুখে বললেন—আমার ভুল হয়েছিল ভাই। এক জায়গায় আটকে থাকা মানুষকে বড়ো ছোট করে দেয়। এইজন্যেই তো দেশভ্রমণ প্রয়োজন।