॥ ৮ ॥
ফেলুদাও প্রতিনমস্কার করল। ভদ্রলোক বললেন, ‘কাল সন্ধ্যায় কেভেনটার্সে সামান্য পরিচয় হয়েছিল আমাদের—আপনার মনে আছে বোধ হয়?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ—আপনার নাম ত হরিনারায়ণ মুখোপাধ্যায়?’
‘বাঃ, আপনার মেমরি ত বেশ শার্প দেখছি। তা, একটু বসতে পারি আপনাদের পাশে?’
‘নিশ্চয়ই।’
ফেলুদা ওর নিজের আর লালমোহনবাবুর মাঝখানে একটু জায়গা করে দিল। ভদ্রলোক বসলেন।
‘আপনি ত নয়নপুর ভিলার পাশেই থাকেন?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। উত্তর দিকের বাড়িটা আমার। আমি আছি এখানে প্রায় এগারো বছর।’
‘আপনার বাড়ির পাশেই ত একটা ট্র্যাজিডি হয়ে গেল।’
‘তা ত বটেই,’ বললেন ভদ্রলোক। ‘কিন্তু এর একটা আঁচ ত আগে থেকেই পাওয়া গেস্ল, তাই নয় কি?’
‘আপনার তাই মনে হয়?’
‘একথা বলছি কারণ বিরূপাক্ষ মজুমদারকে আমি অনেকদিন থেকেই চিনি। ঘনিষ্ঠ আলাপ ছিল বলতে পারি না, কারণ মজুমদার যে খুব মিশুকে লোক ছিলেন তা নয়। কিন্তু তাঁর বিষয়ে আমি জানি অনেকদিন থেকেই।’
‘কী করে জানলেন?’
‘আমি এককালে বছর দশেক ছিলাম মধ্যপ্রদেশের নীলকণ্ঠপুরে। আমার পেশা ছিল জিওলজি। ইট পাথর নিয়ে কারবার ছিল আমার। সেই নীলকণ্ঠপুরে একবার আসেন বিরূপাক্ষ মজুমদার। তখন ওঁর বয়স ছিল হয়ত পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ। শিকারের খুব শখ ছিল ভদ্রলোকের। নীলকণ্ঠপুরে রাজা পৃথ্বী সিং মজুমদারকে আমন্ত্রণ জানান তাঁর জঙ্গলে গিয়ে শিকার করার জন্য। পরস্পর আলাপ ছিল আগে থেকেই। এই দুই শিকারীর মধ্যে একটা মিল ছিল সেটা এই যে, কেউই মাচার উপর থেকে শিকার করতে চাইতেন না। এমনকি হাতির পিঠ থেকেও না। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল বীটারদের সাহায্য না নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সোজা হেঁটে গিয়ে বাঘ শিকার করা। এই শিকার থেকেই হয় এক চরম দুর্ঘটনা।’
‘কি রকম?’
‘বাঘের বদলে মানুষের উপর গুলি চালান বিরূপাক্ষ মজুমদার।’
‘সে কি!’
‘ঠিকই বলছি।’
‘মানে, কোনো স্থানীয় অধিবাসী-টাসী—?’
‘না। তাহলে ত তবু কথা ছিল। যিনি মরেছিলেন তিনি ছিলেন ভদ্রলোক এবং বাঙালি। নাম সুধীর ব্রহ্ম। বাঙালি হলেও বাপের আমল থেকে মধ্যপ্রদেশবাসী। পেশা ছিল নীলকণ্ঠপুর রাজ কলেজে ইতিহাসের প্রফেসারি, কিন্তু প্রচণ্ড শখ ছিল কবিরাজীর। রাজা এবং মজুমদার যে সময় বাঘ খুঁজছিলেন, সেই সময় ব্রহ্ম ঘুরছিলেন জঙ্গলে গাছড়ার অনুসন্ধানে। তাঁর গায়ে একটা গেরুয়া চাদর ছিল। একটা ঝোপের পাতা নড়তে দেখে আর ঝোপের ফাঁক দিয়ে গেরুয়া দেখে বাঘ ভেবে গুলি চালান বিরূপাক্ষ মজুমদার। সে গুলি গিয়ে লাগে সুধীর ব্রহ্মের পেটে। তৎক্ষণাৎ মৃত্যু।
‘এ খবর যাতে না ছড়ায় তার জন্য বিস্তর টাকা খরচ করতে হয়েছিল পৃথ্বী সিং-কে। আমি নিজে জানি, কারণ আমি ছিলাম ব্রহ্মের বন্ধুস্থানীয়। মজুমদার কলঙ্কের হাত থেকে পার পায় ঠিকই, কিন্তু সে যে অপরাধী, সে যে হত্যাকারী, বাঘ মারতে সে যে মানুষ মেরে ফেলেছিল তাতে ত কোনো সন্দেহ নেই! এই অপরাধের বোঝা বয়ে মানুষ কতদিন বেঁচে থাকতে পারে?’
‘আপনার কি মনে হয় এবার যে খুন হয়েছে তার সঙ্গে এই দুর্ঘটনার কোনো যোগ আছে?’
‘একটা ব্যাপার আছে। আপনি গোয়েন্দা, আপনি হয়ত বর্তমানে হত্যা নিয়ে ভাবছেন,তাই আপনাকে বলছি। সুধীর ব্রহ্মর একটি ছেলে ছিল, নাম রমেন ব্রহ্ম। এই দুর্ঘটনা যখন ঘটে তখন ছেলেটির বয়স ষোল। সে কিন্তু এই ধামা চাপা দেওয়ার ব্যাপারটাকে মোটেই বরদাস্ত করতে পারেনি। আমাকে কাকা বলে সম্বোধন করত রমেন। সেই সময়ই সে বলেছিল যে বড় হয়ে সে এই হত্যার প্রতিশোধ নেবে। এখন তার বয়স হওয়া উচিত আটত্রিশ।’
‘আপনার সঙ্গে সে যোগাযোগ রেখেছিল?’
‘না। আমি নীলকণ্ঠপুর ছাড়ি আজ থেকে বিশ বছর আগে। কিছুকাল ছোট নাগপুরে ছিলাম। তারপর রিটায়ার করে চলে আসি দার্জিলিং-এ। আমার বাড়িটা আপনার চোখে পড়েছে কিনা জানি না। ছোট্ট কটেজ বাড়ি। আমি আর আমার স্ত্রী থাকি। আমার একটি ছেলে, সে কলকাতায় প্লীডার। একটি মেয়ের বিয়ে হয়ে বাইরে রয়েছে।’
‘আপনার কি ধারণা সুধীর ব্রহ্মর সেই ছেলে এখন এখানে রয়েছে?’
‘তা বলতে পারব না; আর বাইশ বছর পরে তাকে দেখলে হয়ত চিনতেও পারব না। কিন্তু সে বাপের হত্যার প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর ছিল সে কথা আমি জানি।’
ভদ্রলোক যে ঘটনাটা বললেন সেটা যে খুবই আশ্চর্য তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটা বুঝতে পারছিলাম যে, এ কাহিনী ফেলুদাকে নতুন করে ভাবাবে।
ফেলুদা বলল, ‘আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। সে ছেলে যদি এখন এখানে নাও থাকে, মিঃ মজুমদারের জীবনে যে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে এটা শুনে খুবই অবাক লাগছে। তাঁর জীবনে যে কোনো একটা গোলমেলে ব্যাপার ঘটেছিল সেরকম ইঙ্গিত দু-একবার পেয়েছি, এমন কি আপনিও দিয়েছেন, কিন্তু সেটা যে এমন একটা ঘটনা সেটা ভাবতে পারিনি। আর আপনি নিজেই যখন সে সময় নীলকণ্ঠপুরে উপস্থিত ছিলেন, তখন এটা অবিশ্বাস করার কোনো কারণ থাকতে পারে না।’
হরিনারায়ণবাবুর সঙ্গে আমরাও উঠে পড়লাম। ফেলুদার কপালে নতুন করে ভ্রূকুটি দেখা দিয়েছে। আমার মন বলছে এবার আর কেসটাকে তেমন সহজ বলে মনে হচ্ছে না ফেলুদার। খানিকটা পথ কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হেঁটে ও বলল, ‘এই কাহিনী আমার চিন্তাকে সাহায্য করবে না ব্যাহত করবে সেটা বুঝতে পারছি না। এখন এই শহরের অবস্থা যেমন, আমার মনের অবস্থাও ঠিক সেই রকম। একরাশ কুয়াশা এসে চিন্তাশক্তিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। যদি একটু সূর্যের আলো দেখতে পেতাম!’
আমরা হাঁটতে হাঁটতে অবজারভেটরি হিল রোডের পূব দিকটায় এসে পড়লাম। বুঝতে পারছিলাম ফেলুদার মনের ভিতরটা ছটফট করছে,তাই সে এক জায়গায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।
কুয়াশার মধ্যেই একজন নেপালি একটা ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে এল, পিঠে কোনো সওয়ার নেই। ‘বাবু, ঘোড়া লেগা, ঘোড়া?’ বলে উঠল লোকটা, কিন্তু আমরা তাকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে গেলাম। সামনে বাঁয়ে ঘুরে গেছে রাস্তাটা, ডাইনে খাদ, আমরা সে খাদ বাঁচিয়ে রাস্তার বাঁ দিক ঘেঁষে চলেছি। রাস্তার পাশের রেলিংটা প্রায় দেখা যাচ্ছে না কুয়াশায়। পরিষ্কার দিনে এখান থেকে সামনে উত্তরে পুরো কাঞ্চনজঙ্ঘার লাইনটা দেখা যায়; আজ আমাদের চার দিক থেকে ঘিরে রয়েছে একটা দুর্ভেদ্য সাদা দেয়াল।
এবার পাশের রেলিংটা ফুরিয়ে গেছে। এখন ডাইনে রাস্তার ধারেই খাদ। আমরা এখনও পাহাড়ের দিক ঘেঁষে চলেছি, যদিও দেখছি ফেলুদা, মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে একটু বেশি ডান দিকে চলে যাচ্ছে। লালমোহনবাবু খালি বলছেন, ‘মিস্টিরিয়াস, মিস্টিরিয়াস’…। তারপর একবার বললেন, ‘মশাই, মিস্ট থেকেই মিস্ট্রি আর মিস্টিরিয়াস এসেছে নাকি?’
হঠাৎ আমাদের পিছনে ফিরতে হল, কারণ দ্রুত পায়ের শব্দ পেয়েছি। কিন্তু কই, এখনো ত কাউকে দেখা যাচ্ছে না! অথচ পায়ের শব্দটা এগিয়ে আসছে। তারপর হঠাৎ কুয়াশার ভিতর থেকে একটা ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল। তার মুখ ভালো করে দেখার আগেই সে মূর্তি ফেলুদাকে সজোরে মারল একটা ধাক্কা খাদের দিকে। ফেলুদা টাল সামলাতে না পেরে পাহাড়ের গা দিয়ে গড়িয়ে মুহূর্তের মধ্যে নীচে অদৃশ্য হয়ে গেল—চারিদিক কুয়াশায় কুয়াশা!
ইতিমধ্যে মূর্তিও আবার কুয়াশায় মিলিয়ে গেছে, সেই সঙ্গে মিলিয়ে গেছে তার দ্রুত পায়ের শব্দ।
লালমোহনবাবুর আর্তনাদের সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম কী সাংঘাতিক একটা ঘটনা ঘটে গেল।
আর সেই সঙ্গে দুটো নেপালি সামনের কুয়াশা থেকে বেরিয়ে এল, আর আমাদের দেখেই জিগ্যেস করল, ‘কেয়া হুয়া, বাবু?’
আমরা বললাম কী হয়েছে। আমাদের সঙ্গের লোক খাদে পড়ে গেছে জেনেই তারা দুজন অনায়াসে পাহাড়ের গা দিয়ে নীচে নেমে গেল—‘এক মিনিট ঠাহরিয়ে বাবু, হাম্ দেখ্তা হ্যায় কেয়া হুয়া।’
লোক দুটোও কুয়াশার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল, কিন্তু সেই মুহূর্তেই কুয়াশাও হঠাৎ পাতলা হয়ে চারিদিকে সব কিছু যেন আবছা আবছা দেখা যেতে লাগল। কে যেন একটা ফিন্ফিনে চাদর টেনে সরিয়ে নিচ্ছে সমস্ত দৃশ্যের উপর থেকে।
নীচে ওটা কী?
একটা গাছ। রডোডেনড্রন বলেই ত মনে হচ্ছে। তার গুঁড়ির সঙ্গে লেগে একটা মানুষ পড়ে আছে। ফেলুদা। ওই যে তার খাকি জার্কিন আর লাল-কালো চেক্ মাফলার।
নেপালি দুটো মুহূর্তের মধ্যে পাহাড়ের গা দিয়ে নেমে গেছে, তারপর ফেলুদাকে দুহাতে ধরে তুলতেই যেন ফেলুদারও হুঁশ ফিরে এসেছে।
‘ফেলুদা!’
‘ফেলুবাবু!’
আমাদের দুজনের ডাকের উত্তরে ফেলুদা তার ডান হাতটা তুলে আশ্বাস দিল যে সে ঠিকই আছে।
তারপর সে খাড়াই দিয়ে উঠে এল দুই নেপালির সাহায্যে—আমাদের চরম বিপদের সময় দুই আচমকা বন্ধু।
পাঁচ মিনিটের কসরৎ ও চেষ্টার পর ফেলুদা পৌঁছে গেল আমাদের কাছে—সে হাঁপাচ্ছে, তার কপাল ছড়ে গিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে, হাতেও আঁচড় লেগেছে, তাতে রক্তের আভাস।
‘বহুৎ শুক্রিয়া!’ ফেলুদা বলল তার উদ্ধারকারীদের।
তারা দুজনে চাপড় মেরে ফেলুদার গা থেকে ধুলো ঝেড়ে দিয়ে বলল, ম্যালের মোড়েই ডাক্তারখানা আছে, সেখানে এক্ষুনি গিয়ে যেন ফেলুদা ফার্স্ট এডের ব্যবস্থা করে।
আমাদেরও সে মতলব ছিল। আমরা হাঁটা দিলাম আবার ম্যালের দিকে।
‘লোকটা কে ছিল বুঝতে পারলে তপেশ?’ লালমোহনবাবু জিগ্যেস করলেন। আমি মাথা নাড়লাম। সত্যি বলতে কি, চাপ দাড়ি ছাড়া আর কিছুই দেখিনি আমি। আর দাড়িটাও মনে হচ্ছিল নকল। ‘কি রকম বোধ করছেন?’ জটায়ু জিগ্যেস করলেন ফেলুদাকে।
‘বিধ্বস্ত,’ বলল ফেলুদা। ‘ওই গাছটাই আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে, না হলে হাড়গোড় সব চুরমার হয়ে যেত। কিন্তু মনে হচ্ছে এবার আস্তে আস্তে মাথা খুলে যাবে। একটা জোরালো ক্লু ত এর মধ্যেই পেয়েছি। আমার এরকমই হয়, জানেন, এরকমই হয়। এটার দরকার ছিল। আর এটাও বুঝলাম যে কেসটা মোটেই সরল নয়।’