০৮. পরিচয়

পরিচয়

টুম্পা খুব নিঃশব্দে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ভেতরে খুটখুট করে কিছু একটা শব্দ হচ্ছে, কিসের শব্দ কে জানে। টুম্পা বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে দরজায় ঠোকা দিলো, সাথে সাথে ভেতরের খুট খুট শব্দ বন্ধ হয়ে গেল, ভয় পাওয়া গলায় তার আব্বু  বলল, কে?

টুম্পা বলল, আমি আব্বু। আমি টুম্পা।

টুম্পা? আব্বুর গলায় অবিশ্বাস, টুম্পা কে?

আমি তোমার মেয়ে আব্বু।

মিথ্যা কথা। আব্বু চিৎকার করে উঠলেন, সব মিথ্যা।

না আব্বু–টুম্পাও গলা উঁচিয়ে বলল, মিথ্যা না। সত্যি।

আমি জানি টুম্পাকে নিয়ে গেছে।

হ্যাঁ আব্বু। আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। আমি এখন এসেছি। তুমি দরজা খোলো তাহলে তুমি দেখবে।

না।

প্লিজ আব্বু–তুমি দরজা খোলো।

না। তুমি চলে যাও।

টুম্পা কাতর গলায় বলল, কেন আমি চলে যাব?

আব্বু ভয় পাওয়া গলায় বললেন, আমি জানি তুমি কেন এসেছ। আমি সব জানি।

তুমি কী জান?

আব্বু দরজার কাছে এসে ফিস ফিস করে বললেন, আমি জানি তোমাকে ওরা পাঠিয়েছে।

কারা?

যারা আমাকে মারতে চায়!

কে তোমাকে মারতে চায়?

আব্বু গম্ভীর গলায় মাথা নাড়লেন, বললেন, আছে একজন।

টুম্পা নরম গলায় বলল, আব্বু আমি তোমার কাছে বসে থাকব, আমি কাউকে তোমার কাছে আসতে দেব না! তুমি একবার দরজা খুলে আমাকে দেখো, তোমার যদি ইচ্ছে না হয় তাহলে আমাকে ঢুকতে দিও না।

ঘরের ভেতর থেকে আব্বু কোনো শব্দ করলেন না। টুম্পা নরম গলায় বলল, তুমি না চাইলে আমি ভিতরে ঢুকব না। আব্বু। বিশ্বাস কর।

এবারেও ভেতর থেকে কোনো শব্দ এল না। টুম্পা বলল, তুমি শুধু একবার দরজা একটু খোলো, আমি তোমাকে শুধু একটু দেখতে চাই। তুমি আমার আব্বু, আমি তোমাকে কোনোদিন দেখি নাই।

ঘরের ভেতরে খস খস করে একটু শব্দ হলো। টুম্পা বলল, দরজা খুলো আব্বু, তুমি কি একবার তোমার মেয়েকে দেখতে চাও না?

ভেতর থেকে আব্বু বললেন, তুমি আমার মেয়ে না।

আমি তোমার মেয়ে। দরজা খোলো তাহলে দেখবে। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আমি ভিতরে ঢুকব না।

সত্যি?

সত্যি।

তাহলে তুমি দূরে দাঁড়িয়ে থেকো।

টুম্পা কয়েক পা পিছনে সরে গিয়ে বলল, এই দেখো আমি দূরে দাঁড়িয়ে আছি।

খুট করে দরজায় শব্দ হলো। তারপর খুব ধীরে ধীরে দরজাটা একটু খুলে যায়। সেখানে একটা মুখ উঁকি দেয়, ভীত, সন্ত্রস্ত একটা মুখ। মাথা ভরা এলোমেলো চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গায়ের রং ফর্সা, চোখের নিচে কালি। টুম্পা হতচকিত হয়ে তাকিয়ে থাকে, এই মানুষটি তার আব্বু? তার এখনও বিশ্বাস হয় না সে তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।

আব্বু তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর ফিস ফিস করে বললেন, তুমি টুম্পা না। আমার টুম্পা অনেক ছোট।

আমিও ছোট ছিলাম আব্বু। আমি অনেক বড় হয়েছি।

আব্বু দরজাটা বন্ধ করে দিচ্ছিলেন, টুম্পা অনুনয় করে বলল, আব্বু তুমি দরজাটা বন্ধ করো না, প্লিজ। আমি ভেতরে ঢুকবো না। এই দেখো আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।

আব্বু দরজাটা বন্ধ করতে গিয়ে থেমে গেলেন, আবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে টুম্পার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ফিস ফিস করে বললেন, তুমি কেন এসেছ?

তোমাকে দেখতে।

আমাকে দেখেছ। এখন চলে যাও।

আমি আরো দেখতে চাই। টুম্পা অনুনয় করে বলল, আমি এখানে বসি?

আব্বু কোনো কথা বললেন না। টুম্পা নিজেই তখন সিঁড়ির উপর বসে গেলো। নরম গলায় বলল, এই দেখো আমি ভিতরে ঢুকছি না।

আব্বু এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে টুম্পার দিকে তাকিয়ে রইলেন। টুম্পা বলল, আব্বু। তুমি একটা চেয়ার নিয়ে বস।

কেন?

আমরা দুইজন একটু গল্প করি।

আব্বু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর সত্যি সত্যি একটা চেয়ার টেনে এনে দরজায় বসলেন। টুম্পা তার আব্বুর দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আব্বু, তুমি ভালো আছ?

আব্বু কোনো কথা বললেন না। টুম্পা আবার জিজ্ঞেস করল, ভালো আছ তুমি?

আব্বু মাথা ঝাঁকালেন, বোঝালেন ভালো নেই।

কেন তুমি ভালো নেই, আব্বু?

ঘুমাতে পারি না তো তাই।

কেন তুমি ঘুমাতে পার না?

সব সময় আমাকে খুব সাবধান থাকতে হয় তো সেইজন্যে। একটু থেমে যোগ করলেন, কেউ যদি চলে আসে।

টুম্পা অবাক হয়ে তার আব্বুর দিকে তাকিয়ে রইলো। আহা! এই মানুষটি কোনো কারণ ছাড়া শুধু শুধু কী ভয়ানক একটা আতংকে থাকেন? টুম্পা নরম গলায় বলল, আব্বু।

আব্বু কোনো কথা না বলে তার দিকে তাকালেন। টুম্পা বলল, আব্বু, তুমি এখন একটু ঘুমাতে চাও?

কেন?

আমি বসে বসে পাহারা দেব, যেন কেউ না আসতে পারে।

আব্বু অবাক হয়ে টুম্পার দিকে তাকালেন, পাহারা দেবে? তুমি?

হ্যাঁ।

কেন?

আমি তোমার মেয়ে, সেজন্যে। মেয়েরা সবসময় তাদের আব্বুদের কাছে থাকে। তাদের আব্বুদের পাহারা দেয়।

আপু অদ্ভুত একটা দৃষ্টিতে টুম্পার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, তুমি সত্যিই আমার মেয়ে?

হ্যাঁ আব্বু। তুমি দেখতে চাও?

কীভাবে দেখব?

আমাকে একটা কাগজ দাও। তোমাকে দেখাই—

কাগজ? কাগজ? আব্বুকে কেমন যেন বিভ্রান্ত দেখা গেল।

দাঁড়াও, আমার কাছেই কাগজ আছে। টুম্পা তার ব্যাগ থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে তার কোলের উপর রেখে হাতে একটা কলম নেয়, বলে, আব্বু, তুমি নড়বে না।

আব্বু অবাক হয়ে টুম্পার দিকে তাকালেন, টুম্পা কাগজে কলম দিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করলো–দুই মিনিটের মাঝে ছবিটা শেষ করে সে উঠে দাঁড়ায়, একটু এগিয়ে গিয়ে তার আব্বুর হাতে কাগজটা দিয়ে বলল, এই দেখো।

কাগজটা হাতে নিতেই তার আব্বুর মুখে একটা হাসি ফুটে উঠলো, টুম্পা অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে! হাসিটি কী সুন্দর, একেবারে ছোট বাচ্চার মতো। এই প্রথম সে তার আব্বুকে হাসতে দেখলো, আব্বু মুখে হাসিটা ধরে রেখে বললেন, কী সুন্দর! এতো তাড়াতাড়ি তুমি আমার ছবি এঁকেছ?

হ্যাঁ আব্বু। স্ট্রোকগুলো কী পাওয়ারফুল। মাই গড।

আমি কেমন করে এঁকেছি জান?

কেমন করে?

কারণ আমি তোমার মেয়ে সেজন্যে! আমি এটা তোমার কাছ থেকে পেয়েছি।

আব্বু কেমন যেন অবাক হয়ে টুম্পার দিকে তাকালেন তারপর আস্তে আস্তে বললেন, তার মানে, তার মানে তুমি তুমি মানে তুই তুই আসলেই আমার মেয়ে?

হ্যাঁ আব্বু।

তুই একটু কাছে আয়–বলে আব্বু উঠে দাঁড়ালেন।

টুম্পা একটু এগিয়ে গেল, আব্বু খুব সাবধানে টুম্পার হাত একটু স্পর্শ করলেন, তারপর তার মাথায় হাত বুলালেন, তারপর তার থুতনিটা ধরে তার মুখটা উঁচু করে সেদিকে তাকিয়ে ফিস ফিস করে বললেন, তোকে যখন শেষবার দেখেছি তখন তুই এই এতোটুকু ছিলি।

আমার মনে নেই।

কীভাবে মনে থাকবে? তুই তখন মাত্র এইটুকুন। আব্বু খুব সাবধানে টুম্পার মাথায় পিঠে হাত রাখলেন, তাকে দেখে মনে হতে লাগলো একটু জোরে স্পর্শ করলেই টুম্পা বুঝি টুকটুক করে ভেঙে যাবে। টুম্পা ফিস ফিস করে বলল, আব্বু।

কী মা?

আমি তোমাকে একটু ধরি?

ধরবি? ধর।

টুম্পা তার আব্বুকে ধরে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগলো। আব্বু কেমন জানি ভয় পেয়ে গেলেন, টুম্পাকে টেনে সরিয়ে কাঁপা গলায় বললেন, কী হয়েছে টুম্পা? কী হয়েছে?

টুম্পা চোখ মুছে বলল, কিছু হয় নি আব্বু। কিছু হয় নি।

পেট ব্যথা করছে?

 টুম্পা হেসে ফেলল, না আব্বু।

খিদে লেগেছে?

না আব্বু খিদে লাগে নাই।

তাহলে তুই কাঁদছিস কেন?

আমি আর কাঁদছি না আব্বু। এই দেখো– টুম্পা তার চোখ মুছে হাসার চেষ্টা করল।

আব্বু  বললেন, হ্যাঁ। কাঁদিস না।

টুম্পা বলল, আব্বু, আমাকে ভেতরে আসতে দেবে না?

হ্যাঁ। তাড়াতাড়ি ভেতরে আয়। এই দরজাটা বন্ধ করে দিই। পরে আমাদের দেখে ফেলবে।

কে দেখে ফেলবে?

বলেছি না? আব্বু গলা নামিয়ে বললেন, সি.আই.এ।

টুম্পা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, এটাকেই নিশ্চয়ই স্কিৎজোফ্রেনিয়া বলে। অবাস্তব একটা জিনিস নিয়ে ভয়। যে জিনিসটাকে নিয়ে ভয় সেটা অবাস্তব হতে পারে কিন্তু ভয়টা পুরোপুরি বাস্তব। আব্বুর মুখ দেখে সেটা বোঝা যায়।

টুম্পা আব্বুর পিছু পিছু ঘরে ঢুকলো। ঘরের সবগুলো জানালার পর্দা টেনে রাখা আছে। দিনের বেলাতেই ঘর অন্ধকার, মাথার ওপর একটা লাইট মিট মিট করে জ্বলছে। ঘরের দেওয়ালে পেন্সিল দিয়ে আঁকা বিচিত্র ছবি। ঘরে আসবাবপত্র বলে কিছু নেই, একটা খাটে অগোছালো বিছানা। এক কোণায় স্কুপ করে রাখা ময়লা কাপড়। একটা টেবিলের উপর কয়েকটা প্লেট আর বাটি সেখানে কিছু অভুক্ত খাবার।

আব্বু একটা জানালার কাছে গিয়ে পর্দা একটুকু সরিয়ে খুব সাবধানে বাইরে তাকালেন। মনে হলো খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছেন। টুম্পা আব্বুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী দেখো আব্বু?

আব্বু ফিসফিস করে বললেন, মানুষগুলো ঐখানে থাকে।

কোন মানুষগুলি?

সি.আই.এর মানুষগুলো। চুপি চুপি চলে আসতে চায়। আব্বুর মুখ গম্ভীর হয়ে যায়, সেইজন্যে সাবধানে থাকতে হয়। ঘুমাতে পারি না।

আব্বুর জন্যে টুম্পার এতো মায়া হলো সেটা বলার মতো না। আব্বুর হাত ধরে বলল, আব্বু তুমি এখন ঘুমাও। আমি পাহারা দিব যেন কেউ আসতে না পারে।

তুই পারবি না।

কেন পারব না?

ওরা খুব ডেঞ্জারাস, ওদের কাছে কতো কী থাকে তুই জানিস?

থাকলে থাকুক। আমি ওদেরকে কাছেই আসতে দিব না।

কীভাবে কাছে আসতে দিবি না?

আব্বু, আমি আমেরিকা থাকি তুমি ভুলে গেছো? ইংরেজিতে আমি এমন বকা দেব যে, পালাবার রাস্তা পাবে না!

আব্বু অবাক হয়ে বললেন, বকা দিবি? ইংরেজিতে বকা দিবি?

হ্যাঁ।

না, না, সর্বনাশ–ওরা খুব ডেঞ্জারাস। ওরা যদি টের পায় তুই আমার মেয়ে তাহলে তোরও অনেক বড় বিপদ হবে? আব্বুকে খুব দুশ্চিন্তিত দেখালো।

টুম্পা অসহায় বোধ করে। তার আব্বুর সাথে এরকম একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে তার কেমন যেন লজ্জা করে! নিজেকে কেমন যেন প্রতারক মনে হয়। তবু সে চেষ্টা করল, বলল, ঠিক আছে আব্বু, তাহলে আমি ওদেরকে কিছু বলব না।

সেটাই ভালো। দরজাও খুলবি না।

দরজা খুলব না।

যদি আমার কথা কিছু জিজ্ঞেস করে—

তাহলে বলব তুমি এখানে থাকো না।

আব্বুর কাছে কথাটা পছন্দ হলো। বললেন, হ্যাঁ সেটাই ভালো।

টুম্পা তার আব্বুকে বিছানার দিকে টেনে নিয়ে বলল, তুমি এখন একটু ঘুমাও। আস। তোমার ঘুমানো খুব দরকার।

আব্বু টুম্পার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। টুম্পা জিজ্ঞেস করল, তুমি হাস কেন আব্বু?

তুই দেখি ডাক্তারের মতো কথা বলিস। সেও খালি বলে আপনি ঘুমাবেন। বেশি করে ঘুমাবেন।

তোমার ডাক্তারের নাম কী আব্বু?

জানি না। শুভ নিয়ে আসে। আমি ঢুকতে দিতে চাই না।

কেন ঢুকতে দিতে চাও না।

বলা তো যায় না–যদি সি.আই.এর লোক হয়।

টুম্পা বলল, ও!

আব্বু বললেন, খুব বিপদের মাঝে থাকি।

তুমি নিজে ডাক্তারের কাছে যাও না?

আব্বু ভয়ের ভঙ্গী করলেন, বললেন, সর্বনাশ! যদি দেখে ফেলে?

টুম্পা বলল, কারা দেখে ফেলে?

আব্বু বললেন, কারা আবার? সি.আই.এ।

টুম্পা বলল, ও! তারপর তার আব্বুর হাত ধরে তাকে বিছানার কাছে নিয়ে শুইয়ে দিয়ে বলল, তুমি এখন একটু ঘুমাও। কোনো চিন্তা না করে ঘুমাও। আমি এইখানে বসে থাকব।

আমাকে না বলে চলে যাবি না তো?

না আব্বু। চলে যাব না।

টুম্পা তার আব্বুর মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। বলে, তুমি চোখ বন্ধ কর। ঘুমাও।

আব্বু চোখ বন্ধ করলেন তারপর সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে গেলেন। টুম্পা তার আব্বুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। মানুষটা কী সুদর্শন, চেহারাটা একেবারে শিশুর মতো! টুম্পার এখনো বিশ্বাস হয় না সে তার নিজের বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে!

আন্তু যতক্ষণ ঘুমালেন টুম্পা ততক্ষণ একটুও নড়লো না। আব্বুর ঘুমটা প্রথম দিকে ছিল একটু অস্থির, শুয়ে একটু ছটফট করলেন তারপর এক সময় শান্ত হয়ে ঘুমালেন। ঘণ্টা দুয়েক পর আবার ছটফট করলেন, এক সময় চোখ খুলে তাকালেন কিছু দেখলেন বলে মনে হলো না। বিড় বিড় করে কিছু একটা বললেন তারপর আবার ঘুমিয়ে গেলেন। ঘণ্টা দুয়েক পর যখন ঘুম থেকে উঠলেন তখন চোখ খুলে টুম্পার দিকে তাকিয়ে রইলেন, চোখের দৃষ্টিটা একটু অন্যরকম! টুম্পা ভয়ে ভয়ে ডাকলো, আব্বু।

আব্বু উঠে বসে হাত দিয়ে টুম্পাকে স্পর্শ করলেন, মনে হলো যেন পরীক্ষা করে দেখছেন টুম্পা কী সত্যিই আছে নাকি মিথ্যে। টুম্পা আবার ডাকলো, আব্বু।

আব্বু দুর্বলভাবে হাসলেন, বললেন, কোনটা যে স্বপ্ন আর কোনটা যে সত্যি বুঝতে পারি না। আমি ভাবছিলাম তুই বুঝি স্বপ্ন।

না আব্বু। আমি স্বপ্ন না। আমি সত্যি। 

হ্যাঁ তুই সত্যি। আব্বু

বিছানায় পা তুলে গুটিশুটি মেরে বসে রইলেন। টুম্পা বলল, আব্বু তুমি হাত মুখ ধোবে না?

হাত মুখ ধুয়েছিলাম তো।

ঘুম থেকে উঠে আরেকবার ধুলে ভালো লাগবে। টুম্পা আব্বুকে ঠেলে বিছানা থেকে নামালো। বলল, যাও, গোসল করে ফেলো, যা গরম।

কে বলেছে গরম?

আমি তো আমেরিকা এসেছি। আমার অনেক গরম লাগে।

আমার গরম লাগে না।

আমি তোমার বাসাটা দেখি একটু। দে

খবি? আব্বু কেমন সন্দেহের চোখে তাকালেন, কেন দেখবি?

এমনি। তুমি কেমন আছ আমার দেখার ইচ্ছা করে না? 

দেখ তাহলে।

টুম্পা তখন বাসাটা ঘুরে দেখলো। দুইটা রুম, একটা বাথরুম আরেকটা রান্নাঘর। রান্নাঘরে চুলার উপর একটা তোবড়ানো কেতলি। কিছু নোংরা বাসন। হতশ্রী বাথরুম–একটা প্লাস্টিকের বালতি কাৎ হয়ে পড়ে আছে। একটা শুকনো টুথপেস্টের টিউব আর পুরানো একটা টুথব্রাশ ছাড়া আর কিছু নেই। ঘরের মাঝে ইতস্তত বই ছড়ানো। কিছু বাংলা কিছু ইংরেজি। বইগুলোর কোনো মাথামুণ্ডু নেই, কোনোটা কবিতা, কোনোটা ধর্ম, আবার কোনোটা শিল্প ইতিহাস। টুম্পা তার জীবনে এরকম একটা হতচ্ছাড়া বাসা দেখে নি। তার আব্বু কীভাবে দিনের পর দিন এরকম একটা জায়গায় থাকেন, ব্যাপারটা চিন্তা করেই টুম্পার চোখে পানি চলে আসে।

টুম্পা যখন বাইরের ঘরে ফিরে এসেছে তখনো তার আব্বু বিছানায় গুটিশুটি মেরে বসে আছেন। টুম্পা বলল, আব্বু! তোমার বাসার অবস্থা খুব খারাপ।

আব্বু চমকে উঠলেন, ভয় পাওয়া গলায় বললেন, কেন? কেন? কী হয়েছে?

না আব্বু কিছু হয় নাই। তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই! তোমার বাসাটা মনে হয় কোনোদিন পরিষ্কার করা হয় নাই। জঘন্য অবস্থা।

আব্বু এদিক-সেদিক তাকালেন, বললেন, আমার কাছে ভালোই তো লাগছে।

না। এইটা ভালো না। টুম্পা মুখ গম্ভীর করে জিজ্ঞেস করল, আব্বু তুমি কী খাও?

রাত্রি বেলা একজন খাবার দিয়ে যায়। সেইটা খাই।

নাস্তা?

নাস্তা করতে হয় না।

দুপুরে কী খাও?

আব্বু মাথা চুলকে বললেন, যখন যেটা থাকে তখন সেটা খাই। না থাকলে খাই না।

টুম্পা মাথা নাড়লো, বলল, এইটা ঠিক না আব্বু। একেবারে ঠিক না।

আব্বু কোনো কথা বললেন না, একটু হাসার চেষ্টা করলেন। ঠিক এরকম সময় দরজায় ঠুকঠুক করে শব্দ হলো–আব্বু ভীষণ চমকে প্রায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, ভয় পাওয়া গলায় বললেন, সর্বনাশ! কে এসেছে? কে?

টুম্পা হাতের ঘড়িটা দেখে বলল, ছোট খালা আমাকে নিতে এসেছেন।

কেন? কেন এখানে এসেছে? কীভাবে এসেছে?

টুম্পা আব্বুর হাত ধরে বলল, আব্বু তুমি শান্ত হও। তুমি এত ভয় পেলে হবে কেমন করে? আমি ছোটখালাকে বলেছি ঠিক ছয়টার সময় আমাকে নিয়ে আসতে। এই দেখো ছয়টা বাজে

আব্বু তবুও ফ্যাকাসে মুখে টুম্পার দিকে তাকিয়ে রইলেন। টুম্পা বলল, আব্বু আমি আজকে যাই?

আব্বু, বিড় বিড় করে কী একটা বললেন ঠিক বোঝা গেল না। টুম্পা বলল, কাল সকালে আসব। ঠিক আছে আব্বু?

আব্বু আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন। টুম্পা আব্বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, কাল সকালে আমার কথা মনে থাকবে তো?

মনে থাকবে।

টুম্পা দরজা খুলে বের হতেই আব্বু দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। ছোটখালার সাথে ফিরে যাবার সময় টুম্পা দেখলো জানালার পর্দা অল্প একটু সরিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে আব্বু তাকিয়ে আছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *