পরাণ ঢুলীর বাড়িতে মতি বসে আছে। অনুষ্ঠানের ব্যাপারটা ঠিকঠাক করা দরকার। একটু বাদ্য-বাজনাও হোক। মন উদাস লাগছে–বাদ্য-বাজনায় উদাস ভাবটা হয় কাটবে নয় আরও বাড়বে। দুটাই ভাল। উদাস হলে পুরোপুরি উদাস হওয়া দরকার।
সাধারণত এই আসর বাড়ির দাওয়ায় মাদুরের উপর বসে। আজ বসেছে একটু দূরে, ছাতিম গাছের নিচে। পরাণের চোখে-মুখে রাজ্যের অনাগ্রহ। তার মন ভাল নেই, শরীরও ভাল নেই। সারা সকাল পেটের ব্যথায় ছটফট করেছে। দুপুরের পর ব্যথা কমেছে তবে শরীর ঝিম ধরে আছে। বিকালে শুরু হয়েছে তান্য যন্ত্রণা—তার স্ত্রী দুর্গার প্রসবব্যথা উঠেছে। এটা তেমন কিছু না–স্ত্রীলোক, বছরে–দুবছরে প্রসবব্যথা হবেই। প্রথমে খানিকটা দুশ্চিন্তা থাকে–তারপর দুশ্চিন্তার কিছু থাকে না। দূর্গার এই নিয়ে সপ্তমবার। সন্তান প্রসব তার কাছে ডালভাতের মত হয়ে যাবার কথা। হয়েছেও তাই–এই অবস্থাতেও সে সংসারের টুকটাক কাজ সারছে। রাতের ভাত আগেভাগে বেঁধে ফেলেছে। মাষকলাইয়ের ডাল রান্না করা আছে। রাতে আর কিছু না রাধলেও হবে। ধাইকে খবর দেওয়ার জন্যে ছোট ছেলেটাকে পাঠিয়েছে। এই ছেলেটা খুব কাজের। সে যে শুধু খবর দেবে তাই না–যত রাতই হোক সঙ্গে করে নিয়ে আসবে।
পরাণের ছয় ছেলেমেয়ের মধ্যে চারটি বেঁচে আছে। ছেলেরটাই বেঁচে। সংসারে মেয়ে নেই। দুটি মেয়ের মধ্যে বড়টা কথা নেই বাতাসেই হঠাৎ একদিন ধড়ফড় করতে করতে মারা গেল! ছোট মেয়েটা খুব সুন্দর হওয়ায় জন্মের পর পর খারাপ বাতাস লেগে গেল। আতুরঘরে খারাপ বাতাস লাগলে বাঁচানো মুশকিল–সুখানপুকুরে বড় গুণীন কেউ নেই। দূর্গার ধারণা, এবারের সন্তান মেয়ে হবে। দ্বিতীয় মেয়েটির মতই সুন্দর হবে। তা যদি হয় খারাপ বাতাস এবারও লাগবে। এই নিয়ে দূর্গার স্বামী পরাণের কোন মাথাব্যথা নেই তাকে কিছু বলেও লাভ হবে না। যা করতে হয় নিজেরই করতে হবে। একঠা সরিষা, লোহা, কাচা হলুদের এক টুকরা দূর্গা শাড়ির আঁচলে বেঁধে রেখেছে। এতে কাজ হবে না। আগের বারেও এইসব বাধা ছিল। ঘর বন্ধন দিতে পারলে কাজ হত। ঘর বন্ধন দিতে পারে এমন বড় হিন্দু গুণীন কেউ নেইও–তবে মুসলমান ফকিররাও ভাল ঘর বন্ধন পারেন। তাদের কাউকে খবর দিলেও হয়। পরাণকে এইসব বলে লাভ হবে না। তাকে যা-ই বলা হোক সে উদাস গলায় বলবে–যাও বাদ দাও। সৃষ্টিছাড়া মানুষ–নয়ত আজকের দিনে কেউ বাদ্য-বাজনা নিয়ে বসে? সে কি আর জানে না আতুরঘরের পাশে বাদ্য বাজনা করতে নেই? বাদ্য-বাজনার শব্দে খারাপ বাতাস বেশি আকৃষ্ট হয়।
বাদ্য বাজে আতুরঘরে
পেরত বলে আরে আরে।।
দূর্গা শক্ত পাটিতে শুয়ে আছে। তার মাথার নিচে তেল-চিটচিটে বালিশ। বালিশ না দিয়ে শোবার কথা, তবে এখনও দেরি আছে। ব্যথার ধাক্কাটা অনেক পরে পরে আসছে। মাঝরাতের আগে কিছু হবে না। ঘরে তেল নেই। সারারাত কুপি জ্বলবে–তেল লাগবে। ছেলেটা এলে তাকে তেলের জন্যে পাঠাবে। চারটা ছেলের মধ্যে একটাই কাছে আছে। সবগুলি পাশে থাকলে বুকে ভরসা পাওয়া যেত। ভাল-মন্দ কিছু ঘটে গেলে ওদের শেষদেখা দেখা যেত।
অন্ধকার ঘরে শুয়ে দূর্গার মন কেমন কেমন করতে লাগল। ভয় ভয় করতে লাগল। সন্তান জন্মের সময়টাতে সব মেয়েমানুষকে জীবন-মৃত্যুর সীমনায় এসে পঁড়াতে হয়। তখন বড়ই ভয় লাগে। প্রাণ হাহাকার করতে থাকে। ইচ্ছা করে, প্রিয়জনরা সব ঘিরে বসে থাকুক, মাথা থাকুক স্বামীর কোলে। তা হবার নয়। জীবনমৃত্যুর সীমারেখায় সব মেয়েকেই একা একা দাঁড়াতে হয়। দূর্গার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। ঢোলের বাড়ি বাড়ছে–আজকের বাজনাটা কি অন্য রকম? কেমন অদ্ভুত ট্যা টপ টপ ট্যা টা টপ শব্দ।
পরাণ দশ মিনিটের মত বাজিয়ে ঢোল এক পাশে সরিয়ে রেখে বলল—মতি যুইত লাগতাছে না।
মতি বলল, শরীর খারাপ নাকি?
না শরীর ভাল। মনটা ভাল না। বাদ্য-বাজনা হইল মনের ব্যাপক শইল ভাল মন্দের সাথে এর কোন সম্পর্ক নাই। আইজ থাউক।
থাকুক। থাকুক।
চা খাইবা? গুড়ের চা।
তা খাওয়া যায়। দেখি, পাত্তি আছে নাকি দেখি…।
পরাণ চায়ের কথা বলার জন্যে উঠে গেল।
ঘর অন্ধকার করে দূর্গা শুয়ে আছে। তেল যা আছে থাকুক–খরচ করা ঠিক হবে না। অন্ধকার ঘরের সুবিধাও আছে–চোখের পানি আড়াল করা যায়।
এই, চা দেওন যাইব?
দূর্গা নিঃশব্দে উঠে বসল। ব্যথার একটা প্রবল চাপ আসায় সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়তে হল। পরাণ বলল, থাউক বৌ, থাউক। শুইয়া থাক। দূর্গা বাধ্য মেয়ের মত আবারও শুয়ে পড়ল। মনে মনে বলল, আপনে একটু বসেন আমার কাছে। ঘরে এখন কেউ নাই। আপনার সাথে দুইটা সুখ-দুঃখের কথা বলি।
পুরাণ বলল, কেমন বুঝতাছ বৌ?
দূর্গা সেই প্রশ্নের জবাব দিল না। সহজ গলায় বলল–চুলাত আগুন আছে–পানি বসাইয়া দেন। গুড় আছে ছিক্কার ভিতরে ডিব্বার মইধ্যে।
আচ্ছা দেখি–তোমার তো অখনও দেরি আছে?
হুঁ।
কাউরে বলব আসার জন্যে?
না দরকার নাই।
পরাণের বানানো গুড়ের চা ভাল হয়েছে। মতি আরাম করে চা খাচ্ছে। সে এবং পরাণ দুজনই চুপচাপ বসে আছে। পরাণ থা প্রায় কখনোই বলে না। তার সঙ্গে গল্প করতে এলে চুপচাপ বসে থাকতে হয়। দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে থাকার পর পরাণ হঠাৎ দু-একটা কথা বলে। মতির সেই সব কথা শুনতে ভাল লাগে। আজ পরাণ কোন দার্শনিক উক্তিও করছে না। মতি বলল, আইজ তাইলে উঠি কাকা?
আচ্ছা।
উনারে বাজনা দিয়া মোহিত করা লাগব। মনে থাকে যেন।
পরাণ হাই তুলল। উত্তর দিল না।
তোমার ঘর অন্ধকার, ব্যাপার কি?
পরাণ জবাব দিল না। অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নের জবাব দেবার অভ্যাস তার নেই।
বাড়িতে কোন অসুবিধা নাই তো?
না।
কাকীর শইল কি ভাল?
হুঁ।
মতি চলে যাবার পরও পরাণ অনেকক্ষণ একা একা বসে রইল। সুবল এখনও ফিরেনি। ধাই নিয়ে ফিরলে সে খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করত। ধাইকে নতুন শাড়ি, দশটা টাকা আর এক কাঠা চাল দিতে হবে। শাড়ি না আছে। গত হাটে কিনে এনে রেখে দিয়েছে। টাকা দশটা তার কাছে নেই তবে দুর্গার কাছে অবশ্যই আছে। দুর্দিনের জন্যে সে টাকা আলাদা করে রাখে বাড়িঘর এমন অন্ধকার করে রাখা ঠিক না। বিশেষ করে আতুরঘরে সার্বক্ষণিক বাতি রাখতে হয়। দূর্গা ঘর অন্ধকার করে রেখেছে কেন? প্রয়োজন নিশ্চয়ই আছে। বিনা প্রয়োজনে দূর্গা কোনদিনও কিছু করেনি।
পরাণ আবার ঘরে ঢুকল। মৃদু গলায় বলল–বাতি জ্বালাইয়া রাখ বৌ।
দূর্গা বলল, কেরোসিন কম আছে। সারারাত বাতি জ্বলব।
আমি তেল কিন্যা আনি। বোতল কই?
সুবল আসুক। সুবল আনব। আপনে থাকেন। যাইয়েন না।
পরাণ দূর্গার মাথার কাছে বসে আছে। দূর্গার ব্যথার চাপ এখন অনেক কম। সেও উঠে বসল। অন্ধকার ঘরে দুজন নিঃশব্দে বসে আছে। এম্নিতেই দূর্গা প্রচুর কথা বলে কিন্তু এই মানুষটা আশেপাশে থাকলে চুপচাপ বসে থাকতে হয়।
দূর্গা বলল, পুলাপান দুইটারে খবর দিয়া আনেন।
কেন?
অনেকদিন দেখি না, দেখনের ইচ্ছা করে।
আইচ্ছা, কাইল খবর দিব।
দূর্গা খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল–আমার মনের মধ্যে কু ডাক ডাকতাছে। যদি ভাল-মন্দ কিছু হইয়া যায়–ক্ষমা দিবেন।
পরাণ এই কথার জবাব দিল না। হাঁ-হুঁ পর্যন্ত করল না। দূর্গা বলল, অভাব অনটনে সংসার চালাতে গিয়া নানান সময়ে আপনেরে কটু কথা বলছি। মন থাইক্যা বলি নাই–মুখে চইল্যা আসছে, বলছি।
পরাণ বলল, তুমি যেমন বলছ আমিও বলছি।
না, আপনে বলেন নাই। আপনি কোনদিনই কিছু বলেন নাই।
মুখে না বললেও মনে মনে হয়ত বলেছি।
না, মনে মনেও বলেন নাই। মানুষ যখন মনে মনে রাগ করে তখন তার চেহারা দেইখ্যা সেইটা বোঝা যায়। রাগ কইরা কত কটু কথা আপনেরে বলছি, তারপর অবাক হইয়া দেখছি আপনে মাথা নিচা কইরা হাসতাছেন। পুলাপানের মিটমিটাইন্যা হাসি। দেইখ্যা প্রত্যেকবার খুব শরম পাইছি। প্রত্যেকবার নিজেকে বলছি–দূর্গা, এমন একটা মানুষের সাথে তুই কটু কথা কস! তোর কি বিচার-বিবেচনা নাই?
পরাণ বলল, ঢোলটা বাইরে রইছে, নিয়া আসি। হঠাৎ বৃষ্টি নামলে ভিজব।
ভিজুক। আপনে এইখানে বসেন। মন খুইল্যা দুর কথা কোনদিন আপনেরে বলতে পারি না–আইজ বলব।
বল।
কয়েকদিন খাইক্যা মনের মইধ্যে কু ডাকতাছে। ভাল-মন্দ যদি কিছু হয়…
কিছু হবে না। আপনে কি কইরা জানেন কিছু হবে না? আপনে মানুষটা দেবতার মত হইলেও আপনে তো আর দেবতা না।
দূর্গা কাদতে শুরু করেছে। আকাশে মেঘ ডাকছে। গুড়ু গুড় শব্দ হচ্ছে। বৃষ্টি বোধহয় নামবে। বৃষ্টির মধ্যে যে শিশুর জন্ম হয় সে হয় ভাগ্যবান। পরাণের আগের কোন ছেলেমেয়ের জন্মের সময় বৃষ্টি ছিল না—এবারের জন বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আসছে। পরাণ তার শরীরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করল।
ঝুম বৃষ্টির মধ্যে সুবল খোদেজার মাকে নিয়ে এল। বহুদিনের অভিজ্ঞ ধাই। শিশু প্রসবের পুরো ব্যাপারটা নিশ্চিন্তে তার উপর ছেড়ে দেয়া যায়। ঘরে পা দিয়েই সে যা করার অতি দ্রুত করে ফেলবে। গরম পানি, নাড়ি কাটার জন্যে কঞ্চির ধারাল খণ্ড, সেঁক দেয়ার জন্যে কাপড়।
সূরা ইয়াসীন পড়ে রোগির পেটে ফুঁ দিয়ে সে কাজকর্ম শুরু করে। হিন্দু মেয়ের পেটে সূরা ইয়াসীন পড়ে ফুঁ দেয়া যায় কি-না এই নিয়ে তার মনে সংশয় ছিল। এখন সেই সংশয়ও নেই–মায়ের পেটের শিশু মুসলমান। ভূমিষ্ট হবার পর–হিন্দুমুসলমানে ভাগাভাগি আসে। কাজেই পেটের সন্তানকে উদ্দেশ্য করে সূরা ইয়াসীন পাঠ করা যায়।
খোদেজার মা চোখ বন্ধ করে সূরা ইয়াসীন পড়ে ফুঁ দিয়ে রাগী গলায় বলল, ব্যবস্থা তো কিছুই দেখি না। ঘর আন্ধাইর কইরা বইস্যা আছ। আন্ধাইর ঘরে জ্বীন ভূত নাচানাচি করে। আলো না থাকলে ফিরিশতা আসে না। খালি কুপি দিয়া হইব না। হারিকেন লাগব। সেঁকের ব্যবস্থা লাগব। নরম তেনা কই? চা খাওনের একটু ব্যবস্থা দেখ। রাইত জাগন লাগব। ঘুমে চউখ আসতাছে বন্ধ হইয়া।
খোদেজার মা কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে কাজে নেমে পড়ল। পরাণ এবং সুবল বসে রইল উঠোনে। সুবলের স্বভাবও তার বাবার মত–কথাবর্তা বলে না। সারাক্ষণই মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
ভোররাতে খোদেজার মা কুপি হাতে উঠোনে নেমে এসে বলল, অবস্থা ভাল না। বাচ্চার মাথা উপরের দিকে। দূর্গারে সদর হাসপাতালে নেওন লাগব। অতক্ষণ বাঁইচ্যা থাকব বইল্যা মনে হয় না। আমার জ্ঞান-বুদ্ধির মইধ্যে যা ছিল করছি। আল্লাহ পাক জানেন আর আমার নবিজী জানেন, আমি চেষ্টার ত্রুটি করি নাই।
পরাণ হতভম্ব গলায় বলল, দূর্গা কি মারা যাইতাছে?
খোদেজা কিছু বলল না।
সদরে নিয়া যাব?
সদরে নিতে দুইদিন লাগব। অত সময় আমরার হাতে নাই। তারপরেও চেষ্টা কইরা দেখন যায়। সদরে যদি যান–আমিও সাথে যাব।
পরাণ উঠে দাঁড়াল। তার নিজের নৌকা আছে–সেই নৌকায় নেয়া যাবে না–ছই নাই। নৌকার জোগাড় দেখতে হবে। প্রথমেই খবর দিতে হবে মতিকে। মানুষের বিপদে-আপদে যে প্রথম ছুটে আসে সে মতি। সে পাশে থাকলে বুকে আপনাতেই হাতির বল চলে আসে।
টুপটাপ বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। পরাণ ছুটে যাচ্ছে। সুবল বৃষ্টির মধ্যে একা বসে আছে। খোদেজার মা বারান্দা থেকে ডাকল–এই ছেড়া, খামাখা বৃষ্টিতে ভিজতাছস ক্যান? যা, মার হাত ধইরা মার মাথার কাছে বইস্যা থাক।
সুবল নড়ল না। ভিজতে থাকল।
ফজরের নামাজ শেষ করে ইরতাজুদ্দিন বাংলোঘরে এসে দেখেন মতি বসে আছে। উদভ্রান্তের মত চেহারা–বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপ করছে। খালি পা, হাঁটু পর্যন্ত কাদা। ইরতাজুদ্দিনের ভুরু কুঞ্চিত হল–খালি পায়ে যে আসছে সে বাংলোঘরে ঢুকবে কেন? সে দাঁড়িয়ে থাকবে উঠোনে।
মতি বলল—বিরাট বিপদে পড়ে আপনের কাছে আসছি স্যার।
ইরতাজুদ্দিনের ভুরু আরও কুঞ্চিত হল। কি বিপদ আঁচ করতে চেষ্টা করলেন। পারলেন না।
বল কি ব্যাপার। পরাণ কাকার স্ত্রীর সন্তান হবে…
তাকে থামিয়ে দিয়ে ইরতাজুদ্দিন বললেন–সেটা তার বিপদ, তোমার কি? আমার কাছেই বা কেন?
আপনার বড় নাতনী ডাক্তার…
সে ডাক্তার ঠিকই আছে–সে তো আর পাই না যে বাড়ি বাগিয়ে বাচ্চা প্রসব করাবে।
চাচা, কাকী মারা যাইতাছে–একজন ডাক্তার দরকার।
শোন মতি, তোমাকে একটা কথা বলি–আমার নানা ডাক্তার ঠিকই আছে–শেষ মুহূর্তের একটা রোগি দেখবে, তারপর রোগি যাবে মরে–এটা কি ভাল? লোকজনের ধারণা হবে, আমরা নাতনী খারাপ ডাক্তার। এটা তো আমি হতে দেব না। কিছুতেই না। মেয়েটা এসেছে বেড়াতে, অসুখবিসুখ নিয়ে ঘাটাঘাটি করার জন্য আসে নাই…।
একটা মানুষ মারা যাইতেছে।
কপালে মৃত্যু থাকলে মারা যাবেই। ডাক্তার গুলে খাওয়ালেও কিছু হবে না। গ্রামের মানুষের আপনার নাতনীর উপর দাবি আছে স্যার। সেও তো এই গ্রামেরই মেয়ে…
ইরতাজুদ্দিন বিরক্ত গলায় বলল, যুক্তিতর্ক শুরু করলা কেন? এটা তো যুক্তিতর্কের বিষয় না।
আমি উনারে নিজে একটু বইল্যা দেখি–উনি যদি যাইতে চান… কাকী বঁচবো না আমি জানি। তবু মনের শান্তি। সে বুঝবো তাকে বাঁচানোর চেষ্টার ত্রুটি হয় নাই।
এটা বুঝে লাভ কি?
মতি চুপ করে রইল। ইরতাজুদ্দিন বললেন–খামাখা দাঁড়িয়ে থাকবে না। চলে যাও। আর শোন–খালি পায়ে আমার বাংলোঘরে উঠবে না।
মতি তারপরেও দাঁড়িয়ে রইল। নড়ল না। ইরতাজুদ্দিন কঠিন গলায় বললেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন?
মতি বলল, আমি উনার সঙ্গে কথা না বইল্যা নড়ব না। উনার উপর আমার দাবি আছে।
তার উপর তোমার দাবি আছে মানে? বর্বরের মত কি বলছ তুমি? কি করছ তুমি?
মতি চুপ করে আছে। আসলেই তো, তার কিসের দাবি! বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে লগি ঠেলে সে এদের নিয়ে এসেছে। এতে খানিকটা দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়–কিন্তু তার জন্যে সে পারিশ্রমিক নিয়েছে। পঞ্চাশটা টাকা না নিলে দাবি থাকত। এখন নেই। মতি বলল, উনি যদি নিজের মুখে না বলেন তাইলে আমি চইল্যা যাব।
সে না বললে তুমি যাবে না?
না।
দাঁড়িয়ে থাকবে এখানে?
জ্বি।
তুমি যে এই দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ছাগল সেটা তুমি জান?
ছাগল হই আর না হই–আমি উনার সঙ্গে কথা না বইল্যা নড়ব না।
ইরতাজুদ্দিন অনেক কষ্টে রাগ সামলে নাতনীকে আনতে গেলেন।
শাহানা শান্ত মুখে এসে দাঁড়াল। মতি বলল, বড় বিপদে পইরা আসছি। পরাণ কাকার স্ত্রী মরতে বসছে। সন্তান প্রসব হইতাছেনা। আপনি কি তারে একটু চউখের দেখা দেখবেন?
শাহানা তার দাদাজানকে স্তম্ভিত করে দিয়ে বলল, অবশ্যই দেখব।