আট
পরমহংস চলে যাওয়ার পর অনিমেষ অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এই বাদুড়ঝোলা বাস ট্রামে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব নয়। টনটন করছে অপারেশনের জায়গাটা। এতদিন দিব্যি ছিল, কখনও কষ্ট হয়নি। আজ ট্রামে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে আচমকা এই ব্যথাটা শুরু হয়ে গেল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে তবু সহ্য করা যায়, কিন্তু সামনে পা ফেললে মনে হচ্ছে চোখের সামনে লক্ষ আগুনের ফুলকি নাচছে। জোড়া হাড়টা কি খসে গেল? যাঃ, তা যদি হত তা হলে নিশ্চয়ই এতক্ষণ তার হুঁশ থাকত না। সোজা হয়ে থাকলে ব্যথাটা সবসময় থাকছে না, মাঝে মাঝে থাই থেকে একটা ঘূর্ণির মতো পাক খেয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। ডাক্তার বলেছিল ষাট বছর বয়স অবধি কোনও অসুবিধা হবে না। তারপর ওখানে বাতের যন্ত্রণা হতে পারে। কিন্তু মাত্র পাঁচ বছর বাদেই এইরকমটা হয়ে গেল? হয়তো পা বেকায়দায় পড়েছিল, অনিমেষ ঘামে ভিজে চোখ বন্ধ করল। এই যদি শরীরের অবস্থা হয় তা হলে সে জীবনে কোনও কিছুই করতে পারবে না। একটা অক্ষম পঙ্গু মানুষের পক্ষে কোনও স্বপ্ন দেখা বড় রকমের ভ্রান্তি।
নিজের বিছানায় শুয়ে পড়তে অনিমেষ ব্যাকুল হয়ে উঠল। অথচ হেঁটে যে এখান থেকে হস্টেলে ফিরে যাবে তা অসম্ভব। অনিমেষ দেখল দূরে একটা রিকশা দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু দু’জন বৃদ্ধা রিকশাওয়ালার সঙ্গে দর কষাকষি করছেন। রিকশা করে হস্টেলে ফিরে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। এখান থেকে যা দূরত্ব তাতে ওরা এক টাকার কম নিশ্চয়ই নেবে না। অথচ পকেটে শুধু সেটুকুই রয়েছে। কাছেপিছে আর রিকশা নেই। অনিমেষ অপেক্ষা করছিল যদি ওই বৃদ্ধারা বিফল হয়ে রিকশাওয়ালাকে ছেড়ে দেন। কিন্তু ওর নাকের ডগা দিয়েই রিকশাওয়ালা তাদের নিয়ে বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে ঢুকে গেল।
অনিমেষ যখন সাতপাঁচ ভাবছে তখন হাওয়া উঠল। এতক্ষণ লক্ষ করেনি কোন ফাঁকে আকাশে একটু একটু করে মেঘ জমেছিল, এখন সেগুলো ভরাট হয়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি এসে যাবে এই আশঙ্কায় রাস্তাঘাটের চেহারা পালটে যেতে লাগল দ্রুত। বাসস্টপে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা মরিয়া হয়ে এক-একটা বাসে ওঠার চেষ্টা করছে। বৃষ্টি নামার আগেই সবাই বাড়ি ফিরতে চাইছে। অনিমেষ হাল ছেড়ে দিল। তার পক্ষে যখন কিছু করা অসম্ভব তখন খামোখা চিন্তা করার অর্থ হয় না। আসুক বৃষ্টি, একসময় রাত আরও গভীর হলে নিশ্চয়ই ট্রাম খালি হবে, তখন কোনওরকমে উঠে পড়লেই হবে। হস্টেলের গেট বন্ধ হয়ে গেলে সুপারিন্টেন্ডেন্টকে সত্যি কথা বলে দিলেই হবে, তাতে তিনি যদি অসন্তুষ্ট হন তা হলে হবেন। পেছনে ফুটপাতের ওপর যে বইয়ের দোকানগুলো হয়েছে তার একটায় ভাল ছাউনি আছে। অনিমেষ চেষ্টা করল সেই ছাউনির তলায় গিয়ে দাঁড়াতে। বৃষ্টি এলে নিশ্চয়ই হুটোপুটি শুরু হয়ে যাবে।
ব্যথাটা এখন আর পাক দিয়ে উঠছে না। কিন্তু হাঁটা যাচ্ছে না কিছুতেই। অনিমেষ পাশ ফিরতেই মনে হল একটা গাড়ি দ্রুত গতিতে ওর সামনে দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। কেউ চেঁচামেচি করছে শুনে সে গাড়িটার দিকে তাকাতে অবাক হয়ে গেল। থম্বোটোর সেই রুমমেট ট্যাক্সির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে তাকে ডাকছে হাত নেড়ে। পেছন থেকে বোঝা যাচ্ছে থম্বোটোর বন্ধু একা নেই। অনিমেষ এমন হকচকিয়ে গিয়েছিল যে প্রথমে সে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি কী করবে। বাসস্টপে দাঁড়ানো কয়েকজন ছুটে গেল ট্যাক্সিটার কাছে। থম্বোটোর বন্ধু হাত নেড়ে তাদের না বলল। ও নিশ্চয়ই হস্টেলে ফিরছে, অনিমেষের মনে হল আকাশ থেকে যেন দেবদূত থম্বোটার বন্ধুর চেহারা নিয়ে এসেছে, এরকমটা ভাবাই যায় না। এক পা এগোতেই অনিমেষের থাই থেকে কোমর অবধি একটা আগুনের বল ছুটে গেল। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত হয়ে গেল, চোখে জল এসে যাওয়ার উপক্রম। সে দেখল থম্বোটোর বন্ধু ট্যাক্সির দরজা খুলে প্রায় দৌড়ে ওর কাছে চলে এল, ‘হোয়াত্ হ্যাপেন্ড?’
এক হাত দিয়ে নিজের পা দেখাল অনিমেষ, ‘আই ক্যান নট ওয়াক। অফুল পেইন।’
থম্বোটোর বন্ধু ডান হাতে অনিমেষের পিঠে একটা বেড় দিয়ে বলল, ‘সাপোর্ট, সাপোর্ট।’
ব্যথার পা মাটি থেকে সামান্য ওপরে রেখে থম্বোটোর বন্ধুর কাঁধে ভর রেখে অনিমেষ অন্য পায়ে লাফাতে লাফাতে ট্যাক্সির দিকে এগোল। অনিমেষ লক্ষ করল এতে আর ব্যথাটা লাগছে না। শুধু থাই-এর কাছটায় শিরশির করছে। হঠাৎ ওর খেয়াল হল এই ছেলেটির সঙ্গে গতকাল রাত্রে থম্বোটোর ঘরে তার প্রায় মারামারি হবার উপক্রম হয়েছিল। ভারতীয়দের সম্পর্কে একটা হীন মন্তব্য এর মুখ থেকে বেরিয়েছিল। সেই মুহূর্তে এই ছেলেটিকে ওর খুব বাজে টাইপের মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন এইরকম পরিস্থিতিতে ও যেভাবে ট্যাক্সি থেকে নেমে এসে অযাচিতভাবে তাকে সাহায্য করছে গতকালের ঘটনার পর তা কি আশা করা যায়? মানুষের চরিত্র চট করে বোঝা মুশকিল এই সত্য আর-একবার প্রমাণিত হল। হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষ টের পেল থম্বোটার বন্ধুর শরীর থেকে অদ্ভুত নেশা-ধরানো একটা অচেনা গন্ধ বের হচ্ছে। এরকম গন্ধ সচরাচর কোনও চেনা মানুষের শরীরে অনিমেষ পায়নি। ট্যাক্সিতে উঠে কোনওরকমে বসতে-না-বসতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। আচমকা গুলিবর্ষণ শুরু হলে যেমন বিশৃঙ্খল অবস্থা শুরু হয়ে যায় তেমনি বাসস্টপে দাঁড়ানো মানুষেরা এলোমেলো দৌড়ে একটা ছাউনি খুঁজতে লাগল। থম্বোটোর বন্ধু দরজা বন্ধ করে সামনের সিটে গিয়ে বসতেই অনিমেষ ট্যাক্সির অন্য যাত্রীর দিকে তাকাল। পেছনের সিটের ওপাশের জানলা ঘেঁষে ভদ্রমহিলা বসে আছেন। এরকম আধুনিক বেশবাসের মহিলাদের উত্তর কলকাতায় দেখা যায় না। অনেক সময় ব্যয় করলে এইরকম প্রসাধন করা যায়। মাথার চুল কোমরের সামান্য নীচে, ফুলে ফেঁপে মেঘের মতো হয়ে রয়েছে। হাতকাটা জামা শঙ্খরঙা বাহুকে এমন সুঠাম সৌন্দর্য দিয়েছে যে চোখ সরানো দায় হয়ে ওঠে। চোখাচোখি হতেই ওর রক্তাক্ত ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক হয়ে চিকচিকে দাঁতের প্রান্ত দেখা গেল। অনিমেষ অনুমান করল মহিলা হাসছেন।
থম্বোটোর বন্ধু ড্রাইভারের পাশে বসে এদিকে শরীরটাকে ঘোরাল, ‘এনি অ্যাক্সিডেন্ট?’ সব কথা সব জায়গায় বলতে ইচ্ছে করে না, অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ। ‘নো ব্লিডিং?’ আবার প্রশ্ন করে থম্বোটোর বন্ধু উত্তর শুনে নিশ্চিন্ত হল। বৃষ্টির মধ্যে ট্যাক্সিটা কিছু দূর যেতেই দাঁড়িয়ে গেল। সামনে জ্যাম। ঠাসাঠাসি হয়ে রয়েছে গাড়িগুলো। বৃষ্টির ছাট থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অনিমেষ ওর দিকের জানলার কাচ তুলে দিতে দিতে খেয়াল করল থম্বোটোর বন্ধুর নামটাই তার জানা হয়নি অথচ ওর ট্যাক্সিতে সে লিফ্ট নিচ্ছে।
থম্বোটোর বন্ধু বিরক্ত গলায় বলল, ‘ভেরি ব্যাড ট্রাফিক সিস্টেম, ভেরি ব্যাড।’ এই মুহূর্তে অনিমেষেরও সেটাই মনে হচ্ছে। যেরকম বৃষ্টি চলছে তাতে আর কিছুক্ষণ বাদেই ঠনঠনে কালীবাড়ির সামনে এক কোমর জল দাঁড়িয়ে যাবে। তখন হবে আর এক মুশকিল। ট্যাক্সিওয়ালা বেশ বৃদ্ধ, বোধহয় উত্তরপ্রদেশের লোক, তেমন জল জমে গেলে যদি যেতে রাজি না-হয় তা হলেই সোনায় সোহাগা।
এইসময় বেশ শব্দ করে কোথায় বাজ পড়তেই মহিলা আঁতকে উঠলেন, ‘ও গড, আমার ভয় করছে।’ মুখ ফিরিয়ে অনিমেষ দেখল ভদ্রমহিলা সত্যিই ভয় পেয়েছেন। দুটো হাতে কান চাপা দিয়েছেন, চোখ আধবোজা। খুব সুন্দরী মেয়েদের ভয়-পাওয়া চেহারাটা আদৌ সুন্দর হয় না এটা জানা ছিল না।
থম্বোটোর বন্ধু ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘হাউ ইজ ইয়োর পেইন?’
না, এখন আর ব্যথাটা লাগছে না। হেলান দিয়ে বসতে পেরে শরীরে স্বস্তি ফিরে এসেছে। অনিমেষ ঘাড় নেড়ে হাসতেই ছেলেটা বলল, ‘দেন, মিট মাই ফ্রেন্ড, শীলা সেন। ভেরি হোমলি, রিয়েল সুইট।’
এইভাবে কারও সঙ্গে কখনও পরিচিত হয়নি অনিমেষ, মহিলার দিকে তাকিয়ে সে দুটো হাত জোড় করল, ‘আমার নাম অনিমেষ।’
সামান্য মাথা দুলিয়ে মহিলা অভিবাদন গ্রহণ করলেন। তারপর কপালে দুটো রেখা ফুটিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি অসুস্থ?’
অনিমেষ ‘না’-বলতে গিয়েও পারল না, ‘পায়ে একটু আঘাত লেগেছে।’
‘পায়ে? কোথায়?’ মহিলা এতক্ষণে যেন সিরিয়াস হলেন।
অনিমেষ প্যান্টের ওপর দিয়ে জায়গাটা দেখাল।
‘ওখানে, ওখানে আঘাত লাগল কী করে? ওখানে তো কোনও জয়েন্ট নেই!’
‘লাগল, লেগে গেল।’ অনিমেষ হাসল।
হঠাৎ থম্বোটোর বন্ধু বলে উঠল, ‘আই কান্ট ফলো ইউ। ইংলিশ, ইংলিশ প্লিজ!’
সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত নেকি গলায় মহিলা বলে উঠল, ‘ইস, সব যেন ওকে বুঝতে হবে! আমরা ভাই বাংলায় কথা বলব, না? কেলে ভূতটা ইংরেজিও ভাল জানে না।’
চমকে উঠল অনিমেষ। ভদ্রমহিলা এ কী ভাষায় কথা বলছেন? হয়তো এই মহিলার জন্যে কাল রাত্রে থম্বোটোর বন্ধু হইচই করেছিল। এই মহিলাকেই সম্ভবত দারোয়ান রাত আটটার পর আটকে দিয়েছিল। যার জন্যে থম্বোটোর বন্ধু অত আন্তরিকভাবে ক্ষিপ্ত হতে পারে তার মুখ থেকে এ ধরনের কথা কল্পনা করা যায় না। তা হলে কি মহিলা শুধুমাত্র কোনও স্বার্থের জন্য এই বিদেশি আফ্রিকান ছেলেটির সঙ্গে মিশছেন? কী স্বার্থ হতে পারে সেটা? হঠাৎ ওর খেয়াল হল কলকাতা শহরটা একটা বিচিত্র জায়গা। ক’দিন আগে একটা কাগজে পড়েছিল এখানে কয়েক হাজার সুন্দরী কলগার্ল বাস করেন যাঁদের চেহারা এবং কথাবার্তা খুবই অভিজাত এবং চাক্ষুষ কিছু বোঝা সম্ভব নয়। ইনি কি সেই শ্রেণির? না, তা হতেই পারে না। সেই বাল্যকাল থেকে, জলপাইগুড়ির বেগুনটুলির পাশের গলিতে যাওয়া ইস্তক, অনিমেষের একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিল, মেয়েরা অভাবের তাড়নায় পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করে। সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় কোনও মেয়ে ওই জীবনযাপন করতে কেন চাইবে? এই মহিলা যে পোশাক এবং প্রসাধন ব্যবহার করেছেন তাতে দারিদ্র্যের কোনও চিহ্ন নেই। সেরকম মেয়ে হলে সুদূর আফ্রিকা থেকে এসে থম্বোটোর বন্ধু কেন একে বন্ধু বলে পরিচয় দেবে?
মহিলা হাসলেন এবার, সত্যি সত্যি, ‘কী ভাবছেন?’
অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, ‘না তেমন কিছু না।’
মহিলা বললেন, ‘তা হলে কিছু একটা তো বটেই! আপনিও কি ওর সঙ্গে একই হস্টেলে থাকেন? মানে যে হস্টেলে সব বাচ্চারা থাকে?’
থম্বোটোর বন্ধু এবারে অধীর গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘ইংলিশ, ইংলিশ।’
‘শাট আপ।’ মহিলা ধমক দিলেন। গলার স্বর চড়ায় উঠলে একটুও পেলবতা থাকে না অনিমেষ লক্ষ করল। ‘ডোন্ট বিহেভ লাইক এ কিড।’ উচ্চারণে সামান্য জড়তা নেই এবং আশ্চর্য ব্যাপার, সাপের মাথায় ধুলোপড়ার মতো থম্বোটোর বন্ধু কেমন মিইয়ে গেল বকুনি শুনে। জুলজুল চোখে মহিলার দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করতে মহিলা স্তোক হাসি হাসলেন, ‘ইউ নটি বয়!’ অনিমেষ দেখল থম্বোটোর বন্ধু তাতেই নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুরে সোজা হয়ে বসে সামনের গাড়িগুলো লক্ষ করতে লাগল এবার।
মহিলা বললেন, ‘এরা এমনিতে খুব রাফ হয়, কিন্তু ট্যাক্ল করতে পারলে এদের মতো সহজ শিশু পৃথিবীতে আর নেই। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, আপনাদের হস্টেলের অমন নিয়ম কেন?’
অনিমেষ বলল, ‘ওটা কলেজ স্টুডেন্টদের থাকার জায়গা। তাই কিছু কিছু নিয়ম করতেই হয়। আমরা যারা কলেজ ছাড়িয়ে গেছি তারাও নিয়মটাকে মানি।’
মহিলা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি কলেজে পড়েন না?’
‘এটা এক রকমের কলেজ বটে, আমি এম এ পড়ি।’
‘ও মা, তাই নাকি! কী ভাল ছেলে গো! হস্টেলে থাকো, তোমার বাড়ি কোথায় ভাই?’
‘জলপাইগুড়ির কাছে একটা চা-বাগানে।’
‘চা-বাগান? ও মা, নিজেদের চা-বাগান আছে?’ মহিলা দ্রুত অনিমেষের গা ঘেঁষে এসে বসলেন ‘চা-বাগান খুব সুন্দর জায়গা, না? দার্জিলিঙে যেতে আমি দু’চোখ ভরে দেখেছি। কেমন স্বপ্নের মতো দেখতে না? আমার খুব যেতে ইচ্ছে করে।’
অনিমেষ হকচকিয়ে গিয়েছিল মহিলার ভাবভঙ্গিতে। একটু ধাতস্থ হয়ে সে প্রতিবাদ করতে গেল যে তাদের নিজেদের কোনও চায়ের বাগান নেই। চায়ের বাগানের মালিকরা প্রচুর টাকার মালিক, তার বাবা একটি ইওরোপীয় মালিকানায় পরিচালিত চা-বাগানে চাকরি করেন মাত্র। কিন্তু এ কথাগুলো বলার আগেই থম্বোটোর বন্ধু চিৎকার করে উঠল সামনের সিট থেকে। চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেল অভিনব দৃশ্য। থম্বোটোর বন্ধু তিড়িং করে লাফিয়ে জুতোসুদ্ধ গাড়ির সিটের ওপর বসে বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় অনর্গল কিছু বলে যেতে লাগল যার এক বর্ণ অনিমেষ বুঝতে পারছে না। উত্তেজিত এবং ভয় পাওয়া মুখ, দুটো আঙুল সামনের পা রাখার জায়গার দিকে উঁচিয়ে ধরেছে। বুড়ো ট্যাক্সি ড্রাইভার প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিল কালো সাহেবের চালচলন দেখে। কিন্তু সিটের উপর জুতো তুলে উঠে বসতে দেখে সে নিশ্চয়ই বিরক্ত হয়েছিল। কারণ সাহেবের উত্তেজনার কারণটা অনুসন্ধান করতে তাকে নীচের দিকে ঝুঁকে তাকাতে দেখা গেল। অনিমেষ উঠে ব্যাপারটা কী বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে থমকে গেল। এখন কোনওরকম নড়াচড়া আবার যন্ত্রণাটাকে ফিরিয়ে আনতে পারে। ভদ্রমহিলা ট্যাক্সির মধ্যে যতটা পারেন উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা কী বোঝার চেষ্টা করছেন কিন্তু কোনও হদিশ পাচ্ছেন না। ওইটুকু জায়গায় ভদ্রমহিলা দাঁড়াতে চেষ্টা করায় তাঁর শরীরের অনেকটা অনিমেষের ওপর চেপে গেছে, একজন রমণীর শরীর নয় শুধুমাত্র, প্রবল চাপের জন্যই অনিমেষের প্রাণ বেরুবার দায়। এতক্ষণে ড্রাইভার বস্তুটিকে আবিষ্কার করে ফেলেছে। একটি নধর কালো কুচকুচে আরশোলা হাতের মুঠোয় নিয়ে সে বিরক্তির সঙ্গে একবার সবাইকে দেখিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল বাইরে।
যেন সোডার বোতল খুলে গেল হঠাৎ, মহিলা খিলখিল করে উন্মাদ ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে পেছনের সিটে লুটিয়ে পড়লেন। অনিমেষ দেখল ওঁর গায়ের আঁচল নীচে লুটিয়ে পড়েছে, বড় গলার কালো সিল্কের ব্লাউজ তাঁর বিশাল বক্ষকে আবদ্ধ করতে পারছে না। অনিমেষ নিজের অজান্তেই সেদিকে তাকিয়েছিল। হাসতে হাসতেই সেটা লক্ষ করে মহিলা অদ্ভুত ভঙ্গিতে অনিমেষকে টুসকে দিয়ে আঁচল ঠিক করে নিয়ে বলে উঠলেন, ‘ওরে বাবা, কী বীরপুরুষ রে! একটা আরশোলা দেখে ভিরমি খাচ্ছেন, আবার মুখে বড় বড় বাত— সিংহের দেশের লোক আমি, গরিলার দেশের লোক আমি।’
বাইরে ফুটপাতের পাশে পড়ে থাকা আরশোলাটার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে ছিল থম্বোটোর বন্ধু। উত্তেজনাটা এখন থিতিয়েছে। তারপর পা দুটো সন্তর্পণে নীচে নামিয়ে আর-একবার ভাল করে দেখে নিল জায়গাটা, দেখে পেছনের সিটের দিকে ফিরে মুক্তোর মতো দাঁত বের করে হাসল, ‘আই কান্ট স্ট্যান্ড।’
‘খুব গর্বের কথা, আবার চেঁচিয়ে বলা হচ্ছে!’ মহিলা টিপ্পনী কাটলেন। এতক্ষণে ট্যাক্সিটা আবার চলতে শুরু করেছে। সামনের জট খুলতেই গাড়িগুলো শামুকের মতো এগোচ্ছে। একটু বাদেই মনে হল ওরা বিরাট নদীর মধ্যে এসে পড়েছে। ফুটপাত দেখা যাচ্ছে না জলের ঢেউ দু’পাশের দোকানের মধ্যে ঢুকে পড়ার উপক্রম। থম্বোটোর বন্ধু সোৎসাহে বলে উঠল, ‘হাউ ফানি, উই আর সেইলিং।’
অনিমেষেরও মজা লাগছিল কিন্তু সেই সঙ্গে একটা ভয়ও ছিল, যদি ইঞ্জিনে জল ঢুকে যায় তা হলে চিত্তির। এখানে জলবন্দি হয়ে কতক্ষণ বসে থাকতে হবে কে জানে। ড্রাইভার সমানে নিজের মনে গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে। একটু একটু করে জল ভেঙে গাড়ি এগোচ্ছে যেন কতটা পথ আসা হল। অদ্ভুত উত্তেজনার মধ্যে বিদ্যাসাগর কলেজ ছাড়িয়ে আসতে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এখন আর জল কিংবা জ্যাম নেই। ভেজা রাস্তা দিয়ে এগোতে দেখা গেল সারবন্দি হয়ে ট্রাম দাঁড়িয়ে আছে। অনিমেষ বলল, ‘খুব জোর বাঁচা গেল।’
মহিলা চোখ বড় করে বললেন, ‘গাড়িটা আটকে থাকলে খারাপ লাগত নাকি? বেশ তো আমরা অনেকক্ষণ গল্প করতে পারতাম!’
অনিমেষ এর উত্তরে কী বলবে বুঝতে না-পেরে হাসল। হাসি অনেক কিছুর উত্তর হতে পারে, যে যেমন বুঝে নেয়।
বিবেকানন্দ রোডের কাছে গাড়িটা আসতেই মহিলা বললেন, ‘কিন্তু আমি ভাবছি, পায়ে যখন এত যন্ত্রণা, হাঁটা যাচ্ছে না তখন একা একা হস্টেলে থাকা যাবে কী করে! ওটা তো আর বাড়ি নয় যে কেউ সেবাশুশ্রূষা করবে!’
অনিমেষ বলল, ‘না, না, একটু শুয়ে থাকলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’
মহিলা বললেন, ‘যদি না-হয়! আমার ইচ্ছে করছে বাড়িতে নিয়ে যাই। কারও কষ্ট হচ্ছে, ভাবলে এত খারাপ লাগে, মন কেমন হয়ে যায়!’
অনিমেষ লজ্জা পেল, ‘আপনি কিছু ভাববেন না।’
মহিলা বললেন, ‘ভাবব না কী কথা! আলাপ হল আর ভাবব না? ঠিক আছে, কেমন থাকা হচ্ছে আমায় যদি জানিয়ে দেওয়া হয় তা হলে নিশ্চিন্ত হই। আমার নম্বর হচ্ছে পঁয়ত্রিশ চারটে শূন্য। মনে থাকবে? খুব সোজা। শুধু এক্সচেঞ্জ নম্বরটা মনে রাখলেই হল, তারপর সব ফাঁকা। ইংরেজিতে বললাম না, সামনের দুটো কান এদিকে খাড়া হয়ে আছে।’ কথা বলতে বলতে গলার স্বর নীচে নেমে এল, ফিসফিস শোনাল।
এত অল্প পরিচয়ে, বলতে গেলে মাত্র কয়েক মিনিটের বলা যায়, কোনও মহিলা এরকম আন্তরিক ভঙ্গিতে আমন্ত্রণ জানাতে পারে? অনিমেষের মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। হঠাৎ ওর মনে হল তার নিজের মনে নিশ্চয়ই কু আছে। মহিলা তার আহত হবার সংবাদ শুনে স্নেহপ্রবণ হয়ে তার সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে চাইতে পারেন— তাতে অস্বাভাবিক কী আছে? সে হয়তো মিছেই ব্যাপারটাকে সন্দেহের চোখে দেখছে।
হেদোর আগের গলি দিয়ে ট্যাক্সিটাকে ঘোরাতে বললেন মহিলা। স্কটিশের পাশ দিয়ে ট্যাক্সি অনেকটা এগিয়ে একটা লাল রঙের বাড়ির সামনে থামতেই মহিলা একটু অপ্রসন্ন চোখে বৃষ্টির দিকে তাকালেন। এখন বৃষ্টির সেই তেজটা নেই, কিন্তু যেভাবে পড়ছে তাতে একটু হাঁটলেই ভিজে যাওয়া অসম্ভব নয়।
এই বৃষ্টির মধ্যেই থম্বোটোর বন্ধু লাফিয়ে নেমে পড়ল ট্যাক্সি থেকে। নেমে গাড়িটাকে পাক দিয়ে এ-পাশের দরজায় এসে সেটাকে খুলে ধরল, ‘মে আই গো উইথ ইউ?’ মহিলা পুতুলের মতো ঘাড় নাড়লেন, ‘নট টু নাইট ডার্লিং।’ তারপর অনিমেষের দিকে ফিরে বললেন, ‘চলি ভাই, মনে থাকে যেন!’ কথা শেষ করেই উনি প্রায় দৌড়ে খোলা জায়গাটা পেরিয়ে লাল বাড়িটার ভেতরে ঢুকে গেলেন। অনিমেষ দেখল নামবার আগে মহিলা দ্রুত হাতে আঁচলটাকে ঘোমটার মতো আড়াল করে নিয়েছিলেন এবং চলে যাওয়ার সময় একবারও পেছন ফিরে তাকালেন না। বৃষ্টির জন্য রাস্তা ফাঁকা, রকগুলোতেও কেউ নেই।
থম্বোটোর বন্ধু অকপটে সেই চলে যাওয়া দেখল। বৃষ্টিতে ভিজে যে একশা হয়ে গেছে সেদিকে একটুও খেয়াল নেই। তারপর শব্দ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিমেষের পাশে উঠে বসল। সিট ভিজে যাচ্ছে বলে ড্রাইভার বিরক্তি প্রকাশ করতেই সে ঘাড় নেড়ে হাউহাউ করে নিজের ভাষায় কিছু বলে সোজা হয়ে বসল। অনিমেষ ড্রাইভারকে কিছু মনে না-করতে বলে হস্টেলের ঠিকানাটা জানিয়ে দিতে আবার ট্যাক্সি চলা শুরু করল।
থম্বোটোর বন্ধু অনিমেষের হাতের ওপর হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, ‘শি টকড অ্যাবাউট মি?’
অনিমেষ বুঝল মহিলাকে জরিপ করার চেষ্টা করছে ছেলেটা। সে ঘাড় নেড়ে জানাল, হ্যাঁ।
‘টেল মি হোয়াট শি টোলড ইউ!’
অনিমেষ খুব অস্বস্তিতে ওর দিকে তাকাল। মহিলার কথাবার্তা খুব স্বচ্ছন্দ ছিল না। বোঝাই যাচ্ছিল থম্বোটোর বন্ধু সম্পর্কে মহিলার কিছুমাত্র আন্তরিক ধারণা নেই। কিন্তু ওসব কথা এই ছেলেটিকে কী করে বলা যায়। এর হাবভাবে মহিলাটি সম্পর্কে প্রচণ্ড আগ্রহ স্পষ্ট। এরকম চললে শেষ পর্যন্ত হয়তো চূড়ান্ত আঘাত পাবে ছেলেটি। অনিমেষের মনে হল কথাটা থম্বোটোকে খুলে বলা যায়। যদি কিছু সাবধানবাণী ওকে শুনতে হয় তা হলে তা থম্বোটোর মুখ থেকেই শোনা ভাল। কিন্তু এখন একে কী বলা যায়! তীব্র চাহনি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অনিমেষ বলল, ‘শি টোলড মি দ্যাট ইউ আর এ ভেরি গুড বয়। অ্যান্ড অল দিজ প্রেইজি ওয়ার্ডস।’
চোখ বন্ধ করল থম্বোটোর বন্ধু। তারপর খুব গাঢ় গলায় বলল, ‘আই নেভার লভ্ড ওম্যান বিফোর হার। শি ইজ সামথিং।’
হস্টেলের সামনে ট্যাক্সিটা দাঁড়াতে থম্বোটোর বন্ধু ভাড়া মিটিয়ে দিল। প্রায় পনেরো টাকার মতো মিটারে উঠেছে। অনিমেষ দেখল ওর পার্সে থোকা থোকা নোট। চট করে অনুমান করা যায় না টাকার অঙ্কটা। এত টাকা কোনওদিন একসঙ্গে হাত দিয়ে ধরেনি অনিমেষ। পার্সটা যেভাবে ছেলেটা হিপ পকেটে গুঁজে রাখল তাতে বিন্দুমাত্র সতর্কতা নেই। ট্যাক্সি থেকে নামতে গিয়েই সমস্ত শরীর দুলে উঠল অনিমেষের। এতক্ষণ যে বসে ছিল সেটা ছিল একরকম, ব্যথাটার কোনও অস্তিত্ব ছিল না। এখন মাটিতে পা দিয়ে শরীরের ভার রাখতেই মনে হল থাই থেকে একটা আগুনের গোলা পাক খেয়ে কোমরে উঠে এল। যন্ত্রণাটাকে দাঁতে চেপে সামলাল অনিমেষ। দু’চোখে পলকেই জল এসে গেল। থম্বোটোর বন্ধু সমস্ত ঘটনাটা চুপচাপ লক্ষ করছিল। এখন বৃষ্টি টুপটাপ পড়ছে। নিঃশব্দে এগিয়ে এসে অদ্ভুত কায়দায় ছেলেটা অনিমেষকে কাঁধে তুলে নিল। ব্যাপারটা এমন আকস্মিক এবং সহজ ভঙ্গিতে ঘটল যে অনিমেষ হতবুদ্ধি হয়ে গেল। খুব কায়দা করে ওকে ধরে ছেলেটি সিঁড়ি অবধি হেঁটে গেল। থম্বোটোর বন্ধুটি মোটেই স্বাস্থ্যবান নয় কিন্তু ওর গায়ে যে এত শক্তি আছে তা অনুমান করা যায় না। সাবধানে সিঁড়ির গোড়ায় ওকে নামিয়ে দিয়ে ছেলেটা জিজ্ঞাসা করল, ‘হোয়াটস ইয়োর রুম নাম্বার?’
অনিমেষ জানাতেই সে দ্রুত ওপরে উঠে গেল। রেলিং ধরে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকল অনিমেষ। হস্টেলের গেটটা ভেজানো ছিল, থম্বোটোর বন্ধু সেটাকে ঠেলে ঢুকেছে। বাঁ দিকে দারোয়ানের ঘর থেকে তুলসীদাসী রামায়ণের সুর ভেসে আসছে। এখন বোধহয় প্রায় ন’টা বেজে গেছে। এতক্ষণ খেয়াল হয়নি, এবার অনিমেষের মনে হল আবার কি ওকে হাসপাতালে গিয়ে এক বছর বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে? প্রচণ্ড আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল অনিমেষ। এইভাবে পঙ্গুর মতো সমস্ত জীবন কাটানোর চাইতে মরে যাওয়া ঢের ভাল। সারাজীবন টিপটিপ করে বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না।
নানারকম কণ্ঠস্বর ভেসে এল ওপরে, অনিমেষ দেখল ত্রিদিব আরও কয়েকজনকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে নীচে নেমে আসছে। এক দৌড়ে কাছে এসে অনিমেষকে জিজ্ঞাসা করল ত্রিদিব, ‘কী হয়েছে? শুনলাম খুব উন্ডেড হয়েছ?’ অনিমেষ দেখল আরও কয়েকজন তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে আর প্রত্যেকের মুখচোখে উদ্বেগ স্পষ্ট। অনিমেষ খুব অস্বস্তিতে পড়ল, এরকমটা হবে ভাবেনি সে। সিঁড়ির ওপর দিকে থম্বোটোর বন্ধু নির্লিপ্তের মতো দাঁড়িয়ে ছিল, চোখাচোখি হতে হাত নেড়ে চলে গেল নিজের ঘরের দিকে। যেন ওর কর্তব্য শেষ, এরকম ভাব।
অনিমেষ বলল, ‘ট্রামে উঠতে হঠাৎ জখম পায়ে ব্যথা হল। তারপর থেকে আর হাঁটতে পারছি না। এখন যন্ত্রণাটা না-হাঁটলে হচ্ছে না।’
ত্রিদিব ধমকে উঠল, ‘নিশ্চয়ই রানিং ট্রামে উঠছিলে?’
অনিমেষ অস্বীকার করল না, ‘হ্যাঁ, বুঝতে পারছি না জোড়া হাড় ভাঙল কি না!’
ভিড়ের মধ্যে দুর্গাপদ ও গোবিন্দকে দেখতে পেল অনিমেষ। গোবিন্দ ত্রিদিবকে বলল, ‘সিক রুমে নিতে হবে?’
অনিমেষ বলল, ‘না, না, সিক রুমে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। তোমরা একটু হেল্প করো, নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ি।’
ওরা কোনও কথা শুনল না, অনিমেষকে ধরাধরি করে মাথার ওপর তুলে সন্তর্পণে ওর ঘরে ফিরিয়ে আনল। খাটে শুইয়ে দিয়ে ত্রিদিব ভিড়টাকে সরাল। ঘরে শুধু গোবিন্দ আর দুর্গাপদ রয়ে গেল। ত্রিদিব গোবিন্দকে ফিসফিসিয়ে কিছু বলতে সে ছুটে বেরিয়ে গেল।
দুর্গাপদ জিজ্ঞাস করল, ‘ব্যথাটা ঠিক কোথায় হচ্ছে?’
অনিমেষ হাত দিয়ে থাই দেখাতে ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। অনিমেষের মনে হল এরা খুব ঘাবড়ে গেছে।
ত্রিদিব জিজ্ঞাসা করল, ‘জায়গাটা দেখেছ?’
ঘাড় নাড়ল অনিমেষ। তার নিজের পক্ষে প্যান্টের পা গুটিয়ে থাই দেখা সম্ভব নয়। আর নিশ্চয়ই জায়গাটার বাইরে কিছু হয়নি, রক্তটক্ত বেরুবার প্রশ্ন উঠতে পারে না।
ত্রিদিব বলল, ‘ইজি হয়ে শুয়ে থাকো, কোনও চিন্তা কোরো না, আমি দেখছি।’
দুর্গাপদ ওর শার্ট খুলে নিল, ঘামে গেঞ্জি সপসপ করছে। সেটাকে খুলে ফেলতে বেশ আরাম লাগল। ত্রিদিব প্যান্টের বোতামে হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আন্ডার প্যান্ট পরা আছে?’
প্রশ্নটা শুনে হেসে ফেলল অনিমেষ। কাল রাত্রে মদ্যপান করে এসে ত্রিদিবরা ওর ওপর যখন জুলুম করেছিল, জোর করে উলঙ্গ করেছিল তখন এ-কথা একবারও চিন্তা করেনি। অথচ আজ খুব ভদ্রভাবে জেনে নিচ্ছে যাতে অনিমেষ লজ্জায় না-পড়ে। ওকে হাসতে দেখে ত্রিদিব জিজ্ঞাসা করল, ‘হাসির কী হল?’
অনিমেষ বলল, ‘কিছু না। আন্ডার প্যান্ট পরাই আছে। তোমরা আমাকে একটু ধরো, আমি নিজেই প্যান্ট চেঞ্জ করে নিচ্ছি।’
ওরা সে কথায় কান না-দিয়ে প্যান্টটা সন্তর্পণে অনিমেষের শরীর থেকে এমনভাবে খুলে নিল যাতে ওর একটুও ব্যথা না-লাগে। দুর্গাপদ অনিমেষের থাইয়ের ওপর ঝুঁকে পড়ে ভাল করে দেখে বলল, ‘কোথাও তো ফোলা দেখছি না, কিন্তু তোমার বুলেট মার্কের নীচে বেশ কিছুটা জায়গা লাল হয়ে আছে। বোধহয় ওখানেই কিছু হয়েছে।’
ত্রিদিব লাল জায়গাটায় হাত রেখে বলল, ‘ওরে ফাদার! একদম ফার্নেস হয়ে রয়েছে। একদম নড়াচড়া করবে না, চুপচাপ শুয়ে থাকো।’ একটা পাতলা চাদর নিজের বিছানা থেকে তুলে এনে সে অনিমেষের কোমর অবধি ঢেকে দিল।
একটু বাদেই গোবিন্দ ফিরে এল, সঙ্গে হস্টেলের ডাক্তার আর হস্টেলের সুপার মিস্টার দত্ত। হস্টেলের ডাক্তারকে সবাই আড়ালে ঘোড়ার ডাক্তার বলে। ওঁর চিকিৎসায় নাকি কখনও কোনও রুগি সারে না। সবরকম অসুখেই তিনি একই মিকশ্চার আর ট্যাবলেট ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেন। এককালে ছেলেরা এ নিয়ে রাগারাগি করেছে, কোনও ফল হয়নি। উনি ছেলেদের কাছ থেকে কোনও ফি নেন না, হস্টেলের সঙ্গে তাঁর একটা মাসকাবারি ব্যবস্থা আছে। অথচ এই হস্টেলের কারও কোনও অসুখ হলে বাইরের অন্য কোনও ডাক্তারকে ডাকা যাবে না, ইনি যদি সুপারিশ না-করেন।
ডাক্তার সেন হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হয়েছে, কী হয়েছে?’ একটা কথা দু’বার বলা তাঁর অভ্যেস, কথা বলেন হড়বড়িয়ে। ত্রিদিব বলল, ‘ওর পায়ে খুব লেগেছে ট্রামে উঠতে গিয়ে, হাঁটতে পারছে না।’
‘লেগেছে মানে কী? ট্রাম থেকে পড়ে গিয়েছে?’ একটা চেয়ার বিছানার পাশে টেনে এনে বসলেন ডাক্তার সেন।
ত্রিদিব বলল, ‘না, উঠতে গিয়ে-’
‘পেশেন্ট কে, পেশেন্ট কে? পেশেন্টকে বলতে দিন।’ ডাক্তার সেন বললেন।
অনিমেষ যতটা পারে সংক্ষেপে আজকের ঘটনাটা বলতেই ডাক্তার ‘হুম’ বলে মিস্টার দত্তের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন, ‘মশা মারতে কামান দাগা মশাই। এর জন্যে আমাকে ডাকার কোনও দরকার ছিল না, কোনও দরকার ছিল না। সিম্পল ব্যাপার, শিরায় টান লেগেছে, ছেলেমানুষের কারবার।’
কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন ডক্টর সেন। অনিমেষ বন্ধুদের চোখে মুখে প্রতিক্রিয়া দেখে দ্রুত বলে ফেলল, ‘আমার পায়ের ঠিক এই জায়গার হাড় পাঁচ বছর আগে ভেঙে দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল।’
‘অ্যাঁ?’ চমকে উঠলেন ডক্টর সেন, ‘ওখানকার হাড়? হাউ?’
‘অ্যাক্সিডেন্টে।’ অনিমেষ মিস্টার দত্তের সামনে বুলেটের কথাটা বলতে চাইল না। আবার ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে অনিমেষের পা থেকে চাদর সরিয়ে ফেলেন ডক্টর সেন। পুরনো অপারেশনের জায়গাটা চোখে পড়তেই বিড়বিড় করে বললেন, ‘মেজর অপারেশন হয়েছিল দেখছি।’ তারপর ধীরে ধীরে দু’হাত দিয়ে অনিমেষের পা ধরে সেটাকে ভাঁজ করলেন, ‘লাগছে? ফিলিং পেইন?’
‘না, হাঁটুর কাছে কোনও ব্যথা নেই,’ অনিমেষ জানাল।
এবার থাইয়ের মাংস ঠুকে ঠুকে দেখলেন ডাক্তার সেন আর একই প্রশ্ন করে চললেন। কিন্তু অনিমেষ কোনও ব্যথা অনুভব করছিল না। পকেট থেকে রুমাল বের করে ডাক্তার সেন নাকের ডগা মুছে নিয়ে অন্য পকেট থেকে প্যাড বের করলেন। তারপর খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখে অনিমেষের হাতে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, ‘আজ রাত্রে খুব ব্যথা যদি হয় তবে অ্যানাসিন টাইপের কোনও ট্যাবলেট খেয়ে নিয়ো। চলি।’ আর দাঁড়ালেন না তিনি, মিস্টার দত্তের সঙ্গে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন।
অনিমেষের হাত থেকে প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে ত্রিদিব চেঁচিয়ে সবাইকে পড়ে শোনাল, ‘অ্যাডভাইস— কনসাল্ট এনি অর্থপেডিক ইমিডিয়েটলি। যা শালা! এর জন্য তোকে ডাকব কেন? ঘোড়ার ডাক্তার!’
গোবিন্দ খিঁচিয়ে উঠল, ‘ঘোড়ার ডাক্তার হলে তবু কথা ছিল, এ ব্যাটা নিশ্চয়ই কাকেদের চিকিৎসা করে। কারণ, কাকেদের কখনও অসুখ করে না।’
দুর্গাপদ এগিয়ে এসে অনিমেষের বিছানায় বসল, ‘তোমার কি এখন কোনও অস্বস্তি হচ্ছে অনিমেষ?’
অনিমেষ বলল, ‘আমি উঠে দাঁড়ালে বুঝতে পারব।’
দুর্গাপদ বলল, ‘তা হলে ওঠার দরকার নেই। স্বাভাবিক বুদ্ধিতে বলে যদি কারও হাড় ভাঙে তবে তা সেট না-করা পর্যন্ত যন্ত্রণা অসহ্য হয়। আমার মনে হচ্ছে তোমার পায়ের কোনও লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে। আমার দাদার একবার হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিলেন লিগামেন্ট ছিঁড়লে যেন কখনও মালিশ না-করা হয়, ক্রেপ ব্যান্ডেজ দিয়ে বেঁধে রাখাই যথেষ্ট।’
ত্রিদিব বলল, ‘কিন্তু ব্যান্ডেজটা করবে কোথায়?’
দুর্গাপদ এবার অনিমেষের পা নিয়ে পড়ল। মিনিট কয়েকের মধ্যে সে থাইয়ের নীচের দিকে হাঁটুর সামান্য ওপরে একটা জায়গা আবিষ্কার করে ফেলল যেখানে হাত দিলেই অনিমেষ চিৎকার করে উঠছে। জায়গাটায় কোনও বড় শিরা নেই। চিৎকারের সময় অনিমেষের মুখ নীল হয়ে যাচ্ছে এটা লক্ষ করল সবাই।
ত্রিদিব চাপা গলায় বলল, ‘সাধে কি ঘোড়ার ডাক্তার বলেছি, খালি বাকতাল্লা!’
গোবিন্দ বলল, ‘গরম সেঁক দিলে হয় না?’
দুর্গাপদ বলল, ‘সেঁক দিলে খারাপ হবে না তো?’
গোবিন্দ বলল, ‘বাড়িতে তো সবাইকে সেঁক দিতেই দেখেছি।’
দ্রুত ব্যবস্থা হয়ে গেল। কিচেন থেকে একটা ছোট্ট কয়লার উনুন নিয়ে আসা হল।
দুর্গাপদ যখন সেঁক দিচ্ছে তখন বেশ আরাম হচ্ছিল অনিমেষের। অনেকক্ষণ পরে স্বস্তি আসায় ওর দু’চোখ বুজে এল একসময়।
দুর্গাপদ জিজ্ঞাসা করল, ‘অনিমেষ, তুমি খাবে না?’
এখন ঘুম ছাড়া আর কিছু ইচ্ছে করছে না অনিমেষের। সে চোখ বুজে মাথা নাড়ল, না, খাবে না। দুর্গাপদ আর পীড়াপীড়ি করল না।
তখন নিশ্চয়ই মধ্যরাত, অনিমেষের ঘুম ভেঙে গেল। হুঁশ ফিরতেই ওর মনে হল পেটে ছুঁচো ডন মারছে। ধীরে ধীরে উঠে বসতেই সে অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল। ত্রিদিবের বিছানায় বসে গোবিন্দ আর দুর্গাপদ তাস খেলছে। পাশে মাটিতে রাখা কয়লার উনুনটা নিবে গেছে কখন। ত্রিদিব তাতেই ভাঁজ করা কাপড়টা গরম করার চেষ্টা করে তার পায়ে সেঁক দিয়ে চলেছে। অনিমেষ এমন হতভম্ব হয়েছিল যে মুখ থেকে তার কথা সরল না। এই ছেলেগুলো তাকে সেবা করার জন্য একটা রাত জেগে আছে! অথচ গতকাল এদেরই অন্যরকম চেহারা ছিল, মাতাল তিনটি যুবক অশ্লীলতার চূড়ান্ত করেছিল।
ওকে জাগতে দেখে ত্রিদিব সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন, আরাম পাচ্ছ?’
অনিমেষ থাইয়ের তলায় হাত দিয়ে আবিষ্কার করল, সেই পিন-ছোঁয়া যন্ত্রণা একদম নেই, শুধু জায়গাটা অসাড় হয়ে আছে। লজ্জিত গলায় অনিমেষ বলল, ‘আমি ঠিক হয়ে গেছি, তোমাদের আর রাত জাগতে হবে না, এবার শুয়ে পড়ো।’
খেলা থামিয়ে গোবিন্দ বলল, ‘আরে গুরু, রাত আর কোথায়? আর মাত্র এক ঘণ্টা, তার পরেই ফুড়ুত করে আকাশ ফরসা হয়ে যাবে। বাট, তুমি ফিট তো?’
দুটো হাতে বিছানায় ভর দিয়ে অনিমেষ বলল, ‘একবার উঠে দাঁড়ালে বুঝতে পারব।’
সঙ্গে সঙ্গে হাঁ হাঁ করে উঠল ত্রিদিব, ‘না, না, আজ রাত্রে উঠতে হবে না।’
দুর্গাপদ জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন? উঠে দেখুক গড়বড় আছে কি না!’
‘কাল সকালে দেখবে। উঠলে যদি ব্যথা লাগে তা হলে এখনই মন খারাপ হয়ে যাবে আমার। যতক্ষণ অনিমেষের ব্যথা না-হচ্ছে ততক্ষণ মনে হবে ও সুস্থ হয়ে গেছে।’ ত্রিদিব হাসল।
দুর্গাপদ চাপা গলায় বলে উঠলে, ‘কবিরা মাইরি এক নম্বরের এসকেপিস্ট।’
খিদে পাচ্ছে খুব, কিন্তু ঘরে কিছু নেই যা খাওয়া যায়। ত্রিদিবের স্টকে অবশ্য বিস্কুট থাকে, ক্রিম দেওয়া বিস্কুট। হস্টেলের ঠাকুরকে ডাকতে গেলে মারতে আসবে। অনিমেষ ত্রিদিবকে বলল, ‘কয়েকটা বিস্কুট দাও তো খাব।’
‘বিস্কুট?’ অবাক চোখে তাকাল ত্রিদিব, ‘এত রাতে বিস্কুট কেন? ওহো, তুমি তো রাত্রে কিছু খাওনি। যা শালা!’ এক লাফে উঠে গিয়ে ত্রিদিব তার শেলফ থেকে চৌকো টিনটা বের করে ঢাকনা খুলল। তারপর হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, ‘ইস, বিকেলে কিনব ভেবেছিলাম, একদম ভুলে গেছি। মাপ করো গুরু, একদম ইয়াদ ছিল না, দু’-তিনটে ভাঙা পড়ে আছে।’
খাবার কিছু না-পেয়ে অনিমেষ ভাবল চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লে নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়বে, ঘুমালে খিদে লাগবে না। কিন্তু খিদে যখন প্রবল হয় তখন যে ঘুম আসতে চায় না! সে এক গ্লাস জল চাইল। জল খেয়ে পেট ভরানো যাক।
দুর্গাপদ বলল, ‘খালি পেটে জল খাবে? তার চেয়ে একটু মাল দিয়ে জল খাও। ওতে প্রোটিন আছে, পেটও ভরবে, নার্ভ ঠিক থাকবে আর যন্ত্রণা দূর হবে।’
ত্রিদিব সম্মতির ঘাড় নেড়ে লুকোনো জায়গা থেকে কালকের বোতলটা বের করে দ্রুত হাতে একটা গ্লাসে সামান্য ঢেলে জল মিশিয়ে ওর দিকে বাড়িয়ে দিল, ‘আঃ, দারুণ ফ্লেভার, খেয়ে নাও, অমৃত।’
অনিমেষ অবিশ্বাসের গলায় বললে, ‘যাঃ, খামোকা মদ খেতে যাব কেন?’
ত্রিদিব বলল, ‘মদ কথাটা খারাপ। টেক ইট অ্যাজ মেডিসিন, অ্যাজ হেলথ টনিক। শরীর সুস্থ করার জন্য খাওয়া। নাও, হাঁ করো, সেবা করতে দাও।’