০৮. পনের বছর পর

পনের বছর পর লিলিয়ান আবার তাহেরকে নিয়ে ইন্দারঘাটে এসেছে। তাদের সঙ্গে দুটি ফুটফুটে মেয়ে। এগার বছরের সারা, সাত বছরের রিয়া। দুজনই হয়েছে মার মতো, শুধু চোখ পেয়েছে বাবার। বড় বড় কালো চোখ। মার নীল চোখ কেউই পায় নি। দুজনই খুব হাসিখুশি মেয়ে, কিন্তু এদের চোখের দিকে তাকালে মনে হয়–চোখ ভর্তি জল। এক্ষুণি বুঝি কাঁদবে।

তাদের আসা উপলক্ষে বাড়িঘর ঠিক করা হয়েছে। বাড়ির চারপাশের বাগান পরিষ্কার করা হয়েছে। মেয়ে দুটি মহানন্দে বাগানে ছোটাছুটি করছে। রিয়া ছুটতে গিয়ে উল্টে পড়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছে। হাঁটুর চামড়া ছিলে গেছে। কিন্তু রিয়া হাঁটু চেপে ধরে হাসছে। যেন এই বাগানবাড়িতে ব্যথা পাওয়াও এক আনন্দজনক অভিজ্ঞতা।

তাহের নিজেও বাগানে। সে খুব ব্যস্ত। আমগাছের ডালে দোলনা টানানোর চেষ্টা করছে। ডাল উঁচু। চেয়ারে দাঁড়িয়ে নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। বড় মেয়ে সারা বাবাকে সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে এলো। সে গম্ভীর গলায় বলল, বাবা শোন, তুমি যদি দুদিন পর বলো, বেড়ানো শেষ হয়েছে এখন আমেরিকা ফিরে যাব। তাহলে কিন্তু হবে না। আমরা খুব রাগ করব।

তাহলে আমাকে কী করতে হবে?

এখানে থাকতে হবে।

কতদিন?

For eternity.

তাহের হো-হো শব্দে হাসছে। হাসির শব্দে লিলিয়ান এসে দোতলার বারান্দায় দাঁড়াল। তাহের উঁচু গলায় বলল, এই যে বিদেশিনী! দয়া করে মগভর্তি কাঁপাচিনো কফি বানিয়ে নিচে এসে আমাকে সাহায্য কর।

এখন কফি বানানো যাবে না। সরঞ্জাম নেই।

কোনো অজুহাত শুনতে চাই না। কফি বানাতে হবে।

ছোট মেয়ে রিয়া চেঁচিয়ে বলল, বাবার জন্যে কফি বানাতেই হবে।

লিলিয়ান রান্নাঘরের দিকে গেল না। সে ঢুকল আয়নাঘরে। দরজা বন্ধ করে দিল। অন্ধকার হয়ে গেল আয়নাঘন। সে গলার স্বর নামিয়ে প্রায় ফিসফিস কবে বলল, আপনাকে দেখানোর জন্যে আমি আমার বাচ্চা দুটিকে নিয়ে এসেছি। আপনি কি দেখেছেন তাদের?

কেউ জবাব দিল না।

লিলিয়ান বলল, আপনি কি তাদের একটু আদর করে দেবেন না?

নীববতা ভঙ্গ হলো না। আয়নাঘরের স্তব্ধতা ভাঙল না। লিলিয়ানের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। পনের বছর আগে এক ভয়ঙ্কর জটিল সময়ে কেউ একজন তার হাত ধরে বলার চেষ্টা করেছিল–কোনো ভয় নেই। সেই দুঃসময় আজ আর তার নেই। জীবন তার মঙ্গলময় বিশাল বাহু মেলে লিলিয়ানকে জড়িয়ে ধরেছে। আজ আর আশ্বাসের বাণী শোনার তার প্রয়োজন নেই।

লিলিয়ান আবার বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নিচে খুব মজা হচ্ছে। দোলনা তৈরি হয়ে গেছে। তাহের দোল খাচ্ছে। মেয়েরা বাবাকে নামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে, পারছে না। লিলিয়ান আপন মনে বলল, আমি কেউ না, অতি তুচ্ছ একজন, তবু ঈশ্বর কেন এত সুখ আমার জন্যে রেখেছেন?

খুট করে শব্দ হলো। আয়নাঘরের দরজা খুলে গেল। লিলিয়ানেব মনে হলো, নুপুর পায়ে কে যেন আসছে তার দিকে। এই তো লিলিয়ান তার পা ফেলার ছোট ছোট শব্দ শুনতে পাচ্ছে। লিলিয়ান বাগানেব দিকে ইশাবা কবে স্পষ্ট স্বরে বলল— ঐ দেখুন, ও হচ্ছে সারা। আমার বড় মেয়ে। আর নীল জামা পরা মেয়েটা রিয়া। দুজনই খুব দুষ্ট।

তাহের দোল খাওয়া বন্ধ করে উঁচু গলায় বলল, মেয়েরা! তোমাদের মাকে দেখ। অকারণে কাঁদছে। ব্যাপারটা কী বলো তো, এই মহিলার অকারণে কাদার রোগ আছে। আগেও কয়েকবার লক্ষ করেছি।

রিয়া বড়দের মতো গম্ভীর গলায় বলল, আমার মনে হয় মার চোখে কোনো প্রবলেম আছে।

লিলিয়ান খুব কাঁদছে। অসম্ভব সুন্দর এই দিনে কেউ কাঁদে না। লিলিয়ান কাঁদছে, কাঁদতে তার বড় ভালো লাগছে।

2 Comments
Collapse Comments

তাহের কীভাবে বাচল।আর তার ঐ দুষ্ট চাচা কী হল?

সিমান্ত জয় April 28, 2023 at 11:00 am

বেশ ভালো লেগেছে।একধরনের টান অনুভব করছিলাম,শেষে কী হয় জানার জন্য। তবে রহস্যগুলো খোলাসা করলে আরো ভালো লাগত।বাংলা লাইব্রেরিকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *