০৮. নুহাশ পল্লীর দিঘীতে দুটা ঘাট

নুহাশ পল্লীর দিঘীতে দুটা ঘাট আছে। একটা পুরানো ঘাট, নাম জাপানি ঘাট কারণ জাপান বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রী এই ঘাট বানানোয় সাহায্য করেছিল।

আরেকটা ঘাটের নাম চন্দ্র ঘাট। এই ঘাট পুরোটাই শ্বেতপাথরের। চাঁদের আলো শ্বেতপাথরে পড়লে শ্বেতপাথর থেকে জোছনার মতো আলো বের হয় বলেই চন্দ্র ঘাট।

নলিনী বাবু চন্দ্র ঘাটে বসে আছেন। আকাশে চাঁদ। চাদের আলোয় এবং ঘাট থেকে প্রতিফলিত আলোয় তিনি ঝলমল করছেন। আমি তার সামনে বসলাম। ক্লিনিক থেকে ছাড়া পাবার পর আমি প্রথম তাকে দেখছি। ম্যানেজার বুলবুল বলেছে তিনি এখন মোটামুটি স্বাভাবিক।

নলিনী বাবু আমাকে চিনতে পারছেন?

তিনি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। আমি বললাম পরিষ্কার করে বলুন আমি কে। মাথা নাড়ানাড়ি বন্ধ।

নলিনী বাবু বললেন, আপনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নাই, কিন্তু আপনি আমার পরম আত্মীয়।

এই তো আপনার মাথায় কথা ফুটেছে। ক্লিনিকে আপনার অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।

তারা ঘুমের অষুধ দিয়ে মানুষকে জন্তু বানায়ে রাখতে।

কত দিন পর জোছনা দেখছেন?

অনেক দিন পর। আপনি আমাকে পরম শান্তি দিয়েছেন। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন।

ঈশ্বর বিশ্বাস করেন?

মাঝে মাঝে করি। বেশিরভাগ সময় করি না।

এই মুহূর্তে করছেন?

না।

রাতের খাবার খেয়ে সকাল সকাল শুয়ে পড়ুন। কাল সকালে আপনার সঙ্গে কথা হবে।

আপনি যদি কিছু মনে না করেন রাতটা কি আমি ঘাটে শুয়ে কাটাতে

পারি?

অবশ্যই পারেন। আমি একজনকে বলে দিচ্ছি সে আপনার সঙ্গে থাকবে।

একা থাকতে চাচ্ছি।

একা আপনাকে থাকতে দেব না। নুহাশ পল্লীর একজন স্টাফ দূর থেকে আপনার উপর লক্ষ রাখবে আপনি তার অস্তিত্বই টের পাবেন না।

নলিনী বাবুকে রেখে আমি চলে এলাম। রাতে তার ডায়েরি পড়ে শেষ করব। যদি ব্যক্তিগত কিছু পাওয়া যায়।

ডায়েরিতে কিছুই পাওয়া গেল না। সবই থিওরির কচকচানি। এক জায়গায় পাওয়া গেল–সীতার অনেক জ্বর। শরীর ভয়ঙ্কর খারাপ করেছে। সারা গায়ে গুটি গুটি বের হয়েছে। মনে হচ্ছে হাম। হাম জীবাণুঘটিত ব্যাধি। পাঁচশ বছর আগে নস্ট্রডেমাস জীবাণুর কথা বলেছেন। তিনি জীবাণুর আবিষ্কার যে লুই পাস্তুর করবেন তাও বলে গেছেন।

লাল কালি দিয়ে আন্ডার লাইন করা কিছু অংশ পাওয়া গেল। সেখানে লেখা–

মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা বলে কিছু নেই।
সে সম্পূর্ণই নিয়ন্ত্রিত Robot.

তার নিচেই জীববিজ্ঞানী Dewitt-এর কিছু লাইন। যে বইটি থেকে লাইনগুলি নেয়া হয়েছে সৌভাগ্যক্রমে বইটা আমার পড়া বইয়ের নাম The Selfish Gene

লাইনটা হচ্ছে,

What on Earth do you
think you are? If not a robot, albeit
a very complicated one?

যার বাংলাটাও ডায়েরি লেখক করেছেন–

নিজেকে তুমি কি ভাব হে? তুমি রোবট ছাড়া
কিছু না তবে জটিল ধরনের রোবট।

ভোরবেলা চায়ের কাপ নিয়ে বের হয়েছি, নলিনী বাবুর সঙ্গে দেখা। নলিনী বাবু হেসে বললেন, সুপ্রভাত।

আমি বললাম, রাত কি শেষ পর্যন্ত ঘাটেই কাটিয়েছেন?

আজ্ঞে না। মশা কামড়াচ্ছিল বলে ঘরে এসে শুয়েছি।

ঘুম হয়েছে?

অতি সুনিদ্রা হয়েছে। ঘুমের অষুধ ছাড়াই সুনিদ্রা।

চা খেয়েছেন?

না।

আসুন চা খেতে খেতে কিছুক্ষণ গল্প করি।

আপনার সঙ্গে আগ্রহ নিয়ে গল্প করব। কিন্তু চা পান করব না।

আমরা দুজন লিচু বাগানের দিকে রওনা হলাম। নুহাশ পল্লীর সুন্দর জায়গাগুলোর একটি হলো বাঁধানো লিচুতলা। বাঁধানো তলায় বসে গল্প করতে আমার নিজের ভালো লাগে।

নলিনী বাবু! নস্ট্রডেমাসের নাম শুনেছেন?

না। ইনি কে?

পাঁচশ বছর আগের ফ্রান্সের একজন চিকিৎসক। ভবিষ্যৎ বলতে পারতেন। তাঁর নাম শুনেননি?

না। জীববিজ্ঞানী Dewit-এর নামও বোধ হয় শুনেননি।

আজ্ঞে না। প্রথম শুনলাম।

আপনার কি ডায়েরি লেখার অভ্যাস আছে?

না। ডায়েরি লিখবেন মহামানবরা। তারা যা লিখবেন তাতেই অন্যদের জন্য চিন্তার খোরাক থাকবে। আমার মতো অভাজনরা কেন শুধু শুধু ডায়েরি লিখব? ঠিক বলেছি না?

অবশ্যই ঠিক বলেছেন।

সীতাকে চেনেন? রাম লক্ষ্মণের সীতা না। আপনার পরিচিত কেউ আছে নাম সীতা।

হ্যাঁ চিনি।

তার কি কখনো শরীর ভয়ঙ্কর খারাপ করেছিল? গায়ে গুটি বের হয়েছিল?

হাম হয়েছিল। খুব কষ্ট পেয়েছিল। আপনি কিভাবে জানেন?

আমি জবাব দিলাম না। জবাব দেবার সময় আসেনি।

সকালে নাশতা খেতে বসেছি। নলিনী বাবু কিছু খাবেন না। এগারোটার দিকে ভাত খাবেন। তিনি তার আগের একাহারি নিয়মে ফিরে যাচ্ছেন। এটা ভালো লক্ষণ। দ্রুত সুস্থতার দিকে যাওয়া। আমি বললাম, এই ডায়েরিটা উল্টেপাল্টে দেখুন তো, ভালো করে দেখে বলুন ডায়েরির লেখাগুলি কি আপনার?

নলিনী বাবু অনেক সময় নিয়ে দেখলেন। বারবার পাতা উল্টে দেখছেন। তাঁকে অত্যন্ত কনফিউজড মনে হলো।

নলিনী বাবু বললেন, ডায়েরির লেখা আমার। কিন্তু আমি লিখি নাই।

বাপারটা গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে না?

হচ্ছে।

ডায়েরিটা আপনার নীলগঞ্জের বাড়ি থেকে আমি এনেছি। এখন ফিরত দিলাম। আপনি নিজে প্রতিটি লেখা খুব মন দিয়ে পড়বেন। আমি কয়েকদিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছি। ফিরে এসে আপনার সঙ্গে বসব।

কোথায় যাচ্ছেন?

সিঙ্গাপুর। আমার হার্টের কিছু সমস্যা আছে। বছরে দুবার ডাক্তার দেখানোর কথা। আমি অবশ্যি একবার দেখাই।

কদিন থাকবেন?

সব মিলিয়ে চার-পাঁচ দিন লাগবে। আপনি আপনার নিজের বাড়িঘর মনে করে এখানে থাকবেন। এরা সবাই আপনার দেখাশোনা করবে। যদি প্রয়োজন মনে করেন নীলগঞ্জ থেকে রামচন্দ্রকে নিয়ে আসবেন।

কাউকে আনতে হবে না। আমি এখানে ভালো আছি।

আপনার যদি লেখালেখি করতে ইচ্ছে করে ম্যানেজারকে বললেই কাগজ-কলম দিবে।

আমি তো লেখক না যে আমার লেখালেখি করতে ইচ্ছে করবে। কাগজ-কলম লাগবে।

আমি বললাম, ঘুমিয়ে থাকে মহান লেখক অলেখকের অন্তরে।

নলিনী বাবু সুন্দর করে হাসলেন। আমি বললাম, আমি চাই আপনি আপনার অভিজ্ঞতার কথা লিখে ফেলুন। যা মনে আসে লিখবেন। ভাষা ঠিক হচ্ছে কি না তা নিয়ে ভাববেন না। আমি আপনাদের মিসির আলি না। তারপরেও সমাধান করে ফেলব।

নলিনী বাবু বললেন, সমাধান মানে সমাপ্তি! সমাপ্তি বলে কিছু নেই।

সিঙ্গাপুরে যাওয়া কি কারণে যেন বাতিল হয়ে গেল। আমার জন্যে ভালোই হলো। স্থান বদলের বিষয় চলে এসেছে। ধানমণ্ডিতে আমার নিজের ফ্ল্যাট তৈরি। ফ্ল্যাটটি করা হয়েছে একজন মানুষের জন্যে। বিদেশে এ ধরনের ফ্ল্যাটের নাম স্টুডিও এপার্টমেন্ট। বিশাল একটা শোবার ঘর। একটা লাইব্রেরি। আমি চেয়েছিলাম এমন একটা ফ্ল্যাট যেখানে শুধু বাথরুম দেয়াল বন্দি থাকবে। বাইরের দেয়াল ছাড়া আর কোনো দেয়াল থাকবে না। বসার ঘর, শোবার ঘর, লাইব্রেরি ঘর বলে আলাদা কিছু থাকবে না। একটাই ঘর। বাড়ির আর্কিটেক্ট আমার কলেজ জীবনের বন্ধু করিম। তাকে কিছুতেই রাজি করাতে পারলাম না। সে বলল, তোমার মাথা খারাপ হতে পারে আমার মাথা খারাপ না।

নতুন বাড়িতে সংসার পাতার আলাদা আনন্দ আছে। সেই আনন্দে সময় কাটতে লাগল। আজ এটা কিনি কাল ওটা কিনি। রোজ সন্ধ্যায় অজ্ঞা। আচ্ছা বন্ধ করার জন্যে গৃহিণী নেই। সিগারেটের ধোঁয়ায় বাড়ি গ্যাস চেম্বার হলেও বলার কেউ নেই। আমার বন্ধুরা সন্ধ্যা মিলাবার আগেই চলে আসে। রাত গভীর হলে নিতান্ত অনিচ্ছায় তারা ওঠে। কেউ কেউ আবার থেকেও যায়। তারা বলে, বেচারা হুমায়ূন একা একা থাকবে, আচ্ছা আমিও থেকে যাই।

আমার ফ্ল্যাটের আড্ডার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। আড়ার নামও দেয়া হলো–বৃদ্ধ বোকা সংঘ। Old fools club, এই ক্লাবে নতুন নতুন সদস্য যোগ হতে থাকল। আমি সাময়িকভাবে নলিনী বাবুর কথা ভুলে গেলাম। ম্যানেজারের কাছে খবর পাই তিনি ভালো আছেন। এক বেলা খাবার খান। সারাদিন ঘুরে ঘুরে গাছপালা দেখেন। সন্ধ্যাবেলা দিঘীর ঘাটে বসে তারা দেখেন। আমার নিজের এক সময় তারা দেখার শখ ছিল। তিনটা টেলিস্কোপ নুহাশ পল্লীতে আছে। আমার তারা দেখার শখ স্থায়ী হয়নি বলে টেলিস্কোপে ধুলা জমেছে। নলিনী বাবু টেলিস্কোপের ধুলা পরিষ্কারের ব্যবস্থা করছেন জেনে ভালো লাগল।

এক বিকেলে শাওন বেড়াতে এলো। তার হাতে প্লাস্টিকের বাটিতে কি একটা খাবার। সে উপস্থিত থাকতেই আমার বন্ধুরা উপস্থিত হওয়া শুরু করল। শাওন আমাকে আড়ালে নিয়ে বলল, এরা কারা?

আমি বললাম আমার বন্ধুরা। আড্ডা দিতে এসেছে।

আমি আপনার এই আড্ডার খবর পেয়েছি। আড্ডা নাকি রাত দুটাতিনটা পর্যন্ত চলে।

সব দিল না। মাঝে মাঝে চলে। আদ্রা যখন জমে যায় তখন চলে।

রাতে আপনাদের খাবারের কি ব্যবস্থা। ফ্ল্যাটে তো রান্নার কোনো লোক দেখছি না।

রাতে হোটেল থেকে খাবার আসে।

আপনি দিনে কোথায় খান?

দিনে মাজহারদের ফ্ল্যাট থেকে খাবার আসে। অন্য প্রকাশের মালিক মাজহার। তুমি তো চেনো।

প্রতিদিন খাবার আসে?

হুঁ।

আপনার লজ্জা করে না?

লজ্জা করবে কি জন্যে? মাজহার আমার পুত্রস্থানীয়।

আপনার বাড়ি ভর্তি এইসব কিসের বোতল?

আমি এই প্রশ্নের জবাব দিলাম না। জ্ঞানী মানুষ সব প্রশ্নের জবাব দেয়। সেই মুহূর্তে জ্ঞানী হবার প্রয়োজন দেখা দিল।

শাওন কঠিন গলায় বলল, আপনি এই ভাবে জীবনযাপন করবেন আমি তা হতে দেব না। আপনার বয়স হয়েছে, আপনার ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে। আপনার দরকার শান্তি। আপনাকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে হবে। আপনার অনেক কাজ বাকি।

কি কাজ বাকি?

আপনি বলেছেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা উপন্যাস লিখবেন। লিখেছেন?

না।

মধ্যাহ্ন নামে একটা উপন্যাস লেখার কথা বলেছিলেন। ইংরেজ শাসন থেকে দেশ বিভাগ পর্যন্ত ইতিহাস সেখানে থাকবে। লিখেছেন?

না।

ঊনসত্তুরের গণআন্দোলন নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার কথা ছিল। লিখেছেন?

না।

আজ থেকে এই বাড়িতে আড্ডা বন্ধ। আপনার ভিখিরির মতো অন্য বাড়ির খাবার খেয়ে বেঁচে থাকা বন্ধ।

আমি বললাম, তুমি যে কথাগুলো বলছ সেগুলি বলার জন্য অধিকার লাগে। সেই অধিকার কি তোমার আছে?

শাওন বলল, না অধিকার নাই। এবং কোনোদিন যে অধিকার হবে না তাও জানি।

তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল।

মেয়েরা চেষ্টা করে তাদের চোখের পানি দ্রুত মুছে ফেলতে। শাওন তা করল না, চোখ ভর্তি পানি নিয়ে দ্রুত চলে গেল। আমি আজ্ঞা ভেঙে দিয়ে ফ্ল্যাটে তালা লাগিয়ে নুহাশ পল্লীর দিকে রওনা হলাম।

ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের খুঁটিনাটি বর্ণনার বিশেষ কারণ আছে। নিজের জীবন নিয়ে ভাবতে ভাবতেই আমি নলিনী বাবুর রহস্যের মোটামুটি একটা মীমাংসা দাড়া করাই। মীমাংসায় পৌছানোর প্রক্রিয়াটা বলা প্রয়োজন বোধ করছি।

রাত।

গাড়ি যাচ্ছে নুহাশ পল্লীর দিকে। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হওয়ায় গাড়ির গতি মন্থর। আমি মাথার উপরের সানরুফের ঢাকনি খুলে দিয়েছি। কাচের সানরুফে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। দেখতে ভালো লাগছে। আমি বৃষ্টির ফোটা দেখতে দেখতে ভাবছি কোয়ান্টাম বিজ্ঞানীরা যে সমান্তরাল জগতের (Parallal Universe) কথা ভাবেন তা সত্যি হলে আমার জীবনে স্পষ্ট কিছু বিভাজন আছে। বিভাজনগুলি কেমন–

প্রথম জগৎ

এখানে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। লেখক না। নাটক-সিনেমা বানাই না। লেখাপড়া নিয়ে থাকি। প্রবল অর্থকষ্ট আছে। পারিবারিকভাবে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করছি।

দ্বিতীয় জগৎ

এই জগতে আমি একজন লেখক তবে ব্যর্থ লেখক। আমার বই বিক্রি হয় না। সমালোচকরা ভালো বলেন। চরম অর্থকষ্ট। অর্থকষ্টের কারণে পরিবারে অশান্তি। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করানোর সঙ্গতি নেই। এদের কেউ কেউ ড্রাগ ধরেছে।

তৃতীয় জগৎ

সংসার থেকে বিতাড়িত এখন যে জগতে আছি সেই জগৎ। একা থাকছি। বন্ধুবান্ধব আছে এই পর্যন্তই।

চতুর্থ জগৎ

শাওনের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে। জীবনযাত্রায় শৃঙ্খলা এসেছে।

 

সমান্তরাল জগতের থিওরি হিসেবে এই চারটি জগৎ ছাড়াও আরো অগুনতি জগৎ আমার জন্যে চালু হয়েছে। প্রতিটি জগতেরও অনেক শাখাপ্রশাখা আছে। আমি যা বলছি তা কল্পবিজ্ঞানের কথা না বিজ্ঞানের কথা। বিজ্ঞান ছাড়াও ধর্মশাস্ত্রে ভিন্ন জগতের কথা বলা হয়। সাধু-সন্ন্যাসীরা এর অস্তিত্ব স্বীকার করেন। কঠিন যোগ ব্যায়ামের মাধ্যমে নাকি অন্য জগতে কিছু সময়ের জন্য হলেও উপস্থিত হওয়া যায়।

ড্যান্সিং দরবেশরা বলেন, নাচতে নাচতে তাদের ভেতর যখন মত্ততা চলে আসে তখন তারা হঠাৎ লক্ষ করেন তাদের চারপাশের জগৎ বদলে গেছে। তারা অন্য কোথাও আছেন।

সাধু-সন্ন্যাসী বা ড্যান্সিং দরবেশরা যে কাজটি নানা জটিল প্রক্রিয়ায় করেন তা অতি সহজে কিছু লতাপাতা চিবিয়েও করা যায়। এসব লতাপাতায় থাকে এমন সব যৌগ যা ব্রেইন কেমিস্ট্রি বদলাতে পারে। উদাহরণ Rauwolfia serpentinum.

সুইস রসায়নবিদ আলবার্ট হফম্যান LSD তৈরি করেছিলেন (Lysergic acid diethylamide) এই ভয়াবহ যৌগ তিনি নিজে খানিকটা খেয়েছিলেন। তিনি বললেন, এই বস্তু তার পৃথিবীটাকে বিস্তৃত করে দিয়েছিল। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে তিনি কিছুক্ষণের জন্য হলেও বুঝতে পেরেছিলেন।

যেসব স্কিজিওফ্রেনিক রোগী অন্য রিয়েলিটির ভেতর দিয়ে যায় তাদেরকে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, এদের শরীরে Dimetioxyphenyle thylamine পাওয়া যায়। এই যৌগ পারমাণবিক গঠন adrenalin এবং mescaline-এর কাছাকাছি। adrenalin এবং mesaline ব্রেইন কেমিস্ট্রি নিয়ন্ত্রণ করে। স্কিজিওফ্রেনিকদের শরীরে আপনাআপনি যে ড্রাগ তৈরি হয় সেই ড্রাগ তাকে অন্য রিয়েলিটিতে নিয়ে যায়।

আমেরিকায় যখন Ph.D. করি তখন একবার অন্য জগতে যাবার ইচ্ছে হয়েছিল। আমি LSD ট্যাবলেট জোগাড় করেছিলাম। সাহসের অভাবে খেতে পারিনি।

নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটির রসায়ন বিভাগের একজন শিক্ষক (নাম ভুলে গেছি) ভলেন্টিয়ার হয়ে LSD খেয়েছিলেন। তিনি বলেছেন–I entered into the strange world of many realities. অর্থাৎ আমি অসংখ্য বাস্তবতার অদ্ভুত জগতে প্রবেশ করেছিলাম। এই বাস্তবতার ব্যাখ্যাই হলো এমন এক সমস্যা। যার সমাধান নেই।

আমি নিজেও একবার ভিন্ন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছিলাম। তার স্থায়িত্ব ছিল মাত্র কয়েক সেকেন্ডের। ঘটনাটা এ রকম।

আমি তখন উত্তরার বাসায় থাকি। খাবার হোটেল থেকে আসে। একটা কাজের লোক রেখেছিলাম রফিক নাম। সে এক ভোরবেলায় আমার মানিব্যাগ নিয়ে পালিয়ে গেল। অনেকগুলি টাকা ছিল মানিব্যাগে। মন খুবই খারাপ হলো, ঠিক করলাম কাজের লোক রাখব না। আমার তাতে তেমন অসুবিধাও হচ্ছিল না।

বিরাট বিপদে পড়লাম এক রোজার ঈদে। ঈদে হোটেল-রেস্টুরেন্ট থাকে বন্ধ। সকালের নাশতা এলো না। আমি উত্তরা থেকে ধানমণ্ডি চলে এলাম। ধানমণ্ডিতে তখন প্রকাশক আলমগীর রহমান থাকেন। তার ঘর তালবদ্ধ। তিনি স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ঈদ করতে গেছেন তাঁর পৈতৃক বাড়ি গেণ্ডারিয়াতে।

আমি গেলাম মাজহারের খোঁজে। মাজহারও নেই। সে তার স্ত্রী এবং এক পুত্রকে নিয়ে তার শ্বশুরবাড়ি গেছে।

পল্লবীতে আমার মা থাকেন। তিনিও আমার ভাইবোনদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছেন। তার কাছে গেলে তিনি নিশ্চয়ই অভুক্ত পুত্রকে তাড়িয়ে দেবেন না। কিন্তু আমার লজ্জা লাগল। অভিমানও হলো। ওদিকে গেলাম না।

শাওনের বাসায় কি যাব? এমন না যে তার বাসায় যায় না। তবে আজ যেহেতু ঈদের দিন সে নিশ্চয় সেজেগুজে বান্ধবীদের বাড়িতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন অবস্থায় আমার উপস্থিত হওয়াটা কেমন হবে? সে যদি জানতে পারে ঈদের দিন আমি ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুরছি তাহলে খুবই কষ্ট পাবে। আনন্দের একটা দিনে এমন কষ্ট কি আমি তাকে দিতে পারি?

আমি ক্ষুধা সহ্য করতে পারি না। খাবারের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় ক্ষুধা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে লাগল। বের হলাম রেস্টুরেন্টের সন্ধানে। ঈদের দিন যে সব রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকে তা জানতাম না। হতাশ, ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত অবস্থায় বাসায় ফিরলাম। দরজা বন্ধ করে হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। হাতে একটা বই। বই পড়ে যদি ক্ষুধা ভুলে থাকা যায়। আইজাক এসিমভের রোবটদের গল্প।

তখন একটা ঘটনা ঘটল। কীভাবে ঘটল, আমি জানি না। হয় আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। যা দেখার ঘুমের মধ্যে দেখেছি। কিংবা কিছুক্ষণের মধ্যে আমি অজ্ঞান হয়ে গেছি বা অন্য কিছু। হঠাৎ দেখি, বাইরে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ছাটে ঘর ভেসে যাচ্ছে।

দশ-এগারো বছরের একটা ছেলে জানালা বন্ধ করার চেষ্টা করছে। বন্ধ করতে পারছে না।

ছেলেটা দেবদূতের মতো সুন্দর। এবং দেখতে অবিকল আমার মতো। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম

রাশেদ বাবাটিং
দরজা বন্ধ করছিং
আমি বই পড়ছিং
এবং মজা পাচ্ছিং।

ছেলেটা বলল, বাবা আমি ভিজে যাচ্ছি। আমার ঈদের নতুন শার্ট ভিজে যাচেছ।

আমি বললাম, ভিজুক। সে বলল, ঘরের ভেতর পানির সমুদ্র হয়ে যাচ্ছে বাবা। আমি বললাম, হোক সমুদ্র। আমরা সমুদ্র স্নান করব।

হঠাৎ আমার সম্বিৎ ফিরল। আমি দেখলাম, আমি বই হাতে খাটে বসে আছি। কোথাও কোনো ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে না। আমার ঘরে কেউ নেই। অথচ যা দেখেছি, অত্যন্ত স্পষ্ট দেখেছি।

আমার প্রথম পুত্র রাশেদ জন্মের তৃতীয় দিনের দিন মারা যায়। আমি তাকেই দেখেছি। আমার মস্তিষ্ক কি কিছুক্ষণের জন্য আমাকে বিভ্রান্ত করেছে? নাকি যে Parallel world-এর কথা বলা হয় তা প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়াল। কিছুক্ষণের জন্যে আমার কাছে ধরা দিয়েছে। সেই জগতে পুত্র রাশেদ বেঁচে আছে।

মানুষের মস্তিষ্ক অতি জটিল, অতি দুর্বোধ্য এক বস্তু। তার কাণ্ডকারখানা বিজ্ঞানীদের কাছে এখনও স্পষ্ট না। মস্তিষ্কের Frontal lobe-এর কী কাজ তা এখনও কেউ ধরতে পারেনি। Frontal lobe কেটে পুরোপুরি বাদ দিলেও মানুষের কোনো সমস্যা হয় না। মস্তিষ্কের একটি অংশের নাম Thaimus. এ অংশটি মানুষের চিন্তাশক্তির নিয়ন্ত্রক। এর নিচেই Hypothalamus-এর অবস্থান। হাইপোথেলামাসের কারণেই মানুষ আনন্দ-বেদনার অনুভূতি পায়। মস্তিষ্কের এ অংশটি অনুভূতি নিয়ন্ত্রক। এই অংশ উত্তেজিত হলে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। সাইকোলজিস্টরা বলেন, মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব ঘটলে প্রবল ক্ষুধা এবং শারীরিক ও মানসিক যাতনায় হাইপোথেলামাস উত্তেজিত হয়। তখন মানুষের বিচিত্র সব অনুভূতি হয়।

আমেরিকার Duke বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃত্রিমভাবে হাইপোথেলামাস উত্তেজিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ব্যাপারটা এ রকমসাইকোলজিস্টরা বললেন, মানুষ ছয়টি ইন্দ্রিয় দিয়ে বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করে। যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ করে দিলেই মস্তিষ্ক অসহায় হয়ে পড়বে। সে বুঝতে পারবে না এখন কী হচ্ছে। মস্তিষ্কে প্রবল অস্থিরতা দেখা দেবে। এই অস্থিরতা থেকে মুক্তির জন্য সে বিচিত্র কর্মকাণ্ড শুরু করবে।

মস্তিষ্ক বাইরের জগৎ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হলে কী করে তা দেখার জন্য তারা অদ্ভুত এক পরীক্ষার ব্যবস্থা করলেন। শব্দনিরোধী (Sound proof) একটা ঘর তৈরি হলো। সেই ঘরে চৌবাচ্চায় একজন মানুষকে রাখা হলো। চৌবাচ্চার পানিতে কপার সালফেট মিশিয়ে তার ঘনত্ব করা হলো মানুষের শরীরের ঘনত্বের সমান। পানির তাপ রাখা হলো মানুষটির শরীরের তাপমাত্রায়। মানুষটির নাক বন্ধ করে দেওয়া হলো যাতে সে ঘ্রাণ না পায়। ঘর পুরোপুরি অন্ধকার করে দেওয়া হলো। অর্থাৎ মানুষটির প্রতিটি ইন্দ্রিয়ের কর্মক্ষমতা বন্ধ করে দেওয়া হলো। পরীক্ষা শুরু হলো সাতজন ভালেন্টিয়ারকে নিয়ে। তারা সবাই ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। প্রত্যেককে এক ঘণ্টা করে আলাদা ঘরে ঢোকানো হলো।

পরীক্ষার ফলাফল হলো ভয়াবহ। সাতজনের মধ্যে দুজন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে বের হলো। একজন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল। একজন বলল, সে অদ্ভুত এক জগতে চলে গিয়েছিল। সেই জগতে কোনো মাধ্যাকর্ষণ নেই। সবাই ইচ্ছা করলেই ভাসতে পারে। একজন বলল, সে তার মৃত পিতা, মাতা, দাদা-দাদিকে দেখতে পেয়েছে, তাদের সঙ্গে কথা বলেছে। বাকি তিনজন বলল, তাঁরা যে দেখেছে এবং গুলছে তা তারা প্রকাশ করতে চাচ্ছে না। শুধু এইটুকু বলবে যে, ঈশ্বরের সঙ্গে তাদের দেখা হয়েছে।

আমার ক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই এ রকম কিছু ঘটেছে। ক্ষুধা এবং ক্লান্তিতে শরীর অসন্ন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রবল হতাশা বোধ। আমার মস্তিষ্ক প্রবলভাবে উত্তেজিত হয়ে মৃত পুত্রকে উপস্থিত করেছে আমার সামনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *