০৮. নিঃসঙ্গতার সঙ্গ

নিঃসঙ্গতার সঙ্গ

বাবা যা বহাল করেন বাড়িতে, তা যে বছরের পর বছর বহাল থাকে তা নয়। দড়ি তাঁর হাতে, যখন ইচ্ছে ঢিলে করেন, যখন ইচ্ছে শক্ত। তাঁর নেওয়া কিছু কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত থেকে তিনি হঠাৎ একদিন সরে আসেন। আমার কাছে পত্রমিতাদের চিঠি আর না আসতে থাকায় তিনি নতুন আসা ডাকপিয়নকে নতুন করে বাগিয়ে নিয়ে চিঠি হাত করতে চেষ্টা করেন না। ডাকপিয়ন আগের মত বাড়িতে চিঠি দিতে শুরু করেছে। রান্নাঘরের বন্ধ আলমারির তালা খুলে যেভাবে গুনে গুনে সবকিছু দিচ্ছিলেন তাতেও ভাটা পড়ে, তাঁর পক্ষে এত ঘন ঘন নতুন বাজার থেকে প্রতিবেলা রান্না চড়ানোর আগে বাড়ি আসা সম্ভব হয় না। আলমারি এখন খোলাই থাকে। মা আগের মতই সংসারসমুদ্রে নিমজ্জিত হন। জরির মা চলে গেলে নানিবাড়ির পেছনের বস্তি থেকে মালেকাকে এনেছিলেন, সেই মালেকাও মাস পার না হতেই চলে গেছে, দুদিন এদিক ওদিক খুঁজে কাউকে না পেয়ে পাড়ার রাস্তায় ভিক্ষে করা হালিমাকে ধরে আনলেন মা। হালিমা তার মা সহ বাড়িতে বহাল হয়ে গেল। টুকটাক সওদা করতে গিয়ে রাস্তায় কোনও এক শিশিবোতলকাগজঅলার সঙ্গে দেখা হয় হালিমার, সেই অলা তাকে বিয়ে করবে বলেছে বলে খুশিতে সে আটখানা থেকে ষোলখানা হয়ে যায়। মা একটি রঙিন শাড়ি দিলেন হালিমাকে, কাগজঅলা জামাইকে একটি নতুন লুঙ্গি। বিয়ে হওয়া হালিমা সদপের্ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। হালিমার মা একাই রয়ে গেল এ বাড়িতে। খুক খুক কাশতে কাশতে একা। একা তার পক্ষে বাড়ির সব কাজ করা কঠিন হয়ে ওঠে। গা প্রায়ই জ্বরে পুড়তে থাকে। যেদিন কাশির সঙ্গে দলা দলা রক্ত বেরোল, মা তাকে হাসপাতালে নিজে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করিয়ে এলেন। দু সপ্তাহ পার না হতেই হালিমা ফিরে এল অবকাশে। কি হয়েছে? জামাই ভাত দেয় না।

হালিমা আগের মত বাসন ধোয়ায়, কাপড় ধোয়ায়, ঘর মোছায় লেগে গেল। থেকে থেকে কেবল বলে রাইতে ঘুমাইতে পারি নাই বেডার জ্বালায়। জ্বালাটি কি ধরনের জ্বালা শুনতে আমরা উৎসুক।

রাইতে ঘুমের মধ্যে শি.. শি.. বোত..ল কা….গজ কইয়া চিল্লাইয়া উডে। সারাদিন রাস্তায় ঘুইরা ঘুইরা কয় ত, রাইতে ঘুমাইয়াও রাইতেরে দিন মনে করে।

এই হালিমা আবার কিছুদিন পর রাস্তায় দেখা আরও এক কিঅলার প্রস্তাবে রাজি হয়ে অবকাশ ছাড়ে।

অবকাশে ভাসমান দরিদ্রদের আসা যাওয়ার খেলা দেখে অভ্যেস হয়ে গেছে আমাদের। কে আসছে কে যাচ্ছে কেন যাচ্ছে কোথায় যাচ্ছে এসব নিয়ে কোনও গবেষণা চলে না। কাজের মানুষ থাকলে মার খানিকটা আরাম, না থাকলে মার কষ্ট। ব্যাপারটি সম্পণূর্ মার। কেউ থাকুক বা না থাকুক আমাদের আরামে কখনও কোনও ব্যাঘাত ঘটে না। আমরা যেমন আছি তেমন থাকি। কাজের মানুষ পেতে আমাদের চেয়ে মার উৎসাহ তাই সবসময়ই বেশি। একবার হাঁটু অবদি তোলা লুঙ্গি, ছেঁড়া একটি গেঞ্জি গায়ে এক লোক ঢুকেছিল মাঠে। জোয়ান বয়স। লোকটিকে দেখেই আমার ডাকাত বলে সন্দেহ হয়। ডাকাত না হলে দা কেন হাতে!

কি চান? চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করি জানালায় দাঁড়িয়ে।

কাম করাইবাইন?

কি কাম?

দাওয়ের কাম।

দৌড়ে গিয়ে মাকে খবর দিই, একটা ডাকাত আইছে। কয় সে নাকি দাও এর কাম করে। দাওএর কাম মানে বুঝছ ত! দাও দিয়া খুন করার কাম।

মা মশলা বাটছিলেন, বললেন, খাড়ইতে ক।

আমি আর ওমুখো হই না। মা মশলা বাটা রেখে দরজা খুলে মাঠে গেলেন।

লোকটিকে দিব্যি বাড়ির ভেতরে এনে টিনের ঘরের পেছনের জঙ্গল পরিষ্কার করিয়ে এক থাল ভাত দিলেন খেতে, সঙ্গে ডাল তো আছেই, এক টুকরো মাছও। মার কোনও ভয় ডর নেই। এ বাড়িতে এত চুরি হওয়ার পরও মার কাউকে চোর বলে মনে হয় না। ডাকাতির খবরও শোনেন মা, তবু মা কাউকে ডাকাত বলেও মনে করেন না। যখন হাভাতের মত খাচ্ছে লোকটি, মা বললেন, কি গো মিয়া তোমার কোনও মেয়ে নাই? এই ধর বারো তেরো বছর বয়স। যুবতী মেয়ে কাজে রাখতে ভয় হয় মার। তাই মেয়ে চাইলে বারো তেরোর বেশি এগোতে চান না। আর বেশি বয়স হলে চল্লিশের নিচে নয়।

লোক বলল, আফা, আমার একটাই ছেলে, মেয়ে নাই।

ছেলের বয়স কত?

লোক ছেলের বয়স বলতে পারল না। দাঁড়িয়ে পেট বরাবর বাঁ হাত রেখে মাপ দেখালো, আমার পেট সমান লম্বা।

কামে দিয়া দেও ছেড়ারে। কি কও!ফুট ফরমাইসটা ত অন্তত করতে পারব।

লোকটি মার ব্যবহারে মগ্ধু হয়ে পরদিন নজরুলকে নিয়ে এল। নজরুল পেটে ভাতে থাকবে। দাওয়ের কাম করতে গিয়ে এ পাড়ায় এলে লোক তার ছেলেকে দেখে যেতে পারবে। লোক যতবার আসে, মা ভাত দেন খেতে। লোক খুশি মনে ছেলেকে একনজর দেখে চলে যায়। নজরুল প্রায় দুবছর মত টানা ছিল এ বাড়িতে। দু বছর পর একদিন পালিয়ে চলে গেল, তারপর মাস দুই গেলে আবার সেই নজরুলকে তার বাবা বুঝিয়ে দিয়ে গেছে আমাদের কাছে। রাতে সব কাজ শেষ করে সে ঘরে এসে যাত্রার রাজার ভূমিকায় অভিনয় করত। একাই করত। আমরা ছিলাম দর্শক, শ্রোতা। মাঝে মাঝে আমাদের হাত ধরে নিয়ে যেত রানি হওয়ার জন্য মুখোমুখি দাঁড়াতে, হোক না সে সংলাপহীন। কি রে নজরুল বড় হইয়া কি হইবি রে? যাত্রায় পাট করবি? নজরুল চিকচিক চোখে বলত, হ। নজরুল রাধঁ তে পারত না প্রথম প্রথম। কাপড় ধুতেও পারত না। পরে সব শিখে গেছে। যখন সে তার বাবার বুক সমান লম্বা হল, তাকে দাওএর কাজে লাগানোর জন্য নিয়ে গেল তার বাবা। যাবার দিন মা তাঁর আঁচলে আর তোশকের তলে গুঁড়ো পয়সা যা ছিল, জড়ো করে বারো টাকার মত, নজরুলের বাবার হাতে দিয়েছেন। বাড়িতে কোনও কাজের মানুষ না থাকলে মা নানির বাড়ির পেছনের বস্তিতে চলে যান, ওখানে না পেলে যান ব্রহ্মপুত্রের চরে, চরে ভাঙা বেড়া আর খড়ের ছাউনি দিয়ে ঘর তুলে দরিদ্র মানুষের বাস, এক ঘরে না পেলে আরেক ঘরে লোক মেলে। লোক না মিললে ভিক্ষে করতে যারা আসে, তাদের দিয়ে কিছু কাজ করিয়ে দুপুরে ভাত খাইয়ে বেশি করে চাল দিয়ে দেন টোনায়। তারপরও যখন হাহাকার পড়ে, কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না, তখন ঠেকার কাজ সামলাতে নান্দাইল থেকে কাউকে পাঠাতে বলেন বাবা। বেশির ভাগই বাবার নিজের আত্মীয়। খুব দূরের নয়, কাছেরই। নিজের বোনের মেয়ে। বাবার ছোট দু বোনের বিয়ে নান্দাইলের হালচাষ করা কৃষকের কাছেই হয়েছে। অসখু বিসুখে বোনেরা এ বাড়িতে এসে ডাক্তার ভাইকে অসখু দেখিয়ে ওষুধ নিয়ে যায়। বোনের ছেলেরা বড় হয়েছে, একা একাই চলে আসে। আসে টাকা পয়সা সাহায্য চাইতে। দুদিন এ বাড়িতে থাকে খায়, বাবা ওদের ডেকে জমিজমার অবস্থা জিজ্ঞেস করে উপদেশ এবং অর্থ দুটোই বিতরণ করেন। বিয়ের বয়সী মেয়ে নিয়ে বোনেরা আসে। পাত্রের খোঁজ পাওয়া গেছে, কিন্তু পাত্র চাকরি চায়। গ্রামের জমি চাষ করবে না, শহরে পাষনীর বড়লোক মামা থাকে, সেই মামা যদি চাকরি যোগাড় করে দেন তবে বিয়ে নচেৎ নয়। বাবা এদিক ওদিক চাকরি খোঁজেন। চাকরি দেনও ওদের। কিন্তু মেয়ে যদি বাবার কাছে বিচার নিয়ে আসে স্বামী মারধোর করে, বাবা বলেন, করুক। স্বামী মারধোর করুক, চাকরির পয়সা পেয়ে দুটো যদি ডালভাত খেতে দেয়, তবে মখু বুজে স্বামীর সংসার করতে উপদেশ দিয়ে ওদের বিদেয় করেন। আর স্বামী যখন বউ তালাক দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে, বাবা উঠে পড়ে লেগে যান স্বামীর চাকরিটি খেতে। বাবা তাঁর বোনের মেয়ে সুফির স্বামীকে ক্যাডেট কলেজে বই বাধাঁই করার চাকরি দিলেন। ফুটফুটে একটি মেয়ে হল সুফির। এরপর স্বামী সুফিকে মেরে বের করে দিয়ে আরেকটি বিয়ে করল। সুফি এসে কেঁদে পড়ল বাবার পায়ে। বাবা বলেন, যা সতিনের ঘরে কাম কাজ কইরা বাঁইচা থাক। সুফি সতিনের ঘরে অনেকদিন ছিল, শেষে স্বামী আর ওকে ভাত দেয় না বলে চলে এল বাপের বাড়ি। বাপের বাড়িতে ফুটফুটে মেয়ে নিয়ে বাড়তি ঝামেলা পড়ে থাকে মখু বুজে। ওকে একদিন নিয়ে আসা হল শহরে। বাইরের মানুষেরা সুফিকে কাজের মেয়ে বলেই মনে করে। বাড়ির মানুষ কেউ শুধরে দেয় না যে এ কাজের মেয়ে নয়। আমরা মাঝে মাঝে ভুলেও যাই যে সুফি আমাদের ফুপাতো বোন, বাবার আপন বোনের মেয়ে। কারণ সুফি বাড়িতে কাজের মেয়ের মতই কাজ করে। কাজের মেয়ে ঈদের সময় যে কাপড় পায়, সুফিও তাই পায়। যে এঁটোকাঁটা খেতে পায়, সুফিও সেই এঁটোকাঁটা পায়।

ধান ওঠার পর নান্দাইল থেকে বাড়ির লোকেরা যখন আসে, পিঠা নিয়ে আসে, মেড়া পিঠা। পিঠা দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়েন দাদা। সেই মেড়া পিঠা ফালি ফালি করে কেটে ভেজে গুড় দিয়ে খাওয়া হয়। মাঝে মাঝে বড় পাতিলে করে শিং মাগুর মাছ পানিতে সাঁতার কাটছে, আনেন। কেউ কিছু আনলে মা খুশি হন। মাছ রান্না করে পাতে দিতে দিতে বলেন, মাছগুলা খুব তাজা ছিল, পুস্কুনির মাছ। কেউ ঝাল পিঠা আনলে দাদা একাই ভেতরের বারান্দার চেয়ারে বসে পা দোলাতে দোলাতে অর্ধেকই খেয়ে ফেলেন। বাবার বড় বোনের অবস্থা ভাল। নান্দাইলের কাশিরামপুর গ্রামে থাকেন, অনেক জমিজমা, ছেলে মেয়ে লেখাপড়া করেছে। বড় বোনের মেজ ছেলে রাশিদ শহরের কলেজে লেখাপড়া করেছে। এ বাড়িতে থেকেই কলেজে পড়ত। অবকাশে থেকে বাবার অনেক আত্মীয়ই লেখাপড়া করেছে। বাবা তাঁর ভাইয়ের ছেলেদের পড়াতে যত আগ্রহী, বোনের ছেলেদের নয়। চাকরির খোঁজে, অসুখে বিসুখে, লেখাপড়ার কারণে লোক লেগেই থাকে, যে-ই আসে জায়গা হয় টিনের ঘরে, টিনের ঘরে লম্বা বিছানা পাতা আছে গ্রাম থেকে আসা মানুষদের থাকার জন্য। মার কাঁধে নিজের স্বামী সন্তানসহ বাবার বংশের লোকদের রেঁধে বেড়ে খাওয়ানোর দায়িত্ব। মা দায়িত্ব পালনে কোনওরকম ত্রুটি করেন না। এমনকি গ্রাম থেকে ভর দুপুরবেলা বাড়ি ওঠা অনাহূত অতিথিদের পাতেও ছোট হলেও মাছ মাংস দেন মা। মা অনেকটা জাদুকরের মত। এক মুরগি রেঁধে বাড়ির সবাইকে দুবেলা খাওয়ান, পরদিন সকালেও দেখি রুটির সঙ্গে খাবার জন্য কিছু মাংস রেখে দিয়েছেন। গরুর মাংস সস্তায় মেলে, বাবা সস্তার গরুর মাংস কিনে বাড়ি পাঠান প্রায়ই। এ খেলে আমার দাঁতের ফাঁকে মাংসের আঁশ আটকে থাকে, দাঁত খুঁচিয়ে বেলা পার হয়। বেছে বেছে আমার জন্য হাড় রাখেন মা, বড় হাড় মাংস কম, এ হলে কোনওরকম চালিয়ে নিতে পারি। মুরগির দাম বেশি। মুরগি খেতেও স্বাদ। খেতে স্বাদ হলেও মুরগি খাওয়ার ইচ্ছে দপদপ করলেও মুরগি জবাই কেউ আমাকে দিয়ে করাতে পারেনি। অনেক সময় এমন হয়, মা ব্যস্ত, দোকানের কোনও কর্মচারিরও আসার নাম নেই যে মুরগি জবাই করে দেবে, দাদারাও নেই কেউ, মা আমাকে বলেন জবাই করে দিতে। উঠোনে কাজের হাতে মুরগি ধরে দাঁড়িয়ে, আমার কেবল গলার চামড়া উঁচু করে ধরে আল্লাহু আকবর বলে কাটতে হবে যতক্ষণ না পর্যন্ত ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয়। দা নিয়ে গেছি অনেকদিন। গলার চামড়া ধরে উঠিয়েছিও। দা ও গলার কাছে এনেছি। শেষ অবদি পারিনি। আমার পক্ষে কক্ষনো সম্ভব হয়নি জ্যান্ত মুরগির গলা কাটা। গলা কাটা মুরগি যখন উঠোন জুড়ে লাফায়, দেখলে কষ্টও অমন করে আমার বুকের ভেতর লাফায়। দাদার কোনও কষ্ট হয় না দেখতে। দাদা বেশ উপভোগ করেন মুরগির অমন লাফানো। আমি মাকে অনেক সময় বলেছি,আমাদের খাওয়ার মজার জন্য মুরগিটার জীবন দিতে হইল! মা বলেন, ওদেরে আল্লাহ বানাইছেন মানুষের খাদ্যের জন্য। আল্লাহর উদ্দেশে কুরবানি দিলে কোনও গুনাহ হয় না। গুনাহ হয় না মা বলেন, কিন্তু চারমাস উঠোন জুড়ে হেঁটে বেড়ানো, ফার্মের বড় একটি শাদা মুরগিকে, যাকে মা ঝুমঝুমি বলে ডাকতেন, যাকে তাকে কামড় দিত বলে যখন জবাই করার কথা উঠল, মা বললেন, পালা মুরগিরে জবো করা ঠিক না। শেষ অবদি জবাই মুরগিটিকে করা হয়েছিল। মা যে কেবল মুখে তোলেন নি কোনও মাংস, তা নয়, উঠোন রক্তাক্ত করে ঝুমঝুমি যনণ্ত্রায় লাফাবে এই বীভৎস দৃশ্যটি দেখার আগেই যেভাবে ছিলেন যে কাপড়ে, ওপরে একটি বোরখা চাপিয়ে চলে গেছেন নানির বাড়ি। ওখানে তৃপ্তি করে শাক দিয়ে ভাত খেয়েছেন। মার থেকে থেকে মনে হয়েছে ঝুমঝুমি মাকে অভিশাপ দিচ্ছে।

 

ঢাকায় থেকে আসা বার্মা কোরিয়া ঘুরে আসা গীতাকে আমরা বিস্মিত চোখে দেখলেও সে যে মার পুত্রবধু, মা তা ভোলেন না। পুত্রবধূর হাতে সংসারের দায়িত্ব কিছুটা হলেও দিয়ে নিজে তিনি বিশ্রামের সময় পাবেন ভাবেন। মার ভাবনাই সার। গীতা রান্নাঘরের ছায়াও মাড়ায় না। আগের চেয়ে গীতার ঔজ্জ্বল্য আরও বেশি বেড়েছে। আগের চেয়ে তার হিলজুতো থেকে শব্দ হয় বেশি যখন হাঁটে। ঘাড় অবদি চুল কেটেছে। ভুরুদুটো সম্পণূর্ চেছে ফেলে কাজল-পেনসিলে দুটো ধনুক এঁকে দেয় ভুরুর জায়গায়। আগের চেয়ে মখু মালিশের জিনিসপত্র বেশি তার। ঠোঁটে কায়দা করে লাল গোলাপি লিপস্টিক লাগায়, চোখের পাতায় রং লাগায়, নীল শাড়ি পরলে নীল রং, সবুজ পরলে সবুজ। আগের চেয়ে সুন্দর শাড়ি পরে, আগের চেয়ে রঙিন। আগের চেয়ে বেশি বাইরে বেড়াতে যায়। আমি আর ইয়াসমিন আগের মতই খানিকটা বিস্ময়ে, খানিকটা মুগ্ধ হয়ে, খানিকটা আহত হয়ে, খানিকটা বুঝে, খানিকটা না বুঝে গীতাকে দেখি। মার আয়নার টেবিলটির মাথায় তিনটে বাতি লাগিয়ে দিয়েছেন ছোটদা। কড়া আলোর তলে গীতাকে ফর্সা দেখতে লাগে আয়নায়। সেজে গুজে দাঁড়ালে গোলপুকুর পাড়ে সুধীর দাসের মূর্তি বানানোর দোকানে সাজিয়ে রাখা অবিকল দগুর্ামূর্তিটি, দশ হাতের বদলে দু হাত, এই যা পার্থক্য। গীতা ফাঁক পেলেই আমাদের ঢাকার গল্প শোনায়। রাহিজা খানমের তিন ছেলেমেয়ের গল্প। শুনতে শুনতে ছেলেমেয়েগুলোর স্বভাব চরিত্র সব আমাদের জানা হয়ে যায়। বার্মা কোরিয়ার গল্প যখন করে শুনতে শুনতে মনে হয় বার্মা আর কোরিয়া বুঝি আমলাপাড়ার পরের গলিতেই। আগের মতই মা রান্না করে বাড়ির সবাইকে খাওয়ান। আফরোজা উঠ, কিছু খাইয়া লও, থেকে থেকে মার ডাক শুনি। ছোটদার জীবনে লেখাপড়া জাতীয় কিছু হওয়ার আর কোনও সম্ভাবনা নেই বলে বাবা তাঁকে উপদেশ দেন আরোগ্য বিতানে বসতে। আড়াইশ টাকা মাইনে পাবেন। ছোটদা চাকরিটি লুফে নেন। এই চাকরি নেওয়ার পর দাদার ওষুধের ওপর হামলে পড়া প্রায় পুরোটাই কমে গেছে ছোটদার। তিনি ফুরফুরে মেজাজে দিন যাপন করেন। ফুরফুরে মেজাজে বিকেলবেলা গোলপুকুরপাড়ের দিকে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে যান। কালো ফটকে ছোটদার বাইরে যাওয়ার শব্দ হওয়া মাত্রই দৌড়ে গিয়ে সবরি গাছের নিচে মেথরের যাওয়া-আসা করার ছোট দরজার ছিদ্রে চোখ রেখে কলস কলস নিতম্বটি বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে গীতা। ওই ছিদ্রে চোখ রাখলেই রাস্তার উল্টোদিকে ডলি পালের বাড়ি, গীতা দেখে ওই বাড়ির দিকে ছোটদার ভুলেও কখনও চোখ পড়ে কি না। বিয়ে হয়ে কাচ্চা বাচ্চার মা হয়ে তালাক হয়ে বাপের বাড়ি পড়ে আছে ডলি পাল। ডলি পালের দিকে ছোটদা এখন আর তাকান না, তারপরও বার্মা কোরিয়া ঘুরে আসা গীতার সন্দেহ মোচন হয় না। গীতার সবকিছু এমনকি সবরি গাছের তলে দৌড়ে গিয়ে ছোটদাকে দেখার কৌতূুহলও আমাদের কৌতূহলি কবে। গীতার উচ্চাজ্ঞরত শব্দও লুফে নিতে দেরি হয় না। গীতা যে ভাষায় কাজের মানুষদের গাল দেয়, তার বেশির ভাগই আমরা আগে শুনিনি, অথর্ও অনেক গালের জানি না। আমেনাকে পানি দিতে বলার পরও দিতে দেরি হচ্ছিল বলে যখন বলল, বেডি এহনো পানি দেয় নাই। করে কি বেডি? বেডির কি বিগার উঠছে নাহি! বিগার শব্দটি অর্থ না জেনে ইয়াসমিন এখানে সেখানে ব্যবহার করতে লেগে যায়।

এ বাড়িতে গীতার আদরের কমতি নেই। ঈদ এলে দাদা গীতাকে সিল্কের শাড়ি কিনে দিলেন, মার জন্য সুতি। মার পছন্দ খয়েরি বা লাল রংএর শাড়ি, দাদা কেনেন পাড়অলা শাদা শাড়ি। শাদা শাড়িতেই মাকে মা মা লাগে, দাদা বলেন। যে শাড়িই মার জন্য কেনা হয়, মা আমাকে আর ইয়াসমিনকে দেন পরতে প্রথম। আমরা পরে, পরে মানে লুটোপুটি করে শখ মেটালে, পরে মা পরেন। মার অভাব আছে, কিন্তু অভাবের বোধ নেই। শাদা শাড়িটিই, হয়ত দুদিন পরে গ্রাম থেকে কেউ এসে নিজের অভাবের কথা বলে কাঁদল, মা দিয়ে দিলেন। গীতার কাছে রাজিয়া বেগমের নতুন নতুন অনেক কথা শোনেন মা। গীতার খোঁড়া মাসির সঙ্গে, যে মাসির নাম হেনা, যে মাসি আমাদের বাড়ি এসে একসময় আমাকে আর ইয়াসমিনকে পড়াতেন, রাজিয়া বেগমের খুব ভাব। নতুন বাজারের এক এতিমখানার মেট্রন হয়েছেন রাজিয়া বেগম, সেই এতিমখানায় গীতার হেনা মাসিও চাকরি করেন। রাজিয়া বেগমের কথা যত শোনেন মা, তত মার পাগল পাগল লাগে। পাগল পাগল মা বাবা বাড়ি ঢুকলে মখু বিষ করে বসে থাকেন। বাবা রাগ দেখালে মাও রাগ দেখান। বাবা সেই রাগ দেখানো মাকে তোশকের তল থেকে চাবুক এনে মেরে রক্তাক্ত করে উঠোনে ফেলে রাখলেন একদিন। গলা কাটা মুরগির মত ত্রাহি চিৎকার করতে করতে মা লাফালেন, মার গা থেকে রক্ত ঝরল, গাছের কাকগুলো কা কা রব তুলে সরে গেল এলাকা থেকে। দৃশ্যটি নৃশংস বলে সামনে যাইনি, ঘরের দরজা বন্ধ করে আমি আর ইয়াসমিন বসে ছিলাম, বাবার হাত থেকে চাবুক কেড়ে নেওয়ার শক্তি বা সাহস কোনওটিই আমাদের নেই। আমরা পাথর হয়ে থাকি। বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মিনিট পাঁচ পর ছোটদা ঢোকেন। মাকে উঠোনে পড়ে গোঙাতে দেখে দৌড়ে বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে। সোজা আরোগ্য বিতানে। টেবিল থেকে ডাক্তার লেখা ত্রিকোণ কাঠটি নিয়ে আমার মারে মারছস কেন? তরে আমি আজকে মাইরাই ফেলছি বলে ঝাঁপিয়ে পড়েন বাবার ওপর। পুরো নতুন বাজারের লোক জড়ো হয়ে যায় চিৎকার শুনে। ছোটদাকে পাঁচজনে ধরে বেঁধে থামায়। ঘটনা ওদিকে এটুকুই। বাবার কপালের একটি দিক শুধু সামান্য ফুলে উঠেছে। এর বেশি কিছু হয়নি। ছোটদার রক্তারক্তির ইচ্ছে ছিল, সেই ইচ্ছে সফল না হলেও শান্ত হতে হয় তাঁকে। আর এদিকে উঠোনের কাদামাটি থেকে উঠে গীতাকে অদ্ভুত শান্ত গলায় বললেন, চল আফরোজা, কই যাইতে হয় চল। রক্তমাখা শাড়ির ওপরই বোরখা চাপিয়ে মা বেরিয়ে যান গীতাকে নিয়ে। আদালতে গিয়ে সত্যিকার তালাকের কাগজে সই করে বাড়ি ফিরে আমার আর ইয়াসমিনের মাথায় হাত বুলিয়ে ভাল হইয়া থাইকো তোমরা, মাইনষের মা মইরা যায় না? মনে করবা আমি মইরা গেছি। তোমার বাবা আছে, ভাইয়েরা আছে। তারা তোমাদেরে আদর কইরা রাখবে। তোমরা ভাল কইরা লেখাপড়া কইর বলে মা নিজের সহায় সম্পদ যা আছে ছোট একটি পুঁটলিতে বেঁধে চলে গেলেন নানির বাড়ি। মা চলে যাওয়ার আগেই গীতার সঙ্গে বাবার বেশ ভাব হয়েছিল। বাবা গীতাকে আলাদা করে ডেকে বাড়িতে কি হচ্ছে না হচ্ছে খবরাখবর নিতেন। বাবার চিরকাল এমনই অভ্যেস, বাড়িতে সব সময় একজন চর নিযুক্ত করেন গোপন খবর পাওয়ার আশায়। কাজের মানুষরাই সাধারণত বাবার চর হিসেবে ভাল কাজ করে। এবারের চর অবশ্য কাজের মানুষ থেকে অনেক উঁচু মর্যাদার বুদ্ধিসুদ্ধি সম্বলিত।

মা যে নেই, মা যেদিন চলে গেলেন সেদিন বুঝিনি। অথবা মা চলে গেলে বাড়িতে হৈ হৈ রৈ রৈ আগের চেয়ে আরও করতে পারার স্বাধীনতা বেড়ে গেছে বলে একধরনের গোপন আনন্দে ভুগেছিলাম। কিছুদিন পর হাড়ে কেন, মজ্জায় টের পেয়েছি। টের পেয়েছি আমাকে কেউ গা মেজে গোসল করিয়ে দেওয়ার নেই, মুখে তুলে কেউ খাইয়ে দেওয়ার নেই, চুল বেঁধে দেওয়ার নেই। কাপড় চোপড় ময়লা হলে কেউ দেখে না। খেলাম কি না খেলাম কেউ খোঁজ নেয় না। কেউ আর বিকেলে সন্ধেয় ছড়া শোনায় না। আমার কখন ক্ষিধে পেয়েছে, তা আমার জানার আগে মা জানতেন, অস্থির হয়ে উঠতেন আমাকে তৃপ্ত করতে। এখন আমার ক্ষিধে লাগলেই কি না লাগলেই কি, কারও কিছু যায় আসে না। মা চলে যাওয়ার পর সংসার দেখার জন্য নান্দাইল থেকে বাবা তাঁর ছোট ভাই মতিনের বউকে আনিয়েছেন। বউটি ইয়া মুটকি, কুচকুচে কালো। মতিন বিডিআরএ চাকরি যখন করতেন রাজশাহীতে, তখনই বিয়ে করেছেন। বউ নিয়ে কমাস আগে যখন এ বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন, আমরা মখু টিপে হেসেছি বউ দেখে। এক্কেরে মনে হয় কামের বেডি! কামের বেডির আশপাশ মাড়ায় না কেউ, কিন্তু মা দিব্যি সখু দুঃখের গল্প বললেন মতিনের বউএর সঙ্গে। যেন বউটি মার দীর্ঘদিনের সই। আমাদের মখু টেপা হাসির দিকে ফিরে মা বলেছেন, ও মেসে কাম করত। তাতে কি হইছে।মানুষটা খুব সাদাসিধাা। সাদাসিধা মানুষকে সে কাজের বেডি হোক, পথের ফকির হোক, মার পছন্দ। মতিনের বউ এ বাড়িতে রাঁধে বাড়ে, সকলকে খাওয়ায়। কিন্তু মার মত কে হতে পারে! মার মত কার আবেগ উথলে উঠবে আমাদের জন্য! খাওয়ার সময় কলমি শাক পাতে তুলে দিয়ে বলতেন, কলমি লতা কলমি লতা জল শুকোলে থাকবে কোথা? থাকব থাকব কাদার তলে, লাফিয়ে উঠব বর্ষাকালে। মার ছড়ার অন্ত ছিল না। সেই ছোটবেলায় পড়া যে কোনও ছড়াই মা অনর্গল বলে যেতে পারতেন। এত ছড়া মার জানা ছিল যে আমি মাঝে মাঝেই ভাবতাম মার সব ছড়া একদিন লিখে রাখব, কোনওদিন মা ছড়াগুলো আবার ভুলে যান যদি! মা সম্ভবত ছড়াগুলো ভুলে গেছেন, অনেকদিন তো তাঁর ছড়া বলে বলে কাউকে খাওয়াতে হয় না। মন ভাল থাকলে দিদার, সবার উপরে, হারানো সুর, সাগরিকা, বৈজু বাওরা, দীপ জ্বেলে যাই ছবির সংলাপ মা মখু স্থ বলতেন মা। রাতের অনড় স্তব্ধতা ভেঙে চমৎকার গলায় গেয়ে উঠতেন, এখনো আকাশে চাঁদ ওই জেগে আছে, তবু জেনে গেছি তুমি আছ কাছে….! এখন দিন রাত রাতের স্তব্ধতা বিরাজ করে বাড়িটিতে।

ইয়াসমিন ইশকুল থেকে ফিরে চেঁচাচ্ছে আমার ভাত কই? মতিনের বউ বলে, ভাত নাই। ভাত নাই মানে? ইশকুল থেইকা আইসা ভাত পাই নাই এইরম ত হয় নাই কোনওদিন। তা ঠিক, হয়নি কোনওদিন। মা ইশকুল থেকে ফিরলেই ভাত বেড়ে দিতেন। চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করে ইয়াসমিন। মতিনের বউ দিয়ে সংসার চলছে না নিশ্চিত হয়ে বাবা গীতার ওপর সংসারের সমস্ত দায়িত্ব দিলেন। ছোটদার সঙ্গে বাবার যে বচসা হয়েছিল, তা আপনা আপনি মিটে গেল, যেন কোনওদিন বাবার মাথায় কোনও দ্বিকোণ, ত্রিকোণ, চতুষ্কোণ কোনও কাষ্ঠবস্তুর আঘাত লাগেনি। গীতা যা আদেশ করে, মতিনের বউ আর আমেনা সেই আদেশ পালন করে। দিন এভাবেই চলছে। দিন হয়ত চলে, আমার আর ইয়াসমিনের চলে না। গীতা আমাদের নিয়ে ছাদে দৌড়োদৌড়ি করছে, ঘরে নাচের ইশকুল খুলছে, আমাদের সিনেমায় নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কিছু যেন বাকি থেকে যায়। বাবা বাড়ি ফিরেই গীতাকে ঘরে ডাকেন, অনুমান করি রাজ্যির কথা জিজ্ঞেস করছেন, সংসার ছেলেমেয়ের কথা। কেউ আবার কোনওরকম অঘটন ঘটাচ্ছে কি না জানতে চাচ্ছেন। গীতা বাবাকে আশ্বস্ত করেন বলে যে সব কিছু সে নিখুঁত চালাচ্ছে, সবই বিন্যস্ত, সবই সন্নদ্ধ। নিষেধ থাকার পরও এক বিকেলে ইয়াসমিনকে বলি, চল নানির বাসায় মারে দেইখা আসি। ইয়াসমিন লাফিয়ে ওঠে। ভয়ডর তুচ্ছ করে একটি রিক্সা নিয়ে দুজন যখন নানির বাড়িতে পৌঁছোই, মা দৌড়ে এসে আমাদের জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন।

মখু টা এত শুকনা লাগতাছে কেন, খাও নাই?

মাথা নাড়ি, খাইছি।

মা কাছে বসিয়ে কি দিয়ে খেয়েছি, কে রাঁধে, কে কাপড় চোপড় গোছায়, কে বিছানা করে দেয় সব পই পই করে জিজ্ঞেস করেন। মুখে তুলে ভাত মাছ খাইয়ে আঁচলে মখু মুছিয়ে দেন। তেল না পড়া জট বাধাঁ চুল সযতে ্ন আঁচড়ে বেণি গেঁথে দেন। আড়ালে নিয়ে জিজ্ঞেস করেন বাবা কিছু বলে কি না তাঁর কথা। আমি মাথা নাড়ি। বাবা কিছু বলেন না। বাবা যে প্রায়ই আমাদের বলেন কোনও জ্বালউরা বেডি বাড়িতে নাই, এহন নিজের খাওয়া নিজে খাইবি, নিজের পরা নিজে পরবি, নিজের বুঝ নিজে বুঝবি পেটের ভেতর লুকিয়ে রাখি। মা বলেন তিনি ভাল আছেন, নানা তাঁকে শাড়ি কিনে দিয়েছেন, এখানে খাওয়া দাওয়ায় কোনও অসুবিধে হচ্ছে না, এ বাড়ির সবাই মাকে খুব ভালবাসেন।মা বারবার বলেন এই কদিনে আমি আর ইয়াসমিন দুজনই নাকি শুকিয়ে গেছি। চোখের জলে মার গাল ভিজে যায়, বুক ভিজে যায়।

আমার জন্য মন খারাপ লাগে তুমগোর? মা মা বইলা কান্দো?

আমি আর ইয়াসমিন পরস্পরের চোখে চাই। কান্দি না বললে মার যদি কষ্ট হয়, বলি না। নিরুত্তর আমাদের বুকে জড়িয়ে মা বলেন, না কাইন্দো না, কান্দা আইলে তোমরা গীতার সাথে গপ্প কইর, নাম দেশ ফুল ফল খেইল। এখন থেইকা আর কাইন্দো না।

মাথা নাড়ি। আইচ্ছা।

নোমান কামাল আইল না যে! ওদেরে বইল আসতে।

মাথা নাড়ি। আইচ্ছা।

মা খুঁটিয়ে আরও কথা জিজ্ঞেস করেন।

রান্না কেমন হয়?

ভাল হয় না।

কেন ভাল হয়না? মতিনের বউ তো খারাপ রান্ধে না।

ঝাল দেয়।

বইলা দিবা ঝাল যেন না দেয়।

শাকের মধ্যে চুল পাইছি।

শাক ভাল কইরা ধইয়া নিতে কইবা।

আইচ্ছা।

মা, তুমি কি আর কোনওদিন যাইবা না? কণ্ঠে কষ্ট চেপে বলি।

খিলালে দাঁত খোঁচাচ্ছিলেন নানি, থুতু ফেলে বললেন, কেন যাইব? নিজেরা বড় হ।

তারপরে মারে নিয়া থাহিস। ওই বাড়িত ঈদুন আর যাইব না।

মা বলেন, নোমানের ত টাকা পয়সা আছে। সে যদি আলাদা বাসা নেয়, তাইলে ত থাকতে পারি।

অনেকক্ষণ উঠোনে উদাস তাকিয়ে থেকে মা আবার বলেন, দেইখেন মা, এইবার ওই রাজিয়া বেগমরে বাড়িত আনব।

তোমার বাবা কি কিছু কয়? রাজিয়া বেগমরে বাড়িতে আনব, এই ধরনের কিছ?ু মাথা নাড়ি। না।

তোমার বাবা কি বাসায় খায়?

খায়।

খাওয়া পছন্দ হয় তার?

জানি না।

কিছু কয় না?

না।

মা পাংশুমুখে বসে থাকেন। চোখের নিচে কালি মা,বসে থাকেন। গালে চোখের জলের দাগ মা, বসে থাকেন। আমরা যখন চলে আসি, পেছনে পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকেন বাসি গোলাপের মত, স্পর্শ লাগলেই ঝরে যাবেন এমন।

গীতার হাতে যখন সংসার, হাতে সংসার মানে কাজের বেডি বা ছেড়ি বা ছেড়া যেই থাকে কাজে ফাঁকি যেন না দেয়, দেখা; বাসন মাজা কাপড় ধোয়া ঘর মোছা ইত্যাদি কাজ আদেশ দিয়ে বিরামহীন করানো;পটল দিয়ে মাছ হবে, কি শাক দিয়ে মাছ হবে, ডাল পাতলা হবে কি ঘন হবে, আর ভাতের চাল কয় কৌটো নিতে হবে এসব বলে দেওয়া; গীতা যখন মাতব্বর, বাবার সঙ্গে যখন গীতার দহরম মহরম, তখনই একদিন গীতার ছোট ভাই ভাল নাম শিশির মিত্র, খারাপ নাম টুলু আসে, দেখা করে যায় বোনের সঙ্গে। এরপর প্রায়ই আসে। গীতা ঘরে ডেকে নিয়ে টুলুকে এটা সেটা খেতে দিয়ে ফিসফিস গল্প করে। টুলুর আসার খবরটি আমি আর ইয়াসমিন দুজনেই গোপন রাখি। গীতা মুসলমান বিয়ে করে মুসলমান হয়ে গেছে, তার এখন কোনও হিন্দু বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কে থাকতে পারে না, এরকম একটি অলিখিত নিয়ম চালু এ বাড়িতে। গীতা যখন ছোটদাকে নিয়ে নিজের বাড়ি যায়, সে কথা বাড়িতে গোপন রাখে। টুলুর আসার ব্যাপারটিও গোপন।

দাদা নানির বাড়িতে মাকে দেখতে যেয়ে নানির হাতের চমৎকার রান্না খেয়ে নানির পানের বাটা থেকে পান খেয়ে বাড়ি ফেরেন মখু লাল করে। ছোটদাও সন্ধেবেলা বউ নিয়ে বেরিয়ে বন্ধুদের বাড়ি হয়ে, পিওনপাড়া বউএর বাড়ি হয়ে, নানিবাড়ি গিয়ে মাকে দেখে আসেন। দুজনকেই বলি, মারে নিয়া আসো না কেন?

কেউ এর কোনও উত্তর দেন না। না দাদা, না ছোটদা। দিব্যি আছেন তাঁরা। মা-হীন অবকাশ তাঁদের কাছে মোটেও অসহনীয় বলে মনে হয় না।

দাদা একটি মোটর সাইকেল কিনে এনেছেন, লাল রঙের একশ দশ সিসি হোন্ডা।কিনেছেন কিন্তু চালাতে জানেন না। বারান্দার ঘরে রাখা হোন্ডাটি তিনি দুবেলা পরিষ্কার করেন। যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন, হোন্ডায় বসে বিকট শব্দে ইঞ্জিন চালিয়ে ওই ঘরেই আধহাত সামনে যান, আধহাত পেছনে যান। আর হোন্ডার আয়নায় বার বার নিজের মখু টি দেখেন কেমন লাগছে। ইঞ্জিন চালিত কোনও বাহন এই প্রথম আমাদের বাড়ি এল। বাবার হঠাৎ একবার শখ হয়েছিল এম এ কাহহারের বাড়ির লাগোয়া আকন্দ লজের জুলফিকার আকন্দের পুরোনো গাড়িখানা কেনার, বায়নার পঞ্চাশহাজার টাকা দিয়েও দিয়েছিলেন। বাড়ি সুদ্ধ আমরা তখন মনে মনে সেই শাদা ফক্সওয়াগন চালাচ্ছি। কিন্তু ইঞ্জিনে কি না কি দেখা দেওয়ায় সেই গাড়ি বাবা আর কিনলেন না, বায়নার টাকাও ফেরত পেলেন না, ফেরত পাওয়ার নাকি নিয়ম নেই। হোন্ডা কেনাতে বাবাও এর তদারকি করতে লাগলেন। বারান্দার ঘরের দরজা যেন সবসময় বন্ধ থাকে, কেউ যেন আবার চুরি করে না নিয়ে যায় এটি, রাতে তিনি নিজের হাতে ঘরের দরজায় ভেতর থেকে তালা লাগাতে শুরু করলেন। সেই শখের লাল হোন্ডাটি যেটি এখনও রাস্তায় বেরোয়নি, ছোটদা তুলে নিয়ে আমাকে বললেন পেছনে বসতে। ছোটদাও এর আগে কখনও মোটর সাইকেল চালাননি। ঈশ্বরগঞ্জে বাবার হাসপাতালের জিপ চালাতে শিখেছিলেন, সেই জ্ঞান কেবল। হোন্ডা আধমাইল পর্যন্ত যেতে তিরিশবার থামল। রাস্তার লোকেরা থেমে থেমে আমাদের তিরিশবার দেখল। মেয়ে মানুষ হোন্ডায় চড়েছে, দেখার বিষয়টি ছিল এই। মেয়েমানুষ এ শহরে হোন্ডায় বসলেও কোতূক বা কৌতূহলের বিষয় হয়। অথচ এই শহরে নিতু নিজে মোটর সাইকেল চালায়, বিদ্যাময়ী ইশকুলে পড়ে নিতু ছোটবোন মিতুকে পেছনে বসিয়ে ইশকুলে যায় প্রতিদিন। শহরের বিস্ময় সে। মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছে করে নিতু হতে, কাউকে পরোয়া না করে শহরের পথে মোটর সাইকেল চালাতে। ইয়াসমিন যখন নিতু আর মিতুর কথা বলে, আমি মোহগ্রস্তের হয়ে শুনি।

দাদা হোন্ডা শিখে হোন্ডা চড়ে শহর এবং শহরের আশেপাশের শহরগুলো কোম্পানির কাজে যেতে লাগলেন। একদিন তিনি চল তরে পাহাড় দেখাইয়া আনি বলে আমাকে তুলে নেন হোন্ডায়। অপ্রত্যাশিত আনন্দ জানলা ভেঙে হুড়মুড় করে ঢুকে আমার ভুবন ভাসিয়ে দেয়। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে এসে থামতেই আকাশ কালো করে মেঘ দৌড়োতে লাগল, যেন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সূর্যটি, কালো ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে পোড়া সূর্য থেকে। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ওই বৃষ্টির মধ্যেই একটি যাষনীবোঝাই নৌকোর মধ্যে আমরা, দাদার হোন্ডা, দাদা,আমি আর আমার মৃত্যুভয় উঠে পড়ি। নৌকোডুবিতে প্রাণটি যে আজ সকালে হারাতে হচ্ছে এ জেনেও জীবনে প্রথম পাহাড় দেখার ইচ্ছেজ্ঞট আমি কিছুতেই হাতছাড়া করি না। শম্ভগু ঞ্জ পৌঁছে, বাসের বাজারের কোলাহল পেরিয়ে হোন্ডা ছুটে চলল নির্জনতার দিকে। বাতাসে চুল উড়ছে, জামা উড়ছে। যেন এ আমি আর দাদা নই, দুটো প্রজাপতি উড়ে যাচ্ছে। যতদূর দৃষ্টি যায় কোনও বসতি নেই, কেবল বিল হাওড় আর ধানক্ষেত। গলা ছেড়ে হেঁড়ে গলায় গান গাইছি, মখু স্থ কবিতা বলছি, দাদার পেট ভর্তি গল্প, বানানো অবানানো, বলে যাচ্ছেন। দাদা ছোটবেলায় আমাদের গল্প শোনাতেন অনেক। কত আর গল্প জানে একজন মানুষ! দাদা পুরোনো গল্পগুলো আবার শোনাতে গেলে আমরা বিরক্ত হতাম। নতুন গল্পের জন্য জেঁকে ধরতাম। একদিন দীর্ঘ একটি গল্প শোনাবেন বলে আমাদের ডাকলেন। গল্পটি নতুন। খেয়ে দেয়ে লেপের তলায় একেবারে গল্প শোনার পরিবেশ তৈরি করে শোয়া হল, দাদা শুরু করলেন, অচিনপুর নামের এক গ্রামে আলাউদ্দিন নামের একটা কাঠুরে ছিল।একদিন দুপুরে বাড়িতে খুব খাওয়া দাওয়া কইরা একটা নতুন লুঙ্গি পইরা,কান্ধে একটা গামছা নিয়া আলাউদ্দিন বাড়ির বাইর হইল। সামনে বিশাল মাঠ, কোথাও আর কিছু দেখা যায় না। সেই মাঠে আলাউদ্দিন হাইটা হাইটা যাইতাছে, যাইতাছে তো যাইতেই আছে। যাইতে যাইতে যাইতে যাইতে যাইতে যাইতে যাইতে যাইতে যাইতে ..

তারপর?

তারপর মানে?

তারপর কি হইল? কই গিয়া পৌঁছল?

এহনো কোথাও পৌছায় নাই? এহনো যাইতেই আছে। যাইতে যাইতে যাইতে যাইতে যাইতে যাইতে..

আমি উৎসুক জানতে আলাউদ্দিন কোনও নদীর ধারে পৌঁছোল নাকি কোনও বটগাছের কাছে। কিন্তু আমার জানা হয় না কারণ দাদা ওই রাতে এক যাইতে যাইতে ছাড়া আর কিছু বললেন না। পরদিন ঘুম থেকে উঠেই দাদাকে জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কি হইল, আলাউদ্দিন কই গেল? দাদা বললেন,এহনো যাইতেই আছে। এহনো যাইতেই আছে?

হ এহনো যাইতাছে।

কই যাইব?

ওইডা ত পরে জানবি। আগে যাইতে থাকুক।

সপ্তাহ পার হওয়ার পরও দাদা বললেন, যাইতাছে এহনো। কবে পৌঁছবে, কোথাও গিয়ে পৌঁছবে, কি ঘটবে পরে তার কিছুই দাদা জানান না। নতুন কোনও গল্প শুরুও করেন না। কারণ একটি গল্প তো তিনি বলছেন। একমাস পরও দাদা বললেন এখনও আলাউদ্দিন যাচ্ছে। আমি আর ইয়াসমিন গভীর চিন্তায় ডুবে থাকি, তর কি মনে হয়?আলাউদ্দিনের শেষ পর্যন্ত কি হইব? ইয়াসমিনের বিশ্বাস আলাউদ্দিন ক্ষিধের চোটে মরে যাবে পথে। দাদার কি বিশ্বাস তা তিনি কখনও বলেন না। দাদার আলাউদ্দিনের যাওয়া কখনও শেষ হয়নি। দাদার কাছ থেকে আর কোনও গল্পও আমাদের শোনা হয়নি। যেতে যেতে আমার ইচ্ছে করে আমাদের এই পথও না ফুরোক কোনওদিন। তারাকান্দা ফুলপুর পার হয়ে কাঁচা রাস্তা পাকা রাস্তা ভাঙা রাস্তা পেরিয়ে কংস নদীর সামনে আসি। বিষম স্রোতের নদী। যেন দুপাড় এক্ষুনি ভেঙে চুরে নদীর পেটের ভেতর ঢুকে যাবে। দুটো নৌকোর একটি পাটাতন, সেই পাটাতনের ওপর বাস ট্রাক ওঠে, দড়ি টেনে নদী পার করা হয়। নদী পার হতে হতে দাদা আমাকে উজান, ভাটি, লগি টানা কাকে বলে বোঝান, নদী এবং নৌকোর জীবন সম্পর্কে বোঝান। কংস পেরিয়ে আবার হাওয়ার বেগে ছোটা। ধান খেত, পাট খেত, রাস্তার ওপর শুকোতে দেওয়া ধান, পাখির এসে খুঁটে খাওয়া, মানুষের বাড়িঘর, উঠোন মাঠ দেখতে দেখতে হালুয়াঘাট পার হয়ে আরও ভেতরে গারো মেয়েদের ধানবোনা ধানকাটা, পিঠে বাচ্চা বেঁধে হেঁটে যাওয়া দেখতে দেখতে জয়রামকুরায় সুন্দর একটি হাসপাতালের সামনে থামি। এক অস্ট্রেলিয়ান গারোদের জন্য এই হাসপাতালটি বানিয়েছেন। দাদা অস্ট্রেলিয়ান ডাক্তার নেইল পালকারের সঙ্গে কথা বললেন, তাঁকে ওষধু পত্র দিলেন। আমি হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাহাড় দেখছি তখন। পাহাড়ের অন্য পাশে ভারত। বাংলাদেশ থেকে মেঘ ভেসে যাচ্ছে ভারতের দিকে, পাখি উড়ে আসছে ওদিক থেকে এদিকে। দাদাকে জিজ্ঞেস করি, পাহাড় পার হইয়া ওই পাশে যাই যদি! দাদা বললেন না যাওয়া যাবে না, ওইটা অন্য দেশ। পাহাড়ে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে অন্য দেশ ভারত, আমার মনে হয় আমি শুনতে পাচ্ছি ভারতের হৃদপিণ্ডের শব্দ, শুনতে পাচ্ছি শ্বাস ফেলার শব্দ। এত কাছে, এত কাছে ভারত যে ইচ্ছে করে কানে কানে কিছু কথা কই। কই ভাগ হলি কেন রে? তুই কি আমাদের পর? পাহাড় দেখে ফেরার পথে দাদা অনেকের সঙ্গে থেমে থেমে কথা বললেন। দুটো ফার্মেসিতে থামলেন, চা মিষ্টি দেওয়া হল আমাদের। সারাদিন না খাওয়া অথচ ক্ষিধের কিছুই অনুভব করি না। ফার্মেসির একটি লোক পেছনে তাঁর বাড়িতে বউ বাচ্চার সঙ্গে পরিচয় করাতে ঢোকালেন, বউএর সঙ্গে দিব্যি কথা বলি এমনকি বাচ্চাজ্ঞটকে কোলে নিয়ে নাম জিজ্ঞেস করি। ওখান থেকে বেরিয়ে পথে দাদা বলেন, বাহ, তর তো উন্নতি হইছে। তুই ত এমনিতে মানুষের সাথে কথা কস না। আজকে কইতে দেখলাম।

আমি হেসে বলি, সকালে ডেল কার্নেগি পড়ছি কয়েক পাতা। মনে হয় সেই কারণেই।

দাদা অট্টহাসি হাসেন। আমরা আবার হাওয়ায় ভেসে যাই।

দাদাকে এক সময় জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা দাদা, এই যে তুমি সবার সাথে এত সুন্দর ব্যবহার কর, হাইসা হাইসা কথা কও, সেই নিশিবাবুর সাথে, মাথায় হ্যাট গলায় স্টেথোককোপ ঝুলাইয়া মাটির রাস্তায় সাইকেল চালাইয়া আসা হাতুড়ে ডাক্তারটার সাথে, কেমিস্ট নাজমুলের সাথে, জনমানবহীন এই বনবাসে জীবন কাটানো হাসপাতালের ওই ডাক্তারের সাথে—তুমি কি ডেল কার্নেগি মখু স্ত করছ?

দাদা অনেকক্ষণ হেসে উত্তর দেন, ডেল কার্নেগি তো আমার সাথে দেখা করতে আইছিল, আমার লাইফটা দেইখা গিয়া উপদেশমূলক রচনা লিখছে।

ছোট ছোট কাপে চা বিক্রি করে পথের ধারে ঝপু ড়িগুলোয়, চায়ের তৃষ্ণায় থেমে ওখানে চা খেতে গেলে দাদা বলেন, চা খাইস না, চা খাইলে ভেতরে ক্ষয় হইয়া যায়। দেখস না চায়ের কাপে চা রাইখা দিলে কিরম দাগ পইরা যায়, শত চেষ্টাতেও চায়ের কাপের দাগ আর উঠতে চায় না। এইভাবে তর কইলজা ক্ষয় হইয়া যাইব চা খাইলে, তর হৃদপিণ্ডটাও চায়ের কাপের মত নষ্ট হইয়া যাইতাছে। বীভৎস হইতাছে। ঝাঁঝরা হইয়া যাইব একদিন।

মা দধু ছাড়া চায়ে আদা মিশিয়ে দেন, সেই চায়ের স্বাদের ধারে কাছে গ্রামের বাজারের দধু মেশানো বাসিগন্ধের চা দাঁড়াতে পারে না। তবওু এই ঝপু ড়িদোকানের চা আমি পরমানন্দে পান করি, পান করি ঘরের বাইরে বলেই। বাহির আমাকে টানে। সষের্ ফুলে ছেয়ে থাকা গ্রামের হলুদ ক্ষেত আর বাজারের নানারকম ঝপু ড়ি দোকান দেখতে আমার আনন্দ হয়। ব্রহ্মপুত্র পার হওয়ার সময় অদ্ভুত সুন্দর রঙে সেজে ওঠা আকাশ দেখতে দেখতে ভয় উবে যায়, নৌকো ডুবে মরে যাওয়ার ভয়। যখন বাড়ি পোঁছই, সারা গা ধুলোয় কিচকিচ, এমন কি কথা বলতে গেলে দাঁতে কিড়কিড় করে ওঠে ধুলো। ধুলোয় চুল জট হয়ে আছে। দেখতে আমাকে, ইয়াসমিন বলে, ভূতের মত লাগছে। ভূত পেত্নী যেমনই দেখাক না কেন আমাকে, এই ভ্রমণ আমাকে আশ্চর্য রকম সুখী করে। অর্ধেক রাত অব্দি দাদাকে ধমকেছেন বাবা, তর মাথায় ত বুদ্ধি টুদ্ধি আছে জানতাম। এই মেয়েরে নিয়া তুই মোটর সাইকেলে বাইর হস, মাইনষে কি কইব!

রাতে শুয়ে কড়িকাঠের দিকে চোখ, ইয়াসমিনকে বলি, ধর আমি একটা পাহাড়, আমার শরীরের অর্ধেকটা ভারত, অর্ধেকটা বাংলাদেশ। আমার ডান হাত বাঁদিকে যাইতে পারবে না, আমার বাঁ হাত ডান দিকে আসতে পারবে না। কিন্তু আমার ওপর দিয়া তুই যদি পাখি হস, যাইতে পারবি। পাখির স্বাধীনতা মানুষের স্বাধীনতার চেয়ে বেশি। নানির বাড়িতে আমরা গিয়েছি, সে খবর বাবার কাছে পৌঁছে যায়। বাবা আমাকে ডেকে বললেন, ঠ্যাং লম্বা হইয়া গেছে তর। আরেকদিন যদি শুনি বাসার বাইর হইছস, টেংরি ভাইঙ্গা ফেলব। বাবার হুমকি কাজ করে না। আমি ঠিকই নানির বাড়ি যেতে থাকি। মাকে বলি, মা চল। নানি বলেন, তুই কইলেই হইব নাকি! নোমান কামালরে পাঠা, তর বাপরে পাঠা। তর বাপ আইয়া নিয়া গেলে যাইতে পারে। শুকনো-মখু -মা, শুকনো- ঠোঁট-মা বলেন, ওর বাপ কি আসবে? মেয়েদুইটার কষ্ট দেইখাও ত মখু বুইজা রইছে। কি জানি যদি রাজিয়া বেগমরে বাড়িত তুলে, তাইলে তো আর কারও না হোক, মেয়েদুইটার কষ্ট হবে!

নানির বাড়িতে যাওয়ার আসার পথে দেখি আজিজ প্রিন্টাসর্ নামে একটি ছাপাখানা।রিক্সা থামিয়ে সেই ছাপখানায় নেমে ডিমাই সাইজ প্রতি ফর্মা ছাপতে খর্চা কত জেনে আসি। এরপর দাদার কাছে টাকা চেয়ে কাগজ কিনে ছাপাখানায় দিয়ে ওখানে বসেই সেঁজুতির দ্বিতীয় সংখ্যার প্রুফ দেখি। মোহাম্মদ আজিজ নামের লোকটি ছাপাখানার মালিক, দাদা চেনেন তাঁকে, দাদাও মাঝে মাঝে দেখে আসেন ছাপা কদ্দুর। একদিন ছাপার বাকি খরচ দিয়ে বাড়িতে সেঁজুতি নিয়ে আসেন। সেঁজুতি এবার শাদা কাগজে, দাদা একটি কপি হাতে নিয়ে বললেন, নাহ, ছাপা ভাল হয় নাই। এরপর থেইকা জমানে ছাপাইস। জমান হইল সবচেয়ে ভাল প্রেস। পাতা পত্রিকা ত জমান থেইকাই ছাপতাম। দাদা যখন তাঁর এককালের পাতার কথা স্মরণ করেন, তাঁর চোখ থেকে ঝিলমিল আনন্দ ঝরে। পাতা নামে দাদা আর তাঁর বন্ধুরা মিলে যে সাহিত্যের কাগজ প্রকাশ করতেন, তা আসলেই খুব সুন্দর ছিল। পাতার চিঠি লেখার কাগজ, এমনকি সদস্য হওয়ার কাগজ, সদস্যচাঁদা নেওয়ার রশিদ এসবও ছাপা ছিল চমৎকার জলছাপঅলা, দাদা এখনও স্মৃতি হিসেবে পাতার কাগজপত্র রেখে দিয়েছেন কাছে। মাঝে মাঝে বের করে ধুলো ঝেড়ে হাত বুলোন আর বলেন, দেখিস পাতা আমরা আবার ছাপাইয়াম। যে তিনজন পাতা ছাপতেন তার মধ্যে একজন শীলার ভাই, শীলার সঙ্গে দাদার প্রেম হওয়াতে চিকন ফরহাদ দাদার মখু দর্শন করা বন্ধ করে দিয়েছেন, আরেকজন মাহবুব, ও ছেলে পাগল হয়ে এখন মানসিক রোগীর হাসপাতালে শেকল দিয়ে বাধাঁ। দাদা একটি কেন দশটি সাহিত্যপত্রিকা ছাপতে পারেন ইচ্ছে করলে কিন্তু পাতা নামটি ব্যবহার করতে পারবেন না। পাতা দাদার একার সম্পত্তি নয়। দাদা ছিলেন যগু ্ম সম্পাদক, আসল সম্পাদক ছিলেন ফরহাদ। দাদা বলেন, ফরহাদ আর কি করত, সব ত আমিই করতাম! তা বলে স্বস্তি জোটে অবশ্য, কিন্তু কোনও পত্রিকার নাম পাতা দেওয়ার অধিকার জোটে না। দাদা আবার পত্রিকা বের করতে চান পাতা নামে, খবরটি শুনে ফরহাদ জানিয়ে দিয়েছেন, দাদার বিরুদ্ধে তিনি মামলা করবেন।

আমি যখন সেঁজুতিতে ডুবে আছি, একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে বাড়িতে। ইয়াসমিনের পিঠে ছোট্ট একটি পাখা গজায়। পাখা গজানোটি ভয়ঙ্কর নয়, পাখা গজানোর কারণে যেটি ঘটে, সেটি ভয়ঙ্কর। ইয়াসমিনের এই পাখি হওয়ার ইচ্ছে কোনও ভারত বাংলাদেশ সীমানা অতিক্রম করার জন্য নয়, তার নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে একদিন খুব গোপনে উড়ে যাওয়ার জন্য। পাড়ার ফুটফুটে ছেলে বাদল, ইয়াসমিনেরই সমবয়সী, দাঁড়িয়ে থাকত রাস্তায় ইয়াসমিন যখন ইশকুলে যেত, একদিন সাহস করে এগিয়ে এসে কথা বলেছে। রাস্তায় কথা বললে আবার কে না কে দেখে ফেলে কি না কি কাণ্ড ঘটায়, তাই পরদিন সে ইয়াসমিনকে বোটানিক্যাল গার্ডেনে যেতে বলে। গণ্ডি থেকে বেরোবার এমন তীব্র আকর্ষণ ইয়াসমিনের, সে ইশকুল শেষে একটি রিক্সা নিয়ে সোজা সেই গার্ডেনে যায়। বাদল গিয়েছিল তার এক কাকাকে নিয়ে। সেই কাকা বাদল আর ইয়াসমিন বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঘুরে বেড়াচ্ছে, গাছপালা দেখছে, বাগান জুড়ে ফুটে থাকা নানা রঙের ফুল দেখছে, নদী দেখছে, কিন্তু দেখছে না ওদের দেখে পাড়ার একটি ছেলের বাবাকে খবর দেওয়ার জন্য দৌড়ে যাওয়া। খবর পেয়ে বাবা এক মুহূতর্ দেরি না করে সেই গার্ডেনে নিজে গিয়ে ধরে আনেন ওদের। বাদলকে চুলের মুঠি ধরে বাড়িতে এনে হাত পা শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে বারান্দার ঘরে সারা বিকেল চাবকেছেন বাবা। বাদলের আর্তনাদে সারা পাড়া কেঁপেছে, বাবা পরোয়া করেননি। অর্ধমৃত বাদলকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে বাড়ির বের করেন, তাও আবার পুলিশের হাতে দিতে। মেয়ে-কিডন্যাপের মামলা ঠোকেন সেদিনই, বাদলকে কোমরে দড়ি বেঁধে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। জেল থেকে ছেলে ফিরে এলে এ পাড়া ছেড়ে বাদলের বাবা সমীরণ দত্ত চলে যান। কেবল বাদলকেই নয়, ইয়াসমিনকে ঘরের দরজা বন্ধ করে বাবা মেরেছেন একই চাবুকে।ওর শরীরের একটি ইঞ্চিও বাদ ছিল না কালসিটে দাগ থেকে। হু হু করে জ্বর আসে ওর, মাথার ঘন কালো চুল মুঠো মুঠো উঠে আসতে থাকে। এই ঘটনার পর ইয়াসমিন প্রায়ই ইশকুল থেকে ফিরে মন খারাপ করে বসে থাকে। ইশকুলে ওর ক্লাসের মেয়েরা বলতে শুরু করেছে, তুই নাকি কোন ছেড়ার সাথে ভাইগ্যা গেছিলি গা? ময়মনসিংহকে খুব বড় শহর বলে মনে হয়, কিন্তু লোকে যখন রসের গল্প বলতে গিয়ে, রজব আলীর ছোট মেয়ে একটা ছেলের সাথে ভাইগ্যা গেছিল, হাহা হিহি বলে আর এসব আমার কানেও যখন আসে, বুঝি শহরটি বড় ছোট। মানুষের মনও বড় ছোট। বাবা যদি সেদিন ওই ঘটনাটি না ঘটাতেন, ইয়াসমিন ওই গার্ডেন থেকে ফিরে আসত বাড়িতে, দেরি হইছে কেন ইশকুল থেইকা ফিরতে জিজ্ঞেস করলে হয়ত বলত, রিংকুর বাসায় গেছিলাম। ওর বান্ধবী রিংকু ইশকুল শেষ হলে রিংকুর বাড়ি থেকে ঘুরে আসা এমন কোনও অপরাধ নয়। সেদিন ইয়াসমিনের কৌতূহল বাদলের জন্য যত ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল গার্ডেনের জন্য। সেই গার্ডেন একবার দেখা হয়ে যাওয়ার পর ওর গার্ডেনের শখ হয়তো মিটত, গোপনে গোপনে গণ্ডির বাইরে যাওয়ার আনন্দ ও পুষে রাখত নিজের ভেতর। কেউই ইয়াসমিনের দিকে ছুঁড়ে দিত না কোনও ছেড়ার সাথে ভাইগ্যা যাওয়ার জন্য ঘণৃা। ইয়াসমিন নিজেকে এমন অপরাধী ভাবত না, সকলের চক্ষু থেকে এমন প্রাণপণে লুকোতে চাইত না নিজেকে।

গীতা টুলুকে কিছু দিয়েছে, বস্তায় করে। ছোট্ট খবর। এই খবরটি বাবার কানে পৌঁছয়। বাবা দাপাদাপি করেন ঘরে। ফিসফিস কণ্ঠ, কি দিছে রে কি দিছে?

কি জানি, চাইল টাইল মনে হয়। আমেনা বলে।

টুলু কয়দিন আইছে?

আইছে অনেকদিন।

আইয়া কি করে?

এই গপ্প সপ্প করে।

কার সাথে করে?

তার বইনের সাথেই।

বাবা যখন গভীর করে কিছু ভাবেন, চশমা খুলে ফেলেন এক টানে। মাথা নিচু করে বসে থাকেন। চোখ মুহূর্তে হয়ে ওঠে লাল। পায়চারি করেন বারান্দায়। হাতদুটো পেছনে। কখনও কোমরে। মাঝে মাঝে এক মাথা কালো কোঁকড়া চুল টেনে পেছনে সরিয়ে দিচ্ছেন। বসছেন চেয়ারে, চেয়ার সশব্দে সরিয়ে উঠে যাচ্ছেন। আবার বসছেন। বাবাকে এ অবস্থায় দেখলে বাড়ির সবার একটিই কাজ, অপেক্ষা করা, কারণ একটি বিষ্ফোরণ ঘটতে যাচ্ছে খুব শিগগির। কিন্তু এবার বিস্ফোরণ কিছুরই হল না। শান্ত কণ্ঠে তিনি দাদাকে ঘরে ডেকে নিয়ে বললেন, যা তর মারে নিয়া আয়।

আমরা যখন মাকে নিয়ে আসতে গেলাম, মা চমকালেন না, যেন অপেক্ষা করেই ছিলেন। মার ওই শুকনো মুখে হাসি ফুটে উঠল, মা আড়াল করতে পারেন না কোনও আনন্দ। চোখে ঠোঁটে গালে খুশির রেণু চিকচিক করে।

 

অবকাশে মার উপস্থিতি বাবা আড়চোখে দেখেন। কোনও কথা বলেন না। কিন্তু মা ঠিকই বাবার ভাত টেবিলে সাজিয়ে রাখেন। বাবা যেভাবে সংসার চালাতে বলেন, আগের চেয়ে আরও নিপণু ভাবে সেই সংসার চালাতে থাকেন। ঘরের মেঝেগুলো ঝকঝকে, উঠোন তকতকে। বাবার ঘরটি আলোময়, পরিচ্ছত। আলনায় কাপড় ধোয়া, গোছানো। বিছানায় পরিষ্কার চাদর। রাতে বাবা বাড়ি ফেরার আগেই বাবার বিছানা মশারি টাঙিয়ে তৈরি করে রাখা। আমাদের চুল বাঁধা, চুলে ফিতের ফুল বাধাঁ। ক্ষিধে লাগার আগেই আমাদের খাওয়ানো, পানি চাইতেই পানি দেওয়া। না চাইতেই ডাবের পানি, বেলের শরবত, ডাশা পেয়ারা, পাকা আম, জাম ভর্তা, ডালিমদানা হাতের কাছে, মুখের কাছে। মার উপস্থিতি আমাদের সবাইকে আরাম দিতে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *