০৮. নারী ও নীরবতা

নারী ও নীরবতা

এক

এই আলোচনাপত্রটি শুরু হচ্ছে আমাদের প্রথম সাহিত্য ঋগ্বেদ থেকে, যার আনুমানিক রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ১০০০-এর মধ্যে। ঋগ্বেদ-এ বেশ কয়েকজন নারী কবির নাম জানা যায়— ঘোষা, শাশ্বতী, রোমশা, লোপামুদ্রা, অপালা, বিশ্ববারা তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ঋগ্বেদে অস্তূণ ঋষির কন্যা বাক্ (অর্থাৎ বাণী) যাবতীয় প্রধান দেবতাদের যথার্থ মূর্ত রূপ হিসেবে আত্মপরিচয় ঘোষণা করতে অগ্রণী হয়েছিলেন। সংক্ষেপে বললে বেদান্ত দর্শনের ভিত্তিভূমিতে যে সোহম্ (অর্থাৎ, আমিই সেই) তত্ত্ব আছে, তিনি তাই উচ্চারণ করেন। তবু সামাজিক মর্যাদায় তাঁর স্থান অধস্তন; সামাজিক ভাবে যাঁরা ঊর্ধ্বতন, বিশেষত পুরুষ, তাঁদের সামনে তাঁর মুখ খোলা অনুচিত। তাঁর অবদান অনাদৃত থেকে গেছে। তাহলে, এক সময় কিছু মহিলা যথেষ্ট সরব ছিলেন এবং পুরুষরা কোনও কুণ্ঠা না করেই নারী কবি হিসেবে তাঁদের নাম রক্ষা করেছেন। তবু সভা-সমিতিতে উপস্থিত হওয়ার দস্তুর মেয়েদের ছিল না, সমাজকল্যাণ সংক্রান্ত কোনও আলোচনায় যোগদান করার ক্ষেত্রেও একই কথা।

খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দী থেকে পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে ব্রাহ্মণ সাহিত্যের যুগে অবশ্য কোনও সৃজনশীল কাজে মেয়েদের সম্বন্ধে কিছু শুনতে পাওয়া যায় না। তিনি ছিলেন যজমানের পত্নী হিসেবে তাঁকে সাহায্য করতে এবং সম্ভবত কিছু তুচ্ছ কাজে অংশ নিতে। এরই মধ্যে উপনয়নের অধিকার তিনি হারিয়েছেন এবং তার ফলে বৈদিক শাস্ত্র জ্ঞান থেকেই বঞ্চিত হয়েছেন। সুতরাং যজ্ঞে নারীর ভূমিকা নিতান্ত নীরব। যদিও কোনও কোনও ব্রাহ্মণ গ্রন্থে পত্নীকে যজ্ঞের পশ্চার্ধ (অবশ্যই পতি এই সঙ্গে পূর্বার্ধ বলে চিহ্নিত) বলা হয়। তাঁকে অর্ধেক বলার কারণ হল এই যে যতদিন পত্নী না থাকে সন্তানলাভও ঘটে না।[৩] সুতরাং পত্নীর আসল উপযোগ সন্তান প্রসব করায়। সোমযাগের অগ্নিপত্নীবত অনুষ্ঠানে একটা লাঠি দিয়ে -তে আঘাত করা হত। লাঠিটি যেন বজ্র আর এই ভাবে দেবতারা তাঁদের পত্নীদের দুর্বল করে দিতেন যাতে আপন শরীরের কিংবা উত্তরাধিকারের উপর পত্নীদের কোনও অধিকার না থাকে।[৪] সুতরাং মারধর করলেও পত্নী নিষ্ক্রিয়, নীরব, কেননা এহেন মারধর যজ্ঞ-অনুমোদিত। সেই পতি আরও নিচু গলায় মন্ত্র আবৃত্তি করবে যাতে তার কোনও ক্রমে উৎসাহে উজ্জীবিত না হতে পারে। কিন্তু যজ্ঞে, যেমন বরুণপ্রঘাস অনুষ্ঠানে পত্নী কোনও কথা বলবেন না। যজ্ঞ শুরু করার সময় পুরোহিত প্রকাশ্য সমাবেশে যজমানপত্নীকে শুধাবেন— কারও সঙ্গে অবৈধ যৌন সম্পর্ক তিনি করেছেন কিনা। তাঁকে এ কথার জবাব দিতেই হবে, না হলে দুর্দৈব নেমে আসবে। যিনি স্বীকার করলেন, তাঁর পাপের মাত্রা কমে যাবে।[৫] তাঁর স্বামীকে কিন্তু কদাচ এমন কথা জিজ্ঞাসা করা হয় না, আসলে কোনও পুরুষকে কদাচ এমন অবমাননাকর প্রশ্ন করা যায় না। একটি ব্রাহ্মণ-সন্দর্ভে বলা আছে— নারীকে আলাদা করে রাখতে হবে, না হলে তার শক্তিক্ষয় ঘটবে।[৬] জিজ্ঞাসা করা চলে— বিচ্ছিন্ন করে রাখলেই শুধু রক্ষা পায়, কি এমন সেই শক্তিটি?

উপনিষদ-এ মেয়েরা কদাচিৎ কথা বলেছেন, তাঁর স্বামী দুই স্ত্রীর মধ্যে যা বাঁটোয়ারা করে দিতে চাইছিলেন, মৈত্রেয়ী সেই ঐহিক সম্পদের বিশেষ পরোয়া করেননি। স্বামী তাঁকে তখন আধ্যাত্ম-উপদেশ দেন, কিন্তু সারাক্ষণ নীরব নিষ্ক্রিয় শ্রোতা হয়েই ছিলেন মৈত্রেয়ী।

দুই

যাজ্ঞবল্ক্য নামে পরিচিত এই একই স্বামী অন্যত্র বলছেন কীভাবে স্বামীর শয্যায় আসতে নারাজ স্ত্রীকে রাজি করানোর জন্য মারধর পর্যন্ত করতে হবে।[৮] এও আর এক অপমান ও আঘাতের নীরব পাত্র হওয়া। আধ্যাত্মিক বিতর্কে পুরোপুরি কোনঠাসা না করা পর্যন্ত যাজ্ঞবল্ক্যকে চ্যালেঞ্জ করার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন গার্গী। যাজ্ঞবল্ক্য তখন বলে বসলেন, ‘আর কথা বাড়িও না, গার্গী, না হলে তোমার মাথা খসে পড়বে।[৯] এখানেও নারীকে নীরব হতে বলা হল। সুলভা নামে এক বর্ষীয়সী নারী এসেছিলেন যাজ্ঞবল্ক্যের সঙ্গে আধ্যাত্ম আলোচনা করতে। তাঁর চরিত্র, যৌন মতলব ও উদ্দেশ্য নিয়ে যাজ্ঞবল্ক্য এমন অপমানকর ইঙ্গিত করেন যে ওই মহিলা স্থানত্যাগ করেন। একজন নারীবিদ্বেষীর হাতে অন্যায় কৌশলে এই ভাবে সুলভাকে নীরব হতে হয়েছিল।[১০]

সুতরাং সমাজ নারীদের কাছে এটাই আশা করেছিল যে, তাঁরা উচ্চ চিন্তাভাবনার বিষয়গুলো পুরুষদের হাতে ছেড়ে দিয়ে সাংসারিক কাজকর্ম পালন ছাড়া অন্যত্র নীরব থাকবেন। এক মহিলার গল্প আছে যেখানে, জনৈক গন্ধর্ব তার ওপর ভর করায় তিনি খুব কথা বলতেন।[১১] তিনি খুব বেশি কথা বলতেন বটে, কিন্তু আসলে তাঁর মুখ দিয়ে পুরুষ গন্ধর্বটিই কথা বলত। আর এক মহিলার উল্লেখ পাই, যিনি ভয়ানক দুর্ভিক্ষের সময় তাঁর অতিস্বল্প খাদ্যভাগ থেকে স্বামীর জন্য খাবার বাঁচাতেন এবং খুব কম কথা বলে স্বামীকে তা দিতেন। যখনই দরকার, তখনই নারীকে পুরুষের সেবা করতে হবে, কিন্তু কথা বলা চলবে না; সেবা নীরবে হওয়া চাই।

মহাকাব্যের যুগের আগে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী নাগাদ রচিত পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণে প্রত্যয়যোগে শব্দ নিষ্পাদনের এমন কিছু সূত্র যাতে নারী শিক্ষিকার অর্থ অনুধাবন করা যায়। যেমন, নিজে শিক্ষিকা অর্থে আচার্যা, নিজে উপাধ্যায়া অর্থে উপাধ্যায়া; উপাধ্যায়ের পত্নী উপাধ্যায়ানী, আচার্যের পত্নী আচার্যানী। বিস্ময় জাগে, নারীদের যদি উপনয়ন সংস্কার সহ বিদ্যারম্ভ না হত, তাহলে তাঁরা শাস্ত্র শিখতেন কী ভাবে, যাতে শিক্ষয়িত্রী হিসেবে অন্যদের বিদ্যাদান করতেন? কোনও নারী শিক্ষাদান করছেন, এমন কোনও লিখিত প্রমাণ অবশ্য নেই। সম্মানীয় ব্যতিক্রম নিশ্চয় ছিল কিন্তু ব্যতিক্রম হিসেবেই আমরা যেন গণ্য করি। দেখতে হবে, সাধারণ ভাবে নারী মৌন পালন করতেন, কেননা তাঁদের মৌনভাবই সমাজ পছন্দ করত।

রামায়ণ, মহাভারত-এর মূল অংশে অবশ্য কিছু নারীচরিত্র আছে যাঁরা সরব থেকেছেন। অরণ্যবাসে রামের সঙ্গী হওয়ার জন্য অনুমতি পেতে সীতা তাঁর সঙ্গে বিতর্ক করেছিলেন।[১২] সাবিত্রী প্রকাশ্য রাজসভায় পিতার সঙ্গে বিতর্ক করেছিলেন— নিজের পছন্দ মতো স্বামী নির্বাচনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। শাল্বকে অম্বা ভালবাসতেন এবং তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভীষ্মের সঙ্গে অম্বা তর্ক করতেন।[১৩] তপস্যারত মুনি ঋষিদের প্রলোভিত করার সময় অপ্সরাদেরও খুবই বাক্‌পটু হতে দেখা যায়, কিন্তু তাঁরা তো আসলে পার্থিব বারাঙ্গনাদের প্রতিরূপ। নীতি প্রসঙ্গে দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে তর্ক করেছেন। সুতরাং মহাকাব্যের মূলভাগে এমন এক যুগের স্মৃতিচিহ্ন বিদ্যমান এখন পর্যন্ত নারীর প্রকাশ্যে ব্যক্তি হিসেবে কথা বলার অনুমোদন ছিল। কিন্তু মহাকাব্যের পরবর্তী কালে প্রক্ষিপ্ত অংশগুলিতেই দেখছি নারীর সামাজিক অধিকারগুলি নির্মম ভাবে সঙ্কুচিত হয়েছে এবং এই সব অধিকারের মধ্যে আছে কথা বলার মুখ্য অধিকার।[১৪] মহাকাব্যের কোনও কোনও নারীচরিত্র যাঁরা আগের পর্যায়ে যথেষ্ট সরব ছিলেন, এই পর্যায়ে তাঁরা পর্যন্ত নীরবে দীনহীন ভাবে পুরুষের অধীন হয়ে পড়েছেন।

যেমন, বনপর্বে সত্যভামা দ্রৌপদীকে জিজ্ঞাসা করেছেন, তিনি কী ভাবে তাঁর পাঁচজন স্বামীকে খুশি রাখেন। দ্রৌপদী অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে উত্তরে জানান— তিনি কদাচ বোন ও বিষয়ে পাঁচজনের কারও কথার বিরুদ্ধাচরণ করেন না।[১৫] ইনি সেই একই দ্রৌপদী যিনি তাঁর স্বামীদের আগে এক সময় ‘কাপুরুষ’, ‘ক্ষত্রিয় নামের অযোগ্য’ বলেছেন, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে যিনি ধর্মবিষয়ে বিতর্ক করেছেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে যিনি কৃষ্ণকে নিষ্ক্রিয়তার জন্য নিন্দা করেছেন। কিন্তু এই দ্রৌপদী যিনি সত্যভামার কথার উত্তর দিচ্ছেন, তিনি নারীর নীরবতার সমর্থক-প্রবক্তা, মহাভারত-এর প্রক্ষেপকারী ভার্গব কবিদের এক দুর্বল সৃষ্টিমাত্র। এই জন্য একটি ব্রাহ্মণ সন্দর্ভে আমরা বলতে দেখি, আদর্শ নারী যিনি তাঁর শাশুড়ি-ঠাকরুণকে কোনও গৃহকর্মে হাত দিতে হয় না, এবং ‘যিনি কখনও কথার উত্তর করেন না।’[১৬] এই এক মহাকাব্য অন্যত্র জোরের সঙ্গে বলেছে, শ্রেষ্ঠ নারীত্ব একজন সবচেয়ে নিকৃষ্ট পুরুষের চাইতেও খারাপ! আগের যুগে, আরণ্যক সাহিত্যে লেখা হয়েছিল, একজন শিক্ষিত নারী বস্তুত পুরুষ এবং উপার্জনশীল নারীও পুরুষতুল্য।[১৭] মহাভারত কিন্তু সেই নারীর প্রশংসা করেছে, যিনি তাঁর শাশুড়ি ঠাকুরণের সেবা করেন এবং তাঁর কথার ওপর কথা বলেন না।[১৮] সংঘে নারীদের যোগদানে বুদ্ধদেবের প্রতিবন্ধকতার কথা আমাদের নিশ্চয় মনে রাখতে হবে, যদিও পরে তিনি তা মেনে নেন। থেরী গাথাগুলি কবিদের কারও কারও সামাজিক ব্যর্থতার কথা বলে। তবে এমনকী বৌদ্ধ মতবাদের মধ্যেও নারীসমাজ ছিল নীরব ও পরাধীন, চাইকি পুরুষের পদানত। সংঘারামের ভিক্ষুদের জন্য নারীদের গৃহকর্ম করতে হত। এমনকী ভিক্ষুনীদেরও পর্যন্ত তাই করণীয় ছিল মহাভারত-এ রাজকন্যা মাধবীর গল্পের কথা তো এ বইয়ের অন্যত্র উল্লেখ করেছি, কী ভাবে আছে, তাঁর বাবা গালবের হাতে তাঁকে ধার দিয়েছিলেন, যাতে তিনজন রাজার হাতে পর্যায়ক্রমে তাঁকে পুত্র উৎপাদনে নিযুক্ত হতে হয়।[১৯] মেয়েটি নীরব অত্যাচারের শিকার হয়ে রইলেন।

বারললনাদের বাদ দিলে, মেয়েদের কথা খুব কমই কানে তোলা হয়েছে। তাই বারাঙ্গনারা সরকারি খরচে শিক্ষালাভ করতেন এবং সমাজে শিক্ষাপ্রাপ্ত নারী বলতে শুধু এঁরাই ছিলেন। পরবর্তী সাহিত্যে মেয়েদের বাল্যবিবাহ দেখা যায় এবং তারপর আর তাদের প্রসঙ্গ শোনা যায় না। এমনকী রাজরানিদেরও পরবর্তী সাহিত্যে এমন ভাবে পাওয়া যাচ্ছে যে, তাঁরা প্রায় কিছুই বলেন না, কিন্তু স্বামীদের বাক্যে ‘হ্যাঁ’ বলেন। কেউ কেউ কাঁদেন আর ভাগ্যকে দোষ দেন।

নাট্যসাহিতেও দেখি শ্রেষ্ঠ নায়িকারা খুবই কম কথা বলছেন এবং তাঁরা যে চুপচাপ থাকেন এটা তাঁদের অন্যতম গুণ। এটা হল গিয়ে লজ্জাশীলতা, যা নারীচরিত্রের মৌলিক সম্পদ। এ সাহিত্যে তর্কবিতর্ক দুর্লভ এবং মেয়েরা অংশ নিচ্ছেন এমন কথোপকথন, সামান্য কিছু ব্যতিক্রমী নাটক বাদ দিলে, আরও দুর্লভ।

এমনটা হল কেন? কেন আমরা কোনও আরিস্তোফানিসকে পেলাম না, যিনি মেয়েদের অসহযোগের ছবি আঁকতে পারেন, তা সে ঠাট্টা-মস্করার ছলে হলেও? কিংবা, অ্যাটিক কমেডির মতো কিছু, যেখানে মেয়েরা উদ্যোগ নেন, কথা বলেন, তর্ক-বিতর্ক করেন, ভয় দেখান এবং তুলনামূলক ভাবে সরব হন। গ্রিক মহাকাব্যেরও নাটকে মুখ্য নারীচরিত্রগুলি, তা সে দেবী বা মানুষী যাই হোন, স্পষ্ট ভাষায় তাঁদের মনের কথা বলেছেন। ভারতীয় নারীকে কেন এমন আড়ালে রাখা হল, কথা বলার ন্যূনতম সুযোগ পর্যন্ত দেওয়া হল না? তাঁকে এমন জায়গায় নামিয়ে দেওয়া হল, যাঁর কথা শোনা যায় না, কেননা বাক্ (অর্থাৎ বাণী) থাকেন দেহের গভীর অন্তরে।[২০] তাঁর সামাজিক অবস্থান তাঁকে দাসত্ব ও নীরবতার পর্যায়ে নিয়ে গেছে।

এর একটা কারণ তাঁদের সামাজিক অবনত মর্যাদা যা সমাজ শিক্ষালাভ ও তার ফলে স্বাধীন বৃত্তি অবলম্বন থেকে মেয়েদের বঞ্চিত রেখে সৃষ্টি করেছে। নারী-পুরুষ উভয়পক্ষ নারীর নীরবতা মেনেই নিয়েছিল। শিক্ষার অভাব তাঁদের জানার জগৎ কার্যকর ভাবে সঙ্কুচিত করেছে এবং আলাপ-আলোচনার সজীব বিষয় কেড়ে নিয়েছে। আর একটা কারণ হল পুরুষের ওপর মেয়েদের চূড়ান্ত অর্থনৈতিক নির্ভরতা, যার ফলে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস তাঁদের ছিল না। আমরা মনকে বোঝাই, মেয়েরা নিজেদের মধ্যে বেশ জোরে জোরে এবং যেটা মেয়েদের দোষ বলা হয়, বাচালের ভঙ্গিতে কথা বলতেন। কিন্তু বাইরের সমাজ দেখতে চাইত, মেয়েরা সম্পূর্ণ বশীভূত এবং নীরব থাকবেন। এই জন্য, যেটা আদর্শ ভাবা হয়েছে সেই ভাবে নীরব নারীর ছবি ওঁরা এঁকেছেন।

সমাজে নারীর প্রতি উপেক্ষা ছিল অত্যন্ত তীব্র। এতটাই যে নারী আপন অন্তরে এই অন্যায় সামাজিক বিধান মেনে সত্যিই বিশ্বাস করতেন যে তাঁদের যেন কেউ না শুনে ফেলে। যেমন, খনা আপাতদৃষ্টিতে সমাধানের অতীত একটি গাণিতিক সমস্যার সমাধান করেন। রাজা বিক্রমাদিত্য এতটাই খুশি হলেন যে, তিনি তাঁকে রাজসভায় দশম রত্ন গণ্য করতে চাইলেন। কিন্তু খনার স্বামী বরাহমিহির তাঁর জিভ কেটে দিয়ে সত্যি সত্যি তাঁকে বাক্যহীনা করে দিলেন, যাতে তিনি তাঁর গুণের জন্য আর প্রশংসা না পান। এই ঘটনাটি সর্বকালের জন্য একটি প্রতীকী তাৎপর্য পেয়েছে। মেয়েরা দর্শনীয় হলেও তাঁদের নির্বাক হওয়া চাই। মেয়েরা নিজেরাই সমাজের এই ইচ্ছা অন্তরে বুঝেছিলেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন এবং মানতেন যে মর্যাদায় তাঁরা নিচু; তাঁরা পুরুষের সামনে কথা বলা অস্বাভাবিক ও অমর্যাদাকর ভাবতেন। অবশ্য সাহিত্যের বৃহদংশ সম্পন্ন সমাজের নারীর চিত্রই এঁকেছে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যাঁরা নিম্ন পর্যায়ের, সেখানে মেয়েদের নিশ্চয় আর একটু সরব থাকার কথা। উচ্চবর্গের বিধিনিষেধ সেখানে চালু না থাকাই স্বাভাবিক।

এ থেকে একটা মৌলিক প্রশ্ন আমাদের মনে জাগে: শব্দ কী, প্রাচীন মানুষের কাছে তার মূল্য কী ছিল? বেদের গল্পের পর গল্পে বলা হচ্ছে, শব্দ নাকি আধ্যাত্মিক শক্তিতে ভরপুর। বর কিংবা অভিশাপ হিসেবে তা অবিনাশী। শক্তিমান এবং অপরিবর্তনীয়। ঋগ্বেদের ঋষি এমন শব্দ উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু, তার পরই নারীর উপনয়ন সংস্কার বাদ পড়ল, আধ্যাত্মিক তাৎপর্যে মণ্ডিত বাক্য উচ্চারণ থেকে তাঁরা বঞ্চিত হলেন, বিবাহ ও স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের সেবাকেই শিক্ষার সঙ্গে সমান গণ্য করা হল।[২১] এই ভাবে মেয়েদের আরও পিছনে সরিয়ে দেওয়া হল। অথর্ববেদের একটি মন্ত্র বলছে, দিন শুরু হলে নক্ষত্রেরা যেমন আলো থেকে দূরে সরে যায়, তেমনই শ্বশুরের কাছ থেকে বধূরা পালান।[২২]

তবু, ঋগ্বেদ-এর বাক্, এবং ভারতী এবং আরও পরে সরস্বতী স্বয়ং বাগদেবী!

পরবর্তী সাহিত্যে যে সব দেবীরা কথা বলেন, অভিশাপ দেন কিংবা আশীর্বাদ করেন, তাঁদের কল্পনা সমাজে আসলে বাক্যহীনা বৃহৎ নারীগোষ্ঠীর দুর্দশার ক্ষতিপূরণ। নারীর বাক্য যেটুকু আমরা পাই তা গোঁড়া মতাদর্শের কাছে ভয়ানক, দ্রৌপদী, গান্ধারী, সীতা, দময়ন্তী, গার্গী, অম্বা, শকুন্তলা ও অন্যান্যরা যাঁরাই কথা বলেছেন, ভয় দেখিয়েছেন, চ্যালেঞ্জ করেছেন, তাঁরাই ক্ষতিপূরণের পদ্ধতিতে, প্রতীকী পন্থায় নতুন দেবসমাজে অঙ্গীভূত হয়েছেন। তাঁরা বেশির ভাগ দৈব অধিকারে বলীয়সী দেবী হয়ে উঠেছেন।

যেখানেই প্রতিবাদ উঠেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীর সাফল্য হয়নি বললেই চলে। কে প্রতিবাদ করতে পারেন? নারীকে চুপ করাতে সফল হয়েছে সমাজ। যদি বা তাঁরা কিছু বলেছেন, শক্তিমানের আসন পর্যন্ত তা কখনও পৌঁছয়নি, তাঁদের কণ্ঠস্বর এমনকী নির্বিচারে উপেক্ষা করা হয়েছে। এই ভাবে সমাজ সরব নারীদের দমন করার ব্যবস্থা নিয়েছে। পুরাণে ও সাহিত্যিক প্রমাণে প্রায়শ এমন সব জো-হুজুর নারীচরিত্র উপস্থাপিত হয়েছে যাঁরা তাঁদের জীবন ও আচরণ সম্বন্ধে পুরুষের নির্দেশিকা মেনে চলেন, কদাচ প্রশ্ন তোলেন না এবং পতিব্রতা ও সতী হিসেবে নিজেকে বড় প্রমাণ করার জন্য পরস্পর প্রতিযোগিতায় মাতেন— চিন্তাশীল হিসেবে কিংবা সামাজিক মূল্যাবোধের বিচারক হিসেবে নয়। জনতার অর্ধেককে এই ভাবে নির্বাক নিষ্ক্রিয় দর্শকে অবনমিত করার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সমাজ আখেরে হারিয়েছে অনেক কিছু। কেননা, দুটি মস্তিষ্ক সব সময়ে একটির চেয়ে ভাল। নারীর ওপর নীরবতা চাপিয়ে দেওয়ার ফলে নিঃসন্দেহে সমাজের অধোগতি ত্বরান্বিত হয়েছে, বিশেষত খ্রিস্টিয় পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে। নারীদের সম্বন্ধে সমাজের নীরবতা এবং নারীর ওপর নীরবতা চাপানোর কুফল হিসেবে, সমাজে নারীর নীরবতা এই ভাবে একটা চরম অভিশাপ হয়ে উঠেছিল।

***

সূত্রাবলি

১. ঋগ্বেদ ১০:১২৫

২. মৈত্রায়নী সংহিতা ৪:৭:৪

৩. তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬:১:৮:৫

৪. প্রাগুক্ত ৬:৫:৮:২; শতপথব্রাহ্মণ ৪:৪:২:১৩

৫. তৈত্তিরীয় সংহিতা ২:৫:২:২০

৬. শতপথব্রাহ্মণ ১৪:১:১:১১

৭. বৌধায়ন ৩:৬:১

৮. প্রাগুক্ত ৫:৪:৭

৯. প্রাগুক্ত ৩:৬:১৭

১০. মহাভারত ১২:৩২০

১১. বৌধায়ন ধর্মসূত্র ৩:৩:১২

১২. রামায়ণ ২:২:২১, ২৮, ৩৫, ৩৬, ৩০, ২০, ২১

১৩. মহাভারত ১:৯৬:৪৭:৪৮

১৪. প্রাগুক্ত ৩:২৭, ৩০, ৩২, ৩৭

১৫. প্রাগুক্ত ৩:২২২:২৮-৩৩

১৬. ঐতরেয়ব্রাহ্মণ ৩:২৪:২৭; আপাস্তম্ব ধর্মসূত্র ১:১০:৫১-৫৩-তে বিষয়টির পুনরাবৃত্তি মেলে।

১৭. তৈত্তিরীয় আরণ্যক ১:১১:৪

১৮. মহাভারত 2:227:36; ১৩:১৩:১৩১

১৯. প্রাগুক্ত ৫:১১৮-২২

২০. ঋগ্বেদ ১:৬৭:৩

২১. মনুসংহিতা ২:৬৭

২২. অথর্ববেদ ৮:৬:২৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *