নারীজাতির ঐতিহাসিক মহাপরাজয়
দ্য বোভোয়ার বলেছেন নারী মনুষ্যপ্ৰজাতির শিকার; পুরুষ তার শরীরকে অতিক্রম ক’রে গেছে, কিন্তু নারী পশুর মতো, শুধু জন্ম দেয়াই যার একান্ত ধর্ম, বন্দী হয়ে রয়েছে নিজের শরীরের শেকলে। নারী পরাভূত হয়েছে : মনুষ্যপ্ৰজাতির পরাজিত লিঙ্গের নাম নারী। নারী তার শরীরমনে বয়ে চলছে। ওই পরাজয়; বিজয়ী পুরুষকে অভিবাদন জানিয়ে, তার সামনে নত থেকে, শুরু ও শেষ হয় তার জীবন। নারী পরাজিত হয় পুরুষের কাছে, নারী তন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটে। পিতৃ-বা পুরুষ-তন্ত্রের রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে। নারীর পরাজয়ের তত্ত্ব রচনা করেছেন অনেকে : চেরানিশেভঙ্কি [কী করণীয়?] মিল [নারী-অধীনতা], বেবেল [নারী ও সমাজতন্ত্ৰ], ভেবলেন [সুবিধাভোগী শ্রেণীর তত্ত্ব] প্রমুখ, তবে এঙ্গেলস লেখেন সবচেয়ে বিপ্লবাত্মক রচনাটি, যার নাম ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ (১৮৮৪)। এঙ্গেলস এটি লিখেছিলেন হেনরি মর্গানের ‘আদিম সমাজ’ (১৮৭৭) ও বাখোফেনের ‘মাতৃ-অধিকার’ (১৮৬১) অবলম্বনে, কিন্তু তিনি এতে পেশ করেন পিতৃতন্ত্রের ইতিহাস ও অর্থনীতির এক সংহত বিবরণ; এবং একমাত্র তিনিই আক্রমণ করেন পিতৃতন্ত্রের বহুনন্দিত একটি সংস্থাকে, যাকে বলা হয় পরিবার। পিতৃতন্ত্রবাদীরা বিশ্বাস করেন পিতৃতন্ত্র ও পরিবারসংস্থা মানুষের সমাজসংস্থাগুলোর মধ্যে অনাদি; তাঁরা মনে করেন এগুলোর উদ্ভব ঘটেছিলো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় পুরুষের জৈবিক শক্তি ও সহজাত প্রাধান্য ভিত্তি করে। যেনো এটিই বিধির স্বর্গীয় বিধান। তাঁরা মনে করেন দেহই নারীর নিয়তি; তার শারীরিক অশক্তি, ঋতুস্রাব, গর্ভ ও প্রসব তাকে বাধ্য করে পরাজিত লিঙ্গে পরিণত হ’তে।
নারীবাদীদেরও অনেকে দ্বিধাভরে মেনে নিয়েছেন একথা; যেমন দ্য বোভোয়ার দ্বিতীয় লিঙ্গ-এ নারীর অশক্তির, মনুষ্যপ্ৰজাতির শিকার হওয়ার, দিয়েছেন বিশদ বিবরণ; কিন্তু কেইট মিলেট (১৯৬৯, ১০৯) এটা মেনে নেন নি। মিলেটের মতে সামাজিক রাজনীতিক সংস্থা দেহবল ভিত্তি ক’রে গ’ড়ে ওঠে না, গ’ড়ে ওঠে সমাজের মূল্যবোধ ও উৎপাদন পদ্ধতি ভিত্তি করে। পিতৃতন্ত্র একটি সংস্থা; মানুষের বিকাশের বিশেষ সময়ে এর উদ্ভব ঘটে, উদ্ভবের পেছনে রয়েছে বিশেষ পরিস্থিতি। তার উদ্ভবের প্রক্রিয়া আজ পুরোপুরি জানা না গেলেও সে-সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব। অনেকেই মনে করেন পিতৃতন্ত্রের আগে ছিলো অন্য কোনো তন্ত্র। ম্যাথিয়াস ও ম্যাথিলডা ভ্যারটুং [আধিপত্যশীল লিঙ্গ, ১৯২৩] মনে করেন পিতৃতন্ত্রের আগে ছিলো মাতৃতন্ত্র বা নারীতন্ত্র, যেখানে নারীরাই ছিলো আধিপত্যশীল, যেমন পিতৃতন্ত্রে আধিপত্যশীল পুরুষেরা; আর বাখোফেন [মাতৃ-অধিকার, ১৮৬১], ম্যাকলেনন [আদিম বিবাহ, ১৮৭৫l, মর্গান [আদিম সমাজ, ১৮৭৭), ব্ৰিফল্ট [মাতারা, ১৯২৭) মনে করেন পিতৃতন্ত্রের আগে ঠিক মাতৃতন্ত্র না থাকলেও তার মতোই কিছু একটা ছিলো। সেখানে হয়তো সামাজিক আর ধর্মীয় এলাকায় প্রধান মূল্য পেতো মাতৃ-অধিকার, বা নারীনীতি, বা নারীর উর্বরতা। পিতৃতন্ত্রবাদীরা এটা মানতে রাজি নন; তাঁরা মনে করেন বর্তমান ও ঐতিহাসিক কালটি সম্পূর্ণরূপে পিতৃতন্ত্রের; শুধু তাই নয়, তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস প্রাগৈতিহাসিক কালটিও পিতৃতন্ত্রের, এবং বিপুল ভবিষ্যৎও থাকবে পুরুষতন্ত্রের অধিকারে। নারীবাদীরা অস্বীকার করেন দাবি; তাঁরা মনে করেন না যে পিতৃতন্ত্র অনাদি ও শাশ্বত; তাঁদের মতে পিতৃতন্ত্রের আগামী বিপুল ভবিষ্যৎ জুড়ে টিকে থাকার কোনো জৈবিক সামাজিক কারণ বা প্রয়োজন নেই। আজ যা আছে, তাকে সনাতন শাশ্বত ভাবা হাস্যকর।
পিতৃতন্ত্র মানুষের ইতিহাসের একটি পর্বমাত্র; তাই তার সমাপ্তি ঘটে শুরু হতে পারে নরনারীর সম্পর্কের আরেক, ও উন্নত, পর্ব। জন স্টুয়ার্ট মিল উদার মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে লিখেছিলেন নারী-অধীনতা (১৮৬৯) নামে একটি প্রভাবশালী বই। স্টুয়ার্ট মিল ধ’রে নিয়েছিলেন নারীজাতির অধীনতা ঘটেছে পুরুষের বলপ্রয়োগের বিশ্বজনীন নীতিতে, তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে নারীজাতির অধীনতা দূর হবে প্রগতি ও নৈতিকতার ক্রমাগ্রগতির ফলে। তাঁর বিশ্বাস ছিলো মানুষের প্রগতি ও নৈতিকতার অগ্রগতি অবধারিত, কেননা মানুষ আর পেছনের দিকে যেতে পারে না। এঙ্গেলস মানুষের ওপর পোষণ করতে পারেন নি এতোটা আস্থা। মিলের মতো তিনি এমন আশাবাদ পুষতে পারেন নি যে মানবসমাজ প্রগতিশীল থেকে প্রগতিশীলতর হবেই, কেননা প্ৰগতিশীল আদিম সাম্যবাদের পর প্রতিক্রিয়াশীল দাসপ্রথার আবির্ভাব তিনি দেখেছেন। বিপ্লবী ছিলেন তিনি; তাই তার পক্ষে কোনো সংস্থার জৈবিক উদ্ভবতত্ত্বে বিশ্বাস করাও ছিলো অসম্ভব। তাঁর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে সংস্থামাত্রেই মানুষের তৈরি। তাই বদলে দেয়া যেতে পারে যে-কোনো সংস্থাকে, এমনকি দরকার হ’লে তাকে হঠাৎ প্ৰচণ্ড বিপ্লবাত্মক প্রক্রিয়ায়ও উচ্ছেদ করা সম্ভব। তিনি দেখেন যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ও সম্পত্তির মধ্যে; সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানা ও নারীর অধীনতার ভিত্তির ওপরই স্থাপিত পিতৃতন্ত্র। তাই পিতৃতন্ত্র ও পরিবার দাঁড়িয়ে আছে শোষণের ওপর; মানুষের একটি লিঙ্গ শোষণ করছে আরেকটি লিঙ্গকে–নারীশোষণের মহত্তম যন্ত্রটির নাম পিতৃতন্ত্র। তিনি অনুরক্ত ছিলেন বাখোফেনের মাতৃ-অধিকার গ্রন্থে প্রস্তাবিত তত্ত্বের প্রতি : মাতৃ-অধিকারে এঙ্গেলস দেখতে পান এক ধরনের আদিম সাম্যবাদ, যেখানে ছিলো না কোনো ব্যক্তিমালিকানা। পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে একরাশ সামাজিক রোগ নিয়ে; দেখা দেয় সম্পত্তির ব্যক্তিগত অধিকার, নারী-অধীনতা ও দাসপ্রথা, সমাজ ভাগ হয়ে যায় নানা শ্রেণী ও বর্ণে, দেখা দেয় শাসক ও সম্পত্তিশীল শ্রেণী, শুরু হয়। সম্পত্তির অসম বণ্টন, এবং শেষে শোষণের নির্মম বিকট যন্ত্ররূপে দেখা দেয় রাষ্ট্র। এঙ্গেলস বাখোফেন ও মর্গানের সাথে নিজের সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বের সমন্বয় ক’রে রচনা করেন সমাজবিবর্তনের এক বিশ্বজনীন ইতিহাস, যাতে তিনি নির্দেশ করেন কীভাবে উদ্ভূত হয় পরিবার, বিভিন্ন সমাজসংস্থা; মানুষ কীভাবে সম্পদ উৎপাদনের জন্যে হাতিয়ার তৈরি করে, কৃষিকাজ শুরু করে, ব্যবসায়ী হয়, এবং শেষে হয় শিল্পপতি। পরিবারের ইতিহাসকে তিনি ভাগ করেন। কয়েকটি স্তরে; দেখান কীভাবে মাতৃতন্ত্র বা মাতৃ-অধিকারের স্তর থেকে নির্বিচার বা মুক্ত যৌনসম্পর্ক, সমষ্টি বিয়ে, জোড়বাধা বিয়ে, একরক্তেরসম্পর্কের বিয়ে, পুনালুয়া বিয়ে প্রভৃতি থেকে উদ্ভূত হয় পিতৃতান্ত্রিক ও একপতিপত্নী বিয়ে (বা একপতিবহুপত্নী বিয়ে), এবং নারী হয়ে ওঠে পুরুষের সম্ভোগসামগ্ৰী ও পরিচারিকা।
মানুষের ইতিহাসের প্রথমে আরণ্যপর্ব, তারপর বর্বরতার পর্ব, এবং তারপর ও এখন সভ্যতার পর্ব। আরণ্যপর্বে মানুষ ছিলো অরণ্যের সন্তান; মানুষ তখন প্রকৃতি থেকে আহরণ করেছে তার অবিলম্বে ব্যবহার্য সম্পদগুলো, যা তাকে বঁচিয়ে রেখেছে। হাতিযার বলতে কিছুই তার ছিলো না, বা ছিলো সে-সব যা তাকে সাহায্য করেছে প্রকৃতি থেকে ফলমূল আহরণে। এ-সময় নারীর অবস্থা কেমন ছিলো, তা নিশ্চিত জানার উপায় নেই। নারীকে নিশ্চয়ই তখন করতে হতো নানা কঠিন কাজ; স্থান থেকে স্থানান্তরে যাওয়ার সময় ভারবহনের ভারটা হয়তো পড়তো তখন নারীরই ওপর, কেননা পুরুষকে নিজের হাত দুটি মুক্ত রাখতে হতো পশুর আক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচাতে। অর্থাৎ নারী ভার বইতো, কিন্তু পুরুষ করতো আরো ভয়ঙ্কর কাজ। তবে ওই নারীরা আজকের বুর্জোয়া নারীদের মতো ভঙ্গুর ছিলো না। কিন্তু তারা বাঁধা ছিলো ঋতুস্ৰাব, গৰ্ভধারণ ও প্রসবের জৈব শেকলে, যা তাদের তখনো করে রেখেছিলো বিরূপ বিশ্বে অসহায়। তাই অন্ন ও আশ্রয়ের জন্যে তাদের নির্ভর করতেই হতো মুক্ত পুরুষের ওপর। নারী পুরুষের মতো সৃষ্টি বা উদ্ভাবন করে নি, সে গর্ভবতী হয়েছে ও প্রসব করেছে। গৰ্ভ ও প্রসব কোনো কাজ নয়, তা জৈব ব্যাপার; তাই নারীকে আত্মসমৰ্পণ করতে হয়েছে নিজেরই জৈবনিয়তির কাছে। পুরুষ গেছে ভিন্ন পথে; সে তার জৈব ও পাশব স্বভাব পেরিয়ে হয়ে উঠেছে স্রষ্টা বা উদ্ভাবক। আদিম মানুষ মর্যাদাসম্পন্ন হয়েছে আরেক কারণে, তার পৌরুষ বা বীরত্বের জন্যে। সে বেছে নিয়েছে বিপজ্জনক কাজ: সে শিকার করেছে, ভয়ঙ্কর জন্তুদের সাথে লড়াই ক’রে বিপন্ন করেছে জীবন, এবং পরেছে জয়মাল্য। পুরুষ শোষক, স্বার্থপরায়ণ, পীড়ক, কিন্তু শক্তিমান; আর শক্তির কাছে গৌণ হয়ে যায় অন্য সব কিছু। নারী জীবন সৃষ্টি করে, এটা মানুষকে রেখে দেয় পশুরই স্তরে : পুরুষ জীবন বিপন্ন করে, এটা মানুষকে পশুর পর্যায় থেকে উত্তীৰ্ণ করে মানুষের পর্যায়ে। নারী টিকিয়ে রেখেছে মানুষ প্রজাতিকে, আর পুরুষ বদলে দিয়েছে পৃথিবীকে; নারীর নিয়তি, অন্তত এখন পর্যন্ত, হয়ে রয়েছে জীবনের পুনরাবৃত্তি করা; কিন্তু জীবনের পুনরাবৃত্তি করে কেউ পৃথিবীর প্রভু হতে পারে না। জৈবিক ও আর্থ কারণে পুরুষ হয়েছে পৃথিবী ও নারীর প্রভু। আরণ্যপর্বে নরনারীর যৌনসম্পর্কের রীতি কী ছিলো? এ-পর্বে ছিলো নির্বিচার বা মুক্ত যৌনসম্পর্ক, যে-কোনো নারী মিলিত হতো। যে-কোনো পুরুষের সাথে। এটা মেনে নিতে অনেকের লজ্জা লাগতে পারে; কিন্তু আরণ্য মানুষ আজকের ভণ্ডামো আয়ত্ত করে ওঠে নি। এঙ্গেলস (১৮৮৪, ১৯১১) বলেছেন, ‘যদি কঠোর একপতিপত্নী বিধিই সর্বপ্রধান পুণ্য বলে মনে করা হয় তাহলে টোপওয়ার্মকেই শ্ৰেষ্ঠ মানতে হয়, কারণ তার পঞ্চাশ থেকে দু’শ খণ্ডে বিভক্ত শরীরের প্রত্যেকটি খণ্ডে একজোড়া পুরুষ ও স্ত্রী অঙ্গ আছে এবং সারা জীবন ধরে এই কৃমিকীট শরীরের প্ৰত্যেকটি খণ্ডে আত্মসঙ্গম করে কাটায়।‘ আরণ্য নরনারী টেপাওয়ার্ম ছিলো না; এবং ছিলো না তার উত্তরাধিকারীর মতো ভণ্ড।
মানুষের আরণ্যপর্বের পর আসে কৃষি বা বর্বরতার পর্ব। যাযাবর মানুষ স্থির হয় কোনো উর্বর অঞ্চলে, হয় কৃষক; এবং পশু হয় তার প্রধান সম্পদ, মানুষ হয় গোস্বামী। ভূমিকা বদলায় নারীরও। যাযাবর আরণ্য মানুষের ছিলো শুধু বর্তমান; কিন্তু কৃষিসমাজের মানুষের বর্তমান তো রয়েছেই, রয়েছে অতীত ও ভবিষ্যৎ। তার কাছে উর্বরতা দেখা দেয় একটি বড়ো বিস্ময়রূপে। কৃষক অনুভব করে নারী ও জমি একই প্রকৃতির, উভয়ই উর্বর; চাষ করলে উভয়ই সোনা ফলায়। কিন্তু সম্পূর্ণটা তখনো বুঝে উঠতে পারে নি। তারা, নারী ও জমিতে দেখেছে তারা ইন্দ্ৰজাল, যেনো কোনো অলৌকিক যাদুতে নারী হয় সন্তানবতী, জমি ফসলভারাবনত। এ-সময় সন্তান ও ফসলের দায়িত্বও ছিলো নারীর;–নারী শুধু সন্তান ধারণ করতো না, চাষের কাজও করতো। তাই তার মূল্য ছিলো, গৌরব ছিলো। এ-সময়ই দিকেদিকে দেখা দেয় উর্বরতার মহাদেবী: —মহামাতা, যে জীবন দেয়, জীবন হরণ করে, আবার পুনর্জীবন দেয়। ব্যাবিলোনিয়ায় তার নাম ইশতার, সেমেটীয় অঞ্চলে আসতারতে, গ্রিকদের সে রিঅ্যা, মিশরীয়দের আইসিস। এ-সময়ে নারীপুরুষের যৌনসম্পর্কের কয়েকটি রূপ দেখা দেয়, উন্মেষ ঘটে পরিবারের আদিরূপটির। পরিবারের আদি রূপটি হচ্ছে একরক্তসম্পর্কের পরিবার। একরক্ত পরিবারে বিয়ে হতো প্ৰজন্মক্রমে : পিতামহ ও পিতামহী পরস্পরের ভাইবোন ও স্বামীস্ত্রী, তাদের পুত্রকন্যারা একে-অন্যের ভাইবোন ও স্বামীস্ত্রী, তাদের পুত্রকন্যারা ভাইবোন ও স্বামীস্ত্রী। ক্রমে নিষিদ্ধ হয় একরক্তসম্পর্কিতদের মধ্যে বিয়ে, উদ্ভূত হয় এমন একধরনের পরিবার, মর্গান ও এঙ্গেলস যাকে বলেছেন ‘পুনালুয়া পরিবার’। পুনালুয়া পরিবারে আপনি বা সমান্তরবর্তী কজন বোন হতো তাদের সাধারণ স্বামীদের সাধারণ স্ত্রী, বাদ পড়তো তাদের ভাইয়েরা। এ-পরিবারে স্বামীরা পরস্পরের ভাই হতো না, তারা হতো একে-অন্যের ঘনিষ্ঠ সাথী বা পুনালুয়া। ঠিক একইভাবে একদল আপনি বা সমান্তরবর্তী ভাইয়েরা মিলিতভাবে বিয়ে করতো একদল নারীকে, এবং স্ত্রীরা হতো একে-অন্যের সাখী। এটা ছিলো সমষ্টি বিয়ে, যা থেকে উৎপত্তি হয়েছিলো গোত্রের।
সমষ্টি বিয়ের পরিবারে বাপের ঠিক ছিলো না, কিন্তু মা ছিলো সুনিশ্চিত। সমষ্টি মায়েররা পরিবারের সব সন্তানকেই নিজের সন্তান মনে করতো, তবে নিজের পেটের সন্তানদের চিনতো পৃথক করে। সমষ্টি বিয়েতে শুধু মায়ের দিক থেকেই সম্ভব ছিলো বংশপরম্পরা ঠিক করা; তাই তাতে স্বীকৃতি পেতো শুধু মাতৃধারা। সমষ্টি বিয়ের কালে বা তারও আগে কিছু সময়ের জন্যে দেখা দিয়েছিলো জোড়বাধা পরিবার, যাতে বহু স্ত্রীর মধ্যে একটি পুরুষের থাকতো একটি মুখ্য স্ত্রী। আবার ওই পুরুষটি হতো ওই নারীর বহু পতির মধ্যে মুখ্য পতি। মহাভারতে বিয়ের প্রচলন সম্পর্কে একটি কাহিনী রয়েছে। শ্বেতকেতু তার পিতা উদালক ও মায়ের সাথে বসে ছিলো; এমন সময় এক ব্ৰাহ্মণ এসে শ্বেতকেতুর মাকে নিয়ে যায়। শ্বেতকেতু এর কারণ জানতে চাইলে তার পিতা তাকে জানায় যে তার মায়ের ওপর তার একান্ত অধিকার নেই; যে-কেউ তার মাকে নিয়ে ভোগ করতে পারে। এ-উপাখ্যান নির্দেশ করে সম্ভবত জোড়বাধা পরিবার। এর আগে পুরুষের জন্যে নারীর অভাব ঘটতো না, কারণ তখনো রক্তসম্পর্কিতদের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ হয় নি, তাই প্রচুর নারী পাওয়া যেতো বিয়ের জন্যে; কিন্তু এখন নারী দুষ্পপ্ৰাপ্য হয়ে ওঠে। নারীর অভাবে জোড়বাধা বিয়ের সাথেসাথে শুরু হয় নারীহরণ ও নারীকেনা। জোড়বাঁধা বিয়ে ছিলো অস্থায়ী ও দুর্বল; তাই এর ফলে আগের সাম্যতন্ত্রী গৃহস্থালি ভেঙে যায় নি। সমষ্টি বিয়ের সাম্যতন্ত্রী পরিবারে ছিলো নারীদের আধিপত্য; কেননা তখন জনককে নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হতো না, তাই মা-ই ছিলো স্বীকৃত, পিতা তখনো স্বীকৃতি পায় নি। সমাজের সূচনাকালে নারীরা পুরুষের দাসী ছিলো না; আরণ্য ও বর্বর নারীরা ছিলো স্বাধীন ও সম্মানিত। সাম্যতন্ত্রী পরিবারে নারীরা বা বেশির ভাগ নারী হতো একই গোত্রের, পুরুষেবা বিভিন্ন গোত্রের; তাই আদিম যুগে ছিলো নারীর আধিপত্য। নারীরা তখন বিচ্ছিন্ন ছিলো না। শ্রম থেকে, শ্রমই তাদের সত্যিকার মর্যাদার আসনে বসাতো; তারা আধুনিক সুবিধাভোগী শ্রেণীর শ্রমবিচ্ছিন্ন নারীদের মতো আসার আরাম আর মর্যাদা ভোগ করতো না।
সমষ্টি বিয়েতে এক নারীর ছিলো বহু পতি, পরে তা একপতিতে সমাপ্তি পায়। পাতিব্ৰত্য এখন গুণ, কিন্তু একপতিতে সীমাবদ্ধ হওয়ার প্রথম দিকে পাতিব্ৰত্য হয়ে ওঠে নারীর অপরাধ; আর এ-অপরাধের জন্যে প্ৰায়শ্চিত্তও করতে হয় নারীদের। এটা নেয় নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে আত্মদানের রূপ, নারীদের বিশেষ সময়ের জন্যে স্বামী ছাড়া অন্যদের দান করতে হয় দেহ। ব্যাবিলনের নারীদের বছরে একবার দেহদান করতে হতো মিলিট্টার মন্দিরে, মধ্যপ্রাচ্যের নানা উপজাতির মেয়েদের কয়েক বছর দেহদানের জন্যে পাঠানো হতো আনাইটিসের মন্দিরে। পরে প্রাঃশ্চিত্তমূলক দেহদানের সময় কমানো হয়। বাখোফেন বলেছেন : বৎসরে একবার করে আত্মদানের বদলে মাত্র একবার আত্মদান চালু হয়, বিবাহিতা স্ত্রীলোকের হেটায়ারিজমের (গণিকাবৃত্তি) জায়গায় দেখা দেয় কুমারীদের হেটায়ারিজম, বিবাহিত অবস্থায় তার আচরণের বদলে বিবাহের পূর্বে আচরণ, সকলের কাছে নির্বিচারে আত্মদানের বদলে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির কাছে আত্মদান’ [দ্র এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২০৮)]। ভূমধ্যসাগর থেকে গঙ্গার কূল পর্যন্ত ধর্মের আবরণে, এবং কোনো কোনো জাতির মধ্যে ধর্মের আবরণ ছাড়াই চলে এ-প্রথা। পুরোনো দিনের থ্রেসিয়ান, কেল্টিক, ভারতের বহু আদিম অধিবাসী, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ ও আমেরিকার অনেক আদিবাসীদের মধ্যে মেয়েরা বিয়ের আগে ভোগ করতো প্রচুর যৌনস্বাধীনতা। কোনো কোনো জাতির মধ্যে বরের বন্ধু বা আত্মীয়রা বা বরযাত্রীরা বিয়ের রাতেই কনের দেহের ওপর খাটাতো নিজেদের সনাতন অধিকার, সবশেষে আসতো বরের পালা। পুরাকালে এর চল ছিলো বেলিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জে, ও আফ্রিকার অগিলাদের মধ্যে। কোনো কোনো জাতির মধ্যে কনের ওপর ‘প্রথম রাত্রির অধিকার’ উপভোগ করতো গোত্রপ্রধান, কাসিক, শামান, পুরোহিত, রাজপুত্র ইত্যাদি বরেণ্যরা। বাঙলায়ও একসময় ছিলো। এ-প্ৰথা, যার নাম গুরুপ্রসাদী; এতে গুরু বা পুরোহিত মোচন করতো বধুর কৌমাৰ্য। গুরুর প্রসাদগ্ৰহণ সম্পন্ন হওয়ার পর বরের ভাগ্যে জুটতো নববধুর দেহপ্রসাদ।
ক্রমে ক্রমে সম্পদ বাড়তে থাকে, আর সম্পদই শত্রু হয়ে দেখা দেয় নারীদের। পুরুষ যখন জমির মালিক হয়, সে তখন নারীর মালিকানাও দাবি করে। জমি আর নারী পুরুষের কাছে এক। আরণ্যপর্ব থেকে মানুষ যখন পৌঁছোয় কৃষিপর্বে তখন সম্পদশালী হয়ে ওঠে বিভিন্ন গোত্র। একসময় ওই সম্পদ অধিকারে চলে আসে গোত্রপতিদের; তারা হয়ে ওঠে সম্পদশালী। আগে, মাতৃ-অধিকার অনুযায়ী, গোত্রের কেউ মারা গেলে তার সম্পত্তি পেতো গোত্রভুক্তরা। সম্পদ যতো বাড়তে থাকে পরিবারে নারীদের থেকে গুরুত্ব বাড়তে থাকে পুরুষদের, এবং পুরুষেরা উদ্যোগ নেয় উত্তরাধিকারের সূত্র বদলানোর। পুরুষ মাতৃধারার প্রথা ভেঙে সৃষ্টি করে পিতৃধারার প্রথা। এটা এক বিপ্লব, কিন্তু এ-বিপ্লবে কোনো রক্তপাত ঘটে নি; নীরবেই সম্পন্ন হয়। পুরুষের অভ্যুত্থান। স্থির হয়। পুরুষের সন্তানসন্ততি হবে তার গোত্রভুক্ত, নারীর সন্তানেরা বাদ পড়বে গোত্র থেকে, অন্তর্ভুক্ত হবে পিতার গোত্রের। এভাবে উচ্ছেদ হয় মায়েদের দিক দিয়ে বংশপরম্পরার হিশেবে ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার; তার স্থানে আসে পিতার দিক থেকে বংশপরম্পরার হিশেবে ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার। ঠিক কখন এ-বিপ্লব ঘটেছিলো, অভ্যুত্থান ঘটেছিলো পুরুষের, এবং কীভাবে ঘটেছিলো, তা আজ বলার উপায় নেই, কিন্তু এটা সত্য যে মানুষ প্ৰজাতির মধ্যে পুংলিঙ্গের উত্থানে অধিকার হারিয়েছিলো স্ত্রীলিঙ্গ। মাতৃ-অধিকারের উচ্ছেদকে এঙ্গেলস বলেছেন ‘স্ত্রীজাতির এক বিশ্ব ঐতিহাসিক পরাজয়’, যার ভার এখনো বইছে নারী। সত্যিই কি একসময় একটা আশ্চর্য সোনালি যুগ ছিলো নারীদের, যা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো পুরুষের অভ্যুত্থানে? বাখোফেন এতে বিশ্বাস করেন, তার অনুসরণে এতে বিশ্বাস করেন এঙ্গেলস; কিন্তু দ্য বোভোয়ার মনে করেন নারীদের ওই সোনালি যুগ একটি সুন্দর কিংবদন্তি। তার মতে সমাজ সব সময়ই পুরুষের, রাজনীতিক শক্তিও সব সময় ছিলো ও আছে পুরুষের মুঠোতে। তবে বাখোফেন নারীর সোনালি দিনের, পুরুষতন্ত্রের অভ্যুত্থানের যে কথা বলেছেন, তা তাঁর কল্পনা নয়; তিনি পুরুষের অভ্যুত্থানের কিছু চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন পুরাণে ও সাহিত্যে।
কখন ঘটে এ-অভুত্থান? সম্ভবত এটা ঘটে যখন জানা হয়ে যায় পিতৃত্বের রহস্য। আগে মনে করা হতো নারীদের গর্ভে দৈবপ্রক্রিয়ায় পুনরায় শিশু হয়ে জন্ম নেয় পূৰ্বপুরুষেরা; কিন্তু পিতৃত্বের রহস্য যখন জানা হয়, যখন পুরুষ বুঝতে পারে সন্তান জন্ম দেয়ায় রয়েছে তার ভূমিকা, তখন পুরুষ প্রজননে নারীর ভূমিকাকে অস্বীকার ক’রে নিজের ভূমিকাকেই গুরুত্বপূর্ণ ব’লে ঘোষণা করে। পিতৃত্বের রহস্যটি যখন জানা হয়, তখনই ঘটে পুরুষতান্ত্রিক বিপ্লব। বাখোফেন এর পরিচয় দেখতে পেয়েছেন এস্কিলুসের অরেন্সতেইয়া ত্ৰিনাটকে। এ-ত্রিনাটকের তৃতীয়টির নাম অয়মেনিদেস [সুভাষিত অর্থ: দয়াবতী দেবীগণ, আসলে বোঝায় প্রতিহিংসার দেবীগণ], যাতে রূপায়িত হয়েছে জয়ী পিতৃতন্ত্র ও পরাজিত মাতৃতন্ত্রের শেষ রাজনীতিক সংঘর্ষ। ট্রয়ের যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছে বিজয়ী সেনাপতি আগামেমনন, সাথে নিয়ে এসেছে অনেক নারীর মধ্যে ট্রয়ের রাজকন্যা কাসান্দ্ৰাকে, ধর্ষণেধর্ষণে যে পাগল হয়ে গেছে। ফেরার পর এ বিজয়ী বীরকে হত্যা করে তার স্ত্রী ক্লাইতেমনোন্ত্রা। হত্যার পেছনে রয়েছে দুটি কারণ; স্বামীর দশ বছরের অনুপস্থিতির সময় সে একটি দায়িত পেয়েছে, এবং সে তার কন্যা ইফিজিনিয়ার হত্যার প্রতিশোধ নিতে চায়। ট্রয়যাত্রার আগে আগামেমনন কন্যা ইফিজিনিয়াকে একিলিসের সাথে বিয়ে দেয়ার কথা বলে নিয়ে বলি দেয় দেবতার উদ্দেশে, যাতে দেবতার বরে অনুকূল বায়ুতে সে যেতে পারে ট্রয়ে। পরে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে অরেসতেস খুন করে মা ক্লাইতেমনোন্ত্রাকে। কিন্তু মাকে খুন ক’রে অরেসতেস রুষ্ট করে প্রতিহিংসার দেবীদেব, যারা তাকে তাড়িয়ে ফেরে শহর থেকে শহরে।
প্রতিহিংসার দেবী কারা? তারা আর কেউ নয়, তারা মাতৃতন্ত্র বা মাতৃ-অধিকারের পরাভূত শক্তিরাশি, যারা এখন পরিণত হয়েছে কলহপরায়ণ নারীতে। তারা যখন চিৎকার ক’রে অরেসতেসের শাস্তি চায়, তখন তাদের চিৎকারে শোনা যায় মাতৃ-অধিকারের শেষ দাবি। অরেসতেস তাদের জানায় তার কোনো দোষ নেই, অ্যাপোলোর নির্দেশেই সে মাতৃহত্যা করেছে। দৈববাণীর দেবতা এমন নির্দেশ দেবে, এটা তাদের বিশ্বাস হয় না; তাই তারা বিচারের জন্যে অ্যাথেনাকে মধ্যস্থ মানে অরেসতেস। জানতে চায় তারা কেনো স্বামীঘাতক ক্লাইতেমনোস্ত্ৰকে তাড়া করে নি? তারা উত্তর দেয় : ‘যে-পুরুষকে সে করেছে হত্যা তার সাথে ছিলো না তার রক্তের সম্পর্ক।’ এতে প্রকাশ পায় মাতৃ-অধিকারের ন্যায়। অরেসতেস প্রশ্ন করে : ‘কিন্তু আমি কি আমার মায়ের?’ এ-প্রশ্নে ক্ষুব্ধ হয় দেবীরা; কিন্তু অ্যাপোলো সত্যকে অস্বীকার ক’রে, পিতৃতান্ত্রিক দাপটে, জানায়, ‘মা ছাড়াও পিতা পারে জন্ম দিতে’। সে প্রমাণ হিশেবে দাঁড় করায় অ্যাথেনাকে, যার জন্ম হয়েছিলো পিতা জিউসের মাথা থেকে। অ্যাথেনা উঁচু গলায় ঘোষণা করে পুরুষতন্ত্রের জয়। প্রতিহিংসার দেবীরা ‘হে মাতা, হে অন্ধকার’ ব’লে কান্নায় ভেঙে পড়ে। হেরে যায় আগের উর্বরতার দেবীরা, সেখানে দেখা দেয় পুরুষ দেবতারা; মাতৃতন্ত্রকে উচ্ছেদ ক’রে প্রতিষ্ঠা পায় পিতৃতন্ত্র। পুরুষের জয় ঘোষিত হয় দিকেদিকে, এবং হাজার হাজার বছরে কেউ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে নি। নারী হয়ে থাকে মানুষপ্রজাতির পরাভূত লিঙ্গ।
আগে নারী ছিলো গৃহের প্রধান; মাতৃ-অধিকার উচ্ছেদের পর পুরুষ দখল করে গৃহের কর্তৃত্ব। পুরুষ নারীকে করে নিজের দাসী, শৃঙ্খলিত, লালসার শিকার ও সন্তান (বিশেষ ক’রে পুত্র) উৎপাদনের যন্ত্র। দেখা দেয় পিতৃপ্রধান একপতিপত্নী পরিবার। আরো দুটি প্রথা ছিলো বিয়ের, এর একটি এখনো টিকে আছে মুসলমানদের মধ্যে। একটি বহুপত্নীত্ব ও অন্যটি বহুস্বামীত্ব। বহুপত্নীত্ব হচ্ছে সম্ভোগের চরম রূপ। ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে ও তিব্বতে বহুস্বামীত্বও এক সময় ছিলো, হয়তো এখনো আছে। এখন চলছে, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, একপতিপত্নী প্রথা; কিন্তু একপতিপত্নী প্রথার সূচনা হয় কখন, এবং কাদের উদ্যোগে? বাখোফেন বলেছেন, তার কথিত ‘হেটায়ারিজম’ থেকে চালু হয়েছিলো একপতিপত্নীপ্ৰথা নারীদেরই চেষ্টায়। তাঁর মতকে এঙ্গেলস বলেছেন ‘সম্পূর্ণ নির্ভুল’। এ-বদলের কারণ ব্যাখ্যা ক’রে এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২১০) বলেছেন যে আর্থনীতিক বিকাশের ফলে আদিম সাম্যতন্ত্রী ব্যবস্থার ঘটে অবনতি, আগের যৌনসম্পর্কগুলো আরণ্যক চরিত্র হারিয়ে নারীদের কাছে মনে হতে থাকে হীন ও পীড়নমূলক, তাই ‘আগ্রহের সঙ্গে পরিত্রাণ হিসাবে তারা অবশ্য পাতিব্ৰত্যের অধিকার, একটি পুরুষের সঙ্গে অস্থায়ী বা স্থায়ী বিবাহ চেয়ে থাকবে।‘ এঙ্গেলস মনে করেন এ-অগ্রগতি পুরুষ চাইতে পারে না, কেননা পুরুষ আজও পর্যন্ত স্বপ্নেও কখনও আসল সমষ্টি-বিবাহের সুবিধা ছাড়তে চায় নি।‘ নারীরাই চেয়েছিলো পাতিব্ৰত্য, বহুযৌনসম্পর্ক নারীদের কাছে মনে হয়েছিলো পীড়াদায়ক, এবং তার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে নারীরা চেয়েছিলো একপতির পবিত্ৰ শয্যায় সতীত্বের অধিকার? সমষ্টি বিয়ে পুরুষের জন্যে সুবিধাজনক, নারীদের জন্যে অসুবিধাজনক? মিলেট (১৯৬৯, ১১৬) এঙ্গেলসের সিদ্ধান্তে দেখেছেন ‘অ্যাবসারডিটি’; কেননা এঙ্গেলস ধরে নিয়েছেন যে নারীরা কাম অপছন্দ করে। হাজার হাজার বছর ধরে পুর্বপশ্চিমের ঋষিরা রটিয়েছেন নারীরা কামচণ্ডালী, ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণ (২৩:৩২) বলেছর ‘পুরুষের থেকে নারীদের কাম আটগুণ’, সন্তরা বলেছেন জরায়ুর ক্ষুধা আগুনের মতোই অশেষ ; আর এঙ্গেলস ধ’রে নিয়েছেন কাম নারীদের কাছে পীড়াদায়ক, অপ্ৰিয়। সঙ্গমকে তিনি হয়তো মনে করেছিলেন নারীর একধরনের রাজনীতিক পরাজয়, কেননা নারী যেনো তাতে আত্মসমৰ্পণ করে পুরুষের কাছে; এবং তার ভিক্টোরীয় মানসিকতাও কাজ করেছিলো এর পেছনে। ওই সময়ে এমন একটি ধারণা তৈরি, প্রচার ও জনপ্রিয় ক’রে তোলা হয়েছিলো যে নারী কামকে ঘেন্না করে, কাম নারীর প্রিয় নয়। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ভিক্টোরীয় সংস্কৃতি নারীকে কামবোধহীন ক’রে তুলেছিলো, শীতল নারীকেই তারা মনে করতো সতী; তাই সে-সময় নারীরা শীতল হয়ে উঠেছিলো; কিন্তু কাম নারীদের কাছে অপ্ৰিয় নয়। নারীদের কামপ্রবলতা সম্পর্কে প্রাচীন উপাখ্যানের শেষ নেই : মহাভারত-এ একটি উপাখ্যান রয়েছে, যাতে বলা হয়েছে পুরুষদের থেকে নারীরাই সঙ্গম উপভোগ করে বেশি। রাজর্ষি ভঙ্গাসন ইন্দ্রের ক্ৰোধে নারীতে পরিণত হয়, এবং এক তাপসের ঔরষে নিজের গর্ভে একশো পুত্র জন্ম দেয়। পরে ইন্দ্র তাকে পুরুষত্ব ও নারীত্বের মধ্যে একটি বেছে নিতে বললে সে নারীই থাকতে চায়। কারণ হিশেষে সে বলে, ‘স্ত্রীপুরুষের সংযোগকালে স্ত্রীরই অধিক সুখ হয়।‘ ভঙ্গাসনের মতো নারীপুরুষ দু-রূপেই অভিজ্ঞতা অর্জন এখন অসম্ভব, কিন্তু মিলনের সময় নারীর আচরণ দেখে মনে হতে পারে কাম উদ্ভাবিতই হয়েছিলো নারীর জন্যে। কাম পুরুষের একটি প্রত্যঙ্গের, আর নারীর সমগ্র শরীর ও চৈতনার ব্যাপার। আধুনিক গবেষণা তাই প্রমাণ করেছে।
আধুনিক গবেষণা দেখিয়েছে সহজাত ও জৈবিকভাবে নারী পুরুষের থেকে অনেক বেশি উপভোগ করে কাম। পৌনপুনিকতায় ও পুলকানুভূতিতে নারী অনেক বেশি সমর্থ পুরুষের থেকে। মাস্টারস ও জনসন সাড়াজাগানো ‘মানুষের যৌন সাড়া’ (১৯৬৬) গ্রন্থে দেখিয়েছেন নারী খুব দ্রুত একের পর এক পুলক অনুভব করতে পারে, যা পুরুষ কখনো পারে না। নারীর পুলক সম্পর্কে ধারণাও বদলে গেছে একালে। আগে শুধু রন্ধটিকেই সুখের খনি মনে করা হতো; কিন্তু নারীর আসল সুখের বেদি ভগাঙ্কুর। মানুষের অন্য কামাঙ্গগুলোর আরো কাজ আছে, কিন্তু নারীরই শুধু রয়েছে একটি বিশেষ প্রত্যঙ্গ যার একমাত্র কাজ যৌনসুখ অনুভব। সেটি ভগাঙ্কুর। পুরুষের এমন কোনো প্রত্যঙ্গ নেই। পুরুষের যৌনশক্তি সীমিত, নারীর অমিত, তাতে শুধু বাধা দিতে পারে শারীরিক ক্লান্তি বা মানসিক অবস্থা। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা নারীকে ও তার কামকে দমন ক’রে রেখেছে নানা বিধিনিষেধে; এবং পুরুষের কামকে ক’রে তুলেছে নিবৃত্তিহীন। পুরুষতন্ত্র পুরুষের কামশক্তির ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে রক্ষা করেছে বহুবিবাহ ও দ্বৈতমানের সুযোগ। এটা জৈব সত্যের সম্পূর্ণ অপলাপ। পুরুষতন্ত্র ভোগে স্ববিরোধিতায়ও : পুরুষতন্ত্র নারীকে কামসামগ্ৰীতে পরিণত করতে চায়, আবার চায় যে নারী হবে কামবিমুখ। মুসলমান দেশগুলোতে এটা প্ৰবল; ওই দেশের পুরুষেরা চায় স্বামীদের শয্যায় নারীরা হবে মেরেলিন মনরো, শয্যার বাইরে হবে সতীসাধ্বী বিবি। এঙ্গেলসের ধারণা ঠিক নয় যে নারীরাই চেয়েছিলো একপতির অধীনে পতিব্ৰতা হয়ে থাকতে, কেননা কাম তাদের কাছে পীড়াদায়ক। পুরুষই চেয়েছিলো, তাই এটা হয়েছে; যদি নারী চাইতো আর পুরুষ না চাইতো, তাহলে কখনো এটা ঘটতো না। পুরুষ নারীকে ক’রে তুলেছিলো তাদের শ্ৰেষ্ঠ সম্পত্তি, আর ওই সম্পত্তিতে ভাগ বসাক অন্য কেউ, এটা তারা চায় নি। তারা নিজেদের জন্যে রেখেছে বহুবিবাহ, বা বহুনারীসংসর্গের সুযোগ্য; আর নারীকে ক’রে রেখেছে একজনের একান্ত ভোগ্যবস্তু। নারী বহু কাল ধ’রে বাধ্য হয়ে যুগিয়ে আসছে পুরুষের কামতৃপ্তি এবং পশুর মতো প্রসব করে আসছে মনুষ্যশাবক।
বর্বরতার মধ্য স্তর থেকে শেষ স্তরে ওঠার সময় জোড়বাধা বিয়ে থেকে উদ্ভব ঘটে একপতিপত্নী বিয়ের। সভ্যতার সূচনার সময় একপতিপত্নী বিয়েই রীতি হয়ে ওঠে। এর ভিত্তি পুরুষাধিপত্য, লক্ষ্য সুনিশ্চিত পিতৃত্বে সন্তান উৎপাদন। তখন বাপই সমস্ত সম্পত্তির মালিক; আর বাপ এমন কাউকে সম্পত্তি দেবে না, যে তার ঔরষে জন্ম নেয় নি : বাপের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে সন্তান, বিশেষ করে পুত্র। এ-বিয়েতে স্বামীস্ত্রীর খেয়ালে বিয়ে ভাঙা সম্ভব নয়, তবে স্বামী তা পারে বেশ সহজে। এ-বিয়েতে দাম্পত্যজীবনে পুরুষের বিশ্বাসভঙ্গের অধিকারও থাকে খুবই বেশি; কিন্তু নারীর কোনো অধিকার থাকে না। এমন একপতিপত্নী পরিবারের কঠোর রূপ দেখা দেয় গ্রিকদের মধ্যে। সেখানে পুরোনো দেবীদের যে-প্রতিষ্ঠা, তা থেকে বোঝা যায় নারীরা তখন সম্মানিত ছিলো, কিন্তু বীরযুগে পতন ঘটে নারীদের অবস্থার। তখন দেখা যায় পুরুষেরা বিয়ের বাইরে যৌনসম্পর্ক রাখছে, কিন্তু নারীরা বাধ্য হচ্ছে কঠোর সতীত্ব বা পাতিব্ৰত্য পালন করতে। সভ্যতার যুগে নারী হয়ে ওঠে। পুরুষের বৈধ উত্তরাধিকারীর জননী, তার প্রধান গৃহকত্রী, দাসীদের প্রধান। স্বামীরা দাসীদের নিয়মিত সম্ভোগ করতো, বাইরে গণিকা উপভোগ করতো; কিন্তু স্ত্রীদের থাকতে হতো আপাদমস্তক সতী। তাই একপতিপত্নী বিয়ে নির্মমভাবে সত্য হয় শুধু নারীর জন্যে, পুরুষের জন্যে নয়। ডেমোসথেনেস বলেছেন, ‘চেতনার সুখের জন্যে আমাদের আছে গণিকা, ইন্দ্ৰিয়সুখের জন্যে রক্ষিতা, এবং পুত্রলাভের জন্যে স্ত্রী’ [দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ১১৯)]। পুরোনো ভারতে পুরুষ বিয়ে করতো বহু, তার ওপরে ছিলো বিচিত্র ধরনের বেশ্যা, যাদের শ্ৰেষ্ঠ ছিলো ‘গণিকা’। বাৎস্যায়ন লিখেছেন, ‘চৌষট্টিকলায় উৎকর্ষ লাভ ক’রে শীল, রূপ ও গুণান্বিতা বেশ্যা ‘গণিকা’ সংজ্ঞা লাভ করে এবং গুণগ্রাহীদের সমাজে স্থান লাভ করে। রাজা সর্বদা তাকে সম্মান করেন, গুণবানেরা তার স্তুতি করেন এবং সে সকলের প্রার্থনীয়া, অভিগম্য ও লক্ষীভূত হয়ে থাকে’ [কামসূত্র: দ্ৰ মহেশচন্দ্র (১৯৮০)]। কিন্তু স্ত্রীরা রাজা কেনো স্বামীদের কাছেও সম্মানিত ছিলো না।
একপতিপত্নী বিয়ে দেখা দেয় নি নারীপুরুষের সদ্ভাবের ফলে, বা বিয়ের একটি আদর্শ রূপ হিশেবে। এটি দেখা দিয়েছিলো নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্যরূপে; এবং এখনো তাই আছে। এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২২) বলেছেন, ‘ইতিহাসে শ্রেণীবিরোধ প্রথম যা দেখা দেয় সেটা মিলে যায় একপতিপাতী বিবাহে স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে বিরোধের বিকাশের সঙ্গে এবং প্রথম শ্রেণীপীড়ন মেলে পুরুষ কর্তৃক স্ত্রীজাতির ওপর পীড়নের সঙ্গে।‘ একপতিপত্নী বিয়ে অগ্রগতি, কিন্তু পেছনে ফেরাও, কেননা এর ভিত্তি নারীর ওপর পুরুযের শোষণ। পবিত্র একপতিপত্নী বিয়ের সাথে দেখা দেয় দুটি অপবিত্র ব্যাপার, যা আগে ছিলো না; একটি গণিকাবৃত্তি, অন্যটি ব্যভিচার। গণিকাবৃত্তির শুরু হয়েছিলো প্ৰায়শ্চিত্তমূলক দেহদানে, যখন নারীরা প্রণয়দেবীর মন্দিরে অর্থের বিনিময়ে আত্মদান ক’রে প্রায়শ্চিত্ত করতো সতীত্বের। অর্থ জমতো মন্দিরের কোষে। আর্মেনিয়ার আনাইটিসের মন্দির ও করিন্থের আফ্রোদিতির মন্দিরের পরিচারিকারী ও ভারতের মন্দিরের দেবদাসীরা ছিলো প্ৰথম গণিকা। সম্পত্তির বৈষম্য শুরু হওয়ার পর ক্রীতদাসীরা যখন বাধ্য হয় প্রভুকে দেহদানে, তখন শুরু হয় স্বাধীন নারীদের পতিতাবৃত্তি। স্বামীরা পতিতা সম্ভোগ করতো, তাতে কোনো বাধা ছিলো না; কিন্তু স্ত্রীরা ছিলো অবহেলিত। স্ত্রীরা শুধু চোখ বুজে দেখে যাবে স্বামীদের লাম্পট্য, থাকবে সতীসাধ্বী, এটা আশা করা যায় না; তারাও যে হাত বাড়াবে নিষিদ্ধ গন্ধমের দিকে, এটাই স্বাভাবিক। তাই দেখা দেয় একটি নতুন প্রপঞ্চ, যার নাম স্ত্রীর উপপতি; শুরু হয় নারীর ব্যভিচার। একপতিপত্নী বিয়ের মধ্যে স্বামীর দিক থেকে থাকে গণিকাসম্ভোগ, আর স্ত্রীর দিক থেকে থাকে, এঙ্গেলসের মতে, ‘ঢালাও ব্যভিচার’। বাইবেলেব হিতোপদেশ বলেছে, ‘পরকীয়া স্ত্রীর ওষ্ঠ হইতে মধু ক্ষরে, তাহাব তালু তৈল অপেক্ষাও স্নিগ্ধ’; এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২৬) বলেছেন, ‘মৃত্যুর মতোই ব্যভিচারের কোন চিকিৎসা নেই।‘ এ-বিয়ের সুখ কেমন? এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২৬) বলেছেন, ‘একপতিপত্নী বিবাহের উত্তম দৃষ্টান্তগুলির গড়পড়তা ধরলেও তা পরিণত হয় এক নিরেট একঘেয়েমির দাম্পত্য-জীবনে, যাকে বলা হয় দাম্পত্য সুখ।’ এ-বিয়ে পরিণত হয, এঙ্গেলসের মতে, স্থল বেশ্যাবৃত্তিতে, বিশেষ ক’রে স্ত্রীর বেলা। স্ত্রী আর পতিতা কি এক? এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২৭) বলেছেন, ‘স্ত্রীর সঙ্গে সাধারণ পতিতার পার্থক্য এইটুকু যে সে ফুরনের মজুরের মতো নিজের দেহ ভাড়া খাটায় না, পরন্তু সে দেহটা বিক্রি করে চিরকালের মতো দাসত্ত্বে; এবং ফুরিয়ের [ দ্র এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২৭)] বলেছেন, ‘ব্যাকরণে যেমন দুটি নেতিবাচক শব্দে একটি ইতিবাচক শব্দ হয়, তেমনই বিবাহের নীতিশাস্ত্রে দুটি বেশ্যাবৃত্তি মিলে পুণ্যধর্ম হয়ে ওঠে। সাম্যবাদী এঙ্গেলস বুর্জোয়াদের দাম্পত্যজীবনকে পতিতাবৃত্তি মনে করলেও প্রলেতারিয়েতদের সম্পর্কে তাঁর উঁচু ধারণা ছিলো; তিনি মনে করেছেন তাদের মধ্যে স্বামীস্ত্রীর সম্পর্ক সুস্থ হ’তে পারে। কিন্তু এটা এক সাম্যবাদী ভ্ৰান্তি। প্রলেতারিয়েতদের স্বামীস্ত্রীর সম্পর্ক আরো অসুস্থ; তা একেবারেই শস্তা পতিতাবৃত্তি। পতিতার খদ্দের হিশেবে প্রলেতারিয়েতের থেকে বুর্জোয়া উৎকৃষ্ট।
উৎপাদন বা আর্থ ক্রিয়াকাণ্ডে যার অংশ নেই, দুরবস্থা তার কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। নারীর দুরবস্থার কারণ তাই নারী বহুকাল ধ’রে আর্থ ক্রিয়াকলাপ থেকে নিবাসিত হয়ে পরগাছায় পরিণত হয়েছে। নারী আর্থনীতিকভাবে শোষিত, তাই সব দিকেই শোষিত। আদিম সাম্যতন্ত্রী গৃহস্থালিতে নারীর ওপর অর্পিত ছিলো গৃহস্থালি, তা আজকের পরিবার সেবা ছিলো না, ছিলো একটি গুরুত্বপূর্ণ বৃত্তি। কিন্তু পিতৃপ্রধান পরিবার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গৃহস্থলির কাজের মূল্য কমে যায়; বৃত্তির বদলে তা হয়ে ওঠে সেবা, যার দরকার আছে কিন্তু মূল্য নেই। সামাজিক উৎপাদনের এলাকা থেকে বহিস্কৃত হয়ে স্ত্রী হয়ে ওঠে প্রথম ঘরোয়া ঝি। আধুনিক পরিবার দাঁড়িয়ে আছে নারীর প্রকাশ্য বা গোপন গাৰ্হস্থ দাসত্বের ওপর; এঙ্গেলস বলেছেন, পরিবারের মধ্যে স্বামী হচ্ছে বুর্জোয়া, স্ত্রী প্রলেতারিয়েত। কারণ বিত্তবান শ্রেণীগুলোতে পুরুষ উপার্জন করে, নারী কোনো কিছু উপার্জন করে না; তাকে এমনভাবে নিষ্ক্রিয় ক’রে দেয়া হয়েছে যাতে সে হয়ে উঠেছে আপাদমস্তক অপদার্থ। পানী শ্রেণীগুলোতে নারীদের ক’রে তোলা হয়েছে অপদার্থতার প্রতিমূর্তি; পুরুষের বিনোদ যোগানোর বেশি আর কিছু তারা করতে পারে না ; মানুষের হাতেপায়ে শেকল পরানো সহজ, কঠিন হচ্ছে শেকলমুক্ত করা; আর ওই শেকল যদি সুবিধাজনক হয়, তবে মানুষ মুক্তির চেয়ে শেকলকেই বেশি প্রিয় মনে করে। এটা ঘটেছে বুর্জোয়া নারীদের বেলা; তারা কারুকার্যখচিত শেকলকেই বরণ ক’রে নিয়েছে। ওই শেকল তাদের স্বাধীনতা ও সম্মান হরণ করেছে, কিন্তু নানা সুবিধা এনে দিয়েছে বলে শোকলে তারা নিজেদের আরো শক্ত করে বেঁধে রাখতে চায়। একপতিপত্নী বিয়েতে নারী সব স্বাধীনতা হারিয়েছে, দাসী হয়ে উঠেছে; তার সমষ্টি বিয়ের যৌন স্বাধীনতা হারিয়েছে, কিন্তু পুরুষ সমষ্টি বিয়ের সুবিধা হারায় নি। পুরুষদের জন্যে আজো রয়ে গেছে সমষ্টি বিয়ে। মুসলমানেরা বহু বিয়ে করতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় সবাই বহু বিয়ে ক’রে থাকে; এবং পৃথিবী জুড়েই পুরুষেরা উপভোগ করে বিয়ের বাইরে জাকালো যৌনসম্পর্ক। নারীর পক্ষে যা মারাত্মক অপরাধ, পুরুষের বেলা তা অনেক সময় গৌরবের বা আনন্দের সাথে উপভোগ্য নিন্দার ব্যাপার। একই পুরুষের অধিকারে প্রচুর সম্পত্তি জড়ো হওয়ার ফলে, এবং তাঁর সন্তানসন্ততিকে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করার বাসনা থেকে উদ্ভূত হয় একপতিপত্নী বা একপতি-একাধিক পত্নী বিয়ে;- সম্পূর্ণ পুরুষের স্বার্থে। এজন্যে নারীর পক্ষে একপতিত্ব বাধ্যতামূলক, পুরুষের জন্যে নয়।
এঙ্গেলস পিতৃতান্ত্রিক বিয়ে ও পরিবারের উদ্ভব ও প্রকৃতির যে-ব্যাখ্যা দেন, তা বিপ্লবাত্মক; কেননা তিনি দেখান যে এর কোনোটিই শাশ্বত নয়। যা বহুকাল ধ’রে চ’লে এসেছে, তাই যে চিরকাল চলবে এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। পিতৃতান্ত্রিক বিয়ে, পরিবার ও আর সমস্ত কিছু ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় উদ্ভূত-বিবর্তিত হয়েছে, এখনো বিবর্তন চলছে; এমনকি এর আমূল পরিবর্তনও ঘটানো অসম্ভব নয়। তিনি দেখান যে পিতৃতান্ত্রিক বিয়ে ও পরিবার গড়ে উঠেছে নারীকে পুরুষের সম্পত্তিতে পরিণত করে। নারীশোষণই পিতৃতন্ত্রের ভিত্তি, যার সাথে যুক্ত আরো নানা ধরনের শোষণ। এ-সমস্ত শোষণের চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে রাষ্ট্র, যার কাজ বিচিত্র ধরনের শোষণ ও বৈষম্যকে বৈধ ক’রে তোলা। তাই সমস্ত মানবিক বৈষম্যের মূলে রয়েছে। পুরুষাধিপত্য ও নারীর অধীনতা, লৈঙ্গিক রাজনীতির ভিত্তির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে সমস্ত সামাজিক, রাজনীতিক, আর্থ সংগঠন। এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২২) বলেছেন :
ইতিহাসে শ্রেণী-বিরোধ প্রথম যা দেখা দেয় সেটা মিলে যায় একপতিপত্নী বিবাহে স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে বিরোধের বিকাশের সঙ্গে এবং প্রথম শ্রেণী পীড়ন মেলে পুরুষ কর্তৃক স্ত্রীজাতির ওপর পীড়নের সঙ্গে। একপতিপত্নী বিবাহ ইতিহাসের একটি বড় অগ্রসর পদক্ষেপ, কিন্তু সেই সঙ্গেই দাসপ্রথা ও ব্যক্তিগত সম্পদসহ তা এমন এক যুগের পত্তন করে যা আজও পর্যন্ত চলছে এবং যাতে প্রত্যেকটি অগ্ৰগতিই হচ্ছে সেই সঙ্গে একটা আপেক্ষিক পশ্চাদগতি, যেখানে জনসমষ্টির একাংশের সচ্ছলতা ও উন্নতি হয় অপর এক অংশের দুঃখ ও পীড়নেৰ মধ্য দিয়ে। একপতিপত্নী বিবাহ হচ্ছে সভ্য সমাজের কোষ-রূপ, এখানে আমরা সেই সব বৈরিতা ও বিরোধের প্রকৃতি লক্ষ্য কবতে পারি যেগুলি শেষোক্তের মধ্যে পূর্ণ পরিণতি লাভ করেছে।
বৈরিতা ও বিরোধের ভিত্তির ওপর যা দাঁড়িয়ে আছে, তা কি ধ’সে পড়বে না? এঙ্গেলস স্বপ্ন দেখেছেন এক শোষণহীন সমাজের; তাই যে-আর্থনীতিক শোষণের ওপর দাঁড়ানো একপতিপত্নী বিয়ে ও পরিবার, যদি সে-শোষণ চলে যায়, তবে কি থাকবে এ-বিয়ে ও পরিবার? এর চমকপ্ৰদ উত্তর দিয়েছেন এঙ্গেলস; বলেছেন, ‘এই প্রথা লোপ না পেয়ে পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হবেই।’ ওই সমাজে সামাজিক উৎপাদনের মধ্যে আবার ফিরে আসবে নারী–এটাই তাদের মুক্তির প্রথম শর্ত; এবং ওই সমাজে উৎপাদনের উপায়গুলো হবে সমাজের সম্পত্তি, সেখানে কেউ সুবিধাভোগী কেউ সর্বহারা হবে না। তাই নারী হবে স্বাধীন, সেখানে পতিতা থাকবে না কেউ, এবং একপতিপত্নী প্রথা সত্য হয়ে উঠবে পুরুষনারী উভয়ের জন্যে। পরিবারের রূপ থাকবে না এখনকার মতো, এখন পরিবার হচ্ছে সমাজের অর্থনীতির একক, এঙ্গেলসের সমাজে তা হবে না। সেখানে ‘ব্যক্তিগত গৃহস্থলি পরিণত হবে সামাজিক শিল্পে।‘ শিশুপালন ও শিক্ষা হবে সামাজিক ব্যাপার, বিয়ে বা বিয়ের বাইরে যেভাবেই জন্ম হোক শিশুর, পুরো সমাজ নেবে তার দায়িত্ব, সে হবে সমাজের সন্তান। একপতিপত্নী বিয়েকে শুদ্ধ পবিত্র স্বর্গীয় ক’রে তোলা এঙ্গেলসের লক্ষ্য নয়; তার লক্ষ্য নারীর ওপর পুরুষের শোষণ এবং সার্বিক শোষণ দূর করা। তা কিছুতেই বর্তমান সমাজব্যবস্থায় সম্ভব নয়। আমাদের উগ্র পুরুষতান্ত্রিক, মধ্যযুগীয়, দরিদ্র, অশিক্ষিত সমাজে নারীশোষণ বন্ধ করা বিশেষভাবেই কঠিন; নারীর মুক্তি তো সুদূর ব্যাপার। এখানে একটি ভালো বিয়েকেই নারীর জীবনের পরম সাফল্য ব’লে গণ্য করা হয়; এর বেশি এখনো ভাবা হয় না ; বরং মুক্তিকে মনে করা হয় বিপজ্জনক ও ব্যর্থতা। পশ্চিমের নারীবাদীরা এঙ্গেলসকেও ছাড়িয়ে গেছেন; তাঁরা একপতিপত্নী বিয়ের পবিত্রতাকে বিশেষ মূল্যবান মনে করেন না, তারা নারীর সামাজিক-আর্থ-যৌন সব ধরনের মুক্তি চান। গত তিন দশকে পশ্চিমের নারীবাদীরা বদলে দিয়েছেন তাদের সমাজের বহু এলাকা; এবং যৌন এলাকায় যে-পরিবর্তন ঘটিয়েছেন, তাকে বিপ্লব বলা যায়। তবে পৃথিবী এখনো পুরুষের, নারী এখনো পরাজিত, বন্দী। নারীর মুক্তির জন্যে দরকার বড়ো ধরনের সামাজিক বিপ্লব; যতোদিন ওই বিপ্লব না ঘটে ততোদিন নারী থাকবে পুরুষের অধীনে, থাকবে দাসী ও যৌনসামগ্ৰী।