নর-বানর
রবীন্দ্ৰনাথ আপসোস করে লিখেছিলেন: “আমি যদি জন্ম নিতাম কালিদাসের কালে …।” আমি অদ্দূর পেছনে যেতে চাইনে। আপাতত, তাই বলতে পারি, আমি যদি জন্ম নিতাম ডারউইনের কালে …। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, আমি তা হলে কী করতাম? না, না, আমি কিছুই করতাম না। তবে ডারউইনের মস্ত লাভ হতো। তাঁর তত্ত্ব নিয়ে আজও যে-বিতর্ক আছে, তা আদৌ থাকতো না।
একেবারে যুগান্তকারী আবিষ্কারের কথা বললেও, বিবর্তনবাদ প্রমাণ করা ডারউইনের পক্ষে মোটেই সহজ ছিলো না। অন্তত গবেষণাগারে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন মিশিয়ে পানি তৈরি করে দেখানোর মতো অতো সহজ ছিলো না। তাই তিনি যেসব প্রমাণ দিয়েছেন, তাকে অনেকে অকাট্য বলে মেনে নিতে পারেননি। তাঁর জীবদ্দশাতেই অনেকে তার বক্তব্য প্ৰত্যাখ্যান করেছেন। আর ধর্মপ্ৰাণ ব্যক্তিরা তো তাকে রীতিমতো ধর্মবিদ্বেষী বলেও ফতোয়া দিয়েছেন। তারপর চলে গেছে। দেড় শো বছর। ইতিমধ্যে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। তা সত্ত্বেও আজও অনেকে তাঁর তত্ত্ব মানতে চান না। আসলে, হাতে-কলমে তিনি প্রমাণ করতে পারলেন না। যে, বিবর্তনের মধ্য দিয়েই বানরের মতো একটা জীব নরে পরিণত হয়েছে। এর কারণ, তিনি এমন কোনো নির অথবা বানরের দৃষ্টান্ত হাজির করতে পারলেন না, যাকে দেখে সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবেন যে, হ্যাঁ, এ জন্তু অর্ধ-নর, অর্ধ-বানর। অর্থাৎ নর এবং বানরের মাঝখানকার হারিয়ে-যাওয়া সূত্ৰ–ইংরেজিতে যাকে বলে মিসিং লিঙ্ক–তার সন্ধান তিনি দিতে পারেননি। কিন্তু আমি যদি তাঁর সমসাময়িক হতাম, তা হলে তিনি অনায়াসে আমাকে হাজির করে তাঁর তত্ত্বের প্রতি সবার সমর্থন আদায় করতে পারতেন! আমাকে যাঁরা দেখেছেন, আশা করি তাঁরা একবাক্যে বানরের সঙ্গে আমার সাদৃশ্যের কথা স্বীকার করবেন। সে যাই হোক, আমা-বিহনে ডারউইন মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকেন। আর অন্যরা ১৮৭১ সালে বানর-রূপী ডারউইনের ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করে তাঁর বক্তব্য যে ঠিক নয়, সেটাই প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন।
মোরগের জন্ম আগে, না ডিমের জন্ম আগে— তা নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে অনেক তক্কো হয়ে থাকে। কেবল মোরগ আর ডিম নয়, জানোয়ার-শ্রেষ্ঠ মানুষেরা কোথা থেকে এলো, তা নিয়েও বাচসা শুরু হয় খৃস্টর জন্মের আগে থেকেই। কিন্তু এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তত্ত্ব ডারউইন এবং অ্যালফ্রেড রাসেল ওয়ালেসের আগে পর্যন্ত কেউ দিতে পারেননি। এমন কি, এঁরা দুজন তত্ত্ব দেওয়া সত্ত্বেও এই বিতর্ক থেকেই গেলো।
১৮৫৬ সালে–ডারউইন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, বাইরে থেকে জীবজন্তুদের চেহারা যতোটা ভিন্ন রকমের দেখায়, তাদের দেহের মূল কাঠামো অতোটা ভিন্ন নয়। গোড়ায় এই কাঠামো ছিলো কমবেশি একই রকমের। তারপর কোটি কোটি বছর ধরে ধীর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তারা এখন নানা রকম প্ৰজাতি এবং জীবজন্তুতে পরিণত হয়েছে। তা সত্ত্বেও তাদের শরীরের মূল কাঠামো বিশ্লেষণ করলে এখনো সেই সাদৃশ্য খানিকটা চোখে পড়ে। চারটি একেবারে ভিন্ন ধরনের জন্তু দিয়ে একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে–মাছ, পাখি, মানুষ এবং ঘোড়া। তাদের চেহারা, ফলাফেরা এবং জীবনযাত্রার মধ্যে কোনো মিল নেই। মাছের হাত-পা নেই এবং তারা বাস করে পানিতে। পাখিরও হাত নেই এবং তারা উড়তে পারে। মানুষ চলে দুপায়ে। আর ঘোড়ার আছে চারটি পা–হাত নেই। কিন্তু এদের কঙ্কালগুলো পাশাপাশি রাখলে এদের দেহের মৌলিক কাঠামোতে একটা অত্যাশ্চর্য মিল লক্ষ্য করা যাবে। মাথা, গলা, বুক, পেট, পা ইত্যাদিতে।
বিবর্তনবাদীদের যুক্তি হলো: কোটি কোটি বছর ধরে মাছ পানিতে বাস করায় তার পায়ের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে, তাই তাদের পা নেই। কিন্তু শরীরের যেখানটাতে পা থাকার কথা ছিলো, সেখানে এখনো রয়ে আছে পায়ের দুটি চিহ্ন। পাখিরা উড়ে বেড়ায় বলে তাদের মানুষের মতো ছোটো হাত থাকলে চলে না। সে জন্যে তাদের হাত দুটোই বড়ো পাখায় পরিণত হয়েছে। মানুষ দু পায়ে চলে বলে তার হাত দুটো ঘোড়ার সামনের পা দুটোর মতো নয়। ঘোড়ার মতো তার লেজেরও দরকার নেই। তাই তার লেজটা খসে পড়েছে। কিন্তু যেখানে লেজ থাকার কথা ছিলো, সেখানে এখনো লেজের গোড়াটা রয়ে গেছে। (তা ছাড়া, লেজ না-থাকলেও মাঝেমধ্যে একএকটা কারণে মনুষ্যত্ব ঘুচে গিয়ে তার অদৃশ্য লেজটা বেরিয়ে পড়ে।)
ডারউইনের মতে, আদিম অবস্থায় জন্তু-জানোয়ারের সূচনা হয়েছিলো এক অথবা একাধিক কোষ দিয়ে। তারপর বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তারা বর্তমান শারীরিক বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে। মানুষের দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায় যে, এখন মানুষ দু পায়ে চলাফেরা করলেও, সুদূর অতীতে তা করতো না। তখন তারা চলতো চার হাত-পায়ে। সেই পর্যায়ের মানুষকে বলা হয় হোমো ইরেক্টাস। তারপর এখন থেকে প্রায় দু লাখ বছর আগে তারা পরিণত হয় হোমো সেপাইনসে। সেই হোমো সেপাইনস-ই আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষ।
বানরও কোটি কোটি বছরের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের বানরে পরিণত হয়েছে। তার অর্থ অবশ্য দাঁড়ায় এই যে, নর এবং বানরের মধ্যে চেহারার মিল থাকলেও তারা এক জন্তু নয়। বানর থেকে নরের উদ্ভব হয়নি। এমনি কি, শিম্পাঞ্জি, গরিলা এবং ওরাং ওটাংকে ঢালাওভাবে বানর বলা হলেও তারাও এক প্রজাতির জন্তু নয়। বানরের যেমন নানা রকমের প্রজাতি আছে, অতীতে মানুষেরও তেমনি একাধিক প্রজাতি ছিলো। যেমন, নিয়্যান্ডারটাল মানুষ পঞ্চাশ হাজার বছর আগেও বেঁচে ছিলো। তারপর মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে তারা তাদের আলাদা অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। হবিট নামের খুদে মানুষও ছিলো মানুষেরই আর-একটি প্রজাতি। পঁচিশ হাজার বছর আগেও তারা জীবিত ছিলো।
বিজ্ঞান যাই বলুক না কেন, শাস্ত্রে কিন্তু মানুষের জন্ম হয়েছে বিবর্তনের মাধ্যমে— তা বলা হয়নি। বস্তৃত, ধর্মগুরুরা বলেছেন, সবই ঈশ্বরের সৃষ্টি। কেউ বা বলেছেন, ঈশ্বর বললেন, হও! অমনি হয়ে গেলো। কেউ বলেছেন, ঈশ্বর তাবৎ সৃষ্টি শেষ করলেন সপ্তাহ খানেকের মধ্যে। কেউ বললেন, ঈশ্বর এক বারেই নিখুঁত মানুষ এবং অন্য জন্তুদের সৃষ্টি করে পৃথিবীতে ফেলে দিলেন। এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তা বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড এবং আধুনিক জীবজন্তুদের সৃষ্টি করেছেন, তাদের এখন যেমন দেখা যায় হুবহু সেই চেহারায়। বিবর্তনের ধারণা ধর্মশাস্ত্রে নেই। শাস্ত্ৰমতে বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডেরও বিবর্তন হচ্ছে না— যদিও হাবল টেলিস্কোপ দিয়ে চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এখনো বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড সম্প্রসারিত হচ্ছে প্ৰচণ্ড গতিতে।
শাস্ত্রে এমনও বলা হয়েছে যে, সব জীবজন্তুই সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষের ভোগে লাগবে বলে। কুতর্কিকরা অবশ্য কিছুই এ কথা অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে চান না। তারা বলেন, এ কথা সত্য হলে, মানুষের জন্মের কোটি কোটি বছর আগে ডাইনোসরের জন্ম হলো কেন? অথবা আজও যদি ডাইনোসর থাকতো, তা হলে তারা মানুষের কোন কাজে লাগতো? হাল আমলের মশা, মাছি, ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস এসবই বা কোন কাজে লাগে? শান্ত্রকারেরা এর ব্যাখ্যা দেননি। সে জন্যে অবিশ্বাসীদের মনে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে সন্দেহ থেকেই যায়।
সত্যি বলতে কি, শাস্ত্রে সৃষ্টিরহস্যের যে-ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, বিজ্ঞান দিয়ে তা সমর্থন করা যায় না। ঐতিহাসিক প্রমাণও তার উল্টোটাই বলে। যেমন, শাস্ত্র অনুযায়ী মানুষের বয়স বড়েজোর দশ হাজার বছর। অথচ মানুষের তৈরি যেসব হাতিয়ার পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া গেছে, এমন কি, গুহার ভেতরে মানুষের আঁকা যেসব চিত্র পাওয়া গেছে, তার বয়স দশ হাজার বছরের অনেক বেশি। তাদের কোনো কোনো হাতিয়ার কয়েক লাখ বছরের পুরোনো।
প্রশ্ন করতে পারেন, এতো কাল পরে হঠাৎ বিবর্তনবাদ এবং সৃষ্টিতত্ত্বের বিতর্কের কথা তুলছি কেন? তুলছি, বিজ্ঞানের প্রমাণ অগ্রাহ্য করে চার দিকে পেছনের দিকে যাওয়ার যে-উন্মত্ত প্ৰয়াস দেখা যাচ্ছে, তা দেখে। ইন্দোনেশিয়া থেকে আলাস্কা, আর্জেন্টিনা থেকে ভুলাডিভষ্টক পর্যন্ত সর্বত্র এক দল মানুষের মধ্যে দেখা যাচ্ছে ঘড়ির কাটা ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রবল হুজুগ। ধর্মগুরুরা বিজ্ঞানকে অগ্রাহ্য করেছেন একেবারে প্রাচীন কাল থেকেই। সে জন্যে যখনই শাস্ত্রের সঙ্গে বিজ্ঞানের বিরোধ দেখা দিয়েছে, তখনই ধর্মগুরুরা বিজ্ঞানের পরীক্ষিত জ্ঞানকে অস্বীকার করেছেন, আর বিজ্ঞানীদের নিন্দা জানিয়েছেন।
এক সময়ে জনপ্রিয় বিশ্বাস ছিলো যে, সূর্য ঘোরে পৃথিবীর চারদিকে। কিন্তু ষোলো শতকের প্রথম ভাগে কোপারনিকাস যখন তার উল্টোটা বললেন, তখন তাঁর গ্রন্থ প্ৰকাশ করতে ব্যর্থ হলেন। শোনা যায়, তেরো বছর অপেক্ষা করার পর মৃত্যুশয্যায় তিনি তাঁর গ্রন্থ দেখতে পান। গেলিলিওর ভাগ্য ছিলো আরও খারাপ। তিনি যখন কোপারনিকাসের তত্ত্ব সমর্থন করলেন এবং দাবি করলেন যে, পৃথিবী বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে নয়, তখন পোপ সেটা মানতে পারলেন না। ফলে তাকে বাকি জীবন কাটাতে হয় গৃহবন্দী হিশেবে। কোনো কোনো শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, সূর্য রাতের বেলায় গিয়ে সৃষ্টিকর্তার সিংহাসনের তলায় বিশ্রাম নেয়। পরের দিন ভোরে সে আবার তার দায়িত্ব পালনের জন্যে নিজের জায়গায় ফিরে যায়। এই ব্যাখ্যার মধ্যেও পৃথিবী স্থির থাকার ইঙ্গিত রয়েছে। কোনো কোনো ধর্মে এমনও বলা হয়েছে যে, পৃথিবী গােলকের মতো নয়, পৃথিবী হলো সমতল ভূমির মতো। এসব কথা মেনে নিলে আমাদের মধ্যযুগে ফিরে যাওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প থাকে না।
জ্ঞানবিজ্ঞানের যথেষ্ট অগ্রগতির পরে ডারউইন যে বিবর্তনবাদের তত্ত্ব দিয়েছিলেন, রোম্যান ক্যাথলিক চার্চ প্রায় এক শো বছর পর্যন্ত তার সরাসরি কোনো প্রতিবাদ করেনি। কিন্তু তারপর ১৯৫০ সালে পোপ ফতোয় দেন যে, বিবর্তনবাদ মেনে নিলে মানুষকে ছোটো করা হয়। তবে বিজ্ঞানের অসাধারণ আবিষ্কারের কথা পোপ জানতেন। তাই তিনি নিজেও সৃষ্টিতত্ত্বকে আক্ষরিকভাবে মেনে নিতে পারলেন না। তিনি বললেন, সৃষ্টিতত্ত্বকে মেনে নিতে হবে প্রতীকী অর্থে।
পশ্চিমা বিশ্বের স্কুল-কলেজে সৃষ্টির রহস্য বোঝার জন্যে বিবর্তনবাদ পড়ানো শুরু হয়েছিলো। কিন্তু পোপ এই ফতোয়া দেওয়ার পর থেকে রোম্যান ক্যাথলিক এবং ইভ্যানজেলিকাল (তবলগীদের মতো) খৃস্টানরা বিবর্তনবাদকে অস্বীকার করতে আরম্ভ করেন। জন হুইটকম্ব এবং হেনরি মরিসের মতো শিক্ষিত ব্যক্তিও সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে নতুন করে গ্রন্থ রচনা করেন। সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করার জন্যে একাধিক সংগঠনও প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়: সৃষ্টিতত্ত্বকে প্রচার করে তাকে জনপ্রিয় করা। ১৯৮১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্কেনসতে একটি আইন পাশ হয়, যাতে বিবর্তনবাদ পড়ানোর সময় সৃষ্টিতত্ত্বের জন্যেও সমান সময় ব্যয় করার বিধান থাকে। কিন্তু এই আইন বাতিল হয়ে যায় আদালতে। পরে লুইসিয়ানায়ও অনুরূপ একটি আইন প্রণীত হয়। কিন্তু এ আইনও সুপ্রিম কোর্টে বাতিল হয়। বস্তৃত, ষাটের দশক থেকে অনেক জায়গাতেই সৃষ্টিতত্ত্বের প্রতি একটা নতুন উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়। পূর্ব বাংলায়ও এ সময়ে বরকতুল্লাহ নামে একজন লোক সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে–এই মতবাদ প্রচার করে বই লিখেছিলেন। তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে কয়েকজন লোকের সামনে তাঁর হাস্যকর বক্তব্য পেশ করতে শুনেছিলাম।
তা সত্ত্বেও, ১৯৬০-এর দশকেই এই পেছনে ফিরে যাওয়ার আন্দোলন অতো জোরালো হতে পারেনি। কিন্তু সম্প্রতি সারা বিশ্বে যে-মৌলবাদী চেতনা সুনামির মতো ছড়িয়ে পড়েছে, তার প্রভাবে অ্যামেরিকার মতো জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত দেশেও বিবর্তনবাদ বর্জন করে সৃষ্টিতত্ত্ব পড়ানোর দাবি উঠেছে। পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে রক্ষণশীল মনোভাব প্রচার করার এই ধরনের মনোভাব ভারতীয় উপমহাদেশেও লক্ষ্য করা যায়। ভারতে বিজেপির পৌরোহিত্যে হিন্দু জাতীয়তাবাদী মনোভাব থেকে পাঠ্যপুস্তক সংস্কার করার সরকারী উদ্যোগ নেওয়া হয়। বাংলাদেশেও এর প্রবল প্রয়ােগ লক্ষ্য করা যায়। ধর্মশিক্ষা নয়, তেমন বইয়ের গোড়াতেও থাকে সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা— ধান ভানতে শিবের গীতের মতো। ১৯৭১ সালে যে-দেশ গড়ে উঠেছিলো ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তির ওপর, সেই দেশই মুসলিম জাতীয়তাবাদী ভাবনার জোয়ারে প্রগতিশীল শিক্ষা ব্যবস্থাকে রক্ষণশীল করে তুলেছে। এর জন্যে পাঠ্যপুস্তকে মগজ ধোলাইয়ের ব্যবস্থা করা হয়। তা ছাড়া, সরকারী এবং বিদেশী অর্থে গড়ে ওঠে হাজার হাজার মাদরাসা।
মুশকিল হলো: সৃষ্টিতত্ত্ব মানলে বিজ্ঞানকে অস্বীকার করতে হয়। কিন্তু বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিকে কেউই অস্বীকার করতে পারছেন না। সৃষ্টিতত্ত্বে বিশ্বাসীরাও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগান তাদের মধ্যযুগীয় বিশ্বাস চাপিয়ে দেওয়ার জন্যে। তাই একই সঙ্গে পাশাপাশি চলছে। রক্ষণশীলতা এবং পুস্তকী বিজ্ঞানের চর্চা। যেশিক্ষার্থী বিশ্বাস করে সৃষ্টিতত্ত্বে, সে-ই আবার অভিসন্দর্ভ লেখে বিবর্তনবাদ নিয়ে। বিজ্ঞান মুখস্থ করে পরীক্ষায় পাশ করে; আর জীবনাচরণের জন্যে মুখ ফেরায় শাস্ত্রের দিকে।
সৃষ্টিতত্ত্ব পড়ানোর ফলে রাতারাতি মানব সভ্যতা মধ্যযুগে ফিরে যাবে–এটা মনে করার কারণ নেই। কিন্তু এই মধ্যযুগীয় মূল্যবোধের দিকে সতৃষ্ণ নয়নে তাকানোর প্রবণতা একটা মনোভাবের ইঙ্গিত দেয়। সেই মনোভাব আধুনিকতা, উদারতা, ইহলৌকিকতা এবং প্রগতির বিরোধী। কিন্তু আমার মনে হয়, এই প্রবণতা ধমীয় জাতীয়তাবাদের একটা সাময়িক জলোচ্ছাস মাত্র। বেশি দিন থাকবে না। কারণ, আমাকে না-পেয়ে ডারউইন মহাশয়ের যে-অসুবিধে হয়েছিলো, সেটা জন্তুদের বাহ্যিক কাঠামোর সাদৃশ্য দেখানো ব্যাপারে। কিন্তু এখন জীনতত্ত্ব দিয়ে অনেক দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করা যাচ্ছে যে, মানুষ আর কেঁচো যে-বস্তু দিয়ে তৈরি তা প্রায় একই। মানুষের সঙ্গে একটা ওরাং ওটাং-এর মিল আরও বেশি-শতকরা নিরানব্বই ভাগ। এমন প্রমাণের মুখে পেছনে ফিরে যাওয়ার মনোভাব চিরদিন টিকে থাকবে না; টিকে থাকতে পারে না।