০৮. দোতলা বাড়িটা আগের মতোই আছে

দোতলা বাড়িটা আগের মতোই আছে।

নারিকেল গাছ দুটি বড় হয়েছে। আগে যেখানে ফুলের বাগান ছিল সেখানে টিনের ছাদ দেওয়া গ্যারাজ। বাড়ির পাঁচিল ভেঙে আরো উঁচু করা হয়েছে। এছাড়া সব আগের মতো।

সোমা গেট দিয়ে ঢুকে একটু ইতস্তত করতে লাগল। সরাসরি সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে যাওয়া কি ঠিক হবে? শোভন হবে? একতলায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না। দেখা গেলে জিজ্ঞেস করা যেত প্রফেসর সাহেব কি আছেন? একতলার বাসিন্দাদের জানার কথা না প্রফেসরআছেন কি নেই, তবু জিজ্ঞেস করা।

সোমা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। এক বার শুধু মনে হল, কেন সে যাচ্ছে? মনের ভেতরের সেই প্রশ্ন তাকে কাবু করেই ফেলত যদি না দোতলার সিঁড়ি দিয়ে কাজের মেয়েটি না নামত। খালি বালতি হাতে সে নামছে। সোমাকে দেখে বলল, কারে চান। আফা?

প্রফেসর সাহেব কি আছেন?

জ্বি আছেন। একটু আগে দেখছি।

কাজের মেয়েটি তাকিয়ে আছে। তার চোখের সামনে থেকে নেমে চলে যাওয়া যায় না। সোমা দরজার কলিং বেলে হাত রাখল।

দরজা খুলল।

সোমা শুকনো গলায় বলল, আপনি আমাকে চিনতে পারছেন?

ভদ্রলোক ভারি গলায় বললেন, এস সোমা। এস।

সোমার পা যেন মেঝেতে আটকে গেছে। সে নড়তে পারছে না। ভদ্রলোক চশমার ভেতর দিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। বয়স তাঁর মধ্যে তেমন ছাপ ফেলতে পারে নি। শরীর একটু ভারি হয়েছে। কানের কাছের কিছু চুল রুপালি হয়ে গেছে। এতে তাঁকে আরো যেন সুন্দর দেখাচ্ছে।

দাঁড়িয়ে আছ কেন সোমা? এস ভেতরে এস।

আমি ভেবেছিলাম আপনি আমাকে চিনতে পারবেন না।

কেন চিনতে পারব না বল তো? তুমি তো বদলাও নি। আগের মতো আছ। তোমার বয়স বাড়ে নি। এখন খুকির মতোই লাগছে। বস, এখানে বস।

আজ যাই। অন্য একদিন আসব।

সোমা বসতে-বসতে বলল, বাসায় কেউ নেই?

কাজের একটা ছেলে এসেছে। কি যেন আনতে গেছে। এসে পড়বে। ও এলেই তোমাকে চা দেব।

আপনার মেয়ে কোথায়?

ওকে মেয়েদের ক্যাডেট কলেজে দিয়েছি। ময়মনসিংহ। জান বোধহয়।

হ্যাঁ জানি।

একটু বস, আমি সিগারেট নিয়ে আসি। আগে সিগারেট খেতাম না। এখন হয়েছি চেইন মোকার।

উনি সিগারেট আনতে অনেক দেরি করলেন। সোমা একা একা বসে রইল। আশ্চর্য! এই বাড়ির বারান্দায় একা একা বসে থাকতে খারাপ লাগছে না।

সোমা।

জ্বি।

তোমার কথা প্রায়ই ভাবতাম। তুমি আমার স্ত্রীর উপর কোন রাগ রেখ না। ওর মাথার ঠিক ছিল না।

আমি জানি।

দিনের পর দিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে এই অবস্থা হল। ঐদিন তোমার জন্যে যে কি খারাপ লেগেছে……

ঐ-সব বাদ দিন।

বাদ দিতে পারলে তো ভালোই হত। কিছুই বাদ দেওয়া যায় না। সব থাকে।

সোমা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।

তিনি বললেন, তোমার খবর আমি সবই রেখেছি। অবশ্যি কখনো কোনোরকম যোগাযোগের চেষ্টা করি নি। ইচ্ছা করেই করি নি। এমনিতেই যথেষ্ট সমস্যা হয়েছে। আমি আর তা বাড়াতে চাই নি।

সোমা কথা ঘোরাবার জন্যে বলল, আপনার লাইব্রেরি আগের মতোই আছে?

আছে। বই অনেক বেড়েছে। আগে বই পড়ার সুযোগ হত না। এখন সুযোগ পাই। প্রচুর পড়ি। ঠিক তুমি আগের মতো আসবে। এসে বই নিয়ে যাবে। এস আমার সঙ্গে বই দিয়ে দিই।

আজ থাক। আরেক দিন এসে নেব। আজ বই নিতে ইচ্ছে করছে না।

ইচ্ছে করছে না কেন?

আমার বই পড়ার অভ্যাস নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আর বই পড়তে ভালো লাগে। না।

তিনি সোমার সঙ্গে-সঙ্গে একতলায় নেমে এলেন। সোমা বলল, আপনাকে আসতে হবে না, আপনি কেন কষ্ট করছেন।

তিনি হাসিমুখে বললেন, একটু কষ্ট না হয় তোমার জন্য করলাম। তুমি তো আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছ। করনি?

রাস্তায় নেমেই সোমা লক্ষ করল বিজু রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সোমার চোখে চোখ পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে বিজু চোখ নামিয়ে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করল। বিজুর হাতে সিগারেট। সে আধ-খাওয়া সিগারেট দূরে ছুঁড়ে ফেলল। তার মুখ গম্ভীর। থুথু করে সে কয়েক বার থুথু ফেলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *