সালমা দূরের সাদা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবল, জলিল মিয়া কাল একটা খরগোশের বাচ্চা নিয়ে এসেছিল। বলেছিল, আপামণি তোমার সুখ এনেছি। সালমা ওটার দিকে ভালো করে না তাকিয়েই বলেছিল, খাঁচায় রেখে দাও। এখন ওটাকে ভয়ানক দেখতে ইচ্ছে করে সালমার। নরম তুলতুলে পেলব শরীরে হাত বুলোতে ইচ্ছে করে। ওটাকে যদি বুকের খাঁচায় ঢুকিয়ে রাখা যেত? সালমা ভাবল জীবনটা তো এমনই। কখনো খাচা খালি থাকে। কখনো ভর্তি হয়ে যায়। অনবরত যাওয়া আসাই তো জীবন। রকিব তুই কিছু বুঝিস না। বুঝতেই চাস না। জীবন মানেই বাতাসের মতো এলোমেলো বওয়া। কখনো বৈশাখী। কখনো দখিনা পবন। দুটোই সমান। সালমার গলা ধরে আসে। কষ্ট। কষ্ট। ওই খরগোশের সাদা শরীরটার মতো কষ্ট। খরগোশের সাদা শরীরটা যেমন ভালোবাসা তেমনি বেদনাও। ওই খরগোশটাই সব।
মাথার ওপর দিয়ে একটা প্লেন উড়ে যায়। সালমা মুখটা ঘোরায়। প্লেনের শব্দ দূরে মিলিয়ে যাবার পর বলে, তোর প্রিপারেশন কেমন হয়েছে রকিব?
রকিব মুখ ঘোরায়। চোখের দৃষ্টিতে মেদুর ছায়া। নির্জন দ্বীপের সাগর-ঢেউ আটকে আছে ওখানে। মাথা নাড়িয়ে বলে, ভালো।
আমার মনে হচ্ছে, আমিও খুব খারাপ করব না।
তা আমি জানি। মাস দুই পড়লে তুই ফার্স্ট ক্লাস পেতিস। এখন বোধহয় তা পারবি না।
সালমা হাসে। কথা বলে না। রকিব উঠে দাঁড়ায়।
যাবি?
হ্যাঁ, যাই। অনেকটা সময় নষ্ট করলাম।
নষ্ট? কী জানি অনেকটা সময় সঞ্চয় করলাম বোধহয়।
তাই নাকি? নতুন কথা শোনাচ্ছিস যে?
আমি কি কখনো তোকে পুরনো কথা শুনিয়েছি?
তা বটে। আসি সালমা।
রকিব লাইব্রেরিতে গিয়ে ঢোকে। সালমা সেমিনারের দিকে যায়।
পরীক্ষার দিন পনেরো আগে থেকে সালমা দরজা বন্ধ করে পড়াশোনা শুরু করেছে। কারো সঙ্গে খুব একটা দেখা সাক্ষাৎ হয় না। আনুর মা ঘরেই খাবার দিয়ে যায়। বাবাও ওঁর ডিসটার্ব হবে বলে খাবার টেবিলে ডাকে না। সাকিব মাঝেমধ্যে আসে। টুকটাক কথা বলে। চলে যায়। সালমা কেমন হাঁপিয়ে ওঠে। মনে হয় পারবে না। আবার বেয়াড়া মনটাকে বাগে আনে। শান্ত মেয়ের মতো পরীক্ষার পড়া শেখে। মাঝে মাঝে বিকেলে বাগানে নামে। অবশ্যই যেদিন টের পায় যে বাসায় কেউ নেই, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জলিল মিয়ার কাজ দেখে। কামিনী ফুলের ওপর মৌমাছি দেখে। সুখ-দুঃখের বাক্সের কাছে গিয়ে বাচ্চাগুলোকে আদর করে। একদিন হঠাৎ করেই নাসিমার বাসায় গিয়ে ওঠে।
নাসিমা ওকে দেখে অবাক হয়।
কীরে এতদিন কোথায় ছিলি? শুকিয়ে গেছিস যে?
পরীক্ষার পড়া নিয়ে ব্যস্ত।
তুমি এসে ভালো করেছ সালমা। সাব্বির একমুখ ধোয়া ছেড়ে কথা বলে। মুখটা প্রফুল্ল।
কেন সাব্বির ভাই?
দেখছ না বাঁধাছাদা চলছে।
কী ব্যাপার নাসিমা’পা?
আমরা এ বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি সালমা।
চলে যাচ্ছ? কোথায়?
বনানীতে।
কেন এ বাসা কী দোষ করল?
নাসিমা লাজুক হাসল।
ছোট দু’কামরায় কি আর হয় রে? এখন আমাদের একটা বড় বাসা দরকার।
ব-ড়-বা-সা-।
সালমা বিড়বিড় করল। তারপর হঠাৎ গভীর চোখে নাসিমার দিকে তাকাল। নাসিমাকে একটু রোগা রোগা দেখাচ্ছে। বাসি শিউলির বোটার মতো ফ্যাকাশে। প্রশ্নটা সালমার মনের মধ্যে আনাগোনা করে। ওর এখন আকাক্ষিত স্বপ্নের দিকে পানসি ভাসিয়েছে। সে পানসির গতিতে এখন অনুকূল হাওয়া। তরতর করে ছুটছে। তাই ওদের এখন বড় বাসা চাই। অনেক বড় বাসা। বড় বাসা না হলে ওদের কাক্ষিত ফসলের সংকুলান সম্ভব নয়।
কী ব্যাপার তুমি যেন চিন্তায় পড়েছ সালমা?
আপনারা চলে যাবেন ভাবতেই খারাপ লাগছে।
তাই তো তোমার আপাও খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করেছে। কিছুই খেতে পারছে না।
যাহ, কী যে ফাজিল তুমি!
নাসিমা গোপন কটাক্ষ ছুঁড়ে মারে। সালমা দেখেও না দেখার ভান করে। ব্যাপারটা ওর কাছে এখন পরিষ্কার।
কবে যাচ্ছেন আপনারা?
আগামীকাল।
ফোন বেজে ওঠে। সাব্বির ফোনে কথা বলে। নাসিমা একটু কাজ করে কেমন হাঁপিয়ে ওঠে। ডিভানের ওপর পা ছড়িয়ে বসে। সালমা চারদিকে তাকিয়ে দেখল। নাসিমার বাসায় আজ আর কোনো ফুল সাজানো নেই। ফ্লাওয়ার ভাসগুলো সযত্নে একটি ঝুড়িতে ভরা হয়েছে। সাব্বির ফোন ছেড়ে এসে আবার বই গোছাতে আরম্ভ করেছে। বইয়ের শেলফগুলো আজ খালি।
কী ব্যাপার তুমি যে একদম হাত-পা ছেড়ে দিয়েছ নাসিমা?
একটু জিরিয়ে নিই।
দেখ সালমা, শোনো কথা। ভাবখানা এই যেন মাঠে হাল চালাচ্ছে।
আপার শরীরটা একটু খারাপ মনে হচ্ছে?
তা আর হবে না—
দেখো ভালো হবে না বলছি।
নাসিমা উঠে দাঁড়ায়। সাব্বির হাসতে শুরু করে।
বসো বসো। উঠতে হবে না তোমার।
সালমার মনটা খারাপ হয়ে যায়। কোনো কাজ খুঁজে পায় না। কী করবে বুঝতে পারে না। এই পরিবেশে নিজেকে ভয়ানক অবাঞ্ছিত মনে হয়।
আমি যাই নাসিমা’পা।
কেন, যাবি কেন? বস না।
তুমি তো আচ্ছা মেয়ে সালমা, আমাদের ঠিকানা পর্যন্ত নিলে না?
দিন।
সাব্বির কাগজের ওপর ঠিকানা লিখে সালমাকে এগিয়ে দেয়।
নাও। যখন সময় পাবে তখুনি চলে আসবে।
তোকে মাঝে মাঝে আমাদের মধ্যে পেলে খুব খুশি হব সালমা।
দেখ পরে যেন বিরক্ত হয়ে যেও না।
পাগল। কী যে বলিস।
ঠিক? মনে থাকবে তো?
পরীক্ষা নিস।
আচ্ছা।
ওর সঙ্গে তুমি অত কথা বলো না তাসিমা। দেখো, সালমা হয়তো কোনোদিনই আমাদের ওদিকে যাবেনা।
কীরে ঠিক নাকি?
সালমা হাসে। কথা বলে না। অনেকক্ষণ গল্পসল্প করে বেরিয়ে আসে ও। দরজায় আজ লাল পর্দা নেই। ওরা সব খুলে নিয়েছে। সব বাধাছাদা করছে। ওরা একটা বাসায় যাচ্ছে। সালমা ভাবল ছোট বাসায় ওদের সুখ হয়তো আর আটকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। তাই এখন বিস্তার চাই। দেয়ালভাঙা বিস্তার।
বারান্দায় সিঁড়ির ওপর বসে রইল ও। এখনো কেউ বাড়িতে ফেরেনি। কৃষ্ণচূড়ার মাথার ওপাশে সালমা সূর্য ডোবা দেখেনি। আকাশটা লাল হলো। লাল থেকে বেগুনি। তারপর কালচে। সব শেষে নিকষ কালো। জলিল মিয়া ঘরে ঘরে বাতি জ্বালিয়েছে। দূরে একঝক বাদুড় উড়ে যেতে দেখল সালমা। কাঁপা কাঁপা ডানার ফাঁকে টুকরো আকাশ সালমার মনের মধ্যে আঁধার হয়ে নামল। কলাবতী ঝোপ থেকে আর কোনো লাল ফুল মাথা দোলাল না। সালমা টেবিলের সামনে এসে বই খুলে বসল।
সালমার যেদিন পরীক্ষা শুরু হলো সেদিন এ বাড়িতে মিস্ত্রি এলো। গোটা বাড়ি রং করা হবে। দরজা-জানালা ঠিক করা হবে। সাকিব কায়দা করে জিজ্ঞাস করল, বল না দিদিভাই, কী রং করলে বাড়িটা সুন্দর দেখাবে?
সালমা বাঁকা করে তাকাল, এত আয়োজন কেন রে? তোর সঙ্গে মিতালির বিয়েটা তাহলে হয়েই যাচ্ছে?
যা, কী যে বলিস? আমি তো তোর ছোট।
সালমা থমকে গেল। সাকিব বেশ কৌশলে উত্তর দিতে শিখেছে তো। সেই আশ্চর্য ছেলেমানুষিসুলভ কমনীয়তা বিন্দুমাত্র নেই। বড় বড় গোঁফ রেখেছে আবার। গায়ে ভারী হয়েছে বেশ। ও এখন আপন অন্তরে বলিষ্ঠ পৌরুষত্ব লালন করছে। সাকিব নিজেকে অতিক্রম করতে চলেছে। লক্ষণটা মন্দ না। ভালো। সালমার খুশিই লাগল।
গোলাপি রংটা বেশ সুন্দর, ওটাই দিয়ে দিই। কী বলিস দিদিভাই?
কেন সাদা কী দোষ করল?
সাদা? সাকিব আমতা আমতা করে।
খারাপ কী?
যৌবনের রং চাই দিদিভাই। ওইসব সাদাটাদা দিয়ে পোষাবে না। তাছাড়া উৎসব মানেই রঙের সংমিশ্রণ; সে বাহ্যিক এবং মানসিক দুটোই।
সালমা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে। বিশ্বাস হতে চায় না যে সাকিব এত কথা বলছে।
তাহলে ওই গোলাপিটাই থাক দিদিভাই?
তোর যা খুশি।
সাকিব চলে গেলে সালমার বুকটা ভার হয়ে আসে। ওকে না জানিয়ে ওর সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাহিদ চৌধুরী। তারই তোড়জোড় চলছে বাড়িজুড়ে। ঘনঘন খালারা আসছে। মামা, ফুফু আসছে। কেনাকাটা হচ্ছে। বাবা গম্ভীর। সালমার সঙ্গে হেসেও কথা বলে না। যেন ওর সম্পর্কে যা ভাবা হয়েছে তাই চূড়ান্ত। এ নিয়ে সালমার নিজস্ব কোনো বক্তব্য থাকতে পারে না অথবা কোনোকিছুই ভাবার অধিকারও ওর নেই। সালমা একদিন পাশের ঘর থেকে বড় মামা আর বাবার কথাবার্তা শুনেছিল। বড় মামা বলেছিলেন, এ বিয়েতে সালমা মত দিয়েছে তো?
ওর আবার মতামত কী? আমরা যা করব তাই মেনে নিতে হবে।
কাজটা কি ভালো হচ্ছে?
খারাপটা কী হলো শুনি? আদর দিয়ে দিয়ে ওকে আমি অনেক নষ্ট করেছি। ও আমার কোনো মর্যাদা রাখেনি। কোনো সুযোগ ওকে আর দেওয়া হবে না।
বাবার কথাগুলো জল্লাদের নিষ্ঠুর কণ্ঠস্বরের মতো ভেসে আসছিল। বড় মামা হয়তো চুপ করে গিয়েছিলেন। কেননা আর কোনো কথা ও শুনতে পায়নি। অবশ্য বাবার কথায় সালমার বুক কাঁপেনি। অত দুর্বল স্নায়ু ওর নয়। তবে বাবা নিপুণ কৌশলী। ভূমিকা বদলেছে সযত্নে। সব দেখেশুনে সালমা নীরবতা অবলম্বন করেছে। ফুফুদের, মামাদের সঙ্গে হেসে হেসেই কথা বলে। যেন এ বাড়িতে এমন কিছু হচ্ছে, যার বিন্দুবিসর্গ ও জানে না। পরীক্ষার পড়া ছাড়া ও কিছু বোঝে না। সালমা সবার সঙ্গে আচরণে একটা ছোট্ট সরল বোকা মেয়ে হয়ে যায়। সাকিব মাঝে মাঝে অবাক হয়। সালমাকে ও চেনে। এ আচরণ ওর যথার্থ না ভান বুঝতে পারে না। দিদিভাই এত সহজে সবকিছু মেনে নিচ্ছে? পরক্ষণে ভাবে আসলে সব মেয়েই এক। বিয়ের কথা শুনলে খুশিই হয়। কখনো সালমাকে বলে, দিদিভাই তোকে আজকাল ছটফটে সি-খুশি দেখায়।
পরীক্ষাটা ভালো হচ্ছে তো!
পরীক্ষাটা ভালো, না অন্য কিছু?
সালমা একটুক্ষণ গালে হাত দিয়ে ভেবে বলে, না অন্য কিছু তো খুঁজে পাচ্ছি না।
পাচ্ছিস। পাচ্ছিস। আমাকে বলবি না।
সাকিবের মুখে চাপা হাসি ফুটে ওঠে। সালমা মনে মনে হাসে। তুমি ছেলে সেয়ানা হচ্ছে। আমার সঙ্গে টেক্কা লড়তে এসেছ। লড়ো। দেখি কে জেতে। সাকিব সালমার বেণি টেনে দিয়ে হাসতে হাসতে চলে যায়।
থার্ড পেপার পরীক্ষার পর হল থেকে বেরোতে রকিব এসে ওকে ডাকে। তোর সঙ্গে একটু কথা ছিল সালমা।
ওকে দেখে চমকে ওঠে সালমা। চোহরায় অদ্রিার ছাপ। চোখজোড়া লাল। চুলে তেল নেই। পাঞ্জাবির বোম খোলা। সালমা কথা না বলে ওর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে করিডরের শেষ মাথায় আসে। একটা থামের গায়ে হেলান দিয়ে সালমা দাঁড়ায়। রকিবের রুক্ষ কণ্ঠ চড়চড় করে ওঠে। শব্দটা অনেকটা মড়মড় করে গাছ ভেঙে পড়ার মতো।
আমার সঙ্গে ছলনার কী দরকার ছিল সালমা?
ছলনা?
গতকাল নিউমার্কেটে সাকিবের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। ও সব বলল।
আমি কিছু জানি না।
বিয়ের তারিখ পর্যন্ত ঠিক হয়ে গেছে।
আমি জানি না।
কার্ড ছাপানো শেষ?
আমি জানি না।
কেনাকাটা সব শেষ?
আমি জানি না।
বিয়ের পর তুই কানাডা যাচ্ছিস?
আমি জানি না।
সালমা তুই এত নিষ্ঠুর কেন? আমার জন্য তোর কি এখনো কোনো সময় হয়নি?
অকস্মাৎ রকিবের কণ্ঠ খাদে নেমে যায়। সালমা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কথা বলে না।
এত বড় একটা খবর তুই আমাকে গোপন করে গেলি সালমা! আর সাকিব আমাকে করুণা করল। ব্যঙ্গের হাসি হাসল। তোর ওপর আমি জোর করতে পারি। জোর করে একটা হেস্তনেস্ত করতে পারি। কিন্তু তাতে লাভ? ভালোবাসা তো জোরের ব্যাপার নয়। ভালোবাসা তো প্রভুভূত্যের সম্পর্ক নয়। ভালোবাসা পবিত্র সেখানে দুজনের অধিকার সমান। সেটা পারস্পরিক সমঝোতার ব্যাপার।
তুই থাম রকিব।
সালমা জোরে চেঁচিয়ে কথা বলে, রকিবও সমানভাবে উত্তর দেয়।
আমি তোর শেষ কথা জানতে চাই?
ফোর্থ পেপারটা হয়ে যাবার পর আমি তোকে আমার কথা জানাব।
সত্যি?
বিশ্বাস করতে পারছিস আমাকে?
ওই বিশ্বাস না থাকলে তো আমার ভালোবাসা মিথ্যে।
মাথা ঠাণ্ডা করে পরীক্ষাটা শেষ কর রকিব।
সালমা মুরব্বির মতো কথা বলে। এতক্ষণ পর রকিব হঠাৎ হো হো করে হাসে। সালমা হাসতে পারে না। সাদা দেয়ালে দৃষ্টি ফেলে রাখে। রকিব হাসছে। বেশ প্রাণখোলা হাসি। ওর কষ্টের দ্বীপে ওই হাসি নিঝুম বনের কেওড়া পাখি। বিষণ্ণতা কাটিয়ে দিয়ে যায়। পাখা মেলে দিলে চকচকে ডানায় সূর্যের আলো ভরে ওঠে।
চল ওই মাঠে গিয়ে বসি সালমা?
আজ থাক।
কেন?
ভালো লাগছে না।
সালমা?
আমার ভেতরে ভীষণ একটা অস্থিরতা। তোকে আমি তো বোঝাতে পারব না রকিব। খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার আগে সব প্রাণীর মধ্যে বোধহয় এমন রিনরিনে যন্ত্রণার কাঁপুনি থাকে। আমি এখন সেই ভয়ানক সময়ের শিশিরে গা ড়ুবিয়েছি।
সালমা চল তোকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
না থাক, আমি একলাই যেতে পারব। এখনো আমার সময় হয়নি রকিব।
সালমা হাঁটতে আরম্ভ করে। রকিবও ওর পাশে পাশে হাঁটে। সালমার পিঠে লম্বা বিনুনি দোলে। ছাপা শাড়িতে ওকে আজ জংলি মেয়ের মতো দেখাচ্ছে। চুলগুলো বারে বারে কপালে এসে পড়ে। রকিবের লোভ হয়। ইচ্ছে করে বুকে টেনে নিয়ে চুমু খেতে, ঠোঁট ঘষে ঘষে ওই কপাল থেকে চুলের গুচ্ছ সরিয়ে দিতে, লম্বা নখ সংবলিত সরু আঙুলগুলো নিজের মুঠিতে ধরে রাখতে। কিন্তু হয় না। আশপাশ দিয়ে ছেলেমেয়েরা যাওয়াআসা করছে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় একটু ক্লান্ত দেখায় সালমাকে। একটু অন্যমনস্কও। ও গভীরভাবে কিছু ভাৰছে। রকিব ভাবল। একটা রিকশা ডেকে তুলে দেওয়ার পরও সালমা বেশি কথা বলল না। কেবল বলল, আসি।
রকিব ভেবেছিল সালমা আরো কিছু বলবে। আরো একটু অন্তরঙ্গ হবে রকিবের সঙ্গে। কীভাবে সমস্যার সমাধান করবে সে সম্পর্কেও। জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু সালমা কিছু বলল না। শুধু একরাশ ক্লান্তি ফেলে রেখে গেল রকিবের জন্য। ওর ক্লান্ত মুখটা বারবার ভেসে ওঠে রকিবের সামনে।
রিকশা থেকে নামতেই সালমা দেখল বাবা সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে। মিস্ত্রিদের কাজের তদারক করছে। জলিল মিয়া ফুলের বেড পরিষ্কার করছে। সালমা খুব সন্তর্পণে কাঠের গেটটা খুল। এ বাড়ির প্রতিটি জিনিসের ওপর ওর খুব মায়া হচ্ছে। গেটটায় তবু ক্যাচ করে একটা শব্দ হলো। জলিল মিয়া ওর দিকে তাকিয়ে হাসল। সালমা সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়ে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, পরীক্ষা কেমন হলো?
ভালো।
সালমা পাশ কাটিয়ে ঘরে উঠে গেল। এর বেশি কোনো কথা কেউ বলল না। অন্যদিন হলে বাবা খুঁটিনাটি অনেক কথা জিজ্ঞেস করতেন। সালমা বইখাতা টেবিলে ছুড়ে মেরে বাথরুমে ঢুকল। মুখ-হাত ধুয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকল অনেকক্ষণ। মাথা ধরেছে। নসিয়ার মতো লাগছে।
আনুর মা চা দিয়ে গেল। হয়তো আনুর মার কাছে শুনে মা এলো।
কীরে শরীর খারাপ নাকি?
মাথা ধরেছে।
মাথার আর দোষ কি। চার ঘণ্টা একনাগাড়ে পরীক্ষা দেওয়া কি কম কথা? একটা নোভালাজিন খেয়ে নে।
পাঠিয়ে দাও।
একটু পরে মা নিজেই এলো নোভালজিন নিয়ে। সযত্নে খাইয়েও দিলো। মাথার কাছে বসে কপালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। সালমা বুঝে পেল না হঠাৎ এত আদর কেন? ওর খুব খারাপ লাগল। এই মুহূর্তে কেউ না থাকলেই ভালো। এক একটা সময় আসে কেউ না থাকলে খারাপ লাগে–এক এক সময় কেউ থাকলে। সালমা চাইল মা চলে যাক। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারল না। ভাবল আর কটা দিনই বা। ও ইচ্ছে করেই পাশ ফিরে শুলো। ঘুমের ভান করল। মা আস্তে উঠে গেল। যাবার সময় দরজা বন্ধ করে দিল। সালমা ভাবল সোমবার পরীক্ষা, আজ বৃহস্পতিবার। মাঝে আর কটা দিন। অসংখ্য চিন্তা এলো মনে। কয়েক হাজার মতো তা গেঁথে গেল মনে। স্মৃতিটা বড় কষ্টদায়ক। সালমা বিছানা ছেড়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালু আবারো ভাবল, স্মৃতিটা বড় কষ্টদায়ক। একবার বাবা ওকে একজোড়া লাল জুতো কিনে দিয়েছিল। ঘুরেফিরে সে জুতো জোড়ার কথা মনে পড়তে লাগল ওর। স্মৃতিটা কখনো লাল।
আস্তে দরজা ঠেলে জলিল মিয়া ঢুকল। হাতে এক তোড়া ফুল। দুই গাছি বকুলের মালাও।
আপামণি।
কী ব্যাপার জলিল ভাই?
তোমার জন্য ফুল এনেছি।
সালমা হাত বাড়িয়ে ফুল নিল। জলিল মিয়া ওকে আর কখনো ফুল দিয়েছে কি না তা মনে পড়ল না সালমার। ও ধরে নিয়েছে সালমার বিদায়লগ্ন আসন্ন। সে জন্য ফুল দিতে এসেছে।
আপামণি।
বলো।
এবার তো সত্যি তুমি আমাদের ছেড়ে যাচ্ছ আপামণি।
জলিল মিয়া গামছা দিয়ে চোখ মোছে। গলাটা কেশে পরিষ্কার করে। সালমার নিরুত্তর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, সাকিব ভাই বলেছিল বাসরঘর সাজানোর জন্য অনেক ফুল দরকার, তোমার কী কী ফুল পছন্দ বলো?
আমার সব ফুল পছন্দ জলিল ভাই।
তবু কোনটা বেশি ভালো লাগে?
গোলাপ। লাল গোলাপ।
আচ্ছা।
জলিল মিয়া হেসে মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। ও খুব খুশি হয়েছে। ওই গেঁয়ো লোকটাকে কষ্ট দিতে চায় নি ও। সালমার একটা মুখের কথায় ও যদি ক্ষণিকের আনন্দ পায় তাহলে দোষ কী? বকুলের মালা দুটো ও হাতে জড়িয়ে রাখল। তোড়াটা নাকের কাছে উঠিয়ে গন্ধ শুকল। গন্ধে বুকটা ভরে যায়। পবিত্র মনে হয় নিজেকে। জীবনের কতগুলো সময় এমনি পবিত্র। কেউ তাকে কলুষিত করতে পারে না।
রোববার সারাদিন সালমা নিজের ঘরে কাটাল। কেউ ওকে বিরক্ত করল না। আনুর মা কয়েকবার এসে এটা-ওটা দিয়ে গেল। মনে মনে বলেছিল, সব শাড়ি তুমি নিয়ে যাও আনুর মা। ওতে আমার আর দরকার নেই। কিন্তু বলতে পারেনি। আনুর মার ওপর মায়া হয়েছিল। বেচারি বিশ্বাস করতে পারবে না। মনে মনে কষ্ট পাবে। কষ্ট কাউকে ও আর দিতে চায় না।
রাতে সাকিব আসে গয়নার বাক্স হাতে নিয়ে।
দেখ তো দিদিভাই কেমন হয়েছে?
খু-উ-ব সুন্দর!
তোর পছন্দ হয়েছে?
হ্যাঁ।
যাক, বাঁচলাম।
ডিজাইন কে পছন্দ করেছে রে?
বড় খালা আর মা। আমিও সঙ্গে ছিলাম।
তুই সঙ্গে থাকলে কোনো জিনিস কি খারাপ হবার উপায় আছে?
থাক, বেশি পাম্প দিতে হবে না।
সাকিব কুশিতে ডগমগ হয়ে বেরিয়ে যায়। সালমা বইয়ের পাতায় মনোযোগ দেয়। কিন্তু বেশিক্ষণ পড়তে পারে না। সব মুছে গিয়ে বইয়ের পাতার ওপর কেবল দক্ষিণ সাগরের একটি দ্বীপের ছবি ভেসে ওঠে। সাগর দিয়ে ঘেরা, নারকেলবীথির ছায়া দিয়ে ভরা একটি মনোরম দ্বীপ।
সোমবার সকাল থেকে সালমা এক লাইনও আর পড়তে পারে না। বুকটা কেমন যেন করে। বাথরুমে অনেকক্ষণ কাটিয়ে দেয়। অনবরত গায়ে মাথায় পানি ঢেলেও তৃপ্তি হয় না। ভিজে ভিজে ঠোঁট দুটো সাদা হয়ে ওঠে। মা এসে বকা দেয়। তোয়ালে দিয়ে চুলের গোছা পঁাচাতে পাচাতে বেরিয়ে আসে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ায়। আনুর মা হরলিকস দিয়ে যায়। সালমা খেতে পারে না। কেমন তেতো লাগে। বুকটা ধড়ফড় করে। নসিয়ার মতো লাগছে। আলমারি ঘেঁটে যা টাকা পায় সব কটি টাকা পার্সে ভরে নেয়। শাড়ি পরতে না পরতে সাকিব এসে হাজির হয়।
দিদিভাই তোর হয়নি? বাবা দাঁড়িয়ে রয়েছে তোর জন্য।
কেন?
বাবা তোকে ইউনিভার্সিটি পৌঁছে দেবে।
আজকে হঠাৎ।
জানি না।
সালমা থমকে যায়। আজ পরীক্ষা শেষ। বাবা হঠাৎ এমন উৎসাহী হয়ে উঠল কেন? সালমা তো বরাবর রিকশা করে ইউনিভার্সিটি যায়। একবার ভাবল যাবে না বাবার সঙ্গে। আবার ভাবল না থাক। অহেতুক কোনো ঝামেলার মধ্যে না যাওয়াই ভালো। সুবোধ মেয়ের মতো সালমা বাবার সাদা ড্যাটসানে গিয়ে ওঠে। গাড়িটা গেট পেরিয়ে যাবার সময় সালমা পেছনে ফিরে দেখে মা আর সাকিব বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ও ফিরে তাকাতে মা হাসল। সাকিব হাত নাড়ল। সালমাও হেসে হাত নাড়ল। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। বাবা কথা বলছে না। মুখে পাইপ। সালমা ইউনিভার্সিটিতে নেমে যাবার সময়ে বাবা বলল, তিনটের সময় আমি তোমাকে আবার নিতে আসব। তুমি ওই সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থেক।
আচ্ছা।
সালমা আর কথা না বলে চলে যায়। ওর মনে হচ্ছে, ওর অন্তরে আর কোনো রাগ নেই। কোনো ক্ষোভ, কোনো বিদ্বেষ নেই। ও সবকিছু ভীষণ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারছে। সকলের দিকে ভালোবাসার দৃষ্টি নিয়ে তাকাতে পারছে এবং নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। হলে ঢোকার আগে রকিব একবার কাছে এসে নিচু গলায় বলল, তোকে অপূর্ব দেখাচ্ছে সালমা।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। মনে হচ্ছে তোর চেহারাটা যেন পাল্টে গেছে।
চেহারা নয়, পাল্টেছে মন। যাকগে, শোন রকিব, আজ যে করে হোক ঠিক দশ মিনিট আগে পরীক্ষার হল থেকে বেরোতে হবে।
বলিস কী? কী ব্যাপার?
ভীষণ জরুরি। তোকে পরে সব বলল। পারবি না বেরোতে?
তোর জন্য কি না পারি?
সুযোগ পেলে বাহাদুরি নিতে ছাড়িস না।
দুজনেই হাসতে হাসতে হলে ঢুকে যায়।
তিনটে বাজার দশ মিনিট আগে সালমার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে রকিব। ঘাড়-বাঁকানো তেজি ঘোড়ার মতো দেখাচ্ছে ওকে। এখুনি বুঝি দিগ্বিদিক ছুটবে। সকালের সেই দীপ্র সৌন্দর্যের কমনীয়তা এখনো মুখজুড়ে। কোথাও কোনো পরিবর্তন নেই। অথচ আশ্চর্য তার বিকাশ। একই সঙ্গে আগুনের লাল এবং নীল শিখার মতো। একদিকে সৌন্দর্য, অন্যদিকে তেজ।
কী, অমন করে চেয়ে রয়েছিস কেন?
আমি বিশ্বাস করতে পারছি না সালমা।
বেশি কথা বলার সময় আমাদের নেই।
তুই ভালো করে ভেবেছিস তো সালমা।
সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করি না রকিব।
উঃ, সালমা কী যে খুশি লাগছে! আমি এক্ষুনি রাজি।
রকিব ওর হাতে চাপ দেয়। দুজনে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামতে থাকে।
কিন্তু?
রকিব থমকে দাঁড়াল।
কিসের কিন্তু?
উঠব কোথায়?
এই ঠিকানায়।
সালমা একটা ছোট্ট কাগজ রকিবের সামনে মেলে ধরে। উত্তেজনায় রকিবের হাত কাঁপে। সালমা হাসে। সহজ হাসি। রকিবের মনে হয় এই মুহূর্তে সালমা ওর বুকের সঙ্গে মিশে আছে। সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন করা আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
বিকেলের মধ্যে সব ঘটনা নির্বিবাদে ঘটে যায়। রকিবের কাছে তা স্বপ্নের মতো মনে হয়। সব কাজ শেষ করে ওরা যখন বনানীতে নাসিমা আর সাব্বিরের বাসায় পৌঁছে তখন শেষ বিকেল। লালচে হলুদ আলো ছড়ানো সবখানে। রিকশা থেকে নামার সময় রকিব ওর দিকে তাকিয়ে বলছিল, এখন কেমন লাগছে সালমা?
আকাশে ওড়া পাখির মতো। একদিকে মুক্তির আনন্দ, অন্যদিকে ভালোবাসার স্বাদ।
বাব্বা কত যে ভাবনা।
দুজনে হাসতে হাসতে এসে দরজায় করাঘাত করে। সে শব্দ সালমার বুকে ঘণ্টাধ্বনির মতো বাজে।
সাব্বির ওদের দেখে চেঁচিয়ে ওঠে।
আরে সালমা যে? কতদিন পর এলে।
এতদিন পর আমাদের মনে পড়ল তোর। আমি ভাবলাম তুই বুঝি ভুলেই গেছিস।
তোমাকে কী ভুলতে পারি? সালমা ব্রিত মুখে জবাব দেয়।
কী ব্যাপার, তোমাকে অমন জড়সড় দেখাচ্ছে কেন সালমা? দেখো নাসিমা, সালমাকে আজ কেমন একটু অন্যরকম লাগছে।
হ্যাঁ, আমিও তাই দেখছি।
নাসিমা’পা আমি বিয়ে করেছি।
কী বললে? তাই বল। সাব্বির চেঁচিয়ে ওঠে।
বিকেলে বিয়ে হয়েছে। আজ রাতে তোমাদের এখানে থাকব।
তার মানে বাসর? নাসিমা তুমি আয়োজন করো। আমাদের কী ভাগ্য!
উহ চমৎকার! কী খুশির খবর!
নাসিমা সালমাকে জড়িয়ে ধরে। টানতে টানতে শোবার ঘরে নিয়ে যায়। ব্ৰিত রকিব খুব একটা কথা বলতে পারে না। কেবল সাব্বিরের অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব দেয়।
তারপর নাসিমা আর সাব্বির দুজনে মিলে ওদের জন্য অনেক আয়োজন করে। নতুন শাড়ি কিনে আনে। নতুন প্রসাধনী দিয়ে ওকে। সাজিয়ে দেয়। বিছানায় গোলাপ ছড়িয়ে বাসর তৈরি করে। সালমার ইচ্ছে অনুযায়ী ঘরে লাইটের বদলে মোমবাতি জ্বালায়। বেশি রাত না করে তাড়াতাড়ি খাইয়ে দাইয়ে দুজনকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে যায়। ওরা।
সালমা বিছানার ওপর বসে থাকে। গোলাপের গন্ধ ওকে আচ্ছন্ন করে। মোমবাতির শিখা কাপে। মৃদু নীল আলো রোমাঞ্চিত করে ওকে। রকিব ঘরে পায়চারি করে। সারাদিনের সমস্ত ব্যাপারটায় কোনো কিছু ভেবে দেখার অবকাশ ছিল না। উত্তেজনায় অনেকবার ওর হাত-পা কেঁপেছে। এখন সালমা ওর বউ। আজীবনের সঙ্গী। বউ শব্দটা রকিবকে আবার উত্তেজিত করে। ও সালমার পাশে এসে বসে।
সালমা।
বলো।
আমরা এখন কী করব?
তুমি বলো?
আমরা সারারাত জেগে জেগে কথা বলব।
তোমার ক্লান্তি লাগবে না?
একটুও না। আজ তো ক্লান্ত হবার দিন নয়।
তাই।
সালমা হাসে।
কথা বলতে বলতে একসময় কথা বন্ধ হয়। রকিব ঘুমিয়ে পড়ে। অনেক রাত পর্যন্ত সালমার ঘুম আসে না। গোলাপের গন্ধ এখনো তীব্র। মোমবাতি জ্বলে জ্বলে নিঃশেষ। সালমা উঠে জানালার ধারে এসে দাঁড়ায়। বারান্দায় বেরিয়ে এ-মাথা ও-মাথা পায়চারি করে। কখনো ঝুঁকে ঘুমন্ত রকিবের মুখটা ভালো করে দেখে। সারাদিনের উত্তেজনার পর ও এখন শান্ত।
আমি জানি না, তোমার ভালোবাসা আমাকে ধরে রাখতে পারবে কি না রকিব। বাঁধন আমার ভালো লাগে না। আমি হাঁপিয়ে উঠি। তুমি তো জানো, সোজা পথের বদলে চড়াই-উতরাই পথেই আমার সুখ বেশি। আজকের রাতের মতো এমন সুখের ক্ষণ আমার জীবনে বেশি নেই। ওই টুকরো টুকরো ক্ষণগুলো আমার বেহিসারি জীবনের ওপর মিঠে বাতাস বইয়ে দেয়। একটুক্ষণের জন্য শান্তি পাই। আবার যখন পথে নামব, আজকের রাতটা আমি সুগন্ধি পদ্মের মতো আমার হৃদয়ের জলে চিরকালের করে ভিজিয়ে রাখব রকিব। তুমি তার জন্য দুঃখ করো না।
ঘরে ফিরে ও আবার জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। মগজে অস্থিরতা দপদপ করছে। জানালার শিকে কপাল ঠেকায়।
আমি জানি, তুমি এখনো ঘুমোওনি বাবা। ঘুম তোমার আসছে না। তিনটের সময়ে ইউনিভার্সিটি গিয়ে অনেকক্ষণ বসেছিলে। বারবার ঘড়ি দেখছিলে। পাইপ টানছিলে। তোমার সামনে দিয়ে সব ছেলেমেয়ে চলে যাচ্ছিল। আর তুমি অস্থির হচ্ছিলে। একসময় হয়তো নিজে গাড়ি থেকে নেমে ইউনিভার্সিটির চত্বরে আমাকে খুঁজে বেড়িয়েছিলে। পাওনি। তুমি যাকে চোখে চোখে রেখেছিলে, যাকে নিতে এসেছিলে, দেখলে সে নেই। এরকমই হয় বাবা। কিন্তু তুমি তা কোনোদিনও বুঝতে চাওনি। ভাবতে যা তোমার চাই তা তোমার হাতের মুঠোয় পেতে হবে। এটাই যদি সত্য হতো বাবা, তাহলে সোনার হরিণ শব্দটি কেন?
এখন বেশ বুঝতে পারছি আমাকে ভালোবাসার বদলে নিজের আমিত্বকে প্রতিষ্ঠিত রাখাই ছিল তোমার লক্ষ্য। কোথায় সেই ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার সমগ্র জীবনের ওপর ছায়া দিয়ে পাখা মেলে রাখবে? ভালোবাসাই যদি থাকবে তবে আমার জীবনের এত বড় একটা সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তোমার ভূমিকা জল্লাদের মতো কেন? কেন ক্ষমতার দাপট আর দম্ভ তোমার আচরণের বড় হাতিয়ার? এতকাল শুধু সবার কাছে নতজান ভক্তি পেয়েছ বলেই আমার আচরণ ছিল তোমার অসহ্য। নিজের মেয়েকে ভালোবাসার বদলে চেয়েছ সেই নতজানু ভক্তি আর দীণ শ্রদ্ধা। সেটা পাওনি বলে তুমি ক্ষিপ্ত হয়েছিলে। তোমার বিবেকহীন চেতনায় তা ঘা দিয়েছিল। আর তাই তুমি তোমার ভালোবাসাকে আর প্রসারিত করতে পারলে না। ভালোবাসার রাশ টেনে ধরলে। যদি তুমি তা পারতে তাহলে বুঝতাম তুমি জাহিদ চৌধুরী অন্তত একটি জায়গায় নিজের মহত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছ। পারলে না। দুঃখ আমার নেই। জানতাম তুমি পারবে না। তোমার মানসিকতার প্রতিটি ছিদ্র আমার চেনা, তোমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে আমি গন্ধ পাই। আমি বুঝি তুমি কী চাও। আমি জানি কতটুকু বললে তুমি নিঃশেষ হয়ে যাবে। আমি জানি কতটুকু ভাবলে তোমার সামনে দেয়াল এসে দাঁড়াবে।
আমাকে তুমি জন্ম দিয়েছ বাবা। সে জন্মের শোধ তুলতে চেয়েছিলে তোমার প্রভুত্বের যাঁতাকলে আমাকে পিষ্ট করে। কিন্তু তুমি কি জানেনা বাবা, যারা দাস হয়ে জন্মায় তারা কোনোদিন প্রভু হতে পারে না? তুমি ওই মূলটা ধরতে পারনি। প্রভু হবার আজীবন সাধনা করে তুমি চিরকাল দাস মনোভাব নিয়ে কাটিয়ে দিলে। যারা চেতনার অন্ধিসন্ধির প্রতিটি ফোকর গলিয়ে ঢুকে ভেতরের চেনাপথ খুঁজে পায় না তারা তোমার মতো বিভ্রান্তি নিয়েই সারাজীবন কাটায়। সেজন্য তুমি মোটেও অনুতপ্ত নও। কেননা ব্যবহারিক চাকচিক্যে তোমার আগ্রহ অনেক বেশি। অবশ্য তুমি পেয়েছেও অনেক। কার্পেট মোড়ানো সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠেছ। আর ওইখানেই আমার যত ঘৃণা।
আমি চেয়েছিলাম একজন শক্তিমান পিতা, একজন মহৎ পিতা। আমি… চেয়েছিলাম… একজন শক্তিমান… বাবা … যার ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমি নিজের অস্তিত্বকে মহান বলে অনুভব করতে পারতাম। যার আত্মঅহংকার আমার মানস চেতনায় চিরকালের প্রদীপ হয়ে জ্বলত। তুমি তা হতে পারনি। তাই তুমি আমার ওপর তোমার অধিকার টিকিয়ে রাখবে কিসের জোরে? ভালোবাসা নয়, তোমার ঘৃণা নিয়ে আমি দূরে সরে যেতে চাই। আমি যা করেছি, তার জন্য আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই না। কেননা আমাকে তুমি ক্ষমা করতে পার না। তোমার ব্যর্থতাকে আমি নিজে অতিক্রম করব বলে পথে নেমেছি। তোমার কাছে কোনোদিন পৌঁছবে না আমার সে পদশব্দ।
———–