দুজনের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে দুটি অন্তঃস্রোত, এক মোহনায় গিয়ে কোন্ মুহূর্তে মিলবে জানি না; এখন সারাদিন শুধু মূক করে রাখল।
রাত্রে আবার খুলে যায় একটি ধারার মুখ। আমি বালিশে হেলান দিয়ে সিগারেট টানছি, ধোঁয়াগুলো উড়ে উড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। কাছে বসে ছবি শুরু করল, আমাকে তোমার কাছে আর থাকতে দেবে কিনা জানি না, তবে বলে শেষ করতে দাও আমার কাহিনি। তখন বৌদি সবে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। দাদা একদম উদভ্রান্ত। সারাদিন বাইরে থাকেন। ঘরে চাল বাড়ন্ত সেদিকেও খেয়াল নেই। পান্নাদের বাসা থেকে ধারকর্জ করে চালাচ্ছি। একদিন দাদা একটি লোককে নিয়ে এলেন। স্যুট টাই পরা বেশ ধোপদুরস্ত। দেশি লোক কিন্তু ইংরেজি কথা বলেন। নাকি বিরাট মার্চেন্ট! পৃথিবীর বড় বড় শহরে তার কারবার। মাসের পনেরোদিনই উড়োজাহাজে থাকেন। দেদার টাকা। দাদার কাছে এসেছেন তার ফার্মের একটি মনোগ্রাম করবার জন্য। একহাজার টাকা অগ্রিম দিয়েছেন। টাকা পেয়ে দাদার খুব ফুর্তি। আমাকে চা করে নিয়ে যেতে বললেন। আমার না করবার উপায় ছিল না। লোকটি খুব জবরদস্ত, ভারি গোঁফ তার। ঘরে ঢুকে তার চোখ দেখে আমি ভেতরে-ভেতরে শিউরে উঠি। দাদা তো আপনভোলা লোক, এসব তার নজরেই পড়বার কথা নয়। অথবা পড়লেও বিশেষ আমল দিলেন না।
কিন্তু আমি দেখলাম, লোকটি ভয়ানক ধূর্ত আর যতদূর সম্ভব বদমাশ।
দুদিন পরে এসে দাদাকে ডাকতে ডাকতে একেবারে বাড়ির ভেতর চলে এলেন। দাদা ছিলেন না। আমি সরে পড়বার উদ্যোগ করছিলাম। কিন্তু বাসায় লোকজন নেই বুঝতে পেরে–
কথা থামিয়ে ছবি অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল, আমার শিথিল হাতটার দুটি আঙুল নিয়ে নাড়াচাড়া করে।
আমি চিৎকার করতে চেয়েছি, মুখের ওপর জুতো ছুঁড়ে মেরে বাধা দিয়েছি। কিন্তু বেশিক্ষণ পারিনি।
একখণ্ড মেঘ বোধ হয় উঠে এসেছিল, জানালার বাইরেটা আবছায়ায় ঢেকে গেল। আমি সেদিকে চেয়ে থাকি।
সারা বিকেলটা মেঝের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদলাম। এও কপালে লেখা ছিল? কাকে বলব কেমন করে বলব? দাদাকে বলা সে কি লজ্জা! বৌদি সবে ঝগড়া করে গেছেন আসবেন না, বাইরের কাউকে তো বলাই যায় না। এক বলা যেত পান্নাকে। কিন্তু সে শহরেই নেই, শ্বশুরবাড়ি। দিন যায় রাত আসে। রাত শেষ হয় আবার দিন আসে, আমি বোবা লাশের মতো চলাফেরা করি। দাদা কিছু বুঝতে পারে না। লোকটাও উধাও হয়ে গেলেন। দাদা একদিন বললেন, কি অদ্ভুত এক হাজার টাকা অগ্রিম নিয়ে জিনিসটা নিলেনই না ভদ্রলোক! আমি সব জানতাম, কিছু বলিনি।
এদিকে কিছুদিন না যেতেই আমার দেহে অজানা পরিবর্তন শুরু হলো। কি লজ্জা! লুকিয়ে লুকিয়ে টক ঝাল পোড়ামাটি খাই। আরও কত কি! নিজেকে নিয়েই আছি।
কিন্তু কতদিন ঢেকে রাখব! এ তো গোপন রাখবার জিনিস নয়। মন লুকিয়ে রাখছে, শরীরের মধ্যে দিন দিন সেই প্রকাশ পাচ্ছে। দাদা একদিন শুধু বললেন, একি ছবি!
একদিন বৌদি এসে আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। বিস্ময় কাটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, একি ছবি!
আমি দৌড়ে গিয়ে তার বুকে আশ্রয় নিই। চোখের পানিতে গাল ভেসে গেল। অনেকক্ষণে বললাম, আমাকে বাঁচান বৌদি।
বৌদি আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, কিন্তু তোর এ সর্বনাশ কে করল। কিভাবে করল।
ঘরের দরোজা ভেজিয়ে আদ্যোপান্ত বর্ণনা করলাম। বৌদি সব শুনে এতটুকুন হয়ে গেলেন। বললেন, সর্বনাশ হয়েছে রে সর্বনাশ!
কি হবে আমার বৌদি। আমি কি বিষ খাব, না পালিয়ে যাব কোথাও?
বৌদি সান্ত্বনা দিতে দিতে বললেন না, এ সব কিছু নয়। একটা কিছু উপায় বার করতেই হবে।
এরপর যা বললেন, তা শুনে আমার বুকের ভেতরটা ধুধু করতে থাকে। জানি এই একমাত্র পন্থা। কিন্তু তবু মনটা এমন করছে কেন, যে এসেছে তার তো কোনো অপরাধ নেই? সে নিষ্পাপ নিষ্কলুষ। ফুল কলির মধ্যে থাকতেই তাকে ছিঁড়ে পিষে ফেলা। সমাজ আছে, কিন্তু তার চেয়ে বড় বিবেকও তো মরে যায়নি? আসলে বিবেকও নয়, বিন্দু বিন্দু রক্তে যে গড়ে উঠেছে তার প্রতি কেমন একটা দুর্বোধ্য টান। আমি আস্তে বললাম, বৌদি আমি পালিয়ে যাই। কিংবা দূরে কোনো অচেনা শহরে ব্যবস্থা করে। দাও। আমার জীবনটা তো নষ্ট হলো। অন্য একটা জীবন বাঁচুক।
বৌদি কপাল কুঁচকে ভাবলেন কিছুক্ষণ এরপরে বললেন, তা হয় না ছবি। তোর দরদ কেন, সে আমি বুঝি। কিন্তু এদেশে কোনো দামই তার নেই। বরং ওভাবে গেলে পথের কুকুরের মতো মরতে হবে।
বৌদি! আমি লুটিয়ে পড়লাম। গমকে গমকে কান্না আসছে।
তোর কিছু ভাবনা নেই। আমিই সব ব্যবস্থা করছি। বৌদি বললেন, আমার এক বান্ধবী ভালো ডাক্তার। অনেক দেরি হয়ে গেছে, আমি এক্ষুণি যাচ্ছি ওর কাছে।
তিনদিন তিনরাত্রি পর্যন্ত ছোট বাসাটা হত্যা-ষড়যন্ত্রে চকিত হয়ে রইল। এমনিতেই লোকজন আসে কম। পান্না থাকলে সে আসত মাঝে মাঝেই। কিন্তু এখন ভেতর থেকে গেটের চাপানি দেওয়া থাকে। পর জানতে পেরেছি দাদা নাকি তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন এমন দ্রলোক তার এই কাণ্ড। প্রথম বিশ্বাস করতে পারেনি। পরে বুঝতে পেরে ভয়ানক ক্ষেপে গিয়েছিলেন। শহরের বড় বড় হোটেলে আতিপাতি করে খুঁজেছেন; কিন্তু কোথায় পাবেন তাকে? সে সময়েই কোথায় চলে গিয়েছিলেন।
বৌদির সঙ্গে কথা না বললেও দাদা আপন মনে গজরান আর জোগাড়যন্ত্র নিয়ে থাকেন।
সাতদিনে উঠে বসি কিন্তু ভালোমতো চলাফেরার শক্তি অর্জন করতে মাসখানেক লাগল।
আবার নীরবতা। প্যাকেট থেকে তুলে নিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরাই। আমার কোনো অনুভূতিই যেন আর নেই। হৃৎপিণ্ডটা শুধু স্বাভাবিক চালে ঢিপঢিপ্ করে চলছে। হৃদয়ের মধ্যে ধোয়াটে বুদবুদের মতো যা উঠছে পড়ছে তা অবয়বহীন, খাপছাড়া এলোমেলো। জীবনের সার্থকতা, ব্যর্থতা-কত প্রশ্নই আজ নতুন করে দেখা দিল। দুদিন আগেও নিজেকে মনে হতো রাজার মতো আর এখন পরাজিত সৈনিক!
সেরে উঠলাম বটে-ছবি আবার মুখ খুলল কিন্তু অদ্ভুত এক খ্যাপামিতে পেয়ে বসল। প্রায় পূর্ণশিশু বিষাক্ত ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় বেরিয়ে এসেছিল কিন্তু জীবন্ত ছিল না। মায়ের গর্ভে থেকে পড়ে সে কেঁদে ওঠেনি। কিন্তু তবু তাজ্জব একটু একলা থাকলেই শিশুর কান্না শুনতে পেতাম-যেন কাছেই কখনো কুয়োর ধারে কখনো রান্নাঘরে কখনো বারান্দায়। মাঝে মাঝে আকাশের দিকেও। ব্যাকুল হয়ে ছুটে যেতাম কিন্তু গিয়ে খুঁজে দেখতাম কেউ নেই কিছু নেই। তাহলে এ আমার মনের ভুল?
ফিরে এসে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতাম! এক আশ্চর্য পরীক্ষায় ফেললেন আমায় খোদা! এর হাত থেকে কি আমার মুক্তি নেই?
একদিন শুয়ে ছিলাম পাশ ফিরে দেখি আমার কোলের কাছে নাদুস নুদুস একটা। শিশু হাত নেড়ে হাসছে। ধরতে গিয়ে দেখি শূন্যস্থান। দুপুরে ঘুমিয়ে পড়ে আমি স্বপ্ন। দেখছিলাম।
একদিন বিকেলে আসমানের দিকে চেয়ে আছি দেখি মেঘের ফাঁকে ফাঁকে একদল শিশু!
চোখ কচলিয়ে চাইতেই তারা যেন করতালি দিয়ে এক নিমেষে সব লুকিয়ে পড়ল।
ছবি একটু থেমে শেষবারের মতো বলল, অনেকদিন হয়ে গেল কিন্তু এখনো মাঝে মাঝে ভুল করি আমি এবং যে কোনো শিশুর কান্না সইতে পারিনে। ছুটে যেতে ইচ্ছে হয়।
কথা বলতে বলতে ওর গলা ভারি হয়ে এসেছিল, সে বালিশে মাথা এলিয়ে দিল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।
মশারিটা খাঁটিয়ে দিয়ে আমি নামলাম। আচ্ছন্নের মতো ঘরময় পায়চারী করতে থাকি। এরপর দরোজা খুলে বারান্দায় গেলাম। সাদা মেঘগুলো দক্ষিণ থেকে মৃদুমন্দ গতিতে উত্তরে উড়ে যাচ্ছে, রাতের আকাশে পূর্ণচাঁদের মাতাল জোছনা। ছড়িয়ে পড়ছে। অফুরন্ত ধারায়। একি জোছনা অথবা ধারালো পরিহাস? মেথর পল্লী থেকে ঢিমিক ঢিমিক ঢোল-করতালের বাজনা ভেসে আসছিল, সাধারণের কি উল্লাস! ফুর্তি করছে সারাদিনের খাটুনির পর মদ আর তাড়ি টানছে দেদার, মেয়েমানুষের গলা জড়িয়ে মাতলামি করছে। হা এরাই সুখী! সত্যিকারের সুখী। কারণ এদের মনের বালাই নেই। বৌয়ের সঙ্গে এসেছে তার পূর্বস্বামীর ছেলে তাকে খাওয়াও মারধোর করো এর পর কাজে লাগাও। বাগ মানতে না চাইলে বিদায় দাও। আসলে বিয়েশাদি ব্যাপারটাকে একটা নেহায়েৎ দরকারি কাজ বলে ধরে নিতে পারলেই সকল সমস্যার সমাধান। মনের সূক্ষ্ম তন্ত্ৰীগুলোর সঙ্গে একে জড়িয়ে ফেলার মতো বোকামি আর কিছু নেই! তাতে মিছে জ্বালা মিছে যন্ত্রণা।
কিন্তু এও বোধ হয় ঠিক নয় কারণ যে কোনো চরমই অমঙ্গলকর। শুধু মাত্র হৃদয়াবেগ যেমন ঠুনকো তেমনি নির্জলা যান্ত্রিকতাও বিপজ্জনক এবং যেখানে আতিশয্যের আশঙ্কা আছে সেখানে স্থির মস্তিষ্কে অনুধাবনের ক্ষমতা অর্জন করতে পারলে খুব বড় ত্রুটিকেও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
আর একথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই, মানুষের পরিণতি নির্ভর মননের পরিপকৃতারই ওপর। মনন যেন আগুন এবং আবেগ আগুনের শিখা, যে কোনো একটা নিষ্প্রভ হয়ে গেলে শীতলতা অনিবার্য।
যদিও ভেতরে অনেক ক্ষোভ সঞ্চিত হয়েছে তবু অনেকক্ষণ একা একা বারান্দায় পায়চারী করতে করতে এটুকু বুঝলাম ছবির ঘটনাটাকে বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে বিচার না করলে আমি ভুল করতে পারি। আর সে ভুলের ফল হবে মারাত্মক। আমার অতিরিক্ত ভাবালুতার মানেই হবে ওর দুঃখ এবং দুঃখের ভার বেশি হলে একটা কিছু কাণ্ডও করে বসতে পারে।
এটাই সিদ্ধান্তের ব্যাপার। আমি সামান্য আঘাত করলেই এখন সে মুষড়ে পড়বে এবং তাতে আমার মনের ঝাল মিটবে কিন্তু ঐটুকুই আর কোনো লাভ নেই। অপর পক্ষে ইচ্ছে করলে আমি এখন ওকে মঞ্জরিত করে তুলতে পারি, করতে পারি আরো সার্থক ও সুন্দর। তার জন্য প্রয়োজন প্রেম এবং ক্ষমা।
‘যে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায় ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি’ তারই পূজায় বলি হবার ইচ্ছেটা তো শুধু লাবণ্যের নয় বরং এটা আকাঙ্ক্ষিত জনের কাছে নরনারী মাত্রেরই দাবি।
এখন আমি ওকে ভালোবেসেছি কিনা এটাই প্রশ্ন। যদি বেসে থাকি তাহলে এতটুকু ক্ষমা করতে পারবো না? বিশেষত এ যখন একটা দুর্ঘটনা মাত্র, যার আবর্তে সে একান্ত অসহায় ছিল?
বিছানায় ফিরে এসে দেখি অকাতরে ঘুমাচ্ছে ছবি, এতদিনকার পুষে রাখা মেঘের ভারটুকু ঝরিয়ে যেন এখন সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত।
কিন্তু রাতের ঘুমে যা সম্ভব হয়েছে সকালের আলোতেও কি এ অক্ষুণ্ণ থাকবে? থাকতে পারে, তার একটা মাত্র উপায়। সে হলো আমার আনন্দ ও উচ্ছলতা। কাল সকালে আমি যদি উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারি তখন ওর ওপরে তার যে আভা পড়বে তাতে ওর অন্তর বাহির একটি শিখায় দীপ্যমান হয়ে উঠবে। শাস্তির বদলে ক্ষমা, সঙ্কীর্ণতার বদলে মহত্ত্বের পরিচয় পেয়ে হবে আরো কৃতজ্ঞ।
সে কি আমি করতে পারি না? কতটুকু আত্মত্যাগের প্রয়োজন তার জন্য চেষ্টা করে দেখা যাক।
আঁকার একটা পিরিয়েড পুরো করবার জন্য বাইরে যাব ভাবছিলাম। মুজতবার সঙ্গে কথাও হয়েছে সপ্তাহখানেকের জন্য আমরা যাব চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায়। কিন্তু এখন যাওয়া ঠিক হবে না। এখন সামান্য পিছুটানও ওর মনে গভীর রেখাপাত করতে পারে।
মুজতবা হয়তো বিদ্রূপ করবে, বৌয়ের আঁচল বুঝি ছাড়াতে পারছিস না? ছেলেমানুষ ছেলেমানুষ!
কিন্তু নিজের স্বার্থের জন্যই এটুকু স্বীকার করে নিয়ে প্রোগ্রামের তারিখটা একটু পিছিয়ে দিতে হবেই।
আরো একটা জিনিস রয়েছে ভাববার মতো। ছবি অবচেতন মনের প্রবল আকুতিটার সমাপ্তি প্রয়োজন। কিন্তু তাকে স্থূলভঙ্গিতে দাবিয়ে দিলে হবে না। সেজন্য মনোবিকলনের আঁকাবাঁকা পথেই অগ্রসর হতে হবে। ডাক্তার নই, কিন্তু সাধারণ জ্ঞান। তো আছে? এইটুকু জানি কামনাকে পুর্তির মধ্য দিয়েই জয় করা সম্ভব। কোলের কাছে নতুন কান্না এলে হারিয়ে যাওয়া কান্নার রেশ আর কানে বাজবে না।
সকাল বেলায় আমার আনন্দিত কণ্ঠস্বর শুনে ছবি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। মুখ ধোওয়ার আগে কাগজ দেখছিলাম। হঠাৎ ডেকে উঠলাম, ছবি! ছবি!
ও উঠে বিছানাপত্র গোছগাছ করছিল, অল্পক্ষণ এসে বিমর্ষ মুখে জিজ্ঞেস করল, কি!
আমি ওর হাত ধরে টানি। বললাম, দ্যাখ কি অদ্ভুত খবর। আঠারো বৎসরের তরুণীর ছিয়াত্তর বৎসরের বৃদ্ধকে বিবাহ! নারী রহস্যময়ী, তাতে আর সন্দেহ কী!
ছবি অনিচ্ছার সঙ্গে বলল, সত্যিই অদ্ভুত তো!
হা শোনো! নাড়টাড় কি আছে দাও তো। আর এক কাপ চা খাওয়াও। আমি একটু বৌদিদের ওখানে যাব।
আমার কথায় সহজ সুর থাকা সত্ত্বেও কেমন সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায় ছবি। বলল, ওখানে কেন?
নোটনকে নিয়ে আসি গে! একলা একলা আর কত ভালো লাগে।
ছবি যেন হঠাৎ জেগে উঠল! জিজ্ঞেস করল, সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
আমি উঠতে উঠতে বললাম, তুমি কেটলিটা চাপিয়ে দাও। আমি এক্ষুণি মুখ ধুয়ে আসছি!
আমি বাথরুমের দিকে পা বাড়ালে ছবি পথ রোধ করে বলল, শোনো!
আমি স্নিগ্ধস্বরে বলি, কি বল?
ছবি ঢোক গিলে বলল, এতকিছু যে বললাম তুমি কিছু মনে করনি? আমাকে খারাপ ভাবনি?
ও! পাগল! আমি হেসে উঠে বললাম, এতে মনে করার কি আছে! সাধারণ ব্যাপার! কতই ঘটে থাকে! তাছাড়া তোমার তো কোনো দোষ ছিল না! এজন্য তোমাকে খারাপ ভাবব?
আমার গা ছুঁয়ে বল, সত্যি বলছ তুমি? যদি সত্যি না হয় আমি মরে যাব। বলো বলো আমার গা ছুঁয়ে বলো!
আমি ওকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে বললাম, সত্যি বলছি মনে করিনি। প্রথম ভেবেছিলাম বুঝি ভয়ঙ্কর কিছু, কিন্তু পরে বুঝলাম তোমার আমার ভালোবাসাই বড় সত্য!
কথাটা শেষ করার পর মুখের দিকে ঝুঁকে পড়তে ছবিও সাগ্রহে এগিলে এলো। কিছুক্ষণ পর মাথাটা আমার বুকে এলিয়ে আস্তে আস্তে বলল, সত্যি আমি ভাগ্যবতী।
দুইফোঁটা পানি বেরিয়ে এসে গালের উপর স্থির হয়ে ছিল, আমি মুছে দিলাম।
মেঘ যখন কেটে গেল আকাশে সূর্য, তারা, চাঁদ নীহারিকা দেখা দিতে দেরি হলো না। কঠিন আঘাতকে ভোলে মানুষ আর যা বিস্মৃতির যোগ্য তাকে আমি ভুলব না? ছবিও সংশয়মুক্ত। তাই কোমল পদ্মের মতো পরতে পরতে সে দল মেলেছে। ওর শরীরের বিন্দু বিন্দু অংশ মাতৃত্বের রসে গৌরবান্বিত হয়ে উঠছে ক্রমেই। চাহনি গভীর, হাসি আরো মধুর। সেবায় সুধা-স্পর্শ। নোটনকে এনেছিলাম ওকে নিয়ে থাকতে পারে বলে আমার কাজেরও সুযোগ হয়ে গেল।
প্রতিদিনই কিছু কাজ করি কিন্তু উপলব্ধি করি মনের মধ্যে পালাবদল হচ্ছে। এক ঋতু গিয়ে আসছে অন্য ঋতু। এতদিনকার ছবিতে রূপটাই ছিল প্রধান বাইরের চাক্ষুষ মূর্তি কিন্তু তাতে আর তৃপ্তি পাচ্ছি না। অন্যপথ দরকার, অন্যভঙ্গি। বস্তুর বাইরের রূপটাই তো চরম সত্য নয়? যদি তাই হয় তাহলে শুধুমাত্র একজনের চেহারা না একে চেহারায় তার আত্মাকে ফুটিয়ে তোলাই আসল কাজ। সমালোচনার বইয়ে পড়েছি বহু এবং সেই মতো চেষ্টাও করেছি কিছু কিছু, পান্নার ছেলে কোলে ছবিকে একদিন আঁকতে চেয়েছিলাম। আঁকতে চেয়েছি কিন্তু তখন উপলব্ধি বদলে ধারণাটাই ছিল জাগ্রত। ভালো আঁকা হতো বটে তবে ভালো ছবি হতো কিনা সন্দেহ।
এখন আশ্চর্য যা কিছু পরিকল্পনা জাগে মাথায় আত্মার সঙ্গে না মিলিয়ে তাঁকে দেখতেই পারি না।
এতে অবশ্য একটা বিপদ আছে। সে হলো অতিমাত্রায় অ্যাবৃট্রাকশনের প্রতি ঝোঁক, যার ফল মূল্যবোধের নেতি। আর শিল্পী যদি এমন হয় কামুর চরিত্রের মতো তার নির্বাসনে আর বেরুবার পথ নেই কারণ অতীত মোহ সব নিঃশেষ আর স্বপ্নের দেশ অলীক প্রমাণিত- জীবন আর ব্যক্তিত্বে করুণ বিচ্ছেদ, অভিনেতা আর মঞ্চে অসঙ্গতির পরাকাষ্ঠা। জীবনে এই হলো সামগ্রিক অর্থহীনতার অনুভূতি। তাহলে সেই শিল্পীর অস্তিত্বই সংকটাপন্ন। যে আত্মবিচ্ছেদের বন্ধুর যাত্রা তার অপমৃত্যু থেকে উত্তরণের পথ তাতে সফল হতে পারে আর কয়জন?
অথচ শিল্পীর জীবনে এমনি ধরনের আত্মিক সংকট অবশ্যম্ভাবী। কারণ সে আর দশ-পাঁচটা লোকের মতো নয়। বরং সবচেয়ে স্পর্শকাতর এবং সংবেদনশীল। সেতারের সূক্ষ্ম তারগুলো বাজছে প্রতি নিয়তই এমন কি হাওয়ার ছোঁয়ায়ও সে স্থির থাকবে কি করে? ভাববেই, কাদবেই ভেঙে পড়বেই। আর একমুহূর্তে যে তাকে ভুলতে পারে স্নেহশীল পিতার মতো হাত ধরে সে হলো আস্থা। প্রতারণাকে বুঝেও বিশ্বাস। ঘৃণাকে নিয়েও প্রেম! মৃত্যুকে বুঝেও মানবতা অধ্যাত্মবাদী না হয়েও শিল্পী বলবে : হিরন্ময়েন পাত্রেণ সত্যসাপিহিতং সুখ। তৎ ত্বং পুষন্নপাকৃণু সত্য ধর্মীয় দৃষ্টায়ে। যৎ তে রূপং কল্যাণতমং তত্তে পশ্যামি। যোহহসাবসৌ পুরুষঃ সোৎ সম্মি!
শিল্পীর কাছে সে সূর্য ছাড়া আর কি? সে যদি আমার কাছে তার আচ্ছাদন ক্ষণিকের জন্য সরিয়ে থাকে তাহলেই তো আমি ভাগ্যবান।
আসলে সংক্ষিপ্ত কোনো রাস্তাই নেই। মহৎ শিল্পী হতে গেলে সে সমস্তই মাড়িয়ে যেতে হবে। মাড়িয়ে যেতে হবে, হঠাৎ খাদে পড়ে গেলে নিমজ্জিত হলেও চলবে না। আগুনকে বুকে নিয়েই হতে হবে খাঁটি সোনা। মনকে বাঁচিয়ে রেখে নিজের মনের উর্ধে তাকে উঠতে হবে। কঠিন সাধনা।
এ বয়সে তা পুরাপুরি অর্জন করা অসম্ভব। কারণ এখন আবেগ অতিরিক্ত, বুদ্ধি মোহগ্রস্ত, প্রজ্ঞা অপূর্ণ এবং অভিজ্ঞতা সংকীর্ণ। তাই মাস্টারপিস নয় প্রস্তুতিই এখনকার কাজ।
কিছুদিন ধরে একটি ব্যাপার মন থেকে কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারছি না-সে হলো নারী জীবনের সার্থকতা কোথায়? ছবির ব্যবহারটাই এ ভাবনার কেন্দ্র, সেজন্য ক্রমেই তা গভীরতা লাভ করেছে। নারীর জীবন কি প্রেম অথবা মাতৃত্ব? প্রেম ছাড়াও মাতৃত্ব সম্ভব; কিন্তু মনে হয় প্রেমের মধ্য দিয়ে যে মাতৃত্ব সেখানেই রয়েছে সত্য। কিন্তু পুষ্পের বোটায় পরিণত ফলের মতো প্রেমজ সন্তানেই নারী-পুরুষের সম্পর্কের সার্থকতা।
কিন্তু তবু প্রেমহীন ফলের ক্ষেত্রেও মাতৃত্ব অপরাজেয়। আচ্ছা, ছবির সেই অচেতন আকুতিটিকে রেখার বাঁধনে ধরে রাখা যায় না? আলোর ঝিলিমিলির মতো একটা অস্পষ্ট চিত্র ধারণায় খেলতে থাকে।
বিষয়টা পুরনো। রাফায়েল কার্লো ডলচি মাইকেল এঞ্জেলো পিকাসো ডালি কেউ বাদ দেননি। বক্তব্যের বিশেষ পার্থক্য নেই আছে শুধু আঁকার স্বাতন্ত্র। প্রাচীনে ছিল কুমারী জননী ও শিশু এবং আধুনিকে যে কোনো অবয়বের কতকটা বিমূর্ত প্রতিরূপ।
চিত্রকলার পিতাদের ছবির সঙ্গে আরো একটি ছবি বাড়ালে আপত্তির তো কিছু নেই। ভালো হলে পুনরাবৃত্তি বলে হবে না পরিত্যাজ্য।
কিন্তু এখনই তা আঁকতে পারব না। ছবির কোলে অন্যের শিশু বসিয়ে কাজ করা যেতে পারে না এমন নয় কিন্তু সেটা সত্যিকারের কাজ হবে কি? তাতে আসবে কি মাতৃত্বের সেই গভীর মোহন রূপ? হয়তো তা নয়। ফুটতে পারে কিন্তু আত্মা জাগবে না এবং আত্মা না জাগলে তার প্রতিচ্ছায়াও পড়বে না মুখের রেখায় রেখায়। অপরপক্ষে নিজের বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে যে শিশু তৈরি হচ্ছে যে আসছে অনেক কালের আশা ও স্বপ্নের মতো সে-ই হতে পারে সত্যিকারের প্রেরণা।
ওর বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত এই ছবির কাজ স্থগিত রাখব বলেই ঠিক করলাম।
কিন্তু পর্যবেক্ষণ আমার থামল না। মাঝে মাঝে একদৃষ্টে চেয়ে থাকি। সেই দৃষ্টি অন্যের কাছে অস্বাভাবিক মনে হওয়াও স্বাভাবিক।
ছবিও একদিন বলল, কি ব্যাপার! এমন করে দেখছ যে আমাকে যেন অপরিচিতা!
আমি হেসে বললাম, পরিচয় আর কতটা হলো ছবি! আরো ভালো করে চিনতে হবে। এমনকি সারাজীবনই লাগতে পারে!
আরে বাপ! দেখি সাংঘাতিক ব্যাপার! আমাকে নিয়ে এত কি! আমি একটি সাধারণ মেয়ে মাত্র!
সাধারণ বলেই তো অসাধারণ! অসাধারণ যারা অসাধারণ হয়েই শেষ। কিন্তু সাধারণের মধ্যে সারাজগৎ।
ছবি কাছে এসে জড়িয়ে মাথার চুলে আদর করে আমার। গালে গাল চেপে রাখে। বলে, সত্যি তুমি এমনভাবে কথা বলো তা শুনে আমার কান্না আসতে চায়! অনেক দিলে আমাকে অ-নে-ক! প্রতিদানে কিছুই তো দিতে পারিনি আমি!
তুমি আমাকে কি দিয়েছ সে তুমি জানো না। আস্তে আস্তে বললাম, আমার জীবনে তোমার দান অপরিসীম এবং একথা বলছি তোমাকে খুশি করবার জন্য নয়! এ আমার প্রাণের সংলাপ!
ছবি বলল, সত্যি কি যে হলো আমার এক মুহূর্ত তোমাকে না দেখলে ভালো লাগে । তুমি কাজে যাও, আমি সারাক্ষণ তোমার কথাই ভাবি। কাজ শেষ হয়ে গেলে স্টুডিওতে গিয়ে বসি। তখন আর একলা লাগে না। মনে হয় তুমি ছড়িয়ে আছ সারা ঘরটাতে! হাত বাড়ালেই যেন তোমাকে পাব! কিন্তু আসলে আমি কি চাই জানো? আমি চাই তুমি খুব বড় শিল্পী হও। দেশ-বিদেশে তোমার নাম ছড়িয়ে পড়ুক। তোমার ছবি বেরুক। জীবনী ছাপানো হোক। তখন আমাকে যদি ছেড়েও যাও দুঃখ করব না।
কপালের ওপরে একগোছা চুল টেনে দিতে দিতে আমি বললাম, পাগলী এমন নাম আমি চাই না। আমি যদি শিল্পী হই তোমার মধ্যে দিয়েই হবো। অন্যভাবে নয়, আর পিরবোও না।
আগেই ভেবে রেখেছিল, হঠাৎ মনে পড়ার যেন ও বলল, আচ্ছা তুমি না বাইরে যেতে চেয়েছিলে? ঘুরে এসো না কয়দিন?
তুমি তো এক্ষুণি বললে, আমাকে এক মুহূর্ত না দেখে থাকতে পারো না?
বলেছি আর তা মিথ্যে নয়। ছবি বলল, কিন্তু তোমার জন্য আমি সব পারি! তুমি বিশ্বাস করো না?
গভীর আদরে মিশে যাওয়াই এ প্রশ্নের একমাত্র জবাব আমি তাই করলাম। বড় প্রেম শুধু স্বার্থপর নয় উদারও বটে।
হেমন্তের ছোঁয়া লাগছে আকাশের নীলে গাছপালায় দুর্বাঘাসে, হাওয়ায় হাওয়ায়। ঘরে ফসল উঠল! চড়ুইরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যায়, তাদের ঠোঁটে কিচির মিচির কলরব। ঘরে তখন নিবিড় আনন্দের অতল ধারা বাইরের আয়োজনে যোগ দিতে আর দেরি করব না। আর ঘর বাহির যে এক করতে চাই!