দিন-তিনেক পরের কথা। পিসিমা তখনও অসুস্থ। কাহারও সহিত কথা তেমন বলেন না, বিশেষ বউকে দেখিলে যেন জ্বলিয়া যান।
শিবনাথ কাছারির বারান্দায় দাঁড়াইয়া ছিল। পাশের রাস্তা দিয়া জনপচেক পাঞ্জাবী পাঁচছয়টা ঘোড়া লাগাম ধরিয়া লইয়া যাইতেছিল, শিবনাথ তাড়াতাড়ি গিয়া ফটকে পাঁড়াইল।
একজন বৃদ্ধ পাঞ্জাবী জিজ্ঞাসা করিল, বাবু হ্যায় খোকাবাবু?
শিবনাথ হাসিয়া বলিল, হ্যায়। কেন?
পাঞ্জাবী বলিল, ঘোড়া বেচনে আসিয়াছি হামলোক। বাবু হামারা পাশ এক ঘোড়া লিয়া, বহুত রোজ হুয়া, উ ঘোড়া মালুম হোতা বাতেল হো গেয়া। নয়া বহুত আচ্ছা ঘোড়া হায় হামারা পাশ।
পাঞ্জাবী ফটকের মধ্যে প্রবেশ করিল। শিবনাথ, ফিরিয়া আসিয়া বারান্দায় চেয়ারের উপর বসিল।
বৃদ্ধের পিছনে তাহার ঘোড়াগুলিকে লইয়া দলবলও কাছারি-বাড়ির প্রাঙ্গণে আসিয়া প্রবেশ করিল। বৃদ্ধ হাসিমুখে নায়েববাবুকে অভিবাদন করিয়া বলিল, সেলাম বাবুজী, তবিয়ত আচ্ছা!
নায়েব একটু হাসিয়া বলিলেন, হ্যাঁ, ভাল। বহুদিন পর যে?
পাঞ্জাবী বলিল, হাঁ, বহুত রোজকে বাদ, সাত বরিষ হো গিয়া। মালিকবাবু—হজুর হামারা কঁহা হ্যায়, সেলাম তো ভেজিয়ে, রমজান শেখ আয় হ্যায়। উ ঘোড়া হামারা কিধর হ্যায়?
নায়েব নীরব হইয়া রহিলেন। শিবনাথ দেখিতেছিল ঘোড়াগুলিকে, ছয়টি ঘোড়া—একটি সাদা, একটি কালোয় সাদায় মিশ্ৰিত, তিনটি লাল, একটি কালো। অস্থির চঞ্চল ভঙ্গি ওই কালো ঘোড়াটির, ঘাড়ে কেশরের মত চুল, লেজটাও বোধহয় মাটিতে ঠেকে, কিন্তু লেজ ঈষৎ উচ্চে তুলিয়া রাখে। সর্বদাই সে ঘাড় নামায় আর তোলে, মুহুর্মুহুঃ মাটিতে পা ঠুকিয়া হ্ৰেষারবে স্থানটা মুখরিত করিয়া তুলিতেছিল। শিবনাথের বুকের মধ্যে বাসনা তোলপাড় করিতেছিল। ওই ঘোড়াটার পিঠে সওয়ার হইয়া বাতাসের বেগে—সে কী আনন্দ! তাহার পিতার গল্প মনে পড়িল। শ্যামপুর মহল এখান হইতে পঁচিশ ক্ৰোশ পথ, সেখান হইতে তাহার পিতার অসুখের সংবাদ পাইয়া কয় ঘণ্টার মধ্যে আসিয়া পৌঁছিয়ছিলেন।
পাঞ্জাবীর উচ্চকণ্ঠের চকিত ধ্বনিতে তাহার চমক ভাঙিল, আরে হায় হায় মেরে নসিব, মালিক হামারা নেহি হ্যায়!
নায়েব কখন মৃদুস্বরে স্বর্গীয় মালিকের মৃত্যুসংবাদ তাহাকে দিয়াছেন।
থাকিতে থাকিতে শিবনাথের মাকে মনে পড়িয়া গেল। সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া উঠিয়া পড়িল। সেবার বাইসিক্ল কিনিবার সময় মায়ের কথা মনে পড়িল। তিনি বলিয়াছিলেন, বিলাসের শেষ নেই শিবু, যত বাড়াবে তত বাড়বে, অথচ তৃপ্তি তোমার কখনও হবে না। এবার কিনে দিলাম, কিন্তু ভবিষ্যতে নিজের মনকে নিজে শাসন কোরো।
পাঞ্জাবী একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ওহি কালা ঘোড়াঠো হাম লে আয়ে থে। হামারা মালিকজাদা কাহা দেওয়ান-সাব-এহি এহি, হ হাঁ, হাম বহুত ছোটে দেখা থা। সেলাম হামারা হজুর মালিক, হামারা কসুর তো মাফ হোয় জনাব, হাম আপকো পহেলেই নেই পছানা।
শিবনাথকে দাঁড়াইতে হইল। সে বলিল, তোমরা এখানে খাওয়াদাওয়া কর। নায়েববাবু, এদের সিদের বন্দোবস্ত করে দিন।
পাঞ্জাবী বলিল, হাঁ, হুজুরকে সওয়ার হোনেকা উমর তো হো গেয়া। লে লেজিয়ে হুজুর, আপকে বাবাকে নামকে চিজ।
শিবনাথ বলিল, না।
নায়েবও সঙ্গে সঙ্গে বলিলেন, বাবু ছেলেমানুষ খাঁ সাহেব। এত বড় ঘোড়া নিয়ে কী করবেন? পড়ে-টড়ে গেলে–
পাঠান হা-হা করিয়া কৌতূহলভরে হাসিয়া উঠিল। গির যাবেন বাবুসাব! তব একঠো ছোটা–
নিয়ে এস কালো ঘোড়া।—শিবনাথ আদেশ করিল। আদেশের ধ্বনির বাধা পাইয়া পাঠান। নীরব হইয়া গেল। শিবনাথ লাফ দিয়া বাগানের বেদির উপর উঠিয়া আঙুলের ইশারা করিয়া বলিল, হিয়া লে আও।
পাঠান হাসিয়া নায়েববাবুকে বলিল, শেরকে বাচ্চা, জনাব, শেরই হোতা হ্যায়। তারপর ওদিকে মুখ ফিরাইয়া হাকিল, লে আও রে কালা বাচ্চেঠো।
একটা লম্বা-চওড়া জোয়ান পাঠান ঘোড়াটির মুখ ধরিয়া আনিয়া বেদিটির পাশে দাড় করাইল। পাঠান বলিল, দেখিয়ে হুজুর, হামারা লড়কাকে লড়কাপা বরিষ উমর পাঞ্জাবসে সওয়ার হোকে চলা আয়া হিয়া।
তারপর সে ঘোড়ার লাগাম ও রেকাব ঠিক করিয়া দিয়া শিবনাথকে কোলে তুলিয়া ঘোড়ার পিঠে তুলিয়া দিতে গেল। শিবনাথ পিছাইয়া গিয়া বলিল, হঠ যাও তুম। বলিয়াই সে বেদির উপর হইতে লাফ দিয়া ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হইয়া বসিল।
পাঠান আনন্দে করতালি দিয়া উঠিল। বলিল, বহুত আচ্ছা হ্যায়, বহুত আচ্ছা!
শিবনাথ ঘোড়ার লাগাম ধরিয়া আকৰ্ষণ করিতেছিল।
পাঠান বলিল, থোড়া ঠহরিয়ে হুজুর। তারপর সে নাতিকে আদেশ করিল, লে আও তো রে ঘুঙুর।
ঘোড়ার পায়ে ঘুঙুর বাঁধিয়া দিয়া সে বলিল, আর বাঁশি তো ফুকারো রহমৎ।
শিবনাথকে বলিল, বিবিকে নাচ দেখু লিজিয়ে পহেলে।
বাঁশির সুর বাজিয়া উঠিতেই অশ্বিনীর পা উঠা-নামার সঙ্গে সঙ্গে তালে তালে ঘুঙুরগুলি ঝুমঝুম শব্দে বাজিতে আরম্ভ করিল।
নায়েব শঙ্কিত হইয়া উঠিয়াছিলেন। এতক্ষণ কোনো কথা বলিবার অবকাশ পর্যন্ত পান নাই। কিছুক্ষণ দেখিয়া-শুনিয়া তিনি অন্দরের মধ্যে শিবনাথের মায়ের নিকট গিয়া হাজির হইলেন। পিসিমা অসুস্থ অবস্থায় কয়দিন শয্যাশায়িনী হইয়াই আছেন। আর এক্ষেত্রে শিবনাথের মাতা ভিন্ন অপরের দ্বারা শিবনাথকে প্রতিনিবৃত্ত করা যাইবে না।
সম্মুখেই নিত্য-ঝিকে দেখিয়া বলিলেন, নিত্য, মা কোথায় দেখ তো। শিগগিরশিগগির ডেকে দাও।
মা নিকটে ভাঁড়ার-ঘরের মধ্যে ছিলেন, তিনি বাহির হইয়া আসিলেন, কী সিংমশায়? এমন ভাবে এলেন যে?
মহাবিপদ হয়েছে মা, কর্তাবাবুকে যে পাঠান ঘোড়া বেচত, সেই পাঠান ঘোড়া নিয়ে। এসেছে। বাবু দেখে ক্ষেপে উঠেছেন, কালো রঙের এক প্রকাণ্ড ঘোড়া কিনতে বসেছেন, দুশো আড়াইশো টাকা চান। তা ছাড়া, ঘোড়া থেকে পড়লে আর রক্ষে থাকবে না।
মা বিস্মিত হইয়া প্ৰশ্ন করিলেন, শিবনাথ ঘোড়া কিনছে?
হ্যাঁ মা, আমি বারণ করবার ফাঁক পেলাম না। প্রকাণ্ড এক কালো ঘোড়া—
মা ডাকিলেন, নিত্য!
মা!
শিবনাথকে ডেকে আন্ তো। বলবি, এক্ষুনি ডাকছি আমি, তার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি আমি।
নিত্য চলিয়া গেল। নায়েব বলিলেন, আমি সরে যাই মা। আমার থাকাটা ভাল হবে না।
মা কোনো কথা বলিলেন না, তাহার শুভ্র মুখ রাঙা হইয়া উঠিয়াছিল। নায়েব চলিয়া গেলেন। কিছুক্ষণ পর শিবনাথ আসিয়া বাড়ি ঢুকিল। মুখ তুলিয়া মায়ের দিকে চাহিয়া সে বলিল, কী বলছ?
মা দেখিলেন, শিবনাথের শ্যামবৰ্ণ কিশোর মুখখানি থমথম করিতেছে।
মা বলিলেন, তুমি নাকি ঘোড়া কিনছ শিবনাথ?
শিবনাথ অকুণ্ঠিতভাবে উত্তর দিল, হ্যাঁ।
মা তেমনই স্বরে বলিলেন, না, ঘোড়া কিনতে হবে না।
শিবনাথ মাথা হেঁট করিয়া নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল, কিন্তু আদেশ পালনের জন্য কোনো ব্যগ্রতা তাহার দেখা গেল না। মাও নীরব। কিছুক্ষণ পর মা দৃঢ়স্বরে বলিলেন, যাও, নায়েববাবুকে বলো গে, ওদের পাঁচটা টাকা দিয়ে বিয়ে করে দিতে। দুশো-আড়াইশো টাকা দিয়ে ঘোড়া কেনবার মত অবস্থা আমাদের নয়।
শিবনাথ যাইবার জন্য ফিরিল।
কিন্তু কী মনে করিয়া মা আবার ডাকিলেন, শিবু, শোন, শুনে যাও।
শিবু ফিরিল। মা তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া সস্নেহে বলিলেন, ছি বাবা, সংসারে কি মনের বাসনাকে প্রবল করতে আছে! জেনে রেখো, ভোগ করে বাসনা কখনও কমে না, বাড়ে। আরও চাই, আরও চাই—এ অশান্তির চেয়ে বড় অশান্তি আর নেই। তুমি আড়াইশো টাকা দিয়ে ঘোড়া। কিনবে, কিন্তু ভাব তো, কত লোক আড়াইটা পয়সার অভাবে খেতে পায় না সংসারে! যাও,
বলে দাও লোকটিকে—আমার মা বারণ করলেন।
শিবনাথ চোখ মুছিয়া জোর করিয়া মুখে হাসি আনিয়া বলিল, তাই বলিগে মা।
কাছারিতে আসিয়া শিবনাথ পাঠানকে এ কথা বলতে পারি না, তাহার কেমন লজ্জা করিতেছিল। নায়েবকে বলিয়া দিয়া সে পড়ার ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল। চোখ হইতে তাহার টপটপ করিয়া জল ঝরিয়া পড়িতেছিল।
বাহিরে মৃদুভাষী নায়েবের সকল কথা সে শুনিতে পাইতেছিল না।
পাঠানের উচ্চ কণ্ঠস্বর সে স্পষ্ট শুনিতে পাইল, সেলাম দেওয়ান সাব, যাতা হ্যায় তব।
ফিরে নিয়ে যেও না! কত দাম ঘোড়ার?
শিবু দ্রুতপদে বাহির হইয়া আসিল। কাছারির বরান্দায় দাঁড়াইয়া পিসিমা প্রশ্ন করিতেছেন, রোগশীর্ণ চোখে একটা অস্বাভাবিক প্রখর দীপ্তি।
পাঠান চিনিতে ভুল করিল না, সে দৃপ্তা মূর্তিকে চিনিতে ভুল হইবার কথাও নয়। আভূমিনত সেলাম করিয়া বলিল, দুই শত পঁচিশ মায়ী।
একতাড়া নোট নায়েবের হাতে দিয়া পিসিমা বলিলেন, আড়াইশো টাকা আছে। দাম একটা ঠিক করে নিয়ে দিয়ে দিন।
শিবনাথ বুকের কাছে দাঁড়াইয়া ছিল। তাহাকে বলিলেন, চড় ঘোড়ায় শিবু, আমি দেখি।
শিবু লাফ দিয়া বেদির উপর হইতে ঘোড়ায় চড়িয়া বসিল। একজন পাঠান ঘোড়ার মুখ ধরিয়া রাস্তা ধরাইয়া দিতেই ঘোড়া ঘাড় বাঁকাইয়া উচ্চ পুচ্ছভঙ্গির সঙ্গে দুলকি চালে চলিয়া দেখিতে দেখিতে দৃষ্টির বাহির হইয়া গেল।
পিসিমা বলিলেন, কেষ্ট সিং, আস্তাবল সাফ করাও। তারপর স্থিরদৃষ্টিতে পথের দিকে। চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। মিনিট বিশেক পরে শিবু ফিরিল, ধূলিধূসরিত দেহ, মাথার পিছন হইতে পিঠ বাহিয়া রক্ত ঝরিতেছিল।
পিসিমা আশঙ্কাভরে প্রশ্ন করিলেন, পড়ে গিয়েছিলি শিবু?
ঘোড়া হইতে নামিতে নামিতে শিবনাথ বলিল, লাগে নি পিসিমা, পেছনে মাথাটা একটু কেটে গিয়েছে শুধু।
পাঠান বলিল, ঘোড়া তো শয়তান নেহি হ্যায় এইসা!
শিবনাথ বলিল, না, বদমাশ নয়, রাস্তায় একটা ছোট বাঁধ ছিল, ও মেরে দিলে এক লাফ, আমি ঠিক বুঝতে পারি নি আগে, উলটে পড়ে গেলাম। সেখানটায় বালি ছিল, না হলে লাগত। একটা পাথরে শুধু মাথাটা কেটে গেল।
নায়েব একটা টিপ লইয়া সম্মুখে ধরিয়া বলিলেন, ঘোড়ার খরচটা সই–
টিপটা ফেলিয়া দিয়া পিসিমা বলিলেন, আপনাদের এস্টেটের টাকা নয় সিংমশায়, এ আমার নিজের টাকা।
শিবনাথ শিশুর মত তাহার মুখের দিকে চাহিয়া ছিল। কত দিন পর পিসিমা তাহাকে বুকের মধ্যে গভীর আবেগে চাপিয়া ধরিলেন, ক্ষতস্থানটিতে হাত বুলাইতে আরম্ভ করিলেন।
সে আবেষ্টনের মধ্যে শিবনাথ হাঁপাইয়া উঠিয়াছিল। সে ডাকিল, পিসিমা!
পিসিমার চোখ দিয়া জল পড়িতেছিল।