॥ ৮ ॥
আমি দার্জিলিং থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছি, এবারে প্লেনে দিল্লী আসার সময় দিন পরিষ্কার ছিল বলে দূরে বরফে ঢাকা অন্নপূর্ণা দেখেছি, সিনেমাতে শীতের দেশের ছবিতে অনেক বরফ দেখেছি, কিন্তু সিমলাতে এসে চোখের সামনে বরফ দেখতে পেয়ে যেরকম অবাক হয়েছি সেরকম আর কখনো হইনি। রাস্তায় যদি আমাদের দেশের লোক না দেখতাম, তা হলে ভারতবর্ষে আছি বলে মনেই হতো না। অবিশ্যি শহরটার চেহারাতে এমনিতেই একটা বিদেশী ভাব রয়েছে। তার কারণ, ফেলুদা বলল, দার্জিলিঙের মতো সিমলাও নাকি সাহেবদেরই তৈরি। ১৮১৯ খৃস্টাব্দে লেফটেনান্ট রস্ বলে একজন সাহেব নাকি সিমলায় এসে নিজের থাকার জন্য একটা কাঠের বাড়ি তৈরি করে। সেই থেকে শুরু হয় সিমলায় সাহেবদের বসবাস। ভাগ্যিস সাহেবরা গরমে কষ্ট পেত, আর তাই গরমকালে ঠাণ্ডা ভোগ করার জন্য পাহাড়ের উপর নিজেদের থাকার জন্য শহর তৈরি করে নিত!
কালকা থেকে মিটার গেজের ছোট ট্রেনে এখানে আসার পরে বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটেনি। সেই কানে তুলো গোঁজা বুড়ো লোকটা কিন্তু একই গাড়িতে সিমলা এসেছে, আর আমাদের সঙ্গে একই ক্লার্কস হোটেলে উঠেছে। তবে লোকটা এখন আমাদের দিকে আর বিশেষ নজর দিচ্ছে না, আর আমারও মনে হচ্ছে ওকে সন্দেহ করে আমরা হয়ত ভুলই করেছিলাম। সত্যি বলতে কি, এখন লোকটাকে প্রায় নিরীহ গোবেচারা বলেই মনে হচ্ছে। লালমোহনবাবুও আমাদের সঙ্গে ক্লার্কসেই উঠেছেন। এই বরফের সময় খুব বেশি লোক বোধ হয় সিমলায় আসে না, তাই উনি আগে থেকেই রিজার্ভ না করেও একটা ঘর পেয়ে গেছেন।
ফেলুদা হোটেলে এসে ঘরে জিনিসপত্র তুলেই পোস্টাপিসের খোঁজে বেরিয়ে গেল। আমরাও যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ও বলল বাক্সটাকে চোখে চোখে রাখা দরকার। তাই আমরা দুজনেই থেকে গেলাম। ফেলুদা কিন্তু এসে অবধি সিমলা বা তার বরফ সম্বন্ধে কোনো মন্তব্যই করেনি। আর ঠিক তার উলটোটা করছেন লালমোহনবাবু। যা কিছু দেখেন তাতেই বলেন, “ফ্যানাস্ট্যাটিক”। আমি যখন বললাম যে কথাটা আসলে ফ্যান্টাস্টিক, তাতে ভদ্রলোক বললেন যে উনি নাকি ইংরিজি এত অসম্ভব তাড়াতাড়ি পড়েন যে প্রত্যেকটা কথা আলাদা করে লক্ষ্য করার সময় হয় না। এ ছাড়া, সিমলায় পোলার বেয়ার আছে কিনা, এখনো আকাশে অরোরা বোরিয়ালিস দেখা যায় কিনা, এই বরফ দিয়ে এস্কিমোদের বাড়ি ইল্গু (আমি বললাম কথাটা আসলে ইগ্লু) তৈরি করা যায় কিনা—এই সব উদ্ভট প্রশ্ন করে চলেছেন অনবরত।
ক্লার্কস হোটেলটা পাহাড়ের ঢালু গায়ের উপর তৈরি। হোটেলের দোতলার সামনের দিকে একটা লম্বা বারান্দা, আর বারান্দা থেকে বেরোলেই রাস্তা। দোতলাতেই ম্যানেজারের ঘর, লাউঞ্জ বা বসবার ঘর, আমাদের ডাবল রুম আর লালমোহনবাবুর সিঙ্গল রুম। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নেমে একতলায় আরো থাকার ঘর রয়েছে, আর রয়েছে ডাইনিং রুম।
ফেলুদার ফিরতে দেরি হয়েছিল বলে আমাদের লাঞ্চ খেতে খেতে হয়ে গেল প্রায় দুটো। ডাইনিং রুমের এক কোণে ব্যাণ্ড বাজছে, লালমোহনবাবু সেটাকে বললেন কনসার্ট। আমরা তিনজন ছাড়া ঘরে রয়েছেন সেই কানে তুলো গোঁজা বৃদ্ধ—যার দিকে ফেলুদা আর দেখছেন না—আর অন্য আরেকটা টেবিলে বসেছেন তিনজন বিদেশী—দুজন পুরুষ আর একজন মহিলা। আমরা যখন খেতে ঢুকছি তখন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল একজন কালো চশমা পরা ছুঁচোল দাড়িওয়ালা মাথায় ‘বেরে’ ক্যাপ পরা ভদ্রলোক। যতদূর মনে হয় সবসুদ্ধ এই আটজন ছাড়া হোটেলে আর কোনো লোক নেই।
সূপ খেতে খেতে ফেলুদাকে বললাম, ‘ধমীজার কাছে তো আজকেই যাবার কথা?’
‘চারটেয় অ্যাপয়েন্টমেন্ট। তিনটেয় বেরোলেই হবে।’
‘বাড়িটা কোথায় জানো?’
‘ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার হল পড়ে কুফ্রি যাবার পথে। এখান থেকে আট মাইল।’
‘তা হলে এক ঘণ্টা লাগবে কেন?’
‘অনেকখানি রাস্তা বরফে ঢাকা। পাঁচ মাইলের বেশি স্পীড তুললে গাড়ি স্কিড করতে পারে।’ তারপর লালমোহনবাবুর দিকে ফিরে বলল, ‘আপনার সঙ্গে যা গরম আছে প’রে নেবেন। যেখানে যাচ্ছি সেটা সিমলার চেয়ে এক হাজার ফুট বেশী হাইটে। বরফ আরো অনেক বেশি।’
লালমোহনবাবু চামচ থেকে সুড়ুৎ করে খানিকটা সূপ টেনে নিয়ে বললেন, ‘শেরপা যাচ্ছে সঙ্গে?’
কথাটা শুনে প্রচণ্ড হাসি পেয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ফেলুদা বেশ গম্ভীরভাবেই জবাব দিল, ‘না। রাস্তা আছে। গাড়ি যাবে।’
সূপ শেষ করে যখন মাছের জন্য অপেক্ষা করছি তখন ফেলুদা হঠাৎ লালমোহনবাবুকে বলল, ‘আপনি যে অস্ত্রের কথা বলছিলেন সেটা কী হল?’
লালমোহনবাবু একটা কাঠির মতো সরু, লম্বা রুটির খানিকটা চিবোতে চিবোতে বললেন, ‘সেটা আমার বাক্সে রয়েছে। এখনো দেখানোর ঠিক মওকা পাইনি।’
‘ব্যাপারটা কী?’
‘একটা বুমের্যাং।’
ওরেব্বাস্! এই কারণেই কাল রাত্রে ঘুমের মধ্যে ভদ্রলোক বুমের্যাং বলে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন!
‘ও জিনিসটা আবার কোথায় পেলেন?’ ফেলুদা জিগ্যেস করল।
‘এক অস্ট্রেলিয়ান সাহেব বিজ্ঞাপন দিয়েছিল কাগজে। আরো পাঁচ রকম জিনিসের মধ্যে ওটাও ছিল। লোভ সামলাতে পারলুম না। শুনিচি ঠিক করে ছুঁড়তে পারলে নাকি শিকারকে ঘায়েল করে আবার শিকারীর হাতেই ফিরে আসে।’
‘একটু ভুল শুনেছেন। শিকার ঘায়েল হলে অস্ত্র শিকারের পাশেই পড়ে থাকে। লক্ষ্য যদি মিস্ করে তাহলেই আবার ফিরে আসে।’
‘সে যাই হোক মশাই—ছোঁড়া খুব ডিফিকাল্ট। আমি আমাদের গড়পারের বাড়ির ছাদ থেকে ছুঁড়েছিলুম। তা সে বুমের্যাং গিয়ে দীনেন্দ্র স্ট্রীটের এক বাড়ির তেতালার বারান্দায় ঝোলানো ফুলের টব দিলে ভেঙে। ভাগ্যে চেনা বাড়ি ছিল—তাই ফেরত পেলুম।’
‘ওটা আজ সঙ্গে নিয়ে নেবেন।’
লালমোহনবাবুর চোখ জ্বল জ্বল করে উঠল—‘ডেঞ্জার এক্সপেক্ট করছেন নাকি?’
‘পাথরটা তো পায়নি সে লোক এখনো!’
ফেলুদা যদিও কথাটা বেশ হালকাভাবেই বলল, আমি বুঝতে পারলাম যে কোনো রকম একটা গোলমালের আশঙ্কা সেও যে করছে না তা নয়।
তিনটে বাজতে পাঁচ মিনিটের সময় একটা নীল অ্যাম্বাসাডর ট্যাক্সি এসে আমাদের হোটেলের সামনে দাঁড়াল। আমরা তিনজনই সামনের বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছিলাম, গাড়িটা আসতেই ফেলুদা চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। ড্রাইভারটা এখানকারই লোক, বয়স অল্প, বেশ জোয়ান চেহারা। ফেলুদা সামনে ড্রাইভারের পাশে বসল, তার সঙ্গে ধমীজার (নকল) বাক্স, আর আমরা দুজন পিছনে। লালমোহনবাবু তার বুমের্যাংটা ওভারকোটের ভিতর নিয়ে নিয়েছেন। কাঠের তৈরি জিনিসটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখেছি। অনেকটা হকি স্টিকের তলার অংশটার মতো দেখতে, যদিও তার চেয়ে অনেক পাতলা আর মসৃণ।
আকাশে সাদা সাদা মেঘ জমেছে, তাই শীতটাও খানিকটা বেড়েছে। তবে মেঘ ঘন নয়, তাই বৃষ্টির সম্ভাবনা বিশেষ নেই।
কাঁটায় কাঁটায় তিনটের সময় আমাদের গাড়ি ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার হলের উদ্দেশে রওনা দিল।
ক্লার্কস হোটেলটা শহরের ভিতরেই। এসে অবধি হোটেলের বাইরে যাওয়া হয়নি। গাড়ি যখন শহর ছেড়ে নির্জন পাহাড়ী পথ ধরল তখন প্রথম সিমলা পাহাড়ের বরফে ঢাকা ঠাণ্ডা থমথমে মেজাজটা ধরতে পারলাম। রাস্তার এক পাশ দিয়ে পাহাড় উঠে গেছে—কোনো সময় বাঁয়ে, কোনো সময় ডাইনে। একদিকে খাড়াই, একদিকে খাদ। রাস্তা বেশি চওড়া নয়, কোনো রকমে দুটো গাড়ি পাশাপাশি যেতে পারে। পাহাড়ের গায়ে চারিদিক ছেয়ে রয়েছে ঘন ঝাউ বন।
প্রথম চার মাইল রাস্তা দিব্যি কুড়ি-পঁচিশ মাইল স্পীডে যাওয়া সম্ভব হল, কারণ এই অংশটায় রাস্তার উপরে বরফ নেই বললেই চলে। বনের ফাঁক দিয়ে দূরের পাহাড়ে বরফ দেখা যায়, আর মাঝে মাঝে রাস্তার এক পাশে বা উপর দিকে চাইলে পাহাড়ের গায়ে বরফ দেখা যায়। কিন্তু এবার ক্রমে দেখছি বরফ বাড়ছে, আর সেই সঙ্গে আমাদের গাড়ির স্পীড কমে আসছে। পাঁচ মাইলের মাথায় শুরু হল রাস্তার উপর এক হাত পুরু বরফ। তার উপরে গভীর হয়ে পড়েছে গাড়ির চাকার দাগ, সেই দাগের উপর চাকা ফেলে অতি সাবধানে এগিয়ে চলেছে আমাদের ট্যাক্সি। মাটি এতো পিছল যে মাঝে মাঝে গাড়ির চাকা ঘুরে যাচ্ছে, কিন্তু গাড়ি চলছে না।
নাকের ডগা আর কানের পাশটা ক্রমে ঠাণ্ডা হয়ে আসতে লাগল। লালমোহনবাবু একবার বললেন তাঁর কানে তালা লেগে গেছে, আরেকবার বললেন তাঁর নাক বন্ধ হয়ে আসছে। আমি অবিশ্যি নিজের শরীর নিয়ে একদম মাথা ঘামাচ্ছি না। আমি খালি ভাবছি, কী অদ্ভুত জগতে এসে পড়েছি আমরা! এ এমন একটা জায়গা যেখানে মানুষ থাকার কোনো মানেই হয় না। এখানে শুধু থাকবে বরফের দেশের রকমারি পাখি আর পোকামাকড়। কিন্তু তার পরেই আবার মনে হচ্ছে—এ রাস্তা মানুষের তৈরি, রাস্তার বরফের উপর গাড়ির চাকার দাগ রয়েছে, এ রাস্তা দিয়ে একটু আগেও গাড়ি গেছে, অনেকদিন থেকেই যাচ্ছে, অনেকদিন ধরেই যাবে। আর সত্যি বলতে কি, আমাদের অনেক আগেই এখানে মানুষ না এলে এমন আশ্চর্য দৃশ্য আমাদের দেখাই হতো না।
এই অদ্ভুত তুষাররাজ্য দিয়ে আরো মিনিট কুড়ি চলার পর হঠাৎ রাস্তার ধারে একটা কালো কাঠের ফলকে সাদা অক্ষরে লেখা দেখলাম ‘ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার হল’। এমন নির্ঝঞ্চাটে আমাদের জার্নিটা শেষ হয়ে যাবে সেটা ভাবতেই পারিনি।
আরো কিছুদূর যেতেই রাস্তার ধারে একটা ফটক পড়ল যার গায়ে ধমীজার বাড়ির নামটা লেখা রয়েছে—‘দি নুক’। গাড়ি ডান দিকে ঘুরে গেটের মধ্যে দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে যেতেই প্রকাণ্ড পুরোনো বিলিতি ধরনের টাওয়ার-ওয়ালা বাড়িটা দেখা গেল। বাড়ির ছাদে আর কার্নিশে পুরু হয়ে বরফ জমে আছে। সাহেবী মেজাজের মানুষ না হলে এরকম সময় এরকম জায়গায় এরকম বাড়িতে কেউ থাকতে পারে না।
আমাদের ট্যাক্সি পোর্টিকোর নিচে গিয়ে থামল। আমরা নামতেই গরম উর্দিপরা বেয়ারা এসে ফেলুদার হাত থেকে কার্ড নিয়ে ভেতরে গেল, আর তার এক মিনিটের মধ্যেই বাড়ির মালিক নিজেই বেরিয়ে এলেন।
‘গুড আফটারনুন মিস্টার মিটার। আপনার পাংচুয়ালিটি প্রশংসনীয়। ভেতরে আসুন, প্লীজ।’
ধমীজার ইংরিজি উচ্চারণ শুনলে সাহেব বলে ভুল হয়। বর্ণনা শুনে যে রকম.কল্পনা করেছিলাম, চেহারা মোটামুটি সেই রকমই। ফেলুদা আমার আর লালমোহনবাবুর সঙ্গে ভদ্রলোকের পরিচয় করিয়ে দিলে পর আমরা সবাই একসঙ্গে ভেতরে ঢুকলাম। কাঠের মেঝে ও দেয়ালওয়ালা প্রকাণ্ড ড্রইংরুম, তার এক পাশে ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে। সোফায় বসার আগেই ফেলুদা তার হাতের ব্যাগটা তার আসল মালিকের হাতে তুলে দিল। ধমীজার নিশ্চিন্ত ভাব দেখে বুঝলাম সে আমাদের ভাঁওতা একেবারেই ধরতে পারেনি।
‘থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ! মিস্টার লাহিড়ীর ব্যাগটাও আমি হাতের কাছেই এনে রেখেছি।’
‘একবার ঢাকনা খুলে ভেতরটায় চোখ বুলিয়ে নিন’, ফেলুদা হালকাভাবে সাহেবী হাসি হেসে বলল।
ধমীজাও হেসে ‘ওয়েল, ইফ ইউ সো সো,’ বলে ঢাকনাটা খুলল। তারপর জিনিসপত্র আলতোভাবে ঘেঁটে বলল, ‘সব ঠিক আছে—কেবল এই খবরের কাগজগুলো আমার নয়।’
‘আপনার নয়?’ ফেলুদা প্রশ্ন করল। সে ইতিমধ্যে কাগজগুলো ধমীজার হাত থেকে নিয়ে নিয়েছে।
‘না। অ্যান্ড নাইদার ইজ দিস্।’ ধমীজা কাল্কা স্টেশন থেকে কেনা সুপুরি ভরা কোডাকের কৌটোটা ফেলুদাকে দিয়ে দিল। ‘বাকি সব ঠিক আছে।’
‘ওঃ হো’, ফেলুদা বলল, ‘ওগুলো বোধহয় ভুল করে আপনার বাক্সে চলে গেছে।’
যাক—তাহলে এটা বোঝা যাচ্ছে যে, ধমীজার সঙ্গে ওই পাথরের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তাহলে ওই কৌটো কী করে গেল ওই বাক্সের মধ্যে?
‘অ্যাণ্ড হিয়ার ইজ মিস্টার লাহিড়ীজ ব্যাগ।’
ঘরের এক পাশে একটা টেবিলের উপর থেকে দীননাথবাবুর ব্যাগটা ফেলুদার হাতে চলে এলো। ধমীজা হেসে বললেন, ‘আপনি যে কথাটা আমাকে বললেন, আমিও আপনাকে সেটা বলতে চাই—একবার ঢাকনা খুলে ভেতরটা দেখে নিন।’
ফেলুদা বলল, ‘মিস্টার লাহিড়ী কেবল একটা জিনিসের জন্যেই একটু ভাবছিলেন—একটা এনটারো-ভায়োফর্মের শিশি—’
‘ইট্স দেয়ার। রয়েছে বাক্সের ভেতর’, বললেন মিস্টার ধমীজা।
‘—আর একটা ম্যানুস্ক্রিপ্ট ছিল কি?’
‘ম্যানুস্ক্রিপ্ট?’
ফেলুদা বাক্সটা খুলেছে। ঘাঁটবার দরকার নেই, পাঁচ হাত দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে ওর মধ্যে কোনো খাতা জাতীয় কিচ্ছু নেই।
ফেলুদার ভুরু ভীষণভাবে কুঁচকে গেছে। সে খোলা বাক্সটার দিকে চেয়ে রয়েছে।
‘কী ম্যানুস্ক্রিপ্টের কথা বলছেন আপনি?’ ধমীজা প্রশ্ন করল।
ফেলুদা এখনো চুপ। আমি বুঝতে পারছিলাম তার মনের অবস্থাটা কী। হয় মিস্টার ধমীজাকে মুখের ওপর চোর বলতে হয়, আর না হয় সুড়সুড়িয়ে ওই খাতা ছাড়া বাক্স নিয়েই থ্যাঙ্ক ইউ বলে চলে আসতে হয়।
ধমীজাই কথা বলে চললেন—‘আই অ্যাম ভেরি সরি মিস্টার মিটার, কিন্তু আমি প্রথম যখন গ্র্যান্ড হোটেলে আমার ঘরে বাক্সটা খুলি, তখন ওতে যা ছিল, এখনো ঠিক তাই আছে। খাতা তো ছিলই না, এক টুকরো কাগজও ছিল না। আমি বাক্সের মালিকের ঠিকানা পাবার আশায় তন্ন তন্ন করে বাক্সের ভিতর খুঁজেছি। সিমলায় এসে এ বাক্স আমার আলমারির ভেতর চাবি বন্ধ অবস্থায় ছিল। এক মুহূর্তের জন্যও অন্য কোনো লোকের হাতে পড়েনি—এ গ্যারান্টি আমি দিতে পারি।’
এ অবস্থায় আর কী করবে ফেলুদা? সে চেয়ার ছেড়ে উঠে লজ্জিত ভাব করে বলল, ‘আমারই ভুল মিস্টার ধমীজা। কিছু মনে করবেন না।…আচ্ছা, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ।’
‘একটু কফি…বা চা…’
‘আজ্ঞে না। থ্যাঙ্ক ইউ। আজ আসি আমরা! গুড বাই—’
আমরা উঠে পড়লাম। লেখাটা কোথায় যেতে পারে, কেন সেটা বাক্সের মধ্যে থাকবে না, সেটা কিছুই বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ মনে পড়ল, নরেশ পাকড়াশী বলেছিলেন, দীননাথবাবুকে ট্রেনে কোনো পাণ্ডুলিপি পড়তে দেখেননি। সেটাই কি তাহলে সত্যি কথা?
দীননাথবাবু কি তাহলে লেখার ব্যাপারটা একেবারে বানিয়ে বলেছেন?