অষ্টম অধ্যায় – দাক্ষিণাত্য ও মুঘল সাম্রাজ্য (১৬৫৭ পর্যন্ত)
ভারতের বৈচিত্র্য ও ঐক্য সব সময়ে সেই সকল শাসকের সামনে সমস্যা সৃষ্টি করেছে। যারা ভারতকে ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে এক করে দেখেছেন এবং একটি সার্বভৌম রাজনৈতিক শক্তির ছত্রছায়ায় ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছেন। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে সর্বদাই আঞ্চলিকতার জোরালো প্রবণতা বর্তমান। এই বিভিন্নতা আরও বেশি প্রকট বিন্ধ্য পর্বত বরাবর ভারতের দক্ষিণ অংশে। বিন্ধ্য পর্বত দক্ষিণ ভারতকে উত্তর ভারত থেকে আলাদা করেছে ঠিকই কিন্তু কোনো অভেদ্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়নি কখনো। বস্তুত ধর্মীয় নেতা, সাধু সন্ত, পরিব্রাজক প্রমুখেরা সব সময় এই দুই প্রান্তে অবাধে চলাচল করেছেন। রাজনৈতিক ভাবেও পশ্চিমের মালব ও গুজরাট এবং পূর্বের উড়িষ্যার সঙ্গে দক্ষিণের রাজ্যগুলোর বিশেষ করে বাহামনি ও বিজয়নগর এবং আরও কিছুটা আগে রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের বেশ ভালো যোগাযোগ ছিল।
মজার বিষয় হল উত্তরের কিংবা দক্ষিণের দূরবর্তী অঞ্চল জয় করতে গিয়ে দুই প্রান্তের শাসকদের বেশ বেগ পেতে হত, আর তার ফলে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তৈরি হওয়া চাপ সেই সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করত।
আকবরের নেতৃত্বে মুঘল শক্তির উত্তর ভারত জয় করতে যেখানে দীর্ঘ প্রস্তুতি সত্ত্বেও প্রায় পঁচিশ বছর সময় লেগেছিল, সেখানে দক্ষিণ ভারতের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া চলেছিল প্রায় একশো বছর ধরে (১৫৯৬-১৬৮৭)। এই দীর্ঘ প্রক্রিয়াকে আলোচনা। করতে গেলে আমাদের মাথায় রাখতে হবে একাধিক নীতি ও শাসকদের প্রতি ব্যক্তিগত পক্ষপাতের প্রেক্ষাপট, বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও সামাজিক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সম্পর্ক, ভৌগোলিক বিষয় ইত্যাদি বিভিন্ন দিককে।
১৫৯৫ সাল পর্যন্ত দাক্ষিণাত্য রাষ্ট্র
পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকে শক্তিশালী বাহামনি সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের পর যে তিনটি শক্তিশালী রাজ্যের উত্থান ঘটেছিল সেগুলি হল–আহমেদনগর, বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা। এই রাজ্যগুলি একে অপরের সঙ্গে এবং বিজয়নগরের সঙ্গে ক্রমাগত সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। সৌভাগ্যবশত হোক বা অকস্মাৎ প্রয়োজনের খাতিরে তোক এই তিন রাজ্য একজোট হয়ে বিজয়নগরের বিরুদ্ধে ১৫৬৫ সালে তালিকোটার কাছে। বান্নিহাট্টিতে একটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। সেই যুদ্ধে জয়লাভ করলেও এদের নিজেদের মধ্যে ছায়া যুদ্ধের কোনো অবসান ঘটেনি। আহমেদনগর ও বিজাপুর উভয় রাজ্য উর্বর ও সমৃদ্ধশালী শোলাপুরের দখল নিতে উঠে-পড়ে লেগেছিল। ১৫২৪ সালে আহমেদনগরের শাসক বুরহান শাহ ও বিজাপুরের শাসক ইসমাইল আদিল খান সমঝোতায় আসতে সম্মত হন এবং ঠিক হয় যে ইসমাইল আদিল শাহের বোনকে বিবাহ করবেন বুরহান নিজাম শাহ আর পণ হিসাবে শোলাপুর তুলে দেওয়া হবে তার হাতে। কিন্তু বিবাহের পর আদিল শাহ শোলাপুরের দুর্গ সহ সেখানকার সাড়ে পাঁচটি উর্বর সরকার হস্তান্তর করতে অস্বীকার করলে আবার আহমেদনগর ও বিজাপুরের মধ্যে রক্তাক্ত শত্রুতা শুরু হয় ও যুদ্ধ বেঁধে যায়। উভয় শক্তির কাছে এবার শোলাপুর জয় করা সম্মান ও মর্যাদার প্রশ্নে পরিণত হয়। শোলাপুর ছাড়াও দাক্ষিণাত্যের আরও দুটি ছোটো অথচ স্বাধীন রাজ্য বিদর ও বেরার জয় করার বাসনাও ছিল আহমেদনগর ও বিজাপুরের। বিদর ছিল পুরোনো বাহামনি সাম্রাজ্যের অবশিষ্ট অংশ। এই অঞ্চলটি বাহামনি সাম্রাজ্যের উজির আলি বরিদ দেখাশোনা করতেন এবং যতদিন-না সাম্রাজ্যটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় ততদিন পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করেছিলেন যাতে সাম্রাজ্যের পতন হলেই তিনি স্বাধীন শাসক হিসাবে এলাকাটির দখল নিতে পারেন। দাক্ষিণাত্যের অন্যান্য রাজ্যগুলোর ক্রমাগত আক্রমণ সামলে বরিদী বংশ সেখানে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত নিজেদের শাসন কায়েম রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে নলদুর্গকে কেন্দ্র করে বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল। একই সঙ্গে এই দুই রাজ্য কর্ণাটকে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের বাকি অংশ হারিয়েও নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে উদ্যত হয়েছিল।
সুতরাং এটা বলতেই হবে যে দাক্ষিণাত্যের প্রায় সব প্রথম সারির রাজ্যগুলোর মধ্যে সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রবণতা ছিল প্রবল। তাই পারস্পরিক শত্রুতার কারণে এদের কারও পক্ষে উত্তর ভারত থেকে ধেয়ে আসা আক্রমণকে একযোগে প্রতিহত করা সম্ভব হয়নি।
গুজরাটি সাম্রাজ্যের পতনের পর আহমেদনগর ও বিজাপুর আবার একটি সমঝোতায় এসে ঠিক করে যে আহমেদনগর এবার বিনা বাধায় বেরার দখল করতে পারবে এবং সম পরিমাণ আয়তনের অঞ্চল বিজয়নগর থেকে দখল করতে বিজাপুরকেও কেউ বাধা দেবে না। সমঝোতা মতে আহমেদনগর বেরার দখল করলেও (১৫৭৩) বিজাপুর কিন্তু বিজয়নগরে কোনো অঞ্চলে হাত দিতে পারেনি। ফলে তাদের প্রতারিত হতে হয়।
এই প্রকার রাজনৈতিক শত্রুতা ছাড়াও সে সময় দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলি জাতিগত বিবাদ ও সাম্প্রদায়িক হিংসায় ব্যতিব্যস্ত ছিল। বাহামনি সুলতানি সাম্রাজ্যের কথা যদি প্রথমে বলি, সেখানে আমরা দেখতে পাই যে অভিজাততন্ত্র দুই ভাগে বিভক্ত ছিল–একদিকে ছিল বিদেশিরা, যাদের বলা হত আফাঁকিবা ঘারিব, আর অন্যদিকে ছিল দক্ষিণী মানুষ। দক্ষিণীরা আবার আফগান ও হাবসি–এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। এই হাবসিরা আসলে এসেছিল আবিসিনিয়া ও আফ্রিকার লোহিত সাগরের তীরবর্তী অঞ্চল থেকে। আফাঁকিদের মধ্যে অনেকেই এসেছিল খুরাসান ও ইরান অঞ্চল থেকে যেখানে যোড়শ শতকে সাফাভিদদের উত্থানের মধ্য দিয়ে শিয়াবাদ হয়ে উঠেছিল রাষ্ট্রের প্রধান ধর্ম। ফলে আফার্কিদের মধ্যে অনেকেই শিয়া ধর্মাবলম্বী এই সন্দেহে দক্ষিণীরা এদের চরম বিরোধিতা শুরু করেছিল। বিজাপুরের শাসক ইউসুফ আদিল শাহ ১৫০৩-৪ সালে শিয়াবাদকে রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা দেওয়ায় প্রশাসনে দক্ষিণী অভিজাতদের পদমর্যাদা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির অবক্ষয় ঘটে গিয়েছিল। আবার যখন দক্ষিণী গোষ্ঠীর ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছিল তখন তারা সুন্নিবাদকে পুনঃস্থাপন করে আফাঁকিদের তথা শিয়াবাদকে উৎখাত করে দিয়েছিল।
আহমেদনগরেও জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক বিবাদ নতুন কিছু ছিল না। গোলকুণ্ডায় ১৫০৩ সালে শাসককুল শিয়াবাদকে সমর্থন জানিয়েছিল ঠিকই, তাই বলে সেখানে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব হত না তা কিন্তু নয়। আবার এই সময় মাহদাবিবাদের উত্থান ঘটায় সাম্প্রদায়িক সংঘাত অন্য মাত্রা লাভ করেছিল। সৈয়দ মহম্মদকে এরা মাহদি বা উদ্ধারকর্তা হিসাবে দাবি করায় শিয়া ও সুন্নি কোনো সম্প্রদায়ের নেতাই তা মেনে নিতে পারেননি।
এই সময় আর-একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটছিল তা হল দাক্ষিণাত্যের নানা বিষয়ে ক্রমাগত মারাঠাদের হস্তক্ষেপ। বাহামনি সাম্রাজ্যে বহু মারাঠা সৈন্যকে সহায়ক সেনাবল বা বর্গির (bargir) (সাধারণত এরা বর্গি নামে পরিচিত ছিল) হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল। স্থানীয় অঞ্চলের রাজস্ব বিষয় দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল দক্ষিণী ব্রাহ্মণদের ওপর। বাহামনি শাসকদের সেবায় নিয়োজিত থাকার ফলে যে সকল পুরোনো মারাঠা পরিবারের প্রতিপত্তি এ সময় বেশ বেড়ে উঠেছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মোরে, নিমবালকর, ঘটগে প্রমুখ। এদের বেশিরভাগ ছিলেন শক্তিশালী জমিদার যাদের দাক্ষিণাত্যে বলা হত দেশমুখ। এরা কিন্তু রাজপুতদের মতো রাজবংশ পরম্পরায় কোনো রাজ্য শাসন করতেন না। তাছাড়া এরা এমন কোনো জাতিগোষ্ঠীর নেতা ছিলেন না যাদের সাহায্য ও পুঁজির ওপর এরা নির্ভর করতে পারতেন। এই জায়গা থেকে অনেক মারাঠা সর্দার নিছক যুদ্ধবাজ হিসাবে নিজ বিশ্বাসযোগ্যতার পরিচয় দিয়ে শক্তিশালী দক্ষিণী রাজ্যগুলোতে ভালো জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ষোড়শ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলি মারাঠাদের নিজ নিজ পক্ষে টানার নীতি গ্রহণ করায় বহু মারাঠা প্রধান দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলি বিশেষ করে বিজাপুর ও আহমেদনগরের প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মারাঠাদের কাজে লাগানোর এই নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন ১৫৫৫ সালে সিংহাসনে বসা বিজাপুরের শাসক ইব্রাহিম আদিল শাহ। বলা হয় যে তার সেনাবাহিনীতে নাকি প্রায় ৩০,০০০ মারাঠা যোদ্ধা (বর্গি) ছিল এবং তিনি তাঁর রাজস্ব প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রেও নাকি মারাঠাদের যথেষ্ট সুযোগ করে দিয়েছিলেন। মনে হয় তিনি রাজস্ব হিসাব নির্ধারণের সর্বস্তরে মারাঠাদের নিয়োগ করেছিলেন। এই নীতির ফলে বিজাপুরে শুধু যে ভোঁসলেদের (ঘোরপড়েদের পারিবারিক নাম ছিল ভোঁসলে) মত পুরোনো মারাঠি পরিবারের উত্থান ঘটেছিল তাই নয়, ডাফলিদের (বা চবন) মতো অন্যান্য পরিবারের প্রাধান্যও যথেষ্ট পরিমাণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাছাড়া কূটনৈতিক সমঝোতার জন্য প্রায়শই মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণদের ব্যবহার করা হত। তাই আহমেদনগরের শাসক কানোজি নারসি নামে এক ব্রাহ্মণকে পেশোয়া উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
গোলকুণ্ডায় সুলতান কুলি কুতুব শাহ কেবল বিজয়নগরের হিন্দু রাজাদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত থাকা ছাড়া আর কোথাও হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে কোনোরকম বৈষম্য করেননি। তাঁর উত্তরসূরি ইব্রাহিম কুতুব শাহ তেলেগুদের খুব বড়ো পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং সামরিক, প্রশাসনিক ও কূটনৈতিক প্রয়োজনে প্রায়শই তিনি হিন্দু আধিকারিকদের সাহায্য নিতেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, এ সময় মুরারি রাও। নামে একজন হিন্দু আধিকারিকের ক্রমপর্যায়ে পদোন্নতি হয়েছিল এবং সব দিক থেকে তিনি কার্যত রাজ্যের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন।
সুতরাং যেভাবে স্থানীয় ভূম্যধিকারী শ্রেণির সঙ্গে সমঝোতা করে এবং যোদ্ধা সম্প্রদায়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকা মানুষদের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের রাজ্যগুলি এই সময় সাফল্য পাচ্ছিল, সেই নীতি দাক্ষিণাত্যেও সমান ভাবে কার্যকর করে সাফল্য এসেছিল। যদিও দক্ষিণী শাসকরা নিজেদের মধ্যে সংকীর্ণ আঞ্চলিক বিবাদকে কখনোই ঝেড়ে ফেলতে পারেননি, তবুও তাদের নেওয়া নীতির ফলে এই সময় দাক্ষিণাত্যে হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষের ঘটনা খুব একটা দেখা যায়নি এবং আঞ্চলিক সংস্কৃতির গৌরব সম্পর্কে সচতেনতার বিকাশও ঘটেছিল। তবে গুরুত্বপূর্ণ যেটা ছিল তা হল এই চেতনা ও আঞ্চলিকতার কারণে মুঘলরা তাদের কাছে। বহিরাগত হিসাবেই বিবেচিত হয়েছিল।
দাক্ষিণাত্যের উদ্দেশ্যে মুঘল অভিযান
মুঘল সাম্রাজ্য উত্তর ভারতে নিজেদের শক্তিকে সুসংবদ্ধ করার পর দক্ষিণ ভারতের দিকে আক্রমণ করতে যে এগিয়ে আসবে সেটা একপ্রকার অবশ্যম্ভাবী ছিল। তুঘলক। সুলতানদের দাক্ষিণাত্য জয় এবং উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি উভয় এলাকার মধ্যে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান অনেক মজবুত করে তুলেছিল। দিল্লি সুলতানির পতনের পর বহু সুফি সাধক ও সুযোগসন্ধানী মানুষ বাহামনি সাম্রাজ্যের দরবারে কাজের আশায় চলে এসেছিল। রাজনৈতিক ভাবেও উত্তর ও দক্ষিণ ভারত এ সময় আলাদা ছিল না। সমৃদ্ধশালী কোঙ্কন উপকূল তথা, বেরার অঞ্চলের ওপর গুজরাটের শাসকদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল আগে থেকেই। গুজরাটের শাসক বাহাদুর শাহ আহমেদনগর আক্রমণ করে সেখানকার শাসককে, বাধ্য করেছিলেন তার নামে খুৎবা পাঠ করতে। তারপর ষাট ও সত্তরের দশকে মালব। ও গুজরাট জয় করার পর মুঘলরাও আর নিজেদের দাক্ষিণাত্য আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
১৫৬২ সালে মুঘলদের মালব জয়ের পর পীর মহম্মদ খান খান্দেশ অঞ্চল আক্রমণ করেছিলেন। স্বাধীন এই রাজ্যটি উত্তর ভারতের সীমানা হিসাবে পরিচিত নর্মদা এবং তাপ্তী নদীর মধ্যবর্তী স্থলে অবস্থিত ছিল। মালবের পূর্বর্তন শাসক বাজ বাহাদুরকে আশ্রয় দেবার শাস্তিস্বরূপ খান্দেশের বিরুদ্ধে এই আক্রমণ পরিচালিত হয়েছিল। কিন্তু এই অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল। দু’বছর পর যখন আকবর মালবে এসেছিলেন সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত শাসক আবদুল্লাহ খান উজবেকের স্বতন্ত্র আচরণকে শায়েস্তা করতে, তখন খান্দেশের শাসক মুবারক শাহ আকবরের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রস্তাব দেন এবং তার কন্যাকে আকবরের সঙ্গে বিবাহ দিতে সম্মত হন। এছাড়া তিনি আকবরের হাতে তার চাহিদা মতো মালব জয় সম্পূর্ণ। করতে বিজয়গড় ও হান্ডিয়া এলাকাও তুলে দিয়েছিলেন। তবে এটা ভাবা ঠিক হবে না যে ১৫৬৪ সালেই আকবর ও তার দলবল মালব জয়ের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ ভারত আক্রমণের নীতি গ্রহণ করেছিলেন।
সম্ভবত গুজরাট জয়ের পর আকবর তার নজর দাক্ষিণাত্যের দিকে ঘুরিয়েছিলেন এবং মির হুসেন রিজাভিকে একপ্রকার অনুচর সাজিয়ে দাক্ষিণাত্যের পরিস্থিতি বোঝার জন্যে প্রেরণ করেছিলেন। দাক্ষিণাত্যে অনুচর প্রেরণের আর একটা কারণ ছিল আহমেদনগরের রাজদরবারে আশ্রয় নেওয়া মহম্মদ হুসেন মির্জা ও তাঁর দলবলের গতিবিধির ওপর নজর রাখা। ১৫৭৬ সালে মুঘল অনুচর দাক্ষিণাত্য সফর করে ফিরে আসে। এরপর আহমেদনগরের শাসক সৌহার্দ্য প্রদর্শন করে আকবরকে অনেক উপঢৌকন প্রেরণ করেন এবং মহম্মদ হুসেন মির্জাকে তার দরবার থেকে বিতাড়িত করে দেন। মহম্মদ হুসেন মির্জা তারপর খান্দেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন। আকবর এরপর খান্দেশ আক্রমণ করেছিলেন কারণ সেখানকার নতুন শাসক রাজা আলি আকবরকে উপঢৌকন প্রদানে অনীহা দেখিয়েছিলেন। আসলে নিজাম শাহের প্ররোচনায় মুঘলদের বিরোধিতা করলেও খুব তাড়াতাড়ি রাজা আলি এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে দক্ষিণী রাজ্যগুলো যে-যার স্বার্থ নিয়ে চলে। তাছাড়া মুঘল শক্তির আঘাতে তিনি যথেষ্ট কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। ফলে তিনি যে কেবল উপঢৌকন প্রদানে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন তাই নয়, মহম্মদ হুসেন মির্জাকে গ্রেফতার করে মুঘলদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
এইভাবে দাক্ষিণাত্যের প্রথম কোনো রাজ্য হিসাবে খান্দেশ মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করেছিল। খাদেশকে খুব সহজেই দাক্ষিণাত্যের রাজগুলির বিরুদ্ধে মুঘল কার্যকলাপের কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করা যেত, এমনকি দাক্ষিণাত্যে থাকা মুঘল অনুচর মির মুহসিন এমনও খবর দিয়েছিলেন যে দাক্ষিণাত্যে রাজ্যগুলোর মধ্যে বিশৃঙ্খলতা ও অস্থিরতার পরিস্থিতি চরম। এমন অবস্থা দাক্ষিণাত্য আক্রমণের জন্য ছিল আদর্শ। কিন্তু বাংলা ও বিহারের পরিস্থিতি দেখে সেখানে আক্রমণ করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিচার করে আকবর সেই মুহূর্তে দাক্ষিণাত্য আক্রমণের পরিকল্পনা স্থগিত রেখেছিলেন।
আবুল ফজলের বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে মুঘলরা ভারত বলতে আসমুদ্র হিমালয় অখণ্ড একটা দেশকে বুঝত এবং মনে করত যে এই সমগ্র দেশের ওপর শাসন করার একমাত্র নৈসর্গিক অধিকার তাদেরই আছে। আর এই কারণেই মুঘল সম্রাটগণ দাক্ষিণাত্যের শাসকদের সম্বোধন করার সময় শাহ’ কথাটা ব্যবহার করতেন না, পরিবর্তে ব্যবহার করতেন কেবলমাত্র ‘খান’ কথাটা, এমনকি অনেক সময় তাদের নিছক মরজাবান বা প্রধান বলে ডাকতেন। আবুল ফজল আরও লিখেছেন যে সর্বোচ্চ শাসক হিসাবে ‘অনাচার ও স্বৈরাচারের তুমুল ভার থেকে অত্যাচারিতদের মুক্ত করার একমাত্র গুরুদায়িত্ব রয়েছে মুঘলদের। আসলে সাম্রাজ্য গড়ে তোলার অজুহাত হিসাবে মধ্যযুগের সব শক্তিই এইভাবে প্রজাদের কল্যাণের কথা বলত। মুঘল শক্তিও এর ব্যতিক্রম ছিল না। আবুল ফজল স্পষ্ট জানিয়েছিলেন যে সারা ভারত জুড়ে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠার অর্থ এই নয় যে সব স্থানীয় রাজ্যকে ধ্বংস করে সর্বত্র সরাসরি শাসন প্রতিষ্ঠা করা। উত্তর ভারতে আকবর যে মডেল ব্যবহার করেছিলেন এবং যা দক্ষিণ ভারতের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন তা । ছিল রাজপুতদের মতো যে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর নিজ নিজ এলাকায় ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল শান্তি (সাম্প্রদায়িক শান্তি সহ) ও আইন-শৃঙ্খলা সুষ্ঠু ভাবে বজায় রাখার ক্ষমতা রাখে তাদের সঙ্গে এমন ভাবে সম্পর্ক গড়ে তোলা যাতে তারা একদিকে যেমন মুঘল সার্বভৌমত্ব মেনে নেবে, তেমনি অন্যদিকে প্রয়োজন পড়লে মুঘলদের হয়ে কাজও করতে পারবে।
মুঘলদের গুজরাট জয়ের এক দশকের বেশি সময় পরে আকবর দাক্ষিণাত্যের। পরিস্থিতির দিকে নজর দিয়েছিলেন এবং আশা করেছিলেন যে কূটনৈতিক কৌশলে। দক্ষিণী রাজ্যগুলোতে নাগরিক সুশাসন ও সাম্প্রদায়িক শান্তির পাশাপাশি সামগ্রিক আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে সেখানকার শাসকদের মুঘল সার্বভৌমত্ব। মেনে নিতে বাধ্য করানো যাবে। ১৫৭৯ সালে বিজাপুরের শাসক আলি আদিল শাহের কাছে বিশেষ ‘পথ প্রদর্শক হিসাবে পাঠানো হয়েছিল আইন-উল-মুলককে। বিজাপুর থেকে দুর্মূল্য উপহার ও সৌহার্দের বার্তা দেওয়া একটি পত্র নিয়ে তিনি ফিরে এলেও বিজাপুরের শাসক মুঘল কর্তৃত্ব মেনে নেবার কোনোরকম লক্ষণ দেখাননি। ১৫৮০ সালে আলি আদিল শাহের মৃত্যুর পর বিজাপুরে আবার দলাদলি, বিবাদ ও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের বাতাবরণ তৈরি হয়।
আহমেদনগরের অবস্থাও সে সময় ভালো ছিল না। সেখানকার শাসক মুর্তাজা নিজাম শাহ লোকমুখে দিওয়ানা বা পাগল বলে বেশি পরিচিত ছিলেন। একজন দাস বালকের প্রতি তার অত্যধিক অনুরাগ রাজ্যে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা সৃষ্টি করেছিল এবং মুর্তাজার ভ্রাতা বুরহানকে সিংহাসনে বসানোকে কেন্দ্র করে অভিজাতদের মধ্যে প্রবল দলাদলি শুরু হয়েছিল। এই দলাদলিতে বুরহান যখন সিংহাসনে বসতে ব্যর্থ হলেন। তখন তিনি ঘুরতে ঘুরতে আকবরের দরবারে গিয়ে হাজির হলেন ১৫৮৪ সালে। এরপর আকবর নিজাম শাহের বিরুদ্ধে অভিযান চালান এবং বেরারের কাছে একটি সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করেন। সম্ভবত এই সময় উত্তর-পশ্চিম দিকে পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠলে সেদিকে নজর দেওয়ার কারণে আকবর আর নিজাম শাহের বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পাননি। কিন্তু এর মধ্যে আহমেদনগরের পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। মাহদাবিবাদকে রাজ্যের প্রধান ধর্মের স্বীকৃতি দেওয়া হলে সেখানে ভয়ংকর রক্তাক্ত দাঙ্গা শুরু হয়।
১৫৮৯ সালে মুর্তাজা নিজাম শাহ মারা যান এবং তারপর আকবর আহমেদনগরের পরবর্তী শাসক হিসাবে বুরহান নিজাম শাহের মনোনয়নকে সমর্থন জানিয়ে এই আশায় বুক বেঁধেছিলেন যে দীর্ঘদিন ধরে মুঘল দরবারে আশ্রয় লাভ করার সুবাদে বুরহানের শাসনাধীন আহমেদনগরের সঙ্গে মুঘলদের সুসম্পর্ক তৈরি হবে এবং সেখানে চলা নৃশংস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অবসান ঘটবে পরোক্ষভাবে মালবকে অনেকটা স্বস্তি দান করবে। অবশেষে খান্দেশের শাসকের সহয়াতায় বুরহান আহমেদনগরের সিংহাসনে বসেন। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর আকবরের আশা মতো মুঘলদের কর্তৃত্ব স্বীকার করার কোনো লক্ষণ তার মধ্যে দেখা যায়নি। সেখানে মাহদাবিবাদকে সরিয়ে শিয়াবাদকে প্রধান ধর্মের স্বীকৃতি দেবার পর আবার সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলা শুরু হয়।
এরপর আকবর অনেক বেশি কূটনৈতিক তথা আক্রমণাত্মক অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৫৯১ সালে দাক্ষিণাত্যের চার রাজ্যে চার দূত অভিযান প্রেরণ করা হয়। মুঘল দরবারি কবি তথা আবুল ফজলের ভ্রাতা ফৈজিকে খাদেশে প্রেরণ করা হয় সেখানকার শাসক রাজা আলিকে এটা বোঝানোর জন্য যে তার মিত্র আহমেদনগরের শাসক বুরহান নিজাম শাহ যেন তার ভুল সংশোধন করে নেন। আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি যে খান্দেশের শাসক রাজা আলি ইতিমধ্যে মুঘল কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে নিজ কন্যাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আকবরের কাছে বিবাহের জন্য। অন্য যে দূত অভিযানগুলো পাঠানো হয়েছিল দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলোতে, সেখান থেকে কেবল উপঢৌকন ও সৌহার্দের বার্তাই এসেছিল। আকবর অনেক বেশি উত্তর-পশ্চিম দিকের পরিস্থিতি নিয়ে ব্যস্ত আছেন দেখে তারা কেউই এই মুঘল অভিযানকে গুরুত্ব দেননি। এমনকি বুরহান আরও অসভ্যতা করে মুঘলদের কোনো উপঢৌকন পাঠানো তো দূরের কথা, রূঢ় ভাবে মুঘল দূতকে অপমান পর্যন্ত করেছিলেন।
মোটামুটিভাবে এই ছিল মুঘলদের ১৫৯৫ সালে দাক্ষিণাত্য আক্রমণের প্রেক্ষাপট। এর সঙ্গে আর-একটি বিষয়কে আকবরের মুঘল সাম্রাজ্যের দাক্ষিণাত্যে সম্প্রসারণের কারণ হিসাবে দেখা যেতে পারে, তা হল উপকূলবর্তী অঞ্চলে পর্তুগিজদের ক্রমবর্ধমান কার্যকলাপ। মুঘলদের গুজরাট জয়ের পর আকবর প্রথম পর্তুগিজদের সংস্পর্শে আসেন। ১৫৩০ সালে পর্তুগিজরা দিউ অল দখল করে নিয়েছিল এবং পরে তাদের প্রভাব বেসিন পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছিল। তারা সুরাটের দিকে অগ্রসর হতে চাইছিল এবং কোঙ্কন উপত্যকার বন্দরগুলি সহ গোঁয়ার বিপরীত উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোর দিকেও তাদের তীক্ষ্ণ নজর ছিল। যেভাবে তারা করতাজ বা বিশেষ অনুমতি পত্র ছাড়া অন্য কোনো বাণিজ্যিক জাহাজকে পশ্চিম উপকূল থেকে বাইরে যেতে দিত না এবং যেভাবে গুজরাটের দিকে বাণিজ্য করতে আসা সব জাহাজকে বাধ্য করত দিউ বন্দরে শুল্ক জমা দিতে, তাতে পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে অন্য সকল বণিকদের ক্ষোভ তৈরি হওয়া ছিল স্বাভাবিক। তার ওপর পর্তুগিজদের ধর্মান্তরিতকরণ কর্মসূচিও যথেষ্ট অসন্তোষের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু আকবর সুরাটে পর্তুগিজ নেতৃত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ১৫৭৩ সালে তিনি ক্যাম্বে বন্দরে পর্তুগিজদের আমদানি বাণিজ্যে বিশেষ শুল্ক ছাড়ের ব্যবস্থা করেছিলেন, গুজরাটে অবস্থিত তার আধিকারিকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে পর্তুগিজদের সেখানে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা না হয় তা দেখার জন্য এবং তাদের বিরুদ্ধে মালাবারের জলদস্যুদের উৎসাহ প্রদান করাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। প্রতিদানে পর্তুগিজরাও মুঘল দরবারের পারিবারিক জাহাজগুলোকে মক্কা গমনের সময় অনুমতিপত্র বা করতাজ গ্রহণ থেকে অব্যাহতি দেওয়া, বছরে আকবরের একটি করে জাহাজকে বিনামূল্যে করতাজ প্রদান করা এবং দিউ বন্দরে গিয়ে শুল্ক দেওয়া থেকে ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে সম্মতি জানিয়েছিল। কিন্তু তাই বলে মুঘলদের সঙ্গে পর্তুগিজদের সামগ্রিক সংঘাতের সম্ভাবনা কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। মুঘল রাজপরিবারের সদস্যদের সামুদ্রিক কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য পর্তুগিজদের কাছে গিয়ে অনুমতিপত্র নিতে হচ্ছে–এটা যথেষ্ট অপমানকর বিষয় ছিল। আর এই অপমান আরও জোরালো ভাবে দেখা গিয়েছিল যখন ১৫৭৭ সালে আকবরের একটি জাহাজ করতাজ থাকা সত্ত্বেও পর্তুগিজরা বাজেয়াপ্ত করে দিউ-এ নিয়ে গিয়েছিল ও পরে ভুল বুঝতে পেরেছিল।
১৫৮০ সালে আকবর কুতুবুদ্দিন খানের নেতৃত্বে একটি সেনাদল নিয়োগ করেছিলেন উপকূলীয় বন্দর থেকে পর্তুগিজদের উৎখাত করে হজের জন্য মুক্ত সমুদ্রপথ তৈরি রাখার জন্য। দাক্ষিণাত্যের যেসব রাজ্যগুলোর পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে নিজস্ব অভিযোগ ছিল তাদেরকেও সহযোগিতা করার জন্য আকবর আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু এই বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতি ঘটেনি। সম্ভবত আকবর বুঝতে পেরেছিলেন যে কোনো শক্তিশালী নৌবাহিনী ছাড়া পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে বড়োসড়ো সাফল্য পাওয়া সম্ভব নয়। তবে তিনি আশা করেছিলেন যে দক্ষিণে মুঘল কর্তৃত্ব আরও বেশি করে প্রতিষ্ঠিত হলে হয়তো পর্তুগিজদের ওপর অনেক বেশি কৌশলগত ও সামরিক দিক থেকে চাপ দেওয়া সম্ভব হবে।
মুঘলদের বেরার, খাদেশ ও আহমেদনগরের কিছু অংশের এলাকা জয়
১৫৯১ সালে তার কূটনৈতিক আক্রমণাত্মক নীতির ব্যর্থতা আকবরকে দাক্ষিণাত্য আক্রমণ নিয়ে আরও বেশি সক্রিয় করে তুলেছিল। ১৫৯৫ সালে বুরহান নিজাম শাহের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র ইব্রাহিম। নিজাম শাহ ক্ষমতায় এসে শোলাপুরকে কেন্দ্র করে বিজাপুরের সঙ্গে নতুন করে যুদ্ধ শুরু করেন কিন্তু সেই যুদ্ধে তিনি নিজে পরাজিত ও নিহত হন। এরপর আহমেদনগরের মসনদে বসার জন্য একাধিক প্রার্থীর উত্থান ঘটে। দরবারের পেশোয়া ও দক্ষিণী গোষ্ঠীর নেতা মিয়াঁ মাঞ্জু তার নিজের এমন এক প্রার্থীকে সামনে নিয়ে আসেন যিনি নিজামশাহী পরিবারের কেউ ছিলেন না। আবার বুরহান শাহের বোন চাঁদ বিবি যিনি ১৫৬৪ সালে আদিল শাহী শাসককে বিবাহ করেছিলেন, তিনি তার পক্ষের প্রার্থী হিসাবে মৃত রাজা ইব্রাহিম নিজাম শাহের নাবালক পুত্র বাহাদুরকে তুলে ধরেছিলেন যাকে দরবারের হাবসি গোষ্ঠী সমর্থন জানিয়েছিল। ১৫৮০ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে এই চাঁদ বিবি বহু বছর ধরে একটি বিশ্বস্ত উপদেষ্টামণ্ডলীর সহায়তায় বিজাপুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিষয়টি তদারকি করতেন। কিন্তু দরবারের দলাদলি এত বেড়ে গিয়েছিল যে তাঁকে সব দায়িত্ব তাঁর ভ্রাতা বুরহান নিজাম শাহের হাতে তুলে দিতে হয়েছিল। যাই হোক, আহমেদনগরের সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে তৈরি হওয়া বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে হাবসি গোষ্ঠীর সাহায্য নিয়ে চাঁদ বিবি যাতে রাজ্যের সমস্ত ক্ষমতা দখল করতে না পারে তার জন্যে দরবারের দক্ষিণী গোষ্ঠীর নেতা মিয়া মাঞ্জু মুঘলদের কাছে সাহায্যের আবেদন জানায়।
আকবর এমনিতে দাক্ষিণাত্য আক্রমণের জন্যে এক পা এগিয়ে ছিলেন। ১৫৯৩ সালে যুবরাজ দানিয়ালকে আদেশ দেওয়া হয়েছিল নিজাম শাহকে শায়েস্তা করার জন্যে, কিন্তু সেই অভিযান শেষমেশ মুলতুবি হয়ে যায়। এরপর নতুন করে আক্রমণ শানানোর জন্য যুবরাজ মুরদকে গুজরাটের প্রাদেশিক শাসক নিয়োগ করা হয়। তিনি যখন আক্রমণের জন্যে একেবারে প্রস্তুত, ঠিক সেই সময় মিয়া মাঞ্জুর আবেদন এসে পৌঁছায় মুঘল শিবিরে। অভিযানের নেতৃত্ব দেন আবদুর রহিম খান-ই-খানান। সঙ্গে যোগ দেন খান্দেশের শাসক রাজা আলি। নিজামশাহী অভিজাতদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে মুঘল বাহিনী খুব সহজে আহমেদনগরে এসে পৌঁছায়। কিন্তু মুঘলদের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে মিয়াঁ মাঞ্জু মুঘলদের কাছে সাহায্য চেয়ে ভুল করেছেন এই মনে করে চাঁদ বিবির পক্ষে যোগ দিয়ে মুঘল আক্রমণ প্রতিহত করবার সিদ্ধান্ত নেন। চাঁদ বিবি বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার কাছেও সাহায্যের প্রার্থনা করেন। তার ডাকে সাড়া দিয়ে বিজাপুর থেকে সাত হাজার সৈন্য আসায় চাঁদ বিবির বাহিনী বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। চার মাসের অবরোধের পর চাঁদ বিবি মুঘলদের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে এবং বেরার অঞ্চলকে মুঘলদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন। অবশেষে মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করতে রাজি হয়ে যায় আহমেদনগর এবং মুঘলদের নজরদারিতে নাবালক বাহাদুর নিজাম শাহকে শাসকের স্বীকৃতি দিয়ে চাঁদ বিবির নেতৃত্বে সেখানে অন্তর্বর্তীকালীন শাসন বলবৎ করা হয়। সময়টা ছিল ১৫৯৬ সাল এবং মুঘলরা এই সমঝোতা মানতে বাধ্য হয়েছিল কারণ তখনও আহমেদনগরের চারপাশে বিজাপুর-গোলকুণ্ডার মতো শক্তিশালী রাজ্যের বাহিনীর উপস্থিতি ছিল।
তবে এই সমঝোতায় কোনো পক্ষই সন্তুষ্ট ছিল না। মুঘলরা বালাঘাট দখল করতে চাইছিল যেটা গুজরাট ও আহমেদনগরের মধ্যে ঝামেলার মূল কারণ ছিল। নিজামশাহী অভিজাতদের মধ্যে বিবাদ লেগেই ছিল, একদল মুঘলদের হাতে বেরার অঞ্চল তুলে দেবার বিরোধিতা করছিল তো অন্যদিকে ওয়াকিল তথা পেশোয়া মহম্মদ খানের নেতৃত্বে আর-এক দল মুঘলদের সঙ্গে পরবর্তী সমঝোতায় যেতে আগ্রহী ছিল। এই রকম পরিস্থিতিতে চাঁদ বিবি বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার শাসকদের কাছে জরুরি বার্তা পাঠিয়ে অতিরিক্ত সাহায্য প্রার্থনা করেন। বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার তরফ থেকে তড়িঘড়ি সাহায্য এসেছিল কারণ এই দুই রাজ্যের শাসক এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে মুঘলদের হাতে বেরার অঞ্চল চলে যাওয়ার অর্থ হল ‘দাক্ষিণাত্যে তাদের উপস্থিতি সুদৃঢ় করার জন্য একটা স্থায়ী জমি পেয়ে যাওয়া, যেখান থেকে অনায়াসে তারা বিপদ ডেকে আনতে পারে। ফলে বিজাপুর, গোলকুণ্ডা, ও আহমেদনগরের একটি মিলিত বাহিনী বিজাপুরের সেনাধিপতি সোহেল খানের নেতৃত্বে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে বেরার পুনরুদ্ধারের অভিযান চালায়। ১৫৯৭ সালে সোনেপতের কাছে তুমুল যুদ্ধে মুঘল বাহিনী দক্ষিণী বাহিনীকে তিন-তিন বার পরাজিত করে। চাপে পড়ে বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার বাহিনী প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় এবং চাঁদ বিবি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্যে একা পড়ে যান। যদিও চাঁদ বিবি ১৫৯৬ সালের সমঝোতার শর্ত মেনে চলতে প্রস্তুত ছিলেন, তথাপি বেরারে মুঘল শিবিরের ওপর তার অভিজাতদের বিব্রতকর আক্রমণ চলতেই থাকে। ফলে বাধ্য হয়ে দ্বিতীয় বারের জন্য মুঘল বাহিনী আহমেদনগর অবরোধ করে। কোনো তরফ থেকে কোনোরকম সাহায্য না পেয়ে অবশেষে চাঁদ বিবি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন এবং মুঘলদের কাছে তার ও বাহাদুরের ভরণপোষণের জন্য মনসব ও জায়গিরের আর্জি জানান। অচিরে তিনি দরবারের শত্রুপক্ষের দ্বারা বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে অভিযুক্ত হন এবং খুন হয়ে যান। এই ভাবে শেষ হয়ে যায় দক্ষিণের রাজনীতির এক অন্যতম পরাক্রান্তা নায়িকার জীবন। মুঘলরা এরপর আহমেদনগর দখল করে নেয়। এবং বালক বাহাদুরকে গোয়ালিয়রের দুর্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই ভাবে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বালাঘাট ও দৌলতাবাদ, যা দখল করার বাসনা মুঘলদের অনেক আগে থেকে ছিল, সেই অঞ্চলগুলি সহ আহমেদনগরের দুর্গে মুঘল বিজয় পতাকা উড্ডীন হয়ে যায়।
আহমেদনগরের দুর্গ দখল করলেও দাক্ষিণাত্যে আকবরের সমস্যা তখনই শেষ। হয়ে যায়নি। মুঘল বাহিনীর পক্ষে আহমেদনগর দুর্গের চারপাশের অঞ্চল দখল করা তখনও পর্যন্ত সম্ভব হয়ে ওঠেনি। মুর্তাজা নিজাম শাহের পুত্র আশি বছরের বৃদ্ধ শাহ আলি কিছুদিন ধরে তাঁর পুত্র আলিকে নিয়ে বিজাপুরের শাসকের নিরাপত্তায় সেখানে বসবাস করছিলেন। ১৫৯৫ সালে কয়েক জন নিজামশাহী অভিজাত আলিকে দ্বিতীয় মুর্তাজা শাহ উপাধি দান করে আহমেদনগরের উত্তরাধিকার বলে ঘোষণা করে দেন। বাহাদুর চলে যাবার পর দ্বিতীয় মুর্তাজার পক্ষে একজন নিজামশাহী পরিবারের সন্তান হিসাবে আহমেদনগরের সিংহাসনে বসার রাস্তা অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল আর বিজাপুরের পূর্ণ সমর্থনও ছিল তার পক্ষে।
দাক্ষিণাত্যে মুঘল সেনাধিপতি খান-ই-খানান যুদ্ধ করতে করতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং দ্বিতীয় মুর্তাজার প্রধান সেনাপতি হিসাবে উঠে আসা মালিক অম্বরের সঙ্গে সমঝোতা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি তাদের অউসা, ধারওয়ার ও বির সরকারের কিছু অংশ আনুগত্যের খাতিরে দ্বিতীয় মুর্তাজাকে দান করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। খান-ই-খানানের কাছে দুবার পরাজিত হওয়া অম্বর এই প্রস্তাবে অবশেষে রাজি হয়েছিলেন। কিছু অঞ্চলতাকে কথামতো দেওয়া হয়েছিল। ঠিকই, কিন্তু বতটা দেওয়া হয়েছিল তা প্রাপ্ত তথ্য থেকে স্পষ্ট নয়। দক্ষিণী বিষয়ের ঐতিহাসিক ফেরিস্তার মতে, দুই পক্ষই তাদের জন্যে সম্মানজনক ভবিষ্যৎ সীমানা। স্থির করে ফেলেছিল। সময়টা ছিল ১৬০১ সাল। এইভাবে মুঘল বাহিনী। আহমেদনগরের রাজধানী ও বালাঘাট অঞ্চল দখল করলেও রাজ্যের বাকি অংশে তখনও নিজামশাহী রাজত্ব বলবৎ ছিল এবং তা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল মুঘল, কর্তৃপক্ষ।
এর কিছু বাল আগে ১৬০০ সালে আকবর মালব ও তারপরে খান্দেশে অগ্রসর হয়েছিলেন খোনকার পরিস্থিতি বোঝার জন্য। তিনি জানতে পারেন যে যুবরাজ দানিয়াল যখন আহমেদনগর যাবার পথে খান্দেশ হয়ে গমন করছিলেন তখন। খান্দেশের নতুন শাসক বাহাদুর তার প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মান প্রদর্শন করেননি। এমনকি বারবার ডাকা সত্ত্বেও তিনি আকবরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেননি। কিন্তু বাহাদুরের বিরুদ্ধে আকবরের পদক্ষেপ গ্রহণের প্রধান কারণ ছিল অন্য। বাহাদুর খান্দেশের নিকটবর্তী আসিরগড় দুর্গ দখলে রাখার বাসনা করেছিলেন, কিন্তু দাক্ষিণাত্যের অন্যতম খান্দেশের নিকটবর্তী আসিরগড় দুর্গের ওপর মুঘলদের নজর ছিল আগে থেকেই। তাছাড়া বাহাদুর কিছুতেই খান্দেশ রাজ্য ও তার রাজধানী বুরহানপুর মুঘলদের হাতে তুলে দেবার পক্ষপাতী ছিলেন না, কিন্তু এই বুরহানপুর ছিল দাক্ষিণাত্যে প্রবেশের পথ। খাদেশ ছিল সুরাট ও গুজরাটের সামুদ্রিক বন্দর এলাকার পশ্চাদভুমি এবং আগ্রা থেকে সুরাট যাওয়ার রাস্তা এই বুরহানপুরের ওপর দিয়েই ছিল। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই মুঘলদের খাদেশ অঞ্চল ও তার রাজধানীর ওপর দখল কায়েম করা খুব প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু তা মুঘলদের হাতে ছেড়ে দিতে অস্বীকার করায় বাহাদুরের সঙ্গে মুঘলদের যুদ্ধ বাঁধে। দীর্ঘদিন ধরে দুর্গ অবরুদ্ধ থাকার পর এবং দুর্গে মহামারী দেখা দেওয়ায় খান্দেশের শাসক বাহাদুর দুর্গ থেকে বেরিয়ে আসেন এবং আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন (১৬০১)। তাকে একজন ভাতাভোগী শাসকে পরিণত করে গোয়ালিয়রের দুর্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর খান্দেশ মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
যেভাবে আসিরগড় দুর্গ ও খাদেশ জয়, বেরার ও বালাঘাট দখল এবং আহমেদনগর দুর্গ ও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি অঞ্চলের ওপর মুঘল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে এটা স্পষ্ট যে দাক্ষিণাত্যে মুঘলদের সাফল্য নেহাত কম ছিল না। কিন্তু তখনও দাক্ষিণাত্যের সকল রাজ্য মুঘল শক্তির সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেবে। এই রকম পরিস্থিতিতে পৌঁছোতে অনেকটা বাকি ছিল। আসিরগড় দুর্গের পতনের পর আকবর পুনরায় বিজাপুর, গোলকুণ্ডা ও বেরারের শাসকের কাছে দূত পাঠিয়ে তাদের বশ্যতা স্বীকারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু এদের মধ্যে কোনো রাজ্যের শাসকই সেই প্রস্তাবে রাজি হননি। যদিও ইতস্তত করে অবশেষে বিজাপুরের শাসক তাঁর কন্যাকে দাক্ষিণাত্যের দায়িত্বে থাকা যুবরাজ দানিয়ালের হারেম-এ পাঠাতে রাজি হয়েছিলেন। ইতিমধ্যে যুবরাজ সেলিমের বিদ্রোহের খবর পেয়ে আকবর আগ্রায় ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু দাক্ষিণাত্যের সবথেকে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী রাজ্য বিজাপুরের তরফ থেকে এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে স্বার্থসিদ্ধি করার আশা পূর্ণ হয়নি আকবরের। আদিলশাহী রাজকুমারীর সঙ্গে যুবরাজ দানিয়ালের বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল ১৬০৪ সালে। আর তার কিছুদিনের মধ্যে অত্যধিক মদ্যপান করার কারণে আকবর চিরতরে হারিয়েছিলেন দানিয়ালকে। আকবরেরও এর কিছু কাল পর মৃত্যু ঘটে যায়। ফলে দাক্ষিণাত্যে মুঘলদের অবস্থা অস্পষ্টই থেকে যায় এবং সেই অস্পষ্টতা কাটানোর দায়দায়িত্ব সামলাতে হয় পরবর্তী মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরকে।
মালিক অম্বরের উত্থান এবং মুঘলদের সাম্রাজ্য সুদৃঢ়করণের পথে বিপত্তি (১৬০১-১৬২৭)
মুঘলদের দ্বারা আহমেদনগর দুর্গের পতন ও বাহাদুর নিজাম শাহের পরাজয়ের পর আহমেদনগর রাজ্যটি ভেঙে খণ্ড খণ্ড হয়ে প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর অধিকারে চলে যায়। তবে এই পরিস্থিতিতে একজনের উত্থান বেশ চমকপ্রদ ছিল, তিনি ছিলেন মালিক অম্বর। মালিক অম্বর ছিলেন একজন আবিসিনীয়, জন্মেছিলেন ইথিওপিয়ার হারারেতে। তার প্রথম দিককার জীবন ও কর্মকাণ্ড নিয়ে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। মনে হয় তার দরিদ্র পিতামাতা তাঁকে বাগদাদের ক্রীতদাস বাজারে বিক্রি করে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। সময়ের কাল বেয়ে তাকে এক বণিক কিনে নিয়ে আসেন। প্রতিশ্রুতির নগর দাক্ষিণাত্যে। মুর্তাজা নিজাম শাহের এক প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় মন্ত্রী চেঙ্গিজ খানের তত্ত্বাবধানে তিনি কাজ করা শুরু করেন এবং ক্রমে শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। যখন আহমেদনগরে প্রথম মুঘল আক্রমণ ঘটল তখন অম্বর বিজাপুর ও গোলকুণ্ডায় পালিয়ে গিয়ে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি অচিরেই ফিরে আসেন এবং নিজেকে আহমেদনগরের দরবারের হাবসি অভিজাত গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে ফেলে চাঁদ বিবির বিরোধিতা শুরু করেন।
১৫৯৬ সালে মুঘলদের সঙ্গে চাঁদ বিবির চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার ঠিক আগে ১৫৯৫ সালে পারোতে দ্বিতীয় মুর্তাজা শাহ নিজেকে শাসক হিসাবে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। তারপর তার হয়ে মালিক অম্বর ও রাজু দক্ষিণী মুঘলদের তেলেঙ্গানা ও বালাঘাটে নানাভাবে বিব্রত করা শুরু করেন। আমরা ঠিক জানি না কবে ও কীভাবে মালিক অম্বর দ্বিতীয় মুর্তাজা নিজাম শাহের প্রধান সেনাপতি হয়ে উঠেছিলেন এবং আহমেদনগরের বেশ জনপ্রিয় উপাধি পেশোয়া হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। অম্বর দ্বিতীয় মুর্তাজা নিজাম শাহের পক্ষে বহু বিক্ষিপ্ত দক্ষিণী, আফগানি ও হাবসি সেনা জড়ো করেছিলেন, এমনকি একটি বিশালসংখ্যক মারাঠা যোদ্ধা বাহিনী বা বর্গি–দেরও নাকি তিনি তাঁর সেনাদলে সংগঠিত করেছিলেন বলে জানা যায়।
মারাঠা যোদ্ধারা দ্রুত এক স্থান অন্য স্থানে গমন ও বিরোধী শিবিরের রসদ লুঠ করে সমস্ত সরবরাহ ভেস্তে দেওয়ার ব্যাপারে ছিল একেবারে সিদ্ধহস্ত। যদিও দাক্ষিণাত্যে মারাঠাদের এই ধরনের গেরিলা প্রকৃতির যুদ্ধ করার ঐতিহ্য অনেকদিনের, তবুও এই ধরনের যুদ্ধ পদ্ধতি সম্পর্কে মুঘলরা একেবারেই ওয়াকিবহাল ছিল না। তাই মারাঠাদের ব্যবহার করে মালিক অম্বর বেরার, আহমেদনগর ও বালাঘাটে মুঘলদের অবস্থান সুদৃঢ় করার পরিকল্পনায় জল ঢেলে দেবার চেষ্টায় নেমে পড়েন।
সে সময় দাক্ষিণাত্যের দায়িত্বে সেনাপ্রধান আবদুর রহিম খান-ই-খানান যিনি একাধারে একজন বিচক্ষণ ও কৌশলী রাজনীতিবিদের পাশাপাশি একজন দক্ষ সৈনিকও ছিলেন। তিনি ১৬০১ সালে তেলেঙ্গানার কাছে নান্দের বলে একটি জায়গায় মালিক অম্বরের সঙ্গে যুদ্ধে শামিল হয়ে তার কাছে পরাজিত হন। তবে যুদ্ধে হেরেও তিনি অম্বরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে এগিয়ে এসেছিলেন এই ভেবে যে অম্বরের হাত ধরে দাক্ষিণাত্যের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার একটা সুযোগ তৈরি হলেও হতে পারে। আর অম্বরও ভেবেছিলেন যে খান-ই-খানানের সঙ্গে মিত্রতা করলে তিনি তার সহযোগী তথা প্রতিদ্বন্দ্বী রাজু দক্ষিণীকে চাপে রাখতে পারবেন। ফলে একে অপরের প্রয়োজনে ১৬০১ সালে উভয়ের মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হয়।
পরবর্তী আট-নয় বছরে দাক্ষিণাত্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। বিজাপুরের শাসক ইব্রাহিম আদিল শাহ নিজামশাহী বংশের শাসনকে টিকিয়ে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। অম্বর ও রাজু দক্ষিণীর মধ্যে শত্রুতাও তীব্র আকার নেয়। এঁদের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে এসে মুর্তাজা নিজাম শাহ নিজের পদ ও জীবন দুই-ই খুইয়ে ফেলেছিলেন ১৬১০ সালে। তবে এই পরিস্থিতিতে আদিল শাহ মালিক অম্বরকে নিজ পক্ষে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
আকবরের মৃত্যুর পর জাহাঙ্গির ক্ষমতায় এসে যুবরাজ খুসরুর বিদ্রোহ সামলাতে যখন ব্যস্ত তখন মালিক অম্বর মুঘলদের বেরার, বালাঘাট ও আহমেদনগর থেকে উৎখাত করার জন্য একটি প্রচণ্ড সামরিক অভিযান চালিয়েছিলেন। পরিস্থিতি সামলানোর জন্য ১৬০৮ সালে জাহাঙ্গির পুনরায় আবদুর রহিম খান-ই-খানানকে দাক্ষিণাত্যের দায়িত্বে নিয়োগ করেছিলেন। এই সময় খান-ই-খানান একটি অসম্ভব প্রতিজ্ঞা করে বলেছিলেন যে দু-বছরের মধ্যে তিনি অম্বরের কাছে পরাজিত অঞ্চলগুলো শুধু নয় সেই সঙ্গে বিজাপুর অঞ্চলকেও মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করবেন। খান-ই-খানানের হুমকি শুনে মালিক অম্বর সাহায্যের জন্য আদিল শাহের কাছে এই বলে দরবার করেছিলেন যে বিজাপুর ও আহমেদনগর রাজ্য দুটি সব সংকল্প ও লক্ষ্যে একযোগে অবিচল। অম্বরের ডাকে সাড়া দিয়ে আদিল শাহ সাহায্যের জন্য রাজি হয়ে যান এবং তাঁকে শক্তিশালী কান্দাহার দুর্গ ছেড়ে দেন যাতে সেখানে অম্বর তার পরিবার-পরিজন ও সম্পদ নিরাপদে আগলে রেখে সেখান থেকে পূর্ণ শক্তি নিয়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারেন। এছাড়া আদিল শাহ অম্বরকে সাহায্য করার জন্য ১০,০০০ সেনাও নিয়োগ করেছিলেন যাদের ভরণপোষণের জন্য অম্বর তিন লক্ষ হুনের জায়গিরের ব্যবস্থা করেছিলেন। আসলে আদিল শাহ ও অম্বরের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আগে থেকে এবং তা সম্ভব হয়েছিল বৈবাহিক মিত্রতার মাধ্যমে। শোনা যায় বিজাপুরের প্রথম সারির একজন ইথিওপীয় অভিজাতর কন্যার সঙ্গে মালিক অম্বরের কন্যার বিবাহ হয়েছিল এবং সেই বিবাহ খুব ধুমধাম করে উদ্যাপন করা হয়েছিল (১৬০৯)। আদিল শাহ বরপণ হিসাবে প্রচুর অর্থ প্রদান করেছিলেন এবং ৮০,০০০ টাকা নাকি আলাদা ভাবে খরচ করা হয়েছিল কেবলমাত্র আতসবাজির জন্য।
বিজাপুরের তরফ থেকে এই রকম সাহায্য পেয়ে এবং মারাঠা যোদ্ধাদের সক্রিয়। অংশগ্রহণকে কাজে লাগিয়ে অচিরে মালিক অম্বর খান-ই-খানানকে বুরহানপুরে ঠেলে দিতে সক্ষম হন। ফলে ১৬১০ সাল নাগাদ আকবর কর্তৃক দাক্ষিণাত্যে মুঘলদের যা কিছু লাভ হয়েছিল সব এক ঝটকায় হারিয়ে যায়। যদিও জাহাঙ্গির যুবরাজ পারভেজকে বিশাল সেনা সহযোগে দাক্ষিণাত্যে প্রেরণ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি মালিক অম্বরের চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়াতে পারেননি। এমনকি আহমেদনগরের ওপর অধিকার খুইয়ে ফেলে পারভেজ অম্বরের সঙ্গে একটি লজ্জাজনক শান্তি চুক্তি সম্পাদন করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
১৬১১ সালে জাহাঙ্গির দুটো সেনাদল প্রেরণ করেছিলেন দাক্ষিণাত্যে, একটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন খান-ই-জাহান লোদি, সঙ্গে ছিলেন রাজা মান সিংহ এবং অপর সেনাদলের নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুল্লাহ খান। এই দুই সেনাদলের কাজ ছিল দুই দিক দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে দৌলতাবাদে এসে মিলিত হওয়া। কিন্তু এই দুই দলের মধ্যে যোগসূত্রের অভাব ও অন্তর্কলহ সেই অভিযানকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে।
এদিকে মালিক অম্বরের কার্যকলাপ দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং যতদিন পর্যন্ত তিনি মারাঠা ও অন্যান্য শক্তিগুলোর সাহায্য ব্যাপকভাবে পেয়েছিলেন, ততদিন মুঘলদের পক্ষে দাক্ষিণাত্যে কোনোরকম সুবিধা করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু সময় যত এগিয়েছে ততই মালিক অম্বর বড্ড বেশি উদ্ধত হয়ে উঠেছিলেন এবং তার অনেক সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গেই দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করেছিলেন। খান-ই-খানান যাকে পুনরায় দাক্ষিণাত্য বিষয়ে দেখাশোনা করার দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছিল, তিনি এই পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ নিয়ে জগদেব রাই, বাবাজী কাটে, উদজী রাম, মালজী, মানহোজী প্রমুখ বেশ কয়েকজন হাবসি ও মারাঠা অভিজাতদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিজের পক্ষে টেনে আনতে সক্ষম হন। মারাঠাদের পাশে পাওয়ার মূল্য কতটা তা জাহাঙ্গির নিজে খুব ভালো করে জানতেন এবং তিনি তাঁর স্মৃতিগ্রন্থে লিখেও ছিলেন যে, মারাঠারা ছিল ‘অত্যন্ত শক্তিশালী গোষ্ঠী এবং এ দেশের প্রতিরোধ শক্তির কেন্দ্র।’ মারাঠা সর্দারদের সাহায্য নিয়ে খান-ই-খানান ১৬১৬ সালে ঝাঁপিয়ে পড়েন আহমেদনগর, বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার যৌথবাহিনীর বিরুদ্ধে। ইব্রাহিম আদিল শাহ মোল্লা মহম্মদ লোরির নেতৃত্বে পঁচিশ হাজার সেনা পাঠিয়েছিলেন, কুতুব শাহ পাঠিয়েছিলেন পাঁচ হাজার ঘোড়া। কিন্তু সব কিছুকে চুরমার করে দিয়ে মুঘল বাহিনী নিজামশাহীর নতুন রাজধানী খিরকি দখল করে নিয়েছিল এবং সেখান থেকে যাওয়ার আগে সেই নগরের সব ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিল। এই। পরাজয়ের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি দক্ষিণী জোট।
খান-ই-খানানের জয়কে পূর্ণতা দান করতে ১৬১৭ সালে জাহাঙ্গির তাঁর পুত্র শাহজাদা খুররমের (পরবর্তীকালের শাহজাহান) নেতৃত্বে দাক্ষিণাত্যে একটি বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেছিলেন এবং তিনি স্বয়ং শাহজাদাকে সাহায্য করতে মাণ্ডু পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। মুঘল বাহিনীর এই সক্রিয়তায় আতঙ্কিত অম্বরের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো রাস্তা খোলা ছিল না। বালাঘাটের সমস্ত অঞ্চল যা তিনি পুনরুদ্ধার করেছিলেন সব তুলে দিতে হয়েছিল মুঘলদের হাতে। তুলে দিতে হয়েছিল আহমেদনগর দুর্গের চাবিও। উল্লেখ্য যে এই অভিযানে জাহাঙ্গির কিন্তু আকবরের দাক্ষিণাত্য আক্রমণের পরিধিকে অতিক্রম করে আরও বেশি অঞ্চল জয় করার কোনো প্রচেষ্টা নেননি। তার মানে এই নয় যে জাহাঙ্গিরের সামরিক শক্তি দুর্বল ছিল, আসলে এটা একটা বিশেষ নীতি ছিল। জাহাঙ্গির মুঘল সাম্রাজ্যকে দাক্ষিণাত্যে বেশি সম্প্রসারিত করতে চাননি, অথবা অন্য ভাবে বললে, তিনি দাক্ষিণাত্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বেশি জড়িয়ে পড়তে ইচ্ছুক ছিলেন না। তবে তার আশা ছিল যে মুঘল বাহিনীর ভালো ব্যবহার ও নমনীয় মনোভাব অচিরেই দক্ষিণী রাজ্যগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলতে ও শান্তিপূর্ণ ভাবে মুঘলদের সঙ্গে সহাবস্থানের রাস্তায় হাঁটার ক্ষেত্র তৈরি করতে সাহায্য করবে। এই নীতির অংশ হিসাবে জাহাঙ্গির বিজাপুরকে নিজ পক্ষে টানার চেষ্টা করেছিলেন এবং আদিল শাহকে পাঠানো এক করুণাময় ফরমান–এ তাঁকে সন্তান’ (ফরজাল) বলে সম্বোধন করেছিলেন।
সমঝোতা ও শান্তির প্রচেষ্টা চললেও ওদিকে অম্বর তখনও মুঘল-বিরোধী দক্ষিণী প্রতিরোধ শক্তির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন এবং পুনরায় সামরিক অভিযান চালিয়ে আহমেদনগর ও বেরারের বিশাল অংশ পুনর্দখল করে দিয়েছিলেন। দক্ষিণী শক্তির এই বাড়বাড়ন্ত সামলাতে ১৬২১ সালে শাহজাদা শাহজাহানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল মুঘল অভিযান চালানোর জন্য। মুঘলদের হাতে এবারেও সম্মিলিত দক্ষিণী বাহিনীর বড়োসড়ো পরাজয় ঘটে। পরিণামে অম্বরকে আবার মুঘলদের দখল করা অঞ্চল নতুন করে আহমেদনগরের পার্শ্ববর্তী ১৪ কোশ জমি সমেত ফিরিয়ে দিকে হয়েছিল। সেই সঙ্গে দক্ষিণী রাজ্যগুলোকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল মুঘলদের এই সাফল্যের সমস্ত কৃতিত্ব শাহজাদা শাহজাহানের প্রাপ্য।
বলা হয়ে থাকে যে দক্ষিণী রাজ্যগুলোর প্রতি জাহাঙ্গিরের নরম আচরণের পশ্চাতে ছিল সাফাভিদ দ্বিতীয় শাহ আব্বাসের চাপ। দক্ষিণী রাজ্যগুলোর সঙ্গে সাফাভিদ শাসকদের নিয়মিত দূত আদানপ্রদান হত আর দাক্ষিণাত্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে যথেষ্ট খোঁজখবর রাখতেন তারা। এই সময় চালাচালি হওয়া পত্রাবলীর ওপর গবেষণায় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে সাফাভিদ শাসক দক্ষিণী রাজ্যগুলোকে মুঘলদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন, আর তাই তিনি জাহাঙ্গিরের কাছে আবেদন করেছিলেন দক্ষিণী রাজ্যগুলোর প্রতি এমন নমনীয় নীতি। গ্রহণ করতে যাতে তারা উপঢৌকন প্রদানকারী অনুগত’তে পরিণত হয়ে যায় এবং ‘প্রথাগত শাসন ও আনুগত্য তথা সম্ভ্রম প্রকাশের শর্ত’ থেকে পিছু না হঠে। এ থেকে পরিষ্কার যে সাফাভিদ রাজতন্ত্র দক্ষিণী রাজ্যগুলোর মুঘলদের সঙ্গে সংঘাতের নীতিকে সমর্থন করেনি এবং গোলকুণ্ডার শাসককে প্রচ্ছন্ন সতর্ক করে জানিয়ে দিয়েছিল যে তারা যেন এ ব্যাপারে নিজেদের সংযত রাখে।
দক্ষিণী রাজ্যগুলোর যৌথবাহিনীর একের-পর-এক পরাজয় মুঘলদের বিরুদ্ধে তাদের ঐক্যবদ্ধ হবার প্রচেষ্টাকে ভেস্তে দিয়েছিল। আর তার ফলে রাজ্যগুলোর নিজেদের মধ্যে পুরোনো শত্রুতা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। আগেই জানিয়েছি যে শোলাপুর ও বিদরকে কেন্দ্র করে বিজাপুর ও আহমেদনগরের মধ্যে বহু পুরোনো শত্রুতা ছিল। আদিল শাহ অম্বরকে সাহায্য করার সময় কেবল যে শোলাপুর নিজের দখলে রেখে দিয়েছিলেন তাই নয়, অম্বরকে কান্দাহার ফিরিয়ে দেবার সময় শিরওয়াল পরগনাও দখল করে নিয়েছিলেন। ১৬১৯ সালে আদিল শাহ বিদর রাজ্য আক্রমণ ও অধিকার করে নিয়েছিলেন।
বিজাপুরের ঐতিহাসিকদের মতে, অম্বর এই সময় অত্যন্ত ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছিলেন এবং পূর্বে যার সাহায্য পেয়ে তিনি লাভবান হয়েছিলেন সেই ইব্রাহিম আদিল শাহকে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি বুক ফুলিয়ে বহু নিজামশাহী অভিজাতদের উপেক্ষা করেছিলেন এবং তাঁর রূঢ় ব্যবহারের শিকার হয়েছিলেন স্বয়ং দ্বিতীয় মুর্তাজা শাহ। ফলে আহমেদনগর ও বিজাপুরের মধ্যে সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে এবং উভয় পক্ষই মুঘলদের সঙ্গে মিত্রতা করতে উঠে-পড়ে লেগে যায়। খুব নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করে জাহাঙ্গির বিজাপুরের সঙ্গে আঁতাত করেন। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন যে অম্বরের মতো অদম্য, উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষের সঙ্গে সমঝোতা মুঘলদের অহেতুক দাক্ষিণাত্যের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে টেনে আনতে পারে। তাছাড়া দাক্ষিণাত্যে মুঘলদের অবস্থাকে সুদৃঢ় করতে গেলে মালিক অম্বরকে দূরে সরিয়ে রাখা অবশ্যই দরকার ছিল। যাই হোক, বিজাপুরের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে আদিল শাহ তার এক মন্ত্রী মোল্লা মহম্মদ লোরির নেতৃত্বে ৫০০০ জনের একটি সেনাবাহিনী বুরহানপুরে মুঘলদের সেবার জন্য প্রেরণ করেছিলেন।
ওদিকে যখন এইসব ঘটনা ঘটছিল তখন এদিকে অম্বর গোলকুণ্ডা আক্রমণ করে সেখানকার শাসককে বাধ্য করেন অগ্রিম দুই বছরের উপটৌকন দেবার জন্য। তিনি গোলকুণ্ডার সঙ্গে একটি রক্ষণাত্মক তথা আক্রমণাত্মক চুক্তিও সম্পাদন করেন। এই দিক থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে অম্বর এবার বিদরে বিজাপুরের একটা বাহিনীকে অপ্রত্যাশিতভাবে পরাজিত করে সরাসরি বিজাপুর আক্রমণ ও লুঠ করার জন্য অগ্রসর হন। এর ফলে আদিল শাহ দুর্গে আশ্রয় নিতে এবং তড়িঘড়ি বুরহানপুর থেকে মহম্মদ লোরিকে ডেকে পাঠাতে বাধ্য হন। বিজাপুরের দায়িত্বে থাকা মুঘল আধিকারিক মহবত খান, লস্কর খান ও একটি শক্তিশালী মুঘল বাহিনীকে বিজাপুরে মহম্মদ লোরিকে সহায়তা করার জন্য নিয়োগ করেন। বলা হয়ে থাকে যে মালিক অম্বর নাকি সিংহাসনে বসে মুঘল বাহিনীকে পাশে সরিয়ে রেখে নিজাম-উল-মুলক ও আদিল শাহকে পূর্বের মতো একে অপরের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এটা মুঘলরা মেনে নিতে পারেনি কারণ তা করলে বিজাপুরের সঙ্গে তাদের হওয়া চুক্তি লঙ্ঘিত হবে। মুঘলরা তাই বিজাপুরকে নিয়ে আহমেদনগরের কাছে ভাটুরিতে যৌথভাবে আক্রমণ করলে (১৬২৪) অম্বরের বাহিনী জবাবে সকলকে অবাক করে দেয়। তার প্রথম আঘাতে মহম্মদ লোরি মারা যান এবং আদিল শাহ ও মুঘলদের যৌথবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
আদিল শাহ ও মুঘলদের যৌথবাহিনীকে ভাটুরির যুদ্ধে পরাজিত করে মালিক অম্বরের মর্যাদা ও খ্যাতি চরম উচ্চতায় পৌঁছে যায়। মুঘল বাহিনী শাহজাহানের বিদ্রোহ সামলাতে ব্যস্ত থাকায় দিল্লি থেকে কোনো সাহায্য দাক্ষিণাত্যে মুঘল শিবিরে। আসেনি। যুদ্ধে জয়লাভের পর অম্বর আহমেদনগর দুর্গ অবরোধ করেন, কিন্তু সেখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত আঁটসাঁট দেখে তিনি ইব্রাহিম আদিল শাহের হাতে। গড়া পার্শ্ববর্তী নৌরসপুর নগর আগুনে পুড়িয়ে ও লুণ্ঠন করে পুনরায় বিজাপুরে ফিরে যান। তিনি শোলাপুরও পুনর্দখল করেছিলেন। তারপর বালাঘাট থেকে মুঘল কর্তৃত্ব উৎখাত করে বুরহানপুর পর্যন্ত অবরোধ করেন। এর কিছুকাল পর উড়িষ্যা, বাংলা ও বিহার থেকে বিদ্রোহ সেরে শাহজাহান ফিরে এলে তাকে ঝটিকা আক্রমণে বুরহানপুর দখলের জন্য প্ররোচিত করেন অম্বর, কিন্তু সেই সুযোগ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন শাহজাহান।
জাহাঙ্গির এরপর থেকে কার্যত তার সবথেকে সুযোগ্য সন্তান শাহজাহানের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার দিকে নজর দিয়েছিলেন। এই সময়ে মারা যান মালিক অম্বর (১৬২৭)। একজন সমকালীন মুঘল ঐতিহাসিক মুতাম্মদ খানের মতে, যুদ্ধক্ষেত্রে হোক বা নেতৃত্বদানে কিংবা বিচক্ষণতায় হোক বা প্রশাসনিক কাজে’, তিনি (মালিক অম্বর) ছিলেন অপ্রতিরোধ্য ও অনন্য। (তিনি) জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার অবস্থানে দৃঢ় ছিলেন এবং মাথা উঁচু করে নিজের কর্মজীবন সম্পন্ন করেছিলেন।
যদিও অম্বরের সামগ্রিক ভূমিকা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। বেশিরভাগ পর্যবেক্ষকের মতে, তিনি ছিলেন মুঘলদের বিরুদ্ধে দক্ষিণী স্বতন্ত্রতার একজন সাহসী বিজেতা। মুঘলদের দাক্ষিণাত্য নীতি নিয়ে লেখা একটি প্রবন্ধে সতীশ চন্দ্র বলেছেন, একজন দক্ষিণী স্বতন্ত্রতার পরাক্রমী যোদ্ধা এবং নিজামশাহী বংশের অধিকারের একনিষ্ঠ সমর্থক হিসাবে অম্বর সমস্ত জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যেভাবে নিজেকে সামনে তুলে ধরতেন তাতে তাকে একজন ঈশ্বরের উপহার না বলে থাকা যায় না। তার বাঁধনছাড়া উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁকে বিজাপুরের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে দিয়েছিল যা মুঘলদের বিরুদ্ধে দক্ষিণী রাজ্যগুলোর মিলিত জোট ভেঙে যাবার মূল কারণ ছিল। তাছাড়া ১৬০০ সালে তাঁর সমঝোতাকে প্রত্যাখ্যান ও অসম্মান করার ফলে যেভাবে ক্রমাগত যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তাতে তিনি যে সাম্রাজ্য মুঘলদের হাত থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন সেই সাম্রাজ্যের চুড়ান্তভাবে পতন ঘটে যায়। হয়তো মালিক অম্বরের প্রধান কৃতিত্ব ছিল এটাই যে তিনি মারাঠা সৈন্যদের এমন প্রশিক্ষণ ও আত্মবিশ্বাসের চেতনা প্রদান করেছিলেন যাতে তারা খুব সহজেই সর্বশক্তিমান মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতেও পিছপা হয়নি।
মালিক অম্বরের প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। টোডর মলের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাকে দাক্ষিণাত্যে প্রবর্তন করার কৃতিত্ব সাধারণত দেওয়া হয়। তাকে। পরবর্তীকালের মারাঠি সূত্র থেকে জানা যায়: “তিনি (মালিক অম্বর) সাম্রাজ্যের জমিগুলোকে জরিপ করে রাজস্ব হার নির্ধারণ করেছিলেন, বিভিন্ন গ্রামের সীমানা পুনর্বিন্যাস করেছিলেন এবং বিঘা ও অন্যান্য বিষয়ের মাপ ধার্য করেছিলেন। সেই থেকে মালিক অম্বরের ভূমি বন্দোবস্ত এই অঞ্চলে চলে আসছে।
এইভাবে মালিক অম্বর চুক্তির মাধ্যমে জমি দান করার পদ্ধতির (ইজারা) বদলে জবতি ব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন। কয়েকটি দলিল অনুসারে, শিকল দিয়ে জমি জরিপ করা হত এবং কৃষির আওতায় আনা নতুন জমিগুলোতে ভালোমতো কর। চাপানো হত, যেখানে পঞ্চম বছরে গিয়ে করের পুরোটা মিটিয়ে দিতে হত। সে সময়ের রাজস্ব হারের পরিমাণ সম্পর্কে আমাদের কোনো সঠিক ধারণা নেই, তবে মনে হয় সাধারণত তা ছিল এক তৃতীয়াংশ।
স্থানীয় দেশমুখ ও অন্যান্য কৃষিজ জমির সঙ্গে যুক্ত মানুষদের সমস্যা সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে খোঁজখবর রাখতেন মালিক অম্বর। আর সেই সূত্র ধরে তিনি স্থানীয় এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা ও কৃষির সম্প্রসারণের চেষ্টা করতেন।
আহমেদনগরের পতন এবং বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার মুঘল আধিপত্য স্বীকার
শাহজাহান মুঘল সিংহাসনে বসেন ১৬২৭ সালে। যুবরাজ হিসাবে দাক্ষিণাত্যে দুটি অভিযানে নেতৃত্ব দেবার পাশাপাশি পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বেশ কয়েক দিন দাক্ষিণাত্যে সময় কাটানোর সুবাদে দাক্ষিণাত্য ও সেখানকার রাজনীতি সম্পর্কে শাহজাহানের অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিগত জ্ঞান ছিল প্রচুর।
মালিক অম্বরের মৃত্যুর পর জাহাঙ্গিরের আমলের শেষ বছরে যে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল দাক্ষিণাত্যে, তার ফলে সেখানে থাকা মুঘল প্রশাসক খান-ই-জাহান লোদি নাকি তিন লাখ হুনের বিনিময়ে বালাঘাট অঞ্চলের অধিকার বিকিয়ে দিয়ে এসেছিলেন বলে অভিযোগ। এমনকি বুরহানপুরও অবরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রতিপক্ষের সেনাবাহিনী দ্বারা।
সিংহাসনে বসে শাহজাহানের প্রথম কাজ ছিল দাক্ষিণাত্যের যেসব অঞ্চল মুঘলরা নিজামশাহী শাসকের কাছে হেরে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল, সেগুলি পুনরুদ্ধার করা। এই কাজের জন্য তিনি সর্বাগ্রে পুরোনো ও অভিজ্ঞ খান-ই-জাহান লোদির ওপরেই ভরসা করেছিলেন, কিন্তু অচিরে তার ব্যর্থতার কারণে তাকে দরবারে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কিছুদিন পর তিনি এই অভিযোগ তুলে মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি জাহাঙ্গিরের আমলে যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন তা শাহজাহানের আমলে ভোগ করতে পারছেন না। তিনি রেগে গিয়ে দাক্ষিণাত্যে চলে যান এবং সেখানে নিজামশাহী শিবিরে যোগ দেন। নিজামশাহী শাসক তাঁকে বেরার ও বালাঘাটের যেটুকু অংশে মুঘল অধিকার বলবৎ ছিল, সেখান থেকে তাদের উৎখাত করার দায়িত্ব দেন। মুঘলদের এক প্রথম সারির অভিজাতকে যেভাবে মুঘলদের বিরুদ্ধেই লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাতে বিষয়টিকে কোনো ভাবেই হালকা করে দেখতে পারেননি শাহজাহান। এটা পরিষ্কার যে মালিক অম্বরের মৃত্যুর পরে বেরার ও বালাঘাটে মুঘল উপস্থিতিকে উপেক্ষা করে চলার নীতি অব্যাহত রেখেছিলেন নিজামশাহী শাসক। ফলে শাহজাহান ভেবেছিলেন যতদিন আহমেদনগর স্বাধীন রাজ্য হয়ে থাকবে, ততদিন দাক্ষিণাত্যে মুঘলরা শান্তিতে থাকতে পারবে না। ফলে যে করেই হোক আহমেদনগর দখল করতে হবে। আকবর বা জাহাঙ্গির যে দাক্ষিণাত্য নীতি নিয়েছিলেন তা থেকে এটা ছিল অনেকটা আলাদা। যদিও এটা ঠিক যে শাহজাহান প্রয়োজন ছাড়া দাক্ষিণাত্যে মুঘল কর্তৃত্ব সম্প্রসারণ করার পক্ষপাতী ছিলেন না। তাই তিনি বিজাপুরের শাসককে লেখা একটি পত্রে মুঘলদের প্রস্তাবিত আহমেদনগর দখল অভিযানে সহায়তা করার প্রতিদানে আহমেদনগর রাজ্যের এক তৃতীয়াংশ অঞ্চল তাকে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আহমেদনগরকে কূটনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে একঘরে করে দেবার লক্ষ্যে এটা ছিল শাহজাহানের একটা বিচক্ষণ পদক্ষেপ। এছাড়া তিনি বিভিন্ন মারাঠা সর্দারের কাছে অনুচর পাঠিয়ে তাদের মুঘলদের হয়ে যুদ্ধ করার টোপ দিয়েছিলেন।
প্রথম দিকে এই পদক্ষেপে শাহজাহান সাফল্য পেয়েছিলেন। তার অভিযানের প্রথম ঝটকায় মালিক অম্বর পরাজিত হয়েছিলেন এবং মোল্লা মহম্মদ লোরি সহ বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ বিজাপুরী অভিজাতকে হত্যা করা হয়েছিল। আদিল শাহ অবশেষে শাহজাহানের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়ে মুঘলদের সহায়তা করার জন্য নিজামশাহী সীমান্তে সেনা মোতায়েন করেছিলেন। প্রায় এই সময়ে একজন দক্ষ মারাঠা অভিজাত যাদব রাও যিনি জাহাঙ্গিরের আমলে মুঘলদের হাতে পরাস্ত হয়েও নিজাম শাহের হয়ে কাজ করতে চলে এসেছিলেন, তাঁকে বিশ্বাসঘাতকতা করে মুঘলদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে হত্যা করা হয়েছিল। এর ফলে তার পৌত্র (অর্থাৎ শিবাজির পিতা) শাহজি ভোঁসলে নিরুপায় হয়ে মুঘলদের কাছে পরিবার পরিজন সমেত ধরা দিয়েছিলেন। শাহজাহান তাঁকে পাঁচ হাজারি মনসব ও পুনা অঞ্চলের একটি জমি জায়গির হিসাবে দান করেছিলেন। এইভাবে চাপে পড়ে আরও অনেক মারাঠা সর্দার এ সময় শাহজাহানের শিবিরে শামিল হয়েছিলেন।
১৬২৯ সালে শাহজাহান আহমেদনগরের বিরুদ্ধে দুটি সামরিক অভিযান প্রেরণ করেছিলেন, একটা অভিযান পশ্চিম দিক থেকে বালাঘাট অঞ্চল হয়ে পরিচালিত হয়েছিল। সম্রাট নিজে বুরহানপুর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন সমগ্র অভিযানটি তত্ত্বাবধানের জন্য। দুদিক দিয়ে চাপে পড়ে আহমেদনগরের অনেকটা অংশ মুঘলদের দখলে চলে যায়। অন্যতম শেষ আশ্রয় পারেন্ডা অঞ্চলও মুঘল বাহিনী অবরোধ করে। নিজাম শাহ এবার নিরুপায় হয়ে আদিল শাহকে এই আবেদন করেন যে রাজ্যের সর্বত্র মুঘল গ্রাসে চলে গিয়েছে, এবার যদি শেষ আশ্রয় পারেন্ডাও হাত ছাড়া হয়ে যায় তাহলে তা হবে নিজামশাহী বংশের পতন, আর তারপর এই মুঘলরা কিন্তু। বিজাপুরকেও ছাড়বে না। আহমেদনগরে যেভাবে মুঘল আক্রমণ ধেয়ে এসেছিল। তাতে বিজাপুরের রাজদরবারের একটা শক্তিশালী অভিজাত অংশ কিন্তু বিপদের আশঙ্কা করা শুরু করে দিয়েছিলেন। এমনকি মুঘলদের সাহায্য করতে যাওয়া বিজাপুরী সৈন্যদল সীমান্তে দাঁড়িয়ে কেবল নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল, মুঘল অভিযানে তাদের কোনোরকম সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হয়নি। মুঘলরাও আহমেদনগর দখল করার পর সমঝোতা অনুযায়ী বিজাপুরকে সে রাজ্যের অংশ প্রদানে অস্বীকার করে। ফলস্বরূপ আদিল শাহ পালটি খেয়ে নিজাম শাহকে সাহায্য করবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। নিজাম শাহ তাঁকে শোলাপুর ছেড়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। এইরকম একটা পরিবর্তিত পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় মুঘলরা পারেন্ডা অঞ্চলের ওপর থেকে অবরোধ তুলে নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়, যদিও আহমেদনগরের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি তখনও মুঘলদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল। মালিক অম্বরের পুত্র ফতেহ খানকে নিজাম শাহ এই আশায় পেশোয়া পদে নিযুক্ত করেছিলেন যে তিনি হয়তো সমঝোতা করে শাহজাহানকে যুদ্ধবিরতির জন্য রাজি করাতে পারবেন। কিন্তু সে আশার বিপরীতে গিয়ে ফতেহ খান গোপনে শাহাজাহানের সঙ্গে আঁতাত করেছিলেন এবং শাহজাহানেরই অঙ্গুলিহেলনে বুরহান নিজাম শাহকে হত্যা করে দৌলতাবাদে একটি পুতুল শাসন কায়েম করা হয়েছিল যার নেতৃত্বে ছিলেন ফতেহ খান। তিনি মুঘল সম্রাটের নামে খুৎবা পাঠ ও সিক্কা প্রচলন করেছিলেন। এর পুরস্কারস্বরূপ ফতেহ খানকে মুঘল শিবিরে যুক্ত করে নেওয়া হয়েছিল এবং পুনার যে অঞ্চল আগে শাহজি ভোঁসলেকে দান করা হয়েছিল তা জায়গির হিসাবে তাকে হস্তান্তর করা হয়েছিল এই ভাবে শাহজি ভোঁসলের সঙ্গে মুঘলদের সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। ঘটনাগুলো ঘটছিল ১৬৩২ সালে।
ফতেহ খানের এরূপ আত্মসমর্পণের পর শাহজাহান দাক্ষিণাত্যের দায়িত্ব তুলে দেন মহবত খানের ওপর এবং নিজে আগ্রা প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু বিজাপুর ও শাহজি সহ স্থানীয় নিজামশাহী অভিজাতদের প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়ে দাক্ষিণাত্যে। মহবত খানের অবস্থা জটিল আকার ধারণ করে। পরে বিজাপুরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাওয়ায় দৌলতাবাদের দুর্গ দখল করা ও ফতেহ খানকে শায়েস্তা করার জন্য দক্ষিণী রাজ্যগুলির একটা শক্তিশালী জোট তৈরি হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে মুঘলদের পক্ষে সেখানে নিজেদের অধিকার ধরে রাখা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।
বস্তুতপক্ষে দেখা যাচ্ছে যে ধরাশায়ী আহমেদনগরের দখলদারিকে কেন্দ্র করে মুঘল ও বিজাপুরের মধ্যে কার্যত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। আদিল শাহ রনদৌলা খান ও মুরারি পণ্ডিতের নেতৃত্বে একটি বিশাল বাহিনী পাঠিয়ে দৌলতাবাদকে আত্মসমর্পণ করতে চাপ দিতে শুরু করেন। শাহজি ভোঁসলেকেও বিজাপুরের বাহিনীতে নিয়োগ করা হয়েছিল মুঘলদের বিব্রত করা ও তাদের রসদ সরবরাহ ব্যবস্থা ভেস্তে দেবার জন্য। কিন্তু বিজাপুরী বাহিনী ও শাহজির মিলিত প্রচেষ্টাতেও কাজের কাজ হয়নি। কারণ অচিরে মহবত খান দৌলতাবাদে সেনা পাঠিয়ে সেখানকার দুর্গ দখলের চেষ্টা করেন এবং দুর্গের বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য চাপ দিতে থাকেন। (১৬৩৩)। নিজাম শাহকে আটক করে গোয়ালিয়রে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কারাবাসের জন্য। এই ভাবে নিজামশাহী বংশের অবসান ঘটে। কিন্তু এতেও মুঘলদের সঙ্গে সমস্যার সমাধান হয়নি। মালিক অম্বরের দৃষ্টান্ত মাথায় রেখে শাহজি একজন নিজামশাহী রাজপুরুষকে খুঁজে বের করে তাকে শাসক হিসাবে তুলে ধরেন। আদিল শাহ শাহজিকে সাহায্য করার জন্য ৭,০০০ থেকে ৮,০০০ অশ্বারোহী বাহিনী প্রেরণ করেন এবং বহু নিজামশাহী অভিজাতকে শাহজির হয়ে কাজ করতে ও নিজ নিজ দুর্গ ব্যবহার করার জন্য উৎসাহ দেন। বহু ছত্রভঙ্গ নিজামশাহী সৈনিক এ সময় শাহজির বাহিনীতে যোগদান করে এবং তার বাহিনীতে এক ধাক্কায় ২০,০০০ ঘোড়ার জমায়েত হয়ে যায়। এই শক্তি নিয়ে শাহজি মুঘলদের আক্রমণ করেন এবং আহমেদনগরের অনেকটা অংশ দখল করে নেন।
এই পরিস্থিতিতে শাহজাহান ঠিক করেন ব্যক্তিগত ভাবে বিষয়টি দেখবেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এই পরিস্থিতি এত জটিল হয়ে ওঠার একটাই কারণ, তা হল বিজাপুরের নাছোড়বান্দা মনোভাব। তাই তিনি বিজাপুরকে আক্রমণ করে শেষ করে দেবার জন্য একদিকে যেমন বিশাল বাহিনী নিয়োগ করেছিলেন তেমনি অন্যদিকে আদিল শাহের কাছে অনুচর পাঠিয়ে তার সঙ্গে পূর্বের সমঝোতা অনুযায়ী পুনরায় আহমেদনগরের এলাকা ভাগ করে নেবার টোপ দিতে থাকেন।
এই লোভ দেখানো ও সঙ্গে ভয় দেখানোর নীতি (The policy of the Stick and the Carrot) এবং দাক্ষিণাত্যের উদ্দেশ্যে শাহজাহানের আগমন বিজাপুরের রাজনীতিতে আরও একটা পরিবর্তন সূচিত করেছিল। মুরারি পণ্ডিত সহ সেখানকার মুঘল-বিরোধী গোষ্ঠীর প্রায় সকল নেতাকে পদ থেকে অপসারণ ও হত্যা করা শুরু হয়েছিল এবং একটি নতুন চুক্তি বা অহনামা শাহজাহানের সঙ্গে সম্পাদন করা হয়েছিল। এই চুক্তি অনুসারে আদিল শাহ মুঘল আধিপত্য স্বীকার করে নিতে রাজি হয়ে যান, সেই সঙ্গে তাঁকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে কুড়ি লক্ষ টাকা এবং মুঘল নিয়ন্ত্রণে থাকা গোলকুণ্ডার কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার প্রতিশ্রুতি দিতে হয়। চুক্তিতে এও বলা হয়েছিল যে ভবিষ্যতে যদি বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার মধ্যে কোনোরকম বিবাদ ঘটে, তাহলে সালিশি করে মিটিয়ে নেবার নিদান দেবেন স্বয়ং মুঘল সম্রাট। শাহজিকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা বা যদি আত্মসমর্পণ নাও করেন এবং বিজাপুরের হয়ে ক কাজ করতে সম্মত হন, তাহলে তাঁকে মুঘল সীমান্তের অনেক দূরে দক্ষিণের কোনো অঞ্চলের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হবে এরূপ অভিসন্ধি নিয়েই আদিল শাহ মুঘলদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলেন। এর প্রতিদানে প্রায় ২০ লক্ষ হুন (প্রায় আশি লক্ষ টাকা) মূল্যের এলাকা যা আহমেদনগরে অবস্থিত ছিল তা বিজাপুরের হাতে তুলে দেওয়া হয়। শাহজাহান আদিল শাহকে সম্রাটের হাতের ছাপ দেওয়া এক রাজকীয় ফরমান পাঠিয়ে বলেছিলেন এই চুক্তি হয়ে উঠুক আলেকজান্ডারের যুদ্ধ-প্রাকারের মতো শক্তিশালী এবং তা যেন কখনো না লঙ্ঘিত হয়।
দাক্ষিণাত্যে নিজের অবস্থানকে দৃঢ় করতে শাহজাহান গোলকুণ্ডার সঙ্গেও একটি চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। সেখানকার শাসক খুৎবা–তে ইরানীয় সম্রাটের নাম সরিয়ে মুঘল সম্রাটের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি হয়েছিলেন। কুতুব শাহ মুঘল সম্রাটের কাছে আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। গোলকুণ্ডা আগে বিজাপুরকে যে চার লক্ষ হুন বার্ষিক উপঢৌকন প্রেরণ করত তা বন্ধ করে দিয়েছিল এবং মুঘল সম্রাটকে চুক্তি অনুসারে বার্ষিক দুই লক্ষ হুন অর্থ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার সঙ্গে ১৬৩৬ সালের চুক্তি দুটি ছিল একেবারে বিচক্ষণ রাজনৈতিক পদক্ষেপ। এর ফলে শাহজাহান আকবরের স্বপ্ন পূরণের দোরগোড়ায় গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। এবার থেকে মুঘল সম্রাটের আধিপত্য দেশের সবদিক থেকে গৃহীত হয়েছিল। এই চুক্তি দুটি দাক্ষিণাত্যের পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে যেমন অনেকটা সাহায্য করেছিল, তেমনই দাক্ষিণাত্যে মুঘলদের সাম্রাজ্য বিস্তার একটা নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে যাওয়ায় মুঘলদের সঙ্গে দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলোর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিস্থিতিকে অনেক বেশি সুদৃঢ় করেছিল।
শাহজাহান ও দাক্ষিণাত্য (১৬৩৬-৫৭)
১৬৩৬ সালের চুক্তি সম্পাদনের পরবর্তী এক দশকে উত্তর দিক থেকে মুঘল আক্রমণের ভয় না থাকায় বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা নিশ্চিন্ত মনে কৃষ্ণা নদী থেকে তানজোর হয়ে আরও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে কর্ণাটকের সমৃদ্ধ ও উর্বর অঞ্চলে লুঠপাট চালাতে শুরু করে। এই অঞ্চলগুলো আবার কয়েকটি ছোটো ছোটো খণ্ড রাজ্যে বিভক্ত ছিল যেখানে স্থানীয় প্রভাবশালী কর্তৃপক্ষের নিজস্ব রমরমা চলত। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন তানজোরের নায়ক, জিনজি ও মাদুরাই-এর ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা বিজয়নগরেরের প্রাক্তন শাসক রায়াল প্রমুখরা। এই সকল খণ্ড রাজ্যের ওপর এ সময় একাধিক আক্রমণ চালিয়েছিল বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা।
কিছুদিনের জন্য মুঘলরা বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার এই আক্রমণকে স্বাগত জানিয়েছিল। বিনয়ী নিরপেক্ষতা বজায় রাখার পাশাপাশি মুঘলরা কূটনৈতিক ভাবে এই দুই দক্ষিণী রাজ্যের মধ্যে চলা বিভেদ ও শত্রুতা মিটিয়ে ফেলতে সাহায্য করেছিল। সে সময়ের কূটনৈতিক মধ্যস্থতা মুঘল সম্রাট বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার মধ্যে ১৬৪৬ সালে একটি চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে একেবারে সঠিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই চুক্তি অনুসারে ঠিক হয়েছিল দক্ষিণে গোলকুণ্ডা ও বিজাপুরের বাহিনী কোনো যুদ্ধে জয়লাভ করলে প্রাপ্ত অঞ্চল ও সম্পদ উভয় রাজ্যের মধ্যে এই অনুপাতে ভাগ হয়ে যাবে যে দুই ভাগ পাবে বিজাপুর ও এক ভাগ পাবে গোলকুণ্ডা। কিন্তু এতসব সত্ত্বেও জিনজি ও কর্ণাটকের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার মধ্যে আবার সংঘর্ষ শুরু হলে কুতুব শাহ বাধ্য হন মুঘলদের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করতে। শাহজাহানকে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার জন্যে ওই এলাকায় আমিন প্রেরণ করার জন্য অনুরোধ করা হয় এবং কর্ণাটককে দুই ভাগে ভাগ করে উভয় বিবদমান রাজ্যের মধ্যে ভাগ করে দেবার জন্যে একটি চুক্তি তৈরি করতে বলা হয়। বিজয়নগরের রায়াল–ও দাক্ষিণাত্যের পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য মুঘলদের হস্তক্ষেপ দাবি করেছিলেন।
১৬৪৮ সালের পর থেকে মুঘলদের বিনয়ী নিরপেক্ষতা বজায় রাখার নীতি ক্রমশ বদলে যেতে শুরু করে। ১৬৪৯ সালে আদিল শাহ যখন শাহজি ভোঁসলেকে গ্রেফতার করেছিলেন তখন মুঘলদের সে ব্যাপারে মনোভাব থেকেই এই নীতি পরিবর্তনের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। ১৬৩৬ সালের সমঝোতা অনুসারে মুঘলরা ও বিজাপুর যৌথ ভাবে পরস্পরের আধিকারিকদের বিপথে চালনা না করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছিল। পরবর্তীকালে বিজাপুরের আধিকারিক শাহজির ওপর বিশেষ নজর পড়েছিল মুঘলদের। তাই মুঘলদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য যদি আদিল শাহ একান্ত ভাবে চাইতেন তাহলে তিনি শাহজিকে নিজের কাজে অন্তর্ভুক্ত করতেই পারতেন, কিন্তু তাহলে তাকে মুঘল সীমান্ত থেকে অনেক দূরে কর্ণাটকের দায়িত্ব দিয়ে পাঠাতে হত। যাই হোক, ১৬৪৯ সালে যুবরাজ মুরদ বকসের অনুরোধে। শাহজিকে ৫০০০ মনসব প্রদান করা হয়েছিল এবং তাকে তার পিতা ও জাতিভাইদের সঙ্গে যুক্ত হতে আহ্বান করা হয়েছিল। এ থেকে, এটা মনে হয় যে শাহজিকে তুষ্ট করার কারণ একটাই যাতে মুঘলরা দাক্ষিণাত্যে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার পরিকল্পনা করে এগোলেও মারাঠা সর্দারদের সমর্থন আদায় করে তাদের নিজ পক্ষে টেনে নিতে না পারে কোনোভাবে। এই কারণেই পরের দিকে মির জুমলাকেও কাজে বহাল করা হয়েছিল।
এর পর থেকে দক্ষিণী রাজ্যগুলোর প্রতি মুঘলদের মনোভাব দ্রুত পরিবর্তিত হতে শুরু করে এবং তারা ১৬৫৬ ও ১৬৫৭ সালে পরপর গোলকুণ্ডা ও বিজাপুরে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের পশ্চাতে অনেকগুলো বিষয় কাজ করেছিল। সে সময় মুঘল কর্তৃপক্ষ দাক্ষিণাত্যের দায়িত্বে থাকা তৎকালীন মুঘল প্রতিনিধি যুবরাজ ঔরঙ্গজেবের মধ্যে উত্তেজিত পত্র চালাচালি এবং শাহজাহান কর্তৃক মালব ও সুরাটের রাজকোষে ঘাটতি মেটাতে না পাবার ঘটনা তাদের দাক্ষিণাত্যের প্রতি মনোভাব পরিবর্তনের পিছনে একটা কারণ হিসাবে কাজ করেছিল বলা যেতে পারে। আগে শাহজাহান বিজাপুরকে বিজয়নগরের রায়াল-এর সঙ্গে যুদ্ধে বাজেয়াপ্ত সম্পদের একটা অংশ মুঘলদের নিরপেক্ষতার জন্য ক্ষতিপূরণ হিসাবে দিতে চাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষতিপূরণ হিসাবে এভাবে সম্পদের ভাগ দেবার কোনো নিয়ম ছিল না, বরং বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা দক্ষিণ দিকে যে বিশাল এলাকা দখল করতে সক্ষম হয়েছিল তার কিছু অংশ মুঘলদের বিনয়ী নিরপেক্ষতা বজায় রাখার নীতির প্রতিদান হিসাবে দেওয়া যেতে পারত। পরিস্থিতিও হয়তো মুঘলদের দক্ষিণী রাজ্যগুলোর কাছে ক্ষতিপূরণ হিসাবে এলাকার ভাগ চাওয়ার দাবি করছিল। সেই সঙ্গে টাকা ও হুন-এর মধ্যে বিনিময় মূল্যের হ্রাসকে কেন্দ্র করে বিবাদ এবং ফলস্বরূপ টাকায় বার্ষিক উপঢৌকন প্রেরণে গোলকুণ্ডার তরফ থেকে অনীহা যুদ্ধ বাঁধার প্রাক্-পরিস্থিতি রচনা করেছিল বলা যায়। অন্যদিকে বিজাপুরের ক্ষেত্রে ১৬৫৬ সালে মহম্মদ আদিল শাহের মৃত্যুর পর সেখানে তৈরি হওয়া বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি এবং উপঢৌকন প্রেরণে গড়িমসি ও সাম্প্রতিক যুদ্ধে গোলকুণ্ডার পক্ষ নেওয়ার ঘটনা মুঘলদের হাতে বিজাপুর আক্রমণের একটা অজুহাত তুলে দিয়েছিল। তাই বলা যায় ১৬৫৬-৭ সালে। মুঘলদের বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা আক্রমণ কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না, অনেকদিন ধরে যে এইরকম পরিস্থিতির ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছিল তা ওপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট।
এই যুদ্ধে শাহজাহান, দারা ও ঔরঙ্গজেবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক কি ছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। প্রথম দিক থেকেই ঔরঙ্গজেব সমগ্র গোলকুণ্ডা রাজ্য দখল করতে চেয়েছিলেন এবং শাহজাহানের কাছ থেকে সেই দখলের আদেশ আদায় করে নিতে তিনি কোনোরকম যুক্তি দেখাতে বাকি রাখেন নি। কিন্তু শাহজাহানের ভাবনা ছিল অন্য, তিনি কুতুব শাহের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের নামে সব কিছু হাতিয়ে নেবার পরিকল্পনা করেছিলেন। চুক্তি অনুসারে অতিরিক্ত প্রাপ্তি হিসাবে মুঘলরা রামগির জেলা লাভ করেছিল। কিন্তু অচিরেই এই নিয়ে বিতর্ক দানা বেঁধেছিল যে কর্ণাটকে মির জুমলার জায়গিরটা কাদের দখলে থাকবে, মুঘলদের না । কুতুব শাহের? কুতুব শাহ ওই অঞ্চলের জন্য পনেরো লক্ষ টাকা মুঘলদের দিতে চাইলে ঔরঙ্গজেব সেই প্রস্তাব সরাসরি খারিজ করে দেন, কারণ তার যুক্তি ছিল গোলকুণ্ডা রাজ্যের বাইরে বাকি সম্পদের ওপর মুঘল সম্রাট ও কুতুব শাহের সমান। অধিকার আছে। তিনি কড়া ভাবে কুতুব শাহকে সাবধান করে বলেছিলেন যে, কর্ণাটকের ওপর অধিকার মির জুমলার এবং তা দাক্ষিণাত্যের একটা অংশ। তাই তা দখল করার সব অভিসন্ধি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন…’। এর পরে কুতুব শাহ নিজের অধিকার ছাড়তে অস্বীকার করায় শাহ বেগ খান, কাজি মহম্মদ হাসিম ও কৃষ্ণ রাও-এর নেতৃত্বে একটি বিশাল মুঘল বাহিনী কর্ণাটকে প্রবেশ করেছিল। এ সময় শাহজাহানের অবস্থানের মধ্যে বেশ অস্পষ্টতা ধরা পড়েছিল। তিনি একদিকে ঔরঙ্গজেবকে গোলকুণ্ডা জয় করার নির্দেশ দিয়েছিলেন আর অন্যদিকে বিজাপুরের। ক্ষেত্রে সম্ভব হলে সমগ্র রাজ্যকে না হলেও অন্তত পুরোনো আহমেদনগর অঞ্চল অধিকার করার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং বাকি অংশ দেড় কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দিলে ও সম্রাটের নামে খুৎবা পাঠ ও সিক্কা প্রচলন করে মুঘল সাম্রাজ্যের কর্তৃত্ব স্বীকার করে নিলে মকুব করে দেবার কথা বলেছিলেন।
এই ভাবে দেখা যাচ্ছে একদিকে ঔরঙ্গজেব সমগ্র দক্ষিণী রাজ্যগুলো দখল করার পক্ষে ছিলেন আর শাহজাহান প্রথম দিকে সেই ব্যাপারে রাজি হলেও কোনো কারণে তার মধ্যে একটা সংকোচ কাজ করেছিল। ঔরঙ্গজেবের সন্দেহ হয়েছিল যে সম্রাটের মনোভাবের এই পরিবর্তনের পিছনে তার চরম শত্রু শাহজাদা দারার হাত থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে দারার কোনো ভূমিকার প্রমাণ পাওয়া যায় না। যাই হোক, দাক্ষিণাত্য নিয়ে শাহজাহানের ভাবনা তখনও সীমিতই ছিল এবং যখন ঔরঙ্গজেব সর্বব্যাপী রাজ্য জয়ের নীতি নিয়ে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছিলেন তখন তাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন শাহজাহান। ১৬৫৭ সালের চুক্তি অনুসারে বিজাপুরকে বাধ্য করা হয় ১৬৩৬ সালের সমঝোতা অনুযায়ী তাদের যে নিজামশাহী অঞ্চল দেওয়া হয়েছিল তা মুঘলদের হাতে তুলে দিতে। সেই সঙ্গে মির মুজলার জায়গিরের অংশ হিসাবে উর্বর ও সমৃদ্ধশালী করমণ্ডল অঞ্চল ও গোলকুণ্ডার অধিকারও মুঘলদের হাতে তুলে দেবার জন্যে চাপ দেওয়া হয়। এই করমণ্ডল অঞ্চল বস্ত্র ও নীল আমদানির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসাবে গুজরাটকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল। দাক্ষিণাত্যে মুঘলদের চাহিদা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা দিন দিন বেড়েই চলেছিল সীমাহীন ভাবে। তাই মুঘলদের আকাশছোঁয়া চাহিদার কারণে দক্ষিণী রাজ্যগুলো সঙ্গে কোনো সমঝোতার সম্ভাবনা রীতিমতো মনস্তাত্বিক অসম্ভবতায় পরিণত হয়েছিল (যদুনাথ। সরকার)।
শাহজাহানের ভূমিকা এখানে আরও একবার বিভ্রান্তিজনক ছিল। তিনি ১৬৩৬ সালের চুক্তি অনুসারে দাক্ষিণাত্যে যা যা অর্জন করেছিলেন তার ওপর দখলটা কেমন যেন আলগা করে দিয়েছিলেন। মুঘল সম্রাটের দফতর থেকে দুই দক্ষিণী রাজ্যকে সম্পূর্ণ ভাবে দখল করার নীতি ঘোষিত হলেও শাহজাহান নিজে কোথাও যেন ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাই এটা বলা যায় যে শাহজাহানই তার সংকোচবোধের কারণে এমন একটা টানাপোড়েনের পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন যা থেকে ঔরঙ্গজেব তাঁর জীবদ্দশাতেও পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেননি। ১৬৩৬ সালের চুক্তি রদ হয়ে গিয়েছিল আগেই তবুও দক্ষিণী রাজ্যগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অধিকার কায়েম করার উদ্যোগ মুঘলদের সামনে একাধিক সমস্যার সৃষ্টি করেছিল।
উপরের আলোচনা পরিষ্কার ভাবেই শাহজাহানের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেয়, অথচ তিনি আগে যেভাবে দাক্ষিণাত্য পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছিলেন তাতে তার এই বিচক্ষণতা নিয়ে আমাদের কোনোরকম সন্দেহ ছিল না। কিন্তু তার আমলের শেষদিকে শাহজাহান বালখ অভিযান ঠিকঠাক ভাবে সামলাতে পারেননি, তার সফল কান্দাহার অভিযানও শেষমেশ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। এসব তার মর্যাদাকে কোথাও-না-কোথাও কলুষিত করেছিল। তবে তাঁর সবথেকে বড়ো ভুল হয়েছিল দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলি নতুন করে দখল করার চেষ্টা করা, কারণ ১৬৩৬ সালে তিনি খুব সাফল্যের সঙ্গে এ ব্যাপারে একটা বোঝাপড়ার জায়গায় চলে গিয়েছিলেন।
দক্ষিণী রাজ্যগুলোর সাংস্কৃতিক অবদান
মুঘলদের মতো দক্ষিণী শাসকরাও সংস্কৃতির ব্যাপক পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং বৃহত্তর সহনশীলতার নীতি অনুসরণ করে চলতেন যার হাত ধরে সমন্বয়ী সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল দাক্ষিণাত্যে।
আলি আদিল শাহ (মৃত্যু, ১৫৮০) হিন্দু ও মুসলিম সাধকদের সঙ্গে প্রায়শই আলোচনা করতেন এবং তিনি নিজে একজন সুফি হিসাবে পরিচিত ছিলেন। আকবরের অনেক আগে তিনি তাঁর রাজসভায় ক্যাথেলিক মিশনারিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর ছিল একটি দারুণ গ্রন্থাগার যেখানে তিনি ওয়ামান পণ্ডিত নামে একজন খ্যাতনামা সংস্কৃত বিশেষজ্ঞকে নিয়োগ করেছিলেন। তার উত্তরসূরিরাও সংস্কৃত ও মারাঠি ভাষার পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাঁর পরবর্তী উত্তরসূরি ইব্রাহিম আদিল শাহ (১৫৮০-১৬২৭) নয় বছর বয়সে সিংহাসনে বসেছিলেন। তিনি দরিদ্রদের প্রতি খুব সদয় ছিলেন বলে তার উপাধি হয়ে গিয়েছিল অবলা বাবা বা ‘গরিবের বন্ধু। তিনি সঙ্গীতের একজন গুণমুগ্ধকর অনুরাগী ছিলেন এবং একটি গ্রন্থও রচনা করেছিলেন যার নাম ছিল কিতাব–ই–নৌরস, যেখানে তিনি বিভিন্ন ধরনের রাগাশ্রয়ী গানের তালিকা তৈরি করেছিলেন। তিনি নৌরসপর নামে একটি নতুন রাজধানী নির্মাণ করেছিলেন যেখানে বসবাস করার জন্যে বিশালসংখ্যক সঙ্গীতজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তাঁর গানে তিনি মুক্ত মনে সঙ্গীত ও জ্ঞানের দেবী মা সরস্বতীর আরাধনা করেছিলেন। তার এই দরাজ মনোভাবের জন্য তিনি জগৎ গুরুনামে পরিচিত হয়েছিলেন। তিনি হিন্দু সাধু ও মন্দির সহ সকলের যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাই তিনি ভিতভার পূজার প্রধান কেন্দ্র পন্ধারপুরে জমি দান করেছিলেন আর এই এলাকাই মহারাষ্ট্রের ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম মুখ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। ইব্রাহিম আদিল শাহের এই বৃহত্তর সহনশীল নীতি অনুসরণ করেছিলেন তাঁর উত্তরসূরিরাও। আহমেদনগর রাজ্যের পরিষেবায় কীভাবে মারাঠা পরিবারগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তা তো আমরা আগেই আলোচনা করেছি।
কুতুব শাহও তার সামরিক, প্রশাসনিক ও কূটনৈতিক কাজে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষদের নানাভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন। ইব্রাহিম কুতুব শাহের (মৃত্যু ১৫৮০) আমলে রাজ্যের পেশায়া পদে উঠে এসেছিলেন মুরারি রাও নামে একজন হিন্দু। আমরা জানি যে এই পেশোয়া পদ ছিল জুমলা বা উজির পদের ঠিক পরের পদ। এই বংশের জন্মলগ্ন থেকে সামরিক তথা জমি-কেন্দ্রিক শক্তির উৎস হিসাবে নায়কওয়াড়ীরা রাজ্যে যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিল। ১৬৭২ সাল থেকে মুঘলদের হাতে ১৬৮৭ সালে সমাহিত হয়ে যাবার আগে পর্যন্ত রাজ্যের প্রশাসনিক ও সামরিক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন দুই নায়কওয়াড়ী ভাই–মান্না ও আখান্না।
শিক্ষিত লোকজনদের আঁতুড়ঘর ছিল গোলকুণ্ডা রাজ্য। আকবরের সমসাময়িক সেখানকার সুলতান কুলি কুতুব শাহ (১৫৮০-১৬১১) সাহিত্য ও স্থাপত্যের একজন একনিষ্ঠ অনুরাগী ছিলেন। সুলতান যে কেবল শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাই নয়, রীতিমতো একজন কবিও ছিলেন। তিনি দক্ষিণী উর্দু, ফারসি ও তেলেগু ভাষায় অনেক কবিতা লিখেছেন এবং রেখে গেছেন কবিতার এক বিপুল সম্ভার বা প্রচুর দিওয়ান। তিনিই প্রথম কাব্যের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার আমেজ নিয়ে এসেছিলেন। আল্লা ও পয়গম্বরের প্রতি প্রার্থনার পাশাপাশি তিনি প্রকৃতি, প্রেম ও তার সময়ের সামাজিক জীবনের নানা ছবি তুলে ধরেছিলেন কবিতায়। কয়েকজন, আধুনিক লেখকের মতে, তেলেগুভাষী মানুষ গোলকুণ্ডা রাজ্যকে তাদের নিজেদের বড়ো কাছের বলে মনে করত এবং ইব্রাহিমকে (কুতুব শাহ) সম্মান দিয়ে ডাকত। ‘মালকিভরম’ বলে। পরবর্তীকালে কুতুব শাহী শাসকরা ফারসি ও তেলেগু ভাষায়। কথা বলা মানুষদের বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন বলে জানা যায়।
দক্ষিণী উর্দু ভাষার বিকাশ এই পর্বের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল। মহম্মদ কুলি কুতুব শাহের উত্তরসূরি সহ সে সময়ের বহু কবি ও লেখক তাদের সাহিত্য চর্চার ভাষা হিসাবে উর্দুকে বেছে নিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে ফারসি ভাষাকেও অনেকে ব্যবহার করতেন আর ভাষার আকার, প্রকাশভঙ্গি, বিষয়বস্তু এমনকি শব্দভাণ্ডারের জন্য অনেকে হিন্দি ও তেলেগু ভাষার ব্যবহারও করতেন। বিজাপুরের দরবারেও উর্দু ভাষাকে বিশেষ উৎসাহ দেওয়া হত। দরবারের সভাকবি ছিলেন নুসরাতি যিনি মূলত । সপ্তদশ শতকের মধ্যবর্তী কালে বিখ্যাত হয়েছিলেন এবং কনকনগরের শাসক যুবরাজ মনোহর ও মধুমতাঁকে নিয়ে একটি অমর প্রেমকাহিনি রচনা করেছিলেন। দাক্ষিণাত্য থেকেই উর্দু ভাষা অষ্টদশ শতকে উত্তর ভারতে পৌঁছে গিয়েছিল।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে ১৫৬০ সাল থেকে দক্ষিণী চিত্রকলার সূচনা ঘটেছিল, ঠিক এই সময়ে মুঘল চিত্রকলারও বিকাশ ঘটেছিল। মুঘলদের মতো দক্ষিণী চিত্রকররাও পারস্যের চিত্রকলার পাশাপাশি পূর্ববর্তী সুলতানি/বাহামনি আমলের চিত্রকলা এবং দেশীয় চিত্রকলার ঐতিহ্য থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন। দক্ষিণী চিত্রকলার সকল ঘরানার মধ্যে বিজাপুরী চিত্রকলা ছিল সবথেকে উৎকৃষ্ট। বিজাপুরী চিত্রকলার এই নামডাকের পশ্চাতে মূলত দ্বিতীয় ইব্রাহিম আদিল শাহের (১৫৮০-১৬২৭) পৃষ্ঠপোষকতা ও ব্যক্তিত্ব কাজ করেছিল। এই সময়ে আহমেদনগর, বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা–এই তিন রাজ্যে সবথেকে সেরা সব দক্ষিণী চিত্রকলা সৃষ্টি হয়েছিল। ‘সাহিত্যিক উপাদান থেকে পরিষ্কার ভাবে জানা যায় যে ইব্রাহিম আদিল শাহ ছিলেন সংস্কৃতি ও কারিগরি শিল্পের ভক্ত, একজন সঙ্গীতজ্ঞ ও কবি এবং সম্ভবত একজন ভালো চিত্রকর, আর তাই তিনি তার দরবারে সব সময় সেরা শিল্পীদের নিয়ে আসার চেষ্টা করতেন’ (জগদীশ মিত্তল)।
স্থাপত্যের ক্ষেত্রে প্রথমে যার নাম মনে আসে তিনি হলেন মহম্মদ কুলি কুতুব শাহ। তিনি বহু স্থাপত্য নির্মাণ করেছিলেন যার মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় ছিল চার। মিনার। ১৫৯১-৯২ সালে কাজ শেষ হওয়া এই স্থাপত্য কীর্তি কুলি কুতুব শাহের বানানো নতুন শহর হায়দ্রাবাদের একেবারে উপকণ্ঠে অবস্থিত। এর চারদিকে ছিল চারটি উচ্চ খিলান। এর মূল সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে চার তলা ও ৪৮ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট এর চারটি মিনারের মধ্যে। খিলানগুলোর নকশাও দেখার মতো। বিজাপুরের শাসকরা উচ্চ মর্যাদা বজায় রেখে চলতেন এবং স্থাপত্যের প্রতি তাদের অনুরাগ ছিল প্রশ্নাতীত। এই সময়ের সবথেকে মনোমুগ্ধকর বিজাপুরী স্থাপত্যকর্মটি হল ইব্রাহিম রৌজা ও গোল গুমবাজ। ইব্রাহিম রৌজা ছিল ইব্রাহিম আদিল শাহের সমাধি এবং এর শৈলী ছিল অনন্য। ১৬৬০ সালে নির্মিত মহম্মদ আদিল শাহের সমাধি গোল গুমবাজে আছে, এখনও পর্যন্ত নির্মিত সবথেকে বড়ড়া একক গম্বুজ, এটির চারদিকের অনুপাত সমান, বৃহৎ গম্বুজটিকে চার কোণ দিয়ে ঘিরে আছে চারটি উচ্চ মিনার। বলা হয় যে এই সমাধির বিশাল ঘরের এক দিকে আস্তে আস্তে কথা বললে ওপর দিক থেকে তা শোনা যায়।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে দক্ষিণী রাজ্যগুলি কেবল একটি সুস্থ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করেই থেমে যায়নি, সেই সঙ্গে তারা সঙ্গীত, সাহিত্য, চিত্রকলা ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রেও রেখে গিয়েছে অসামান্য সব অবদান, যার অবদান, যার গুরুত্ব আজও আমাদের কাছে অপরিসীম।
—
১. রাজা আলি খানকে লেখা একটি চিঠিতে আকবর বলেছিলেন যে তিনি (দাক্ষিণাত্যের) রাজ্যগুলোর প্রধান ও শাসকদের কাছ থেকে রাজকীয় আনুগত্য ও মিত্রতা ছাড়া আর। কিছুই প্রত্যাশা করেন না।