০৮. দরজা পুড়িয়ে বের হওয়ার বুদ্ধি

দরজা পুড়িয়ে বের হওয়ার বুদ্ধি কাজ করল না। দরজার এক কোনায় আগুন ঠিকই জ্বলল, তবে সে আগুন স্থায়ী হল না। দরজার খানিকটা পুড়িয়ে নিভে গেল। লাভের মধ্যে লাভ এই হল যে, দরজা পোড়ানোর উত্তেজনায় মিসির আলির রাত কাটল নির্ঘুম। শরীরে ধস নেমে গেল।

বেঁচে থাকার জন্য শরীরকে মোটামুটি ঠিক রাখতে হবে। প্রচুর পানি খেতে হবে। তা তিনি খাচ্ছেন। বাথরুমের বেসিন থেকে নিয়ে মগভর্তি পানি। কিছুক্ষণ পরপর পানি। তাঁর মন বলছে বাথরুমের বেসিনের পানি থাকবে না। যে তাঁকে আটকেছে সে পানি বন্ধ করে দেবে। তখন প্রবল তৃষ্ণায় কমোডের পানি ছাড়া গতি থাকবে না।

ক্ষুধার যন্ত্রণা কমে আসছে। কাজটি করছে মস্তিষ্ক। মস্তিষ্ক যখন দেখে খাবার পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই তখন ক্ষিধে কমিয়ে দেয়। শরীরে জমে থাকা চর্বি থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টা করে। একজন সবল মানুষ কোনো খাদ্য গ্রহণ না করে চল্লিশ দিন পর্যন্ত বাঁচতে পারে।

মিসির আলি কোনো সবল মানুষ না। নানান অসুখে পর্যুদস্ত একজন মানুষ। তিনি ধরে নিয়েছেন, এইভাবে তিনি বেঁচে থাকতে পারবেন দশ দিন। এর বেশি না। তবে শেষ দিনগুলো খুব কষ্টকর হবে না। তার হেলুসিনেশন শুরু হবে। বাস্তবতার দেয়াল ভেঙে যাবে। তিনি ঢুকে পড়বেন অবাস্তব এক জগতে। একজন সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে অনেকবার সেই জগতে তার ঢোকার ইচ্ছে হয়েছে। ইচ্ছে এখন পূর্ণ হতে চলছে, কিন্তু তাঁর ভালো লাগছে না।

.

বন্দি অবস্থায় মিসির আলি আটান্ন ঘণ্টা পার করলেন। ক্ষুধাবোধ এখন পুরোপুরি চলে গেছে। তৃষ্ণা আছে, তবে তা কম। বেসিনের কলের পানি বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি শেষ পানি কখন খেয়েছেন তা মনে করতে পারছেন না। প্রবল ক্লান্তি তাঁকে ভর করেছে। সময় কাটাচ্ছেন বিছানায় শুয়ে। হেলুসিনেশন শুরু হয়েছে। শুরুটা হল ঘড়ি দিয়ে। মিসির আলি হঠাৎ দেখলেন ঘড়ির কাঁটা উল্টোদিকে ঘুরছে।

মিসির আলি মনে মনে বললেন, ইন্টারেস্টিং। হাতে কাগজ-কলম থাকলে হেলুসিনেশনের ধাপগুলো লিখে ফেলতে পারতেন। হাতে কাগজ-কলম নেই।

ঠিক তিনটা বাজার সময় ঘড়ি উল্টোদিকে চলা শুরু করেছিল। এখন বাজছে দু’টা। ঘড়ির কাঁটা কি দ্রুত ঘুরছে? তিনি বুঝতে পারলেন না।

মিসির আলি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙলে দেখেন, তিনি বাইনোকুলার হাতে হোটেলের বারান্দায় বসে আছেন। কাক-দম্পতি দেখছেন। তিনি কি সত্যি হোটেলের বারান্দায়? নাকি এটিও হেলুসিনেশন? যখন কাক মানুষের মতো কথা বলতে শুরু করল তখন বুঝলেন এটা হেলুসিনেশন

কাক বলল, মানুষের যেমন প্রাইভেসি আছে, আমাদেরও আছে। আপনি সারাক্ষণ বাইনোকুলার ফিট করে রাখছেন, এটা কি ঠিক? আপনার ওপর কেউ বাইনোকুলার ফিট করে রাখলে আপনার ভালো লাগত?

মিসির আলি বললেন, না।

কাক বলল, সবারই অনেক প্রাইভেট ব্যাপার আছে। হাগা মুতা আছে। ঠিক কি না স্যার আপনি বলেন?

মিসির আলি বললেন, অবশ্যই ঠিক। আমি দুঃখিত। আর বাইনোকুলার ধরব না।

মিসির আলি চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লেন। কতক্ষণ ঘুমালেন তিনি জানেন না। হয়তো সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম ভাঙল অথবা দীর্ঘ সময় ঘুমালেন। ঘুম ভাঙলে প্রথমেই ঘড়ি দেখলেন। ঘড়ি উল্টাদিকে যাচ্ছে না। স্থির হয়ে আছে। ঘড়ির হিসেবে সময় এখন বারোটা। দিন বা রাত বোঝা যাচ্ছে না।

বাথরুম থেকে শব্দ আসছে। মনে হচ্ছে কেউ থালাবাসন ধুচ্ছে।

মিসির আলি বললেন, কে?

কিশোরীদের মিষ্টি গলায় কেউ একজন বলল, চাচাজি! আমি চম্পা।

মিসির আলি হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, আবার হেলুসিনেশন শুরু হয়েছে।

মিসির আলি বললেন, বাথরুমে কেন? সামনে আসো।

চাচাজি! আমি বাথরুম পরিষ্কার করছি। আমার হাতে হাতমোজা নেই বলে আপনার সামনে আসতে পারব না। আপনার সামনে এলে আপনি আমার হাত দেখে ফেলবেন। আমার বিরাট পাপ হবে। শেষ বিচারের দিন জবাব দিতে পারব না।

মিসির আলি বললেন, ও আচ্ছা।

চম্পা বলল, শরীরের উপর আমার ঘেন্না ধরে গেছে তো চাচাজি। কাউকেই এখন শরীর দেখাই না। হাত পায়ের আঙুল, চোখ, সব লুকিয়ে রাখি। চাচাজি! এই ঘরটা কি চিনতে পারছেন?

না।

আপনার এত বুদ্ধি, আর সাধারণ ব্যাপারটা ধরতে পারলেন না। ঘরে একটা মাত্র জানালা। সেই জানালা কঠিনভাবে বন্ধ।

মিসির আলি বললেন, এই ঘরেই কি তুমি তোমার শ্বশুর সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে আসো?

চম্পা বলল, আপনি খুব সুন্দর করে বললেন, দেখা করতে আসি। আমি দেখা করতে আসি না। বাধ্য হয়ে ভয়ংকর কিছু কর্মকাণ্ডের জন্য আসি।

মিসির আলি বললেন, তুমি আমাকে আটকে রেখেছ কেন?

চম্পা বলল, আমি আপনাকে আটকে রাখি নি। বড়পা রেখেছে।

কেন?

বড়পা এই ঘরে অনেক দিন আটক ছিল। এই দুঃখে সে সবাইকেই এভাবে আটকে রাখতে চায়।

কত দিন আটকে রাখবে?

জানি না। মনে হয় ছাড়বে না।

ছাড়বে না?

না। চাবি কুয়ায় ফেলে দিয়েছে তো। দরজা খুলবে কীভাবে?

সেটাও একটা কথা।

চাচাজি! আমি এখন যাই। পরে আসব। হাতমোজা পরে আসব, তখন আপনার সামনে আসা যাবে। গল্প করা যাবে।

আচ্ছা।

আপনার জন্য এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আসব। আপনি আরাম করে সিগারেট খাবেন।

মিসির আলি বললেন, সঙ্গে দিয়াশলাই আনবে। আমার দিয়াশলাইয়ের কাঠি শেষ হয়ে গেছে।

চম্পা বলল, অবশ্যই দিয়াশলাই আনব। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন তো চাচাজি। আপনার ঘুম দরকার। ঘুমপাড়ানি গান গাইয়ে ঘুম পাড়াব?

মিসির আলি ক্লান্ত গলায় বললেন, গান লাগবে না। এমনিতেই ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।

মিসির আলি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন।

একসময় ঘুম ভাঙল। তিনি অবাক হয়ে দেখেন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি পড়ছে ঘরের ভেতর। কাক-দম্পতির বাসাও ঘরের ভেতর। বৃষ্টিতে ভিজে দু’টা কাক শীতে থরথর করে কাঁপছে। পুরুষ কাকটা মিসির আলিকে বলল, স্যার, একটা ছাতা দিতে পারবেন? প্লিজ!

মিসির আলি বললেন, ছাতা পাব কোথায়? তাকিয়ে দেখো, আমিও ভিজছি।

কাক বলল, একটা কিছু ব্যবস্থা কি করা যায় স্যার? বৃষ্টির পানি ভয়ংকর ঠাণ্ডা। ডিমগুলো পুরোপুরি ভিজে গেলে আর বাচ্চা ফুটবে না।

মিসির আলি বললেন, তোমার বাসাটা কি আমার খাটের নিচে আনতে পারো? তা হলে বৃষ্টির পানির হাত থেকে বাঁচতে পারো।

থ্যাংক য়্যু স্যার। ভালো সাজেশন।

কাক-দম্পতি অনেক কষ্টে বাসাটা খাটের দিকে আনছে। বাসা মিসির আলির হাতের নাগালে চলে এসেছে। তিনি ইচ্ছা করলেই হাত বাড়িয়ে বাসাটা ধরে খাটের নিচে চালান করে দিতে পারেন, কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না। তাঁর সমস্ত শরীর অবশ। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মিসির আলির কেন জানি মনে হচ্ছে এবার ঘুমিয়ে পড়লে আর ঘুম ভাঙবে না। তিনি প্রাণপণে জেগে থাকার চেষ্টা করছেন।

স্যার স্লামালিকুম।

ওয়ালাইকুম সালাম।

আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন? আমি আপনার ছাত্রী। আমার নাম রেবেকা।

ও আচ্ছা আচ্ছা।

চিনতে পারেন নি?

শরীরটা ভালো না তো। এইজন্য সমস্যা হচ্ছে।

স্যার, আমি আপনাকে চামড়ায় বাঁধানো একটা খাতা দিয়েছিলাম।

এখন মনে পড়েছে। তুমি কেমন আছ?

আমি ভালো আছি। কিন্তু আপনার এ কী অবস্থা!

একটু বেকায়দা অবস্থাতেই আছি। এরা আমাকে আটকে ফেলেছে।

কেন?

কেন তা তো জানি না।

স্যার, আপনি জানবেন না তো কে জানবে? আপনি হচ্ছেন মিসির আলি। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে বের করুন কেন তারা আপনাকে আটকেছে। এরা কি আপনার শত্রুপক্ষ?

না।

তাদের ক্ষতি হয় এমন কিছু কি আপনি করেছেন?

না।

আপনাকে আটকে রাখলে তাদের কি কোনো স্বার্থসিদ্ধি হয়?

না।

আপনার চিন্তা করার ক্ষমতা ঠিক আছে কি না, সেই পরীক্ষা কি করবেন?

কী পরীক্ষা?

ক্লিস টেস্ট। স্যার, মনে পড়েছে?

হ্যাঁ, পড়েছে। ১০০ থেকে নিচের দিকে নামতে হবে।

প্রথমবার একটি সংখ্যা বাদ দিয়ে নিচে নামা। ১০০ থেকে হবে ৯৮, তারপর দু’টা সংখ্যা বাদ ৯৫, তারপর তিন সংখ্যা বাদ ৯১।

স্যার, পরীক্ষা দিতে থাকুন। এই ফাঁকে আমি পানি এনে দিচ্ছি। পানি খান।

পানি কোথায় পাবে? পানি তো বন্ধ।

আমি কমোড থেকে পানি আনব। আপনি কল্পনা করবেন ঝরনার পবিত্র পানি খাচ্ছেন। বেঁচে থাকার জন্য আপনার পানি খাওয়াটা জরুরি। ঠিক না স্যার?

হ্যাঁ ঠিক।

মিসির আলি ঘুমিয়ে পড়লেন। তিনি কতক্ষণ ঘুমালেন তা জানেন না। পানির পিপাসায় তাঁর বুক শুকিয়ে গেছে। বিছানা থেকে নামার শারীরিক শক্তি তাঁর নেই।

মাথার কাছে দুঃখিত চোখমুখ করে পারুল দাঁড়িয়ে আছে।

মিসির আলি বললেন, পারুল। আমাকে একগ্লাস পানি খাওয়াতে পারবে?

আমি পারুল না। আমি এক ভূতনি। আমার নাম—হুড়বুড়ি।

ও আচ্ছা, তুমি হুড়বুড়ি?

জি হুড়বুড়ি। একটা ছড়া শুনবেন স্যার।

হুড়বুড়ি, থুরথুরি
বুড়াবুড়ি, কুরকুরি
ফুরফুরি ফুরফুরি

মিসির আলি বললেন, চুপ করো প্লিজ।

হুড়বুড়ি চুপ করল। তখন বেজে উঠল লাল টেলিফোন। এই টেলিফোনের তার ছেড়া, তারপরেও বাজছে কেন? টেলিফোন নিশ্চয়ই বাজছে না। তিনি ভুল শুনছেন। তাঁর বিভ্রান্তির কাল শুরু হয়েছে।

রিং হতে হতে টেলিফোন থেমে গেল। এখন ভাঙচুরের শব্দ হচ্ছে। মিসির আলি বললেন, কী হচ্ছে?

হুড়বুড়ি বলল, স্যার! পুলিশ এসেছে। দরজা ভাঙছে। শব্দ শুনছেন?

মিসির আলি ক্লান্ত গলায় বললেন, ও আচ্ছা পুলিশ।

পুলিশের সঙ্গে জসু আছে। মনে হয় সে-ই আপনাকে উদ্ধারের জন্য পুলিশ এনেছে।

স্যার! দরজা ভেঙে ফেলেছে। তাকিয়ে দেখুন, পুলিশ ঢুকছে।

মিসির আলি তাকিয়ে আছেন। তিনি পুলিশ দেখতে পাচ্ছেন। জসুকে দেখতে পাচ্ছেন। তাদের সঙ্গে মল্লিক সাহেবও আছেন। একজন মৃত মানুষ। যার ডেডবডি কুয়া থেকে তোলা হয়েছে। মৃত মানুষ সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। এটা নিশ্চয়ই হেলুসিনেশন

মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *