তোমার না থাকা
তুমি কি কোথাও আছ
মেঘ বা রঙধনুর আড়ালে!
হুহু বাতাসের পিঠে ভর করে মাঝে মধ্যে আসো, আমাকে ছুঁয়ে
যাও!
তুমি কি দেখছ চা জুড়িয়ে
জল হচ্ছে আমার
আর আমি তাকিয়ে আছি সামনে
যে বাড়ি ঘর, মানুষ, যন্ত্রযান
দুপুরের আগুনে রাস্তা, ঝরে পড়া
শুকনোপাতা, মরা ডাল
বুড়ো কুকুরের লালা ঝরা
লাল জিভের দিকে
আর তোমার না থাকার দিকে!
তুমি কি খুব গোপনে দেখছ তাকিয়ে থাকতে থাকতে
চোখ কেমন জ্বালা করছে আমার–
তুমি কি কোনও বৃক্ষ হয়ে
দাঁড়িয়ে আছ কোথাও,
কোনও পাখি বা প্রজাপতি!
কোনও নুড়ি কোনও অচিন দেশে!
মানুষগুলো খাচ্ছে পান করছে হাঁটছে হাসছে
দৌড়োচ্ছে, জিরোচ্ছে, ভালবাসছে
তোমার না থাকা মাঝখানে
বসে আছে, একা।
.
একটি মৃত্যু, কয়েকটি জীবন
একটি মৃত্যুকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েকটি জীবন।
কয়েক মুহূর্ত পর জীবনগুলো চলে গেল
যার যার জীবনের দিকে।
মৃত্যুপড়ে রইল একা, অন্ধকারে
কেঁচো আর কাদায়–
জীবন ওদিকে হিসেব পত্তরে,
বাড়িঘরে,
সংসারে, সঙ্গমে।
.
আমার মায়ের গল্প
১.
চোখ হলুদ হচ্ছিল মা’র,
শেষে এমন, যেন আস্ত দুটো ডিমের কুসুম!
পেট এমন তেড়ে ফুলছিল, যেন
জেঁকে বসা বিশাল পাথর
নাকি এক পুকুর জল–বুঝি ফেটে বেরোবে!
মা দাঁড়াতে পারছে না,
না বসতে,
না নাড়তে হাতের আঙুল,
না কিছু।
মা’কে মা বলে চেনা যাচ্ছিল
না, শেষে এমন।
আত্মীয়রা সকাল সন্ধে শুনিয়ে যাচ্ছে
ভাল একটি শুক্রবার দেখে যেন তৈরি মা..
যেন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলতে বলতে
যেন মুনকার নকির সওয়াল
জবাবের জন্য এলে বিমুখ না হয়
যেন পাক পবিত্র থাকে ঘর দুয়োর,
হাতের কাছে থাকে সুরমা আর আতর।
হামুখো অসুখ মা’র
শরীরে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে সেদিন,
গিলে ফেলছে দুফোঁটা যে শক্তি ছিল শেষের, সেটুকুও।
কোটর থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে
চোখ,
চড়চড় করছে জিভ শুকিয়ে,
ফুসফুসে বাতাস কমে আসছে
মা’র,
শ্বাস নেবার জন্য কী অসম্ভব কাতরাচ্ছে–
যন্ত্রণায় কুঁচকে আছে কপাল,
কালো ভুরু
গোটা বাড়ি তখন চেঁচিয়ে মাকে বলছে তাদের সালাম পৌঁছে
দিতে নবীজিকে,
কারও কোনও সংশয় নেই যে
মা জান্নাতুল ফিরদাউসে যাচ্ছে,
নবীজির হাত ধরে বিকেলে বাগানে হাঁটবে,
পাখির মাংস আর আঙুরের রস খাবে দুজন বসে,
অমনই তো স্বপ্ন ছিল, মা’র অমনই স্বপ্ন ছিল।
আশ্চর্য, মা তবু কোথাও এক পা যেতে
চাইছিলো না।
চাইছিলো বিরুই চালের ভাত
বেঁধে খাওয়াতে আমাকে,
টাকি মাছের ভর্তা আর ইলিশ ভাজা। নতুন ওঠা জাম-আলুর ঝোল।
একখানা কচি ডাব পেড়ে দিতে
চাইছিলো দক্ষিণের গাছ থেকে,
চাইছিলো হাতপাখায় বাতাস করতে চুল সরিয়ে দিতে দিতে–
কপালের কটি এলো চুল।
নতুন চাঁদর বিছিয়ে দিতে চাইছিলো বিছানায়,
আর জামা বানিয়ে দিতে, ফুল
তোলা..
চাইছিলো উঠোনে খালি পায়ে হাঁটতে,
হেলে পড়া কামরাঙা গাছটির
গায়ে বাঁশের কঞ্চির ঠেস
দিতে
চাইছিলো হাসনুহেনার বাগানে
বসে গান গাইতে ওগো মায়াভরা চাঁদ আর
মায়াবিনী রাত, আসেনি তো বুঝি আর জীবনে আমার। ….
বিষম বাঁচতে চেয়েছিলো মা।
.
২.
আমি জানি পরকাল, পুলসেরাত বলে কিছু
নেই।
আমি জানি ওসব ধর্মবাদীদের টোপ
ওসব বেহেসত, পাখির মাংস, মদ আর গোলাপি
মেয়েমানুষ!
আমি জানি জান্নাতুল ফিরদাউস নামের কোনও বেহেসতে
যাবে না, কারও সঙ্গে বাগানে হাঁটবেনা মা!
কবর খুঁড়ে মা’র মাংস খেয়ে যাবেপাড়ার শেয়াল
শাদা হাড়গুলো বিচ্ছিরিরকম ছড়িয়ে–
গোরখাদক একদিন তাও তুলে
ফেলে দেবে কোথাও,
জন্মের মত মা নিশ্চিহ্ন হবে।
তবু আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে
সাত আসমানের ওপরে অথবা কোথাও
বেহেসত বলে কিছু আছে,
জান্নাতুল ফিরদাউস বলে কিছু,
চমৎকার কিছু,
চোখ ঝলসানো কিছু।
মা তরতর করে পুলসেরাতপার হয়ে
গেছে
পলক ফেলা যায় না দেখলে
এমন সুদর্শন, নবীজি,
বেহেসতের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে মা’কে আলিঙ্গন করছেন;
মাখনের মত মা মিশে যাচ্ছে নবীজির
লোমশ বুকে।
ঝরণার পানিতে মা’র স্নান করতে ইচ্ছে হচ্ছে
মা’র দৌড়োতে ইচ্ছে হচ্ছে
বেহেসতের এ মাথা থেকে ও মাথা–
মা স্নান করছে,
দৌড়োচ্ছে, লাফাচ্ছে।
রেকাবি ভরে পাখির মাংস এসে গেছে, মা খাচ্ছে।
মা’কে দেখতে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা পায়ে হেঁটে
বাগান অবদি এসেছেন।
মা’র খোঁপায় গুঁজে দিচ্ছেন লাল একটি
ফুল,
মা’কে চুমু খাচ্ছেন।
আদরে আহ্লাদে মা নাচছে, গাইছে।
মা ঘুমোত গেছে পালকের বিছানায়,
সাতশ হুর মা’কে বাতাস
করছে,
রুপোর গেলাশ ভরে মা’র জন্য পানি আনছে গেলবান।
মা হাসছে, মা’র সারা
শরীর হাসছে
আনন্দে।
পৃথিবীতে এক দুঃসহ জীবন ছিল মা’র, মা’র মনে নেই।
এত যে ঘোর নাস্তিক আমি,
আমার বিশ্বাস করতে ভাল লাগছে বেহেসত বলে কিছু আছে কোথাও।
.
দুঃখবতী মা
মা’র দুঃখগুলোর ওপর গোলাপ-জল ছিটিয়ে
দেওয়ার ইচ্ছে ছিল,
যেন দুঃখগুলো সুগন্ধ পেতে
পেতে ঘুমিয়ে পড়ে কোথাও
ঘুমটি ঘরের বারান্দায়,
কুয়োর পাড়ে কিম্বা কড়ই তলায়।
সন্ধেবেলায় আলতো করে তুলে বাড়ির ছাদে রেখে এলে
দুঃখগুলো দুঃখ ভুলে চাঁদের
সঙ্গে খেলত হয়ত বুড়িছোঁয়া খেলা।
দুঃখরা মা’কে ছেড়ে কলতলা অবদি যায়নি কোনওদিন।
যেন এরা পরম আত্মীয়, খানিকটা
আড়াল হলে বিষম একা পড়ে যাবেন মা;
কাদায় পিছলে পড়বেন, বাঘে ভালুকে খাবে, দুষ্ট
জ্বিনেরা গাছের মগডালে
বসিয়ে রাখবে মা’কে–
দুঃখগুলো মা’র সঙ্গে নিভৃতে কী সব কথা
বলত…
কে জানে কী সব কথা
মা’কে দুঃখের হাতে সঁপে বাড়ির মানুষগুলো
অসম্ভব স্বস্তি পেত।
দুঃখগুলোকে পিড়ি দিত বসতে,
লেবুর শরবত দিত, বাটায়
পান দিত,
দুঃখগুলোর আঙুলের ডগায় চুন লেগে থাকত..
ওভাবেই পাতা বিছানায় দুঃখগুলো দুপুরের দিকে গড়িয়ে নিয়ে
বিকেলেই আবার আড়মোড়া ভেঙে
অযুর পানি চাইত,
জায়নামাজও বিছিয়ে দেওয়া হত ঘরের মাঝখানে।
দুঃখগুলো মার কাছ থেকে
একসুতো সরেনি কোনওদিন।
ইচ্ছে ছিল লোহার সিন্দুকে উই আর
তেলাপোকার সঙ্গে, তেলাপোকা আর
নেপথলিনের সঙ্গে ওদেরপুরে রাখি।
ইচ্ছে ছিল বেড়াতে নিয়ে গিয়ে ব্রহ্মপুত্রের জলে, কেউ জানবে
না,
ভাসিয়ে দেব একদিন
কচুরিপানার মতো, খড়কুটোর মতো, মরা সাপের মতো ভাসতে ভাসতে দুঃখরা
চলে যাবে কুচবিহারের দিকে…
ইচ্ছে ছিল
দুঃখগুলো মা’র সঙ্গে শেষ অবদি কবর অবদি গেছে,
তুলে নিয়ে কোথাও পুতে রাখব
অথবা ছেঁড়া পুঁতির মালার
মত ছুড়ব রেললাইনে,
বাঁশঝাড়ে, পচা পুকুরে। হল কই!
মা ঘুমিয়ে আছেন, মা’র শিথানের কাছে মার দুঃখগুলো আছে,
নিশুত রাতেও জেগে আছে একা একা।
.
দেশ বলতে এখন দেশ
এখন আমার
কাছে আস্ত একটি শ্মশান,
শ্মশানে দাঁড়িয়ে প্রতিরাতে
একটি কুকুর কাঁদে,
আর এক কোণে নেশাগ্রস্ত পড়ে
থাকে চিতা জ্বালানোর কজন
তোক।
দেশ এখন আমার কাছে আর শস্যের সবুজ ক্ষেত নয়,
স্রোতস্বিনী নদী নয়, রোদে ঝিলমিল দীঘি নয়,
ঘাস নয়, ঘাসফুল নয় …
দেশ ছিল ‘র ধনেখালি শাড়ির আঁচল
যে আঁচলে ঘাম মুছে, চোখের জল মুছে দাঁড়িয়ে থাকতেন মা, দরজায়।
দেশ ছিল ‘র গভীর কালো চোখ,
যে চোখ ডানা মেলে উড়ে যেত
রোদ্দুরে, রাত্তিরে
যেখানেই ভাসি, ডুবি, পাড়
পাই–খুঁজত আমাকে।
দেশ ছিল ‘র এলো চুলের হাতখোঁপা,
ভেঙে পড়ত, হেলে পড়ত, রাজ্যির শরম ঢাকত আমার।
দেশ ছিল ‘র হাতে সর্ষের তেলে মাখা মুড়ি
মেঘলা দিনে ভাজা ইলিশ, ভুনো
খিচুড়ি
দেশ ছিল মা’র হাতের ছ’জোড়া রঙিন চুড়ি।
দেশ ছিল বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে মা মা বলে ডাকার আনন্দ।
কনকনে শীতে মা’র কাঁথার
তলে গুটিসুটি শুয়ে পড়া,
ভোরবেলায় শিউলি ছাওয়া মাঠে বসে ঝাল-পিঠে খাওয়া..
অন্ধকারে মুড়ে,
দূরে,
নৈঃশব্দ্যের তলে মাটি খুঁড়ে
দেশটিকে পুরে,
পালিয়েছে কারা যেন,
দেশ বলে কেউ নেই এখন, কিছু নেই আমার।
খাঁ খাঁ একটি শ্মশান সামনে, একটি কুকুর, আর কজন নেশাগ্রস্ত লোক।
.
তুমি নেই বলে
তুমি নেই বলে ক’টি বিষাক্ত সাপ উঠে এসেছে উঠোনে, ফিরে যাচ্ছে না
জলায় বা জংলায়।
কাপড়ের ভাঁজে, টাকা পয়সার ড্রয়ারে,
বালিশের নিচে, গ্লাসে-বাটিতে, ফুলদানিতে,
চৌবাচ্চায়, জলকলের মুখে
ইঁদুর আর তেলাপোকার বিশাল
সংসার এখন,
তোমার সবকটি কবিতার বইএ
এখন উই।
তুমি নেই বলে মাধবীলতাও আর ফোটে না
দেয়াল ঘেঁসে যে রজনীগন্ধার গাছ ছিল, কামিনীর,
ওরা মরে গেছে, হাসনুহানাও।
গোলাপ বাগানে গোলাপের বদলে শুধু কাঁটা আর পোকা খাওয়া পাতা।
বুড়ো জাম গাছের গায়ে
বিচ্ছুদের বাসা, পেয়ারা
গাছটি হঠাৎ একদিন
ঝড় নেই বাতাস নেই গুঁড়িসুদ্ধ উপড়ে পড়ল।
মিষ্টি আমের গাছে একটি আমও আর ধরে না, নারকেল গাছে
না একখানা নারকেল।
সুপুরি গাছেদের নাচের ইশকুল বন্ধ এখন।
তুমি নেই বলে সবজির বাগান পঙ্গপাল এসে খেয়ে গেছে
সবুজ মাঠটি ভরে গেছে খড়ে,
আগাছায়।
তুমি নেই বলে মানুষগুলো
এখন ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে
পারে যে কাউকে।
তুমি নেই
তোমার না থাকা জুড়ে দাপট এখন অদ্ভুত অসুস্থতার,
আমার শ্বাসরোধ করে আনে
দূষিত বাতাস..
আমিও তোমার মতো যে কোনও সময় নেই হয়ে যেতে চাই।
(তোমার না থাকার দৈত্য ঝাঁপিয়ে পড়ছে ঘাড়ে,
তোমার না থাকার শকুন ছিঁড়ে খাচ্ছে আমার সর্বাঙ্গ,
তোমার না থাকার উন্মত্ত
আগুন পুড়িয়ে ছাই করছে
তোমার না থাকার সর্বগ্রাসী
জল আমাকে ডুবিয়ে নিচ্ছে…)
.
ফেরা
মা একদিন ফিরে আসবেন বলে
মা’র ঘটিবাটি, দু’জোড়া চটি
বিছানার চাঁদর, লেপ কাঁথা,
ডালের ঘুটনি, হাতা
ক’টি কাপড়, ক’টি চুড়ি দুল
চিরুনিখানি, ওতে আটকা চুল
ফুল ফলের ছবি, মা’র আঁকা
যেখানে যা কিছু ছিল, তেমন করেই রাখা।
মা ফিরে আসবেন
ফিরে কলতলায় পায়ের কাদা ধুতে ধুতে বলবেন
খুব দূরে এক অরণ্যে গিয়েছিলাম!
তোরা সব ভাল ছিলি তো!
খাসনি বুঝি! আহা, মুখটা কেন শুকনো
লাগছে এত!
বাঘ ভালুকের গল্প শোনাতে
শোনাতে মা আমাদের খাওয়াবেন রাতে
অনেকদিন পর মাও খাবেন মাছের ঝোল
মেখে ভাতে,
খেয়ে, নেপথলিনের গন্ধঅলা
লালপাড় শাড়ি পরে একটি তবক দেওয়া পান
হেসে, আগের মত গাইবেন সেই চাঁদের দেশের গান।
একদিন ফিরে আসবেন মা
ফিরে আসবেন বলে আমি ঘর ছেড়ে
দু’পা কোথাও বেরোই না
জানালায় এসে বসে দু একটি
পাখি,
ওরাও জানে মা ফিরবেন, বিকেলের দুঃখী হাওয়াও, ..
আকাশের সবকটা নক্ষত্র জানে, আমি জানি।
.
একটি অকবিতা
।আমার মা যখন মারা যাচ্ছিলেন, সকালবেলা স্নান করে জামা জুতো পরে ঘরবার হলেন বাবা, চিরকেলে অভ্যেস। বড়দা সকালের নাস্তায় ছ’টি ঘিয়ে ভাজাপরোল নিলেন, সঙ্গে কষানো খাসির মাংস, এ না হলে নাকি জিভে রোচে না তাঁর। ছোড়দা এক মেয়েকে বুকে মুখে হাত বুলিয়ে সাধাসাধি করছিলেন বিছানায় নিতে। সারা গায়ে হলুদ মেখে বসেছিলেন বড়বৌদি, ফর্সা হবেন; গুনগুন করে হিন্দি ছবির গান গাইছিলেন, চাকরবাকরদের বলে দিয়েছেন ইলিশ ভাজতে, সঙ্গে ভুনা খিচুড়ি। ভাইয়ের ছেলেগুলো মাঠে ক্রিকেট খেলছিল, ছক্ক মেরেপাড়া ফাটিয়ে হাসছিল। মন ঢেলে সংসার করা বোন আমার স্বামী আর কন্যা নিয়ে বেড়াতে বেরোল শিশুপার্কে। মামারা ইতিউতি তাকিয়ে মা’র বালিশের তলায় হাত দিচ্ছিল সোনার চুড়ি বাপাঁচশ টাকার নোট পেতে। খালি ঘরে টেলিভিশন চলছিল, যেতে আসতে যে কেউ খানিক থেমে দেখে নেয় তিব্বত টুথপেস্ট নয়তপাকিজা শাড়ির বিজ্ঞাপন। আমি ছাদে বসে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে নারীবাদ নিয়ে চমৎকার একটি কবিতা লেখার শক্ত শক্ত শব্দ খুঁজছিলাম।
মা মারা গেলেন।
বাবা ঘরে ফিরে জামাকাপড় ছাড়লেন। বড়দা খেয়ে দেয়ে ঢেঁকুর তুললেন। ছোড়দা রতিকর্ম শেষ করে বিছানা ছেড়ে নামলেন। বড়বৌদি স্নান সেরে মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে ইলিশ ভাজা দিয়ে গোগ্রাসে কিছুখিচুড়ি গিলে মুখ মুছলেন। ভাইয়ের ছেলেগুলো ব্যাট বল হাতে নিয়ে মাঠ ছাড়ল। স্বামী কন্যা নিয়ে বোনটি শিশুপার্ক থেকে ফিরল। মামারা হাত গুটিয়ে রাখলেন। আমি ছাদ থেকে নেমে এলাম। ছোটরা মেঝেয় আসন পেতে বসে গেল, টেলিভিশনে নাটক শুরু হয়েছে। বড়দের এক চোখ মায়ের দিকে, আরেক চোখ টেলিভিশনে। মায়ের দিকে তাকানো চোখটি শুকনো, নাটকের বিয়োগান্তক দৃশ্য দেখে অন্য চোখে জল।
.
যদি
কাউকে বাঁচতে দেখলে অসম্ভব রাগ হয় আমার।
পৃথিবীর সব গাছ যদি মরে কাঠ হয়ে
যেত
পাহাড়গুলো ধসেপড়ত বাড়িঘরের ওপর,
নদী সমুদ্র শুকিয়ে চর হয়ে যেত, সেই চরে
পশুপাখি মানুষ এক বিষম অসুখে কাতরে কাতরে মরে যেত!
কদাকার পিন্ডটি যদি মহাকাশে ছিঁড়ে
পড়ত হঠাৎ,
সুর্যের দুহাত কাছে গিয়ে
ঝলসে যেত, ছাই হয়ে যেত!
এরকম স্বপ্ন নিয়ে আজকাল আমি বেঁচে থাকি
আর এই বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন বিবমিষা, প্রতিদিন ঘৃণা..
.
মা কষ্ট পেলে আমাদের কিছু যেত আসত না
আমার একটি মা ছিল
চমৎকার দেখতে একটি মা,
একটি মা আমার ছিল
মা আমাদের খাওয়াত শোয়াত ঘুম পাড়াত,
গায়ে কোনও ধুলো লাগতে দিত, পিঁপড়ে উঠতে না,
মনে কোনও আঁচড় পড়তে দিত না
মাথায় কোনও চোট পেতে না।
অথচ
মাকে লোকেরা কালো পেঁচি বলত,
আমরাও।
বোকা বুদ্ধ বলে গাল দিতাম
মা’কে।
মা কষ্ট পেত।
মা কষ্ট পেলে আমাদের কিছু যেত আসত না।
আমাদের কিছুতে কিছু যেত আসত না,
মা জ্বরে ভুগলেও না,
মা জলে পড়লেও না,
মা না খেয়ে শুকিয়ে কাঁটা হয়ে গেলেও না
পরনের শাড়ি ছিঁড়ে ত্যানা
হয়ে গেলেও না,
মা’কে মা বলে মনে হত,
মানুষ বলে না।
মা মানে সংসারের ঘানি টানে যে
মা মানে সবচেয়ে ভাল রাঁধে
যে, বাড়ে যে,
কাপড় চোপড় ধুয়ে রাখে গুছিয়ে রাখে যে
মা মানে হাড় মাংস কালি
করে সকাল সন্ধে খাটে যে
যার খেতে নেই, শুতে নেই, ঘুমোতে
নেই
যার হাসতে নেই।
যাকে কেবল কাঁদলে মানায়
শোকের নদীতে যার নাক অবদি
ডুবে থাকা মানায়
মা মানে যার নিজের কোনও জীবন থাকে না।
মা’দের নিজের কোনও জীবন
থাকতে নেই!
মা ব্যথায় চেঁচাতে থাকলে
বলি
ও কিছুনা, খামোকা আহ্লাদ!
মরে গেলে মাকে পুঁতে রাখে মাটির তলায়,
ভাবি যে বিষম এক কর্তব্য পালন হল
মা নেই।
আমাদের এতেও কিছু যায় আসে
না।
.
সাধ
তোমাকে কখনও বেড়াতে নিইনি
যেখানে চাঁদের নাগাল পেতে পাহাড়ের কাঁখে চড়ে বসে থাকে একটি দুধু নদী, গায়ে-হলুদের দিনে একঝাঁকনক্ষত্রের চোখ ফাঁকি দিয়ে চুপ চুপ, টুপ করে জলে পড়ে নদীর সারা গায়ে চুমু খায় চাঁদ!
তোমাকে কি নিয়েছি
যেখানে সমুদ্র মন খারাপ করে বসে থাকে, আর তার জলতুতোপাখিগুলো অরণ্যের বিছানায় শুয়ে রাতভর কাঁদে। সমুদ্রের মন ভাল হলে নেমন্তন্ন করেপাখিদের, অঢেল খাবার আরপানীয়ের ছড়াছড়ি–পাখিরা বিষম খুশি, কিছু ফেলে, কিছু খায়। নাচে, গায়!
তোমাকে বড় নিতে ইচ্ছে করে
যেখানে বরফের চাঁইএর হাঁটুতে মাথা রেখে সুবোধ বালকেরমত ঘুমিয়ে আছে আগ্নেয়গিরি, আর দিগন্তের মাথায় ঠোকর খেয়ে কেঁদে কেটে চোখ লাল করে অভিমানে দৌড়ে বাড়ি ফেরে হাওয়ার কিশোরী, দেখে বরফের চোখেও জল জমে মায়ায়।
তোমাকে কত কোথাও নিতে ইচ্ছে।
যেখানে সাতরঙ জামা পরে প্রজাপতি চুমু খেতে যায় ঘাসফুলের ঠোঁটে, পাড়ার ন্যাংটো হরিণ তার জামা কেড়ে নিতে দৌড়ে আসে, দেখে প্রজাপতি লুকোয় রাধাচূড়া মাসির শাড়ির আঁচলে, ঘাসফুল ভেজা ঠোঁটে অপেক্ষা করে আরেকটি চুমুর।
তুমি নেই বলেই কি ইচ্ছেরা জড়ো হচ্ছে এমন ..
.
প্রায়শ্চিত্ত
একটি অসুখ চাইছি আমি, ঠিক সেই অসুখটি–
সেই বৃহদন্ত্রের অসুখ, হামাগুড়ি
দিয়ে যকৃতে পৌঁছবে,
যকৃত থেকে হেঁটে হেঁটে হাড়ে, হাড় থেকে দৌড়ে ধরবে ফুসফুস
ফুসফুস পেরিয়ে রক্তনদী
সাঁতরে মস্তিষ্ক।
ভুল কাটাছেঁড়া, ভুল ওষুধ,
ভুল রক্তের চালান
অসুখের পেশিতে শক্তির যোগান
দেবে, কুরুক্ষেত্রে বাড়তি
সৈন্য, রণতরী।
সেরকম পড়ে থাকব বিষণ্ণ বিছানায় একা, যেরকম ছিলে তুমি
যেরকম আস্ত কঙ্কাল, যন্ত্রণায়
কুঁকড়ে যাওয়া হাড়ের কঙ্কাল
মাংস খসে পড়ছে, রক্ত ঝরে
যাচ্ছে
ধসে পড়ছে স্নায়ুর ঘরবারান্দা
ঠিক সেরকম হোক আমারও,
আমারও যেন চোখের তারা জন্মের মত
অচল হয়
যেন তীব্র শ্বাসকষ্ট হয়,
ফুসফুস
ফুলে ঢোল হয়ে থাকে জলে, নিশ্বাসের হাওয়া পেতে যেন কাতরাই,
যেন হাত পা ছুঁড়ি,
যেন না পাই।
যেন কারও স্পর্শ পেতে আকুল হই,
যেন কাতরাই, হাত বাড়াই,
যেন না পাই।