০৮. তারপর বাবুদের মনে ভয় ঢুকে গেল

ঝগড়ু বললে, তারপর? তারপর বাবুদের মনে ভয় ঢুকে গেল, তারা বাড়ি ফিরতে পারলে বাঁচে। যার হাতের বন্দুক ছুটে গেছিল, সে যাচ্ছে সবার আগে, এমন সময় তাকে খরিশে ছোবলাল।

খরিশ? খরিশ কী, ঝগড়ু?

খরিশ আমাদের সাপ, রমুদিদি, ভারি তার তেজ। মাথায় তার খড়ম আঁকা থাকে।

তারপর লোকটা বোধ হয় মরে গেল?

না, বোগিদাদা, আমরা পাঁচজনা দুমকার ছেলে ছিলাম সাথে, মরবে কেন? তাকে আমরা ওষুধ করে বাঁচিয়ে দিলাম, তবে তাকে কথা দিতে হল আর বন্দুক ধরবে না।

তা কেন ঝগড়ু? তোমরাও তো জানোয়ার মার।

বোগিদাদা, আমরা মারি পেটের জ্বালায় কিংবা প্রাণের তরে। তারপর শোনোই-না, এমনি সময় আমার নাকে এল কী মিষ্টি গন্ধ সে আর কী বলব। বাবুরা এগিয়ে গেল, আমি খুঁজে খুঁজে মরি, দেখি গাছের গোড়ায় মাটি থেকে ফুটে আছে এক গোছা উঁইচাপা। কী তাদের রূপ দিদি, মনে হয় সাদা মোমের তৈরি, তার মধ্যে বেগুনি রঙের চিত্তির করা। আর ভূঁইচাপার পাশে মাটির উপর পড়ে আছে সাপের মাথার মণি।

না, ঝগড়ু, যা-তা বললে হবে না, আমাদের বইতে আছে, সাপের মাথায় মণি হয় না।

সে তো তুমি বললেই হবে না, বোগিদাদা, নিজের চোখে দেখলাম।

কোথায় সে?

আরি বাবা! সাপের মাথায় মণিতে হাত দেব আমি! তুমি কি পাগল হলে? তাহলে উনিই-বা আমাকে ছাড়বেন কেন? যেখানেই লুকোয়-না কেন, ঠিক খুঁজে বের করবেন। না, বোগিদাদা, যেখানকার জিনিস সেইখানেই রেখে ঘরে ফিরে এলাম।

সাপের মাথার মণি কেউ নেয় না, ঝগড়ু?

নেবে না কেন, দিদি? যাদের দেখাশুনো শেষ হয়ে গেছে, তারা নেয়। আমার যে এখনও ঢের বাকি আছে। চলোই-না মেলায়, সেখানে একটু খুঁজে দেখা যাবে।

ততক্ষণে মেলার কাছে ওরা পৌঁছে গেছে। কী নেই ওই মেলায়? বোগি রুমু মাথা উঁচু করে নাক তুলে বুক ভরে মেলার গন্ধ শুকে নিল। সব্বাই তেলেভাজা খাচ্ছে, পাঁপড় খাচ্ছে, আলুকাবলি খাচ্ছে, গোলাপি বাতাসা খাচ্ছে, টানাল্যাবেঞ্চুষ খাচ্ছে।

ঝগড়ু বলল, এদিকটা ঢের ভালো, দিদি, দেখো এই সব ভালো ভালো বাঁশি, আয়না, কাচের পুতুল, দু-আনা করে বিলিয়ে দিচ্ছে। দেখো কেমন কাচের চুড়ি, মোতির মালা, চুলের ফিতে। ছাঁচি পান খাবে? দিদিমা তো পানের কথা কিছু বলেননি—

ঝগড়ু এইরকম বলছে, এমন সময় একটা অদ্ভুত লোক এসে ওদের পাশে দাঁড়াল। বেজায় লম্বা, বেজায় রোগা, হাড়গোড় বের করা, গর্তের মধ্যে চোখঢোকা, তার ঢাকনি পিটপিট করছে, ভুরু নেই, ছককাটা সরু-ঠ্যাং পেন্টেলুন পরা, মাথায় একটা বারান্দাওয়ালা টুপি, বগলে রুপো-বাঁধানো ছড়ি আর একটা থলে, আর দশ আঙুলে দশটা চমৎকার লাল নীল পাথর-বসানো আংটি।

তাকে দেখেই বোগি রুমুকে অন্য পাশে টেনে নিল! তাই দেখে লোকটা সোনা দিয়ে মোড়া, সোনার পেরেক ফোঁটানো লম্বা লম্বা দাঁত বের করে খিকখিক করে হাসতে লাগল।

কোথায় সরাবে ওকে, খোকাবাবু, ইচ্ছে করলেই আমি ওকে এক্ষুনি একটা জোনাকি পোকা বানিয়ে হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আসতে পারি, তা জান? অমনি আমার কত আছে, এই দেখো। বলেই লোকটা হাতের মুঠো খুলে দেখাল, আট-দশটা কালো পোকা কিলবিল করছে।

রুমু বলল, যাও, বাজে কথা, ওগুলো মোটেই জোনাকি পোকা নয়, জোনাকি পোকাঁদের আলো জ্বলে।

লোকটা খুব হাসল। রাতে এদের দেখো খুকি, চোখে তাক লেগে যাবে। সুন্দর জিনিস চেন না? সাদা চোখে কালো কুচ্ছিত, নকল আলোয় চমৎকার।

পোকাগুলোকে লোকটা পকেটে পুরে রাখল।

ওরা মরে যাবে না?

গেলই-বা, এমনি আরও কত পাব।

বোগি রুমু একটু সরে দাঁড়াল। ঝগড়ু, চলো।

লোকটাও একটু ঘেঁষে এসে বলল, ভয় পাচ্ছ?

ঝগড়ু বলল, যাদের সঙ্গে সঙ্গে দুমকার ছেলে রয়েছে, তাদের আবার ভয় কীসের?

লোকটা খুব হাসল। উত্তর মেরুতেও ঘুরে এসেছি, ভয় কোথায় নেই বলতে পার?

ঝগড়ু বুক ফুলিয়ে বলল, দুমকায় ভয়ের জায়গা নেই।

নেই, যাবে আমার সঙ্গে ঘোর রাত্রে তোমাদের মহাশিরীষ গাছের তলায়?

ঝগড়ু বোগি রুমুর হাত ধরে টানতে লাগল, চলো, দিদিমা না অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলতে মানা করেছেন?

তাই শুনে লোকটা হেসেই খুন। কে অচেনা? যে মনের কথা জানতে পারে, তাকে দেখেনি বলেই ব্যস সে অচেনা হয়ে গেল? তোমার সাহস থাকতে পারে, কিন্তু বুদ্ধির বহরটি তো বেশ! তা ছাড়া আমার কাছ থেকে একটা কিছু না কিনে যেতে পাবে না।

না, না, ওদের কাছে বেশি পয়সা নেই, মেলা কেনবার আছে।

লোকটা রুমুকে বলল, ঘুম থেকে উঠে কী খেয়েছিলে, দিদি?

ডিমসেদ্ধ, রুটি, দুধ, কলা।

তারপর দুপুরে?

মাছ-ভাত।

আর আমি কী খেইছি জান? সেই কাল রাত্রে চাট্টিখানিক বকফুল ভাজা। তাও একজনকে ভাঁড়িয়ে, পাঁচটা মিথ্যে কথা বলে। মিথ্যে বলা ভারি খারাপ জান তো? কিনবে কিছু? সেই পয়সা দিয়ে আমি আলুকাবলি কিনে খাব।

ঝগড়ু তখনও বোগি রুমুর হাত ধরে টানছে। রুমু বলল, কই, দেখাও কী আছে?

লোকটা বলল, তিনফলা ছুরি কিনবে? বলেই একটা আশ্চর্য তিনফলা ঝিনুক দিয়ে বাঁধানো ছুরি বের করল।

ঝগড়ু বলল, না, ওতে ধার থাকে না।

তবে কি জাপানি তারের ধাঁধা কিনবে? বলেই একটা চকচকে সোনালি জড়ানোমড়ানো তারের গোছা বের করল।

না, ও দু-দিনে পাকিয়ে যায়।

তাহলে এই সাপের মাথার মণিটা কেনো। বলেই ফস করে থলে থেকে একটা লাল ন্যাকড়ার টুকরো বের করল। তার মধ্যে এই এত্ত বড়ো একটা সাদা পাথর হিরের মতো জ্বলজ্বল করছে, চারদিকে তার পল কাটা, তাতে রোদ পড়ে রামধনুর রং ঠিকরোচ্ছে।

ঝগড়ু চেঁচিয়ে বলল, দেখো রুমুদিদি, ওতে হাত দিলে, ভালো হবে না বলছি।

লোকটা হেসে বলল, কেন, কী হবে?

তাহলে আমি– দুমকা চলে যাব।

না, ঝগড়ু না, সাপের মাথার মণি নেব না। আর কী আছে দেখাও।

লোকটা রুমুর দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে বলল, সাপের মাথার মণি দিতে আমারও একটু আপত্তি ছিল, খুকি, নেহাত তুমি বলেই দিচ্ছিলাম। তা ভালোই হল, কলজের জিনিস কি আর অন্য লোকের হাতে তুলে দিতে হয়? তবে তুমি কি বাক্সের ভিতর বাক্সের ভিতর বাক্সের ভিতর আশ্চর্য জিনিস নেবে? বলে একটা কাঠের বাক্স বের করল। এতটুকু, রমুর হাতের মুঠির সমান হবে। চীনে কারিগররা ছাড়া এ জিনিস বড়ো-একটা কেউ করে না, খুকি। এই দেখো কেমন ডিমের খোলার মতো পাতলা বাক্সের গা।

একটার ভিতর–একটার ভিতর একটা করে দশটা বাক্স বেরুল। শেষেরটার মুখ এঁটে রয়েছে, ঝাঁকালে ভিতরে কী নড়ে।

নখের কোনা দিয়ে খুঁটে লোকটা সে বাক্সটাও খুলে ফেলল। ভিতরে একটা লম্বা লাল বিচি, অনেকটা নিমের বিচির মতো, কিন্তু অনেক বড়। পালিশ করা চকচক করছে, এক কোনায় একটা সাদা চোখের মতো।

কী ওটা?

ওইখান দিয়ে ওর শেকড় গজাবে, দিদি। পৃথিবীতে এ-রকম গাছ আর একটাও পাবে না খুঁজে। পুঁতবে কিন্তু ছাইয়ের গাদায় কী আস্তাকুঁড়ে। ফুল যখন ধরবে দেখবে কোথায় লাগে পারিজাত। ভালো জায়গায় লাগালে ফুল ধরবে না কিন্তু।

ঝগড়ুর বোধ হয় একটু রাগ হয়েছিল, দূর থেকে টাকাটা ফেলে দিয়ে, ওদের টেনে নিয়ে চলল। প্রায় দৌড়ে চলল ঝগড়ু।

লোকটা গোড়ালি ঠুকে একটা সেলাম ঠুকল।

রুমু বলল, রাগ করলে, ঝগড়ু?

ঝগড়ু, ওদের হাত ছেড়ে দিয়ে, আস্তে আস্তে চলতে লাগল। না, দিদি রাগ করিনি। মাঝে মাঝে মনটা কেমন করে ওঠে। রাগ করিনি। ও গাছ হল গিয়ে মানুষের মনের গুণের মতো, কষ্ট না পেলে ফুটে ওঠে না। ওর নাম দিয়ো গুণমণি। আমাদের রান্নাঘরের পাশে ছাইগাদার মধ্যে পুঁতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *