০৮. তারপর ঘরের মধ্যে ঢুকে

তারপর ঘরের মধ্যে ঢুকে তো সব যে যার ধুপধাপ তক্তাপোশের ওপর শুয়ে পড়ে, আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে একসঙ্গে বলতে লাগলেন, ইস্! গাল টিপলে এখনও দুধ বেরোয়, অথচ এত বড়ো আরেকটা খুনে বদমায়েশ দুনিয়াতে আছে কি না সন্দেহ! তিন-তিনটে লোককে রাতারাতি একেবারে হাওয়া করে দিল মশায়!

বিরিঞ্চিদার পিসেমশাই একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, সব থেকে খারাপ হচ্ছে যে বিরিঞ্চি হতভাগা আমার সিল্কের জামাটা গায়ে দিয়েই

সেজোদাদামশাই বললেন, স-স-স– ওঁদের বিষয় অমন করে বলতে নেই। যা হবার তা হয়ে গিয়েছে। এখন ইন্সপেক্টর সায়েবের কর্তব্য হল এই ছোকরাকে জেরা করে সব কথা বের করে নেওয়া।

এতক্ষণ রোগা ভদ্রলোক, পুলিশরা আর আমি হাঁ করে তাঁদের কথাবার্তা শুনছিলাম, কিন্তু কিছুতে যোগ দিচ্ছিলাম না। এবার সবাই মিলে একসঙ্গে কথা বলতে লাগলাম।

ইন্সপেক্টর আমার দুই কাঁধে হাত রেখে বলল, বনা বাবা কী করেছিস? মালার কথা নিশ্চয় তোর অজানা নেই, বল-না, নিদেন মালাটাই বের করে দে না। কথা দিচ্ছি তোকে ছেড়ে দেব, কেউ তোকে কিছু করবে না, দে দিকি বাপ মালাটা বের করে।

মহা মুশকিলে পড়ে গেলাম। আমি বেচারা ছেলেমানুষ, কিছুই জানিনে, অথচ কে কাকে বোঝায়! ভাবলাম দেখাই যাক একবার স্নানের ঘরে গিয়ে।

আমাকে উঠতে দেখে ওরাও উঠে পড়ল। স্নানের ঘরে ঢুকে ইগল পাখির মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে ঘরের প্রত্যেকটা ইঞ্চি পরীক্ষা করলাম। দেখলাম ওই একটিমাত্র দরজা, উঁচুতে ওই একটিমাত্র শিক-দেওয়া জানলা। তাই তো, ঠানদিদিদের হল কী?

অন্যরা সবাই এগিয়ে এসে, দরজার কাছটিতে ভিড় করে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। নীচের তলা থেকে রাঁধাবাড়া ফেলে বুড়িও ততক্ষণে এসে ওদের সঙ্গে জুটেছে দেখলাম!

ওরা তাকে খুব জোরে ফিসফিস করে বলল, চুপ! এ এবার মালা বের করে দেবে, সেই তাদের যা বাকি আছে বের করে দেবে।

তাই শুনে বুড়িও চোখ গোল করে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকল!

হঠাৎ দেখলাম ঘরের কোণে, বালতির পিছনে একটা জিনিস চিকচিক করছে। অবাক হয়ে দেখলাম ছোট্ট একটা সোনার আংটি! আমাকে সেদিকে চাইতে দেখে ওরাও সবাই ঘরের কোণে, বালতির পেছনে, সোনার আংটি দেখতে পেল।

সেজোদাদামশাইও চিৎকার করে উঠলেন, চিনেছি, চিনেছি! তবু বলছিস কিছু জানি নে! লক্ষ্মীছাড়া মিথ্যেবাদী। এমনি করেই পাপের গন্ধমাদন চাপা পড়ে মানুষেরা মরে-চ্যাপটা হয়ে যায়।

ইন্সপেক্টরবাবু হঠাৎ আমার দিকে ফিরতেই আমি এক ছুটে স্নানের ঘরের ঠিক মাঝখানে চলে গেলাম। সঙ্গেসঙ্গে মনে হল আমার পায়ের তলা থেকে মাটিটা সরে গেল, আমি অতল গভীর অন্ধকারে পড়ে গেলাম।

ওপর থেকে হো-হো করে চিৎকার আমার কানে এল।

কী আর বলব আমার মনের অবস্থা। পড়তে আর কতটুকুই-বা সময় লাগল, তবু মনে হল পড়ছি তো পড়ছিই।

ছেলেবেলা থেকে আজ অবধি যত অন্যায় করেছি, একটার পর একটা করে সব মনে পড়তে লাগল। যেগুলোর কথা একদম ভুলে গেছলাম, এমনকী যেসব ঘটনা কোনোকালে ঘটেইনি, সেরকমও রাশি রাশি মনে পড়ে গেল!

হঠাৎ ধপাস করে মাটি ছুঁলাম।

বুঝলাম কতকগুলো খড়কুটোর ওপর পড়েছি তাই যতটা লাগতে পারত, পেছনে ততটা লাগেনি।

তবু খানিকক্ষণ চোখ বুজে চুপচাপ বসে থাকলাম। তারপর যখন টেন পেলাম যে সত্যি বেঁচে আছি, তখন আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখলাম যে যতটা অন্ধকার ভেবেছিলাম, আসলে ততটা নয়।

দেখলাম যেন একটা শুকনো কুয়োর মতনের নীচে পড়ে আছি। পকেট চাপড়ে দেখলাম চিরুনি-টিরুনি ঠিকই আছে। বাঁচা গেল।

ওপর দিকে চেয়ে দেখলাম অন্ধকার সুড়ঙ্গ, চারিদিকে ঘিরে আছে মাকড়সার জালে-ঢাকা পাথরের দেয়াল, নাকে এল সোঁদা সোঁদা একটা গন্ধ আর দেখলাম দেওয়ালের এক দিক দিয়ে একটু আলোর রেখা আসছে।

সেই আলোতেই দেখতে পেলাম খড়ের ওপর জ্বলজ্বল করছে বিরিঞ্চিদার মুক্তোর মালা। মালাগাছি তুলে নিলাম, মাঝখানের রঙিন পাথরটি মিটমিট করে জ্বলতে লাগল।

বসে বসে ভাবলাম কী মালা, কার মালা কে জানে। এই কি তবে জমিদার গিন্নির হারানো মালা? তবে আগেকার সেই আরেকটা মালা সেটি কোত্থেকে এল? এ তো সে মালা হতেই পারে না। কারণ সেটাকে আমি ছাড়া আর কেউ তো বের করতে পারবেই না, আমিও পারব কি না সন্দেহ।

মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। মালাটা পকেটে পুরে ফেললাম। বিরিঞ্চিাদের নিশ্চয় সাংঘাতিক কোনো বিপদ হয়েছে, নইলে কি আর মালা ফেলে অমনি অমনি চলে যায়।

ভাবলাম এই সুড়ঙ্গ দিয়ে ধুপধাপ করে, এক জনের উপর এক জন ওরাও নিশ্চয় পড়েছিল। ওরা যখন বেরুবার পথ পেয়েছে আমিও পাব।

ভালো করে চেয়ে দেখলাম কোথা দিয়ে আলোর রেখা আসছে। মনে হল সেদিকে যেন সরু পথ রয়েছে।

কত কালের পুরোনো বাড়ি, কে জানে কেন এই গোপন সুড়ঙ্গ বানিয়েছিল, হয়তো কোনো চোরাকারবার চালাত কেউ, তাই এইসব গলিঘুচি তৈরি করে রেখেছিল। হয়তো শব্দুরদের ধরে এনে এখানে শেকল দিয়ে বেঁধে রেখে দিত। গা শিরশির করতে লাগল।

অদ্ভুত সেই গলিটা। কে জানে কারা এখান দিয়ে ভারী ভারী বাক্স প্যাটরাতে লাখ লাখ টাকার মোহর বোঝাই করে আনাগোনা করত। ইস, একটা বাক্সও যদি পেতাম, তবে আর আমাকে এত কষ্ট করে লেখাপড়া শিখতে হত না।

দেখলাম দু-পাশে তাক আছে, জিনিস ঝোলাবার আংটা কড়া আছে। মনে হল হঠাৎ যদি দেখি একটা কঙ্কাল ঝুলে আছে। বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল।

অবিশ্যি একদিক দিয়ে দেখতে গেলে, ওপরকার ওই ঘরের চাইতে আমার পক্ষে এই অন্ধকার ঘুপচিই অনেক বেশি নিরাপদ, তবু যদি হঠাৎ মাথার ওপর থেকে দড়ি ছিঁড়ে ঘাড়ের ওপর কিছু পড়ে।

তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলাম। মনে হল ওপরে যেন ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কীসের যেন হাওয়া মুখে লাগল, অদ্ভুত একটা গন্ধ নাকে এল। মনে মনে বললাম, ও কিছু না, বাদুড়। আরও তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলাম।

এখানে পথটা খানিক ঢালু হয়ে নীচের দিকে নেমে গেছে। পায়ের তলার মাটি এত নরম যে কিছুমাত্র শব্দ হয় না।

ওপর থেকে টপ টপ করে ফোঁটা ফোঁটা কী যেন আমার মাথায় পড়ল। সে সাদা কি লাল তা আর দেখবার উপায় ছিল না ওই অন্ধকারে।

খানিক আগেই এই পথ দিয়ে বিরিঞ্চিদা, শ্যামাদাসকাকা আর ঠানদিদি নিশ্চয় ভয়ে আধমরা হয়ে, এক জনের পেছনে এক জন হেঁটে গেছেন। কোথাও যখন কেউ পড়ে-উড়ে নেই, তখন নিশ্চয় কোনো ভয়ের কারণও নেই।

বলতে-না-বলতে নরম কীসে হোঁচট খেয়ে উবু হয়ে পড়ে গেলাম। অন্ধকারটা যেন আরও কালো হয়ে ঘনিয়ে এল। তখনও মনে হচ্ছিল দূরে একটা হো-হো শব্দ।

নড়ছি-চড়ছি না, কাঠ হয়ে নরম জিনিসটার ওপর পড়ে আছি। কান খাড়া করে রেখেছি সেটার নিশ্বাস ফেলার শব্দের জন্য। কিন্তু যদি নিশ্বাস না-ই ফেলে?

উঠে বসলাম। কানে একটা থুপ-থুপ পায়ের শব্দ। ঘন ঘন নিশ্বাস। তবে কি শেষপর্যন্ত ওদের নাগাল পেয়ে গেলাম নাকি?

কিন্তু শব্দটাকে যেন একটু অস্বাভাবিক ঠেকল। যেন ভারী কিছু সাবধানে এগুচ্ছে। বুকের ভেতরটা আবার ছ্যাঁৎ করে উঠল।

উঠে বসে অন্ধকার ভেদ করে দেখতে চেষ্টা করলাম। খানিকক্ষণ কিছু বুঝতে পারলাম না। তারপর দূরে দেখলাম দুটো লাল চোখ জ্বলজ্বল করছে, আর নাকে এল কেমন একটা চেনা চেনা অদ্ভুত গন্ধ।

আমি আর সেখানে বসে থাকবার ছেলেই নই। উঠেই দিলাম টেনে দৌড়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *