তপনের মনের গঠন হয়তো কিছু অদ্ভুত। সে কোনদিন কাহাকেও আঘাত করে না—এমন ক আঘাতের প্রতিঘাত করে না। ইচ্ছা করিলে তপতীকে সে আঘাত করিয়া চূর্ণ করিয়া দতে পারিত, কিন্তু কাহাকেও আঘাত দিয়া কিম্বা জোর করিয়া ভালবাসা আদায় করিবার লোক তপন নহে। সে আপনাকে পরিপূর্ণ মনুষ্যত্বের মধ্যে বিকশিত করিতে চায়-ইহাই তাহার সাধনা। তাহার বিষয়-বৈরাগী মন শুধু চাহিয়াছিল একজন সাথী, যাহাকে সে জীবনের পথে দোসর ভাবিতে পারে। কিন্তু অদৃষ্ট তাহার অন্যরূপ। দুঃখ সে পাইয়াছে, কন্তু সে-দুঃখ সহিবার শক্তিও তাহার আছে।
আজ রিক্ত সর্বস্ব হইয়া মন প্রসারিত হইয়া পড়িল জনকল্যাণের বিপুলায়তনে। মুক্তির মধ্যে সে খুঁজিয়া পাইল বন্ধনের ইঙ্গিত। সকালে খাইতে বসিয়া তপন কহিল,—আমি একুশে শ্রাবণ একটু মাদ্রাজের ওদিকে যাব, মা, কন্যাকুমারিকা তীর্থের দিকেও যেতে হবে।
–মাদ্রাজ?–অতদূরে তোমার কি কাজ, বাবা? মা ম্লানমুখে প্রশ্ন করিলেন।
তপন হাসিয়া বলিল,–দূর আর কোথায় মা? তারপর একটু থামিয়াই বলল,–
সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী
রেখেছো বাঙালী করে মানুষ করোনি!
তপতী চা খাইতেছিল। কথাটা সে শুনিয়া কিছু উন্মনা হইলা পড়িল।
–কতদিন দেরী করবে, বাবা? মা সাগ্রহে প্রশ্ন করিলেন।
–দেরী একটু হবে বইকি, মাকাজটা শেষ করবো তবে তো?
আর কোনো কথা না বলিয়া তপন চা-পান শেষ করিল—এবং উঠিয়া বাহিরে চলিয়া গেল।
তপতী একটু ইতস্তত করিয়া মাকে জিজ্ঞাসা করিল,—ও মুখ্য মানুষ, মাদ্রাজে গিয়ে কি করবে, মা? আমাদের অফিসের কাজ কিছু?
–কি করে জানবো, বাছা, তুই তো জিজ্ঞেস করলেই পারিস। আর মুখ ও মোটেই নয়, এটা এতদিনেও বুঝতে পারলিনে তুই। তোর বাবা ওর কাজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
তপতী চুপ করিয়া রইল। মা বিরক্ত হইয়াছেন। আর কোন কথা না বলাই উচিত। তপন যে মূর্খ নয় ইহা তপতীও জানে, আর জানে, মাদ্রাজ যাওয়ার অছিলায় আরো কিছু টাকা তপন বাগাইবে। তা নিক টাকা তাহার বাবার যথেষ্ট আছে, তপন তো সকলেরই মালিক হইবে একদিন, কিম্বা হয়তো সত্যই কোনো কাজ আছে। কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া তপতী কহিল–আমায় আজ একটু বেড়াতে নিয়ে যেতে বোললা, মা! আমি বললে ও এড়িয়ে যায়।
মা হাসিয়া বলিলেন,—আচ্ছা বলল দেবো। কিন্তু এড়িয়ে যেতে দিস কেন তুই?
উত্তর না দিয়া তপতী আসিল আপন ঘরে। বিকালে সে আজ তপনকে লইয়া বেড়াইতে যাইবে—দেখিবে তাহার অন্তরে তপতীর স্থান কোথায়। বৈকালিক জলযোগের জন্য তপন আসিবার পূর্বেই তপতী রক্তাম্বরা হইয়া অপেক্ষা করিতেছিল। তপন আসিতেই মা তাহাকে বেড়াইতে যাইবার জন্য বলিলেন,–খুকী বললে তুমি নাকি এড়িয়ে যাও বাবা—তাই আমাকে দিয়ে বলাচ্ছে।
—আচ্ছা মা যাচ্ছি। আমার কাজ থাকে, দুএকদিন আগে বললে সময় করে রাখি।
তপন গিয়া গাড়ীতে বসিল-তপতী আসিয়া বসিল পাশে। গাড়ী চলিতেছে। নির্বাক চোখের ঠুলিটার মধ্য দিয়া সোজা সামনের রাস্তায় দৃষ্টি প্রসারিত করিয়া দিয়াছে বামে যে একটা সুসজ্জিতা নারী অপেক্ষা করিতেছে, তাহার অস্তিত্বও যেন তপন ভুলিয়া গিয়াছে। তপতী উসখুস করিতে লাগিল। সোজা কোনো কথা জিজ্ঞেসা করিতেও তাহার বাধিতেছে, কথাই-বা কহিবে কিরূপে। যাহাকে সে অপমানে, আঘাতে বিদলিত করিয়া দিয়াছে, তাহার সহিত এভাবে বেড়াইতে আসাই তো চরম নির্লজ্জতা! কিন্তু তপন তো আসিল, এতটুকু অসম্মতি জানাইল না? অন্যদিনও সে আসিবে তাহার স্বীকৃতি ছিল—অথচ কোনো কথা বলে না কেন! বাঁ দিকে একটা রাস্তা চলিয়া গিয়াছে। তপতী আপনার ডান হাতটা তপনের দুই হাতের ফাঁকে চালাইয়া দিয়া স্টিয়ারিংটা ঘুরাইয়া দিতে দিতে বলিল,—এই দিকে যাবো–
অকস্মাৎ বাধাপ্রাপ্ত গাড়ীটার ঝোক সামলাইয়া লইয়া তপতীর নির্দেশমতো পথেই তপন গাড়ী চালাইল। একটু দূরে কয়েকজন কলেজের মেয়ে বেড়াইতেছে, স্থানটা বেশ ফাঁকা।
তপতী বলিল,–এখানেই নামা যাক একটু—কেমন?
তপন গাড়ী থামাইল। নিজে নামিয়া তপতী ভাবিল, তপনও নিশ্চয় নামিবে; কিন্তু তপন গাড়ীতেই বসিয়া আছে মাথা নিচু করিয়া। তপতীর কেমন লজ্জা করিতে লাগিল তপনকে সঙ্গে আসিতে বলিতে। সে খানিকটা চলিয়া গেল, কিন্তু কি ভাবিয়া ফিরিয়া আসিয়া বলিল,একা যাবো নাকি?
তপন নিঃশব্দে নামিয়া তাহার অনুগমন করিতেছে। তপতী যা-হোক একটা কিছু বলিবার জন্যই যেন বলিয়া উঠিল,—ঐগুলো বুঝি গাংচিল? নয়?
–হ্যাঁ–বলিয়াই তপন নীরব রইল।
এই নিষ্ঠুর ঔদাসিন্য তপতীর অসহ্য বোধ হইতেছে। তাহার কলকাকলির স্রোত রুদ্ধ হইয়া গিয়াছে যেন। তনকে কথা কহিবার অধিকার দেওয়ার পরও তাহার এতটা নীরবতা হেতু কী! তপতী আবার বলিল,–ঐ নৌকোটা কোথায় যাচ্ছে?
—তা তো জানিনে।
তপন কি প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা একটিও বলিবে না? নৌকোটা কোথায় কোন চুলোয় যাইতেছে, কে তাহা জানিতে চায়! তপন কেন বোঝে না?–মানুষের যাত্রাপথও এমনি—কোথায় যাবে জানে না–তপতী পুনর্বার হাসিমুখেই বলিল।
তপন কোনোই উত্তর দিল না। নিঃশব্দে হাঁটিতে লাগিল। তপতী ক্রমশ উত্তপ্ত হইয়া উঠিতেছে। কথাই যদি না বলে তো সঙ্গে বেড়াইবে কিরূপে! কিন্তু হয়তো তপন এখনও বাগিয়া আছে। অপমানটা তত কম হয় নাই! তপতী কথার মোড় ঘুরাইবার জন্য সোজা প্রশ্ন করিল, মাদ্রাজে কদিন দেরী হবে?
ঠিক বলতে পারিনে–মাস দুই তো নিশ্চয়ই।
দুমাস! এতদিন কি করিবে সে? কিন্তু প্রশ্ন করিলে যদি তপন ভাবে তাহার কর্মের অযোগ্যতা লইয়া তপতী ব্যঙ্গ করিতেছে। তপতী আর প্রশ্ন করিল না। কিন্তু তপনের রাগ করার প্রমাণ সে পাইতেছে না। কী কথা আরম্ভ করিবে তপতী? কিছুক্ষণ ভাবিয়া প্রশ্ন করিল,–জামাকাপড়গুলো তো আর একটু ভালো করলেই হয়?
তপন মৃদুস্বরেই উত্তর দিল,—জীবনে অনেক কিছু না পেয়ে প্রাপ্ত বস্তুর উপরও আর শ্রদ্ধা নেই!
তপতী রাগিয়া উঠিল, ভণ্ডামীর আর জায়গা নেই যেন! কিন্তু রাগ চাপিয়াই হাসিয়া বলিল,–ওঃ বুদ্ধদেব! ত্যাগ শেখা হচ্ছে?—তপতীর কণ্ঠে সুস্পষ্ট ব্যাঙ্গের সুর ধ্বনিয়া উঠিল।
বিস্ময়ের সুরে তপন কহিল,–বুদ্ধদেব তো কিছু ত্যাগ করেননি। তিনি তার পিতার ক্ষুদ্র রাজ্য ছেড়ে অগণ্য মানবের হৃদয়-সিংহাসনে রাজ্য বিস্তার করেছেন। ত্যাগ কোথায়?
বিমূঢ় তপতী কিছুক্ষণ স্তব্ধ রহিল তপনের দিকে তারপর বলিল—ত্যাগ তবে কাকে বলে?
ত্যাগ বলে কোনো বস্তু তো নেই। আমরা যাকে ত্যাগ বলি, সেটার মানে এড়িয়ে যাওয়া। আর সত্যকার ত্যাগ মানে বন্দীত্ব থেকে মুক্তি অর্থাৎ বিস্তার, ক্ষুদ্র থেকে বৃহতে, লঘিষ্ট থেকে গরীয়ানে।
তপতীর বিস্ময় বাড়িয়া উঠিতেছে। প্রতি কথায় তপনের মুখ হইতে একি বাণী ঝঙ্কারিয়া উঠে! তপতী এতটা পড়িয়াছে—এমন করিয়া তো ভাবে নাই। এই লোক কি মূর্খ হইতে পারে? অশিক্ষিত হইতে পারে? তপতী আরো কি কথা বলিবে ভাবিতেছে।
কয়েকটি কলেজের মেয়ে আসিয়া তপতীকে নমস্কার জানাইয়া বলিল,—ভাল তো মিস চ্যাটার্জি।
তপনের সম্মুখে সে তাহাকে মিস বলিয়া সম্বােধন করায় তপতীর লজ্জা করিতে লাগিল, কিন্তু আরো কিছু অঘটন ঘটিবার আশঙ্কায় সেতাড়াতাড়ি—ভালোই আছিবলিয়া দূরে চলিয়া যাইতে চায়।
একটি মেয়ে তপনকে লক্ষ্য করিয়া, হাসিয়া প্রশ্ন করিল,–আপনার সঙ্গীর পরিচয়টা।
তপতীকে কিছু বলিবার জন্য ইতত করিতে দেখিয়া তপন কহিল-আমি সামান্য ব্যক্তি, নাম তপনজ্যোতি।
মেয়েটি হাসিয়া বলিল,–তপন মানে সূর্য-উনি কিন্তু বরাবর বড়লোক; কখনও সামান্য নন।
—আমি বড়লোক? কিসে বুঝলেন?
—ঠিক বুঝেছি। যে প্রকাণ্ড গাড়ীখানা!
—গাড়ী দেখেই বুঝি আপনারা বড়লোক ঠাওরান? আমরা, ছেলেরাও তাই শাড়ী দেখে বড়লোক ভাবি?
—ছেলেরা কিন্তু ভুল করে। কারণ, বাড়ী আর গাড়ীতে পয়সা লাগে—শাড়ীর দাম আর কত?
-ছেলেরা মেয়েদের সম্বন্ধে বরাবর ভুলই করে থাকে—কথাটা বলিয়া তপন নিঃশব্দে হাসিল।
—কেন? আপনি কিছু ভুল করেছেন নাকি মেয়েটি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে কথাটা বলিল।
–না–আমি মেয়েদের এড়িয়ে চলি যথাসম্ভব।
—ভয় করে বুঝি?
–আগে করতো। এখন টিকা নিয়ে ফেলেছিবসন্ত আর হবে না।–মেয়েরা বুঝি আপনার কাছে বসন্ত।
—মারীভয়! তাকে কে ভয় না করে বলুন? প্রমাণ তো ইতিহাসে যথেষ্ট রয়েছে ট্রয়ের ধ্বংস, লঙ্কার দহন।
-কিন্তু ভালোও তো বাসেন দেখছি!
–বাসি। মানুষ যাকে ভয় করে, তাকে ভালোও বাসে। প্রমাণ ভূত। ভূতকে ভয় করি বলেই তার গল্প অবধি শুনতে ভালবাসি আমরা। কিন্তু ভূতকে এড়িয়ে যেতে চাই।
আপনার যুক্তি কাটাতে না পারলেও কথাটা ঠিক মেনে নিতে পারছিনে।
–আমি নিরুপায় বলিয়া তপন নমস্কার জানাইল।
অতি সাধারণ কথাতেও তপন যথেষ্ট দক্ষতা দেখাইতে পারে, তপতী আজই প্রথম তপনকে লইয়া বেড়াইতে আসিয়াছে; দেখিল, সুশিক্ষিত কলেজের মেয়েদের সহিত আলাপে তপনের কোথাও জড়তা নাই। কেন তপতী এতদিন উহাকে লইয়া বেড়াইতে আসে নাই? তপনকে লইয়া তো তাহাকে অপদস্থ হইতে হইত না।
মোটরে গিয়া তপতী চালকের আসনে বসিল। সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখিদল কুলায ফরিতেছে। তপন সেই দিকে চাহিয়া আপন জীবনের কথা ভাবিতেছে—আর তপতী ভাবিতেছে উহার সহিত ভাব করিবার কী কৌশল আবিষ্কার করা যায়। হঠাৎ তপতী ব্রেক কসিয়া থামাইয়া দিল। নির্জন নিস্তব্ধ পথের দুধারে ফুটিয়া আছে অজস্র বন্য কুসুম—তপতী নামিয়া তাহাই কতকগুলি তুলিয়া লইল আঁচলে। একটা পুষ্পিত শাখা ছিঁড়িয়া তপনের গায়ে মৃদু আঘাত করিয়া বলিল,—আপনি চালান, আমি ফুল পরবো—তপতী উঠিতেই তপন নিঃশব্দে চালকের আসনে সরিয়া গিয়া গাড়ী ছাড়িয়া দিল।
এই নিতান্ত নির্লিপ্ততা তপতীর অন্তরকে জাগ্রত করিতেছে। তাহার আধুনিক মন ভাবিতেছিল ফুলগুলি তপন স্বহস্তে তাহাকে পরাইয়া দিবে, কিন্তু ও তপতীর সহিত অসহযোগ আরম্ভ করিল নাকি? তপতী বার বার চাহিয়া দেখিল–তপন অনড়–দৃষ্টি সম্মুখের দিকে হইতে একচুল নড়ে নাই। আপনার সুদীর্ঘ বেণীতে পুষ্পগুচ্ছ জিয়া তপতী বেণীটাকে এমনভাবে ফেলিয়া দিল যাহাতে তপনের বাম বাহুতে উহা পড়িতে পারে। তপন নির্বিকার। তপতী অসহিষ্ণু হইয়া উঠিতেছে। এই কঠিন পাষাণ-মূর্তিকে লইয়া সে করিবে কি? রাগই যদি তপনের হইয়া থাকে, তবে না-হয় দুচার কথা শুনাইয়া দিক-তপতী সহ্য করিবে। কিন্তু এই নীরবতা একান্ত অসহ্য। তপতী ঝাঁজিয়া বলিয়া উঠিল,কথা তো ভালোই বলতে পারেন চুপ করে কেন আছেন এখন।
–কথা না বলেও তো অনেক কথা বলা যায়—যেমন কথা বলে ঐ পুষ্পিত শাখা—
কিন্তু আমি শাখা নই, আমি মানুষ কথা বলবার জন্য আমার ভাষা আছে। আর ভাষাকে সুন্দর করবার জন্য আমি অনেক তপস্যা করেছি–
—আমার মৌনতাকে আমি সুন্দর করতে চাই—তাই হোক আমার তপস্যা।
—অর্থাৎ আমি যা চাই তার উল্টোটা, কেমন? চমৎকার।
তপন চুপ করিয়া রহিল। দিকে দিকে সন্ধ্যার মিন্ধ সুষমা গান গাহিয়া উঠিতেছে মৌন মহিমায়। মৌনতার এই সুগভীর সৌন্দৰ্য্য একান্ত প্রিয়জনের সান্নিধ্যেই যেন অনুভব করা যায়। তপতী অনেকক্ষণ ভাবিয়া বলিল,কাল আসতে হবে বেড়াতে, বুঝলেন? পালাবেন না যেন?
–কাল আমার বোনের বাড়ি যাবো, আসতে পারবো না।
তপতী বারুদের মতো জ্বলিয়া উঠিল। ঐ বোনটাই তপতীর সর্বনাশ করিতেছে। কোনরূপে ক্রোধ দমন করিয়া সে কহিল–আমি যাবো নিয়ে যাবেন আমায়? আমি দেখতে চাই, তার সঙ্গে আপনার সত্যিকার সম্পর্কটা কী।
তপন সজোরে গাড়ীটার ব্রেক কষিয়া থামাইয়া দিল। তপতী লাফাইয়া উঠিল স্প্রিংএর গদিতে। তপন ধীরে শান্ত স্বরে কহিল,তার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা যাই হোক, মিস্ চ্যাটার্জি আপনার তাতে কিছুই যাবে আসবে না। অনর্থক আঘাত করায় কি আপনার লাভ হচ্ছে? আমার সঙ্গে সব সম্পর্কই তো আপনি ছিন্ন করেছেন। আজ আবার বলছি—আপনি মুক্ত, আপনি স্বতন্ত্র, আপনি স্বাধীন! আপনার উপর কোন দাবী আর রাখিনে। আশা করি, আপনিও আমার উপর রাখবেন না।
তপন তীরবেগে গাড়ীটা চালাইয়া দিল। তপতী বসিয়া রহিল বাক্যহারা ব্রততীর মতো।
বাড়ির প্রায় কাছাকাছি আসিয়া তপতী হঠাৎ বলিল, সত্যি তাহলে আপনি আমাকে মুক্তি দিয়াছেন?
-হ্যাঁ। আমি আপনার জীবন থেকে অস্ত গিয়েছি।
—অস্ত-সূর্যটি কিন্তু প্রতি সকালে উদিত হন—তপতীর ব্যঙ্গ তীক্ষ্ম হইয়া উঠিল।
—তার জন্য থাকে রাত্রির সুদীর্ঘ সাধনা—ধীরে উত্তর দিল তপন।
—ভালো! রাত্রি সাধনাই করবে!—তপতী আবার বিদ্রূপ করিল।
-আমি কিন্তু সূর্য নই। আমি দূর নীহারিকাপুঞ্জের এক নগণ্য নক্ষত্র, অস্ত গেলে বহু শতাব্দীর পরেও পুনরুদয়ের সম্ভাবনা কম থাকে।…
গাড়ী বাড়ি পৌঁছিল। তপন দরজা খুলিয়া তপতীর নামিবার পথ করিয়া দিল এবং সে নামিয়া গেলে নিজেও ধীরে ধীরে আপনার ঘরে প্রবেশ করিল।
সমস্ত রাত্রিটাই দুশ্চিন্তায় কাটিয়া গেল তপতীর। চিন্তার পর চিন্তার তরঙ্গ যেন আছড়াইয়া পড়িতেছে তাহার মনের উপকুলে। তপনের সহিত তাহার এই কয়মাসের ব্যবহার স্মৃতিসাগর মথিত করিয়া তপতী কুড়াইয়া ফিরিতেছে—কিন্তু যতদূর দৃষ্টি যায়, যাহা কিছু দেখে, সর্বত্রই তপন নির্বিকার, নির্দোষ সে না হইতে পারে কিন্তু নির্লিপ্ততা সে অক্ষুন্ন রাখিয়াছে! তপতীর বারম্বার অসম্মানের আঘাতেও তপন অবিচল রহিয়া গিয়াছে—আর আজ সেই আঘাতগুলিই তপতীর অপরিসীম লজ্জার কারণ হইয়া দাঁড়াইল।
তপন তাহাকে মুক্তি দিয়াছে? সত্যিই কি সে আজ তপনের সহিত বিবাহ বন্ধন হইতে মুক্ত? বেশ ভালো কথাই তো। কিন্তু কেন যেন আনন্দ.আসিতেছে না। এতদিন যে লোকটিকে কেন্দ্র করিয়া তপতী তাহার দুঃখের বিলাসকুঞ্জ রচনা করিতেছিল, আজ যেন সে কুঞ্জ সমূলে ধ্বসিয়া গিয়াছে। অবাধ অসীম বিস্তারের মধ্যে আজ তপতী যাহাকে ইচ্ছা গ্রহণ করিতে পারে—তপন আর কিছুই বলিবে না। সে বলিয়াছে—তপতীর উপর তাহার আর কোনো দাবী নাই। নিতান্ত নিস্পৃহের ন্যায় সহজ সুরেই তপন আজ কথা কয়টা বলিয়াছে। সত্যই কি তাহাকে মুক্তি দিয়াছে তপন? হ্যাঁ দিয়াছে। তপতী মুক্তি চাহিয়াছিল—শুধু চাহিয়াছিলই নয়, মিঃ ব্যানার্জির কাধে মাথা রাখিয়া তপনকে নিঃসংশয়ে বুঝাইয়া দিয়াছিল, তাহাকে সে চাহে না—তাহাকে সে গ্রাহ্য করে না। এতদিনের এত আঘাতেও যে তপন এতটুকু বিচলিত হয় নাই, সেদিন সেই তপন শরাহত মৃগশিশুর মতো কাদিয়াছে,—অজস্র উদ্বেলিত অশ্রুধারায় প্রক্ষালিত করিয়া দিয়াছে তাহার পূজার বেদীমূল, আর তপতী নির্লিপ্ত নিষ্ঠুরতায় সে কান্না দেখিয়াছে—বিদ্রূপ করিয়াছে, বিরক্ত হইয়াছে।
তপনকে আজ বলিবার মত তপতীর আর কি থাকিতে পারে? হয়তো ক্ষমা চাহিবার অধিকারটুকুও তাহার লুপ্ত হইয়া গেছে। হাঁ, তপতী আজ সত্যই মুক্ত, স্বাধীন, স্বাতন্ত্র। কিন্তু তপন আজও রহিয়াছে কেন? সুদীর্ঘকাল বারম্বার অপমান সহ্য করিয়াও যে-লোক এ গৃহ ত্যাগ করে নাই, সে নিশ্চয়ই এত সহজে তপতীকে ত্যাগ করিবে না। না-না-না-তপতী বৃথাই ভাবিয়া মরিতেছে।
আশ্বস্ত হইয়া তপতী খানিকটা ঝিমাইয়া লইল। তপনের চলিয়া যাওয়াটা তাহার পক্ষে কত বড় ক্ষতি ইহা সে ঠিক বুঝিতে পারিতেছে না; কিন্তু তাহার থাকায় যে কিছু লাভ আছে; ইহা যেন তপতীর আজ বার বার মনে হইতেছে মাবাবা উহাকে স্নেহ করেন সে নিশ্চয়ই এই বাড়িতেই থাকিবে। আপাতত তপতীকে ভয় দেখাইবার জন্য বলিয়াছে—মুক্তি দিলাম। মুক্তি অত সহজ কিনা? এ-তো আর চার টাকায়-কেনা পাখি নয়! আর যদিই বা মুক্তি দেয় তো ক্ষতিটা কি? তপতী উহার জন্য কাঁদিয়া মরিয়া যাইবে না। বাড়িতে আছে, থাক—আরো কিছু টাকা লইতে চায়, লউক! তপতী উহাকে আর বিরক্ত করিবে না। দুজনেই তাহারা আজ হইতে স্বাধীনভাবে চলিবে।
তপতী হাসিয়া ফেলিল। তপন তো তাহার স্বাধীনতায় কোনদিন হস্তক্ষেপ করে নাই। তপতী চিরদিনই স্বাধীনা আছে, এবং থাকিবে।
ভোর হইয়া গিয়াছে। বীতবৰ্ষণ আকাশের কোমল আলোক তপতীর চোখে বড় সুন্দর লাগিতেছিল। উঠিয়া সে স্নান করিয়া ফেলিল। তারপর ধীরে ধীরে আসিয়া দাঁড়াইল বারান্দায়; তপনের ঘরের দিকে চাহিয়া দেখিল দরজা খোলা। ত্ৰ তপতীত্বরিতে আসিয়া দেখিল তপন পূজায় বসিয়াছে। তপনের পিছন দিকটা তপতী বহুবার দেখিয়াছে কিন্তু মুখ ভালো করিয়া দেখে নাই। আত্মবিস্মৃতা তপতী ঘরে ঢুকিয়া পড়িল, জীবনের এই প্রথম। প্রেমাভিসারের এই ক্ষুদ্র আয়োজনটুকুতেই হয়তো তার অনেক সময় ব্যয় হইয়া যাইত, কিন্তু আজ একান্ত অকস্মাৎ তাহা ঘটিয়া গেল।
তপনের দুই আঁখি ধ্যানক্তিমিত। শ্মশুগু মুণ্ডিত সুন্দর মুখমণ্ডল ব্যাপিয়া রহিয়াছে যে শান্ত সৌম্য শ্রী, তাহাতে তপতী বুদ্ধদেব ছাড়া আর কিছুই বলিতে পারে না। তপতী দাঁড়াইয়া রহিল। তপনের মানসিক্ত চুল হইতে তখনও জল ঝরিতেছে। তপতীর ইচ্ছা করিতেছে আপনার বুকের অঞ্চল দিয়া তপনের মাথাটি মুছিয়া দেয়।
তপন চক্ষু মেলিয়াই বিস্মিত হইল। অত্যন্তই সহজ সুরেই প্রশ্ন করিল, কিছু বলতে চান?
–না–কিছুনা বলিয়া বিমূঢ় তপতী দাঁড়াইয়া রহিল; প্রণাম শেষ করিয়া তপন চলিয়া গেল খাইবার জন্য মার কাছে, এবং খাইয়া বাহিরে।
সমস্ত দিনই তপন ঘুরে ফিরিল না। সেই সকালে গিয়াছে—তপতী অত্যন্ত উসখুস করিতেছে, মাকে জিজ্ঞাসা করিতে তাহার লজ্জা করিতেছিল বিকালে নিশ্চয় জল খাইতে আসিবে। কিন্তু বিকাল হইয়া গেল, ছয়টা বাজিল, তপন আসিল না। হঠাৎ তাহার মনে পড়িল কাল তপন বলিয়াছিল বোনের বাড়ি যাইবে। তবে কি আজ আর মোটেই আসিবে না? মিঃ ব্যানার্জি প্রভৃতি বন্ধুগণ তপতীকে বহুক্ষণ হইতে ডাকিতেছেন-নিরাশ হইয়া তপতী নীচে নামিল।
মিঃ বানার্জি কহিলেন, কী ব্যাপার? যক্ষবধুর মতো চেহারা যে মিস চ্যাটার্জি?
–আমি মিসেস গোস্বামী—আজ থেকে মনে রাখবেন–বলিয়া তপতী ওধারে ফুলবীথিকায় চলে গেল।
মিঃ অধিকারী ডাকিয়া কহিলেন,—খেলবেন না একটু?
না–তপতীর কণ্ঠস্বর এত দৃঢ় শুনাইল যে সকলেই থামিয়া গেল।
রাত্রি সাড়ে নয়টায় ফিরিয়া আসিল তপন। মা প্রশ্ন করিলেন,—কি কি খেলে, বাবা বোনের বাড়িতে?
—এই—পাটিসাপ্টা, সরুচাকলী, পানিফলের কি সব—আরো কত-কি খেলাম-মা—
তপতী আড়ালে দাঁড়াইয়া শুনিতেছে। মা কহিলেন,—বেশ বাবা বোনের বাড়ি তো বেশ খাও–আর এখানে খেতে দিলেই বলবে, ভালবাসিনে, মা!–
বিস্ময়ের সুরে তপন বলিল, কেন মা, আপনি যেদিন যা দিয়েছেন খেয়েছি তো? তবে আমি পরিমাণে কম খাই।
মা পুনরায় কহিলেন, কিন্তু বাবা, খুকী সেদিন যা-কিছু রান্না করলে, তুমি খেলে না।
তপন অকস্মাৎ গম্ভীর হইয়া গেল! বাহিরে তপতী সাগ্রহে কান খাড়া করিয়া আছে, তপন কি বলে শুনিবার জন্য। তপন ধীরে ধীরে বলিল, কথাটার জবাব দিতে চাইনে মা, ব্যথা পাবেন আপনি।
বিস্মিতা মাতা ব্যাকুল হইয়া কহিলেন,–তা হোক বাবা, তুমি বলো,–বলল কিজন্যে তুমি খাওনি? বলল, শুনতে চাই আমি–
-মার মনে ব্যথা দেওয়া উচিত নয়, মা–তাই বলতে চাইছি নে।
না বাবা, তোমায় বলতেই হবে।-মার নির্বন্ধাতিশয্য বাড়িয়া গেল!
নিরুপায় তপন কোমল কণ্ঠে কহিল,–আপনার খুকী তো আমার জন্য কিছু কোনদিন রান্না করেনি,—মা-যেদিন যা-কিছু করেছে, সবই তার বন্ধুদের জন্য। আর আমার বোন আমার জন্য পাটিসাপ্টা তৈরী করে আঁচল ঢেকে বসে থাকে—যেতে দুমিনিট দেরী হলে চোখের জলে তার বুক ভেসে যায়। তার সঙ্গে আপনার খুকীর তুলনা করবেন না, মা—সে তো প্রগতিশীল তরুণী নয়, ভাইএর বোন সে–
মা একেবারে মুক হইয়া গেলেন। বাহিরে তপতীর অন্তর বিপুল বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছে! এতবেশী সেন্টিমেন্টাল ও! এত তীক্ষ্ম লক্ষ্য উহার!
কিছুক্ষণ সামলাইয়া মা কহিলেন,—খুকী বড় ছেলেমানুষ, বাবা-–বোঝে না।
কলহাস্যে ঘরের বিষাক্ত হওয়াটা উড়াইয়া দিয়া তপন অতি সহজকণ্ঠে কহিল,–আমি কি বলেছি, মা, সে বুড়ো মানুষ। আপনি তো বেশ উল্টো চার্জে ফেলেন। খাওয়া হইয়া গিয়াছে, তপন উঠিয়া আপনার ঘরে চলিয়া গেল।
পরদিন সকালে আসিয়াই তপন করুণ কণ্ঠে কহিল,কাল আপনাকে কথাগুলো বলে মনে বড় কষ্ট পেয়েছি মা—সত্যি বলুন, আপনি দুঃখ পাননি?
—তুমি আমার বড় উপকার করেছ, তপন, দুঃখ পাবার আমার দরকার ছিল।
-খুব বড় কথা বললেন, মা–দুঃখ পাবার মানুষের দরকার থাকে। এই পৃথিবীতে দুঃখের চাকায় আমাদের মন-মাটি মানুষের মূর্তিতে গড়ে ওঠে। তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন:
বজ্রে ভোলো আগুন করে আমার যত কালো
তপন খাইতে আরম্ভ করিল। মা দেখিতে লাগিলেন, দরজার আড়ালে তপতীর অঞ্চলপ্রান্ত দুলিতেছে। ডাকিলেন, আয় খুকী-খাবি আয়।
তপতী আসিতে আজ সঙ্কুচিত হইতেছে। মা বলিলেন, লজ্জা দেখো মেয়ের! আয়। ও কাল কি বললো জানো বাবা, তপন? বললো, তোমার জামাইএর জন্য খাবার করবো বলতে আমার লজ্জা করে-জামাই তোমার বোঝে না কেন?
বিস্ময়ে হতবাক তপন দুই মুহূর্ত পরে উত্তর দিল,লজ্জার একটা সুমিষ্ট সৌরভ আছে, মা, আপনার খুকীর আচরণে এযাবৎ সেটা পাইনি। কিন্তু মা ও কথা এবার বন্ধ করুন! অপ্রিয় আলোচনা না করাই ভালো, মা।
–হ্যাঁ বাবা, থাক—পাছে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে উঠিয়া পড়ে, ভয়ে মা আর কোন কথাই তুলিলেন না। তপন চলিয়া গেলে তপতীকে কহিলেন,—তোর কিন্তু এতোটুকু বুদ্ধি নেই খুকী, মিছেই লেখাপড়া শিখছিস।
তপতী আজ এই ভৎসনা মাথা পাতিয়া গ্রহণ করিল! তাহার জন্মজ্জিত সংস্কার আজ যেন তাহাকে চাবুক মারিয়া বুঝাইতেছে, আপনার স্বামীকে চিনিয়া লইবার ক্ষমতাটুকু পৰ্য্যন্ত সে এত বিদ্যাতেও অর্জন করে নাই। মার কথার বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ না করিয়া তপতী হাসিল–এবং আপন ঘরে গিয়া সারাদিন ভাবিয়া একটা প্ল্যান খাড়া করিয়া ফেলিল!
বিকালে জলযোগের জন্য তপন আসিতেই মা কহিলেন—খুকীর বড্ড মাথা ধরেছে, বাবা, ভীষণ কাতরাচ্ছে। ওকে একটু বেড়িয়ে আনো
-মাথা ধরেছে? কিন্তু আমার সঙ্গে বেড়িয়ে ও বিশেষ কিছু আনন্দ পাবে না, মা–ওর বন্ধুদের সঙ্গে যেতে বলুন না? গল্প করলে মাথা ধরা সেরে যাবে শিঘ্রী।
তপতী সোফায় শুইয়া সব শুনিতেছিল। নিতান্ত করুণ কণ্ঠে কহিল—থাক মা যেতে হবে না—ওর হয়তো কাজ আছে। না হোক বেড়ানো আমার–
তপন বিস্মিত হইয়া কহিল,—আমি না গেলে বেড়ানো হবে না কেন, বুঝতে পারছি, মা-রোজই তত বেড়াতে যায়।
তপতীর আর বলিবার মতো কথা ফুটিতেছে না। মা ব্যাপারটা বুঝিলেন। কহিলেন,—এতকাল ছেলেমানুষ ছিল, বাবা, চিরকাল কি আর বন্ধুদের সঙ্গে যায়?
তপন হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। সুমিষ্ট হাসসা সারা বাড়িটা মুখরিত হইয়া উঠিল। বলিল—বেশ যা-হোক, মা, গতকালই বলেছেন, আপনার খুকী ছেলেমানুষ—আর আজই বড় হয়ে গেল! আপনার বাপের বাড়িতে তাই হয় বুঝি? ঝিঙে, বেগুন, করলা দুইবেলা কিন্তু বাড়ে, মা—আপনার খুকী কি তাহলে…
তপনের বলার ভঙ্গীতে খুকী অবধি হাসিয়া ফেলিল।
মা বলিলেন, দুষ্টুমি কোরো না, বাবা-যাও দুজনে বেড়িয়ে এসো গে—
-–আচ্ছা, মা–যথাদেশ-বলিয়া তপন গাড়ীতে আসিয়া উঠিল।
চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট মাইল বেগে গাড়ী চলিতেছে। কাহারও মুখে কথা নাই। তপ বাঁ হাতে কপাল টিপিয়া বসিয়া আছে। তপনের দৃষ্টি দূর দিকচক্রে সমাহিত। হুড়-শূন্য গাড়ীর উপর দিয়া যেন ঝড় বহিয়া যাইতেছে। তপতী মাথাটা টিপিয়া বার দুই উঃ-আঃ করিল। তপন নির্বিকারে গাড়ী চালাইতেছে। তপতী মাথার চুলগুলো এলাইয়া দিল। তপনের চোখে-মুখে লাগিতেছে—তপন মুখটা সবাইয়া লইল। ঘাড়টা কাত করিয়া তপতী পিছনের ঠেসায় রাখিল, তপনের বাম বাহুতে তাহার মাথা ঠেকিতেছে—তপন নির্বিকারে গাড়ীর গতিটা বাড়াইয়া দিল। তপতী ওগো, মাগো বলিয়া মাথাটা তপনের বুকের অত্যন্ত নিটে তানিয়া ফেলিয়েছে—তপনের নিঃশ্বাস তাহার ললাট স্পর্শ করিবে—তপন অকস্মাৎ গাড়ীর গতি অত্যন্ত মন্দ করিয়া দিল, এবং একটু পরেই থামাইয়া ফেলিল। ঘাড় তুলিয়া তপতী চাহিয়া দেখিল, গঙ্গার কূলেই তাহারা আসিয়াছে।
গাড়ীর দরজা খুলিয়া তপন নামিয়া পড়িল। তপতী বিস্মিতা, ব্যথিতা, বিপন্না বোব করিতে লাগিল। আপনাকে এতখানি অসহায় তাহার কোনদিন মনে হয় নাই। চাহিয়া দেখল, তপন গঙ্গার জলের ধারে গিয়া দাঁড়াইয়াছে। তপতীও নামিল এবং একটা আকন্দগাছ হইতে ফুলগুচ্ছ ছিঁড়িয়া তপনের গায়ে ছুঁড়িয়া দিতে দিতে কহিল-ফুলের ঘায়ে মুচ্ছা যায় তার নামটি কি! বলুন তো?
তপন পিছন ফিরিয়াই দাঁড়াইয়া রহিল। তপতীর এই নির্লজ্জ ন্যাকামী তাহার চিরসহিষ্ণু অন্তরকেও অসহিষ্ণু করিয়া তুলিতেছে। যে নারী দিনের পর দিন বিবাহিত স্বামীর অন্তরকে অপমানে বিদীর্ণ করিয়া দিয়াছে—একবার ফিরিয়া দেখে নাই কতখানি শাণিত ক্ষরণ হইল, যে স্বেচ্ছায় অন্য পুরুষের অঙ্গে শয়ন করিয়া স্বামীর কাছে মুক্তি মাগিয়া লয়—আজ আবার কোন সাহসে সে স্বামীর সঙ্গে রঙ্গ করিতে আসে!
ইহাই কি আধুনিকার প্রগতি! কিন্তু তপন কাহাকেও আঘাত করে না—তপতীকেও কিছু বলিল না।
তপতী আশা করিয়াছিল, তাহার কবিতার উত্তরে তপন বলিয়া উঠিবে—তার নাম তপতী। কিছুই তপন বলিল না, এমন কি মুখ ফিরাইল না দেখিয়া তপতী অত্যন্ত মুষড়াইয়া পড়িল। তাহার এতক্ষণকার ব্যবহার মনে করিয়া লজ্জায় তাহার মরিয়া যাইতে ইচ্ছা হইতে লাগিল। নিরুপায়ের শেষ অবলম্বনের মতো সে শুধু বলিল,–বসবেন না একটু?
তপন নীরবে আসিয়া একটু দূরেই বসিল। সবুজ তৃণমণ্ডিত মাঠে একান্ত আত্মীয় দুইটি মানবের একান্ত নীরবতা বুঝি প্রকৃতিকেও পীড়িত করিতেছে—কোথায় একটা পাপিয়া ডাকিয়া উঠিল-পিউ কাহা? তপতী নির্ভুলভাবেই বুঝিয়াছে, তপন আর কথা কহিবে না! উপায়হীনা তপতী উঃ বলিয়া সেই ঘাসের উপরই তপনের হাঁটুর কাছে মাথা রাখিয়া শুইয়া পড়িল।
হয়তো সত্যিই উহার কষ্ট হইতেছে! কারুণ্য কোমল তপন সস্নেহে হাত দিল তপতীর ললাটে। মাথা ধরার কিছুমাত্র লক্ষণ নাই, দিব্যি শীতল স্নিগ্ধ স্পর্শ কপাল, রগ-দুটি যথাসম্ভব স্বাভাবিক ভাবেই টিপটিপ করিতেছে। এই মিথ্যাবাদিনী ছলনাময়ী নারীকে তপন বিবাহ করিয়াছে! ঘৃণায় তাহার সর্বাঙ্গ শিহরিয়া উঠিল! কিন্তু কিছুই সে বলিল না, তপতীর শীতল মসৃণ কপালে তাহার নিপুণ অঙ্গুলি চালনা করিতে লাগিল। আরামে তপতীর চক্ষু বুজিয়া আসিতেছে। এক এক বার সে ভাবিতেছে তপনের হাঁটুর উপর মাথাটা তুলিয়া দিলে কেমন হয়—কিন্তু থাক, অতটা বাড়াবাড়ি দরকার নাই—যদি নিজেই তুলিয়া লয় তো আরো ভালো হইবে।
–নমস্কার—