৮
ডঃ জাবেদ আহসান অবাক হয়ে বললেন, ‘আপনি আমার কাছে ঠিক কী জানতে চান, বুঝতে পারছি না। কয়েকটি গাছপালার হাতে-আঁকা ছবি দিয়ে গিয়েছেন, আর তো কিছুই বলেন নি।‘
‘ছবিগুলো ভালো করে দেখেছেন?’
‘ভালো করে দেখার কী আছে?’
মিসির আলি লক্ষ করলেন ডঃ জাবেদ বেশ বিরক্ত। ভদ্রলোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররা তেমন কোনো কাজকর্ম করেন না, কিন্তু সব সময় ব্যস্ততার একটা ভঙ্গি করেন। ডঃ জাবেদ এই মুহূর্তে এমন মুখের ভাব করেছেন, যেন তাঁর মহা মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মিসির আলি বললেন, ‘এই গাছগুলি সম্পর্কে কিছু বলুন। ছবিতে আঁকা গাছগুলির কথা বলছি।’
‘কী বলব, সেটাই বুঝতে পারছি না। আপনি কী জানতে চাচ্ছেন?’
‘এই জাতীয় গাছ দেখেছেন কখনো?’
‘না।’
‘বইপত্রে এ রকম গাছের কোনো রেফারেন্স পেয়েছেন?’
‘দেখুন, পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ ধরনের গাছ আছে। সব কিছু আমার জানার কথা নয়। আমার পিএইচ.ডি.’র বিষয় ছিল প্লান্ট ব্রিডিং। সে-সম্পর্কে আপনাকে আমি কিছু বলতে পারি। আপনি একটি বাচ্চা মেয়ের আঁকা কতগুলি ছবি নিয়ে এসেছেন। সেই ছবিগুলি দেখে আমাকে গাছ সম্পর্কে বলতে বলছেন। এ-ধরনের ধাঁধার পেছনে সময় নষ্ট করার আমি কোনো অর্থ দেখছি না।’
মিসির আলি বললেন, ‘আপনি বিরক্ত হচ্ছেন কেন?’
‘বিরক্ত হচ্ছি, কারণ আপনি আমার সময় নষ্ট করছেন।’
মিসির আলি বললেন, ‘আপনি তো বসে-বসে টিভি দেখছিলেন। তেমন কিছু তো করছিলেন না। সময় নষ্ট করার কথা উঠছে না।
মিসির আলি ভাবলেন, এই কথায় ভদ্রলোক ভীষণ রেগে যাবেন।’গেট আউট’ জাতীয় কথাবার্তাও বলে বসতে পারেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, তেমন কিছু হল না। ডঃ জাবেদকে মনে হল, তিনি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়েছেন। অপ্রস্তুত মানুষেরা যেমন খুব অদ্ভুত ভঙ্গিতে কাশতে থাকে, ভদ্রলোক সে-রকম কাশছেন। কাশি থামাবার পর বেশ মোলায়েম স্বরে বললেন, ‘একটু চা দিতে বলি?’
‘জ্বি-না, চা খাব না।’
‘একটু খান, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা পড়েছে। চা ভালোই লাগবে। বসুন, চায়ের কথা বলে আসি।’
চা এল। শুধু চা নয়, চায়ের সঙ্গে নানান রকমের খাবারদাবার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাড়ির এই একটি বিশেষত্ব আছে। এরা অতিথিকে চায়ের সঙ্গে নানান রকম খাবারদাবার দেয়, যা দেখে কেউ ধারণাও করতে পারে না যে, এই সম্প্রদায় আর্থিক দিক দিয়ে পঙ্গু।
‘মিসির আলি সাহেব, চা নিন।’
তিনি চা নিলেন।
‘বলুন, স্পেসিফিক্যালি আপনি কী জানতে চান।’
‘পৃথিবীতে ঠিক এ-জাতীয় গাছ আছে কি না তা কে বলতে পারবে? অর্থাৎ আমি জানতে চাচ্ছি, গাছপালার ক্যাটালগজাতীয় কিছু কি আছে, যেখানে সব-জাতীয় গাছপালার ছবি আছে? তাদের সম্পর্কে তথ্য লেখা আছে?’
‘হ্যাঁ, নিশ্চয় আছে। এ-দেশে নেই। বোটানিক্যাল সোসাইটিগুলিতে আছে। ওদের একটি কাজই হচ্ছে গাছপালার বিভিন্ন স্পেসিসকে সিসটেমেটিকভাবে ক্যাটালগিং করা।’
‘আপনি কি আমাকে কিছু লোকজনের ঠিকানা দিতে পারবেন, যাঁরা আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন?’
‘হ্যাঁ, পারি। আপনি যাবার সময় আমি ঠিকানা লিখে দেব। আর কী জানতে চান?’
‘মানুষ এবং গাছের মধ্যে পার্থক্য কী?’
‘প্রশ্নটা আরো গুছিয়ে করুন।’
মিসির আলি থেমে-থেমে বললেন, ‘আমরা তো জানি গাছের জীবন আছে। কিন্তু আমি যা জানতে চাচ্ছি, সেটা হচ্ছে, গাছের জীবনের সঙ্গে মানুষের জীবনের মিলটা কোথায়?’
‘চট করে উত্তর দেওয়া যাবে না। এর উত্তর দেবার আগে আমাদের জানতে হবে জীবন মানে কি? এখনো _ আমরা পুরোপুরি ভাবে জীবন কী তা–ই জানি না।’
‘বলেন কী! জীবন কী জানেন না!’
‘হ্যাঁ, তাই। বিজ্ঞান অনেক দূর আমাদেরকে নিয়ে গেছে, কিন্তু এখনো অনেক কিছু আমরা জানি না। অনেক আনসলভড্ মিস্ট্রি রয়ে গেছে। আপনাকে আরেক কাপ চা দিতে বলি?’
‘বলুন।’
ডঃ জাবেদ সিগারেট ধরিয়ে শান্ত স্বরে বললেন, ‘অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, মানুষের সঙ্গে গাছের মিল অনেক বেশি।’
‘বলেন কী!’
‘হ্যাঁ, তাই। আসল জিনিস হচ্ছে ‘জীন’, যা ঠিক করে কোন প্রোটিন তৈরি করা দরকার। অনেকগুলি জীন নিয়ে হয় একটি ডিএনএ মলিক্যুল। ডিওক্সি রিবো নিউক্লিয়িক অ্যাসিড। প্রাণের আদি ব্যাপার হচ্ছে এই জটিল অণু। এই অণু থাকে জীব-কোষে। তারা ঠিক করে একটি প্রাণী মানুষ হবে, না গাছ হবে, না সাপ হবে। মাইটোকনড্রিয়া বলে একটি জিনিস মানুষেরও আছে, আবার গাছেরও আছে। মানুষের যা নেই, তা হচ্ছে ক্লোরোপ্লাসট।’
‘আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘বুঝতে পারার কথাও নয়। বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। আপনি চাইলে, আমি আপনাকে কিছু সহজ বইপত্র দিতে পারি।’
‘আমি চাই। আপনি আমাকে আরো কিছু বলুন।’
‘ডিএনএ প্রসঙ্গেই বলি। এই অণুগুলি হচ্ছে প্যাচাল সিঁড়ির মতো। মানুষের ডিএনএ এবং গাছের ডিএনএ প্রায় একই রকম। সিঁড়ির দু’-একটা ধাপ শুধু আলাদা। একটু অন্য রকম।’
মিসির আলি গভীর আগ্রহে তাকিয়ে আছেন। এক জন ভালো শিক্ষক খুব সহজেই একজন মনোযোগী শ্রোতাকে চিনতে পারেন।
ডঃ জাবেদ এই মনোযোগী শ্রোতাকে পছন্দ করে ফেললেন।
‘শুধু এই দু’-একটি ধাপ অন্য রকম হওয়ায় প্রাণিজগতে মানুষ এবং গাছ আলাদা হয়ে গেছে। প্রোটিন তৈরির পদ্ধতি হয়েছে ভিন্ন। আপনি আগে বরং কয়েকটা বইপত্র পড়ুন। তারপর আবার আপনার সঙ্গে কথা বলব।’
ডঃ জাবেদ তিনটি বই দিলেন। দু’টি ঠিকানা লিখে দিলেন। একটি লন্ডনের রয়েল বোটানিক্যাল সোসাইটির, অন্যটি ডঃ লংম্যানের। ডঃ লংম্যান আমেরিকান এগ্রিকালচারাল রিসার্চের ডেপুটি ডাইরেক্টর।
মিসির আলি সাহেব তাঁর সঙ্গের ছবিগুলি দু’ ভাগ করে দু’ জায়গায় পাঠালেন। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, দশদিনের মাথায় ডঃ লংম্যান-এর চিঠির জবাব চলে এল।
টমাস লংম্যান
Ph.D. D. Sc.
US Department of Agricultural Science
ND 505837 USA
প্রিয় এম. আলি,
আপনার পাঠানো ছবি এবং চিঠি পেয়েছি। যে সমস্ত লতানো গাছের ছবি আপনি পাঠিয়েছেন, তা খুব সম্ভব কল্পনা থেকে আঁকা। আমাদের জানা মতে ও রকম গাছের কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে পেরুর গহীন অরণ্যে এবং আমেরিকার রেইন ফরেস্টে কিছু লতানো গাছ আছে, যার সঙ্গে আপনার পাঠানো গাছের সামান্য মিল আছে। আমি আপনাকে কিছু ফটোগ্রাফ পাঠালাম, আপনি নিজেই মিলিয়ে দেখতে পারেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করছি, রেইন ফরেস্ট এবং পেরুর গাছগুলির রঙ সবুজ, কিন্তু আপনার পাঠানো ছবির গাছের বর্ণ হলুদ এবং লালের মিশ্রণ। এর বেশি আপনাকে আর কোনো তথ্য দিতে পারছি না।
আপনার বিশ্বস্ত
টি. লংম্যান।
পুনশ্চ : আপনি যদি আপনার ছবির মতো গাছের কিছু নমুনা পাঠান, তাহলে আমরা তা অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে পরীক্ষা করব।
.
রয়েল বোটানিক্যাল সোসাইটি চিঠির জবাব দিতে কুড়ি দিনের মতো দেরি করল। তাদের জবাবটি ছিল এক লাইনের।
প্রিয় ডঃ এম. আলি,
আপনার পাঠানো ছবির মতো দেখতে কোনো গাছের কথা আমাদের জানা নেই।
আপনার বিশ্বস্ত,
এ. সুরনসেন।
.
মিসির আলি সাহেব এই ক’দিনে জীবনের উৎপত্তি এবং বিকাশের উপর গোটা চারেক বই পড়ে ফেললেন। ডিএনএ এবং আরএনএ মলিক্যুল সম্পর্কে পড়তে গিয়ে লক্ষ করলেন, প্রচুর কেমিষ্টি জানা ছাড়া কিছু স্পষ্ট হচ্ছে না। বারবার এ্যামিনো অ্যাসিডের কথা আসছে। এ্যামিনো অ্যাসিড কী জিনিস তা তিনি জানেন না। অথচ বুঝতে পারছেন, প্রাণের রহস্যের সঙ্গে এ্যামিনো অ্যাসিডের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। মিসির আলি নাইন টেনের পাঠ্য কেমিষ্ট্রি বই কিনে এনে পড়া শুরু করলেন। কোমর বেঁধে পড়াশোনা যাকে বলে। এই ফাঁকে চিঠি লিখলেন তিন্নির বাবাকে। তিন্নির বাবা তার জবাব দিলেন না। তবে তিন্নি একটি চিঠি লিখল। কোনো রকম সম্বোধন চিঠিতে নেই। হাতের লেখা অপরিচ্ছন্ন। প্রচুর ভুল বানান। কিন্তু ভাষা এবং বক্তব্য বেশ পরিষ্কার। খুবই গুছিয়ে লেখা চিঠি, বাচ্চা একটি মেয়ের জন্যে যা বেশ আশ্চর্যজনক। চিঠির অংশবিশেষ এ-রকম-
(চিঠি)
আপনি আব্বাকে একটি লম্বা চিঠি লিখেছেন। আব্বা সেই চিঠি না-পড়েই ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। আব্বা এখন আর আপনাকে পছন্দ করছেন না। তিনি চান না, আপনি আমার ব্যাপারে আর কোনো চিন্তাভাবনা করেন। কিন্তু আমি জানি, আপনি করছেন। যদিও আপনি অনেক দূরে থাকেন, তবু আমি বুঝতে পারি। আপনি যে আমাকে পছন্দ করেন, তাও বুঝতে পারি। কেউ আমাকে পছন্দ করে না, কিন্তু আপনি করেন। কেন করেন? আমি তো ভালো মেয়ে না। আমি সবাইকে কষ্ট দিই। সবার মাথায় যন্ত্রণা দিই। কাউকে আমার ভালো লাগে না। আমার শুধু গাছ ভালো লাগে। আমার ইচ্ছা করে, একটা খুব গভীর জঙ্গলের মাঝখানে গিয়ে বসে থাকি। গাছের সঙ্গে কথা বলি। গাছেরা কত ভালো। এরা কখনো এক জন অন্য জনের সঙ্গে ঝগড়া করে না, মারামারি করে না। নিজের জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, এবং ভাবে। কত বিচিত্র জিনিস নিয়ে তারা ভাবে। এবং মাঝে-মাঝে এক জনের সঙ্গে অন্য জন কথা বলে। কী সুন্দর সেই সব কথা! এখন আমি মাঝে-মাঝে ওদের কথা শুনতে পাই।
চিঠি এই পর্যন্তই। মিসির আলি এই চিঠিটি কম হলেও দশ বার পড়লেন। চিঠির কিছু অংশ লাল কালি দিয়ে দাগ দিলেন। যেমন একটি লাইন–‘এখন আমি মাঝে-মাঝে ওদের কথা শুনতে পাই।’ স্পষ্টতই মেয়েটি গাছের কথা বলছে। পুরো ব্যাপারটাই সম্ভবত শিশুর কল্পনা। শিশুদের কল্পনার মতো বিশুদ্ধ জিনিস আর কিছুই নেই। মিসির আলির নিজের এক ভাগনী অমিতা গাছের সাথে কথা বলত। ওদের বাড়ির সামনে ছিল একটা খাটো কদমগাছ। অমিতাকে দেখা যেত গাছের সামনে উবু হয়ে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ করছে। মিসির আলি এক দিন আড়ালে বসে কথাবার্তা শুনলেন।
‘কিরে, আজ তুই এমন মুখ কালো করে রেখেছিস কেন? রাগ করেছিস? তুই এমন কথায়-কথায় রাগ করিস কেন? কেউ বকেছে? কী হয়েছে বল তো ভাই শুনি।’
অমিতা অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। যেন সে সত্যি-সত্যি শুনতে পাচ্ছে গাছের কথা। মাঝে-মাঝে মাথা নাড়ছে। এক সময় সে উঠে দাঁড়াল এবং বিকট চিৎকার করে বলল, ‘কে কদমগাছকে ব্যথা দিয়েছে? কে পাতাসুদ্ধ তার ডাল ছিঁড়েছে?’ কান্নাকাটি আর চিৎকার। জানা গেল আগের রাতে সত্যি-সত্যি কদমগাছের একটি ডাল ভাঙা হয়েছে। ব্যাপারটা বেশ রহস্যজনক। কিছুদিন পর গাছটি আপনা-আপনি মরে যায়। অমিতা নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে বড় অসুখে পড়ে যায়। জীবন-মরণ অসুখ। মাসখানিক ভুগে সেরে ওঠে। গাছপ্রসঙ্গ চাপা পড়ে যায়।
মিসির আলি ঠিক করলেন, অমিতার সঙ্গে দেখা করবেন। ছোটবেলার কথা জিজ্ঞেস করবেন। যদিও এটা খুবই সম্ভব যে, অমিতার শৈশবের কথা কিছু মনে নেই। সে এখন থাকে কুমিল্লার ঠাকুরপাড়ায়। তার স্বামী পুলিশের ডিএসপি। সে নিজে কোনো এক মেয়ে-স্কুলে পড়ায়। মিসির আলি ঠিক করলেন, অমিতার সঙ্গে দেখা করেই চলে যাবেন ময়মনসিংহ। তিন্নির সঙ্গে কথা বলবেন। দু’-একটা ছোটখাটো পরীক্ষাটরীক্ষা করবেন। তিন্নির মার আত্মীয়স্বজনের খোঁজ বের করতে চেষ্টা করবেন। তিন্নিকে দিয়ে আরো কিছু ছবি আঁকিয়ে পাঠাবেন ডঃ লংম্যানের কাছে। অনেক কাজ সামনে। মিসির আলি দু’মাসের অর্জিত ছুটির জন্যে দরখাস্ত করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর চাকরির পদটি হচ্ছে অস্থায়ী। পার্ট টাইম শিক্ষকতার পদ। দু’ মাসের ছুটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দেবে না। হয়তো চাকরি চলে যাবে। কিন্তু উপায় কী? এই রহস্য তাঁকে ভেদ করতেই হবে। ছোট্ট একটি মেয়ে কষ্ট পাবে, তা হতেই পারে না।