৮. টমাস পেনের নিয়তি
(১৯৩৪ সালে রচিত)
দু’ দুটো বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অংশগ্রহণ করে তৃতীয় এক বিপ্লবের প্রচেষ্টা করার ফলে যাঁকে ফাঁসির মঞ্চে প্রায় উঠতে হয়েছিল সেই টমাস পেন আমাদের সময়টাতে কিছুটা ফিকে হয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের প্রপিতামহদের কাছে তিনি ছিলেন এক পার্থিব শয়তান এবং তাঁর ঈশ্বর ও তাঁর রাজার কাছে তিনি ছিলেন ধ্বংসাত্মক নাস্তিক বিদ্রোহী। পরস্পর কখনই ঐক্যবদ্ধ ছিলেন না এমন তিনটি মানুষকে ভীষণভাবে বিপদে ফেলে তিনি তিক্ত শত্রুতা কুড়িয়েছিলেন। এই তিনজন মানুষ হলেন পিট, রোবসপিয়ের এবং ওয়াশিংটন। এদের মধ্যে প্রথম দু’জন তাঁর মৃত্যু চেয়েছিলেন এবং তৃতীয়জন সযত্নে নিজের জীবন বাঁচাতে চিৎকার চেঁচামেচি না করে নানা রকম পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। পিট ও ওয়াশিংটন তাঁকে ঘৃণা করতেন এইজন্য যে তিনি একজন ডেমোক্র্যাট ছিলেন, অন্যদিকে রোবসপিয়ের তাকে ঘৃণা করতেন কেননা তিনি রাজার মৃত্যুদণ্ড ও সন্ত্রাসের রাজত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। সর্বদাই তার ভাগ্যে বিরোধী পক্ষের প্রশংসা ও সরকারের ঘৃণা জুটেছে। যখন তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন তখন এই ওয়াশিংটন তাঁর সম্পর্কে উচ্চ প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। ফরাসী জাতি ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁকে স্তূপাকৃতি সম্মানে ভূষিত করেছে যতক্ষণ না জ্যাকোবিনরা ক্ষমতায় এসেছে। এমনকি ইংল্যান্ডেও প্রসিদ্ধ হুইগ রাষ্ট্রনেতারা তাঁকে বন্ধুর মতো সাহায্য করেছেন এবং তাদের ইস্তাহার তৈরি করবার ব্যাপারে তাকে কাজে লাগিয়েছেন। অন্যান্য মানুষদের মতোই তারও কিছু ভুল ছিল, কিন্তু এটা ছিল তাঁর গুণ যার জন্য তিনি ঘৃণিত হয়েছিলেন এবং সফলতার সঙ্গে উচ্চ শিখরে উঠতে পেরেছিলেন।
ইতিহাসে পেনের গুরুত্ব এই কারণে যে তিনি গণতান্ত্রিক গণতন্ত্রের প্রচার করেন। তিনি সেই সব গণতান্ত্রিকদের কথা বলেছিলেন যারা অষ্টাদশ শতকে ফরাসী ও ইংরেজ সম্ভ্রান্ত শ্ৰেণীদের মধ্যে ছিল, ছিল দার্শনিকদের মধ্যে ও আস্থাহীন মন্ত্রীদের মধ্যে, কিন্তু এদের সবাই তাদের নিজের নিজের ধারণাগুলোকে এমনভাবে গঠন করতে যা কেবলমাত্র শিক্ষিতদেরই দেওয়া যেত। পেন তাঁর মতবাদকে কোন রকম কাব্য না করে এমন এক শৈলীতে উপস্থাপিত করতেন যা সহজ সরল এবং সরাসরি হত, যার ফলে প্রতিটি বুদ্ধিমান কর্মী মানুষ সেই মতবাদকে প্রশংসা করতে পারত। এই ব্যাপারটাই তাঁকে বিপজ্জনক করে তুলেছিল এবং যখন তিনি তাঁর অন্যান্য অপরাধে ধর্মীয় শিথিলতা প্রদর্শন করেন তখন ধর্মরক্ষকরা তাঁর সমস্ত সুযোগ সুবিধা কেড়ে নিয়ে তাঁকে তিরস্কারের ভারে ভারাক্রান্ত করে তোলে।
তাঁর জীবনের প্রথম ছত্রিশটা বছরে তেমন কোন প্রতিভার সন্ধান পাওয়া যায়নি যা তাঁর পরবর্তী জীবনে পাওয়া যায়। তিনি ১৭৩৯ সালে থেটফোর্ডে জন্মগ্রহণ করেন সাহায্যের উপর নির্ভরশীল এক দরিদ্র পরিবারে। তের বছর বয়স পর্যন্ত তিনি আঞ্চলিক একটি ব্যাকরণ বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং মেয়েদের জামার পাড় তৈরি করে জীবিকা অর্জন করতে থাকেন। এই ধরণের পরিত্যক্ত জীবন তার অভিপ্রেত ছিল না। সতেরো বছর বয়সে তিনি ‘দ্য টেরিবল’ নামক একটি জাহাজ রক্ষার জন্য বে-সরকারী সৈন্যদলে তালিকাভুক্ত হবার চেষ্টা করেছিলেন, যার সৈন্যাধ্যক্ষের নাম ছিল ডেথ (Death)। কিন্তু পেনের পিতামাতা তাঁকে সেখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে সম্ভবত তার জীবন রক্ষা করেছিলেন কেননা এর কিছুদিন পরেই একটি ঘটনায় সেই জাহাজ রক্ষাকারী নাবিক সৈন্যদলটির ২০০ জন সদস্যের মধ্যে ১৭৫ জন সদস্যই নিহত হয়। কিছুদিন বাদেই সপ্তবর্ষের যুদ্ধ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি উপরোক্ত ধরণের আর একটি বেসরকারী সৈন্যদলে যোগদান করেন। সেই সময় সমুদ্রবক্ষে তাঁর সংক্ষিপ্ত রোমাঞ্চকর জীবন সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না। ১৭৫৪ সালে তিনি লন্ডনে মেয়েদের অন্তর্বাস তৈরি করবার কাজে আবার যোগ দেন এবং ওই একই বছরে তিনি বিবাহ করেন কিন্তু তাঁর স্ত্রী কয়েক মাস পরেই মারা যান। ১৭৬৩ সালে তিনি মাসুল আদায়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী হিসেবে কাজে লাগেন কিন্তু দু’বছর পরেই বরখাস্ত হন এই অভিযোগে যে তিনি তার অনুসন্ধানমূলক কাজের সময় কাজ না করে ঘরে বসে পড়াশুনো করছিলেন। প্রচণ্ড দারিদ্রের সময় তিনি সপ্তাহে দশ শিলিংয়ের বিনিময়ে একটি স্কুলে চাকরি পেয়ে যান এবং ইংল্যান্ডের গীর্জার ধর্ম গ্রহণের চেষ্টা করেন। উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এই রকম দুঃসাহসিক পদক্ষেপের ফলে লিউইসের মাসুল আদায়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী পদে পূর্ণ বহাল হয়ে বেঁচে যান। সেখানে তিনি বিবাহ করেন কোয়েকার সমাজের একটি মেয়েকে (কোয়েকার সমাজ বলতে ষোড়শ শতকে জর্জ কক্সের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি বিশেষ ধরনের ধর্মীয় সম্প্রদায়), কিন্তু ১৭৭৪ সালে সাধারণভাবে তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে, তবে এর পেছনে কারণ কি ছিল তা জানা যায়নি। এই বছরেই তিনি আবার তাঁর চাকরিটি হারান। এর কারণ ছিল তিনি মাসুল আদায়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী হিসেবে উচ্চ বেতনের জন্য সম্মিলিত ভাবে আবেদন সংগঠিত করেছিলেন। এরপর তিনি তার যা কিছু ছিল তা বিক্রী করে দেন ঋণশোধ করবার জন্য এবং যা কিছু বাঁচে তা দেন সেই স্ত্রীকে, কিন্তু নিজে আবার চরম দারিদ্র্যে পড়েন।
লন্ডনে তিনি মাসুল আদায়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী হিসেবে উচ্চ বেতনের জন্য সংসদে সম্মিলিত আবেদন করতে গিয়ে বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের সঙ্গে পরিচিত হন। বেঞ্জামিন তার সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করতেন। এর ফলস্বরূপ তিনি ১৭৭৪ সালের অক্টোবর মাসে আমেরিকায় যাত্রা করেন ফ্র্যাঙ্কলিনের একটি চিঠি হাতে নিয়ে। সেখানে তাঁর সম্পর্কে লেখা ছিল ‘একজন সরল ও উপযুক্ত যুবক। যেই তিনি ফিলাডেলফিয়ায় পৌঁছলেন তখনি একজন লেখক হিসেবে তাঁর দক্ষতা প্রদর্শন করতে শুরু করলেন এবং খুব অল্প দিনের মধ্যে একটি জার্নালের সম্পাদক হয়ে গেলেন।
তাঁর প্রথম প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় ১৭৭৫ সালে যেখানে তিনি দাসত্ব ও দাস ব্যবসার বিরুদ্ধে জোরালো ভাষায় লেখেন। তাঁর বন্ধুরা বলতে পারেন যে তিনি এইসব করে তার বিরুদ্ধে কিছু গোঁড়া শত্রুর সৃষ্টি করেছিলেন। এর কারণ ছিল তাঁর প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে জেফারসন স্বাধীনতার সনদের খসড়ায় উক্ত বিষয়ের সন্নিবেশ করেন যা পরবর্তীকালে বাতিল করে দেওয়া হয়। দাসত্ব ব্যবস্থাটি পেনসিলভেনিয়াতে ১৭৭৫ সালেও টিকে ছিল। এই ব্যবস্থা সেখান থেকে দূরীভূত হয় ১৭৮০ সালের একটি আইন অনুযায়ী। সাধারণত সেখানে এই বিশ্বাস প্রচলিত যে পেন সেই আইনের প্রস্তাবনাটি রচনা করেন।
একদম প্রথম না হলেও পেনই প্রথম মানুষ যিনি ইউনাইটেড স্টেটের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা দাবী করেছিলেন। ১৭৭৫ সালে অক্টোবরে স্বাধীনতার সনদে যারা স্বাক্ষর করেছিলেন তারা প্রত্যেকেই ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে মানিয়ে চলার আশা করেছিলেন। এ বিষয়ে পেন লিখলেন,
‘আমি বিশ্বাস করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত নই যে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর শেষ পর্যন্ত আমেরিকাকে ব্রিটেনের থেকে আলাদা করে দেবেন। তোমরা একে স্বাধীনতা বলেও ডাকতে পার আবার তোমাদের ইচ্ছে অনুযায়ী যা খুশী বলে ডাকতে পার, যদি তা ঈশ্বর ও মানবিকতার কারণে ঘটে তবে অবশ্যই তা চলতে থাকবে। যখন ঈশ্বর আমাদের আশীর্বাদ করবেন এবং আমাদেরকে এমন জনগণ রূপে তৈরি করবেন যারা তার উপর নির্ভরশীল, তখন তাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার জন্য আমাদের উচিত একটি উপমহাদেশীয় আইন প্রণয়ন করা যা নিগ্রোদের বিক্রি করার জন্য আমদানিকে বন্ধ করবে। তাদের নীতিকে কেউ তখন আর নরম বা কঠিন করে তুলতে পারবে না যা এখানে এখন বর্তমান এবং তাদের স্বাধীনতা যথাসময়ে অর্জিত হবে।’
কেবলমাত্র স্বাধীনতার খাতিরে– রাজতন্ত্র থেকে স্বাধীনতা, স্বাধীনতা অভিজাততন্ত্র থেকে, দাসত্ব থেকে এবং সবরকম স্বৈরাচারিতা থেকে যা পেন আমেরিকা গঠনের জন্য চেয়েছিলেন।
স্বাধীনতার যুদ্ধের কঠিন দিনগুলোতে তিনি সারাটা দিন প্রচার করে বেড়াতেন এবং রাতটা কাটাতেন ইস্তাহার রচনা করে যা common sense’ নামে প্রকাশিত হত। তাঁর রাতটা কাটাতেন ইস্তাহার সফলতা পেয়েছিল এবং বাস্তবিক পক্ষে এই জন্যই যুদ্ধে জয়লাভ সম্ভব হয়েছিল। ব্রিটিশরা মেনের ফলমাইথ ও ভার্জিনিয়ার নরফোক শহর পড়িয়ে দেবার পর, ৩১ শে জানুয়ারী ১৭৭৬ সালে ওয়াশিংটন তার এক বন্ধুকে লেখেন:
‘ফলমাউথ ও নরফোকের জ্বলন্ত দৃষ্টান্তজাত প্রশ্ন যা ‘common sense’ প্রকাশিত হবার পর কোন উত্তর পাওয়া যায়নি, সেই সব প্রশ্নের উপর ভিত্তি করেই স্বতন্ত্রতার যথার্থতা নিধারিত হবে।’
কাজটা ছিল সময়সাপেক্ষে বিষয়োপযোগী ও বর্তমানে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেখানে এমন কিছু শব্দগুচ্ছ আছে যেগুলো আজও বলা হচ্ছে। বিবাদ কেবল রাজার সঙ্গে নয়, বিবাদ সংসদের সঙ্গেও তা দেখবার পর, পেন বললেন, তাদের অধিকারসমূহ নিয়ে সংসদের নিম্নকক্ষ যতটা ঈর্ষান্বিত আর কেউ নয়, কারণ তারা তাদের বিক্রি করে দিয়েছে। সেই সময় এই ধরণের বিদ্রুপাত্মক বিচারকে অস্বীকার করাটা ছিল অসম্ভব।
প্রজাতন্ত্রের স্বপক্ষে জোরালো সমর্থন উত্থিত হয় এবং কেবলমাত্র রাজতন্ত্রই গৃহযুদ্ধকে রোধ করতে পারে এইরকম ধারণাকে নিদারুণভাবে খণ্ডন করা হয়। তিনি ইংরেজের ইতিহাসকে অতি সংক্ষেপে বর্ণনা করে বলেন, রাজতন্ত্র ও উত্তরাধিকার সমস্ত জগৎটাকে রক্ত ও ছাইতে শুইয়ে দিয়েছে। এটা এমন এক ধরণের সরকার যেখানে ঈশ্বরে বাণীকে বিরুদ্ধ সমালোচনা করা হয় এবং তাকে রক্তাক্ত করে তোলা হয়। ১৭৭৬ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন যুদ্ধের ভাগ্য বিরূপ আকার ধারণ করেছে। তখন পেন ‘The Crisis’ নামক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে প্রথমে এই কথা লিখলেন,
‘এটা এমন একটা সময় যখন মানব-আত্মাকে অনেক পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। এই সংকটে কষ্টসহিষ্ণু দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ও সূর্যস্নাত স্বদেশপ্রেমিক সবাই একে একে দেশের কাজের থেকে সরে যাচ্ছে, কিন্তু সব প্রতিকূলতা সহ্য করেও পিতৃভূমি যে ভাবে আজও দাঁড়িয়ে আছে তার জন্য এখন তিনি নারী ও পুরুষ উভয়েই প্রেম ও ধন্যবাদের যোগ্য।
ওয়াশিংটন এই প্রবন্ধটি তার সৈন্যবাহিনীর সম্মুখে পাঠ করে পেনকে এই কথা বলে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন যে এটা আপনার কাজের গুরুত্বের জীবন্ত দৃষ্টান্ত।’ আমেরিকা পেনের মতো এত জনপ্রিয় লেখক কেউ ছিলেন না। তিনি যদি চাইতেন তবে কলমের জোরে তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারতেন কিন্তু লেখা থেকে যে অর্থ তিনি পেতেন তা নিতে অস্বীকার করতেন। স্বাধীনতার যুদ্ধের শেষে সংযুক্ত রাষ্ট্রে তিনি চিরকালের জন্য শ্রদ্ধার আসনে বসলেন কিন্তু তখনও তিনি গরীব রইলেন। যদিও রাষ্ট্রের একটি আইন-সভা তাঁকে কিছু অর্থের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল এবং পরে আর একটি নতুন আইন-সভা তাকে একটি জমিদারী প্রদান করল। এইভাবে তাঁর বাকি জীবনে আরাম ও অবসরের সুযোগ মিললো। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সফল বিপ্লবীদের গুণাগুণ নিয়ে সম্মানিত হয়ে থাকতে পারতেন কিন্তু তিনি তা থাকলেন না। তিনি রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পথে এলেন। কিভাবে বড় বড় লোহার পাত দিয়ে ব্রিজ তৈরি করা যায় তা দেখালেন যা আগে অসম্ভব বলে ভাবা হত। লোহার ব্রিজ তৈরির সূত্র ধরে তিনি আবার ইংল্যান্ডে গেলেন এবং সেখানে ব্রুক, পোর্টল্যান্ডের ডিউক ও স্বনামধন্য হুইগরা তাকে বন্ধুর মতো স্বাগত জানালেন। প্যাডিংটনে তিনি তার বিরাট আকারের লোহার ব্রিজটি মডেল স্বরূপ তৈরি করলেন এবং প্রখ্যাত ইঞ্জিনিয়াররা তাকে প্রশংসা করলেন এবং এরপর তিনি তাঁর বাদবাকি জীবনটা একজন আবিষ্কারক হিসেবে কাটালেন।
ইংল্যান্ডের মতো ফ্রান্সও লৌহ ব্রিজের ব্যাপারে উৎসাহী ছিল। ১৭৮৮ সালে তিনি এই ব্যাপারে প্যারিসে গেলেন ও লাফায়েতসহ অন্যান্যদের সঙ্গে আলোচনা করলেন। এরপর তিনি তার পরিকল্পনাটি অ্যাকাডেমি দ্য সায়েন্সে পেশ করলেন। এই ব্যাপারে অ্যাকাডেমি তার রায় জানাতে একটু দেরি করলেও পরে রায়টি তার অনুকূলেই গিয়েছিল। বাস্তিল দুর্গের পতনের পর লাফায়েত কারাগারের চাবিকাঠি ওয়াশিংটনকে উপহার দেবেন বলে মনস্থ করলেন, এবং আটলান্টিক মহাসাগরের ওপারে তার উপহারটি ওয়াশিংটনের হাতে পৌঁছে দেবার জন্য তিনি টমাস পেনকে একমাত্র বিশ্বস্ত মনে করলেন। কিন্তু পেন তখন ইংল্যান্ডে ব্রিজ তৈরি করবার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাই তিনি ওয়াশিংটনকে এই জানিয়ে চিঠি লিখলেন যে তার পরিবর্তে এমন একজন বিশ্বস্ত মানুষকে প্রয়োজন যিনি নিরাপদে তাঁর হাতে সেই উপহারটি পৌঁছে দেবেন যে উপহারটি স্বৈরাচার অবসানের প্রথম স্মৃতিবিজড়িত চিহ্নস্বরূপ আমেরিকার আদর্শের প্রথম পাকা ফল হিসেবে ইউরোপে রোপিত হয়েছিল। এর পরে তিনি আরো লিখেছিলেন যে ফ্রান্সের বিপ্লবের সম্পূর্ণ সফলতা সম্পর্কে আমার আর কোন সন্দেহ নেই, এবং আরও লিখলেন যে আমি একটা ব্রিজ তৈরি করেছি (একটা খিলানের উপর) যেটি একশ দশ ফিট লম্বা এবং খিলানের উপর লোহার দড়ি থেকে সেটি পাঁচ ফুট উঁচু।
একটা সময় ব্রিজ নির্মাণ ও বিপ্লব তাঁর কাছে সমান ভাবে উৎসাহের বিষয় ছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার কাছে বিপ্লবটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। ইংল্যান্ডে সচেতনমূলক আন্দোলন গড়ে তোলার খাতিরে তিনি তাঁর ‘মানুষের অধিকার’ (Rights of man) প্রবন্ধটি রচনা করেন এবং যার ফলস্বরূপ গণতন্ত্রী হিসেবে তার খ্যাতি লাভ হয়।
এই কাজটি যা জ্যাকোবিন-বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়ার সময়টাতে একটা ভয়ঙ্কর সাহসিক বিপর্যয়রূপে চিহ্নিত তা আধুনিক পাঠককে বিস্মিত করবে তার সাধারণ জ্ঞান ও কোমলতার পরিচয়ে। এ প্রবন্ধটি প্রাথমিকভাবে ব্রুকের প্রশ্নের উত্তররূপে লেখা হয়েছিল এবং লেখাটির মধ্যে তৎকালীন ফ্রান্সের ঘটনাগুলির সম্যক বিচরণ ও তার উপর যথার্থ আলোচনা ছিল। এই গ্রন্থটির প্রথম অংশটি প্রকাশিত হয় ১৭৯১ সালে, দ্বিতীয়টি প্রকাশিত হয় ১৭৯২ সালে। সুতরাং বিপ্লবের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার দায়ে তার ক্ষমা চাইবার কোন জায়গা নেই। এই গ্রন্থটির একটি ছোট্ট জায়গায় প্রাকৃতিক অধিকার সম্পর্কে অল্প মর্মস্পর্শী লেখা তিনি লিখেছিলেন, কিন্তু সেখানে ব্রিটিশ সরকার সম্পর্কে তাঁর পরিচ্ছন্ন গভীর বোধের পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। ব্রুক এইভেবে প্রশান্তি লাভ করেছিলেন যে ১৬৮৮ সালের বিপ্লবের ফলে অ্যাক্ট অব সেটলমেন্টের দ্বারা চিরকালের জন্য ব্রিটিশরা সার্বভৌম শক্তির বশ্যতা মানতে বাধ্য হল। পেন কিন্তু ব্রুকের মতো ভেবে প্রশান্তি লাভ করলেন না, তিনি এই ভেবে প্রশান্তি লাভ করেছিলেন যে সমৃদ্ধিকে কখনও আর বাধা যাবে না এবং সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংবিধান সংশোধন অবশ্যই ঘটবে।
তিনি লিখলেন, সরকারগুলোকে তিনটি মূল বিষয়ের অন্তর্গতরূপে ভাবা যেতে পারে। প্রথম, কুসংস্কার, দ্বিতীয়, ক্ষমতা, তৃতীয়, সমাজের সাধারণ স্বার্থ ও মানুষের সাধারণ অধিকার হিসেবে। প্রথমটি হল পুরোহিতদের সরকার, দ্বিতীয়টি হল বিজিতদের সরকার এবং তৃতীয়টি হল বুদ্ধির দ্বারা নির্মিত সরকার। প্রথম দুটি এক জায়গায় মিলেমিশে গেল এবং তা ‘সেন্ট পিটারের চাবিকাঠি ও ধনভাণ্ডারের চাবিকাঠিতে পরিণত হল, এবং পরবর্তীকালে তা আরও কয়েকটি টুকরো হয়ে নানা রকম ভণ্ড ও জোচ্চোর ধরণের পূজারী সরকারের সৃষ্টি করল। এই ধরণের অসাধারণ পর্যবেক্ষণ সত্যই অপ্রতুল। তার বেশিরভাগ কাজ প্রথমে ১৭৮৯ সাল থেকে ১৭৯১ সালের শেষ পর্যন্ত ফ্রান্সের ইতিহাস সম্পর্কে এবং দ্বিতীয়টি ব্রিটিশ সংবিধানের সঙ্গে ১৭৯১ সালের ফ্রান্সের রায়ের তুলনা সম্পর্কীয়, তবে এই কাজে ফ্রান্স, তার কাছ থেকে বেশি উপকার পেয়েছে। এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে ১৭৯১ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সে রাজতন্ত্র ছিল। পেন ছিলেন প্রজাতান্ত্রিক এবং তা তিনি কখনই গোপন করেননি, কিন্তু তিনি ‘মানবের অধিকারসমূহ’ নামক গ্রন্থে সে সম্পর্কে খুব একটা জোরও দেননি।
কিছু কিছু সংক্ষিপ্ত আলোচনার ক্ষেত্র ছাড়া পেন সর্বদা সাধারণ চেতনার কাছে তাঁর আবেদন করেছেন। পিসের অর্থনীতির বিরুদ্ধে তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন এমন কারণের, যে কারণের উপর ভিত্তি করে রাজস্ববিভাগের সভাপতির কাছে আবেদন করা একান্ত উচিত। পেনের পথ অনুসরণ করে পরে কবেটও একই কাজ করেন। তিনি সেই ডুবে যাওয়া অর্থভাণ্ডারের পরিপ্রেক্ষিতে বিরাট অঙ্কের টাকা ধার করাটাকে তুলনা করলেন খরগোশ ধরবার জন্য একটা মানুষকে হাতে লাঠি ধরিয়ে বসিয়ে রাখার সঙ্গে যত দূর খরগোশরা ছোটে, ততদূর বসে থাকা মানুষটা সরে যায়। তিনি কবেটের পথ অনুসরণ করে রাজস্ববিভাগকে কাগজের টাকা বানাবার কুমোরের কারখানা এই শব্দগুচ্ছ প্রয়োগ করে তার উপর আলোচনা করলেন। বস্তুত অর্থভাণ্ডারের উপর তাঁর লেখা কবেটের সঙ্গে তার পূর্বের শত্রুতাকে মুছিয়ে দিয়ে সে জায়গায় তার প্রতি কবেটের প্রশংসা এনে দিল। তাঁর বংশানুক্রমিক আদর্শের প্রতি আপত্তি যা ব্রুক এবং পিটকে আতঙ্কগ্রস্ত করেছিল তা আস্তে আস্তে হিটলার ও মুসোলিনি সমেত সমস্ত রাজনীতিবিদদের কাছে সাধারণভাবে গ্রাহ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াল। তার লেখার শৈলী কখনই উদ্ধত ধরণের ছিল না। তার লেখা ছিল পরিষ্কার, অকপট, প্রাণবন্ত, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধ পক্ষের লেখার মতো কখনই গালাগালিপূর্ণ ছিল না।
শুধু তাই নয়, পিট মনস্থ করেছিলেন যে পেনের বিরুদ্ধে মকদ্দমা করেও তার মানব অধিকারসমূহ’ নামক গ্রন্থটি বাতিল করে তিনি তাঁর সন্ত্রাসের রাজত্ব শুরু করবেন। তাঁর ভ্রাতুস্পুত্রী লেডি হেসটার স্ট্যানহোপের মতে তিনি রোজই বলতেন টম পেন সর্বদাই সত্যের পক্ষে, কিন্তু তার পর আবার বলতেন, আমাকে আর যে কি করতে হবে? আসল কথাটা হল যদি আমরা টম পেনের মতামতকে মেনে নিই তবে আমাদের বিশ্রী ধরণের বিপ্লবে জড়িয়ে পড়তে হবে। পেন এই মকদ্দমার প্রত্যুত্তর হিসেবে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। কিন্তু সেপ্টেম্বরের গণহত্যার পর ইংরেজ টোরিরা বর্ধিত আগুনে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়ল। জাগতিক প্রজ্ঞায় অনেক বড় হয়েও কবি ব্লেক পেনকে প্ররোচিত করে বলেন যে তিনি যদি ইংল্যান্ডে থাকেন তার ফাঁসি হবে। কর্মরত যে পুলিশ অফিসাররা তাকে ধরতে এসেছিল তাদের ফাঁকি দিয়ে তিনি ফ্রান্সে পালিয়ে যান। যাবার আগে কিছু ঘন্টা তিনি লন্ডনে থাকেন এবং সেখান থেকে তিনি কিছুক্ষণের জন্য ডোভারে আসেন এবং সেখানে তিনি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ফ্রান্সে যাবার অনুমতি পান, কেননা সেই কর্তৃপক্ষ কিছুদিন আগে ওয়াশিংটনের কাছ থেকে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ চিঠি পান যেখানে তিনি টমাস পেনকে সুযোগ সুবিধা দেবার কথা বলেছিলেন।
তখন ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড জড়িয়ে পরেনি, ফলে ডোভার ও কালেই একটি স্বতন্ত্র জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিল। পেন ফ্রান্সের সাম্মানিক নাগরিকতা পেলেন, যার ফলে তিনি তিনটি নির্বাচন এলাকার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন, যার মধ্যে কালেই তাকে সঙ্গে সঙ্গে নিজের এলাকায় অভ্যর্থনা জানায়। তাকে সম্মানীয় অতিথি হিসেবে শ্রদ্ধা জানাতে তারা তোপ দাগলো এবং সেই সঙ্গে তীরে দাঁড়ানো হাজারো মানুষ তাঁর জয়ধ্বনি করে উঠলো। কালেই-এর প্রতিনিধি হিসেবে তিনি যখন ফ্রান্সের মাটিতে পা রাখলেন তখন সৈনিকরা তাঁকে রাস্তা করে নিয়ে গেল, বড় বড় অফিসাররা তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন এবং তাঁকে জাতীয় ফুল উপহারস্বরূপ দেওয়া হল। তার পরে ফরাসী কায়দায় আরো অনেক রকম সাম্মানিক আচরণ তার সঙ্গে করা হল, বহু সুন্দরী মহিলা ও মেয়র তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন।
প্যারিসে পৌঁছে তিনি অহঙ্কারের জায়গায় অনেক বেশি জনতা-হৃদয় সম্পন্নতা দেখালেন। তিনি আশা করেছিলেন ফ্রান্সে গণহত্যার জায়গায় একটি নিয়মানুবর্তী বিপ্লবের উত্থান হবে যা তিনি আমেরিকায় গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিলেন। তিনি গিরাডিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন, লাফায়েৎ সম্পর্কে বাজে চিন্তা ছেড়ে দেন (যা এখন লজ্জাজনক), এবং একজন আমেরিকানের মতো তিনি চতুর্দশ লুইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করেন, কেননা তিনি স্বাধীনতার যুদ্ধে সংযুক্ত রাষ্ট্রকে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে রাজার শিরোচ্ছেদের বিরোধিতা করে জ্যাকোবিনদের রোষে পড়েন। তাঁকে প্রথমে সাম্মানিক অতিথির সম্মান থেকে বরখাস্ত করা হয়, পরে একজন বিদেশী হিসেবে তাকে বন্দী করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। রোবসপীয়ের যতদিন ক্ষমতায় আসীন ছিলেন তার কিছু মাস পরে পর্যন্ত পেন কারাগারে বন্দী ছিলেন। যদিও তাঁর এই অপমানের দায় ফ্রান্সের ছিল তবে তা ছিল আংশিক। এর পেছনে আমেরিকান মন্ত্রী গুর্ভারনিয়ার ছিলেন সমানভাবে দায়ী। গুর্ভারনিয়ার ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র মতবাদী এবং তিনি ফ্রান্সের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের পক্ষ নিয়েছিলেন। আসলে গুর্ভারনিয়ার এই কাজ করেছিলেন পুরোনো প্রতিহিংসা মেটাবার জন্য। কেননা তিনি স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় গুর্ভারনিয়ারের কোন বন্ধুর বাজে কাজ ফাঁস করে দিয়েছিলেন। এরই জের টেনে তিনি পেন সম্পর্কে বলেছিলেন যে তাঁকে কোনরকম সাহায্য তিনি করতে পারবেন না। ওয়াশিংটন গোপনে ইংল্যান্ডের সঙ্গে জের চুক্তিতে আবদ্ধ হন, তিনি পেনকে এই অবস্থায় দেখেও কোনরকম সহানুভূতি প্রদর্শন করলেন না পাছে পেন ফরাসী সরকারকে আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল করে তোলেন। আকস্মিকভাবে তিনি গিলোটিন থেকে রেহাই পান, কিন্তু মারাত্মক শরীর খারাপের ফলে তিনি প্রায় মরতে বসেছিলেন। শেষে মরিসের বদলে মনরো আসেন যিনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুক্তির ব্যবস্থা করে দেন এবং তাঁকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আঠারো মাস ধরে আন্তরিকতা ও যত্নের সঙ্গে সারিয়ে তোলেন।
পেন জানেননি মরিস তার দুর্ভাগ্যের জন্য কি পরিমাণ দায়ী ছিলেন, কিন্তু তিনি ওয়াশিংটনকে কখনও ক্ষমা করতে পারেননি। ওয়াশিংটনের মৃত্যুর পর মানুষ হিসেবে তাঁর মর্মরমূর্তি নির্মাণের খবর শুনে, তিনি ভাস্করকে নীচের পঙক্তিগুলি শুনিয়েছিলেন,
খনি থেকে তোল শিল্পী
যে ঠান্ডা কঠিন পাথর
তাই যে ওয়াশিংটন,
আবার মূর্তির কি প্রয়োজন!
তবুও যদি চাও,
তোমার কঠিন হাতে আঘাত হেনে
তার বুকেতে গভীর করে
‘অকৃতজ্ঞ’ লিখে দাও।
তিনি ওয়াশিংটনকে একটি দীর্ঘ ও তিক্ত পত্র লেখেন যেটি বহুদিন অপ্রকাশিত থাকার পর ১৭৯৬ সালে প্রকাশিত হয় এবং যে পত্রটি শেষ হয় এই বলে :
‘এবং আপনার সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় যে মহাশয়, আপনি ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে একজন বিশ্বাসঘাতক মানুষ (কেননা বিপদের সময় আপনি এরকমই আচরণ আমার সঙ্গে করেছেন), এবং জনগণের জীবনের ক্ষেত্রে একজন ভণ্ড মানুষ, এবং আপনি একজন স্বধর্মত্যাগী না প্রতারক তা নিয়ে জগৎ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বিহ্বল হয়ে পড়বে এই সিদ্ধান্ত নিতে যে আপনি মঙ্গলজনক আদর্শ পরিত্যাগ করেছিলেন না কোনদিনই তেমন কোন আদর্শ আপনার ছিল না।’
যারা কেবল ইতিহাসের ঐতিহ্যময় ওয়াশিংটনকে চেনেন তারা এই ধরণের পত্রকে বর্বরোচিত বলে মনে করতে পারেন। কিন্তু ১৭৯৫ সালে রাষ্ট্রপতির পদ নিয়ে জেফারসন ও অ্যাডামসের মধ্যে নির্বাচনের লড়াইতে ওয়াশিংটন অ্যাডামসকে সমর্থন করলেন একথা জেনেও যে অ্যাডামস রাজতন্ত্র ও সম্ভ্রান্ত শ্ৰেণীর সমর্থক। শুধু তাই নয়, তিনি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের পক্ষ নিলেন এবং যে প্রজাতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক আদর্শ নিয়ে তিনি আমেরিকার উচ্চ স্থানে এসেছিলেন সেই আদর্শের বিরুদ্ধে তিনি তাঁর সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। জনগণের পক্ষ নিয়ে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসাজাত পত্রটি প্রমাণ করে যে পেনের কথাগুলো বেঠিক ছিল না।
পেনকে বন্দীদশার করুণ অবস্থায় ফেলে রেখে যাওয়াটা ওয়াশিংটনের পক্ষে খুবই কষ্টকর হয়ে উঠত যদি না এই জেদি মানুষটি তার শেষে মুক্ত জীবনগুলিতে ধর্মতত্ত্বের উপর সেই সব মতামত প্রকাশ করে দিন কাটাতেন, যে মতামতকে ভিত্তি করে তিনি ও জেফারসন মেনে নিতে পেরেছিলেন ওয়াশিংটন ও অ্যাডাম্সকে যারা ধর্ম বিষয়ে জনগণের যে-কোন রকম শিথিলতাকে যত্নসহকারে এড়িয়ে যেতেন। নিজের দূরদৃষ্টির ফলে নিজের বন্দীদশাকে আগে থেকে জানতে পেরে যুক্তির যুগ’ (The age of reason) প্রবন্ধটি লিখতে শুরু করেন, এবং গ্রন্থটির প্রথম ভাগটি লেখা শেষ করার ছয় ঘণ্টার পর তিনি গ্রেফতার হন। এই গ্রন্থ তাঁর সমসাময়িক ব্যক্তিদের আহত করে এবং তাদেরকেও আহত করে যারা তাঁর রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। বর্তমানে এই গ্রন্থটির কিছু বাজে লেখা ছেড়ে দিলে বাদবাকি যে লেখাগুলি পড়ে থাকবে তা খুব কম যাজকই অস্বীকার করে উঠতে পারবেন। প্রথম অধ্যায়ে তিনি লেখেন,
‘আমি একটিমাত্র ভগবানে বিশ্বাসী এবং আমি এজীবনের পরেও সুখ-আশা করি।
‘আমি মানুষের সমতায় বিশ্বাসী, এবং আমি বিশ্বাস করি যে ধর্মীয় কর্তব্যসমূহ নির্ভর করে ন্যায়বিচার, প্রেমময় করুণা এবং মনুষ্যজাতিকে সুখী করার প্রচেষ্টার মধ্যে।’
এই সমস্ত কথাগুলো মোটেই ফাঁকা বুলি ছিল না। জনগণের সেবায় ব্রতী হবার প্রথম দিন থেকেই তিনি যে-কোন রকম নিষ্ঠুরতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। ১৭৭৫ সালে তিনি দাসত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এবং মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত নিজের সমর্থিত দলের কিংবা বিরুদ্ধ দলের কোনরকম নিষ্ঠুরতাকে বরদাস্ত করেননি। সেই সময় ইংল্যান্ডে কতিপয় ব্যক্তির নিষ্ঠুর শাসন চলছিল। তারা সংসদকে নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করে গরীব শ্রেণীকে আরও গরীব করে তুলেছিল। পেন এই ধরণের জঘন্য শাসনের রাজনৈতিক সংস্কার চাইলেন। ফলস্বরূপ তাকে সে দেশ ছাড়তে হল নিজের জীবন বাঁচাতে। ফ্রান্সে গণহত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন এবং অল্পের জন্য মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেলেন। আমেরিকার দাসত্বপ্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এবং স্বাধীনতা ঘোষণার আদর্শকে সমর্থন করে তিনি সেখানকার সরকারের দ্বারা পরিত্যক্ত হলেন ঠিক তখন যখন তাঁর ওই সরকারের সমর্থন খুব দরকার ছিল। তাঁর ধর্মমতকে এখন অনেকেই মেনে থাকেন। তিনি যে ধর্মমত পোষণ করতেন এবং সারাটা জীবন মেনে চলতেন তা হল সত্য ধর্ম বলতে বোঝায় ন্যায়বিচার, প্রেমময় করুণা প্রদর্শন এবং মানবজাতিকে সুখী করবার প্রচেষ্টা। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর মধ্যে এমন কেউ ছিলেন না যিনি নিজেকে এই বিচারে একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ বলতে পারেন।
‘যুক্তির যুগ’ নামক গ্রন্থটির বেশিরভাগ অংশ নৈতিক দিক থেকে ওল্ড টেষ্টামেন্টের সমালোচনা। বর্তমান যুগে খুব কম মানুষই Pentateuch এবং Book of Joshua-তে ধর্মের নামে নারী, পুরুষ ও শিশুকে নির্বিচারে হত্যার যে ঘটনার কথা নথিভুক্ত আছে তা মানতে পারবেন। কিন্তু পেনের সময়ে ইজরায়েলীয় ধর্মকে নিন্দা করাটা অপবিত্র বলে মনে করা হত কেননা তারা ওল্ড টেষ্টামেন্টের দ্বারা মনোনীত ছিল। এর ফলে অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষ তাকে চিঠি লিখে তাদের উত্তর জানিয়েছিল। এদের মধ্যে উদারপন্থী ল্যান্ডফের বিশপ Pentateuch-এর ঘটনা মমাজেসের দ্বারা লিখিত নয় বলে প্রচার করেন এবং জালমা-র (Psalma) নয় বলে দাবী করেন। এইজন্য তিনি তৃতীয় জর্জের শত্রুতাকে দায়ী করেন যার জন্য ডেভিডের রচনাকে ঠিক মতো অনুবাদ করা যায়নি। কিছু কিছু বিশপ প্রত্যুত্তরে বলেন যে পেন একজন কৌতূহলী মানুষ ছাড়া আর কিছুই নন। উদাহরণস্বরূপ ‘যুক্তির যুগ’ গ্রন্থটি এই সন্দেহ করে এগিয়েছে যে সত্যই ঈশ্বর মিডিয়ানটিয়দের মধ্যে নারী-পুরুষ-শিশু হত্যা করার আদেশ দিয়েছিলেন না দেননি। কেননা অল্পবয়স্ক মেয়েদের রক্ষা করাটাই তখন ধর্ম ছিল। বিশপ রেগে গিয়ে প্রত্যুত্তর দিয়েছিলেন যে অল্পবয়স্ক মেয়েদের কখনই অবৈধ কার্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে রক্ষণ করার নিয়ম ছিল না যে রকম পেন বিশ্রীভাবে বলতে চেয়েছেন, তবে দাসী হিসেবে তাদের রক্ষণ করাটাকে নৈতিক দিক থেকে আপত্তি করার কিছু নেই বলে জানান বিশপ। আমাদের সময়ে গোঁড়া ধর্মাবলম্বীরা হয়ত ভুলে গেছেন আজ থেকে একশচল্লিশ বছর আগে গোঁড়া ধর্মাবলম্বী বলতে ঠিক কি বোঝাত। ধর্মমতকে নরম করতে গিয়ে কি ধরণের অত্যাচার পেনকে সেই সময় সহ্য করতে হয়েছিল যার ফলস্বরূপ আজকে আমাদের যুগটা লাভবান। কবরের ভারপ্রাপ্ত পুরোহিতরাও পেনের মৃত্যুর পর তাদের কবরভূমিতে তাঁর দেহ কবরস্থ করার অনুমতি দেয়নি। শেষ পর্যন্ত ঐরকম একজন কৃষক পুরোহিত (যারাও সংখ্যায় খুব কমই আছে) পেনের নশ্বর দেহকে কবরস্থ করে।
‘যুক্তির যুগ’ প্রকাশিত হবার পর পেনের রচনাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবাটা বন্ধ হয়ে গেল। অনেক দিন ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু যখন তিনি আরোগ্য লাভ করলেন তখন তিনি দেখলেন ফ্রান্সের জ্ঞাতব্য বিষয়ক পুস্তকে তার কোন জায়গা নেই, এমন কি প্রথম কনসালেও তার কোন জায়গা নেই। নেপোলিয়ন যদিও তাঁর সঙ্গে কোনরকম খারাপ ব্যবহার করেননি, তবুও তার তাকে তেমন কোন দরকার হয়নি কেবলমাত্র ইংল্যান্ডে তাকে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের আন্দোলনের একজন সম্ভাব্য এজেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা ছাড়া। এরপর তিনি আমেরিকায় থাকবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন এবং যুক্তরাষ্ট্রবাদীদের বিরুদ্ধ পক্ষ জেফারসন অনুরাগীদের কাছে এ বিষয়ে সাহায্য চান। কিন্তু ইংরেজদের হাতে ধরা পড়লে তার ফাঁসি অবধারিত ছিল। এরপরে ১৮০২ সালে তিনি বালতিমোরে এসে নামেন এবং সঙ্গে সঙ্গে জেফারসনকে একটি চিঠি লেখেন (জেফারসন তখন রাষ্ট্রপতি) :
ষাট দিন ধরে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে হ্যাঁভার থেকে আমি শনিবার এখানে এসে পৌঁছলাম। আমার অনেক রকম মডেল ও চাকা প্রভৃতি অনেক কিছু নিয়েছিলাম এবং জর্জটাউনের জন্য নেওয়া জিনিসের মোড়কগুলো জাহাজে তোলা মাত্রই আমি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা আপনার প্রতি জ্ঞাপন করলাম। আপনার বাধিত অনুরাগী নাগরিক, টমাস পেন।
কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্রবাদী ছাড়া তাঁর বাদবাকি পুরোনো বন্ধুরা যে তাকে স্বাগত জানাবেন এ বিষয়ে তার কোন সন্দেহ ছিল না। কিন্তু একটা অসুবিধা ছিল। রাষ্ট্রপতি পদের জন্য জেফারসন মরণপণ লড়ছিলেন। নির্বাচনী প্রচারে তার বিরুদ্ধে সব থেকে বড় যে-অস্ত্রটি তার বিরোধী সমস্ত দলের মন্ত্রীরা ব্যবহার করে আসছিল তা হল তার বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ। তার বিরোধী দল তাঁর সঙ্গে পেনের অন্তরঙ্গতাকে বড় করে দেখিয়ে দুজনকে একজোড়া ব্যভিচারী বলে প্রচার করছিল। কুড়ি বছর পরেও স্বদেশবাসীর এই ধর্মীয় গোঁড়ামী দেখে তিনি এতটাই আশ্চর্য হয়েছিলেন যে তিনি ঈশ্বরের ত্রিমূর্তিবাদে অবিশ্বাসী একজন মন্ত্রী যিনি তাঁর একটি চিঠি প্রকাশ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তাঁকে প্রত্যুত্তরে লিখেছিলেন, না, শ্রদ্ধেয় মহাশয়, সমস্ত জগতের জন্য নয়। … আমার খুব তাড়াতাড়ি বেড় লামের পাগল খুলিটাকে নিয়ে আসা উচিত যে বকবক করে আথানাসীয়দের মনে যুক্তিকে প্রতিষ্ঠা করবে…তাই ক্যালভিনের কাঠ ও আগুন এবং তার বলি সারভেটাসের থেকে আমাকে বাঁচান। এই কারণে এটা খুব আশ্চর্যের বিষয় নয় যে যখন সারভেটাসের নিয়তি তাদের হুমকি দিচ্ছিল তখন জেফারসন ও তার রাজনৈতিক অনুরাগীরা পেনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক রাখার লজ্জাকে ঢাকার চেষ্টা করবে এবং অস্বীকার করবে। পেনের সঙ্গে দ্র ব্যবহার করা হয়েছিল ফলে অভিযোগ করার কোন উপায়ই নেই, কিন্তু পুরোনো সেই সহজ বন্ধুত্বের সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল।
তাঁর অন্যান্য বন্ধুদের কাছে তাকে আরও খারাপ অবস্থায় পড়তে হয়েছিল। আমেরিকায় তাঁর প্রথম বন্ধুদের মধ্যে একজন ফিলাডেলফিয়ার ডাক্তার রুশ তার জন্য কিছুই করেননি। রুশ লেখেন, তাঁর যে আদর্শের কথা তিনি যুক্তির যুগ নামক গ্রন্থটিকে অকপটে বলতে পেরেছেন তা আমাকে এতটাই অসন্তুষ্ট করেছে যে আমি তার সঙ্গে আর নতুন করে কোন সম্পর্ক তৈরি করতে ইচ্ছুক নই। তিনি নিজের প্রতিবেশীদের কাছে ছিলেন অত্যাচারিত এবং স্ট্যাগ কোচে (বগা-হরিণ বাহিত গাড়ি) তাকে কোন বসবার জায়গা দেওয়া হত না। তাঁর মৃত্যুর তিন বছর আগে থেকে তাকে ভোট দিতে দেওয়া হত না এই অভিযোগে যে তিনি একজন বিদেশী। তাঁকে অনৈতিক ও অমিতাচারী বলে অভিযুক্ত করা হয় এবং তাঁর জীবনের শেষ বছরগুলোতে তাঁকে একাকিত্ব ও দারিদ্রে কাটাতে হয়। তিনি মারা যান ১৮০৯ সালে। যে সময় তিনি মারা যাচ্ছেন তখন দুজন পাদ্রী তাঁর ঘরে জোর করে ঢুকে তাঁকে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত করতে চান, তখন তিনি অনেক কষ্টে একবার বলেন, আমাকে একা থাকতে দিন, সুপ্রভাত। এতদসত্ত্বেও গোঁড়া ধর্মাবলম্বীরা বলে বেড়ালেন মৃত্যুশয্যায় তার ভুল স্বীকারোক্তির কথা যা সবাই বিশ্বাস করে থাকে।
মৃত্যুর পর তাঁর খ্যাতি আমেরিকার চেয়ে ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ে বেশি। তাঁর রচনাগুলো প্রকাশ করা বেআইনী ছিল, কিন্তু তা বারবার প্রকাশিত হতে লাগলো। যদিও বেআইনীভাবে প্রকাশ করার জন্য বহু মানুষ কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। ১৮১৯ সালে পেনের রচনা প্রকাশ করার জন্য সর্বশেষ অভিযুক্ত করা হয়েছিল রিচার্ড কারলাইল ও তার স্ত্রীকে। তাঁকে তিন বছরের জন্য দণ্ড দেওয়া হয়েছিল ও তার উপর পনেরোশো পাউন্ড জরিমানা ধার্য করা হয়েছিল। তার স্ত্রীকে দণ্ড দেওয়া হয়েছিল এক বছরের জন্য ও পাঁচশো পাউন্ড জরিমানা ধার্য করা হয়েছিল। এই বছরেই কবেট পেনের অস্থি ইংল্যান্ডে নিয়ে আসেন এবং ইংল্যান্ডে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বীরযোদ্ধাদের অন্যতম যোদ্ধা হিসেবে তার খ্যাতিকে প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও তাঁর অস্থিকে চিরস্থায়ী বিশ্রামের জায়গা দিতে পারেননি। মনকিয়োর কনওয়ে (পেনের জীবনী ও তাঁর রচনাগুলি লেখা ও প্রকাশ করার ক্ষেত্রে যিনি যথেষ্ট নিষ্ঠা ও যত্নের পরিচয় দিয়েছেন। বলেছেন, যে স্মৃতিস্তম্ভের চিন্তা কবেট করেছেন তা কোনদিনই গড়ে উঠবে না। এই ঘটনাটিকে নিয়ে ইংল্যান্ডের সংসদে ও পৌরসভায় যথেষ্ট উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। বোলটনের শহর-ঘোষক পেনের অস্থি পৌঁছনোয় খবর ঘোষণা করার জন্য তিন সপ্তাহের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। ১৮৩৬ সালে পেনের অস্থি কবেটের হাত থেকে পশ্চিমের এক গ্রহীতার কাছে যায়। লর্ড চ্যান্সেলার পেনের অস্থিকে সম্পদ হিসেবে মানতে অস্বীকার করেন। ফলে সেই অস্থি ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত একজন দিনমজুরের দ্বারা রক্ষিত হয়, তারপর তা ১৩ নম্বর বেডফোর্ড স্কোয়ারে, লন্ডনের এক ফার্নিচার ব্যবসায়ী বি. টিলির হাতে যায়…১৪৫৪ সালে রেভারেন্ড আর এইনস্নি (ইউনিটারিয়ান) ই, ট্রলাভকে বলেন যে তিনি টমাস পেনের খুলি ও ডান হাতের হাড়টি কিনেছেন, কিন্তু তার এই কথা সত্য কিনা তা যথেষ্ট অনুসন্ধান সাপেক্ষ। তাঁর নশ্বর দেহের কোন কিছুই আর পড়ে নেই, এমনকি তার খুলি বা ডান হাতটিও কোথাও পাওয়া যায় না।
পৃথিবীতে পেনের প্রভাব দু’ধরনের। আমেরিকার বিপ্লবের সময় তিনি উৎসাহ ও দৃঢ়তার জন্য প্রেরণা জুগিয়েছেন এবং বিপ্লবে জয়লাভের জন্য বহু কিছুই করেছেন।
ফ্রান্সে তার জনপ্রিয়তা ছিল ক্ষণস্থায়ী ও কৃত্রিম, কিন্তু ইংল্যান্ডে তিনি পিট ও লিভারপুলের দীর্ঘ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সাধারণ শ্রেণীর হয়ে কঠোর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। বাইবেলের উপর তার মতামতসমূহ তার ঈশ্বরের ত্রিমূর্তিবাদে অবিশ্বাসের থেকে অনেক বেশি তার সমসাময়িকদের অসন্তুষ্ট করেছিল, অথচ আজ কোন এক আর্চবিশপ ওই মতবাদই পোষণ করছেন। কিন্তু যারা সত্যিই তাঁর অনুরাগী ছিল তারা ছিল সেই সব মানুষ যারা তাঁর আদর্শকে গ্রহণ করে আন্দোলন করে পিটের নির্দেশে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। সেইসব মানুষদের কেউ ছিল Owenites, Chartists, Trade unionist ও Socialist যারা Sixth Acts-এর দ্বারা ক্লেশ ভোগ করেছিল। এই সমস্ত অবদমিত বীরদের কাছে সাহস, মানবিকতা ও সম-মনোভাবাপন্নতার উদাহরণ তিনি নিজেকে দিয়েই রেখে গেছেন। যখনই জনসাধারণের কোন ব্যাপার তার কাছে এসেছে তখনই তিনি তাঁর ব্যক্তিগত অহঙ্কারের কথা ভুলে গেছেন। তাঁর নিজের প্রতি এই অনীহার জন্য জগৎ তাকে শাস্তি দিয়েছে। যদি তিনি একটু কম দয়ালু হতেন, একটু কঠোর হতে পারতেন, তবে বোধহয় আজ তিনি খ্যাতির চূড়ায় উঠতে পারতেন। প্রশংসাকে ধরে রাখতে গেলেও কিছুটা জাগতিক প্রজ্ঞার প্রয়োজন হয়।