০৮. জীবনদর্শনের পার্থক্য

জীবনদর্শনের পার্থক্য

যুদ্ধের সতেরো দিনের দিন কর্ণের মৃত্যু হয়। আঠারো দিনের আধবেলার সেনাপতি ছিলেন শল্য। কিন্তু তার আগেই তাঁর বেশি পরিচয়; কর্ণের সেনাপতিত্বকালে শল্য ছিলেন কর্ণের সারথি। মদ্র বা বাহ্লীক দেশের রাজপুত্র শল্য, মাদ্রীর ভাই। দ্রৌপদীর স্বয়ংবরে শল্য ধনুতে জ্যা আরোপ করতে পারেননি। শল্যকে প্রথম থেকেই দেখি আনুগত্যের ব্যাপারে দ্বিধান্বিত। ইচ্ছে ছিল পাণ্ডবপক্ষে যুদ্ধ করার; কিন্তু দুর্যোধন তাকে এমন খাতির করেন যে, তিনি কৌরবপক্ষেই যোগ দেন। তবু যুদ্ধের ঠিক আগে পাণ্ডবদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের বিজয়কামনা ও আশীর্বাদ জানান। তাঁর পাণ্ডবকৌরবপক্ষ সম্বন্ধে দোলাচলচিত্ততা বুঝতে পেরে যুধিষ্ঠির তাঁর কাছে অনুরোধ করেন যেন শল্য যুদ্ধক্ষেত্রে কর্ণের সারথি হন এবং কর্ণকে তেজভ্রষ্ট করেন।[১] এখানে একটা কথা আছে: সারথির দুটি কাজ, একটা রথ সম্বন্ধে, অর্থাৎ সাবধানে বিপদ এড়িয়ে কৌশলে রথ চালানো; আর দ্বিতীয় কাজ হল, রথারূঢ় যোদ্ধাকে অস্ত্র, বাণ, ইত্যাদি এগিয়ে দেওয়া এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল, রথীকে প্রশংসা করে, অভয় দিয়ে, তাকে অজেয় বলে উল্লেখ করে, তার মনোবল অক্ষুণ্ণ রাখা।

যুদ্ধক্ষেত্রে শল্য কর্ণকে প্রশংসা করা দূরে থাক, বারবার বলেছেন, অর্জুনকে কেউ জয় করতে পারবে না। তিনি দুর্ধর্ষ ধনুর্বিদ, তাঁর জ্ঞান, কৌশল ও অস্ত্রসিদ্ধির সামনে কেউ দাঁড়াতেই পারে না, অর্জুনকে যুদ্ধে পরাস্ত করার চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। এটা সারথির ধর্মবিরুদ্ধ, মিত্রপক্ষের লোকের ভূমিকায় থেকে শত্রুপক্ষের কাজ করেছেন শল্য। তাঁর কর্ণের সারথি হতে অস্বীকার করা উচিত ছিল; যেহেতু তাঁর মনের আনুগত্য পাণ্ডবপক্ষে। অথবা এ সত্ত্বেও যখন সারথি হয়েছিলেন তখন যুধিষ্ঠিরের কাছে পাণ্ডবপক্ষে আনুগত্য সম্বন্ধে কথা দেওয়া[২] অন্যায়, অধর্মীয় প্রতিশ্রুতি— অর্জুনের প্রশংসা করে, কর্ণের আপেক্ষিক অক্ষমতার কথা উল্লেখ করে কর্ণের মতো অস্ত্রজ্ঞ বীরের মনোবল নষ্ট করার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা তাঁর উচিত ছিল না। এখানে শল্য সম্বন্ধে পাঠকের মনোভাব দ্বিধা-বিভক্ত হতে বাধ্য। প্রাথমিক আনুগত্য তাঁর কৌরবপক্ষে, অথচ ষড়যন্ত্রীর মতো গোপনে তিনি যুধিষ্ঠিরের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছেন যে, যথার্থ সারথির ভূমিকা তিনি পালন করবেন না বরং কৌরবদের শত্রুতা করবেন। যুদ্ধের নীতি অনুসারে তাঁর ভূমিকা অত্যন্ত গর্হিত, কাজেই শল্য সম্বন্ধে পাঠক অবজ্ঞা ও ঘৃণা বোধ করেন। কর্ণ নানা দোষে দোষী, এমনকী রথের চাকা বসে যাওয়ার পিছনেও তাঁর পূর্ব অপরাধের অভিশাপই ছিল সক্রিয়। কিন্তু কুচক্রী শল্যের কোনও মার্জনা নেই। এবং এ-ই হল কৌরবদের শেষ সেনাপতি। দায়িত্ব পালন করা দূরে থাক, বিশ্বাসঘাতকতা করলেন কর্ণের মতো বীরের সঙ্গে— এমন একটা সময়ে যখন তার প্রতিকার করা কর্ণের সাধ্যের বাইরে। শল্যের আনুগত্য দ্বিধাবিভক্ত— কৌরব ও পাণ্ডবপক্ষে, পাঠকেরও প্রতিক্রিয়া তাই নীতি ও দুর্নীতির মধ্যে বিভ্ৰান্ত।

যুদ্ধের একেবারে শেষ প্রহরের ঘটনা স্বল্পকালীন শেষ সেনাপতি দুর্যোধনের মৃত্যু। আঠারো দিনের প্রত্যেক দিনই দুর্যোধন যুদ্ধ করেছেন, আহত হয়েছেন। একে একে ভাই-জ্ঞাতিবান্ধবদের মৃত্যু দেখতে হয়েছে তাঁকে, এবং প্রখ্যাত কৌরববীরদের অন্যায় সমরে মিথ্যাচরণের মধ্যে নিহত হতে দেখতে হয়েছে। কাজেই দুর্যোধন তখন শরীরে মনে বিধ্বস্ত। স্বল্পকাল বিশ্রামের জন্য দ্বৈপায়ন হ্রদের মধ্যে গিয়ে শুয়েছিলেন; তখন ভীম ও অন্যান্য পাণ্ডব বীররা গিয়ে বিদ্রুপ ও বক্রোক্তি করে তাঁকে উঠে এসে যুদ্ধ করতে বলেন। শ্রান্ত বিষণ্ণ দুর্যোধন উঠে আসেন। তাঁর প্রধান শিক্ষা গদাযুদ্ধে, তাই পাণ্ডবপক্ষের সুশিক্ষিত গদাযোদ্ধা ভীমের সঙ্গেই তাঁর যুদ্ধ। ভীম প্রবল যোদ্ধা, কিন্তু গদাতে দুর্যোধনের দক্ষতা বেশি, এই জন্য কিছুক্ষণ যুদ্ধ হওয়ার পরে কৃষ্ণের ইশারায় অর্জুন ভীমকে দুর্যোধনের ঊরুতে আঘাত করবার ইঙ্গিত দেন। ভীমও গদাঘাতে দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করেন; এর পরে ভীম বাঁ পা দিয়ে দুর্যোধনের মাথা চূর্ণ করতে উদ্যত হলে দুর্যোধন কৃষ্ণকে ধিক্কার দেন ও ভীম নিরস্ত হন।[৩]

ধিক্কার কেন? দুটি কারণে। উদ্যোগপর্বে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে পাণ্ডব ও কৌরবরা উভয়ের প্রতি প্রযোজ্য কতকগুলি নীতি স্থির করেন। তার একটা হল, রণক্লান্ত সৈনিকের বিশ্রামের অধিকার আছে এবং বিশ্রামের সময়ে তাকে জোর করে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করানো যাবে না। পাণ্ডবরা এ শর্তটি মানলেন না। দ্বিতীয়ত, একটি বড় শর্ত স্বীকৃত হয়েছিল, অধোনাভি প্রহার করা রণনীতি-বিরোধী; ঊরু অধোনাভি, সেখানে আঘাত করা তাই বেআইনি। এটা করতে হল, কারণ কৃষ্ণ ও পাণ্ডবরা জানতেন যে, কৃত্যারা (মূর্তিমতী জাদুশক্তি) দুর্যোধনকে নির্মাণ করার সময়ে কটির ঊর্ধ্বদেশের দেহকে দুর্ভেদ্য কঠিন লৌহের দ্বারা গঠন করে, কটির নিম্নদেশ ফুল দিয়ে নির্মাণ করেন; অর্থাৎ ওই অংশটিই সহজভেদ্য।’[৪] যুদ্ধের আইন মেনে চললে ভীমের যতই দক্ষতা থাকুক না কেন, দুর্যোধনের দেহকে ক্ষত বা বিদ্ধ করতে পারতেন না। তাই এই বেআইনি অধোনাভি আঘাত।

দুর্যোধন অনেক দুষ্কর্ম করেছেন, যার প্রধান হল প্রকাশ্যে রাজসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণে সমর্থন, এবং নিজের বাম ঊরুতে আঘাত করে পতিবতী দ্রৌপদীকে তাঁকে পতিরূপে ভজনা করার অশালীন ইঙ্গিত। পাঠকের মনে হয় সেই যে সে দিন ঊরুতে চপেটাঘাতের ইঙ্গিতের দ্বারা কুলস্ত্রীর চূড়ান্ত অবমাননা ঘটেছিল, তারই প্রতিশোধে কৃষ্ণের নির্দেশে অর্জুন নিজের ঊরুদেশ দেখিয়ে ভীমকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে দেহের ঊর্ধ্বভাগে সম্পূর্ণ দুষ্প্রধৰ্য্য দুর্যোধন, অতএব ঊরুভঙ্গ করা ছাড়া তাঁকে পরাজিত বা নিহত করার কোনও উপায় নেই।[৫] এ সবের মধ্যে যেন কোনও এক ভাবে একটা গর্হিত কর্ম শোধ হল অনুরূপ একটা গর্হিত কর্মের দ্বারা। পাণ্ডবদের উদ্ভাবিত উপায়টি যতই অত্যাবশ্যক হোক, যে সব শর্ত যুদ্ধের প্রাক্কালে উভয়পক্ষই মেনেছেন, তার একটা শর্তকে এ ভাবে লঙ্ঘন করলে স্বভাবতই দুর্নীতির কলঙ্ক স্পর্শ করে পাণ্ডবদের। অতএব মহাবীর দুর্যোধনের এই নীতিহীন ভাবে মৃত্যু ঘটানোর জন্য সে মুহূর্তে অপরাধী দুর্যোধনকে ছাপিয়ে ওঠে অপরাধিত দুর্যোধন। পাঠকের দুর্যোধনের অতীত অপরাধ সম্বন্ধে যত ক্রোধ বিরাগই থাকুক না কেন, মৃত্যুর মুহূর্তে দুর্নীতির কাছে বলিপ্রদত্ত ভগ্নোরু ধূলিশায়ী দুর্যোধন করুণার সঞ্চার করেই।

রামায়ণের যুদ্ধে রাবণ রামকে মায়াসীতা ও সীতাকে রামের মুণ্ড দেখালেও মৃত্যুটা তাঁর যুদ্ধনীতিকে লঙ্ঘন করে হয়নি; সীতাহরণের পর থেকে পাঠকের সহানুভূতি রামের প্রতিই, রাবণের প্রতি নয়। তাই সে ভেবে দেখে না যে, সুশিক্ষিত সশস্ত্র বহুসংখ্যক রাক্ষসসৈন্য শুধু দু-ভাইয়ের ধনুর্বাণ ও বানরদের ভেঙে আনা গাছপাথরে পরাজিত হওয়াটা অবাস্তব ঘটনা। পাঠক চায় রাবণ পরাজিত হোক, রাম জিতুন। এবং যে কোনও উপায়ে সেটা সংঘটিত হলেই পাঠকের অন্তরাত্মা স্বস্তি পায়, কারণ জয় পরাজয়ের দুটো দিকই খুব পরিষ্কার। তাই পক্ষত্যাগী বিভীষণকেও বিশ্বাসঘাতক বলার আগে পাঠক মনে করে যেহেতু রামপক্ষ ন্যায়পক্ষ, রাবণপক্ষ অন্যায়ের, তাই বিভীষণের কাজটা শেষ বিচারে অন্যায় নয়, বরং তিনি অন্যায়কে বর্জন করে ন্যায়পক্ষ অবলম্বন করেছেন। গুহকের আতিথ্য প্রত্যাখ্যান, বালিবধ, সীতাপ্রত্যাখ্যান এবং শম্বুকবধ ছাড়া তার কোথাও নৈতিক সমস্যার বালাই নেই। ওগুলি খুবই মারাত্মক, গ্লানিকর অপরাধ, তাই অনেক কুতর্কের অবতারণা করতে হয়েছে সব কটি ক্ষেত্রেই। অন্য দিকে মহাভারত যদিও বিস্তর কুতর্কের প্রসঙ্গ টেনে এনেছে তার ভার্গব-প্রক্ষেপের অংশে, কিন্তু অপ্রক্ষিপ্ত মূল অংশে মহাভারত ঘটনা ও চরিত্রকে যে ভাবে বিন্যস্ত করেছে তাতে এর অন্তর্নিহিত বহু মৌলিক ও তাৎপর্যপূর্ণ দ্বিধাস্থান স্বতই উদ্ঘাটিত হয়েছে, পাঠক ন্যায়নীতি সম্বন্ধে তার অভ্যস্ত চিন্তা ও বোধের ক্ষেত্রে পরিপন্থী মূল্যবোধের সম্মুখীন হয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ও অস্থির। যে গ্রন্থ পাঠককে চিন্তার মধ্যে ঠেলে দিয়ে আজন্মলালিত বোধ ও বিচারকে পুনর্বিবেচনা করতে বলে, তার জনপ্রিয়তার সম্ভাবনা কম।

মূল মহাভারত এক সময়ে শেষ হয়েছিল স্ত্রী পর্বে। এটি ছোট একটি পর্ব, এর মধ্যে থেকে দু-তিনটি বিষয় উপস্থাপিত করব। প্রথম, যুদ্ধ-শেষে রণক্ষেত্রে এলেন সধবা গান্ধারী— একশত তরুণী বিধবা পুত্রবধূকে নিয়ে। শতপুত্রের মৃতদেহের ছিন্নভিন্ন অংশ যুদ্ধক্ষেত্রে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। চারিদিক থেকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কুড়িয়ে জোড়া দিয়ে বধূরা নিজেদের স্বামীর দেহে অবয়ব বিন্যাস করছেন, সঙ্গে চলছে শত তরুণীর যুগপৎ বিলাপ। ক্রমেই ধৈর্য্যচুতি ঘটছে গান্ধারীর। ইতিমধ্যে ভীম এসে জানালেন যে, তিনি সত্যিই দুঃশাসনের রক্ত পান করেননি, ওষ্ঠে স্পর্শ করিয়েছিলেন মাত্র। যুধিষ্ঠির এসে ক্ষমা চাইলেন যুদ্ধের জন্য পুরো দায়িত্ব মেনে নিয়ে, গান্ধারীর অভিশাপ প্রার্থনা করলেন। মুখাবরণের ফাঁক দিয়ে গান্ধারী যুধিষ্ঠিরের পায়ের আঙুল শুধু দেখতে পেলেন, তাঁর ক্রুদ্ধ দৃষ্টিপাতে সেগুলি কালো হয়ে গেল। দ্যূতক্রীড়া থেকে এবং অন্যত্রও ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের যে খানিকটা দায়িত্ব ছিল এই শ্মশান-রচনায়, তা প্রমাণিত হল। কিন্তু গান্ধারী জানতেন মূল অপরাধী কে। তাই কৃষ্ণকে বললেন, পাণ্ডব-কৌরবদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ছিল, এ যুদ্ধে সিংহাসন-লাভের স্বার্থ, তাই তাদের যুদ্ধ বোঝা যায়। কিন্তু কৃষ্ণই ছিলেন একমাত্র যাঁর সে রকম কোনও স্বার্থ ছিল না এবং যাঁর কথা শেষ পর্যন্ত দু’পক্ষই শুনত; চাইলে একা তিনিই এ যুদ্ধ বন্ধ করতে পারতেন— কিন্তু চাননি। সেটা এত বড় এক বিধ্বংসী অপরাধ যে, গান্ধারী তাঁকে অভিশাপ দিলেন: কুৎসিত উপায়ে কৃষ্ণের মৃত্যু হবে, যদুকূলের অনাথ বিধবারা কুরুবিধবাদের মতোই অসহায় আর্তনাদ করবেন।[৬] প্রথমত ধর্মপরায়ণা গান্ধারীর এ অভিশাপ দেওয়ার অধিকার ছিল, তাঁর সামনে ছিল তাঁর একশত বিধবা পুত্রবধূ এবং একশত পুত্রের শবদেহের ছিন্নভিন্ন অবয়ব। নৈতিক অধিকার তাঁর এসেছিল মর্মন্তুদ শোক থেকে; এই নিবার্য প্রলয় ও অসংখ্য স্বজনহত্যা নিবারণ না করবার পুরো দায় তিনি কৃষ্ণের উপর আরোপ করলেন। এর পরেও একটু কথা থাকে: গান্ধারীর অভিশাপবাণী যে ধর্মসম্মত, তার কী প্রমাণ? প্রমাণ এই যে, স্বল্পকালের মধ্যে এ অভিশাপ অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল এবং প্রমাণ করে দিল কৃষ্ণেরই পুরো দায়িত্ব ছিল এই বিভীষিকাময় সর্বনাশের জন্য। পাণ্ডবের কাছে তাঁর একটি অভিযোগ ও পরে একটিমাত্র প্রার্থনা ছিল। অভিযোগ হল: ‘দুটো অন্ধ বুড়োবুড়ির অবলম্বন একটা লাঠিও রাখলে না? একশোটা ছেলেকেই মেরে ফেলতে হল?’

অনেক পরে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরের কাছে গান্ধারী ও তাঁর নিজের নামে বনে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে বলেছিলেন, রাজা ও রানি এই পুত্রহীন, অন্ধ, বৃদ্ধ বৃদ্ধা দুজনেই তাঁদের পুত্রদের অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইছেন, আর ভিক্ষা চাইছেন বাকি জীবনের জন্য বনবাসী হওয়ার সম্মতি।[৭] এ দৃশ্যের তুলনা কমই আছে। কী প্রতিক্রিয়া হবে পাঠকের এখানে? এই দম্পতির মধ্যে ধৃতরাষ্ট্র দেহে মনে অন্ধ, অন্ধ পুত্রস্নেহে বারবার বিসর্জন দিয়েছেন ন্যায়নীতিবোধ, কিন্তু বসনাবৃতনেত্রা গান্ধারী বাস্তবে তো চক্ষুষ্মতী ছিলেন এবং নৈতিক স্তরে আরও বেশি করেই, তাই বারবার গোপনে এবং প্রকাশ্যে ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন, দুর্যোধনকে ত্যাগ কর। দুর্যোধন যুদ্ধযাত্রার আগে তাঁর আশীর্বাদ ভিক্ষা করতে এলে তিনি শুধুই বলতেন, ‘ধর্ম যেখানে, জয় সেখানে’। ‘পুত্র জয়ী হও’— এ কথা কখনও বলতে পারেনি। এই দম্পতির মধ্যে নীতিগত গভীর পার্থক্য ছিল, কিন্তু এই দীন আর্তি মুহূর্তের জন্য পাঠককে ভুলিয়ে দেয় ধৃতরাষ্ট্রের বহু অন্যায় কর্ম এবং বহুতর অন্যায়কে সমর্থন ও প্রশ্রয়দান। যেন তিনি পুত্রশোক, বার্ধক্য, অন্ধত্ব, রাজপটে আসীন পাণ্ডব ভ্রাতাদের প্রচ্ছন্ন ও প্রকাশ্যে বিদ্রূপ-ভর্ৎসনা ও বক্রোক্তি সহ্য করার এবং নিজ বাসভূমে পরবাসী হওয়ার দুঃখে, সিংহাসনের রাজমর্যাদা ও সম্মানের পরিবর্তে বর্তমানে প্রজার ভূমিকায় অবনমিত হয়ে বহু পূর্ব পাপ ক্ষালন করেছেন; নীরবে অনাদরে দূর অরণ্যে মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে বাকিটুকু শোধ করে দেওয়ার অনুমতি ভিক্ষা চাইছেন। সমস্ত মহাকাব্য জুড়ে যিনি স্বয়ং দুষ্কৃতি এবং দুষ্কৃতকারীর প্রশ্রয়দাতা, তিনি সর্বগৌরব-রিক্ত অবস্থায় সর্বজনের কৃপাপ্রার্থীর ভূমিকায় অবতীর্ণ।[৮] কাজেই পাঠকের স্বভাবতই কিছু ধন্ধ থাকে। পূর্বের ধৃতরাষ্ট্রকে সে মার্জনা করে না ঠিকই, কিন্তু এখন? এ ধৃতরাষ্ট্রের অন্তরের কারাবাস তো কেউ লাঘব করতে পারবে না, কাজেই পাঠকের করুণা তাঁর প্রতি উদ্যত হবেই। তাই ভর্ৎসনার সঙ্গে মিশল করুণা, প্রতিক্রিয়া হল মিশ্র, দ্বিধাসংকুল।

আর গান্ধারী? পাঠকের মনে পড়ে, কুন্তির সন্তান যুধিষ্ঠির আগে জন্মগ্রহণ করলে শোকে ক্রোধে ক্ষোভে নিদারুণ পীড়িত গান্ধারী তাঁর গর্ভজাত শিলাস্বরূপ বর্তুলাকৃতি বস্তুটিকে বিনষ্ট করতে উদ্যত হয়েছিলেন, হিতৈষীদের মধ্যস্থতায় নিবৃত্ত হন।[৯] দু-বছর পরে একশত কৌরব পুত্র জন্মায়। গান্ধারীর এই ক্রোধ ও ক্ষোভ সূচিত করে তাঁর রাজমাতা পদের জন্য দুর্বার আকাঙ্ক্ষা। স্বামী যাঁর অন্ধ, নীতিবর্জিত, দুর্বলচরিত্র, কুমন্ত্রকদের পরামর্শে চালিত, তাঁর জীবনের শেষ বাসনা ছিল শতপুত্রপ্রসবিনী হয়ে হস্তিনাপুরের সিংহাসনে রাজমাতার পদে আসীন থাকা। এ পদ তিনি পেয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু ন্যায়ের দৃষ্টিতে কুন্তির পুত্রই জ্যেষ্ঠ, ধৃতরাষ্ট্রের নয়; পাণ্ডুরই প্রাপ্য ছিল সিংহাসন এবং পরে পাণ্ডবদের। এই সমস্ত ব্যাপারটা নষ্ট হতে চলেছিল একটি কঠিন পিণ্ড প্রসব করে দু-বছর অণ্ডবৎ ভ্রূণগুলিকে লালন করার সম্ভাবনায়। তাই ওই সাংঘাতিক ক্ষুব্ধ মর্মান্তিক আক্রোশ। এ আক্রোশ নিজের ভাগ্যের বিরুদ্ধেই, কাজেই এ তাঁর পাপ নয়, ব্যর্থতাবোধ; বহুধাবঞ্চিতা নারীর নীরব আর্তনাদ। এ ছাড়া সারা জীবনে যিনি সত্যিই কোনও অন্যায় করেননি, আত্মজের অন্যায়কেও যিনি প্রশ্রয় দিতে পারেননি মাতৃহৃদয়ের স্বাভাবিক প্রবণতা সত্ত্বেও, রাজবধূ ও রাজমাতার পদ যাঁর কাছে গুরুদায়িত্বের আসন ছিল বলে যিনি মাতৃসুলভ কোমলতাকে শাসন করেছেন নীতির মর্যাদা রাখতে, তিনি তো আগাগোড়াই সকলের সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধার পাত্রী ছিলেন। যুদ্ধের শেষে প্রাসাদের জীবনযাত্রা আবর্তিত হতে লাগল পাণ্ডবদের ঘিরে, কৌরব রাজমাতা প্রান্তবাসিনী হয়ে রইলেন তাঁরই সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে যে স্বামীর সঙ্গে তাঁর সুদীর্ঘকালের গভীর বিচ্ছেদ ন্যায়বোধের স্তরে। তাঁর অন্তরের বনবাস শুরু হয়েছিল প্রাসাদের অভ্যন্তরেই, পরে সেটা বাস্তবায়িত হল।

বিদুর, সঞ্জয় ও গান্ধারী ছিলেন ধৃতরাষ্ট্রের বিকল্প বিবেক; এঁদের এবং তৎকালীন রাজমাতা কুন্তিকে নিয়ে শুরু হল বনবাস, শেষ হল অগ্নিদাহে, মৃত্যুতে। বনগমনের প্রাক্কালে গান্ধারী সম্বন্ধে পাঠকের কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে? সেও এক মিশ্র অনুভূতি। চিরশ্রদ্ধার পাত্রী গান্ধারী দীন ভাবে বনবাসের অনুমতি চাইছেন। এতে পাঠকের মনে যে সহানুভূতি জাগে তার মধ্যে কোথাও একটা দীনতা ও করুণার সংশ্লেষ ঘটে।

এই স্ত্রীপর্বেই পঞ্চম অধ্যায়ে একটি উপাখ্যান আছে:

এক ব্রাহ্মণ রাক্ষসবহুল এক বনে প্রবেশ করেন। সেখানে অনেক সিংহ, বাঘ, হাতি, চারিদিকে ঘুরছে। দেখে ব্রাহ্মণটির ভয়ে রোমাঞ্চ হল। দেখলেন চারিদিকে জালে ঢাকা এক বনভূমি তাকে এক নারী দু-হাতে বেষ্টন করে আছে। পাঁচমাথাওয়ালা পাহাড়প্রমাণ হাতিরা ঘুরছে। সেই বনে লতায় ঢাকা এক জলাশয়, তার মধ্যে এক কূপ। ব্রাহ্মণ আচমকা সেই কুয়োয় পড়ে গেলেন, ঝুলন্ত লতা ধরে ঝুলতে লাগলেন— মাথা নিচে, পা ওপরে এই অবস্থায়। কুয়োর পাড়ে এক প্রকাণ্ড হাতি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। ওই ঝুলন্ত শাখায় ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি। মৌচাক থেকে মধুর ধারা নিঃসৃত হচ্ছে। ওই ব্রাহ্মণটির মুখেও মধ্যে মধ্যে ফোঁটা ফোঁটা মধু পড়ছে, পান করে তার অতৃপ্তিই বাড়ছে। মহাভারত বলছে, ওইখানেই মানুষের বেঁচে থাকার বাসনা প্রতিষ্ঠিত। এ দিকে যে-গাছের লতা ধরে মানুষটি ঝুলছে সেই গাছের শিকড়গুলো কেটেই চলেছে কিছু ইঁদুর, অর্থাৎ যে কোনও সময়ে গাছটা পড়ে যাবে, লতাগুলো ছিঁড়ে যাবে এবং মানুষটি কুয়োর নীচে পড়ে যাবে আছে বিষাক্ত সাপ। মানুষ সংসারে নিক্ষিপ্ত হয়ে এই ভাবেই বেঁচে থাকে।[১০]

এই প্রলম্বিত উপমাটি আছে স্ত্রীপর্বে, যেখানে রচনার এক স্তরে মূল মহাভারত সমাপ্ত হয়েছিল, অর্থাৎ মহাভারত জীবন সম্বন্ধে যা বলতে চায় তা এখানে বিধৃত। একবারও অস্বীকার করা হচ্ছে না যে জীবনে বিপদ, আশঙ্কা ও ভয়ের নানা কারণ আছে। অন্যত্র মহাভারত বলছে, ‘শোকস্থান-সহস্রাণি ভয়স্থানশতানি চ।’ ওপরে বিপুলকায় হাতি, মৌমাছির ঝাঁক, জালে ঢাকা জলাশয়ের মধ্যে এই কূপ; যে লতা ধরে ঝুলছে মানুষটি তার আশ্রয়স্থলে যে গাছ তার শিকড় কেটেই চলেছে ইঁদুররা; গাছ-লতা পড়ে গেলে অবলম্বনচ্যুত হয়ে মানুষটি পড়বে কুয়োর নীচে, যেখানে আছে বিষধর সাপ। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত পরিত্রাণের কোনও উপায় নেই। অনিবার্য মৃত্যুর বহুবিধ সম্ভাবনা, যন্ত্রণার নানাবিধ উপাদান এই পরিবেশেই মানুষ জীবনে বেঁচে থাকে। কেন থাকে? কী তাকে বাঁচায়? ওই মৌচাক থেকে ঝরে পড়া ফোঁটা ফোঁটা মধু, যা পান করে তার কখনওই তৃপ্তি হয় না, কিন্তু যার জন্য লোলুপতা তাকে বাঁচিয়ে রাখে, জাগিয়ে রাখে পরবর্তী মধুবিন্দুটির প্রত্যাশায়।

এই মধু-র স্বরূপ প্রত্যেক জীবনে ভিন্ন, কোথাও তা কর্ম, কোথাও কোনও ক্ষেত্রে সাধনা, কোথাও কোনও মানবিক আদর্শ, কোথাও প্রেম, কোথাও বা অন্য কিছু। কিন্তু স্বরূপ যাই হোক, ওই মধু-বিন্দু তাকে তৃপ্তি দেয় না, অতৃপ্তিই বাড়িয়ে দেয়; তার ফলে সে চারিদিকের বিপৎসংকুল পরিস্থিতির মধ্যেও হাল ছেড়ে দেয় না। বেঁচে থাকতে প্রয়াসী ও বদ্ধপরিকর হয়। সংস্কৃত সাহিত্য এই বাঁচবার উদগ্র অনিঃশেষ বাসনাকে বলেছে ‘জীবাতুকাম্যা’। ঋগ্বেদ থেকেই জীবাতু শব্দটির দেখা পাই, অর্থাৎ এই বোধটি বহু প্রাচীন। প্রাচীনতর মহাকাব্য গিলগামেশ্-এও অমৃতের সন্ধানে নায়কের সুদীর্ঘ বিপৎসঙ্কুল অভিযান এরই প্রতীক; এই ‘জীবাতুকাম্যা’র।

স্ত্রীপর্বের এই সুদীর্ঘ উপমা-আখ্যানে মহাভারত মানুষের জীবনের পুনর্মূল্যায়ন করেছে। পাঠক এতে কী ভাবে সাড়া দেবে? মনে রাখতে হবে, এই রচনা উপনিষদের ‘মোক্ষ’ ও বৌদ্ধধর্মের ‘নির্বাণে’র কল্পনার পরবর্তী। অর্থাৎ ওই সব চিন্তাকে পেরিয়ে এখানে মহাভারত তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত জীবন ও জীবনের তাৎপর্য ও ‘জীবাতু’ সম্বন্ধে উচ্চারণ করছে। ‘জীবন মায়া’ বলবার পেছনে যে নিস্পৃহতা তার নানা দিক এখানে সন্নিবিষ্ট— ওই বাঘ সিংহ হাতির দল, মৌমাছির ঝাঁক, অত্যন্ত ক্ষীণ অবলম্বন, ইঁদুরে যাকে এক সময়ে ছিন্নমূল করে দেবেই, অনিবার্য মৃত্যু কুয়োর নীচের সাপের মূর্তিতে এবং ওপরের শ্বাপদকুলের আক্রমণের সম্ভাবনায় প্রতিবিম্বিত। অতএব জীবনকে মায়া বলার প্রলোভনের বিস্তর হেতু এখানে উপস্থিত; অন্তিম মৃত্যুটি কোনও মতেই মায়া নয়, আর বিপদের সম্ভাবনাগুলির মধ্যে জীবনের নানা সংকট ও যন্ত্রণা প্রতিফলিত। এ সবই বাস্তব, কাজেই জীবন সম্বন্ধে যে অনীহা নানা দর্শন-প্রস্থানে উচ্চারিত হচ্ছিল এবং বহু মানুষকে আকৃষ্টও করছিল তার প্রতিস্পর্ধারূপে মহাভারতে জীবনের পুনর্মূল্যায়ন স্পষ্ট ভাবে অন্য এক মূল্যবোধ উপস্থাপিত করছে। জীবন বহুমূল্য; ওই মধুবিন্দুটি তার সম্বন্ধে আকাঙ্ক্ষাকে পরিতৃপ্ত করে না, কিন্তু নিত্যজাগ্রৎ রাখে। জীবনের ইহমুখীন এই স্বীকৃতি নেতিবাচক প্রস্থানগুলিকে প্রত্যাখ্যান করছে, যেগুলি শ্রেণিবিভক্ত সমাজে অত্যাচারিত সংখ্যাগুরু মানুষের জীবনে তখনই বেশ দৃঢ়মূল। কাজেই পাঠক জীবনের আধ্যাত্মিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বহুবিধ বিপদ, ভয়, শোক, আতঙ্ক যন্ত্রণাকে একান্ত মনে করে জীবনকে প্রত্যাখ্যান করে পরমার্থের, নির্বাণ বা মোক্ষের চেষ্টা করবে, নাকি এই মধুবিন্দুটি যেহেতু অলীক নয়, তাই ‘জীবাতু’র মূল্যমানে প্রত্যয় রেখে সংগ্রামী মনোবৃত্তি নিয়ে বিপৎসংঘাতের সম্মুখীন হবে— এ দুটো সম্ভাবনা পাঠককে দ্বিধান্বিত করে। এ কাহিনিতে মহাভারত জীবনের সদর্থক দিককে অভ্যর্থিত করেছে। ঋগ্বেদের পরে এই প্রথম। হয়তো বেশ কিছু শতাব্দী পর্যন্ত; এর শেষ দৃঢ় পুনরুচ্চারণ পাই রবীন্দ্রনাথে— ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে’। দুটি আত্যন্তিক বিকল্পের এমন প্রত্যয়যোগ্য রূপায়ণ রামায়ণে কোথাও নেই; রামায়ণ জীবনের এত গভীর স্তরে মানুষকে নিয়ে যেতে পারেনি। সহজ জীবনে নিশ্চিন্ত প্রত্যয়ী মানুষ তাই যত সহজে রামায়ণে সাড়া দিতে পেরেছে, সংশয়সমাকুল মহাভারতে তেমন ভাবে কখনওই পারেনি।

***

১. উদ্যোগপর্ব; (১৪৪:২২)

২. উদ্যোগপর্ব; (৮:২৭)

৩. উদ্যোগপর্ব; (৮:৩০-৩২, কর্ণ, ২৭:৪২-৪৬)

৪. শল্যপর্ব; (৫৮:৫; ৬০:২৭-৩৮)

৫. আরণ্যকপর্ব; (২৪০:৬-৭)

৬. শল্যপর্ব; (৫৭:৪)

৭. স্ত্রীপর্ব; (২৫:৩৯-৪২)

৮. স্ত্রীপর্ব; (১৪:২০-২১)

৯. আশ্রমবাসিক; (৯:৭-৯) (বঙ্গবাসী)

১০. আদিপর্ব; (১০৭:১১)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *