জায়গাটার নাম চৌসা। গঙ্গা এবং কীৰ্তিনাশা নদীর সঙ্গমস্থলে ছোট একটা গ্রাম। চৌসার দক্ষিণে হুমায়ূনের বিশাল বাহিনী আস্তানা গেড়েছে। নদীর একদিকে মোঘল বাহিনী, অন্যদিকে শের খাঁ’র আফগান বাহিনী। মাঝখানে খরস্রোতা কীর্তিনাশা নদী। আফগান বাহিনী নদী পার হয়ে মোঘল বাহিনীকে আক্রমণ করবে সেই সম্ভাবনা শূন্য। নদীতে নড়বড়ে কাঠের পুল আছে। সেই পুলে বিশাল বাহিনী পার হতে পারবে না। পুলের উপর কামান গাড়ি তোলার প্রশ্নই আসে না।
হুমায়ূনের গুপ্তচর খবর এনেছে শের খাঁ পর্যুদস্ত অবস্থায় আছেন। ঝাড়খণ্ডের চেরুহ। দলপতি শের খাঁকে আক্রমণ করবে। এই নিয়েই শের খাঁ ব্যস্ত। কিছুদিন পরপর নিশাকালে শের খাঁ’র প্রধান সেনাপতি খাওয়াস খাঁ চেরুহ। দলপতির বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্ৰা করেন। তার দেখা না পেয়ে ফিরে আসেন। শের খাঁ যে সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন তাতে বিশাল মোঘল বাহিনীর উপর আক্রমণ চালানোর প্রশ্নই ওঠে না। শের খাঁ চাইবেন যে-কোনো মূল্যে মোঘলদের সঙ্গে সন্ধি।
মোঘল সম্রাট নিশ্চিন্ত মনে সময় কাটাচ্ছেন। জাদুবিদ্যার বইটির পাঠোদ্ধারের ব্যবস্থা হয়েছে। বইটি প্রাচীন সংস্কৃত ভাষায় লেখা। সেই ভাষার একজন পণ্ডিত বইটি ফার্সি ভাষায় অনুবাদ শুরু করে দিয়েছেন। পণ্ডিত হিন্দু ব্ৰাহ্মণ, নাম আচার্য হরিশঙ্কর বিদ্যাবাচস্পতি। তিনি প্রতি পৃষ্ঠা অনুবাদ করার জন্যে পাচ্ছেন একটি করে রৌপ্যমুদ্রা।
সম্রাট নতুন এক খেয়ালেও কিছু সময় দিচ্ছেন। তিনি হিন্দুস্থানি রান্নার একটি কোষগ্রন্থ তৈরি করতে চাচ্ছেন। বিশাল হিন্দুস্থানের নানান অঞ্চলে কত ধরনের রান্নাই-না হয়। সব একত্রিত থাকলে গবেষকদের জন্যে সুবিধা। হিন্দু বিধবারা (যারা নানান কারণে সতীদাহের হাত থেকে বেঁচে গেছে) মাছ-মাংস খেতে পারে না। তাদের জন্যে বিচিত্র সব নিরামিষ রান্না হয়। বিচিত্র নিরামিষের একটি খেয়ে সম্রাট আনন্দ পেয়েছেন। কাঁঠাল নামের একটি কাঁচা ফল থেকে এই নিরামিষ তৈরি হয়। খেতে মাংসের মতো লাগে। সম্রাট শুরুতে ধরতেই পারেন নি তিনি নিরামিষ খাচ্ছেন, মাংস না। হিন্দুস্থানি রান্নার আকরগ্রন্থ তৈরির বাসনার মূলে আছে কাঁঠালের নিরামিষ।
সম্রাট ঠিক করেছেন, জাদুবিদ্যার বইটির অনুবাদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি চৌসাতে থাকবেন। শের খাঁ’র সঙ্গে সন্ধি করে দিল্লী ফিরে যাবেন। পেছনে শক্র রাখা কোনো কাজের কথা না।
সন্ধির শর্ত নিয়ে আলোচনার জন্যে সম্রাটের দূত শায়েখ খলিলকে শের খাঁ’র কাছে পাঠানো হলো। শর্তগুলো নিম্নরূপ–
প্ৰথম শর্ত
শের খাঁ তার অবস্থান থেকে পেছনে সরে যাবেন, যাতে ইচ্ছা করলেই মোঘল বাহিনী কীর্তিনাশা নদী পার হতে পারে।
দ্বিতীয় শর্ত
শের খাঁ তার পুরোনো জায়গির বাংলা ও বিহার ফিরে পাবেন ঠিকই, তবে তাকে নিয়মিত কর পরিশোধ করতে হবে। তিনি খুৎবা পড়বেন সম্রাট হুমায়ূনের নামে। টাঁকশালের মুদ্ৰাও মোঘল সম্রাটের নামে তৈরি হবে।
তৃতীয় শর্ত
শের খাঁ’র এক পুত্রকে (সম্রাটের পছন্দ সাইফ খাঁ) থাকতে হবে দিল্লী দরবারে, সম্রাটের নজরদারিতে।
চতুর্থ শর্ত
শের খাঁ স্বয়ং হুমায়ূনের সামনে উপস্থিত হয়ে তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। তিনি আফগান এবং মোঘল সুসম্পর্কের জন্যে ভূমিকা রাখবেন।
শের খাঁ প্রতিটি শর্ত মেনে নিলেন। নিজের অবস্থান থেকে কুড়ি মাইল পেছনে সরে গেলেন। হুমায়ূনের কীর্তিনাশা নদী অতিক্রমে কোনো বাধা রইল না।
সম্রাট তাঁর বিশাল বাহিনী নিয়ে নদী অতিক্রম করলেন না, তবে তিনি সপ্তাহে একদিন নদীর তীরে স্বয়ং উপস্থিত হতে লাগলেন। ওই বিশেষ দিনে দুই শুড়ের হস্তী শাবককে গোসল করানো হয়। গোসলের সময় সে তার দুই শুড় দিয়ে একসঙ্গে আকাশে পানি ছুঁড়ে মারে। সেই পানি বৃষ্টির মতো তার গায়ে নেমে আসে। অদ্ভুত দৃশ্য।
মঙ্গলবার দ্বিপ্রহর। সম্রাট কীর্তিনাশা নদীর তীরে। হান্তীশাবকের স্নানদৃশ্য দেখছেন। সম্রাটের সঙ্গে আছেন। বৈরাম খাঁ। বৈরাম খাঁকে চিন্তিত এবং বিষগ্র দেখাচ্ছে। হস্তীশাবকের জলকেলি দেখে তিনি তেমন আনন্দ পাচ্ছেন না। সম্রাট বললেন, বৈরাম খাঁ, আপনাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?
বৈরাম খাঁ বললেন, আমি চিন্তিত বলেই মনে হয় চিন্তিত দেখাচ্ছে।
চিন্তিত হওয়ার মতো কোনো ঘটনা কি ঘটেছে?
আমি শের খাঁকে নিয়ে চিন্তিত। সে সাপের মতো ধূর্ত।
সম্রাট হাসতে হাসতে বললেন, সাপ ধূর্ত না, ভীতু প্রাণী। শের খাঁ যদি সাপও হয় সেই সাপ এখন গর্তে ঢুকেছে। সাপ যখন গর্তে ঢোকে সোজা হয়ে ঢোকে।
বৈরাম খাঁ বললেন, সাপ যখন গর্ত থেকে বের হয় তখন কিন্তু আবার একেবেঁকেই চলে।
এই সাপ সহজে গর্ত থেকে বের হবে না।
বৈরাম খাঁ ক্লান্ত গলায় বললেন, শের খাঁ ছাড়াও চিন্তিত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। আপনার ভাই কামরান মীর্জা নিজের নামে খুৎবা পাঠ শুরু করেছেন। নিজের নামে স্বর্ণমুদ্রা বের করেছেন।
সম্রাট বললেন, এটি কামরানের শিশুসুলভ কার্য। শিশুদের সব কাজ গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে নেই। যথাসময়ে সে ক্ষমা প্রার্থনা করবে।
এবং আপনি তাকে ক্ষমা করে দেবেন?
হ্যাঁ।
আপনার আরেক ভ্রাতা হিন্দাল মীর্জাকে রসদের জন্যে পাঠানো হয়েছিল। তিনি কুড়ি হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে রসদ সংগ্রহে বের হয়ে আর ফিরে আসেন নি। খবর পাওয়া গেছে। তিনি দিল্লীর দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। মনে হচ্ছে তারও দিল্লীর সিংহাসনে বসার বাসনা।
সম্রাট একটি শের আবৃত্তি করলেন। ফার্সি শের, যার ভাবাৰ্থ–
বৃদ্ধকে সম্মান করো, এই সম্মান তাঁর অভিজ্ঞতার কারণে, যুবককে সমীহ করো, এই সমীহ তার তারুণ্যের কারণে, শিশুকে ভালোবাসো, এই ভালোবাসা তার শিশুসুলভ কর্মকাণ্ডের জন্যে।
বৈরাম খাঁ বিরস গলায় বললেন, প্রতিটি শের কবির ব্যক্তিগত ধ্যানধারণার ফসল। ব্যক্তিগত কোনো কিছুই সর্বজনীন হতে পারে না। যাই হোক, আমি হস্তীশাবকের স্নান দেখার জন্যে আসি নি। আমি শের খাঁর কাছ থেকে একটি পত্র পেয়েছি। পত্রটি আপনাকে পড়ে শোনানোর জন্যে এসেছি। সম্রাটের অনুমতি পেলে পত্রটি পড়তে চাই।
পড়ুন। বৈরাম খাঁ পত্রটি পড়লেন :
সিংহের চেয়ে সাহসী, দিল্লীর সূর্য সম্রাট হুমায়ূনের প্রিয়ভাজন, বৈরাম খাঁ।
আমার অভিনন্দন এবং সালাম।
আপনি ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই অবগত হয়েছেন যে, সন্ধির সকল শর্ত মেনে আমি আমার বাহিনী নিয়ে দূরে সরে গেছি। আমার পুত্র সাইফ খাঁকে নির্দেশ দিয়েছি সে যেন সম্রাটের সঙ্গে দিল্লী যাত্রা করে।
আমি যে-কোনো এক শুভদিনে সম্রাটের সামনে উপস্থিত হব। তাঁর পদচুম্বনের দুর্লভ সুযোগের আশায় কালযাপন করছি।
এক্ষণ, আপনাকে পত্রদানের কারণ ব্যাখ্যা করি। আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, ঝাড়খণ্ডের দলপতিদের চোরা গোপ্ত হামলায় আমি বিপর্যন্ত।
সম্রাট হুমায়ূনের দীন সেবক হিসেবে এবং দিল্লীর সিংহাসনের প্রতি অতি অনুগত ভৃত্য হিসেবে আমি কি আপনার কাছ থেকে কিছু পরামর্শ পেতে পারি?
ঝাড়খণ্ডের দলপতিদের কীভাবে সমুচিত জবা দেওয়া যায়—এই বিষয়ে পরামর্শ।
সম্রাটের অনুমতি সাপেক্ষে আপনি যদি রাজি থাকেন তাহলে আপনাকে সসম্মানে আমার তাঁবুতে আনার ব্যবস্থা আমি করব।
পত্রের উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম।
ইতি
আপনার গুণমুগ্ধ,
মোঘল সম্রাট হুমায়ূনের দীন সেবক,
শের খাঁ
সম্রাট বললেন, পত্রের কী জবাব দেবেন বলে ঠিক করেছেন?
বৈরাম খাঁ বললেন, আপনি যে জবাব দিতে বলবেন আমি সেই জবাবই দেব।
আমি মনে করি শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে আপনি শের খাঁ’র সঙ্গে দেখা করতে পারেন।
আপনার যদি এরকম নির্দেশ হয়। আমি যাব। এখন আপনার অনুমতি নিয়ে আমি তাঁবুতে ফিরে যেতে চাই। বাংলা মুলুকের প্রচণ্ড তাপে আমি বিপর্যন্ত বোধ করছি।
সম্রাট বললেন, আপনি নিজের তাঁবুতে ফিরে যান। বিশ্রাম করুন।
বৈরাম খাঁ তাঁবুতে ফিরেই শের খাঁ’র পত্রের জবাব দিলেন। সেখানে লিখলেন,
পাঠানদের প্রতিনিধি
শের খাঁ,
আপনার পত্র পাঠ করেছি। আমার পক্ষে কোনোক্রমেই সম্রাট হুমায়ূনকে একা ফেলে আপনার কাছে যাওয়া সম্ভব না।
ক্ষমাপ্রার্থনাপূর্বক
বৈরাম খাঁ
দিন বৃহস্পতিবার। সময় সুবেহ্ সাদেক।
শের খাঁ তার দুই পুত্র এবং প্রধান সেনাপতি খাওয়াস খাকে নিয়ে গোপন বৈঠকে বসেছেন। শের খাঁ বললেন, আজ মধ্যরাতে আমরা মোঘল বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বা। কারও কিছু বলার আছে?
কেউ জবাব দিল না। খাওয়াস খাঁ বললেন, আজকের রাতটা কি বিশেষ কারণে ঠিক করা হয়েছে?
শের খাঁ বললেন, হ্যাঁ। আমরা মুসলমানরা দিনগণনা করি চন্দ্র দেখে। সেই হিসাবে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবারের শুরু। শুক্রবারে মুসলমানরা যুদ্ধযাত্রা করে না। মোঘল বাহিনী নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাবে। আমরা মুসলমান হয়েও ঝাঁপিয়ে পড়ব।
খাওয়াস খাঁ বললেন, দিন নির্ধারণ ঠিক আছে।
শের খাঁ বললেন, মোঘল বাহিনী সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত হবে এই বিষয়ে আমি একশত ভাগ নিঃসন্দেহ। আমি ঝাড়খণ্ডের দলপতির নামে একটা মিথ্যা গল্প তৈরি করেছি। বারবার তার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছি। মোঘলরা তা বিশ্বাস করেছে। আমাদের দুটা লাভ হয়েছে। এক, মোঘলদের বিশ্বাস অর্জন। দুই, দ্রুত যুদ্ধযাত্রা করার অনুশীলন।
শের খাঁ’র পুত্র সাইফ খাঁ বললেন, বারবার ঝাড়খণ্ডের দলপতির বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা যে একটি অনুশীলনের অংশ তা আমি আগে বুঝতে পারি নি।
শের খাঁ বললেন, এখন আমি কিছু কঠিন নির্দেশ দেব। এইসব নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে।
প্রথম নির্দেশ
সম্রাট হুমায়ূনকে কোনো অবস্থাতেই হত্যা বা গ্রেফতার করা যাবে না। তাকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে।
শের খাঁ’র পুত্ৰ জালাল খাঁ বললেন, আপনার এই নির্দেশের পেছনে কারণ কী?
শের খাঁ বললেন, একটিই কারণ। মানুষ হিসেবে আমি সম্রাটকে অত্যন্ত পছন্দ করি। আমি আমার দিক থেকে তার কোনো অমঙ্গল হতে দেব না।
দ্বিতীয় নির্দেশ
সম্রাটের পরিবারের সমস্ত নারী ও শিশু এবং তার হেরেমের নারীদের কোনোরকম অসম্মান বা ক্ষতি করা যাবে না।
তৃতীয় নির্দেশ
যে-কোনো মূল্যে বৈরাম খাঁকে হত্যা করতে হবে। বৈরাম খাঁ সিংহের মতো সাহসী আবার শৃগালের চেয়েও ধূর্ত। বৈরাম খাঁ বিহীন হুমায়ূন কোনো শক্তিই না।
শের খাঁ বললেন, এখন খাওয়াস খাঁ’র দায়িত্ব হলো বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে ঝাড়খণ্ডের চেরুহ। দলপতির বিরুদ্ধে মিথ্যা যুদ্ধযাত্রা করা। সম্রাট হুমায়ূন যেন খবর পান। আপনি দলপতিকে শায়েস্তা করতে যাচ্ছেন-আমি সেই ব্যবস্থা করব। আপনি সন্ধ্যা নামার পর ফিরে আসবেন।
খাওয়াস খাঁ বললেন, আমি কি এখনই যাত্রা করব?
শের খাঁ বললেন, এই মুহুর্তে।
ভোরবেলা নাশতা খেতে খেতে হুমায়ূন শুনলেন, শের খাঁ’র বিশাল বাহিনী খাওয়াস খাঁ’র নেতৃত্বে চেরুহ দলপতির বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছে।
হুমায়ূন দুঃখিত গলায় বললেন, শের খাঁ বেচারা ভালো ঝামেলায় আছে।
সারাটা দিন সম্রাটের আনন্দে কাটল। তিনি তার কন্যা আকিকা। বেগমের সঙ্গে পাশা খেললেন। আকিকা বেগম পাশা খেলায় পিতাকে হারিয়ে দিলেন। সম্রাট কন্যার কাছে হেরে প্রভূত আনন্দ পেলেন। তিনি একটি শের আবৃত্তি করলেন। এই শেরটির ভাবাৰ্থ–
সেই ব্যক্তিই সৌভাগ্যবান যে বুদ্ধিতে নিজ পুত্ৰ-কন্যার হাতে পরাস্ত হয়।
আকিকা বেগম বলল, বাবা, আমি তোমাকে বুদ্ধিতে হারাই নি। পাশার দানে হারিয়েছি।
হুমায়ূন হাসতে হাসতে বললেন, একই ব্যাপার।
অম্বা মেয়েটির সঙ্গেও কিছু কথা বললেন। হুমায়ূন বললেন, আমার এখানে তুমি কি সুখে আছ?
অম্বা বলল, মহা সুখে আছি। আমি ইসলাম ধর্ম গ্ৰহণ করতে চাই।
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। আরও চিন্তা করো। সম্রাট দুপুরে আচার্য হরিশংকরের সঙ্গে বসলেন। তাঁর অনুবাদ শুনলেন। সর্বমোট দশ পৃষ্ঠা অনুবাদ হয়েছে। সম্রাট আচার্যকে দশটি রৌপ্যমুদ্রা দিলেন।
মাগরেবের নামাজের পর কোনোরকম খবর না দিয়ে সম্রাট উপস্থিত হলেন জেনানা তাঁবুতে। মহিলারা অভিভূত। অনেকদিন তাঁরা সম্রাটের দর্শন পায় না।
হুমায়ূন বললেন, দিল্লী ফিরে গেলে কেমন হয়?
সবাই একসঙ্গে বলল, খুব ভালো হয়।
আমরা এক সপ্তাহের মধ্যে দিল্লীর দিকে রওনা হব।
মহিলাদের আনন্দের সীমা রইল না। তাদের আগ্রহে সম্রাট রাতের খাবার জেনানা তাঁবুতে গ্ৰহণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। রাতের খাওয়ার শেষে গানবাজনার আয়োজন করা হলো।
আনন্দেরও এক ধরনের ক্লান্তি আছে। সম্রাট সেই ক্লান্তি নিয়ে রাতে ঘুমুতে গেলেন।
শের খাঁ’র বাহিনী কীর্তিনাশা নদীর উপরের কাঠের পুল দিয়ে পার হলো। শের খাঁ বিস্মিত হলেন। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি পুল, সেখানে কোনো পাহারা নেই। শের খাঁ’র হস্তীবাহিনী কীর্তিনাশা সাঁতরে পার হলো।
মোঘল বাহিনীর পেছনে শের খাঁ’র সৈন্যদল। মোঘলরা আছে কীৰ্তিনাশা এবং গঙ্গার সঙ্গমস্থলে। পাঠানদের আক্রমণ শুরু হলে মোঘলদের যেতে হবে নদীর দিকে। শের খাঁ’র নির্দেশে কীর্তিনাশার কাঠের পুল ভেঙে দেওয়া হলো।
শের খাঁ’র বাহিনী ঘুমন্ত মোঘল সেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মোঘল অশ্বারোহীরা তাদের অশ্বের পিঠে জিন পরানোর সময়ও পেল না।
সম্রাটের ঘুম ভাঙল ‘পালাও’ ‘পালাও চিৎকারে। সম্রাট বিস্মিত হয়ে বললেন, কী হয়েছে?
জওহর আবতাবচি ভীত গলায় বলল, আমরা শের খাঁ কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছি, এবং পরাজিত হয়েছি। মোঘল সৈন্যদের প্রায় সকলেই হত।
সম্রাট বললেন, আমি কি দুঃস্বপ্ন দেখছি?
জওহর আবিতাবচি বলল, না। সম্রাট, আপনাকে এক্ষুনি পালাতে হবে।
আহত মোঘল সেনাদের আর্তচিৎকার শোনা যাচ্ছে। মহিলা এবং শিশুদের কান্না শোনা যাচ্ছে।
হুমায়ূন ভেবে পেলেন না, তার তাঁবু কেন আক্রান্ত হয় নি। শের খাঁ’র উচিত ছিল সবার আগে সম্রাটকে হত্যা করা। এখানে কি শের খাঁ’র কোনো হিসাব আছে?
সম্রাট ঘোড়ায় চড়ে কীর্তিনাশা নদীর পাড়ে গেলেন। পুল ভাঙা। শত শত মোঘল সৈন্য পুলে উঠে সেখান থেকে ঝাঁপ দিয়ে পানিতে পড়ছে। নদীর স্রোতে ভেসে চলে যাচ্ছে। হাতিগুলিরও মনে হয় মস্তিষ্ক বিকৃতি হয়েছে। তারা কিছুতেই পানিতে নামবে না। অথচ এরা শিক্ষিত হাতি। যুদ্ধক্ষেত্রের সব পরিস্থিতির জন্যে তৈরি।
হুমায়ূন পেছন দিকে তাকালেন, তার তাঁবুতে আগুন জ্বলছে। আগুন ছুটে যাচ্ছে জেনানা তাঁবুর দিকে। আগুনের লেলিহান শিখায় আকাশ লাল। সম্রাট হুমায়ূনের ইমাম সাহেব উচ্চস্বরে আযান দিচ্ছেন, আল্লাহু আকবার। আল্লাহু আকবার। মহাবিপদের সময় আযান দিতে হয়। আজ মোগলদের মহাবিপদ।
সম্রাট ঘোড়া নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিলেন। মুহুর্তের মধ্যে ঘোড়া পানিতে তলিয়ে গেল। সম্রাট নিজেও তলিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ শুনলেন, কে যেন বলছে আমি আপনার দিকে একটা বাতাস ভর্তি মশক ছড়ে দিচ্ছি। আপনি মশক ধরে নদী পার হওয়ার চেষ্টা করুন।
তুমি কি আমাকে চেনো?
আপনি মোঘল সম্রাট হুমায়ূন।
তোমার নাম কী?
আমি নাজিম। ভিস্তিওয়ালা নাজিম। আপনি মশক শক্ত করে ধরে ভাসতে থাকুন।
নদীর প্রবল স্রোতে হুমায়ূন ভেসে যেতে শুরু করেছেন। তিনি দূর থেকে বললেন, আমি যদি বেঁচে যাই, যদি দিল্লীর সিংহাসনে বসতে পারি। তাহলে তোমার সৎকর্মের প্রতিদান আমি দেব। একদিনের জন্যে হলেও তুমি দিল্লীর সিংহাসনে বসবে।
ভোর হয়েছে।
হুমায়ূন-পত্নী বেগা বেগম শের খাঁ’র হাতে বন্দি হয়েছেন। ভয়ে এবং আতঙ্কে তিনি অস্থির। পরাজিত সম্রাটের স্ত্রীর জন্যে কী অসম্মান অপেক্ষা করছে তা তিনি জানেন। রাজপুত রমণীরা এমন অবস্থায় আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে জহর ব্ৰত পালন করেন। মুসলমানদের জন্যে আত্মহত্যা নিষিদ্ধ বলে এমন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না।
বেগা বেগমকে শের খাঁ’র সামনে উপস্থিত করা হলো। শের খাঁ বললেন, আপনি কাঁদছেন কেন?
বেগা বেগম বললেন, অসম্মানের ভয়ে কাঁদছি।
মা, শুনুন। আপনি যা ইচ্ছা করবেন তা-ই করা হবে। আমি আপনাকে মা ডেকেছি। পুত্রের হাতে মা’র কোনো অসম্মান হবে না এটা আপনি জানেন। আপনি কী চান বলুন?
আমি দিল্লী যেতে চাই।
আপনাকে এবং আপনার সঙ্গে যেসব মহিলা এবং শিশু আছে তাদের সবাইকে আমি এক্ষুনি দিল্লী পাঠাবার ব্যবস্থা করছি।
সম্রাট হুমায়ূনের নয়নমণি আকিকা বেগম এবং তার এক বান্ধবী অম্বাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
আমি তাদের সন্ধানে লোক পাঠাচ্ছি। মা, আপনার আর কিছু কি লাগবে?
বেগা বেগম বললেন, অজুর পানি লাগবে। জয়নামাজ লাগবে। আমি দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ব।
নফল নামাজ শেষে প্রার্থনায় বসে হুমায়ূন-পত্নী বেগা বেগম বললেন, হে পরম করুণাময়, তোমার বান্দা শের খাঁ যে সম্মান আমাকে দিয়েছে সেই সম্মান তুমি তাকে বহুগুণে বর্ধিত করে ফেরত দিয়ে। হুমায়ূন-পত্নী হয়েও আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, শের খাঁ যেন তার জীবনে কখনোই কোনো যুদ্ধে পরাজিত না হয়। (*চৌসার যুদ্ধের পর শের খাঁ কখনোই কোনো যুদ্ধে পরাজিত হন নি। তাঁর মৃত্যু হয়েছিল নিজের একটা কামানের বিস্ফোরণে।)
শুক্রবার। জুম্মার নামাজের সময় হয়েছে। শের খাঁ’র হাতে বন্দি সম্রাট হুমায়ূনের ইমামকেই নামাজ পড়াতে বলা হলো। ইমাম খুৎবায় হুমায়ূনের নাম নিলেন।
শের খাঁ বললেন, খুৎবা পাঠে সামান্য ভুল হয়েছে। ভুল কী হয়েছে ইমাম সাহেব জানেন। তাঁকে নতুন করে খুৎবা পাঠ করতে বলা হচ্ছে।
দ্বিতীয় দফায় খুৎবায় শের খাঁর নাম পাঠ করা হলো। নামাজের শেষে শের খাঁ নিজেকে ভারতের সম্রাট ঘোষণা করে শাহ্ উপাধি গ্ৰহণ করলেন। শের খাঁ হলেন শের শাহ্।