০৮. জাফর সাহেব মেয়েকে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছেন

জাফর সাহেব মেয়েকে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছেন। তিথি অস্বস্তিতে মরে যাচ্ছে যদি মারুফের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। বাবাকে তাহলে সে কি বলবে? বাবাই বা কি মনে করবেন? তিথি ভয়ে ভয়ে চারদিক দেখছে–মারুফকে দেখা যাচ্ছে না। এত মানুষের মাঝে চট করে দেখা পাওয়াও মুশকিল। কোথাও নিশ্চয়ই আছে। দু নম্বর প্ল্যাটফরম থেকে ট্রেন ছাড়বে। সে নিশ্চয়ই দু নম্বর প্ল্যাটফরমে ঘোরাঘুরি করছে। তিথিকে দেখতে পেয়ে হাসি মুখে এগিয়ে আসবে। তখন তিথি তার বাবাকে কি বলবে?

দু নম্বর প্লাটফরমেও মারুফকে দেখা গেল না। তবু তিথির অস্বস্তি দূর হল না। যে কোন মুহুর্তে সে উদয় হতে পারে। জাফর সাহেব যখন মেয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন তখনই শুধু তিথি খানিকটা স্বস্তি বোধ করল। মারুফ এখন এসে উপস্থিত হলে তেমন অসুবিধা হবে না। নুরুজ্জামানকে সামলানো যাবে। সরল ধরনের মানুষ, এদের কে যা বলা হয় তাই তারা বিশ্বাস করে। সে সাড়ে নটায় বাসায় ফিরেছে তাকে বলা হয়েছে সিলেট যেতে হবে, সে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ গুছিয়ে প্রস্তুত। একবার জিজ্ঞেসও করে নি–কেন যেতে হবে? কদিন থাকতে হবে? হলুদ রঙের একটা কোট তার গায়ে। কোর্টের বোতামগুলি মেরুন রঙের। কোন সুস্থ মাথার মানুষ এ রকম একটা কোট গায়ে দিতে পারে? সে আবার সুযোগ পেলেই তিথিকে কোটি সম্পর্কে জ্ঞান দিচ্ছে।

রাস্তার সাইডে বিক্রি করছিল। হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রেখেছে। একটা দুইটা না শত শত কোট। আমি শুধু শুধু জিজ্ঞেস করলাম–দাম কত? বলল দুশ টাকা। আমি চলে আসছি, দোকানদার বলল, চলে যাচ্ছেন কেন, একটা দাম বলেন তারপর চলে যান। যদি দরে বনে দিয়ে দিব। না বনলে নাই। আমি বললাম, পঞ্চাশ টাকা। কেনার ইচ্ছা নাই এই জন্য বললাম, পঞ্চাশ। আগে একবার স্যান্ডেল কিনে ঠক খেয়েছিলাম। তাই বুদ্ধি করে এমন কম দাম বললাম। সে সাথে সাথে পলিথিনের ব্যাগের ভেতর ঢুকায়ে কোট দিয়ে দিল। পরলাম এমন বিপদে না কিনেও পারি না। নিজের মুখে দাম বলেছি। জিনিসটা কেমন হয়েছে?

ভাল।

ঠিক বলেছেন–ভাল। খুব গরম। গরমের চোটে ঘাম ছুটেছে।

তিথি অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, গরমের মধ্যে কোট গায়ে দিয়েছেন ঘামতো ছুটবেই।

এখন গরম তবে সিলেট শীতের জায়গা। তখন দরকার লাগবে। তাছাড়া ট্রেন ছাড়লেও শীত লাগবে।

তিথির বলতে ইচ্ছা করছে–নুরুজ্জামান সাহেব তাকিয়ে দেখুন একমাত্র আপনিই কোট পরে আছেন।

 

মারুফ যে শেষ পর্যন্ত আসবে না এটা তিথি ভাবতে পারে নি। ট্রেন ছাড়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সে আশা করে রইল সে দেখবে মারুফ ছুটতে ছুটতে আসছে। পরনে। সুন্দর একটা হাওয়াই সার্ট। মাথার চুল এলোমেলো। সে বোধহয় কখনোই চুল আঁচড়ায় না। বিয়ের পর একটা কাজ তিথি অবশ্যই করবে। মারুফের চুল আঁচড়ে দেবে।

ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। জানালার কাছে তিথি একা বসে আছে। কামরার দরজাটা খেলা। দরজা বন্ধ করলেই সে একা হয়ে যাবে। তিথি এখনো দরজা বন্ধ করছে না। এখনো সে আশা করে আছে দেখা যাবে হুট করে দরজা দিয়ে মারুফ ঢুকছে। এরকমতো হতেই পারে।

কামরার দরজা তিথি ইচ্ছা করেই খোলা রেখেছে। তার মন বলছে মারুফ ট্রেনে উঠেছে তাকে খুঁজে পাচ্ছে না। ফাস্টক্লাস কামরাগুলিতে সে খুঁজবে। দরজা খোলা না রাখলে সে বুঝবে কি করে তিথি এই খানেই আছে।

ট্রেনের এটেনডেন্ট উঁকি দিল। হাতে কম্বল এবং বালিশ। দুটিই বেশ পরিস্কার। সাধারণত ট্রেনের এটেনডেন্টদের চেহারা এবং আচার আচরণ রুক্ষ ধরনের হয়ে থাকে। এর তেমন না। এর বয়স অল্প। সুন্দর চেহারা। কথা বলছে ভদ্র ও বিনীত ভঙ্গিতে।

আপা রাতের খাবার খাবেন?

না।

চা দেই আপা? চা খান। রাত এগারোটার পর চা বন্ধ হয়ে যাবে।

দিন। চা দিন।

দরজাটা কি বন্ধ করে দেব আপা?

না। কিছুক্ষণ খোলা থাক।

ট্রেনের গতি বাড়ছে। রাতের ট্রেনগুলি কি সব সময়ই দ্রুত চলে? জোছনা আছে। ট্রেনের জানালা থেকে জোছনা মাখা প্রকৃতি দেখার মত আনন্দ আর কিইবা হতে পারে। রাতের ট্রেনে উঠলে তিথির সব সময় মনে হয়–ট্রেনে ট্রেনে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারলে মন্দ হত না। তবে একা না। একজন পাশে দরকার। এমন একজন যাকে দেখতে ভাল লাগে। যার পাশে বসতে ভাল লাগে। যার কথা শুনতে ভাল লাগে। এমন একজন যে কথা বলতে বলতে চোখ ফিরিয়ে নিলে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে, তুমি চোখ ফিরিয়ে নিলে কেন? খবর্দার আর কখনো এরকম করবে না।

মারুফ কি এমন একজন?

অবশ্যই।

মারুফ নিজে কিন্তু তা জানে না। তিথি তাকে তা জানতে দেয় নি। কাউকে প্রচণ্ডভাবে ভালবাসার মধ্যে এক ধরনের দুর্বলতা আছে। নিজেকে তখন তুচ্ছ এবং সামান্য মনে হয়। এই ব্যাপারটা নিজেকে ছোট করে দেয়। তিথির নিজেকে ছোট করতে ইচ্ছা হয় না।

মারুফের সঙ্গে তার পরিচয় পর্বটা বেশ অদ্ভুত। তিথি এক দুপুরবেলা সায়েন্স লাইব্রেরীর থেকে বের হয়েছে। মাথা না আঁচড়ানো এলোমেলো চুলের এক ছেলে এসে বলল, গত বছর ময়ূখের অনুষ্ঠানে আপনার গান আমার অদ্ভুত ভাল লেগেছে। আপনার সঙ্গে আজ এইভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবি নি। যদিও আপনাকে অনেক খুঁজেছি। যাদের প্রাণপণ খে[জা হয় তাদের কখনো পাওয়া হয় না। ভাগ্যিস আপনাকে পেলাম। আমার নাম মারুফ।

তিথি হকচকিয়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে কোনমতে বলল, আপনি মনে হয় ভুল করছেন। আমি গান গাইতে পারি না। কখনো গান গাইনি। ময়ূখের অনুষ্ঠান কি তাও জানি না।

আই এ্যাম সরি।

সরি হবার কিছু নেই। মানুষ ভুল করে। আপনিও করেছেন।

তা করেছি। তবে আমি সচরাচর ভুল করি না।

তিথির তখন চট করে মনে হল এই ছেলেটা তার সঙ্গে কথা বলার জন্যে গল্পটা বানিয়েছে। তার মন খারাপ হল। তিথি এমন কেউ না যে তার সঙ্গে কথা বলার জন্যে একটা মিথ্যা গল্প তৈরী করতে হবে।

মারুফ তখন দাঁড়িয়ে আছে। তিথি সহজ ভঙ্গিতে বলল, কিছু বলবেন?

মারুফ বলল, একটা কথা বলতে চাচ্ছি। সাহসে কুলুচ্ছে না। আপনি যদি অন্য কিছু মনে করেন।

বলুন। আমি কিছু মনে করব না।

আপনি ভাবছেন আপনার সঙ্গে আলাপ করবার জন্যে আমি এই গল্পটা বানিয়েছি। এই জন্যেই আমার খারাপ লাগছে। গল্পটা আমি বানাইনি। আমি ঔপন্যাসিক না। গল্প বানাবার ক্ষমতা আমার নেই। বিশ্বাস করুন।

আমি বিশ্বাস করলাম।

তিথি লাইব্রেরী থেকে নেমে এল রাস্তায়। রিকশা নিল। রিকশায় উঠে আরেকবার তাকালো ছেলেটার দিকে। সে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। ধ্বক করে তিথির বুকে ধাক্কা লাগল। তিথি ভেবেই ছিল মারুফ নামের এই ছেলেটি তার দিকে তাকিয়ে থাকবে। কেন সে তা করল না? এটা এমন কোন বড় ঘটনা না। খুবই সামান্য ঘটনা। কিন্তু এই সামান্য ঘটনার কারণে তিথির সেই রাতে এক ফোঁটা ঘুম হল না।

শায়লা ফজরের নামাজ পড়বার জন্যে ভোররাতে উঠে দেখেন তিথি অন্ধকারে বসার ঘরের সোফায় চুপচাপ বসে আছে। তিনি বললেন, কি হয়েছে রে তিথি? তিথি কাদো কাদো গলায় বলল, কিছু হয়নি।

পরের তিন মাস মারুফের সঙ্গে তিথির দেখা হয়নি। যত বার তিথি লাইব্রেরীতে। গিয়েছে ততবারই তার মনে হয়েছে আজ লাইব্রেরী থেকে বের হলেই মারুফ নামের ঐ ছেলেটির সঙ্গে দেখা হবে। দেখা হয়নি। প্রতিদিনই চাপা এক ধরণের কষ্ট নিয়ে তিথিকে বাসায় ফিরতে হয়েছে। প্রতিদিনই শায়লা জিজ্ঞেস করেছেন–কি হয়েছে তোর বলতো?

তিথি বলেছে, কিছু হয়নি।

অবশ্যই হয়েছে। সব আমাকে খুলে বল।

খুলে বলার মত কিছু হয়নি মা।

তারপর একদিন তিথি হাসিমুখে বাসায় ফিরল। দেখা হয়েছে মারুফের সঙ্গে। তিথি লাইেব্ররী থেকে বের হয়েই দেখল মারুফ লাইব্রেরীর বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাবার চেষ্টা করছে। বাতাসের জন্যে সিগারেট ধরাতে পারছে না। তিথি একবার ভাবল–কিছু না বলে এগিয়ে যাবে। পরমুহূর্তেই সব সংকোচ সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে এগিয়ে এসে বলল, কেমন আছেন?

মারুফ বলল, ভাল।

তিথি বলল, আমাকে চিনতে পারছেনতো?

পারছি। ময়ূখের অনুষ্ঠানে আপনি গান গিয়েছিলেন। যদিও আপনি তা স্বীকার করেন না। আপনি ত্রিশ সেকেণ্ড আমার জন্যে দাঁড়াবেন–আমার দেয়াশলাইয়ের কাঠি শেষ হয়ে গেছে আমি সিগারেট টা ধরিয়ে নিয়ে আসি।

তিথি বলল, এই কাজটা কি আপনি ত্রিশ সেকেণ্ডে করতে পারবেন?

মারুফ বলল, পারব। আপনি ঘড়ি দেখুন আমি ত্রিশ সেকেণ্ডে সিগারেট ধরিয়ে আবার এখানে চলে আসব। আপনার ঘড়িতে সেকেণ্ডের কাঁটা আছেতো?

আছে।

ফাইন। তাকিয়ে থাকুন সেকেণ্ডের কাঁটার দিকে।

মারুফ ২৭ সেকেণ্ডের মাথায় সিগারেট ধরিয়ে চলে এল এবং হালকা গলায় বলল, ত্রিশ সেকেণ্ড আসলে অনেক দীর্ঘ সময়। আমরা তা বুঝতে পারি না।

 

বেয়ারা পটে করে চা নিয়ে এসেছে।

চা ঢেলে দেব আপা?

না আমি নিজেই ঢেলে নেব। আমরা এখন কোথায় আছি?

টঙ্গী ক্রস করেছি আপ।

নেক্সট ষ্টপেজ কোথায়?

ভৈরব। আপা দরজা বন্ধ করে দিয়ে যাই?

আচ্ছা।

ঘুমুবার সময় ভেতর থেকে লক করে দিবেন আপা।

আচ্ছা।

তিথি একা একা চা খাচ্ছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে এখন আর ভাল লাগছে না। পৃথিবীর কোন সুন্দর দৃশ্যই বোধহয় এক নাগারে বেশিক্ষণ দেখা যায় না। সুন্দর যেমন আকর্ষণ করে তেমনি বিকর্ষণও করে।

দরজায় নক হচ্ছে। নুরুজ্জামান এসেছে বোধহয়। তিথি লক্ষ্য করেছে এর মধ্যেই কয়েকবার সে দরজার সামনে দিয়ে হেঁটে গেছে। সে তার দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করছে। তিথিকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাকে কঠিণ করে বলতে হবে, আপনি বিরক্ত করবেন নাতো। নিজের জায়গায় গিয়ে ঘুমিয়ে থাকুন। প্রয়োজন হলে আমি আপনাকে ডাকব।

 

তিথি দরজা খুলল।

মারুফ দাঁড়িয়ে আছে। তার কাঁধে পেটমোটা বিশাল এক কালো ব্যাগ। গায়ে নতুন একটা সার্ট। কি সুন্দর তাকে মানিয়েছে। মারুফ বলল, অবাক হয়েছ?

তিথি জবাব দিল না।

মারুফ বলল, তোমাকে অবাক করে দেবার জন্যে এতক্ষণ উদয় হই নি। ঘাপটি মেরে ছিলাম।

তিথি এখনও কথা বলছে না। তাকিয়ে আছে। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে চায়ের কাপ থেকে ছলকে খানিকটা চা পড়ে গেছে তার শাড়িতে।

মনে হচ্ছে অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছ? ভেতরে আসতে পারি?

হ্যাঁ পার।

বসতে পারি?

পার।

এখন সত্যি করে বল তো, তুমি কি মনে মনে আমাকে এক্সপেক্ট করছিলে না?

করিছলাম।

আমাকে দেখে খুশি হয়েছ তো?

হয়েছি।

তোমার মুখে কিন্তু হাসি নেই। হাসিমুখে তাকাও তে। এই তো হাসি এসেছে। গুড গার্ল।

মারুফ দরজা বন্ধ করে দিল। তিথি ক্ষীণ স্বরে বলল, দরজা খোলা থাক না।

মারুফ বলল, দরজা খোলা থাকবে কেন? একটা কামরায় আমরা দুজন আলাদা–এই ব্যাপারটায় তুমি কি অস্বস্তি বোধ করছ? আচ্ছা বল, এটা কি অস্বস্তি বোধ করার মত কোন ব্যাপার? তারপরেও তুমি যদি অস্বস্তি বোধ কর তাহলে বরং একটা প্রতিজ্ঞা করি।

কি প্রতিজ্ঞা?

কঠিন প্রতিজ্ঞা। যে প্রতিজ্ঞা ভাঙা অসম্ভব। তোমার হাত ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা। দেখি ডান হাতটা বাড়াও।

তিথি হাত বাড়াল। মারুফ হাত ধরে, চোখ বন্ধ করে বিড় বিড় করে বলল,

পৃখিবী নামক গ্রহটির সবচে রূপবতী তরুণীর হাত ধরে প্রতিজ্ঞা করছি–এই কামরায় আমি যতক্ষণ থাকব ততক্ষণ আমি এই রূপবতীর কাছ থেকে খুব কম করে হলেও এক হাত দূরত্ব বজায় রাখব।

তিথি বলল, নাটক করার দরকার নেই। তুমি বস তো আরাম করে।

তাহলে আমি কি ধরে নিতে পারি যে, এই কামরায় রাত কাটানোর অনুমতি পেয়েছি??

চা খাবে? পটে চা আছে।

দাও।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে মারুফ বলল, হলুদ কোট পরা একজনকে দেখলাম তোমার মালপত্র টানাটানি করছে–সে কে?

নুরুজ্জামান।

ও আচ্ছা–আমাদের পাতার বাঁশিবাদক। তোমার চড়নদার?

হুঁ।

যে কোট গায়ে দিয়ে সে ঘুরছে সেটা যে মেয়েদের কোট তা তুমি ওকে বলতে পারলে না?

বেচারা শখ করে কিনেছে। কি দরকার কথা বলার?

মারুফ বলল, তোমার সঙ্গে কি কোন খাবার আছে তিথি? আমি তাড়াহুড়া করতে গিয়ে খেয়ে আসি নি।

আমার সঙ্গে কোন খাবার নেই। তবে এদের বুফে কারে নিশ্চয়ই খাবার আছে।

নেই, খোঁজ নিয়েছি। বোম্বাই টোস্ট নামে কি একটা ভেজে রেখেছে। ওর থেকে ১০১ গজ দূরে থাকা ভাল।

সারারাত না খেয়ে থাকবে?

হ্যাঁ থাকব। সিগারেট ধরাব, তোমার অসুবিধা হবে না তো?

ক্রমাগত সিগারেট খেতে থাকলে অসুবিধা হবে। একটা-দুটা খেলে অসুবিধা হবে না।

একটা মানুষ সারা রাত না খেয়ে থাকবে? তিথির খুব খারাপ লাগছে। কোন স্টেশনে থামলে কলাটলা জাতীয় কিছু কিনতে হবে। নেক্সট স্টপেজ কোথায়–ভৈরব? ভৈরবে থামবে তো? আস্ত নগর ট্রেনগুলি এমন হয়েছে কোথাও থামে না। ট্রেন স্টেশনে না থামলে ভাল লাগে না। স্টেশনে ট্রেন থামবে, চা গ্রাম চা গ্রাম শব্দ হবে। লোকজন উঠবে নামবে। তবেই না মজা।

তিথি বলল, ভৈরবে ট্রেন থামলে তুমি স্টেশনে নেমে কিছু খেয়ে নেবে।

আমার খাওয়া নিয়ে তুমি মোটেই চিন্তা করবে না। না খেয়ে থাকা আমার অভ্যাস আছে।

মারুফ না খেয়ে আছে এটা সত্যি না। সে খাওয়া-দাওয়া করেই ট্রেনে উঠেছে। খাওয়ার কথা বলেছে, কারণ ক্ষুধার্ত মানুষের প্রতি মেয়েদের এক ধরনের বিশেষ মমতা আছে। মমতা তৈরীর এই সুযোগ নষ্ট করা ঠিক হবে না।

তোমার বাবা কেমন আছেন?

ভাল।

এখনো হাসপাতালে?

মনে হয়।

মনে হয় বলছ কেন?

আমার এক মামা আছেন, তাঁকে বলে এসেছি বাবাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করিয়ে বাসায় এনে রাখতে। তবে বাবা বোধহয় রাজি হবেন না। তিনি কোন কিছুতেই রাজি হন না।

বন্ধ দরজায় টোকা পড়ছে। মারুফ বিরক্ত মুখে দরজা খুলে দিল। নুরুজ্জামান দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে রাজ্যের বিস্ময়। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মারুফের দিকে। মারুফ বলল, আপনি কি চান?

নুরুজ্জামান বলল, আপনি কে? আপনি এখানে কেন? এটা রিজার্ভ কামরা। উনি একা যাবেন।

তিথি খুবই অস্বস্তির সঙ্গে বলল, নুরুজ্জামান সাহেব, কোন অসুবিধা নেই।

নুরুজ্জামান কঠিন গলায় বলল, অসুবিধা নেই বললে তো হবে না। অবশ্যই অসুবিধা আছে। এই যে ভাই শুনুন। বের হয়ে আসুন।

নুরুজ্জামান কথা বলছে উঁচু গলায়। তাকে দেখে মনে হচ্ছে এখনই সে সার্টের কলার ধরে মারুফকে বের করে আনবে।

মারুফ বিরক্ত গলায় বলল, আপনি বরং ভেতরে এসে বসে একটু শান্ত হোন। যে হৈ-চৈ শুরু করেছেন ট্রেনের সব যাত্রী চলে আসবে। তিথি, আমার ব্যাপারটা তুমি এই ভদ্রলোককে বুঝিয়ে বল তো। যন্ত্রণা হল দেখি!

তিথি বলল, নুরুজ্জামান সাহেব, ভেতরে আসুন।

নুরুজ্জামান ভেতরে ঢুকল।

দরজা বন্ধ করে দিয়ে বসুন।

আমি বসব না। কি বলবেন বলুন।

বসুন তো।

নুরুজ্জামান বসল না। দাঁড়িয়েই থাকল। তিথি বলল, উনি আমার পরিচিত একজন। তার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। তিনি এক কাপ চা খাবার জন্যে ঘরে এসেছেন। আপনি যা হৈ-চৈ শুরু করেছেন–খুবই অস্বস্তির মধ্যে আমাদের ফেলেছেন।

নুরুজ্জামান লজ্জিত গলায় বলল, আসলে আমার মাথায় হঠাৎ রক্ত উঠে গেছে। এটেনডেন্টকে জিজ্ঞেস করেছি আপনি চা-টা খেয়েছেন কি-না। সে তখন বলল, এই ঘরে একজন ভদ্রলোক আছেন। তখন …

তিথি শান্ত গলায় বলল, বুঝতে পারছি। আপনি শুধু শুধুই আপসেট হয়েছেন। একজন অচেনা লোক তো আর হুট করে আমার ঘরে ঢুকে যেতে পারবে না। আমি তা দেব কেন?

মারুফ বলল, তিথি, তুমি সত্যি কথাটা ভদ্রলোককে বল। ও চলে যাক।

নুরুজ্জামান বলল, সত্যি কথাটা কি?

মারুফ আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরতে বলল, সত্যি কথাটা হচ্ছে–তিথি আমার স্ত্রী। আমরা গোপনে রেজিস্ট্রি বিয়ে করেছি। দু সীটের এই স্লিপিং বার্থ নেয়া হয়েছে যাতে আমরা নিরিবিলি যেতে পারি। আশা করি ব্যাপারটা এখন বুঝতে পেরেছেন? না কি আপনাকে বিয়ের কাবিন নামা দেখাতে হবে?

নুরুজ্জামান ভয়ংকর অবাক হয়ে তিথির দিকে তাকালো। তিথির দারুণ লজ্জা লাগছে। মারুফ এসব কি বলছে? তিথি অস্বস্তি ঢাকার জন্যে অকারণেই নিজের ব্যাগ খুলল।

মারুফ বলল, তিথি, আমি যে সত্যি কথা বলছি এটা এই ভদ্রলোককে বলে দাও–ও বিদেয় হোক।

তিথি বলল, নুরুজ্জামান সাহেব–আমাদের বিয়ে এখনো হয়নি। তবে এক সপ্তাহের ভেতরই হবে।

ও আচ্ছা।

মারুফ বলল, ও আচ্ছা না। আপনি দয়া করে নিজের জায়গায় যান। আপনার হলুদ কেটি দেখে মাথা ঘুরছে। এই কোট পেয়েছেন কোথায়?

কিনেছি?

এটা যে মেয়েদের কোট তা জানেন?

জ্বি না, জানতাম না।

এখন তো জানলেন। এখন দয়া করে কোটটা গা থেকে খুলে ফেলুন। এবং বিদেয় হোন।

নুরুজ্জামান নড়ল না। বরং তিথি এবং মারুফ দুজনকেই অবাক করে দিয়ে বসল। মারুফ বলল, বসলেন যে! ব্যাপার কি? নুরুজ্জামান জবাব দিল না।

জাফর সাহেব তার উপর দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছেন। তিথিকে দেখে-শুনে নিয়ে যেতে। সে যে ভাবেই হোক তা করবে। এদের বিয়ে যখন হবে, তখন হবে। এখনও তো বিয়ে হয় নি।

মারুফ বলল, মনে হচ্ছে আপনি যাবেন না?

নুরুজ্জামান বলল, জ্বি, অবশ্যই যাব। এখানে বসে থাকব কেন?

এই তত বসে আছেন।

আপনার জন্যে বসে আছি।

আমার জন্যে বসে আছেন মানে?

আপনি যখন যাবেন তখন আমিও যাব।

মারুফ তিথির দিকে তাকালো। তিথি কিছুই বলল না। মারুফ নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে হাসিমুখে বলল, আচ্ছা আচ্ছা, বসুন। তিনজন মিলেই গল্প করা যাক। আসলে গল্প-গুজব তিনজন ছাড়া জমে না। থ্রি ইজ কোমপেনি। আপনি করেন কি?

আমি একজন শিক্ষক।

তিথি বলছিল আপনি একজন বংশিবাদক। পাতার বাঁশি বাজান।

জ্বি বাজাই।

ভাল। বাজান পাতার বাঁশি। শুনে দেখি। আর যখন কিছুই করার নেই তখন পাতার বাঁশিই শোনা যাক।

পাতা সাথে নাই।

বাঁশি বাজান অথচ সাথে পাতা নেই এটা কেমন কথা? এরপর থেকে সঙ্গে পাতা রাখবেন। কোন স্টেশনে যদি ট্রেন থামে তাহলে দৌড়ে নেমে পাতা নিয়ে আসবেন।

জ্বি আচ্ছা।

তিথি, তুমি চুপ করে আছ কেন? কিছু বল।

আমার মাথা ধরেছে।

একটু কষ্ট কর। কোন এক স্টেশনে ট্রেন থামুক–তখন উনি পাতা নিয়ে আসবেন। সেই পত্রসংগীত শুনে হোপফুলি তোমার মাথাধরা সেরে যাবে। নাম কি যেন আপনার?

নুরুজ্জামান।

লোকজন আপনাকে কি ডাকে? নুরু?

জ্বি। আমি আপনাকে নুরু ডাকলে আপনার আপত্তি আছে?

জ্বি-না।

নুরু!

জ্বি।

ভালবাসা সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত কি?

কি বললেন বুঝতে পারলাম না।

মনে করুন, আপনার স্কুলের ছাত্রদের আপনি ভালবাসা কি এর উপর একটা বক্তৃতা দিচ্ছেন। এদের কি বলবেন?

ইস্কুলে তো এইসব বিষয়ে বক্তৃতা দেয়া হয় না।

মনে করুন, নতুন কারিকুলাম তৈরি হয়েছে। এই কারিকুলামে ভালবাসার উপর বক্তৃতার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তখন কি করবেন? কারিকুলাম শব্দটার মানে জানেন তো?

জানি।

তিথি বলল, তুমি কি সব কথা বলছ? দয়া করে চুপ কর।

চুপচাপ বসে থেকেই বা কি হবে? তারচে বরং আমরা নুরুর কাছ থেকে ভালবাসা কি এটা জেনে নেই। আমার মনে হচ্ছে উনার বক্তৃতা ইন্টারেস্টিং হবে। নুরু, বলুন ভালাবাসা কি?

নুরুজ্জামান বলল, ঘৃণার উল্টোটাই হল ভালবাসা। আমাকে এইখানে বসে থাকতে দেখে আপনার মনে যে ভাব তৈরি হয়েছে এটার উল্টোটাই ভালবাসা।

মারুফ একটু থমকে গেল। হলুদ কেটি গায়ে এই গ্রাম্য মানুষটার মুখ থেকে এ ধরনের কথা আশা করা যায় না। তবে গ্রামের লোক মাঝে-মাঝে চমকে যাওয়ার মত কথা বলে। সেই সব কথাও সাময়িক। আলো পড়লে এক খণ্ড লোহাও মাঝেমধ্যে ঝলসে উঠে। হীরক খণ্ডের সার্বক্ষণিক দ্যুতি লোহার মধ্যে নেই।

নুরু!

জ্বি।

ভালবাসার ব্যাখ্যা তো আপনি উল্টো দিক থেকে করলেন। সরাসরি ব্যাখ্যা করুন তো।

ময়মনসিংহ গীতিকায় ভালবাসা কি তা সুন্দর করে বলা আছে। সেটা বলব?

বলুন।

উইড়া যায়রে বনের পখী পইরা থাকে মায়া।

এখানে ভালবাসা কোনটা—বনের পাখিটা? যে উড়ে চলে গেল?

জ্বী না। বনের পাখি ভালবাসা না। ভালবাসা হল মায়া। পাখি উড়ে গেলেও যেটা থাকে, সেটা।

ট্রেন ভৈরব স্টেশনে থেমেছে। তিথি মারুফের দিকে অকিয়ে ব্যস্ত হয়ে বলল, তুমি খাবারের ব্যবস্থা কর।

মারুফ বলল, দরকার নেই।

দরকার নেই বললে তো হবে না। তুমি সারারাত না খেয়ে থাকবে না-কি?

আমার খিদে নষ্ট হয়ে গেছে।

মোটেই তোমার খিদে নষ্ট হয় নি। মুখ দেখেই মনে হচ্ছে তুমি কষ্ট পাচ্ছ।

খাদ্যের অভাবে আমি কষ্ট পাই না তিথি। আমি কষ্ট পাই ভালবাসার অভাবে।

কথার পিঠে এই চমৎকার বাক্যটি ব্যবহার করতে পেরে মারুফের ভাল লাগছে। সব সময় এ রকম বাক্য মাথায় আসে না। হঠাৎ হঠাৎ আসে।

নুরুজ্জামান উঠে দাঁড়াল। মারুফ বলল, চলে যাচ্ছেন না কি? দয়া করে চলে যাবেন না। আপনি চলে গেলে আমরা এতিম হয়ে পড়ব।

নুরুজ্জামান বলল, আমি আপনার জন্যে খাবার নিয়ে আসি। কি খাবেন বলুন? বিষ পাওয়া যায় কিনা দেখুন। ব্যাটম হলে সবচে ভাল হয়।

নুরুজ্জামান নেমে গেল। তিথি বলল, তুমি এই লোকটাকে নিয়ে রসিকতা করছিলে। আমার ভাল লাগছিল না।

আমারও ভাল লাগছিল না। কি করব বল–রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। রসিকতা করে রাগটা একটু কমালাম। তবে লোকটা নির্বোধ না। ভালবাসার ব্যাখ্যা ভালই দিয়েছে। এখন বল তো তিথি, এই ব্যাটার হাত থেকে কি করে উদ্ধার পাওয়া যায়?

জানি না।

একটা বুদ্ধি বের কর।

তিথি চুপ করে থাকল। আসলেই তার মাথা ধরে গেছে। কপাল দপদপ করছে। জ্বর আসছে কি না কে জানে, শীত শীত লাগছে। মারুফ বলল, একটা কাজ যদি কর তাহলে কিন্তু এই গাধা বিদেয় হবে।

কি কাজ?

তুমি যদি তাকে কঠিন করে বল–আপনি আমাদের যথেষ্ট বিরক্ত করেছেন–এখন চলে যান। আমরা এখন দরজা বন্ধ করে গল্প করব। পারবে বলতে?

না।

তোমাকে বলতেই হবে। না বললে হবে কি ভাবে? এমন সুন্দর একটা ব্রত আমরা নষ্ট করব? তাকিয়ে দেখ কি সুন্দর জোছনা।

তিথি চুপ করে আছে। মারুফ বলল, এই লোক কি করবে জান? এ আমার জন্যে খাবার আনবে, সেই সঙ্গে পাতা নিয়ে আসবে বাঁশি বাজানোর জন্যে। পাতার বাঁশি বাজিয়ে সে তোমাকে মুগ্ধ করতে চাইবে।

কেন?

আমার তাই মনে হচ্ছে। এবং আমার ধারণা বাঁশি ভালই বাজাবে। তুমি মুগ্ধ হয়েও যেতে পার।

পাগল হলে না-কি?

বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছি। এই লোক আর কিছুক্ষণ থাকলে আমি সত্যি পাগল হয়ে যাব। শোন তিথি–তুমি এই লোককে যদি চলে যেতে না বল তাহলে আমি নিজে চলে যাব। তিনজন এই কামরায় বসে থাকার কোন অর্থ হয় না।

নুরুজ্জামান খাবার নিয়ে এসেছে। লুচি, মিষ্টি, কলা। মারুফ বলল, পাতা কোথায়?

কিসের পাতা?

পাতা ছাড়া বাঁশি বাজাবেন কি ভাবে? পাতা আনেন নি?

জ্বি না।

ও মাই গড়! কৃষ্ণের বাঁশি ছাড়া আমরা এই দীর্ঘ রজনী পার করব কি ভাবে?

নুরুজ্জামান তাকিয়ে আছে। তার চোখের তারায় চাপা রাগ ঝিলিক দিচ্ছে। সে খাবার নামিয়ে রাখছে। মারুফ বলল, তিথি বোধহয় আপনাকে কিছু বলবে, শুনুন তো। মন দিয়ে শুনবেন। তিথি, তুমি কি জানি বলতে চাচ্ছিলে, বলে ফেল।

তিথি বলল, নুরুজ্জামান, আপনি এখন চলে যান। ভোরবেলা ট্রেন যখন থামবে তখন আসবেন।

নুরুজ্জামান খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, জ্বি আচ্ছা।

নুরুজ্জামান বাইরে এসে দাঁড়াতেই মারুফ ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। মারুফ বলল, তিথি শোন, তুমি আপসেট হয়ো না। আমি কিছুক্ষণের জন্যে বাতিটা নিভিয়ে দিচ্ছি। বাতি নিভিয়ে আমি ঐ লোককে একটা ম্যাসেজ দিতে চাই। তা ছাড়া বাতি না. নেভালে সুন্দর চাদের আলো আমরা পাব না।

তিথি কিছু বলার আগেই মারুফ বাতি নিভিয়ে দিল।

নুরুজ্জামান মিনিট পাঁচেক বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ক্লান্ত পায়ে চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *