০৮. জান্নাতেও মদ?

জান্নাতেও মদ?

সকালবেলার ক্যাম্পাস অন্যরকম সৌন্দর্যে ভরে ওঠে। দোয়েল চত্বরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া ফুলগাছটির মগডাল দেখলে প্রথমেই আগুনের গোলা ভেবে যে-কেউ ভুল করতে পারে। মন্টু দার দোকানের পেছনে এঁকেবেঁকে উঠে যাওয়া অর্কিডের গাছ আর রাস্তার দু-পাশে সেনাপতির মতো দাঁড়িয়ে থাকা বকুল, সবমিলিয়ে ক্যাম্পাসটি যেন পৃথিবীর বুকেই এক টুকরো স্বর্গ।

সকালে বুক ভরে মুক্ত বাতাস গ্রহণের তাগিদে এই তল্লাটে অনেকের আগমন ঘটে থাকে। পিজি হাসপাতালের রোগী থেকে শুরু করে বিজি বিজনেসম্যান, পড়ুয়া ছাত্র থেকে শুরু করে পড়ানো শিক্ষক—সকালবেলা সবাই খুব ফুরফুরে মন নিয়ে এদিকটায় হেঁটে যায়।

আজ রবিবার। আমার আর সাজিদ, দুজনের একজনেরও ক্লাস নেই। এদিনটায় আমরা সাধারণত আড্ডা দিয়ে থাকি। খুব ভোরবেলায় সাজিদ রুম থেকে বের হয়েছে। এখনো ফেরার নামগন্ধ নেই। চোখ কচলাতে কচলাতে গতরাতে করা অ্যাসাইনমেন্টের ওপরে ফাইনাল রিভিশন দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের পাশের যে রুমে পার্থরা থাকে, সেখান থেকে জোর ভলিউমে রবীন্দ্রনাথের গান ভেসে আসছে।

খেয়াল করলাম বাইরে থেকে গানের আওয়াজ ছাড়াও কিছু কর্কশ চিৎকার আর আওয়াজের শব্দ ভেসে আসছে। কাছাকাছি কোনো জায়গা থেকেই যে এই শব্দ আসছে সেটি নিশ্চিত। অ্যাসাইনমেন্ট পেপার ভাঁজ করে টেবিলে রেখে গায়ে শাল জড়িয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। ফাগুনের এ সময়টায় ভোরবেলা মৃদুমন্দ শীত পড়ে। এই শীতে গায়ে শাল জড়ানোর দরকার পড়ে না অবশ্য; কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে লুকোনো জ্বর আর সর্দিতে কাহিল হয়ে ওঠা শরীর এই শীতকেও প্রচণ্ড রকম ভয় পাচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে গায়ে শাল তোলা। যাই হোক, রুম থেকে বেরিয়ে দূর থেকে আসা চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজ লক্ষ্য করে এগোতে থাকলাম। দেখতে পেলাম, পূর্বপাশে অবস্থিত থার্ড বিল্ডিংটার নিচে ছোটখাটো একটি জটলা হয়ে গেছে। ওই বিল্ডিংয়ের সবাইকেই চিনি না আমি। কোনো একটি ব্যাপার নিয়ে তারা বেশ তর্কাতর্কি আর হট্টগোল শুরু করেছে বুঝতে পারছি।

আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম জটলাটার দিকে। খুব কাছে না গিয়ে নিরাপদ দূরত্বে এসে দাঁড়ালাম। কোনো একটি জায়গায় যখন সব মানুষ একসাথে কথা বলে, তখন সম্ভবত কেউই কারও কথা শুনতে পায় না। শুনতে না পেলেও মানুষগুলো অনর্গল কথা বলেই যায়। বলে আনন্দ পায়। তারা ভাবে, তাদের কথা অন্যরা খুব আগ্রহভরে শুনছে। এরকম দূরত্বে থেকে আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না আসলে ঘটনা কী।

মধ্যবয়স্ক গোছের একজন লোককে এগিয়ে আসতে দেখে আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আঙ্কেল, একটু কথা বলা যাবে?

ভদ্রলোক বেশ বিরক্ত হলেন বলে মনে হলো। বিরক্তি কোনোরকমে চেপে রেখে বললেন, কী কথা?

এখানে কী নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে?

গিয়া দেখলেই তো পারেন। আমারে জিগান ক্যা?

লোকটার ত্বরিত উত্তর শুনে আমার মনের ভেতরে মিটিমিটি করে জ্বলতে থাকা সব আশার প্রদীপ যেন ধপ করেই নিভে গেল। আমার ওপরে অকারণ চটে বসার কোনো যৌক্তিক কারণ আমি খুঁজে পেলাম না। আমি বেশ ফ্যাকাশে মুখ করে বললাম, ধন্যবাদ।

আমার ধন্যবাদ পেয়েও তার চেহারার মধ্যে খুব বেশি পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি। সম্ভবত তিনি ধরে নিয়েছেন, এই ধন্যবাদ দিয়ে আমি তাকে কোনোভাবে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছি। আমার পাতা ফাঁদে পা দেবেন না এই বিশ্বাস নিয়ে তিনি যে-গতিতে হেঁটে এসেছিলেন, ঠিক সেই গতিতে হেঁটে চলে গেলেন।

কিন্তু আমিও কোনোভাবেই দমে যাওয়ার পাত্র নই। এই রহস্যের সমাধান না করে তো থামছি না। ধীরে ধীরে জটলার দিকে এগিয়ে গেলাম। কাছে এসে দেখতে পেলাম এখানে এলাহি কাণ্ড! লোকজনের কথাবার্তা শুনে যা বোঝা গেল তা হলো, এই বিল্ডিংয়ের কেউ কেউ রোজ রাতে মদ খেয়ে মাতলামি শুরু করে। মাতলামির পর্যায় এমন মাত্রায় গিয়ে পৌঁছায় যে, বিল্ডিংয়ের অন্যান্য লোকজন এই ব্যাপারটি নিয়ে রীতিমতো ক্ষুব্ধ। তারা নাকি দফায় দফায় ওয়ার্নিং দিয়েও এই মাতালদের দমাতে পারেননি। আজ সকালবেলাতেও নাকি এই মাতালের দলের চিৎকার-চেঁচামেচির জন্যে ফজরের সালাত পড়তে অসুবিধা হচ্ছিল কারও কারও। ধার্মিকশ্রেণির লোকেরা এই মাতালদের একটি বিহিত করার জন্যেই এখানে একত্র হয়েছে। ওদিকে মাতাল না হয়েও মাতালদের দলে যোগ দিয়েছে আরও কিছু লোক। তাদের দাবি হচ্ছে, কে মদ খাবে আর কে খাবে না এটি ব্যক্তির একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। মদ খেলে মাতলামি করবে, এটাই স্বাভাবিক। এ নিয়ে ধার্মিক লোকগুলোর এত জ্বালাপোড়া হবে কেন?

এরকম কথা বলা লোকগুলো বোধ করি নাস্তিক হয়ে থাকতে পারে। তারা ডিফেন্ড করছে মাতালগুলোকে। ধার্মিক আস্তিকগুলো এত যুক্তিতর্ক শুনতে নারাজ। তারা চায়, হয় এরা মদখাওয়া ছাড়বে, না-হয় বিল্ডিং ছাড়বে।

এই তর্ক এরকম স্রেফ সাধারণ তর্কে স্থির থাকলে একটি কথা ছিল; কিন্তু এটি আর কোনো সাধারণ তর্কে থেমে নেই। এই তর্ক রীতিমতো থিওলোজিক্যাল ডিবেট তথা ধর্মকেন্দ্রিক তর্কাতর্কিতে রূপ নিয়েছে।

নাস্তিককুলের দাবি হলো, কুরআনে নাকি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা জান্নাতে পুরস্কার হিশেবে মদ খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অবস্থা যদি এই হয়, তাহলে মদখাওয়া ব্যাপারটাকে খারাপভাবে দেখা হবে কেন—এটাই এক নাস্তিকের প্রশ্ন।

এক আস্তিক বেশ জোরালো গলায় বলল, কখনোই নয়। কুরআনে এরকম কোনো কথা থাকতেই পারে না।

আস্তিকটার কথা শুনে হা-হা-হা করে খেকিয়ে হেসে উঠল এক নাস্তিক। বলল, বোকা ধার্মিক। কুরআনে কী আছে সেটাও ভালোমতো জানে না। যাও, আগে নিজের ধর্মগ্রন্থ পড়ে গিয়ে।

এভাবেই পাল্টা তর্কবিতর্ক চলছে। এরকম সিচুয়েশানগুলোতে সাজিদ থাকলে আমার বেশ মজা লাগে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে কীভাবে দাবার খুঁটি উল্টে দিতে হয় সেটি সাজিদ খুব ভালো করেই জানে। এরকম অবস্থায় সে প্রথমে একবার গলা খাঁকারি দেবে। সামনে যদি কোনো পানির গ্লাস থাকে, সে ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি পেটে ভরে বলবে, শুনি তো আপনাদের প্রশ্ন।

হঠাৎ আমার কাঁধে কারও হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি আমার পেছনে সাজিদ দাঁড়িয়ে আছে। লেব্বাবাহ! তার কথা ভাবতে-না-ভাবতেই হাজির! এত দ্রুত আলাদিনের জাদুর চেরাগে থাকা জিনটাও হাজির হতে পারে কি না সন্দেহ আছে। সাজিদ কিছু বলার আগেই প্রশ্ন করলাম, তুই এখানে?

রুমেই ফিরছিলাম। হট্টগোলের শব্দ শুনে এদিকটায় এসে দেখি তুই দাঁড়িয়ে আছিস। কী সমস্যা হয়েছে এখানে?

মনে মনে আমি যে তাকেই খুঁজছিলাম সেটি আর খোলাসা করিনি। হট্টগোলের ব্যাপারটি পুরোটাই খুলে বললাম। সবটুকু শুনে সে বলল, ও আচ্ছা। তার ও আচ্ছা বলার ধরন দেখে মনে হলো যেন সে এরকম ঘটনা চারপাশে অহরহ দেখছে। এরকম ঘটনা দেখতে দেখতেই যেন সে ঘুম থেকে জাগছে আবার ঘুমিয়ে পড়ছে। তার এরকম গা-ছাড়া ভাব দেখলে রীতিমতো আমার পিত্তি জ্বলে যায়।

ধীর পায়ে হেঁটে সাজিদ জটলার মধ্যে মিশে গেল। তাকে অনুসরণ করে আমিও এগিয়ে গেলাম। এখনো বিতর্ক শেষ হয়নি। আস্তিক লোকটিকে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠতে দেখা গেল। সাজিদ তার কাছে গিয়ে বলল, ভাই, একটু থামুন। এভাবে উত্তেজিত হলে তো চলবে না। সমস্যার সমাধান করতে হলে সবার আগে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।

আমি তো মনে মনে ইয়া নাফসি জপ শুরু করেছি। না জানি সাজিদের দার্শনিকসুলভ আলাপ শুনে লোকটি সাজিদকে আবার নাস্তিক ভাবা শুরু করে।

কিন্তু না। সে-রকম হয়নি। সাজিদের কথা শুনে আস্তিক লোকটার গলার আওয়াজ ছোট হয়ে এলো। সাজিদ আরেকবার পুরো ঘটনাটি শুনে নিল বিতর্ককারীদের কাছ থেকে। প্রথম দিকে ঝগড়ার টপিক ছিল মদ পান করে এই বিল্ডিংয়ে হট্টগোল করা যাবে কি যাবে না; কিন্তু এখন ঝগড়ার মূল টপিক এসে দাঁড়িয়েছে জান্নাতে পুরস্কার হিশেবে কুরআন মদের কথা বলছে কি না…।

সাজিদ নাস্তিক লোকটার দিকে ফিরল। এত ঝগড়ার মধ্যেও টাকওয়ালা লোকটিকে এখনো বেশ সতেজ এবং স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। সম্ভবত আস্তিক লোকটিকে রাগিয়ে দিতে পেরে এই লোক বেশ মজা পেয়েছে।

সাজিদ বলল, আপনার বক্তব্য কী?

লোকটি চোখ ঘুরিয়ে সাজিদের দিকে তাকাল। তার চাহনিতে একধরনের তাচ্ছিল্যের ভাব স্পষ্ট। ভাবখানা এমন যেন সাজিদও কোনো মাথাগরম টাইপ আস্তিক—যার ধর্ম, বিজ্ঞান, দর্শন সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই নেই। বেশ গা-ছাড়া ভাব নিয়ে লোকটি বলল, আমাকে বলছেন?

জি, সাজিদ বলল।

বলুন।

আপনি সম্ভবত কোনো একটি টপিক নিয়ে কথা উঠিয়েছেন, যার ফলে এখানে একটি ঝগড়ার সূত্রপাত হয়েছে। আমি সেই টপিকটি শুনতে চাইছি।

মুহূর্তের মধ্যে লোকটির ভদ্র চেহারা পাল্টে তাতে বেশ রুক্ষতা এসে ভর করল। লোকটি কপাল কুঁচকে বলল, আপনি শোনার কে?

সাজিদ কিছুই বলল না। লোকটি আবার বলল, কোথেকে যে এসব গণ্ডমূর্খ আস্তিকগুলো আসে রে বাবা!

লোকটার এরকম কথা শুনে আমার মাথায় রক্ত চড়ে বসল। ইচ্ছে করছিল একটি লাঠি দিয়ে লোকটার মাথায় জোরে একটি আঘাত করি। হাতের কাছে সে রকম কিছু না পেয়ে দাঁতে দাঁত কচলে রাগ গিলে ফেললাম।

সাজিদ বলল, এক্সকিউজ মি। আমি আসলে বেশ কৌতূহল থেকেই আপনার কাছে জানতে চেয়েছি ব্যাপারটি। এই টপিকটি নিয়ে আমার নিজেরও বেশ আগ্রহ আছে। আমি ধর্মতত্ত্বের একজন ছাত্র।

সাজিদের কথা শুনে লোকটার কপাল কুঁচকানোর মাত্রা আরও বেড়ে গেল। বলল, আপনি ধর্মতত্ত্বের ছাত্র হলেই কি কুরআনের কথা পাল্টে যাবে?

তা অবশ্য যাবে না। তবে ভুল ব্যাখ্যা পাল্টে যেতে পারে।

হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ভুল ব্যাখ্যা?, লোকটি তেড়ে আসার ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুড়ে দিল।

এই যে, আপনি বলছেন কুরআন নাকি জান্নাতে পুরস্কার হিশেবে মদ খাওয়ানোর কথা বলছে।

লোকটি উত্তেজিত কণ্ঠে জানতে চাইল, কুরআনে কি এই কথা নেই?

হ্যাঁ আছে।

হা-হা-হা। তাহলে? আমি ভুল কিছু কী বললাম?

সাজিদ বলল, কথা সত্য তবে মতলব খারাপ।

সাজিদের এই কথা সম্ভবত তার গায়ে অপমানের মতো লাগল। বলল, মতলব খারাপ মানে?

সাজিদ মুচকি হাসি দিয়ে বলল, এই তো, আলোচনায় চলে এসেছেন। আপনার মতলব কীভাবে খারাপ সেটি জানার জন্যই তো আলাপ দরকার। এতক্ষণ তো আপনি আলাপেই আসতে চাচ্ছিলেন না।

লোকটার চোখের পলক পড়ছে না। তার সব দৃষ্টিশক্তি সাজিদের দিকে এসে নিবদ্ধ হয়ে আছে। মানুষ ভালোবেসে অপলক নয়নে তাকায় বলে জানতাম। রেগে থাকলেও কি মানুষ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে?

সাজিদ এতক্ষণে গলা খাঁকারি দিল। বলল, আচ্ছা, আলোচনায় আসি। আপনি কি আমাকে বলতে পারবেন যে, কুরআনের ঠিক কোন আয়াতে জান্নাতের পুরস্কার হিশেবে মদের কথা বলা আছে?

লোকটি দাঁতমুখ খিচিয়ে উত্তর দিল, আমি তো সেটি মুখস্থ করে বসে নেই, তাই না?

তা অবশ্য ঠিক। কোনো সমস্যা নেই। আমি কি বলব কোন আয়াতে এই ব্যাপারে বলা আছে?

লোকটি কিছুই বলল না। নীরবতাকে সম্মতির লক্ষণ হিশেবে ধরে নিয়ে সাজিদ আবার বলতে শুরু করল, কুরআনের সূরা মুহাম্মাদের পনেরো নম্বর আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা জান্নাতে পুরস্কার হিশেবে বান্দাদের মদ খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

সাজিদের কথা শুনে এতক্ষণ চুপ মেরে থাকা আস্তিক লোকটি বলে উঠল, অ্যা! আপনার কি ভাই মাথা খারাপ নাকি? আপনিও কি এই ব্যাটার দলের?

সাজিদ সেদিকে কর্ণপাত করল না। কোনো একটি জবাবের আশায় সে নাস্তিকটার দিকে তাকিয়ে আছে। নাস্তিকটি বলল, তো? আমি তো এতক্ষণ সেটাই বলতে চাচ্ছিলাম। মাথামোটা আস্তিকগুলো তো আমার কথা বিশ্বাসই করতে চাইছিল না। হা-হা-হা।

কিন্তু…।

কিন্তু আবার কী?, জানতে চাইল নাস্তিকটা।

এখানে একটি ব্যাপার আপনাকে বুঝতে হবে। এই দুনিয়া হচ্ছে ম্যাটেরিয়াল ওয়ার্ল্ড, আর জান্নাত-জাহান্নাম, আখিরাত এগুলো হচ্ছে ইমম্যাটেরিয়াল ওয়ার্ল্ডের বিষয়। দুনিয়ার কোনো বিষয়ের সাথে আখিরাতের কোনো বিষয়ের তুলনা চলে না। যেমন : দুনিয়ার গাছ দেখতে যে-রকম, আখিরাতের গাছও যে দেখতে ঠিক সে-রকম হবে, এমনটি নয়। আবার দুনিয়ার দুধের রং সাদা। জান্নাতের দুধের রংও সাদা হবে, এমনটি নাও হতে পারে। দুনিয়ার নদীর সাথে আখিরাতের নদীর, দুনিয়ার সাগরের সাথে আখিরাতের সাগরের, দুনিয়ার পাহাড়ের সাথে আখিরাতের পাহাড়ের কোনো তুলনাই হতে পারে না। আমরা আসলে জানি না সেগুলো কেমন হবে, কীরকম হবে…।

নাস্তিকটি খলখল করে হেসে উঠল। এতক্ষণে খেয়াল করলাম হাসলে এই লোকটার সব কটি দাঁত দেখা যায়। বলল, দুনিয়ার জিনিসের সাথে আখিরাতের জিনিসের তুলনা না হলে কুরআনে গাছ, লতা-পাতা, নদী-সাগর-পাহাড় এগুলোর উদাহরণ টানা হলো কেন?

সাজিদ মুচকি হেসে বলল, সুন্দর প্রশ্ন। আখিরাতের কোনো জিনিসের সাথে দুনিয়ার জিনিসের তুলনা না হলে কুরআন কেন এই জিনিসগুলোর উদাহরণ। টেনেছে, তাই না?

হুম।

আপনাকে এবার একটি গল্প শোনাই। গল্পটি হচ্ছে তিন অন্ধের হাতি দর্শনের গল্প। একবার তিন অন্ধ মিলে একটি হাতি দেখতে আসলো। যেহেতু তারা চোখে দেখে, তাই স্পর্শ করেই তাদের অনুমান করতে হবে হাতি আসলে কীরকম। প্রথম অন্ধ হাতির গায়ে হাত বুলিয়ে অন্যদের বলতে লাগল, শোনো, হাতি হচ্ছে গাছের মোটা খুঁড়ির মতো। দ্বিতীয় অন্ধ হাতির পা স্পর্শ করে বলল, না না। হাতি হচ্ছে খাম্বার মতো। তৃতীয় অন্ধ হাতির কান স্পর্শ করে বলল, ধুর বোকা, তোমরা দুজনেই ভুল। আসলে হাতি হচ্ছে কুলার মতো। দেখুন, হাতি দেখতে-না গাছের খুঁড়ির মতো, না দালানের খাম্বা কিংবা কুলার মতো। হাতি এসবের কিছুর মতোই। নয়। হাতি আসলে হাতির মতো; কিন্তু প্রথম অন্ধের গাছের গুঁড়ি সম্পর্কে সম্যক ধারণা আছে বলেই সে হাতির গায়ে হাত বুলিয়ে তৎক্ষণাৎ বলতে পেরেছে হাতি হলো গাছের গুঁড়ির মতো। দ্বিতীয় অন্ধের দালানের খাম্বা সম্পর্কে ধারণা আছে বলেই সে হাতির পা ধরে বলতে পেরেছে হাতি হলো খাম্বার মতো। তৃতীয় অন্ধের কুলা সম্পর্কে ধারণা আছে বলেই সে হাতির কান স্পর্শ করে বলতে পেরেছে। হাতি হলো কুলার মতো। তাদের ধারণা অনুযায়ীই তারা কল্পনা করে নিয়েছে হাতি আসলে কেমন। এখন কুরআন জান্নাত-জাহান্নামের উপমা দেওয়ার সময় এমন-সব উপমা, উদাহরণ আর শব্দচয়ন করেছে, যার সাথে মানুষ পরিচিত। যাতে করে মানুষ সহজভাবে বুঝে নিতে পারে—আসলে ব্যাপারটি কেমন বা কীরকম হতে পারে। যদি এমন-সব উপমা বা উদাহরণ কুরআন ব্যবহার করত, যা মানুষ কোনোদিন দেখেনি, শোনেনি, তাহলে মানুষ সহজেই উপদেশ গ্রহণ করতে পারত না। এ জন্যেই কুরআন গাছ, নদী, সাগর, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি জিনিসের উপমা দিলেও এই ব্যাপারটি মাথায় রাখতে হবে যে, এগুলো দুনিয়ায় থাকা গাছ, নদী, সাগর, পাহাড়-পর্বতের মতো নয়। একইভাবে, কুরআন যখন জান্নাতে মদের কথা বলে তখন আমাদের বুঝতে হবে যে—এই মদ দুনিয়ার মদের মতো নয়। সাজিদ থামল।

লোকটি বলল, কিন্তু মদ তো মদই, তাই না?

সাজিদ বলল, না, সবসময় তা নয়।

লোকটি কপাল কুঁচকে বলল, মানে কী?

আগে আপনি বলুন মদ কীরকম?

পাশে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ ধরে সাজিদের আলাপ শুনছিল মাতালদের একজন। অবশ্য তার মাতলামির ভাবটি এখন কমে এসেছে। সে বলে উঠল, মদ হচ্ছে খুবই দুর্গন্ধময়।

আর কিছু?, সাজিদ জানতে চাইল।

মাতাল লোকটি চুপ মেরে গেল। সম্ভবত মদ সম্পর্কে সে এরচেয়ে বেশি আর কিছু জানে না। সাজিদ বলতে লাগল, আমি বলছি। এটি বিজ্ঞানসম্মত যে, মদ শরীরের জন্য ক্ষতিকর। অ্যালকোহলিক এই জিনিসটি মানুষের সেন্স পাল্টে দেয়। মদপানকারীরা মুহূর্তের মধ্যে মাতাল হয়ে পড়ে। আশপাশের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা এমন-সব কাণ্ড ঘটিয়ে বসে, যা সাধারণ অবস্থায় তারা কল্পনাও করতে পারে না। অতিরিক্ত মদপানকারীর মৃত্যুও ঘটতে পারে।

হুম। সেটি তো বুঝলাম, বলল নাস্তিক লোকটা। এতে কি প্রমাণ হয় সব মদ, মদ না?

হয়।

কীভাবে?

কুরআনে উল্লেখিত মদ আর আপনার দুনিয়ার মদ কিন্তু একই ব্যাপার নয়। আপনার দুনিয়ার মদপানে মানুষের সেন্স, বিবেক-বুদ্ধি লোপ পায়। শরীরের ক্ষতি করে। মোটাদাগে, এটার ক্ষতির দিক এত বেশিই যে, সেগুলো বর্ণনাতীত; কিন্তু অপরদিকে কুরআনে যে-মদের কথা বলা হয়েছে তা নির্মল, বিশুদ্ধ, সুগন্ধময়। তাতে কোনো অ্যালকোহল নেই। ক্ষতিকর কোনো উপাদান নেই, যা পানকারীর বিবেক-বুদ্ধির লোপ পাইয়ে দেবে। তা বিস্বাদ নয়, সুস্বাদু।

সাজিদের কথা শুনে মাতাল লোকটি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এরকম অদ্ভুত মদের কথা শুনে সে মনে হয় আকাশ থেকে পড়ল। নাস্তিক লোকটি কিছু একটা বলতে গিয়েও ঢোক গিলে নিল। তাকে উদ্দেশ্য করে সাজিদ

আবার বলে উঠল, আপনি সম্ভবত বলতে চাচ্ছিলেন—আমার এই কথার পক্ষে যুক্তি কী, তাই না? ফাইন। আমার কথার পক্ষে যুক্তি হচ্ছে স্বয়ং আল্লাহর কথাই। আল্লাহ নিজেই কুরআনে বলেছেন, জান্নাতে যে-মদ তথা পানীয় পরিবেশন করা হবে তা হবে কোমল, সুপেয়, সুগন্ধী। দুনিয়ার মদের মতো তা কোনো পানকারীর বিবেক লোপ করবে না।

আমি জানতে চাইলাম, কুরআনে এ ব্যাপারে ক্লিয়ার-কাট কথা আছে?

সাজিদ বলল, হ্যাঁ।

কোন সূরায়?

সাজিদ তখন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, সম্ভবত সূরা ওয়াকিয়ার মধ্যে আছে।

কী বলা আছে?

জান্নাতে যে-পানীয় পরিবেশন করা হবে তা কীরকম হবে সে-ব্যাপারে খুব পরিষ্কার ব্যাখ্যা।

সাথে সাথে আমি স্মার্টফোন বের করে আল কুরআন অ্যাপস থেকে সূরা ওয়াকিয়া বের করলাম। সাজিদ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি অ্যাপসের সার্চবারে পানীয় লিখে সার্চ দিতেই চলে এলো একটি আয়াত। কুরআন জান্নাতীদের জীবন কেমন হবে সে-সম্পর্কে বলছে এভাবে, সেখানে তাদের সেবায় নিয়োজিত থাকবে চির কিশোরেরা। তাদের (কিশোরদের হাতে থাকবে পানির পাত্র, কেটলি আর ঝরনা থেকে প্রবাহিত স্বচ্ছ পানীয়। এগুলো পান করলে মাথা ঘোরাবে না, জ্ঞানও লোপ পাবে না।[১]

আমি থামতেই সাজিদ বলে উঠল, বেশ স্পষ্ট। কুরআন বিভিন্ন জায়গায় জান্নাতীদের পোশাক, খাবার, পানীয় ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেছে। যেমন, সূরা মুহাম্মাদে আছে একধরনের মদ, দুধ আর ঝরনার পানির কথা। আবার সূরা ওয়াকিয়ার মধ্যেও আছে বিভিন্ন পানীয়ের কথা। সূরা ওয়াকিয়াতে খুব স্পষ্টভাবে আল্লাহ বলে দিয়েছেন যে, জান্নাতের পানীয় কেমন হবে। খেলেই মাথা ঘুরাবে? সেন্স হারাতে হবে? বিবেক-বুদ্ধি লোপ পাবে? মাতলামি শুরু হবে? না। কুরআন বলছে, এগুলো পান করলে মাথা ঘুরাবে না, জ্ঞানও লোপ পাবে না। দুনিয়ার দুধ খেলে কি কারও মাথা ঘুরায়? জ্ঞান লোপ পায়? পায় না। তাহলে দুনিয়ার যে-পানীয় খেলে মাথা ঘুরায়, জ্ঞান লোপ পায় সেটি হলো মদ; কিন্তু জান্নাতের মদ যে এরকম নয়, ভিন্ন কিছু সেটি একদম পরিষ্কার করেই আল্লাহ বলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এগুলো পান করলে মাথা ঘুরাবে না, জ্ঞান লোপ পাবে না। এরচেয়ে ক্লিয়ার কথা আর কী হতে পারে?

নাস্তিক লোকটি কিছুই বলল না। সাজিদ বলল, আপনি নিশ্চয়ই এখন বুঝে গেছেন যে, জান্নাতে পরিবেশিত মদ বলতে আসলে কীরকম মদ বলা হয়েছে।

এতক্ষণ চুপ মেরে থাকা আস্তিক লোকটি এবার কথা বলে উঠল। বলল, ঠিক কইছিলেন ভাইজান। এদের আসলে মতলব খারাপ।

জটলাটায় শুরুতে যে-রকম চিৎকার-চ্যাঁচামেচি ছিল, এখন তা আর নেই। সবাই এতক্ষণ সাজিদের কথা শুনছিল মনোযোগ দিয়ে। সাজিদ চলে আসার জন্যে পা বাড়াতেই নাস্তিক লোকটি বলে উঠল, সব বুঝলাম; কিন্তু তাই বলে পানীয়ের কথা বোঝাতে মদের উপমা কেন দিতে হবে, হুম?

সাজিদ ঘাড় ফিরে তাকাল। নাস্তিক লোকটি তার দিকে আগের মতোই অপলক তাকিয়ে আছে। অপলক তাকিয়ে থাকা লোকটার সম্ভবত মুদ্রাদোষ। সাজিদ বলল, একজন বিখ্যাত কবি তার কবিতায় লিখেছেন, তোমার মাতাল করা চোখের দিকে তাকিয়ে আমি পার করে দিতে পারি মহাকালের পথ। আচ্ছা, মাতাল করা চোখ বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?

লোকটি বলল, অসম্ভব সুন্দর চোখ।

মাতাল শব্দটি কোথা থেকে এসেছে জানেন? মদ থেকে। মদ থেকে আরও অনেক শব্দ এসেছে। যেমন, মাদকতাময়। কবিতায়, সাহিত্যে এসব অহরহ ব্যবহার করা হয়। মাতাল করা চোখ মানে অসম্ভব সুন্দর চোখ। মাদকতাময় সুবাস মানে হলো পাগল করে দেওয়া গন্ধ। যা নাকে লাগলেই নেশা ধরে যায়। এসব শব্দ এসেছে মদ শব্দ থেকে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, কোনো বস্তুর নাম হিশেবে, গুণ হিশেবে মদ মাতাল কিংবা মাদকতাময় শব্দগুলো কোনো খারাপ শব্দ। অ্যালকোহলিক কোনো পানীয়কে যখন মদ বলা হবে তখন সেটি নেগেটিভ সেন্সে ঠিক আছে; কিন্তু কেউ যখন পজিটিভ সেন্সে বলবে, এই ফুলের সুবাসে এক অদ্ভুত মাদকতা আছে, তখন কিন্তু এটি বোঝায় না যে, ওই ফুলের গন্ধে মদের গন্ধ বা মদের উপাদান আছে। আপনাকে বুঝতে হবে কুরআন মদ হিশেবে কীরকম পানীয়ের কথা বলেছে। কুরআন বলছে, সেগুলো হবে) নির্মল পানীয়। সুপেয় এবং সুস্বাদু।

সাজিদ হাঁটা শুরু করেছে। সে খুব ধীরপায়ে হাঁটে। তাকে বললাম, ব্যাটাকে বেশ ভালো জব্দ করেছিস।

সাজিদ আমার দিকে উদাস নয়নে তাকাল। আমার এই কমপ্লিমেন্ট সে গায়ে মাখল না। অবশ্য সে প্রশংসার কোনো কিছুই গায়ে মাখে না।

————-
১ সূরা ওয়াকিয়া, ৫৬:১৭-১৯

1 Comment
Collapse Comments

এ জন্যেই কুরআন গাছ, নদী, সাগর, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি জিনিসের উপমা দিলেও এই ব্যাপারটি মাথায় রাখতে হবে যে, এগুলো দুনিয়ায় থাকা গাছ, নদী, সাগর, পাহাড়-পর্বতের মতো নয়।
–এটা আরিফ আজাদের বানানো হাদিস নাকি?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *