০৮. জলিল মিয়ার চায়ের দোকানে

সকাল ন’টার মত বাজে।

বাকের জলিল মিয়ার চায়ের দোকানের সামনে বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। কড়া রোদ বাইরে। বাকেরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। জলিল মিয়া ডাকল–বাকের ভাই, আসেন চা খান। বাকের জবাব দিল না। সব কথার জবাব দেয়া ঠিক না। এতে মানুষের কাছে পাতলা হয়ে যেতে হয়। সে এগিয়ে গিয়ে পান-বিড়ির দোকানটার সামনে দাঁড়াল। বেশ কয়েকজন কাস্টমার দাঁড়িয়ে আছে সেখানে, দোকানদার সবাইকে বাদ দিয়ে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল, কি দিব বাকের ভাই?

সিগ্রেট দে।

ফাইভ ফাইভ?

বাকের এমন ভাবে তাকাল যেন সে দারুণ বিরক্ত হয়েছে। তাকে ক্ষমা করে দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, অন্য কোনো সিগ্রেট খাই? দোকানদার জিবে কামড় দিয়ে একটা সিগ্রেট বের করল। বাকের গম্ভীর গলায় বলল, এক প্যাকেট দে। সে একটা চকচকে একশ টাকার নোট ছুড়ে ফেলল।

আজ তার মন নানান কারণে খারাপ হয়ে আছে। গত রাতে খবর পাওয়া গেছে। ইয়াদ চাকরি পেয়েছে। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা ইয়াদের সঙ্গে ওঠাবসা অথচ এই খবরটা ইয়াদ তাকে দেয়নি। অন্যের কাছে জানতে হল। খবরটা যাচাই করবার জনে সে সাত সকালে গিয়েছিল। ইয়াদের বাড়ি। ইয়াদ হাই তুলে বলল, আর কতদিন এমনি এমনি ঘুরব? আর চাকরিটাও খারাপ না। ঘোরাঘুরি আছে। টি এ ডি এ পাওয়া যায়।

কবে থেকে চাকরি?

সামনের মাসের এক তারিখ থেকে। দেরি আছে। চল যাই চা খেয়ে আসি। নাশতা করেছিস?

চা খেতে খেতেই বাকের একবার বলল, আমবা চারজন মিলে যে স্পেয়ার পার্টস-এর দোকান দেব বলেছিলাম তার কি?

আরে দূর এইসব কি আর হয় নাকি? দুইজন তো ভোগেই গেল, বিয়ে-শাদী করে একেবারে গেরস্ত।

তুই আর আমি দুইজনে মিলে করতে পারতাম।

পয়সা কই?

ইয়াদ খানিকক্ষণ পরই গলা নিচু করে বলতে লাগল, বড় ভাই এদিকে আবার ফ্যাচাং বঁধিয়ে ফেলেছে। আই.এ. পাস এক মেয়ের সাথে সম্বন্ধ করে ফেলেছে। মেয়ে কালো কিন্তু সুইট দেখতে। একটু অবশ্যি রোগা।

বাকের একটি কথাও বলল না। গম্ভীর হয়ে রইল। ইয়াদ নিজের মনেই কথা বলে যেতে লাগল–আমি নিজে তো মেট্রিকটা পাস করতে পারলাম না। এদিকে বউ হল গিয়ে এই–এ। শালা কেলেঙ্কারি অবস্থা। এখন বউ যদি বি.এ. পড়তে চায় তাহলে গেছি। বড় ঝঞ্ঝাটের মধ্যে পড়ে গেলাম। ইয়াদের মুখ দেখে মনে হল না ঝঞাটের জন্যে সে বিরক্ত। বরং মনে হল সে সমস্ত ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছে।

বাকের চা শেষ না করেই উঠে এল। এটা ঠিক যে পাড়ার সবাই তাকে খাতির করে। কিন্তু দল ভেঙে যাচ্ছে। এ সব লাইনে দল ভেঙে গেলে খাতির থাকে না। দেখতে দেখতে চ্যাংড়ারা উঠে আসবে। গত সপ্তাহেই তার চোখের সামনে মজনু সিগারেট টানতে টানতে রিকশায় উঠল। একটা চড় দিলে দুটো চড়ের জায়গা নেই যার তার এত বড় সাহস।

বাকের জলিল মিয়ার চায়ের স্টলে ঢুকল। জলিল মিয়া নিজেই গলা উঁচিয়ে ডাকল গফফর, গরম পানি দিয়া ভাল কইরা বাকের ভাইরে চা দে। কাপ ধুইয়া দিস। বাকের বসে রইল। উদাস ভঙ্গিতে। এখানে চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া এখন আর কোনো কাজ নেই। স্কুলের সময় হয়ে গেছে, পাড়ার মেয়েরা স্কুলে রওনা হয়েছে দল বেঁধে। দেখতে এত ভাল লাগে। বাকের লক্ষ্য করতে লাগল কোনো ছোকরা শিসটিস দেয়। কিনা। টেনে জিব ছিঁড়ে ফেলবে সে। তার পাড়ায় মেয়েছেলের অসম্মান হতে দেবে না।

মুনা ঘর থেকে বেরুল দশটার দিকে। অফিস পৌঁছতে পৌঁছতে নিশ্চয়ই এগারোটা বেজে যাবে। রোজ দেরি হয়। কালও সে ঘর থেকে বের হয়েছে এগারোটায়। বাকের চায়ের সন্টল ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়াল।

এই যে মুনা অফিসে যাচ্ছ নাকি?

হ্যাঁ। সকালবেলা আর কোথায় যাব?

মামাকে বলবে কাজের মেয়ে একটা জোগাড় করেছি।

ঠিক আছে বলব।

বাকের সঙ্গে সঙ্গে আসতে শুরু করল। মুনা কিছু বলল না। বাকের হালকা স্বরে বলল, তোমাদের অফিসে যাব এক’দিন। মেয়েছেলেরা কাজ করছে দেখলে ভাল লাগে।

আপনারী কিছু করবেন না, গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াবেন। মেয়েরাও যদি তাই করে তাহলে হবে কিভাবে?

তোমাদের জন্যেই তো কিছু করতে পারি না। মেয়েরা সব কাজকর্ম নিয়ে নেয়। বাংলাদেশ একেবারে নারীমহল হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন অন্দরে ঢুকে রান্নাবান্না করব। হা হা হা।

বাকের রাস্তা কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। নিজের কথা তার নিজেরই খুব মনে ধরেছে। সে বড় রাস্তার মোড় পর্যন্ত গেল। এ সময় রিকশা পাওয়া মুশকিল, কিন্তু সে ছুটোছুটি করে রিকশা নিয়ে এল। রিকশাওয়ালাকে গম্ভীর গলায় বলল, আপামণিকে তুরন্ত নিয়ে যাবি। মুনার ধন্যবাদ জানিয়ে কিছু-একটা বলা উচিত। কিন্তু সে কিছু বলল না। বাকের বলল মুনা, ভাড়া দিতে হবে না।

কেন? দিতে হবে না কেন?

দিয়ে দিয়েছি।

বাকের উদাস ভঙ্গিতে সিগারেট ধরাল। তার এখন কিছু করার নেই। মোটর পার্টস-এর দোকানে আগে এই সময়টায় আড্ডা দিতে বসন্ত সে আড্ডাটা এখন আর নেই। লোকজন আসে। না। একা একা কতক্ষণ বসে থাকা যায়? সে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হাঁটতে লাগল। কোনো কিছুই তাকে আকর্ষণ করছে না। রাস্তার পাশে রিকশাওয়ালার সঙ্গে ভাড়া নিয়ে প্যাসেঞ্জারের ঝগড়া বেঁধে গেছে। অন্য সময় হলে প্যাসেঞ্জারের পক্ষ নিয়ে রিকশাওয়ালার গালে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিত। আজ সে ইচ্ছাও হল না। মুনার সঙ্গে রাস্তাঘাটে দেখার হবার পর তার এ রকম হয়। বেশি কিছু সময় কিছুই ভাল লাগে না।

বাকের গ্রিন ফার্মেসিতে উঁকি দিল। ডাক্তার ছেলেটি এখনো আসেনি। সে এলে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ বসা যেত। বাকের গম্ভীর গলায় বলল ডাক্তার কখন আসবে?

দুপুরের পরে।

দেখি টেলিফোনটা দেখি।

ফার্মেসির নীল শার্ট পরা লোক বিরক্ত স্বরে বলল–ফোন তালা দেয়া। চাবি নেই। এই লোকটি নতুন এসেছে, তাকে বোধ হয় ঠিক চেনে না। বাকের ঠাণ্ডা গলায় বলল, চাবি না থাকলে তালা ভাঙার ব্যবস্থা কর। লোকটি তাকিয়ে আছে সরু চোখে। বাকের থমথমে গলায় বলল, ফাজলামি কথাবার্তা আমার সাথে বলবে না। চড় দিয়ে চাপার দাঁত ফেলে দেব। টেলিফোন তালা দেওয়া! তোমার বাবার টেলিফোন?

লোকটি টেলিফোন বের করল। সত্যি বোধ হয় চাবি নেই। সেফটিপিন দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তালা খুলল।

কাকে ফোন করা যায়? মুনাকে করলে কেমন হয়? মাঝে মাঝে সে মুনার সঙ্গে কথা বলে। মুনা ভীষণ বিরক্ত হয়। তবু করে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে টেলিফোনটি বড় সাহেবের ঘরে। মুনাকে ডেকে আনতে হয়। আজও তাই হল। বড় সাহেব তাকে লাইনে থাকতে মুনাকে আনতে খবর পাঠালেন।

হ্যালো, আমি বাকের।

কি ব্যাপার?

রিকশা ভাড়া দাওনি তো? আমি অলরেডি দিয়ে দিয়েছিলাম।

সে তো আপনি আমাকে বলেছিলেন। আবার টেলিফোন কেন? তোমার কাছ থেকে আবার সেকেন্ড টাইম ভাড়া নিল কি না সেটা জানার জন্যে। রিকশাওয়ালারা या হাब्राभि श्श। হা হা হা।

আর কিছু বলবেন?

না। তোমাদের বিয়ের ডেট হয়েছে নাকি?

না। এখনো হয়নি।

হ্যালো মুনা, আমার কানেকশন আছে, আমি হাফ প্রাইসে একটা কমু্যনিটি সেন্টার ভাড়া করে দেব। জাস্ট দশ দিন আগে আমাকে বলতে হবে।

ঠিক আছে বলব। এখন টেলিফোন রাখি?

হ্যালো শোন–তোমাদের ঐ ফ্যানটার কিছু করা গেল না। অসুবিধা নেই, যেটা আছে সেটা ইউজ কর। নো প্রবলেম।

ঠিক আছে, এখন রাখছি। আমার কাজ আছে।

মুনা টেলিফোন নামিয়ে রাখল। বাকের অলস ভঙ্গিতে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, একটা খুব ঠাণ্ডা দেখে পেপসি নিয়ে আস তো। বলবে, বাকের ভাই চায়।

নীল শার্ট পরা লোকটি পেপসি আনতে গেল! বাকের রাস্তার দিকে তাকিয়ে বসে রইল।

শওকত সাহেব অফিসে এলেন লাঞ্চের পর। সবাই তখনো লাঞ্চ সেরে ফেরেনি–অফিস ফাঁকা ফাঁকা। শওকত সাহেবের মনে হল সবাই তাকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করছে। ডিসপ্যান সেকশনের মল্লিক বাবু তাকে দেখেই যেন হঠাৎ করে ফাইলপত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। শওকত সাহেব বললেন, ভাল আছেন মল্লিক। বাবু? মল্লিক। বাবু অতিরিক্ত ব্যস্ততার সঙ্গে বললেন, জি ভাল। আপনি ভাল তো?

বড় সাহেব আছেন?

আছেন, অফিসেই আছেন। যান না, দেখা করুন গিয়ে।

শওকত সাহেব বড় সাহেবের কাছে গেলেন না। যাবার সাহস সঞ্চয় করতে তার কিছু সময় লাগবে। ছোকড়া মত একটি ছেলেকে দেখা যাচ্ছে ক্যাশ সেকশনে। নতুন অ্যাপয়েন্টেমেন্ট হয়েছে নাকি? মল্লিক। বাবু বললেন, চা খাবেন?

জি না।

ক্যাশ সেকশনের নতুন ছেলেটি আড়চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে। তার খবর শুনেছে বোধ হয়।

জসিম সাহেব ঢুকলেন। খুব ফুর্তিবাজ লোক। রসিকতা না করে এক সেকেন্ডও থাকতে পারেন। না। শওকত সাহেবকে দেখে তিনিও কেমন জানি হকচাকিয়ে গেলেন। শুকনো হাসি হেসে বললেন, কি ভাল?

জি ভালই।

দেখা হয়েছে বড় সাহেবের সঙ্গে?

জি না। দেখা করতে বলেছেন?

না কিছু বলেননি। তবে আমার মনে হয় দেখা করা উচিত। ইনকোয়ারি কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে।

শওকত সাহেব কাঁপা গলায় বললেন, কি রিপোর্ট?

জসিম সাহেব উত্তর না দিয়ে ড্রয়ার খুলে কি নিয়ে যেন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

বড় সাহেবের কাছে কি এখনই যাব?

যান। এখুনি যান। দি আরলিয়ার দি বেটার।

শওকত সাহেব ভীত স্বরে বললেন, কিছু শুনেছেন রিপোর্ট সম্বন্ধে?

জি না ভাই। কিছু শুনিনি।

তিনি কথাটা মাটির দিকে তাকিয়ে বললেন। তার মানে এটা মিথ্যা। সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে কেউ মিথ্যা বলতে পারে না। মিথ্যা বলতে হয় অন্যদিকে তাকিয়ে।

বড় সাহেব মানুষটি ছোটখাটো। হাশিখুশি ধরনের। সহজে রাগ করেন না। কড়া ধরনের কথা বলতে পারেন না। কিন্তু তিনিও গভীর। শওকত সাহেবকে দেখে মুখ অন্ধকার করে বললেন, ইনকোয়ারি কমিটির রিপোর্ট ভাল না। শুনেছেন বোধ হয়?

শওকত সাহেব মূর্তির মত বসে রইলেন।

ইনকোয়ারি কমিটির সুপারিশ হচ্ছে, যে টাকার গরমিল দেখা যাচ্ছে সেটা আপনি দশ দিনের ভেতর যদি ফেরত দেন তাহলে আপনার বিরুদ্ধে কোনো পুলিশ অ্যাকশন নেয়া হবে না। আর তা না হলে কেইস পুলিশ হ্যান্ডওভার করা হবে, বুঝতেই পারছেন একটা কেলেংকারি ব্যাপার হবে। আপনি টাকাটা ফেরত দিয়ে দেন।

টাকা আমি কোথায় পাব স্যার?

বড় সাহেব সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন।

আমি স্যার কিছুই জানি না।

এটা তো শওকত সাহেব ঠিক বললেন না। আপনি না জানা মতে এটা হওয়া সম্ভব না। কাজটা করেছেন কাঁচা। আমি নিজেও ইনকোয়ারি কমিটির একজন মেম্বার এটা ভুলে যাচ্ছেন কেন? থানা-পুলিশ হলে একটা বেইজ্জতী ব্যাপার হবে, তার হাত থেকে বাঁচার ব্যবস্থা করুন। শুধু শুধু এখানে বসে থেকে সময় নষ্ট করবেন না। হেড ক্লার্কের কাছে ইনকোয়ারি কমিটির রিপোর্টের কপি আছে। সেটা নিয়ে যান। ভাল করে পড়ুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *