চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
বাঙলার ভূমিরাজস্ব প্রশাসনের ইতিহাসে কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবন্ত এক বিতর্কিত ব্যাপার। কোন পরিস্থিতিতে এর উদ্ভব ঘটেছিল, তা এখানে আলোচনা করার প্রয়োজন আছে। আমরা আগে উল্লেখ করেছি যে ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দে কোম্পানি বাঙলা, বিহার ও ওড়িশার দেওয়ানী লাভের পরবর্তী সাত বছর পূর্বতন ভূমিরাজস্ব প্রশাসনই বলবৎ রাখে। কোম্পানির তরফ থেকে কোম্পানির নায়েব দেওয়ানরূপে মহম্মদ রেজা খা ভূমিরাজস্ব পরিচালনা করতে থাকে। এর ফলে দ্বৈতশাসনের উদ্ভব হয়। দ্বৈতশাসনের ফলে দেশের মধ্যে স্বৈরতন্ত্র ও অরাজকতা প্ৰকাশ পায় ও কৃষি-ব্যবস্থার বিপৰ্যয় ঘটে। এরই পদাঙ্কে ১৭৭০ খ্ৰীস্টাব্দে আসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। মন্বন্তরে বাঙলার অর্ধেক কৃষক মারা যায়. ও আবাদী জমির অর্ধেকাংশ অনাবাদী হয়ে পড়ে। কিন্তু রেজা খা খাজনার দাবী ক্রমশই বাড়াতে থাকে। এর ফলে দেশের মধ্যে অসন্তোষ প্ৰকাশ পায়। এদিকে রাজস্ব সম্পর্কে কোম্পানির প্রত্যাশাও পূরণ হয় না। রাজস্বের টাকা আত্মসাৎ করবার অভিযোগও রেজা খাঁর বিরুদ্ধে আসে। ১৭৭২ খ্ৰীস্টাব্দে ওয়ারেন হেষ্টিংস যখন গভর্নর হয়ে আসেন, তখন তাকে দ্বৈতশাসনের অবসান ঘটাবার নির্দেশ দেওয়া হয়। ওয়ারেন হেষ্টিংস কোম্পানির সারকিট কমিটির তত্ত্বাবধানে জমিদারী মহলগুলিকে নিলামে চড়িয়ে দিয়ে, ইজারাদারদের সঙ্গে পাঁচশালা বন্দোবস্ত করেন। যারা ইজাৱা নেয়, তাদের অধিকাংশই কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের বেনিয়ান। এদের মধ্যে ছিলেন হেষ্টিংস-এর নিজস্ব বেনিয়ান কাস্তবাবু, কিন্তু ইজারাদারদের অধিকাংশই নিজেদের প্রতিশ্রুতি পালন করতে পারে না। কোম্পানির সমস্ত প্ৰত্যাশাই ব্যৰ্থ হয়। এই ব্যর্থতার পর ১৭৭৭ খ্ৰীস্টাব্দে কোম্পানি জমিদারদের সঙ্গে বাৎসরিক বন্দোবস্ত করে।
পাঁচশালা পরিকল্পনার সময় থেকেই অনেকে জমিদারদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কথা তুলেছিল। তাদের মধ্যে ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল আলেকজাণ্ডার ডাউ, স্কটল্যাণ্ডের প্রখ্যাত কৃষিবিন্যাবিদ হেনরী পাটুলো ও কোম্পানির কয়েকজন কর্মচারী যথা মিডলটন, ডেকার্স, ডুকারেল, রাউস প্ৰভৃতি। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সবচেয়ে বড় প্ৰস্তাবক ছিলেন ফিলিপ ফ্রান্সিস। তিনি বললেন, ভারতের বিধিবিধান অনুযায়ী জমিদাররাই জমির মালিক। অর্থনৈতিক মহলের ফিজিওক্রাটদের ভাবধারায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। সেই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে তিনি বললেন, যে কৃষিই সামাজিক ধন্যবৃদ্ধির একমাত্র সুত্র এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা জমিদারদের ভূমির মালিকানা স্বত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করলে, তাদের উদ্যোগে কৃষির পুনরভু্যুদয় ঘটবে এবং তাতে কোম্পানির আর্থিক সমস্যার সমাধান হবে। ফ্রান্সিসের লেখার প্ৰভাবেই ব্রিটিশ পার্লামেণ্ট কর্তৃক ১৭৮৪ খ্ৰীস্টাব্দে বিধিবদ্ধ পিট-এর ‘ভারত আইন’-এ রাজা, জমিদার, তালুকদার ও অনান্য ভূস্বামীদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই নির্দেশ অনুযায়ীই ১৭৮৯-৯০ খ্রীস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিস বাঙলা, বিহার ও ওড়িশার জমিদারদের সঙ্গে দশশালা বন্দোবস্ত করে। (দশশালা বন্দোবস্তের সময় আলোহাবাদের রাজা ও জমিদারদের সঙ্গে বন্দোবন্ত করবার জন্য দেওয়ানীর ভার পেয়ে নোয়াখালির জগমোহন বিশ্বাস অ্যালাহাবাদে যান। তিনি ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে এককালীন দুই লক্ষ টাকা দিয়ে তীর্থযাত্রীদের ওপর থেকে পূর্বপ্রচলিত তীৰ্থকর চিরতরে রহিত করেন)। ১৭৯৩ খ্রীস্টাব্দে এক রেগুলেশন দ্বারা এটাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে রূপান্তরিত হয়। এর সবচের বড় সমর্থক ছিলেন বিহারের কালেকটর টমাস লা। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা জমিদারেরা ও স্বাধীন তালুকদারের জমির মালিক ঘোষিত হয়। এর দ্বারা বিভিন্ন শ্রেণীর জমিদারদের (যথা কুচবিহার ও ত্রিপুরার রাজাদের মত মোঘল যুগের করদ নৃপতি, রাজশাহী, বর্ধমান ও দিনাজপুরের রাজাদের মত পুৱাতন প্ৰতিষ্ঠিত রাজবংশ, মোঘল সম্রাটগণের সময় থেকে বংশানুক্রমিক-ভাবে রাজস্ব-সংগ্ৰাহকের পদভোগী পরিবারসমূহ ও কোম্পানি কর্তৃক দেওয়ানী লাভের পর ভূমিরাজস্ব আদায়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীরা) একই শ্রেণীভূক্ত করে তাদের সকলকেই জমির মালিক বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়। ১৭৮৯ খ্রীস্টাব্দের এক মিনিট-এ কর্নওয়ালিস মত প্ৰকাশ করেন-“আমার সুদৃঢ় মত এই যে ভূমিতে জমিদারগণের মালিকানা স্বত্ব দেওয়া জনহিতার্থে আবশ্যক।” বাঙলার জমিদারদের জমার পরিমাণ ২৬৮ লক্ষ সিককা টাকা নির্দিষ্ট হয়। কোম্পানির আর্থিক প্ৰয়োজন বিচার করেই জমার পরিমাণ নির্দিষ্ট হয়। যাতে নিয়মিতভাবে ভূমিরাজস্ব দেওয়া হয়, সেই উদ্দেশ্যে ‘সূর্যাস্ত আইন’ জারি করা হয়। এই আইন অনুযায়ী কিস্তি দেওয়ার শেষ দিন সন্ধ্যার পূর্বে কোন মহালের টাকা জমা না পড়লে, সেই মহালকে নিলামে চড়ানো হত; অনাদায়, অনাবৃষ্টি, দুৰ্ভিক্ষ প্রভৃতি কোন আছিলাই চলত না। কর্নওয়ালিসের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, সুনিশ্চিত আদায় ও কৃষির বিস্তার। কিন্তু কর্নওয়ালিসের উদ্দেশ্য ও প্রত্যাশা কিছুই সিদ্ধ হয়নি। উপরন্তু জমিদাররা সম্পূর্ণ নির্জীব হয়ে দাঁড়ায় ও প্রজাপীড়ন ক্রমশঃ ঊর্ধ্বগতি লাভ করে।
দুই
এই একশাল, পাঁচশালা ও দশশালা বন্দোবস্তের অন্তরালেই ঘটেছিল বাঙলার বৃহত্তম জমিদারীর বিলুপ্তি। এ জমিদারী ছিল রাণী ভবানীর। বাঙলা দেশের প্রায় আধখানা জুড়ে ছিল এ জমিদারীর বিস্তৃতি। কোম্পানির রেভেন্যু কালেকটর জেমস গ্রাণ্ট বলেছেন—“Rajesahy, the most unwieldy and extensive zemindary of Bengal or perhaps in India”. তাঁর এই বিশাল জমিদারী থেকে লব্ধ দেড় কোটি টাকা খাজনার অর্ধেক তিনি দিতেন নবাব সরকারে, আর বাকী অর্ধেক ব্যয় করতেন নানারকম জনহিতকর ও ধর্মীয় কাজে৷ অকাতরে অর্থ দান করে যেতেন। দীনদুঃখীর দুঃখমোচনে, ব্ৰাহ্মণপণ্ডিত প্ৰতিপালনে ও গুণীজনকে বৃত্তিদানে। তার দান খয়রাতি ও বৃত্তিদান বাঙলা দেশে প্ৰবচনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। দুদিনের জন্য কখনও তিনি কিছু মজুত করেন নি। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পদক্ষেপে যখন প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা অনাদায় রইল, তখন তাঁর জমিদারীর একটার পর একটা মহাল ও পরগণা নীলামে উঠল। সুযোগসন্ধানীরা সেগুলো হস্তগত করবার জন্য বাপিয়ে পড়ল। ওয়ারেন হেষ্টিংস-এর কুকাৰ্যসমূহের যারা সহায়ক ছিল, তারাই এল এগিয়ে। রাণী ভবানীর জমিদারীর অংশসমূহ কিনে নিয়ে তারা এক একটা রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে বসল। কান্ত বাবু (যিনি হেষ্টিংসকে সাহায্য করেছিলেন চৈত সিং-এর সম্পত্তি লুণ্ঠন করতে এবং যেজন্য তার অংশবিশেষ তিনি পেয়েছিলেন) প্রতিষ্ঠা করলেন কাশিমবাজার রাজবংশ, গঙ্গগোবিন্দ সিংহ প্রতিষ্ঠা করলেন পাইকপাড়ার রাজবংশ, দুর্বৃত্ত দেবী সিংহ প্ৰতিষ্ঠা করলেন নসীপুরের রাজবংশ, এমন কি রাণী ভবানীর নিজ দেওয়ান দয়ারাম প্ৰতিষ্ঠা করলেন দিঘাপতিয়ার রাজবংশ। শেষ পর্যন্ত রাণী ভবানী এমন নিঃস্ব হয়ে গেলেন যে তাঁকে নির্ভর করতে হল কোম্পানি প্রদত্ত মাসিক এক হাজার টাকা বৃত্তির ওপর। তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মাদি করবার জন্য, তার স্বজনদের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল ইংরেজ কোম্পানির কাছে। আর তার ললাটে পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল কালিমার টীকা। ১৭৯৯ খ্রীস্টাব্দের ১০ অকটোবর তারিখের (তাঁর মৃত্যুর তিন বছর আগে) এক সরকারী আদেশে বলা হল—’The former rank and situation of Maharanny Bowanny, her great age, and the distress to which both herself and the family have been reduced by the imprudence and misconduct of the Late Rajah of Rajesahy, are circumstances which give her claims to the consideration of Government. We therefore authorise to continue to her an allowance of Rs 1000 per month” অথচ তাঁর মৃত্যুর পর যখন তাঁর স্বজনবর্গ কোম্পানির দ্বারস্থ হল তখন কোম্পানীর রেভেন্যু বোর্ডের কতাঁরা বললেন—“(Board) have reasons to suppose that the Late . Ranny left ample funds by which the expenses of her funeral obsequies may be discharged”.