০৮. চিঠি

বারান্দার কাঠের চেয়ারের হাতলে একটা কাক বসে আছে।

সুলতানার বুক ধ্বক করে উঠল। এটা কি কোনো অলক্ষণ? কা কী করে। কাক ডাকাটা অলক্ষণ। কিন্তু একটা কাক ঝিম ধরে অনেকক্ষণ ধরে চেয়ারে বসে থাকলে তার মানে কী হয়? কাক চুপ করে বসে থাকার পাখি না। সে খাবারের খোঁজে ছটফট করবে। ঘাড় বাঁকিয়ে গৃহস্থকে দেখবে। এই কাজটা সে করছে না। ঝিম ধরে বসে আছে। সুলতানা রান্নাঘরে ঢুকলেন। এশাকে কাক সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করতে হবে। তিনি জানেন, এশা লক্ষণ-অলক্ষণ বিষয়ে কিছুই জানে না। আধুনিককালের মেয়েদের লক্ষণ বিচারের সময় নেই। তবু মনের শান্তির জন্যে জিজ্ঞেস করা।

সুলতানা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, এশা একটা কাক তোর বাবার চেয়ারের হাতলে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে।

এশা পায়েস ব্রাধছিল। পায়েস রান্নার প্রধান কৌশল ক্ৰমাগত হাঁড়ির দুধ নাড়াচাড়া করা। একটু থামলেই দুধ ধরে যাবে। পায়েসে দুধ পোড়া গন্ধ এসে যাবে। সে চামচ নাড়তে নাড়তেই বলল, কাক বসে আছে তো কী হয়েছে?

কোনো অলক্ষণ না তো? এশা হেসে ফেলল। সুলতানা বললেন, কাকটাকে দেখে ভাল লাগছে না।

কাক দেখে ভাল লাগার কোনো কারণ নেই মা। কাকতো ময়ূর না যে দেখে ভাল লাগবে। আজ সকাল থেকে তুমি লক্ষণ বিচার শুরু করেছ। দয়া করে মনটা শান্ত কর। পায়েসের মিষ্টি একটু চেখে দেখ।

সুলতানা মিষ্টি চাখলেন। মিষ্টি বেশি হয়েছে না কম হয়েছে কিছুই বললেন না। তিনি খুবই অস্থির বোধ করছেন। তাঁর অস্থির বোধ করার সঙ্গত কারণ আছে। শামার আজ রাতেই বিয়ে হয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তৃণার উদ্যোগে আনা পাত্রের সঙ্গে বিয়ে সম্পর্কিত সব কথাবার্তা শেষ হয়েছে। পাত্রের নানিকে চিটাগাং থেকে আনা হয়েছে। তিনি সন্ধ্যার পর লোকজন নিয়ে শামাকে দেখতে আসবেন। তিনি যদি বলেন, মেয়ে পছন্দ হয়েছে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গেবিয়ে পড়ানো হবে।

আবদুর রহমান সাহেবকে কাজি এনে রাখার কথা বলা হয়েছে। তাঁর নিকট আত্মীয়স্বজনকেও খবর দিয়ে রাখতে বলা হয়েছে। আবদুর রহমান সাহেব বলেছেন, আমি সব খবর দিয়ে রাখলাম। কাজি নিয়ে আসলাম আর ছেলের নানি বললেন, মেয়ে পছন্দ হয় নি তখন?

এতে পাত্রের মামা (ব্যারিস্টার। ইমরুল হক। হাইকোর্টে প্রাকটিশ করেন।) খুবই বিরক্ত গলায় বললেন, ছেলের নানি এ ধরনের কথা বলবেন না। আমরা সব ঠিকঠাক করে তবেই উনাকে আনিয়েছি। উনি আমাদের সবার। মুরুঝি। এই জন্যেই উনাকে সামনে রাখা, আপনি কি আমাদের কথায় ভরসা। পাচ্ছেন না?

আবদুর রহমান সাহেব ব্ৰিত গলায় বললেন, কেন ভরসা পাব না? অবশ্যই ভরসা পাচ্ছি। ভরসা না পাবারতো কিছু নেই।

সমস্যা থাকলে বলুন কাজি আমরা নিয়ে আসব। আপনাদের কিছু করতে হবে না।

না না কোনো সমস্যা নেই।

আমরা তাড়াহুড়া করছি কারণ ছেলের বাবা অসুস্থ। বারডেমে আছেন। যে-কোনো মুহূর্তে এক্সপায়ার করতে পারেন। উনি যেন ছেলের বউ দেখে যেতে পারেন সেই ব্যবস্থা। বুঝতে পারছেন?

জি পারছি।

আপনাকে দেখে খুবই চিন্তিত মনে হচ্ছে। আপনি কি চিন্তিত?

জি না, চিন্তিত না। শুধু শুধু চিন্তিত হব কেন?

আবদুর রহমান সাহেব মুখে বললেন শুধু শুধু চিন্তিত হব কেন? আসলে তিনি খুবই চিন্তিত বোধ করছেন। এত বড় ঘরে তার মতো সাধারণ মানুষের সম্পর্ক করাটা ঠিক হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছেন না। তার চেয়েও অনেক বেশি চিন্তিত সুলতানা। সুলতানার চিন্তার প্রধান কারণ আজ সন্ধ্যার আগে যদি ছেলের বাবা মারা যায় তাহলে তো আজ বিয়ে হবে না। এবং অবশ্যই পাত্র পক্ষ পিছিয়ে পড়বে। তাদের মধ্যে কেউ না কেউ বলবে, মেয়ে অলক্ষণা। বিয়ের কথা হলো অমি ছেলের বাবা গেল মরে। শ্বশুর-খাকি কন্যা!

সুলতানা আজ সকাল থেকে যে শুধু লক্ষণ বিচার করছেন, এই কারণেই করছেন। শুধু কাকের ব্যাপারটা ছাড়া লক্ষণ বিচারের ফলাফল শুভ। অনেক দিন বৃষ্টি হচ্ছে না। আজ সকাল থেকেই আকাশ মেঘে মেঘে কালো। আকাশের ভাব দেখে মনে হয় যে-কোনো সময় বৃষ্টি শুরু হবে। বিয়ের দিন বৃষ্টি শুভ।

বিয়ের দিন এশাকে দিয়ে পায়েস রান্না বসিয়েছেন। এর মধ্যেও সুলতানার একটা গোপন পরীক্ষা আছে। বিয়ের দিন কনের বাড়িতে রান্না করা পায়েস যদি ধরে যায়, কিংবা পুড়ে যায়, কিংবা পাতিল উল্টে পায়েস মাটিতে পড়ে যায়, তাহলে বিরাট অলক্ষণ। এশার রান্না করা পায়েস খুব ভাল হয়েছে। এটা একটা ভরসার কথা। সুলতানা এক বাটি পায়েস এনে শামার ঘরে ঢুকলেন। শামা খুব মনোযোগ দিয়ে পায়ের নখ কাটছিল। সে নেইল কাটার থেকে চোখ না তুলেই বলল, পায়েস খাব না মা, দেখেই ঘেন্না লাগছে।

পায়েস দেখে ঘেন্না লাগার কী আছে?

ঈদের দিন ছাড়া অন্য যে-কোনো দিন পায়েস দেখলে আমার ঘেন্না লাগে।

একটু চেখে দেখ।

চেখেও দেখব না। আজ আমার বিয়ের দিন। অন্তত আজকের দিনে আমাকে দিয়ে জোর করিয়ে কিছু করাবে না।

তোর বান্ধবীরাতো এখনো কেউ এল না?

সবাই আসবে। এখন তো মাত্র সকাল দশটা বাজে। এত টেনশন করছ কেন মা? শান্ত হয়ে একটু আমার পাশে বসতো।

সুলতানা বসলেন। শামা নখ কাটা বন্ধ রেখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, মা তুমি আমাকে একটা পরামর্শ দাওভতা।

কী পরামর্শ?

খাতাউর সাহেব বিষয়ক একটা পরামর্শ।

সুলতানা ক্ষীণ স্বরে বললেন, ওর কথা আসছে কেন?

শামা বলল, ওর কথা আসছে কারণ ওরা আমাকে এক হাজার এক টাকা এবং একটা আংটি দিয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হচ্ছে আজই এইসব ওদের ফেরত দেয়া উচিত। আমি বাড়িওয়ালা চাচাকে বলে রেখেছি উনি তার গাড়িটা আমাকে তিন ঘণ্টার জন্যে দিয়েছেন। আমি মন্টুকে নিয়ে বের হব। দু’একটা টুকটাক শপিং করব। তারপর খাতাউর সাহেবের বোনের বাসায় গিয়ে তার বোনের হাতে জিনিসগুলি দিয়ে আসব। তোমার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার কোনো কারণ নেই। খাতাউর সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হবে না কারণ উনি খুবই অসুস্থ। ছাদের চিলেকোঠার ঘরে তাঁকে বেশ কিছুদিন হলো তালাবন্ধ করে রাখা হচ্ছে।

তুই এত খবর কোথায় পেলি?

মাঝে মাঝে আমি ঐ বাসায় টেলিফোন করি।

কেন?

মানুষটার অসুখটা কমল কিনা এটা জানার জন্যে টেলিফোন করি। এই মানুষটাতে আমার স্বামীও হয়ে যেতে পারত। পারত না? এখন আমাকে অনুমতি দাও, আমি আংটি ফেরত দিয়ে আসি।

সুলতানা চিন্তিত গলায় বললেন, তোকে যেতে হবে কেন? আংটি ফেরত দিতে হলে তোর বাবা গিয়ে ফেরত দিয়ে আসবে।

শামা শান্ত স্বরে বলল, আংটিতো তারা বাবাকে দেয় নি। আমাকে দিয়েছে। কাজেই আংটি আমাকেই ফেরত দিতে হবে।

সুলতানা বললেন, তুই আমার পরামর্শ চেয়েছিলি। আমার পরামর্শ হলো তুই যাবি না।

শামা বিছানা থেকে নামল। বুক শেলফ থেকে একটা বই বের করল। বইয়ের মাঝখানে রাখা একটা চিঠি বের করে মা’র দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, তুমি চিঠিটা পড়। তারপর আমাকে বল আমার যাওয়া উচিত হবে, কি হবে না।

কার চিঠি?

খাতাউর সাহেবের চিঠি।

সে আবার কবে চিঠি লিখল?

তিনি অসুস্থ হবার আগে চিঠিটা লিখেছেন।

সুলতানা নিচু গলায় বললেন, আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না। সে চিঠি লিখবে কেন? তুই কি এই চিঠির জবাব দিয়েছিস নাকি?

শামা বলল, এত কথা বলছ কেন মা। চিঠিটা তুমি আগে পড়তো। সুলতানা চিঠি পড়ছেন। চিঠি পড়তে গিয়ে তার হাত কাঁপছে।

 

শামা,
তোমার কাছে এই চিঠি লিখতে খুব অস্বস্তি লাগছে, খানিকটা লজ্জাও লাগছে। একবার ভাবলাম এই চিঠি লেখাটাতো তেমন জরুরি না। না লিখলেও চলে। কিন্তু পরে মনে হললা চিঠিটা না লিখলে নিজের কাছে ছোট হয়ে থাকব। অন্তত এইটুকু আমার ব্যাখ্যা করা উচিত কেন আমি অসুখের ব্যাপারটা পুরোপুরি গোপন রাখলাম। আমার ব্যাখ্যাটা যে তোমার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে তা আমার মনে হচ্ছে না। আমার নিজের কাছেই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য না। তাহলে ব্যাখ্যাটা দিচ্ছি কেন? মানুষের স্বভাব হচ্ছে খুব বড় ধরনের ভুল করলেও কেন ভুল করল তার একটা ব্যাখ্যা সে দাঁড় করায়। যতটা না অন্যের জন্যে তারচে’ বেশি নিজের জন্যে। মূল কথা না বলে অন্য গীত গাইছি— তোমা তোমার নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত লাগছে। একটু ধৈর্য ধর, এক্ষুণি আমার সব কথা বলা হয়ে যাবে। আমার ছেলেবেলার একটা গল্প বলব। গল্পটা শেষ হওয়া মানে আমার সব কথা শেষ হওয়া।

আমার তখন সাত বছর বয়স। ক্লাস টুতে পড়ি। জন্ম থেকেই অসুখ বিসুখ আমার লেগেই আছে। দু’দিন পর পর জ্বরে পড়ি। ঠাণ্ডা লাগলেই সর্দি-কাশি। বাবা আমার অসুখ নিয়ে খুবই বিরক্ত। একদিন আমার মা’কে বললেন। শুধুমাত্র তোমার পুত্রের চিকিৎসার জন্যে বাড়িতে একজন ডাক্তারকে জায়গির রাখা দরকার। ডাক্তার ঘরেই থাকবে, খাবে আর বার মাস আমার ছেলের চিকিৎসা করবে। তবে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওর চিকিৎসা আমি করব। প্রতিদিন আমার সঙ্গে সে এক মাইল হাঁটবে। ফজরের নামাজের পর একে তুমি কানে ধরে বিছানা থেকে তুলবে। আমি রোজ একে নিয়ে সান্ধিকোনা পুলের কাছের বটগাছ পর্যন্ত যাব। আবার ফিরে আসব। এই চিকিৎসার নাম হাঁটা চিকিৎসা। এই চিকিৎসা এক মাস করলে তোমার ছেলের আর কোনো চিকিৎসা লাগবে না। ঝড়, বৃষ্টি, তুফান, সাইক্লোন, টাইফুন কোনো অবস্থাতেই এই হাঁটা চিকিৎসা বন্ধ হবে না।

বাবা কথা যা বলেন কাজও তাই করেন। জমিদারি ভাবভঙ্গি আমাদের পরিবারে কারোর মধ্যেই ছিল না। শুধু বাবার মধ্যেই ছিল। আরম্ভ হলে আমার হাঁটাহাটি।

শুরুতে ব্যাপারটা যত ভয়ঙ্কর হবে বলে আমার মনে হচ্ছিল দেখা গেল ব্যাপার তেমন ভয়ঙ্কর না। বাবার মতো গম্ভীর ভারিক্কী ধরনের মানুষও সারা পথই আমার সঙ্গে গল্প করেন। যে বাবার ভয়ে বাড়ির সবাই তটস্থ হয়ে থাকে দেখা গেল সকালবেলায় বাবা সেই বাবা না। সকালবেলায় বাবা খুবই মজার একজন মানুষ। এক এক দিন তিনি একেক রকম মজা করতে করতে হাঁটেন। আমি মহাউৎসাহে তার আঙুল ধরে থাকি। আমার বড়ই ভাল লাগে।

একদিন ভোরে আকাশ খুব মেঘলা করেছে। বৃষ্টি নামি নামি করছে। বাবা আমাকে নিয়ে বের হবেন। মা বললেন, দিন খারাপ। ঝড় বৃষ্টি হবে। আজ বের না হলে হয় না?

বাবা ধমক দিয়ে বললেন, কী বলেছিলাম ঝড়, বৃষ্টি, তুফান, সাইক্লোন কোনো অবস্থাতেই হাঁটা বন্ধ হবে না? | মা বললেন, ছাতা নিয়ে যান।

বাবা বললেন, ছাতা কীসের? বৃষ্টি হলে ভিজতে ভিজতে যাব। এতে শরীর পোক্ত হবে। সামান্য ঠাণ্ডা বাতাস লাগলেই, সর্দি জ্বর এইসব হবে না।

আমি বাবার হাত ধরে রওনা হলাম। সান্ধিকোনা পুলের বটগাছের কাছে যাওয়ার আগেই তুমুল বর্ষণ শুরু হলো। বাবা বললেন, বৃষ্টিতে ভিজতে কেমন লাগছেরে ব্যাটা?

আমি বললাম, ভাল।

বাবা হাসতে হাসতে বললেন, এক কাজ কর, শার্ট প্যান্ট খুলে নাংগু বাবা হয়ে যা। আশেপাশে দেখার কেউ নেই। সারা শরীরে বৃষ্টির পানি লাগলে জীবনে কোনো দিন ঘামাচি হবে না।

আমি বললাম, লজ্জা লাগে।

বাবা বললেন, দূর ব্যাটা! কে দেখবে? দেখবে শুধু আল্লাহপাক। আল্লাহপাকের কাছে কীসের লজ্জা?

আমি শার্ট খুলে ফেলেছি। প্যান্ট খুলতে যাব হঠাৎ দেখি বাবা যেন কেমন করছেন। যে হাতে তিনি আমাকে ধরে ছিলেন, সেই হাত কাঁপছে। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, বাবারে মহাবিপদ। আজ আমার মহাবিপদ!

আমি দেখলাম বটগাছের পেছন থেকে পাঁচ দু’জন মানুষ বের হয়ে এল। খুবই সাধারণ গ্রামের চাষাভুষা মানুষ। তারা আমাদের দিকে দৌড়ে আসতে শুরু করল।

পরের ঘটনাগুলি ঘটল অতি দ্রুত। আমি দেখলাম এরা বাবাকে কাদার ভেতর ফেলে দিয়েছে। একজন গরু জবাই করার মস্ত বড় ছুরি বের করেছে। বাবা গোঙাতে গোঙাতে বলছেন, তোমরা আমার একটা কথা রাখ। এই দৃশ্য যেন আমার ছেলেটা না দেখে। তাকে সরায়ে নিয়ে যাও। আমাকে দয়া করার দরকার নেই, আমার ছেলেকে দয়া কর।

এই দয়া তারা করল না। বাবার কাছ থেকে চার পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য আমি দেখলাম। লোকগুলি যেমন দ্রুত এসেছিল সে রকম দ্রুতই চলে গেল। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম আমার জবাই করা বাবার পাশে। কী বৃষ্টি! বাবার ওপর বৃষ্টির পানি পড়ছে। আর সেই পানি দেখতে দেখতে টকটকে লাল হয়ে যাচ্ছে। আমি এক মুহূর্তের জন্যেও বাবার ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে পারলাম না। আমি তাকিয়েই রইলাম।

সেই থেকে আমার অসুখের শুরু।

দুই তিন বছর পর পর বর্ষার সময় অসুখটা হয়। যখন খুব বৃষ্টি হতে থাকে। তখন বৃষ্টির দিকে তাকালে হঠাৎ মাথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায়। হঠাৎ মনে হয় আমি একটা ভোলা মাঠে দাঁড়িয়ে আছি। আমার গায়ে বৃষ্টির ফোটা পড়ছে আর বৃষ্টির ফোঁটাগুলি অদ্ভুত উপায়ে লাল টকটকে হয়ে যাচ্ছে।

আমাকে সুস্থ করার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। বড় বড় ডাক্তাররা আমাকে দেখেছেন। আমাকে কোলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে একজন বড় সাইকিয়াট্রিস্ট আমাকে দেখেছেন। কোনো লাভ হয় নি। সেই সাইকিয়াট্রিস্ট আমাকে বলে দিয়েছিলেন, আমি যেন কখনো বৃষ্টি না দেখি। আকাশে মেঘ করলেই আমি যেন ঘরে ঢুকে দরজা জানালা বন্ধ করে বসে থাকি। সে চেষ্টাই এখন করি।

এই হলে আমার গল্প। খুবই ভয়ঙ্কর গল্প, আমি চেষ্টা করেছি সহজভাবে বলতে। তা কি আর সম্ভব? এমন ভয়ঙ্কর গল্প কি আর সহজ করা সম্ভব?

শামা এখন বলি আমি আমার অসুখের কথাটা কেন। গোপন করলাম। কেন জানি এক সময় আমার মনে হলো প্রবল বৃষ্টির সময় কেউ যদি গভীর মমতায় আমার হাত ধরে থাকে এবং আমার কানে কানে বলে কোনো ভয় নেই। আমি তোমার পাশে আছি। আমি তোমার হাত ধরে আছি। আমি এক মুহূর্তের জন্যেও হাত ছাড়ব না। তাহলে হয়ত। আমার অসুখটা হবে না। এক সময় বৃষ্টিটা আমার কাছে সহনীয় হয়ে উঠবে। কে জানে একদিন হয়ত সেই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতেও পারব।

আমার এ ধরনের চিন্তার পেছনে কোনো যুক্তি ছিল না, ছিল বিশ্বাস। ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো চেপে ধরে আমিও তাই করতে চেয়েছি।

আমি খুবই ভুল করেছি। আমিতো আর তোমাদের মতো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ না। ভুলতত আমি করবই।

শেষবার এশার সঙ্গে যখন কথা হয়েছে সে আমাকে বলেছে অন্য এক জায়গায় তোমার বিয়ের কথা হচ্ছে। তোমার খুব ভাল বিয়ে হোক এটা আমি মনেপ্রাণেই কামনা করছি। তোমার সঙ্গে আমার অতি সামান্য পরিচয় যেন কোনো অবস্থায়ই তোমার মনে কোনো ছাপ না ফেলে এই প্রার্থনা করছি।

আরেকটা কথা— মাঝে মধ্যে এশা টেলিফোনে আমার সঙ্গে কথা বলেছে। এই নিয়ে তুমি তার ওপর রাগ করো না।

এই চিঠিটা এশাকে দেখিও। শেষবার টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা বলার ভঙ্গি থেকেই বুঝেছি সে আমার গোপন করার ব্যাপারটায় খুব কষ্ট পেয়েছে।

এই চিঠিটা পড়লে তার কষ্ট সামান্য কমতেও পারে।

ইতি আতাউর

 

সুলতানা চিঠি ভাঁজ করে টেবিলে রাখলেন।

শামা বলল, মা তুমি কিছু বলবে?

সুলতানা চুপ করে রইলেন। শামা শান্ত গলায় বলল, মা তুমি বল আমি কি উনার সঙ্গে দেখা করে বলব চিঠিটা পড়ে আমার খুব মন খারাপ হয়েছে। আপনার ওপর আমি খুব রাগ করেছিলাম ঠিকই। এখন আর আমার কোনো রাগ নেই। বল মা, এটাও কি আমি বলব না?

সুলতানা জবাব দিলেন না। চুপ করে রইলেন।

 

শামা মুত্তালিব সাহেবের গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে। মুত্তালিব সাহেব নিজেও গাড়িতে আছেন। তিনি শামাকে নিয়ে পেছনের সীটে বসেছেন।

ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। এমন বৃষ্টি যে গাড়িতে বসে বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মুত্তালিব সাহেব বললেন, এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে আমরা কোথায় যাচ্ছি?

শামা বলল, জানি না চাচা।

মুত্তালিব সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, তুই কোথায় যাবি তা না জেনেই বের হয়েছিস?

শামা বলল, আমরা কী করব, না করব তা কি আমরা সব সময় জানি?

মুত্তালিব সাহেব জবাব দিলেন না। তিনি হঠাৎ লক্ষ করলেন, শামা কাঁদছে। টপটপ করে শামার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।

শামা বলল, চাচা আমি গাড়ির কাঁচটা নামিয়ে দেই?

মুত্তালিব সাহেব বললেন, ভিজে যাবি তো।

চাচা আজ আমার ভিজতে ইচ্ছা করছে।

মুত্তালিব সাহেব নরম গলায় বললেন, তোর যা করতে ইচ্ছে করে তুই কর। আমি আছি তোর সঙ্গে। মা-রে তুই কাঁদছিস কেন?

শামা জবাব দিল না। সে জানালার কাচ নামিয়ে মুগ্ধ হয়ে বৃষ্টি দেখছে। সে কী করবে? সে কি গাড়িতে করে খানিকক্ষণ ঘুরে বাসায় ফিরে যাবে? যে। মানুষটা মাকড়সা ধাঁধার জবাব ঠিকঠাক দিতে পেরেছিল তার সঙ্গে জীবন শুরু। করবে?

না-কি আতাউর নামের মানুষটার কাছে উপস্থিত হয়ে বলবে, হ্যালো মিস্টার। আসুনতো আমার সঙ্গে বৃষ্টি দেখবেন। আজ আমরা বৃষ্টি বিলাস করব। কোনো ভয় নেই। আমি সারাক্ষণ আপনার হাত ধরে রাখব। এক মুহূর্তের জন্যেও হাত ছাড়ব না। কী করবে শামা?

শামা কাঁদছে। শাড়ির আঁচলে সে চোখ মুছছে। কোনো বড় সিদ্ধান্ত সে নিয়ে নিয়েছে। মস্ত বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেবার আগে আগে মেয়েদের চোখে সব সময় পানি আসে।

4 Comments
Collapse Comments

খুব সুন্দর একটা বই,ধন্যবাদ আপনাদের। এই সুন্দর বইটি পড়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।তবে কিছু বানানে সমস্যা আছে,সেগুলো ঠিক করে নেবেন।

আচ্ছা শামা শেষে কী করেছে?

সেটা লেখক যেহেতু লিখে যাননি তাই তা জানার ও আর উপায় নাই

লেখক শেষের অংশটা পাঠকের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *