চাষি
আমরা যাকে সভ্যতা বলি, তার ভিত খোঁড়া হয়েছে। লাঙলের ফলায়। মানুষ যে আদিতে অসভ্য যাযাবর ছিল, তার কারণ স্থিতিশীল সভ্য হয়ে তার প্রাণে বঁচবার উপায় ছিল না। অন্নের পশু ও পালিত পশুর অন্নের সন্ধানে তাকে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড পরিক্রম করতে হত। পরিচিত ভূভাগ স্বল্পপশু ও তৃণবিরল হয়ে উঠলে, অজ্ঞাত দেশের দিকে পা বাড়াতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা চলত না। কৃষির রহস্য আয়ত্ত করে তবেই মানুষ এ ভবঘুরে অস্থিরতার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। চাষের ক্ষেতকে কেন্দ্র করে তারই চারপাশে গ্রাম, নগর, স্বদেশ, স্বরাজ্য গড়ে উঠেছে। এইসব স্থায়ী আবাসে চাষের অন্নের কৃপায় মানুষের মন, শরীরের একান্ত দাসত্ব থেকে নিস্কৃতি পেয়ে, শিল্প ও সৌন্দৰ্য, ভাব ও জ্ঞানের বিচিত্র সৃষ্টিতে রত হয়েছে। তার কর্মকুশলতা অজস্রধারায় সহস্ৰ পথ কেটে চলেছে। এই সভ্যতার জন্মের সন তারিখ ঠিক জানা নেই। কিন্তু মানুষ যেদিন চাষের ক্ষেতের কারখানায় দ্যাবা-পৃথিবী থেকে অন্ন চুইয়ে নেবার সজীব কলের সৃষ্টিকৌশল আবিষ্কার করেছে সেই দিনই এর জন্মদিন।
মাটির চাষ সভ্যতাকে বহন করে এনেছে, কিন্তু সে সভ্যতা চাষিকে বহন করতে পারেনি। চাষি চিরদিনই সভ্যতার ভারবাহী মাত্র হয়ে আছে। সে হচ্ছে সভ্যতার মূল। মাটির নীচে থেকে রস টেনে সে সভ্যতার ফুল ফোটাবে, ফল ধরাবে, কিন্তু তার বর্ণ, গন্ধ, স্বাদ সে কখনও জানবে না।
এর কারণ সভ্যতার জন্মকথার সঙ্গেই জড়ানো রয়েছে। মানুষের যাযাবর জীবন ছিল সাম্য ও স্বাধীনতার স্বৰ্গরাজ্য। জমিয়ে জমিয়ে অবাধে বাড়িয়ে তোলা যায়—-ধনের এমন আকার ছিল না বলে, ধনী ও নির্ধনের উৎকট প্ৰভেদ তখন সম্ভব ছিল না। সমাজের এক ভাগ অন্য সকলের পরিশ্রমের ফলের মোটা অংশ ভোগ করবে, এ ব্যবস্থার উপায় ও অবসর অতি সামান্য ছিল, এ জন্য সমাজের মধ্যে দাস-প্ৰভু সম্বন্ধ গড়ে উঠতে পারেনি। বহিঃপ্রকৃতির দাসত্ব সকলকেই এমন নিরবচ্ছিন্ন করতে হত যে, সে দাসের দলের এক ভাগের আর প্রভু হয়ে ওঠার সুযোগ ছিল না। চাষের জ্ঞানের ফলে মানুষ সে-স্বৰ্গরাজ্য থেকে চু্যত হয়েছে। মাটি যেদিন ধন হয়েছে, ও-স্বৰ্গরাজ্যও সেদিন মাটি হয়েছে। চাষের ফসলকে জীবনোপায় করার সঙ্গে সেই কৌশল মানুষের করায়ত্ত হয়েছে, যাতে একজন বহুজনকে অনাহারের ভয় দেখিয়ে বাধ্য করে খাটিয়ে নিতে পারে। আর তার ফল ক্ৰমে জমা করে সে ক্ষমতাকে ক্রমে বাড়িয়ে চলতে পারে। যাঁরা বলী ও কৌশলী, এ চেষ্টায় তাদের প্রলোভনও ছিল প্রচুর। যাযাবর জীবনে যাঁরা অভ্যস্ত, চাষের পরিশ্রম তাদের কাছে বিস্বাদ ও অতিমাত্রায় ক্লেশকর। ক্ষুধার তাড়নায় গুরু শ্রম, আর তার শাস্তিতে অখণ্ড আলস্য, এই ছিল যাযাবর জীবনযাত্রার সাধারণ ধারা। এর তুলনায় চাষির শ্রম কঠোরতায় লঘু, কিন্তু সে শ্রম প্ৰতিদিনের নিয়মিত পরিশ্রম, অনভ্যাস্তের কাছে যা সবচেয়ে পীড়াকর। সে পরিশ্রম করতে হয়। বর্তমানের ক্ষুধার তাড়নায় নয়, ভবিষ্যতের অনাহারের আশঙ্কায়। কারণ সে পরিশ্রমে বর্তমানের ক্ষুধানিবৃত্তির কোনও সম্ভাবনা নেই। কিছুই আশ্চর্য নয় যে, এই চিরফলপ্ৰসূ, নিয়ত পরিশ্রমের গুরুভার বলবান ও বুদ্ধিমান লোকেরা চিরদিনই দুর্বল ও হীনবুদ্ধিদের কাঁধেই চাপিয়ে এসেছে।
সভ্যতার ইতিহাসের প্রতি অধ্যায়ে এই উদাহরণ ছড়ানো রয়েছে। সভ্য গ্রিসের রাজ্যগুলিতে চাষি ছিল ক্রীতদাস, আর এ ব্যবস্থা ভিন্ন সভ্যতা কী করে টিকে থাকতে পারে, গ্রিক পণ্ডিতেরা তা ভেবে পাননি। রোমান সভ্যতা সাম্রাজ্যের পথে পা দিতেই হাতের লাঙল তুলে দিয়েছিল দাসদের হাতে। ইউরোপের মধ্যযুগে ও রুশিয়াতে সেদিন পর্যন্ত চাষি ছিল নামে ও কাজে দাসেরই রূপান্তর। হিন্দুর শাস্ত্ৰে চাষের কাজ বৈশ্যের, অর্থাৎ আর্যের— যার বেদে অর্থাৎ বিদ্যায় অধিকার আছে। শাস্ত্রের কথা শাস্ত্রের পুথিতেই লেখা আছে, কিন্তু সুদূর অতীত থেকে চাষের লাঙল ঠেলছে। শূদ্রে, যে শূদ্ৰকে ‘দাস্যায়ৈব হি সৃষ্টোহসৌ ব্ৰাহ্মণস্য স্বয়ংভুবা’— স্বয়ম্বু সৃষ্টিকর্তা দাসত্বের জন্যই সৃষ্টি করেছেন।
মোট কথা, ধনতন্ত্রের যেমন দুই দিক–ধনসৃষ্টি ও ধনবিভাগ; সভ্যতার ও তেমনি দুই দিক-সৃষ্টি ও বিভাগ। শরীর ও মনের যা পুষ্টি ও সম্পদ, তার সৃষ্টির কাজে নানা সভ্যতার মধ্যে বড় ছোট, ভালমন্দ ভেদ আছে; কিন্তু বিভাগের কাজে সব সভ্যতার এক চাল। সভ্যতার সৃষ্টির বড় ও শ্রেষ্ঠ অংশ ভাগ হয় অল্প ক’জনার মধ্যে, যা অবশিষ্ট তাই থাকে বাকি সকলের জন্যে, যদিও শ্রমের ভাগটা তাদেরই বেশি।
যে সভ্যতা নিজেকে আধুনিক বলে গর্ব করে, তার শ্রেষ্ঠত্বের প্রধান দাবি এই যে, বিভাগের এই উৎকট বৈষম্য সে ক্রমে কমিয়ে আনছে। জ্ঞান ও রসের সৃষ্টিকে অল্প ক’জনার জন্যে তুলে না রেখে, যার শক্তি আছে তারই আয়ত্তের মধ্যে এনে দেবার সেনানা পথ কেটে দিচ্ছে। শরীরের জন্য যে বস্তুসম্ভার, তাকে ভাগ্যবান ও বুদ্ধিমান এবং স্বল্পভাগ্য ও সাধারণ বুদ্ধি লোকের মধ্যে কেবল প্রয়োজনের মাপে বেঁটে দেওয়া সম্ভব না হলেও, সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য যা প্রয়োজন তা থেকে যাতে কেউ না বঞ্চিত হয়, সেদিকে তার চেষ্টার বিরাম সেই, এবং সাধারণ সুখস্বচ্ছন্দ্যের আদর্শকেও সে ক্রমে উচু দিকেই টেনে তুলছে। পূর্বে যা ধনীর বিলাস ছিল, তাকে সে অল্পবিত্তের নিত্য ব্যবহার্য করেছে। তার জন্যে ধনীর ব্যসনের আয়োজনও পরিমাণ কমাতে হয়নি, তা বরং বেড়েই চলেছে। তবুও যে এ কাজ সম্ভব হয়েছে, সে হচ্ছে বস্তুসৃষ্টির যে অভিনব কৌশল সে আবিষ্কার করেছে, তারই প্রয়োগে। এই কৌশলের বলে স্বল্পপরিসর স্থানের মধ্যে, অল্প লোকে, অতি সামান্য সময়ে প্রয়োজন ও বিলাসের যে বৃহৎ সামগ্ৰীসম্ভার উৎপন্ন করতে পারে, ইতিপূর্বে সমস্ত দেশব্যাপী লোকের বহুদিনের চেষ্টাতেও তা সম্ভব ছিল না। এই কৌশলের নাম ‘ইনডাস্ট্রিয়্যালিজম’।
আধুনিক ইনডাস্ট্রিয়্যাল’ সভ্যতার এই দাবি, তার জন্ম ও লীলাভূমি পশ্চিম ইউরোপে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলে সত্য বলেই স্বীকার করতে হবে। সেখানে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে এখনও যতই পার্থক্য থাকক, ধনিকের তুলনায় শ্রমিকের প্রয়োজন ও বিলাসের উপকরণের জোগান যতই নগণ্য হোক, এ কথা অস্বীকার করা চলে না যে, পূর্ব পূর্ব যুগের তুলনায় ইনডাস্ট্রিয়্যাল’ যুগের সভ্যতার ভারবাহীরা অনেক বেশি পরিমাণে সে-সভ্যতার ফলভোগী হয়েছে। এ সভ্যতার যাঁরা মাথায় রয়েছে, এ যে তাদের উদারতায় ঘটেছে তা নয়। যাঁরা ধনে ও বুদ্ধিতে প্রবল, তাঁরা নিজেদের লাভের লোভেই ‘ইনডাস্ট্রিয়্যালিজম’-এর গোড়াপত্তন করেছে। কিন্তু তার ফলে যে সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তাতে ভারবাহীদের দল বঁধবার সুযোগ ঘটেছে, এবং দলের চাপেই তাঁরা ও-ফল আদায় করেছে। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এর সম্ভাবনা ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। নূতন সৃষ্টিকৌশলে জোগানের পরিমাণ যদি না বেড়ে যেত, তবে ধনিকের ভাণ্ডার খালি না করে শ্রমিকের থলি ভরানো কিছুতেই চলত না।
কিন্তু ‘ইনডাস্ট্রিয়্যাল’ দেশগুলিতে দৃষ্টি আবদ্ধ না রেখে গোটা পৃথিবীর দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে, চাষিকে নিয়ে প্ৰাক-‘ইনডাস্ট্রিয়্যাল’ সভ্যতার যা সমস্যা, ‘ইনডাস্ট্রিয়্যালিজম’–তার কোনওই সমাধান করতে পারেনি; সমস্যাটিকে এক পা দূরে হটিয়ে রেখেছে মাত্র। পূর্ব যুগের সভ্যতা যে গোঁজামিল দিয়ে এর মীমাংসার চেষ্টা করত, ইনডাস্ট্রিয়্যাল’-সভ্যতা খুব ব্যাপকভাবে সেই গোঁজামিলই চালাতে চাচ্ছে।
সভ্যতার নিত্য সমস্যা হচ্ছে, জীবনের পুষ্টি ও আনন্দের যা উপকরণ আবিষ্কার হয়েছে, কী করে তা যথেষ্ট উৎপন্ন করে সমাজের মধ্যে এমন করে বেঁটে দেওয়া যায়, যাতে প্রয়োজনের পরিমাণ থেকে কেউ বাদ না পড়ে, অথচ উৎপাদনের কাজে বুদ্ধি ও পরিশ্রম নিয়োগের আকর্ষণেরও অভাব না হয়; আর প্রকৃতি যাদের নূতন সৃষ্টির ক্ষমতা দিয়ে জন্ম দিয়েছে, তাদের সেই শক্তিপ্রয়োগের শিক্ষা, সুযোগ ও অবসরের কী করে ব্যবস্থা করা যায়। এর একটির উপর নির্ভর করে সভ্যতার স্থিতি, অন্যটির উপর তার বৃদ্ধি। এ পর্যন্ত কোনও সভ্যতা এ সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। সভ্যতাকে বঁচিয়ে রাখার জন্য যে গুরুতর শারীরিক পরিশ্রমের প্রয়োজন, সব সভ্যতা তার বোঝা চাপিয়েছে সমাজের একটা অংশের উপর, যাতে বাকি অংশটা ওই পরিশ্রম থেকে মুক্ত হয়ে সভ্যতার ভোগ ও বৃদ্ধির যথেষ্ট উপকরণ ও অবসর পায়। সব সভ্যতার অস্তরেই এই ভয় যে, ওই পরিশ্রমের ভার সমাজের এক অংশের মাথা থেকে লাঘবের জন্য সকলের উপর ভাগ করে দিলে, সভ্যতা সমাজের সকলের পক্ষেই বোঝা হয়ে উঠবে। ওর ভোগের উপাদান কারও ভাগ্যে জুটবে না, ওর বৃদ্ধির সুযোগ ও অবসর কারও ঘটবে না। কাজেই সভ্যতার স্থিতি ও বৃদ্ধির জন্য বলে হোক, ছলে হোক, সমাজের একদল লোককে তার ভারবাহী করতেই হবে, এবং খুব সম্ভব সে-দল লোক হবে সংখ্যায় সবচেয়ে বড় দল।
‘ইনডাস্ট্রিয়্যাল’-যুগের পূর্ব পর্যন্ত প্রত্যেক সভ্যসমাজে সভ্যতার এই ভারবাহীর দল ছিল চাষি। কারণ কৃষিই ছিল প্রতি সমাজের জীবিকার মূল উৎস। ‘ইনডাস্ট্রিয়্যালিজম’ হঠাৎ আবিষ্কার করল যে, কৃষিকে বাদ দিয়ে এক নূতন ধরনের কারুশিল্পে সমাজের বুদ্ধি ও পরিশ্রম নিয়োগ করলে তার ফল ফলে বেশি। কৃষি জীবিকার যে উপকরণ উৎপন্ন করে, সমান পরিশ্রমে এতে তার অনেক গুণ বেশি পাওয়া যায়। পশ্চিম ইউরোপে এই ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত হলে দেখা গেল যে, এই সমাজব্যবস্থায় সভ্যতার ভারবাহীদেরও অনেক পরিমাণে তার ফলভোগী করা কৃষিসভ্যতার তুলনায় সহজসাধ্য। কারণ এতে যে অল্প সময়ের পরিশ্রমে অনেক বেশি ফল লাণ্ড হয় কেবল তাই নয়, এ ব্যবস্থায় কৃষির জন্য দেশের অধিকাংশ লোককে দেশময় বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে থাকতে হয় না, স্থানে স্থানে অল্প জায়গার মধ্যে তাদের সংঘবদ্ধ হতে হয়। অর্থাৎ দেশের অধিকাংশ লোক গ্রামবাসী না থেকে নগরবাসী হয়; এবং গ্রাম্য হল সভ্যতার বোঝাবাহী বর্বর, আর নাগরিক তার ফলভোগী বিদগ্ধজন। শহরের দলবদ্ধ লোকের শিক্ষা, দীক্ষা, স্বাস্থ্য ও মঙ্গলের জন্য যা সহজসাধ্য, সারা দেশে ছড়ানো চাষির জন্য সে ব্যবস্থা অতি দুঃসাধ্য।
‘ইনডাস্ট্রিয়্যালিজম’-এর এই পরিণতিতে ইউরোপের অনেক সমাজহিতৈষী ভাবুক স্বভাবতই উৎফুল্প হয়েছেন। তাঁরা বলছেন এখন যদি ধনীর লাভের লোভ ও বিলাসের দাবি কমানো যায়, এবং কাউকেও অলস থেকে পরের পরিশ্রমের ফলভোগ করতে না দিয়ে পরিশ্রমের ভার সকলের মধ্যে ভাগ করা যায়, তবে প্রত্যেক লোকের প্রতিদিন অল্প সময়ের পরিশ্রমেই সমাজের সকলের প্রয়োজন ও অল্পস্বল্প বিলাসের উপযোগী ধন উৎপন্ন হতে পারে। আর সভ্যতার যা শ্রেষ্ঠ ফল, সৃষ্টি-কৌশলীদের তার সৃষ্টির এবং অন্য সকলের তার রসগ্রহণের শিক্ষা, সুযোগ ও অবসরের ব্যবস্থা হয়। সভ্যতার ভারবাহী হতভাগ্যের দল সমাজ থেকে লোপ পায়।
বিনা আগুনে এই অন্নপাক কী করে সম্ভব হবে? উত্তর অতি সহজ, পরের আগুনের উপর পাকপাত্ৰ চাপিয়ে। ইনডাস্ট্রিয়্যাল-সমাজ চায় কৃষির পরিশ্রম ও তার আনুষঙ্গিক সমাজব্যবস্থার অসুবিধা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে। অথচ ইনডাস্ট্রিয়্যালিজমের আদি ও অন্ত চাষির পরিশ্রমের উপর নির্ভর করছে। তার শিল্পের উপাদানও জোগাবে কৃষি, বিনিময়ও জোগাবে কৃষি। সুতরাং ইনডাস্ট্রিয়্যাল’ সমাজ থেকে কৃষির পরিশ্রম দূর করার অর্থ–অন্য সমাজের উপর সেই পরিশ্রম দ্বিগুণ করে চাপানো, প্রতি সমাজে চাষির যে সমস্যা ছিল, কতকগুলি সমাজ থেকে তা সরিয়ে অন্য কতকগুলি সমাজের ঘাড়ে তুলে দেওয়া; পৃথিবীর প্রতি সভ্যদেশের একদল লোককে তার সভ্যতার ভারবাহী না করে, কতকগুলি সভ্যদেশের সভ্যতার ভার অন্য কতকগুলি দেশকে দিয়ে বহন করানো; যে ছল ও বল প্ৰত্যেক সভাসমাজের এক ভাগ লোক অন্য ভাগের উপর প্রয়োগ করত, সেই ছল ও বল আত্মীয়তার বাধা নিরপেক্ষ হয়ে মনুষ্যসমাজের একভাগের উপর প্রয়োগ করা।
যাযাবর মানুষের সঙ্গে স্থিতিশীল কৃষিসভ্যতার সংঘর্ষের কাহিনি মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে একটা বড় অধ্যায় জুড়ে রয়েছে। এই সংঘর্ষেই বোমান সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে, গুপ্ত সাম্রাজ্য ভেঙে পড়েছে, বোগদাদের মুসলিম সভ্যতার বিলোপ ঘটেছে। ইনডাস্ট্রিয়্যালিজম’ সেই সংঘর্ষেরই আর এক মূর্তি। চায্যের পরিশ্রম অস্বীকার করে এও চাষির পরিশ্রমের ফল লুটিতে চায়। যে ধন ও ধনী একে চালনা করছে, তাঁরাও মুখ্যত যাযাবর। এক দেশ থেকে অন্য দেশে, পৃথিবীর এক ভাগ থেকে অন্য ভাগে প্রয়োজনমতো চলে বেড়াতে তাদের কিছুতেই বাধা নেই। এবং এর হাতে বিনিময়েব বাটখাবা থাকলেও, অন্য হাতে যাযাবরের শাণিত অস্ত্ৰ বহাল রয়েছে।
সভ্যতার যা সমস্যা, ইনডাস্ট্রিয়্যালিজম’ তার মীমাংসা নয়; কাবণ ও ব্যবস্থা মানুষের সমাজকে এক করে দেখে না এবং দেখতে পারে না। মানুষের এক অংশকে ভাববাহীতে পরিণত না করে, সভ্যতাকে কেমন কবে বাচানো ও বাড়ানো যায়, সমস্ত মানবসমাজেৰে পক্ষ থেকে ‘ইনডাস্ট্রিীয্যালিজমের এর কোনও উত্তব নেই। মানুষের সভ্যতার চরম সমস্যা হচ্ছে চাষি। যেদিন চাষিকে সভ্যতার ভারবাহীমাত্র না রেখে ফলভোগী করা সম্ভব হবে, কেবল সেইদিন সভ্যতার সমস্যার যথার্থ মীমাংসা হবে। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে প্রমাণ হবে গ্রিক পাণ্ডিত্যের কথাই সত্য, দাসের শ্রম ভিন্ন সভ্যতার চাকা অচল।
ফাল্গুন ১৩৩২