অষ্টম পরিচ্ছেদ
ঘূর্ণ বাত্যা
জহাঙ্গীর নগরের দুর্গমধ্যে নদীতীরের একটি কক্ষে বসিয়া বাঙ্গালার সুবাদার মোকরম্ খাঁ বিশ্রাম করিতেছিলেন। ভীষণ গ্রীষ্ম, একজন বাঁদী নবাবের পদসেবা করিতেছিল, দুই জন ময়ূরপুচ্ছ লইয়া ব্যজন করিতেছিল, এবং চতুর্থা সুশীতল পানীয় লইয়। কক্ষের কোণে দাঁড়াইয়াছিল। এই সময়ে একজন খোজা কক্ষের দুয়ারে দাঁড়াইয়া নবাবকে অভিবাদন করিল। নবাবের নিদ্রাকর্ষণ হইতেছিল, তিনি বিরক্ত হইয়া আলস্যবিজড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি চাহ?” খোজা পুনর্ব্বার অভিবাদন করিয়া কহিল, “বন্দানওয়াজ, দেওয়ান হরেকিযণ সদরে অপেক্ষা করিতেছেন।” “হরেকিষণ অসময়ে কেন আসিল?” “বন্দা তাহাকে জানাইয়াছিল, যে সুবাদার এখন খোয়াবগাহে, কিন্তু দেওয়ান সাহেব বলিলেন, যে বাদশাহের দরবার হইতে জরুরী পাঞ্জা লইয়া একজন সওয়ার আসিয়াছে।”
নবাব বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “হরেকিষণকে গোসলখানায় অপেক্ষা করিতে বল, আমি আসিতেছি।” খোজা পুনরায় অভিবাদন করিয়া প্রস্থান করিল। ‘
সদরখালিসার দেওয়ান হরেকৃষ্ণ রায়, বঙ্গজ কায়স্থ, খর্ব্বাকৃতি, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। তিনি বুদ্ধিবলে সামান্য অবস্থা হইতে উন্নত হইয়া এই উচ্চপদ লাভ করিয়াছিলেন। তখন সামান্যবংশজাত হিন্দুর পক্ষে ইহা অপেক্ষা উচ্চতর রাজপদ লাভ করা প্রায় সম্ভব হইত না। বাদশাহের সওয়ার তখনও দেওয়ানখানায় অপেক্ষা করিতেছিল, সেই জন্য হরেকৃষ্ণ অধীর হইয়া ইতস্ততঃ পাদচারণ করিতেছিলেন। বাদশাহের পত্র অথবা ফর্ম্মাণ স্বয়ং সুবাদার ব্যতীত আর কেহ গ্রহণ করিতে পারিত ন। হঠাৎ তাঁহার সম্মুখে মনুষ্যের ছায়া পড়িল, দেওয়ান ভীত হইয়া দুইপদ পিছু হটিয়া গেলেন। তখন দেওয়ানখানার একটি স্তম্ভের অন্তরাল হইতে গুরুগম্ভীর স্বরে উচ্চারিত হইল, “হরেকৃষ্ণ, ভয় নাই।” দেওয়ান চাহিয়া দেখিলেন যে গৈরিকবসন-পরিহিত একজন দীর্ঘাকার সন্ন্যাসী স্তম্ভের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া আছেন। হরেকৃষ্ণ ব্যস্ত হইয়া সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, “প্রভু, সমস্ত কুশল ত?” “কুশল জিজ্ঞাসা পরে করিও, আমি বিশেষ প্রয়োজনে ঢাকায় আসিয়াছি, তুমি আমাকে সুবাদারের সহিত পরিচিত করিয়া দাও।” “কি পরিচয় দিব? আপনার প্রকৃত পরিচয়?” “না, বলিও যে আমি তোমার গুরু।” “আপনি যে আমার গুরু সে কথা ত মিথ্যা নহে, সুমার ও খাজানার কার্য্য—” “ও সকল কথা থাক। আমার এক বন্ধুর কন্যাকে ফিরিঙ্গি হারমাদ্ হুগলীতে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে, তুমি সুবাদারকে অনুরোধ করিয়া তাহার মুক্তির ব্যবস্থা করিয়া দাও।” “প্রভু, বড়ই কঠিন কার্য্য।” “তাহা আমি জানি।” “ফিরিঙ্গিগণ সুবাদারের বড়ই প্রিয় পাত্র।” “তাহাও আমি অবগত আছি।” “তবে কি উপায় করিব প্রভু?” “নবাবকে বল যে আমার অনুরোধ রক্ষা না করিলে একথা এক মাসের মধ্যে বাদশাহের কানে উঠিবে।” “বলেন কি? এমন কাজ কে করিবে?” “নুরজাহান বেগম অথবা আসক্ খাঁ।” “প্রভু, আপনার অসাধ্য কার্য্য নাই।” “হরেকৃষ্ণ, আমার আর একটি অনুরোধ আছে।” “কি আদেশ প্রভু?” “অদ্য নবাবের বজরায় পদার্পণ করিও না, করিলে বিপদে পড়িবে।” “যে আজ্ঞা।”
এই সময়ে ফটকে নাকারা বাজিয়া উঠিল, দেওয়ানখানার দুয়ারে দাঁড়াইয়া নকীব ফুকারিল, আশা, সোটা, মহীমরাতব লইয়া অসংখ্য হরকরা ও পাইক দেওয়ানখানায় প্রবেশ করিল; বাঙ্গালার সুবাদার নবাব মোকরম খাঁ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেওয়ান হরেকৃষ্ণ রায় নবাবকে কুর্ণিশ করিয়া বাদশাহী দরবারের সওয়ারকে ডাকিয়া আনিলেন। সওয়ার অভিবাদন করিয়া দাঁড়াইল, নবাব তিন পদ অগ্রসর হইয়া তিনবার কুর্ণিশ করিলেন, একজন হরকরা একখানি রজতের পাত্র আনিয়া নবাবের হাতে দিল এবং কুর্ণিশ করিয়া প্রস্থান করিল। নবাব রজত পাত্র সহিত বাদশাহের পত্র দেওয়ানের হাতে দিয়া কহিলেন, “হরেকিষণ, মুরসলা বজরাই লইয়া যাও, কিল্লার ভিতরে অত্যন্ত গ্রীষ্ম।” বজরার নাম শুনিয়া দেওয়ানের হৃৎকম্প উপস্থিত হইল। হরেকৃষ্ণ কম্পিত পদে অগ্রসর হইয়া কহিলেন, “হুজুর?” নবাব বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “কি বলিতেছ?”
“আমার গুরুদেব বড় বিপদে পড়িয়া জহাঙ্গীর নগরে আসিয়াছেন; জনাবালীর হুকুম পাইলে তাঁহাকে হজরতের সম্মুখে উপস্থিত করিতে পারি।”
“তোমার গুরু কি চায়?” “তিনি হজরতের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া নিজে আরজ পেশ করিবেন।” “সে কোথায়?” “এই খানেই আছেন।” “লইয়া আইস।”
তখন সন্ন্যাসী স্তম্ভের অন্তরাল হইতে বাহির হইয়া কহিলেন, “ভগবান্ নবাবের মঙ্গল করুন।” নবাব দেওয়ানকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হরেকিষণ, তোমার মুর্শিদ্ কি ফকীর?” হরেকৃষ্ণ সেলাম করিয়া কহিলেন, “হুজুর।” “দেওয়ানা ফকীরের সুবাদারের নিকট কি প্রার্থনা থাকিতে পারে?”
সন্ন্যাসী অগ্রসর হইয়া কহিলেন, “আমার প্রার্থনা আপনার জন্য।” নবাব বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “আমার জন্য? কাফের, তুমি কি পাগল হইয়াছ?” “পাগল না হইলে সংসার ত্যাগ করিতে পারা যায় না। আমার প্রার্থনা সত্য সত্যই আপনার জন্য।” হরেকৃষ্ণ কহিলেন, “হুজুর, ইনি ত্রিকালদর্শী সাধু পুরুষ; ইনি যাহা বলিতে আসিয়াছেন মেহেরবাণী করিয়া তাহ শুনুন।” নবাব বলিলেন, “ফকীর কি বলিতে আসিয়াছ বল।” “আপনি অদ্য নৌকায় উঠিবেন না।” “কেন? আমি এখনই বজরায় যাইতেছি।” “অদ্য নৌযানে ভ্রমণ করিলে আপনার বিপদ হইবে।” “ফকীর সত্য সত্যই পাগল। তুমি কি এই কথা বলিবার জন্য জহাঙ্গীর নগরে আসিয়াছ?” “আমার আরও একটি অনুরোধ আছে, আমার এক বন্ধুর কন্যাকে মখ্সুসাবাদ হইতে ফিরিঙ্গির সপ্তগ্রামে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে। বাদশাহ ঈশ্বরের ছায়া, আপনি তাঁহার প্রতিনিধি, আপনার অনুগ্রহ ব্যতীত অসহায়া বালিকার উদ্ধার অসম্ভব।” “ফকীর, ফিরিঙ্গি লড়াইতে বড়ই বাহাদুর; তাহারা শাহান্শাহ্ বাদশাহের হুকুম সকল সময়ে তামিল করে না, তাহারা কি আমার অনুরোধ গ্রাহ্য করিবে?” “নিশ্চয়ই করিবে।”
হরে। জনাবালী হিন্দুস্থানের রুস্তম, বাদশাহী দরবারের আফ্তাব ও মাহ; সুবা বাঙ্গালায় এমন কে বেকুফ্ আছে যে হুজুরের ফর্মান্ বরদারী করিবে না? জনাবালীর মুখ হইতে আওয়াজ বাহির হইতে হইতে সপ্তগ্রাম ও চট্টগ্রামের সমস্ত ফিরিঙ্গি তাহা তামিল করিবে।
নবাব। হরেকিষণ, তোমার খাতিরে ফকীরের দরখাস্ত মঞ্জুর করিলাম, কিন্তু সেই বালিকাকে ফিরিঙ্গিদিগের নিকট হইতে খরিদ করিয়া আনিতে হইবে।
সন্ন্যাসী। তাহারা যদি বিক্রয় না করে?
নবাব। তখন কলিমুল্লা খাঁকে হুকুম দিব, সে তোমার আত্মীয়াকে ছিনাইয়া লইয়া আসিবে।
সন্ন্যাসী। অর্থলোভে অথবা নবাবের খাতিরে, পর্ত্তুগীজ সেনাপতি বালিকা ছাড়িতে চাহিলে পাদ্রীরা তাহাকে ছাড়িবে না।
নবাব। তুমি কি সেই বালিকাকে খরিদ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলে?
সন্ন্যাসী। ইহার জন্য করি নাই বটে, কিন্তু পূর্ব্বে দুই এক বার করিয়াছি, তখন এই জবাব পাইয়াছিলাম।
নবাব। ফকীর, আমার অনুরোধ আর একবার চেষ্টা করিয়া দেখ।
নবাব এই বলিয়া প্রস্থানের উপক্রম করিলেন, তাহা দেখিয়া হরেকৃষ্ণ অতি বিনীত ভাবে কহিলেন, “হুজুর, বন্দার শরীর অসুস্থ, জনাবালীর হুকুম পাইলে, নায়েব দেওয়ানকে পাঠাইয়া দি।” “হরেকিষণ, তুমি কাফেরের কথা শুনিয়া ভয় পাইয়াছ?” “না; আমার শরীর তিন দিন যাবৎ অসুস্থ আছে।” “তবে মহম্মদ আমিন খাঁকেই পাঠাইয়া দাও।” হরেকৃষ্ণ অব্যাহতি পাইয়া হাঁপ ছাড়িয়া বঁচিলেন।
নবাব অন্দর মহলে প্রবেশ করিলে সন্ন্যাসী হরেকৃষ্ণকে কহিলেন, “মৃত্যু স্বয়ং আসিয়াছেন, মোকরম খাঁ সামান্য মানুষ, সে কি করিবে?” হরেকৃষ্ণ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন?” “মোকরম খাঁ মরিতে চলিয়াছে।” “কেমন করিয়া?” “বাহিরে আসিয়া দেখ।”
উভয়ে দেওয়ানখানা পরিত্যাগ করিয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইলেন। দূরে বুড়ী গঙ্গার প্রশস্ত বক্ষে সুবাদারের প্রকাণ্ড বজরা নঙ্গর করা ছিল; এই সময়ে তাহা আসিয়া কিল্লার ঘাটে লাগিল। ক্ষণকাল পরে সুবাদার ও অন্যান্য বিশিষ্ট রাজকর্ম্মচারিগণ বজরায় উঠিলেন। বজরা ছাড়িল, তাহা দেখিয়া সন্ন্যাসী কহিলেন, “হরেকৃষ্ণ, মোকরম খাঁ ত চলিল; আসদ্ খাঁ কোথায়?” হরেকৃষ্ণ বিস্মিত হইয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন প্রভু?” “এইবার অসিদ্ খাঁ সুবাদারি লাভ করিবে।”
সহসা নদীবক্ষে বিস্তৃত বালুকাক্ষেত্র বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল; সঙ্গে সঙ্গে শান্ত নদীবক্ষ ভীষণ মূর্ত্তি ধারণ করিল; চারিদিক হইতে মেঘ আসিয়া নীলাকাশ আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল; বেগে বায়ু বহিতে আরম্ভ করিল, সুবাদারের বজরা ভীষণ বেগে নাচিতে আরম্ভ করিল, কিল্লা হইতে হাহাকার রব উঠিল। বৃষ্টি আরম্ভ হইল, পর্ব্বতপ্রমাণ তরঙ্গমালা আসিয়া কিল্লায় আছাড়িয়া পড়িতে লাগিল, সহসা প্রকাণ্ড বজরা অদৃশ্য হইল। সন্ন্যাসী ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “হরেকৃষ্ণ, দেখিলে?” দেওয়ান বিষন্ন বদনে কহিলেন, “দেখিলাম, প্রভু, এখন আমার কি উপায় হইবে?” “তোমার কোন ভয় নাই, তুমি দেওয়ানই থাকিবে।” “প্রভু, ভবিষ্যৎ যখন আপনার অবিদিত নহে, তখন আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করিলেন না কেন?” “হরেকৃষ্ণ, বিধিলিপি অখণ্ডনীয়। আসদ্ খাঁ কোথায়?” “বোধ হয় সপ্তগ্রামে।” “আমি চলিলাম, তাহার সহিত ফিরিব।” সন্ন্যাসী এই বলিয়া অন্ধকারে অদৃশ্য হইলেন।