॥ আট ॥
গাড়ি থামল। গাড়ি চলে গেল।
নিজের বাড়ির সামনে একা দাঁড়িয়ে তৃণা। বুকে একটা খাঁ খাঁ আকাশ। সেই আকাশে নানা ভয়ের শকুন উড়ছে।
রাত আটটা বেজে গেছে। তবু তেমন রাত হয়নি। এখনও স্বচ্ছন্দে বাড়িতে ঢোকা যায়। কেউ ফিরেও তাকাবে না সে জন্য। দেবাশিসের গাড়িটা গড়িয়াহাটা রোডের মুখে গিয়ে বাঁ ধারে মোড় নিল।
তৃণা বাড়ির গেট দিয়ে ধীর পায়ে ঢোকে। মস্ত আলো জ্বলছে বাইরে। ছোট বাগানটার গাছপালার ওপর আলো পড়েছে। হাওয়া দিচ্ছে। চাঁদ উঠেছে। ফুলের গন্ধ মুঠো মুঠো ছড়াচ্ছে বাতাস।
আজকের দিনটা দেবাশিসের কাছে ভিক্ষে নিল তৃণা। আজ দিনটা ভাল নয়। এই ভুতুড়ে দিনে এতবড় একটা সাহসের কাজ করতে তার ইচ্ছে করল না। আজকের দিনটি কেটে গেলে এরপর যে কোনওদিন সে চলে যাবে। কেন থাকবে এখানে? কেন থাকবে।
আস্তে ধীরে সে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল। বাঁ ধারের ঘরটায় টেবিল-টেনিস খেলছে রেবা আর তার এক মাদ্রাজি মেয়ে-বন্ধু সরস্বতী। ছোটাছুটি করছে। হাসছে। তাকে কেউ দেখল না।
শচীনের কাকাতুয়াটা চেচিয়ে বলল, চোর এসেছে। চোর এসেছে। শচীন! শচীন!
তৃণা ধীরে তার ঘরে এসে দাঁড়ায়। আলো জ্বালে না। চুপ করে বিছানায় বসে থাকে কিছুক্ষণ, এবং বসে থাকতে থাকতেই টের পায, বুকে আকাশ, আকাশে শকুন। মনটা ভাল থাকলে এই নিয়ে একটাকবিতা লিখত সে।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল তৃণা। অলক্ষ্যে এবং নিজের অজান্তে চাকর এসে ডাকল— মা, খাবেন না? সবাই বসে আছে।
তৃণা উঠল। চাকরের মুখের মা ডাকটা কানে বাজতে থাকে। বাথরুম সেরে এসে খাওয়ার টেবিলে চলে গেল সে। রাতের খাওয়ার সময়টায় সে প্রায়ই থাকে। নিয়ম। না থাকলেও ক্ষতি নেই, তবু নিয়ম।
খাওয়ার টেবিলে আজ সবাই খুব হাসি খুশি।
শচীন ছেলেমেয়েদের কাছে গল্প বলছে। কথামৃতের গল্প। সবাই শুনছে। এ সব গল্পের মধ্যে অবশ্য তৃণাকে ওরা রাখে না। টেবিলের একধারে তৃণা চুপ করে বসে থাকে। টেবিলে সাজানো খাবার। যে যার প্লেটে তুলে নিয়ে খায়।
শচীন গল্পের শেষে বলল, জাপানের চালানটা এলে দেখবি। বামন গাছের এমন একটা বাগান করব।
আমাদের স্কুলে ইকেবানা শেখায়। রেবা বলে।
মনু বলল, সে আবার কী?
ফুলদানি সাজানো। খুব মজার। জাপানিরা স্বর্গ, মানুষ আর পৃথিবী এই প্যাটার্নে ফুল সাজায়। অদ্ভুত।
মনু বলে, জাপানিরা খুব প্রগ্রেসিভ। না বাবা?
প্রগ্রেসিভ! শচীন বলে, তা ছাড়া ওদের মতো মাথা কারও নেই। শুধু দোষের মধ্যে বড্ড সেন্টিমেন্টাল, একটুতেই সুইসাইড করে।
হারিকিরি। রেবা বলে।
হারিকিরি নয়। মনু বলে, হারাকিরি!
এইরকম সব কথা।
রান্নার লোকটা নিঃশব্দে ঘরের একধারে দাঁড়িয়ে ছিল। রোজই থাকে! চমৎকার রাঁধে সে। কোনও ভুল হয় না।
আজ হঠাৎ চাইনিজ চপ সুয়ের একচামচ মুখে তুলেই রেবা চেঁচিয়ে বলে, চিত্ত, আজ এটাতে নুন দাওনি!
চিত্ত শশব্যস্তে–দিয়েছিলাম তো!
দাওনি। রেবা জোর গলায় বলে।
মনু একটু মুখে দিয়ে বলে, দিয়েছে। তবে কম হয়েছে।
শচীন বলল, টেস্ট কিন্তু দারুণ।
রেবা বিরক্ত হয়ে তার বাবার দিকে নুনের কৌটো এগিয়ে দেয়। কী ভেবে নিজেই নুন ছড়িয়ে দেয়। মনুর প্লেটেও দেয়।
তারপরই হঠাৎ তৃণার দিকে ফিরে বলে, মা, তোমাকে… ওঃ, তুমি তো এখনও খাওয়া শুরুই করোনি!
তৃণা ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না যে রেবা তাকে মা বলে ডাকছে। গত এক বছর একবারও ডাকেনি। তার কানমুখ ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে রক্তের জোয়ারে। বুক ভেসে যায়, হৃদয় ক্ষরিত হয়। বহুকাল বাদে স্তনের ভিতরে যেন ঠেলে আসে দুধ। অস্থির তৃণা চেয়ারের হাত চেপে ধরে। আনন্দ! আনন্দ! এত আনন্দ সে বুঝি জীবনে একবারও আর ভোগ করেনি। কেউ তার অবস্থা লক্ষ করছে না! ভাগ্যিস! শচীন ওদের বিদেশের একটা অভিজ্ঞতার গল্প করছে। ওরা কি জানে তৃণার ভিতরে একটা ট্যাপ কে যেন খুলে দিয়েছে! অবিরল নিঝরিণী বয়ে চলেছে তার শরীর দিয়ে। সেই স্রোত তার চারধারে সব কিছুকেই অবগাহন করাচ্ছে, শব্দটা কান পেতে শোনে তৃণা স্রোতের শব্দ।
পরদিন সকালে তৃণা কবিতার খাতা নিয়ে বসল।
আজও দেবাশিস আসবে। বিকেলবেলায়। বাসস্টপে।