খোকা ঠিক করেছে দুর্যোগ নিয়ে সে আর মাথা ঘামাবে না। সে দেখেছে এতে তার ভিতরের অশান্তি দ্বিগুণতর বাড়ে। জনসভা আর মিছিল করে লঙ্কাকাণ্ড বাধাবার জন্যে কোমর বেঁধে উঠে পড়ে লেগে গিয়েছে মানুষজন। কাঁধে রাইফেলের কেঠো ডামি নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় কুচকাওয়াজ করে বেড়াচ্ছে উৎসাহী ছাত্রদল। সেনাবাহিনীর লোকজন ঘোমটার আড়ালে মুখ লুকিয়েছে। ন্যাবলা-গোবলা বাঙালি সেপাই-সান্ত্রীরা চোখেমুখে ভাই ভাই ভাব নিয়ে প্রাণের আনন্দে ট্রাকে ট্রাকে ঘুরে নামকে ওয়াস্তে পাহারাদারি করে বেড়াচ্ছে; হাবভাব দেখলে মনে হয় হাতে কলকে এসে গিয়েছে, এখন কেবল গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ানো।
বিকেলে আউটার স্টেডিয়ামে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করলো খোকা। দেখা হলো রহমান আর নুরুদ্দিনের সঙ্গে। রহমান উচ্ছ্বসিত হয়ে বললে, খেলা জমে গেছে, এবার শালারা বোম ফেলাট হয়ে যাবে–
ময়ানে এখানে-ওখানে জটলা। কোনো একজন বক্তা বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলছে, ভাইসব, সময় নষ্ট করবেন না, আপনারা গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ন, আজ আপনাদের সম্মুখে কেবল একটি পথই খোলা, সশস্ত্র সংগ্রামের পথ। কালবিলম্ব না করে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হবে আপনাদের, আঘাত হানতে হবে শত্রুকে। এতোদিন যে বিপ্লবকে মনে হয়েছিলো পর্বতের মতো ভারি, আজ তা পালকের চেয়েও হালকা, মুক্তির একমাত্র পথই হলো সশস্ত্র বিপ্লব, এই পথই বেছে নিতে হবে আপনাদের–
লে ধড়ফড়াকে! জনসভার বাইরে বাঙ দিয়ে উঠলো একজন।
স্টেডিয়াম গেটের পাশে টিকিট ঘরের ছাদে আসন গেড়ে বসে ফুকফুক করে সিগ্রেট ফুঁকছিলো ছাত্রনেতারা। ময়দানের মানুষজন হুড়মুড় করে ছুটে এসে জমায়েত হলো সেখানে।
খোকা দেখলো জনৈক ছাত্রনেতা কোমরে একটি হ্যান্ডেল লাগিয়ে এবং অপর একটি হাত স্প্রিং-এর মতো নেড়ে নেড়ে অনর্গল তুবড়ি ছোটাচেছ, এরা কারা? আপনাদের মতো আমাদেরও ওই একই প্রশ্ন, এরা কারা? জনতা এদের চেনে? এদের কি কোনো পরিচয় আছে জাগ্রত জনতার সঙ্গে? পরিচয় নেই। জনতা এদের চেনে না। এরা বিবরবাসী। মুক্ত আলোবাতাস থেকে বঞ্চিত এইসব হতভাগ্য অভিশপ্তরা। জনসাধারণের সঙ্গে এদের কোনো সংশ্রব নেই, দেশের সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক নেই। কিছুসংখ্যক বিপথগামী উন্মাদ। সস্তা বিপ্লবের ধুয়ো তুলে এই হঠকারীর দল মূল লক্ষ্য থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাচ্ছে আপনাদের। আমি হুঁশিয়ার করে দিতে চাই–
একফাঁকে সরে পড়লো খোকা। দিনের পর দিন সকাল-বিকেল-দুপুর চিরতার পানির মতো এইসব গিলছে উৎসাহীর দল; ভগ্নোদ্যমকে সেঁকে নিচ্ছে। ফাঁপা আস্ফালন ও বাধাগতের বুলি আওড়ানো, আর কিছু শেখে নি এরা এর বাইরে। দেশের বর্তমান সঙ্কটময় পরিস্থিতির সত্যিকার চেহারা কোনো বক্তৃতাতেই নেই, এদের ঘৃণা করে খোকা, এরা লোভী, ধূর্ত, শঠ, প্রবঞ্চক, সমগ্র রুচিকে এরা বিকৃত করে তুলেছে।
পা ঘষাঘষি করতে করতে শেষ পর্যন্ত নীলাভাবীদের ওখানে গেল খোকা। রাজীব ভাই বাইরে। নীলাভাবী বললে, নিতে এসেছো?
এখনো ইচ্ছে আছে?
তার মানে?
আমি ভেবেছিলাম কথার কথা।
এতোকিছুর পরও?
এতোকিছু আবার কিসের, টেকনিকটা তো পুরানোই—
বাজে কথা বলো না, নিয়ে যাবে কি না বলো?
বিছানায় গা এলিয়ে দিলো খোকা। দুটো বালিশ টেনে গাড়ের নিচে চালান করে হেসে বললে, যদি তুমি আমার মাথা চিবিয়ে খাও–
খাবোই তো!
আসল কথা তোমাকে নিয়ে ভাগতে পারবো না!
খারাপ কথা বলবো কিন্তু!
এ আর নতুন কি–
নীলাভাবী খোকার হাত চেপে ধরলো। বললে, ভেবেছো ঠাট্টার ছলে সব উড়িয়ে দেবে, আমি সব বুঝি, উত্তর তোমাকে দিতেই হবে, ব্যবস্থা তোমাকে করতেই হবে।
খোকা গা ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করে বললে, আমি তোমার কে? আমার ওপর এতো অধিকার খাটাতে চাও কেন? আমি তোমার মুটে-মজুর নই, কোনো বোঝা নিতে পারবো না, সাফ কথা!
আমি কি সত্যিই বোঝা? কি করে বলতে পারলে?
তুমি সিনেমায় নামো না কেন?
বিছানার এক পাশে বসে থোকাকে একটা সিগ্রেট ধরিয়ে দিলো নীলাভাবী। বললে, আমি বুঝতে পারছি নিজের ওপর তোমার তিলবিন্দু আস্থা নেই। সে না হয় হলো, এতো ভয় পাচ্ছো কেন, আমি বাঘ না। ভালুক, তোমাকে বুঝি গিলে খাবো?
অসম্ভব কিছু নয়। নিজের ওপর আস্থা থাকলে অসময়ে এই বান্দাকে সেগুনবাগিচায় কোনো শালা দেখতো না। আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি তুমি আমাকে জাদুটোনা করেছো, পানসুপুরি ছেড়েছো, তোমার মতলব খারাপ!
নীলাভাবীর চোখমুখ দপ করে উঠলো একথায়। বললে, মাঝে মাঝে তুমি এমন কদর্য কথা বলো! আগে তো এমন ছিলে না। এসব নোংরা ইয়ার্কি তুমি অন্য কোথাও মেরো, আমার কাছে না!
নীলাভাবীর একথায় তেজ ছিলো। এই তেজ খোকাকে স্পর্শ করে। এই তেজ খোকাকে তার নিজের মতো করে পথ দেখায়। শেকড় বাকড়হীন এই সমস্যাকে এইখানেই এই মুহূর্তে শেষ করে দিতে হবে, তাকে নেবার প্রশ্ন যেন আর কোনোদিন মাথা তুলে চাড়া না দেয়, খোকা। আলো দেখতে পায়। সে ওঠে বসে বললে, ভণিতা ছেড়ে সোজা রাস্তায়। এসো, কি চাও কি তুমি, কেন এ খেলায় মেতে উঠেছো? রসাতলে নিয়ে যেতে চাও বুঝি আমাকে?
নীলাভাবী স্তম্ভিত হয়ে দীর্ঘ দৃষ্টিতে খোকার দিকে তাকালো।
খোকা বললে, তুমি নিজেকে শাসন করো, অশ্লীলতা বিকৃতি স্বেচ্ছাচারিতা ধ্বংস করে দেবে তোমাকে; এভাবে ছত্রাখান কোরো না। নিজেকে। আমি তোমার ভালো চাই, আমি তোমার বন্ধু। যদি বলো চিরকাল বন্ধু থাকবো, আমি চাইবো তোমার ভালো হোক। নিজের হাতে তোমাকে নষ্ট করবো, ভাবো কি করে, আমার ভিতরে শুধু লাম্পট্যই দেখলে,–
কাকে ভালোমন্দ বলছো? তোমার কাছে শিখতে হবে ভালোমন্দ?
সে তোমার ইচ্ছা! আমি শুধু বলছি আমার অক্ষমতার কথা। আমি যা পারবো না আমার কাঁধে তা চাপাতে যেও না!
তার মানে আমি তোমার কাছে দয়ার কাঙাল!
তুমি ইচ্ছে করে এইভাবে দেখছো—
কিভাবে আমার স্বেচ্ছাচারিতাকে দেখলে, বিকৃতিকে চিনলে?
কথা ঘুরিয়ো না। আমি যা বলছি তুমি তা বুঝেছো। ভান কোরো না না-বোঝার। আগুন ঘাঁটাঘাঁটি কোরো না, হাত পুড়ে যাবে, মুখ ঝল্সে যাবে। তুমি যে সুখ-শান্তির কথা ভাবো সারা দুনিয়া চষে বেড়ালেও তা কখনো কেউ পাবে না, এ আমি জানি। শান্তি রচনা করতে হয়। নিজেকে সংযত করো, নিজেকে শাসন করো–
চমৎকার! থামলে কেন, বলো, আরো বলো!
বলবো না কেন, তুমি আমাকে বলাচ্ছো। হেসে উড়িয়ে দিয়ে বাহাদুরি নেবার চেষ্টা করো না। যেদিন তোমাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম, সেদিন তোমার ভিতর এ বিকৃতি ছিলো না; কতো স্নিগ্ধ ছিলে তুমি, আমার কাছে সেটাই ছিলো তোমার আকর্ষণ। ভেবে দ্যাখো, আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছো, কিভাবে মানসম্মান আত্মগরিমাকে জলাঞ্জলি দিতে বসেছো?
তাহলে আমি এই?
হ্যাঁ, তুমি এই; তোমার সুবুদ্ধি নেই, সংযম নেই, হিতাহিতজ্ঞান নেই, আত্মশাসন নেই, ভেবে দেখেছো কখনো এর শেষ কোথায়?
বুঝতে পারছি খুব বেশি আশা করে ফেলেছি আমি তোমার কাছে!
এখন দেখছো একজন প্রতারক, এই তো?
বুঝতে পারি না। তোমার মতো এতো সহজে আমার মাথায় কিছু ঢোকে না। কোনুটা ভণ্ডামি আর কোনটা ভালোমানুষি সেটা তুমিই জানো। শুধু বুঝতে পারছি আমার চরিত্র নেই, চরিত্রকে হাটে-বাজারে বন্ধক দিয়েছি, লজ্জায় তোমাদের মাথা কাটা যাচ্ছে!
আছে কি নেই সেটা তোমার ভাবনা। থাকলে ভালো হয়, এটাই সত্যি। তুমি একটা সামান্য মেয়েমানুষ, কিন্তু জুয়ার দান দেয়ার জন্যে কোমর বেঁধে লেগেছো। মানুষের সংসারে বাস করা উচিত, না ভাগাড়ে?
খাতায় নাম লিখিয়েছি, এই বলতে চাও তো?
তুমি চাও না, সত্যি করে বলো তো, তুমি চাও না আমি তোমার ভিতর যুঁইফুল ফোঁটাই?
খোকার কথা শেষ না হতেই প্রচণ্ড একটা থাপ্পড় পড়লো তার গালে। বিছানার উপর টলে পড়লো খোকা। চোখে আঁচল চেপে ছুটে বেরিয়ে যেতে দেখলো সে নীলাভাবীকে!
এই ভালো,–গালে হাত বুলিয়ে আরাম পেল খোকা!
খুব ভালো হলো, চড়ের কথা জীবনভর যেন আমার মনে থাকে, মনে রাখবে তো খোকা? ভাই আমার, মনে রেখো!
ভালোই লিখেছিলো বেলী। বেলী লিখেছিলো, তোমাকে তো পারি নি, তাই তোমার একলা বিছানাটাকে তছনছ করে দিলো বেলী। একদিন এই গালে নীলাভাবীর ঠোঁটজোড়া তার সুখশয্যা রচনা করে বিশ্রাম নিয়েছিলো; আমাকে পারে নি, তাই তছনছ করে দিয়েছে আমার গাল।
ভালোই লিখেছিলো বেলী। বেলী লিখেছিলো, কেন লেখো, কেনই-বা ধ্বংস করো; নীলাভাবীকে উস্কে দিয়েছিলাম আমিই, আবার আমিই তাতে পানি ঢেলে দিয়েছি।
খোকা ভাই আমার, আমার এ গাল বড় আদরের, বড় যত্নের, জীবনভর মনে রেখো, থাপ্পড় পড়েছে আমার এই গালে, আগুনের শিখার মতো পাচটা আঙুলের দাগ বসেছে এই গালে। বলো লজ্জা লজ্জা লজ্জা! বলো ঘৃণা ঘৃণা ঘৃণা! বলো কি অশ্লীল এ দাগ!
আর লিখো না, দলামোচড়া করে ছুড়ে দিও না খাটের তলায়। অনেক লিখেছো, অনেক ধ্বংস করেছো, ঢের হয়েছে, এখন তোমার খেলা বন্ধ করো, খোকা, ভাই আমার চেয়ে দ্যাখো কি ক্লান্তি! কি বিতৃষ্ণা!
সন্ধ্যা পর হয়ে রাত্রি গড়িয়েছে সেই কখন। কিছুই জানে না খোকা। তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো সে পড়েছিলো; ডিমের খোলের ভিতর একটু একটু করে সে প্রাণ সঞ্চয় করছিলো। সে জানে, আজ তার নবজন্ম হয়েছে। আজ থেকে, এই মুহূর্ত থেকে, তার আর কোনো সমস্যা নেই, সমস্যার পীড়ন নেই, সবকিছুর সমাধান করে ফেলেছে সে।
ঘরে ফিরে জামার বোতাম খুলতে খুলতে রাজীব বললে, শুনলে কিছু?
কই না।
শুনলাম সবকিছু মিটমাট হয়ে গেছে।
কিছুই শুনি নি! খোকা অপরাধীর মতো স্বীকারোক্তি করলে। ইয়াহিয়া-ভুট্টো নাকি ছদফা মেনে নিয়েছে। টেলিগ্রামও বেরিয়ে গেছে। রাস্তায় রাস্তায় ভিড়, এখন কেবল রেডিও-টেলিভিশনে সরকারি ঘোষণার অপেক্ষা–
রক্তারক্তিটা তাহলে এড়ানো গেল শেষ অব্দি!
কি জানি, হয়তো শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে শয়তানগুলোর। এছাড়া আর কোনো পথ তো ছিলো না, দেখাই যাক!
হাতমুখ ধুয়ে এসে রাজীব ভাই বললে, কথা হয়েছে নীলার সঙ্গে? যা ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলো আমাকে। তোমার অসুবিধের কথা আমি বুঝি, বুঝলে কি হবে, এমন গোঁ ধরে বসেছে, বাধ্য হয়ে তোমাকে বলতে হলো। এখন বোঝানো যাবে। তুমি বোধহয় অব্যাহতি পেলে।
খোকা উঠি উঠি করায় রাজীব ভাই বললে, আরে বোসো বোসো, যাবেই তো, এসো একহাত হয়ে যাক আজ–
দাবার বোর্ড আর ঘুটি বের করলে রাজীব ভাই। খোকার কাছে। এটা একটা চ্যালেঞ্জ মনে হলো। কিছুটা ধারালো রাজীব ভাইয়ের মুখ। হুট করে দাবার বোর্ড টেনে বের করাকে খুব সহজে নিতে পারে না খোকা।
কয়েক চালেই হাতি আর মন্ত্রীর যৌথ আক্রমণ রচনা করলো রাজীব ভাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুলকি চালে ঘোড়াও এসে জুটলো। ভীষণভাবে আক্রান্ত হয়ে গেল খোকা। রাজা সামলাতে গিয়ে এক এক করে বহু খুঁটি হারাতে হলো তাকে; তারপর সামান্য একটু অসতর্কতার সুযোগে। ঘোড়ার চালে কিস্তি দিয়ে তার শেষ শক্তি মন্ত্রীকেও ছোবল দিলো রাজীব ভাই। রিজাইন দিয়ে মুখ রক্ষা করলো খোকা।
পরের বার খুব ধীরে-সুস্থে চাল দেয়া শুরু করলো রাজীব ভাই। খোকার দৃষ্টি এড়ায় না, খুব ঠাণ্ডা মাথায় বোড়ের জাল বিস্তার করে অসাধারণ নিপুণতায় আক্রমণের পরিকল্পনা ফেঁদে চলেছে ভদ্রলোক। খোকাও শক্ত দেয়াল তুলে দিলো এক এক করে।
রাজাকে দুর্গের অভ্যন্তরে সুরক্ষিত রেখে শত্ৰুপুরীতে ঘা দেয়ার জন্যে হাতির রাস্তা পরিষ্কার করে ফেললো। প্রথমে সংঘর্ষটাকে কেন্দ্রস্থলে সীমাবদ্ধ রাখার উদ্যোগ নিলেও অজ্ঞাত কোনো কারণে তা বাতিল করে একপাশ থেকে একটা বোড়ে ঠেলে দিলো রাজীব ভাই খোকার হাতির পথে, খোকা মনে মনে হাসলো, সে জানে বোড়েটা বিষাক্ত নীলাভাবীর চেয়েও। সে লোভ সংবরণ করলে।
এবারে একটা কালো ঘোড়া সামনে দিলো; বিধ্বংসী টোপ, খোকা লোভ সংবরণ করলে এবারও। সে লক্ষ্য করে, এই টোপ না গেলার ফলে রাজীব ভাইয়ের সমস্ত খুঁটির অবস্থান ঢিলে হয়ে পড়েছে। ইচ্ছেমতো খোকা এখন রাজাকে ন্যাংটো করে নাচাতে পারে, কান ধরে টেনে আনতে পারে। না, উচিত হবে না, খোকা মতো বদলে ফেললে। উচিত হবে না রাজীব ভাইকে হারানো। যেমন করেই হোক জিতিয়ে দিবে ভদ্রলোককে। যথেষ্ট মার খাচ্ছে বেচারা ভিতরে ভিতরে, খুব করুণ। মনে হলো খোকার। শেষ পর্যন্ত এ খেলায় সে ইচ্ছে করেই জিতিয়ে দিলো রাজীব ভাইকে।
এটা শেষ গেম। তুমি কিন্তু তেমন মনোযোগ দিয়ে খেলছো না। এ গেমটা তোমার ছিলো!
জেতার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই খোকার। চোখে ধূলো দেয়ার জন্যে কিছুক্ষণ সে আস্ফালন করলো। বিচ্ছিন্নভাবে এধারে-ওধারে ব্যর্থ আক্রমণই চালালো; জোরালো পরিকল্পনা না থাকায় তার সবকটি আক্রমণই অতি সহজে প্রতিহত করে ধীরে ধীরে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে রাজীব ভাই। অব্যাহত চাপের মুখে ক্রমাগত পিছু হটতে থাকে খোকা। ঠিক এই সময় নিঃশব্দে আলো নিভে গেল।
চট করে জানালার পাশে সরে এলো খোকা। ইলেকট্রিসিটি ফেল করেছে, গোটা শহরেই নেমেছে প্রেতায়িত অন্ধকার।
কি ব্যাপার? কান পাতার চেষ্টা করে রাজীব ভাই বললে, স্লোগান শুনতে পাচ্ছো?
একদল তরুণ হুটোপুটি করে ছুটতে ছুটতে রাজীব ভাইদের পাশের বাড়িতে ঢোকে।
কি ব্যাপার? প্রতিবেশীদের একজনকে ডেকে জিগ্যেস করলে রাজীব ভাই।
ট্রাক কি ট্রাক আর্মি নামছে রাস্তায়!
কি সর্বনাশ! খোকা ভেঙে পড়ে বললে, এখন উপায়। ঘরে ফিরবো কি করে?
ব্যস্ত হয়ো না, আগে ব্যাপারটা বুঝতে দাও—
সামনের রাস্তায় বেরিয়ে একজন তরুণের মুখ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সম্ভবমতো যাবতীয় পরিস্থিতির কথা জেনে নিতে থাকে রাজীব ভাই।
খোকা মরিয়া হয়ে বললে, যেতে আমাকে হবেই, যে করেই হোক, ঘরে রঞ্জু একা–
অসম্ভব! রাজীব ভাই খোকার একটা হাত ধরে বললে, যাবে কি করে? খুব ভুল হয়ে গিয়েছে, আমার উচিত হয় নি তোমাকে এভাবে ধরে রাখা। এখন সমস্ত রাস্তাঘাট বন্ধ।
রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড। চারদিকে খণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। ওরা বলছে সৈন্যরা সমস্ত ছাত্রাবাস আর পুলিশ লাইন ট্যাঙ্ক দিয়ে ঘিরে ফেলেছে।
কিন্তু রঞ্জু–
অচৈতন্যপ্রায় খোকা থপ করে বসে পড়ে মেঝের ওপর, চোখে অন্ধকার দেখে সে।
রাজীব ভাই খোকার পিঠে একটা হাত রেখে বললে, শক্ত হবার চেষ্টা করো। এভাবে মুষড়ে পড়ে কোনো লাভ নেই। আমি বেরিয়ে দেখছি এখনো কোনো উপায় আছে কি না।
মুখের কথা প্রায় মুখেই থেকে যায়, চতুর্দিকে মুহুর্মুহু প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ ফেটে পড়তে থাকে। প্রাণভয়ে ভীত রাস্তার মানুষজন আত্মরক্ষার জন্যে যে যেদিকে পারছে ঘুটঘুটে অন্ধকারে এলোপাতাড়ি দুদ্দাড় করে ছুটে পালাচ্ছে।
ছুটতে ছুটতে কে একজন চিৎকার করে বললে, সাবধান। ভাইসব! আপনারা আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকুন! সৈন্যরা। পাগল হয়ে গেছে! কুত্তার বাচ্চারা গরু-ছাগলের মতো মানুষ মারছে। এখন!
খুব কাছাকাছি হডাম করে একটা মর্টারের শেল এসে পড়লো। বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে গোটা বাড়ি থরথর করে কেঁপে ওঠে। বৃষ্টির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসছে। ধরাশায়ী মানুষজনের চিৎকার আর্তনাদে দ্রুত নারকীয় পরিস্থিতি নেমে আসে চতুর্দিকে। জানালার
পালা ভেদ করে উপর্যুপরি কয়েকটি বুলেট দেয়ালে এসে পড়ায় ঝুরঝুরিয়ে পলেস্তারা খসে পড়ে। এক অলিখিত নিয়মে হামাগুড়ি দিয়ে সকলেই খাটের তলায় আশ্রয় নিলো। হাত-পা পড়ে গিয়েছে খোকার। চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে। তার মাথার খুলির ফোকরে ভয়ঙ্কর এক শূন্যতায় লেলিহান অগ্নিশিখার মতো করাল মৃত্যু লকলকে জিভ বের করে অবিরাম ভয়াবহ অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে থাকে।