কয়েকদিন পরে প্রভাস তাকে ডেকে পাঠায়।
আগের বারের মতো নিজে উপস্থিত থেকে বাইরের ঘরে বসিয়ে চা খাওয়ায় না।
নিজে ডেকে পাঠালেও ঘণ্টাখানেক সদরের বারান্দায় বসিয়ে রাখে।
প্রভাসের নতুন চাকর মেঘনাদ এসে এক কাপ ঠাণ্ডা চা, কয়েক টুকরো কেক আর দুখানা নরম ময়দার গরমভাজা লুচি দিয়ে যায়।
বলে, পেট ভরে খা।
চেনা মানুষ। প্রায় জন্ম থেকে চেনা। এক গায়ের এ-পাড়া ও-পাড়া নয়, নদীর এ-পাড় ও পাড় তফাত ছিল।
নদী পেরিয়ে মেঘনাদ তাদের পাড়ায় ডাংগুলী খেলতে আসত!
বড় হয়ে সে কোথায় ছিল, কি করছিল, কিছুই তার জানা নেই।
প্রভাস টেরও পায় না যে তার চাকর ঈশ্বরকে এভাবে খাতির করছে এবং বনানী সব জেনেও চুপ করে আছে।
আরো আধঘণ্টা পরে প্রভাস তাকে ভিতরে ডেকে পাঠায়।
বসতে বলে না। দাঁড় করিয়ে রেখে গম্ভীর কিন্তু উদারভাবে বলে, যে কাজ তুমি করেছ, তোমায় ক্ষমা করা উচিত ছিল না। তবে শুনলাম, তোমার বৌয়ের নাকি খুব খারাপ অবস্থা হয়েছিল–
আজ্ঞে হ্যাঁ, ও বজ্জাতিটা না করলে নিৰ্ঘাত মরে যেত। বিশ্বাস করেন, একটা পয়সা মোর ভোগে লাগে নি, সব চিকিচ্ছেয় গিয়েছে। উল্টে ঘরদের বাধা দিয়া টাকা ধার করেছি।
তার নিজের মুখে বজ্জাতি শব্দটা প্রভাসকে একটু আশ্চর্য করে দেয়। এটা সরলতা না। ভণ্ডামি বুঝে উঠতে পারে না। একটু কড়া সুরেই জিজ্ঞাসা করে, সোজাসুজি চেয়ে নিলে না কেন?
ঈশ্বর হাসে না, যদিও একটু হাসির সঙ্গে বললে তার কথাগুলি আরো অনেক বেশি মানানসই হত।
ধর্মত একটা কথা বলবেন বাবু? সোজাসুজি এসে পায়ে ধরে কেঁদে পড়লেও দশটা টাকা দিতেন?
প্ৰভাস তখন এ প্রসঙ্গ একেবারে এড়িয়ে যাবার জন্যে বলে, যা গে, যা গে। মরিয়া হয়ে একটা দুষ্কর্ম করে ফেলেছ, কি আর করা যাবে। শুনেছি লোক তুমি খারাপ নও।
তাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বেয়াদবের মতো আবেগের সঙ্গে ঈশ্বর বলে ওঠে, বাবু, যদি সুযোগ পাই, যদি কোনোদিন সাধ্যিতে কুলায়, আপনার টাকা সায়েবের টাকা ফিরিয়ে দেব।
চোখে তার জল এসে যায়।–ধরে নেন, টাকাটা ধার নিয়েছি। ভিটে ছাড়াতে যেমন প্রাণপণ চেষ্টা করব, আপনাদেরটা শোধ দিতে তার চেয়ে কিন্তু কম করব না বাবু।
প্রভাস সশব্দে হেসে উঠে বলে, তাই বল, ধার হিসাবে টাকাটা নিয়েছিলে! থাক থাক, ওটাকা তোমার আর শোধ দিতে হবে না। ওসব কথা যাক, তোমায় কেন ডেকেছি বলি।
ঈশ্বর সজল চোখ মোছে না। ভাসের হেসে ওঠার রকম দেখে এবং শুনে বোধহয় প্রাণের জ্বালাতেই অল্পক্ষণের মধ্যে তার চোখের বাড়তি জল শুকিয়ে যায়।
প্রভাস হঠাৎ আপন কথায় আসে। বলে, তোমায় কেন ডেকেছি শোন। একটা কাজ আমি তোমায় দিতে পারি। কাজটা নিতে তোমার মানে বাঁধবে কিনা ভাবছি নাম করা মস্ত শিকারি তুমি!
ঈশ্বর প্রায় রেগে গিয়ে বলে, খেচান কেন বাবু? বন্দুকটাও কেড়ে নিয়ে গিয়েছে জানেন তো।
প্রভাস তাড়াতাড়ি নরম সুরে বলে, না না, ওভাবে কথাটা বলি নি। বন্দুকের ব্যবস্থা আমি করে দেব বন্দুক নিয়েই হবে তোমার কাজ।
কি কাজ বাবু?
বন্দুক নিয়ে আমার বাড়ি পাহারা দেবে। দরোয়ানের কাজ নয়, পাহারাদারের কাজ।
ঈশ্বর কয়েক মুহূর্ত ভাবে।
প্রভাস হাসিমুখে বলে, দরকার হলে তোমায় সাথে নিয়ে শিকারেও কিন্তু যাব ঈশ্বর। সেজন্যে অবশ্য বাড়তি টাকা পাবে, মাইনে নিয়ে খাটছ বলে ওসব ব্যাপারে আমি তোমায় ঠকাব না।
ঈশ্বর সরলভাবে জিজ্ঞাসা করে, গেটে থেকে শুধু পাহারা দেব? বন্দুক নিয়ে?
শুধু পাহারা দেবে। আর কোনো কাজ নয়। বন্দুক নিয়ে পাহারা দেবে–আমার বিপদ আপদে রুখে দাঁড়াবে।
সে তো দাঁড়াবই বাবু।
ঈশ্বর কাজে বহাল হয়।
লাইসেন্স মঞ্জুর হয়ে বন্দুক এসে পৌঁছাতে মোট দুদিন সময় লাগে!
দুনলা বন্দুকটা তার হাতে তুলে দেবার সময় প্ৰভাস তাকে বলে, একটা বড়রকম বড়মিঞাকে মারার বড় সাধ ছিল ঈশ্বর।
বড়মিঞা মানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
খবর রাখব বাবু।
একটা বড়মিঞাকে মারার ব্যবস্থা করতে পারলে আবার আড়াই শ টাকা দেব। আমার গুলিতে মরবে কিন্তু।
ঘরে ফিরে মাথা হেঁট করে বসে থাকে।
অল্প একটু তামাক ছিল। গৌরী ইশারায় পিসিকে ডেকে কানে কানে তামাকটুকু সেজে দিতে বলে।
খানিকক্ষণ উদাসীন হয়ে থেকে ঈশ্বর তামাক টানতে শুরু করলে গৌরী জিজ্ঞাসা করে, হল কি গো?
হল মোর কপাল। গেট পাহারার কাজ নিতে হল।
সব শুনে গৌরী সান্ত্বনা দিয়ে বলে, কি করবে বল, একটা কাজ ছাড়া তো চলবে নি। মোর দিনকালও তো ঘনিয়ে এল।
কমাস যেন তোর?
বাবা রে বাবা! কতবার করে শুনবে? দু-চার দিন বাদে বাদেই শুধধচ্ছে, কমাস হল রে! বলি নি সাত মাস চলছে?
সুখেও বলে, যাক গে, তেমন মন্দ নয় কাজটা। শুধু ছকা মাইনে নয়, এটা ওটা পাবে, ব্ৰত পার্বণে খাওয়া জুটবে।
ঈশ্বর মুখ বাঁকিয়ে বলে, সেদিন কি আর আছে, বাবুর আজকাল এদিক টানতে ওদিক কুলোয় না। ঠাট বজায় রাখতেই প্রাণান্ত।
দিবারাত্রির প্রহরী।
কিন্তু উর্দি পরে বন্দুক ঘাড়ে করে দিবারা কেউ তো একটানা টহল দিতে পারে না। এমন বোকা প্ৰভাস নয় যে, এরকম অসম্ভব প্রস্তাব করবে।
দিবারাত্রির প্রহরী মানে চব্বিশ ঘণ্টা এ-বাড়িতেই সে থাকবে সতর্ক হয়ে প্রস্তুত হয়ে থাকবে।
রাত্রে টহল। দিনে শুধু সতর্ক ও প্রস্তুত হয়ে থাকা।
শরীরের প্রাকৃতিক ক্ৰিয়াকৰ্মাদি চালাবে বৈকি, নেয়ে খেয়ে ঘুমোবে বৈকি, ইচ্ছা হলে অল্পক্ষণের জন্য বাড়িতে গিয়ে ঘুরেও আসতে পারবে বৈকি, কিন্তু দিনের বেলায় সর্বক্ষণ তাকে রেডি হয়ে থাকতে হবে।
দিনের বেলা কিংবা প্রথম রাত্রে অবশ্য গুণ্ডা ডাকাতের অতর্কিত আক্রমণের আশঙ্কা একরকম নেই বললেই চলে। প্রভাসের বাড়িতে অনেক লোক। লাঠিসোটা বর্শা বল্লম বন্দুক ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্রেরও অভাব নেই।
সারা বাড়িটা যখন জেগে আছে তখন হঠাৎ হানা দেবার মতো গুণ্ডা বা ডাকাতের দল রবার্টসন জগৎ খুঁজে পাবে না।
হতাশায় মরিয়া কিছু বাজে লোককে পেতে পারে, তাতে প্রভাস ডরায় না। বন্দুকও দরকার হবে না, চাকর দারোয়ান ভাগে ভাইপোরা লাঠিসোটা নিয়ে হৈহৈ করে বেরোলেই ওরা লেজ গুটিয়ে পালাবে।
তবু ঈশ্বর প্রস্তুত হয়ে থাকবে, সর্বক্ষণ বন্দুক সঙ্গে রাখবে। যেখানে যে অবস্থাতেই থাক, যেন ডাকামাত্র এসে অব্যর্থ লক্ষ্যে ঘায়েল করতে পারে হানাদারদের।
ঈশ্বর সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, দু-চারজনকে মারলে আমার ফাঁসি হবে না তো?
প্রভাস হেসে বলে, ফাসি হলে আমার হবে, তোর হবে কেন? অফিসারের হুকুম মতো পুলিশেরা যে গুলি চালায়, সেজন্যে কি পুলিশেরা দায়িক হয়?
সুযোগ পেলেই ঈশ্বর ঘরে আসে। যতক্ষণ পারে থেকে যায়।
দিনে তো আসেই, প্রভাস মদ খেয়ে এমনভাবে জ্ঞান হারিয়েছে যে, পরদিন বেলা নটা–দশটার আগে তার ঘুম ভাঙার সম্ভাবনা নেই জানতে পারলে রাত্রিটাও ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে আসে।
বিবেক আর কামড়ায় না।
এটা বিশ্বাসঘাতকতা নয়।
সে মনেপ্রাণে জানে যে, প্রভাসের আতঙ্ক অলীক। রবার্টসন আর কোনোদিনই গুণ্ডা ডাকাতের দল পাঠিয়ে তাকে ঘায়েল করার কথা কল্পনাও করবে না।
যদি তাকে জব্দ করতে কি মারতে চায়, অন্যভাবে করবে।