ক্লাস থেকে বেরুনমাত্র এণ্ডারসনের সঙ্গে দেখা। এণ্ডারসন লোকটি ফুর্তিবাজ। দেখা হলেই একটা মজাদার কথা বলবে কিংবা জিভ বের করে ভেংচে দেবে। কে বলবে সে হেটারোসাইক্লিক কম্পাউণ্ডের এক জন বিশেষজ্ঞ–এক জন ফুল প্রফেসর।
আনিস বলল, হ্যালো এ্যাণ্ডারসন।
এ্যাণ্ডারসন একটি চোখ বন্ধ করে অন্য চোখ পিটপিট করতে লাগল। আনিস হেসে ফেলতেই সে বলল, তোমার সঙ্গে কথা আছে আনিস। এস, কফি খেতেখেতে বলব।
কফি হাউসে তিলধারণের জায়গা নেই। ফাইন্যাল এগিয়ে আসছে। ছেলেমেয়েরা বইখাতা নিয়ে ভিড় জমাচ্ছে হাউসে, কেউ টেবিল ছাড়ছে না। খুপরি ঘরগুলির একটিতে জায়গা পাওয়া গেল মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে থাকার পর। আনিস বলল, কী বলবে বল।
ইদানীং কি তুমি অল্পবয়সী একটি সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছ?
আনিস অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কি জন্যে জিজ্ঞেস করছ?
কারণ আছে। আমেরিকা একটি ফ্ৰী কান্ট্রি। তুমি কোনো মেয়ের সঙ্গে ঘুরে বেড়ালে কিছুই যায় আসে না। কিন্তু এই ক্ষেত্রে একটি প্রবলেম হয়েছে।
কী প্রবলেম?
এ্যাণ্ডারসন গম্ভীর মুখে বলল, মেয়েটি একটি প্রসটিটিউট।
আনিস চুপ করে রইল। এ্যাণ্ডারসন আবার বলল, তুমি প্রসটিটিউটের সঙ্গে ঘুরলেও কিছু যায় আসে না। কিন্তু মাঝেমাঝে বড়ো রকমের ঝামেলা হয়। হঠাৎ এক দিন হয়তো মেয়েটি তোমাকে এসে বলবে, আমার পেটে তোমার বাচ্ছা! এবরশনের জন্যে হাজার দশেক ডলার দরকার।
আনিস গম্ভীর মুখে বলল, জানলে কী করে, মেয়েটি একটি প্রসটিটিউট?
আমি জানি। মেয়েটির নাম নিশ্চয়ই মালিশা। ঠিক না?
আনিসা জবাব দিল না।
জোসেফাইন পঞ্চম বারের মতো শফিকের চাকরি নট করে দিল।
তোমার মতো মিনমিনে শয়তান, ফাজিল আর অকর্মাকে ছাড়াও আমার চলবে। শুক্রবারে এসে পাওনা-গণ্ডা বুঝে নেবে।
বুড়ির রেগে যাওয়ার কারণ, শফিক এক জন কাস্টমারের নাকে গদাম করে ঘুষি মেরেছে। বেচারার দোষ হচ্ছে, সে নাকি শফিকের দেশ বাংলাদেশ শুনে কোমরে হাত দিয়ে হায়নার মতো হোসেছে। জোসেফাইন চোখ লাল করে বলেছে, হেসেছে বলেই ঘুষি মারবো? খুশি হয়ে বেচারা হোসেছে।
খুশি হয়ে হেসেছে মানে? এই হাসি খুশি হওয়ার হাসি?
কিসের হাসি সেটা? বল তুমি কিসের হাসি?
কিসের যে হাসি তা অবশ্যি শফিকও জানে না। হয়তো বিনা কারণে হোসেছে। কিন্তু শফিকের মেজাজ সকাল থেকেই খারাপ যাচ্ছিল। সকালবেলাতেই খবর পাওয়া গেছে জেমসটাউনের রকিবউদ্দিন একটি রেস্টুরেন্ট দিচ্ছে। মন খারাপ করার মতো খবর নয়। কিন্তু রেস্টুরেন্টের নাম দিয়েছে ইণ্ডিয়া হাউস। শফিককে টেলিফোন করে বলল, বাংলাদেশের নাম তো কেউ জানে না। কিন্তু ইণ্ডিয়ান ফুডের নাম জগৎজোড়া, কাজেই নাম দিলাম ইণ্ডিয়া হাউস। আপনি ভাই ফার্গোর সব বাঙালিদের খবর দেবেন। ইনশাআল্লাহু আগামী মাসেই খুলব।
শফিক মেঘস্বরে বলল, ইণ্ডিয়া হাউস নাম দিয়েছেন?
এখনো ফাইন্যাল করি নি। ইণ্ডিয়া ফুডস-ও দিতে পারি।
অর্থাৎ ইণ্ডিয়া থাকবেই?
হ্যাঁ, তা তো থাকতেই হবে।
শোনেন ভাই, আপনাকে যদি আমি ফার্গোতে দেখি, তাহলে আপনাকে আমি খুন করে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসব, বুঝেছেন?
আপনি কী বলছেন, বুঝতে পারছি না।
চুপ শালা।
শফিক টেলিফোন রেখে নিক্স প্লেসে এসেই কাস্টমারের নাকে ঘুষি বসাল। জোসেফাইন এবার সত্যি সত্যি রেগেছে। এ পর্যন্ত তিন বার বলেছে।
শফিক তোমাকে যেন আর না দেখি। যথেষ্ট হয়েছে।
শফিক নিজের ঘরে ফিরে এসে দেখে, ইমিগ্রেশন থেকে চিঠি এসেছে সে যেন চিঠি পাওয়ার সাত দিনের ভেতর ইমিগ্রেশন এ্যাণ্ড ন্যাচারলাইজেশন অফিসার টি, রবাটসনের সঙ্গে দেখা করে।
শফিককে এ নিয়ে খুব চিন্তিত মনে হল না। তার মাথায় ঘুরছে, কী করে হারামজাদা রহমানকে একটা উচিত শিক্ষা দেওয়া যায়। একটা বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট দিয়ে ফেললে কেমন হয়? খুব কি কঠিন ব্যাপার? নাম দেওয়া যেতে পারে দি মেঘনা-এ প্লেস ফর এক্সোটিক বাংলাদেশী ফুড। কিন্তু ফুড কি এক্সোটিক হবে? শব্দটা ঠিক আছে নাকি? এইসব ব্যাপারে রুনকি এক জন ছোটখাটো বিশেষজ্ঞ। শফিক টেলিফোন করল তৎক্ষণাৎ। টেলিফোন ধরলেন রাহেলা।
আমি শফিক।
বুঝতে পারছি। কী ব্যাপার?
খালা, আমরা একটা রেস্টুরেন্ট দিচ্ছি, নাম হচ্ছে আপনার–দি মেঘনা।
কী দিচ্ছ?
রেস্টুরেন্ট। বাংলাদেশী সব খাবারটাবার পাওয়া যাবে। আজ সন্ধ্যায় বাসায় এসে সব আলাপ করব। রাহেলা গম্ভীর গলায় বললেন, সন্ধ্যাবেলা আমরা থাকব না।
ও আচ্ছা, রুনর্কিকে একটু দিন। ওর সঙ্গে কথা বলি।
রুনকি তো নেই।
নেই মানে?
রাহেলা থেমে থেমে বললেন, তুমি কি কিছু জান না?
না, কী জানব?
রুনকি এখন আর আমাদের সঙ্গে থাকে না।
কোথায় থাকে তাহলে?
রাহেলা ঠাণ্ডা স্বরে বললেন, আমি জানি না কোথায় থাকে।
শফিক অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, কই, আমাকে তো কিছু বলেন নি।
তোমাকে বলতে হবে কেন? তুমি কে?
রাহেলা টেলিফোন নামিয়ে রেখে ছেলেমানুষের মতো কেঁদে উঠলেন। এই শহরে আর থাকতে পারবেন না। অনেক দূরে চলে যেতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরে যেতে হবে আড়ালে, যাতে কেউ কখনো রুনকির খোঁজে টেলিফোন করতে না পারে।