০৮. ক্রীতদাস ও কুলি-মজুর

ক্রীতদাস ও কুলি-মজুর

প্রাচীন হিন্দুযুগ থেকে আমাদের সমাজে দাসপ্রথা প্রতিষ্ঠিত ছিল। মুসলমানযুগে এই প্রথা আরও ব্যাপকভাবে আমাদের সমাজে প্রচলিত হয়। মুসলমান শাসকদের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র দাসবংশ কিছুদিন এদেশে রাজত্ব করেছিলেন। নানা উপায়ে তখন একজন মানুষকে দাসে পরিণত করা হত। যুদ্ধক্ষেত্রে যারা বন্দি হত তাদের দাসত্ব গ্রহণ করতে তো হতই, অনেক সময় ঋণের দায়ে, অথবা দারিদ্র্যের তাড়নায় অনেককে বাধ্য হয়ে দাসত্ব করতে হত। এই দাস বা গোলামরা ছিল কতকটা ভোগ্য পণ্যদ্রব্যের মতন, বাইরে বাজারে তাদের কেনা-বেচা চলত, বিবাহের যৌতুকেও রাজা-বাদশাহদের উপঢৌকনের সঙ্গে গোলামও দান করা হত। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি এদেশে এসে, এই দাসপ্রথাকে সমাজে বেশ প্রতিষ্ঠিত প্রথারূপে দেখতে পান। প্রথাটির সঙ্গে তাঁরা নিজেরাও যে অপরিচিত ছিলেন তা নয়, কারণ তাঁদের নিজেদের দেশে ইংলণ্ডেও দাস-প্রথা রীতিমত প্রচলিত ছিল। অর্থাৎ ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর দিগ্বিজয়ী বণিক ইংরেজরা আফ্রিকার কৃষ্ণকায় নিগ্রোদের গোলামরূপে দেশ-বিদেশে চালান দিয়েছেন, এবং মুনাফার জন্য গোলামি-প্রথাকে প্রত্যক্ষভাবে উৎসাহিত করেছেন। সুতরাং আমাদের দেশের প্রচলিত গোলামি-প্রথাকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা না করে, তাঁরা দাসব্যবস্থার মুনাফার স্বার্থে এবং নিজেদের ব্যক্তিগত সুখ-সাচ্ছন্দ্যের জন্য, খানিকটা তা চলিত রাখার চেষ্টা করেছিলেন বলা চলে। আঠার শতক ও উনিশ শতকের প্রথমভাগ পর্যন্ত বাংলাদেশ এই দাসব্যবসার (Slave trade) একটি বড় ঘাঁটি হয়ে উঠেছিল। কলকাতা শহরও ইংরেজদের অধীনে আসার পর, গোলাম কেনা-বেচার একটা বড় ঘাঁটিতে পরিণত হয়। নতুন শহর কলকাতার গোলামির যুগের এই অন্ধকার স্মৃতি নবযুগের নতুন মানুষের কাছে আজ নিশ্চয় ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন বলে মনে হবে।

কোম্পানির আমলে গোলামের ব্যবসার মুনাফা বেশ লোভনীয় ছিল। ইংরেজদের আগে পর্তুগিজরা গোলামের ব্যবসায়ে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। সুন্দরবন অঞ্চল থেকে কলকাতার কাছে বজবজ আখড়া পর্যন্ত অনেক জায়গায় নদীর ধারে ধারে, পতুর্গিজ ও তাঁদের দোসর মগ বোম্বোটের গোলাম কেনাবেচার বাজার স্থাপন করেছিল। এই মগ ও পর্তুগিজদের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে ইংরেজরাও দাসব্যবসাক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। মুনাফার মোহে অনেক রুচিবান শিক্ষিত ইংরেজেরও মানবতাবোধ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে যায়। ওয়ারেন হেস্টিংসের মতন শাসকও আইন করেছিলেন যে ডাকাতদের ফাঁসি দেওয়া হবে তাদের নিজেদের গ্রামে এবং তার পরিবারের লোকজন রাষ্ট্রের দাস হয়ে থাকবে, গবর্ণমেণ্ট যখন যে-ভাবে খুশি লোকের সুবিধার জন্য তাদের ব্যবহার করতে পারবেন-‘the family of the criminal shall become the slaves of the State, and shall be disposed of for the general convenience and benefit of the people according to the discretion of the Government.’ এ ছাড়া আরও নিয়ম করা হয়েছিল যে দণ্ডিত অপরাধীদের অনর্থক জেলখানায় বন্দি করে না রেখে, অন্যান্য জায়গায় যেখানে কোম্পানির ব্যবসায়ের ঘাঁটি আছে, সেখানে গোলাম হিসেবে পাঠিয়ে দেওয়া অনেক ভাল, অথবা তাদের বিক্রি করে দিলেও ক্ষতি নেই-‘Persons convicted of crime, instead of being incarcerated, should be sold for slaves or transported, as such to the Company’s establishment at Fort Marlgborough in Sumatra.’ অতএব গোলামিপ্রথার প্রতি বণিকদের নয় শুধু, ইংরেজ শাসকদেরও যে কি রকম নিষ্ঠুর মনোভাব ছিল, তা হেস্টিংসের আমলের এইসব কানুন দেখলেই বোঝা যায়। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি গোলামিপ্রথাকে কায়েম করারই চেষ্টা করেছিলেন, এবং কোট হাউসে জনপ্রতি চারটাকা চারআনা ‘ডিউটি’ দিয়ে গোলামদের রেজিস্ট্রি করাবারও ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

৩০ ডিসেম্বর, ১৭৬৩ কোম্পানির ডিরেক্টররা একখানি চিঠিতে লেখেন : ‘পশ্চিম উপকূলে আমাদের যে-সব উপনিবেশ আছে, সেখান থেকে কি ভাবে তাড়াতাড়ি গোলাম চালান দেবার ব্যবস্থা করা যায়, সে সম্বন্ধে আমরা গভীরভাবে চিন্তা করছি। Fort William ও Success নামে দু’খানি ৩৫০-টনের জাহাজ শীঘ্রই আমরা এর জন্য পাঠাব। জাহাজ দু’খানি এখান থেকে সোজা ম্যাডাগাস্কার যাবে, এবং সেখান থেকে যতগুলি সম্ভব গোলাম বোঝাই করে নিয়ে ফোর্ট মার্লবুরোর দিকে রওয়ানা হবে। সেখানে ১৫ পাউণ্ড (প্রায় ২০০ টাকা) করে এক একটি গোলাম বিক্রি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এতগুলি গোলাম যখন ওখানে গিয়ে পৌঁছাবে তখন তাদের খাওয়া-পরারও কিছু ব্যবস্থা করা দরকার। সে সম্বন্ধে আপনারা অবহিত হবেন, এবং সময়মত সেখানে জিনিসপত্র পাঠাবেন।’

বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে তাঁরা পরবর্তী একখানি চিঠিতে ব্যাখ্যা করেন। তাঁরা লেখেন : ‘জাহাজ দু’খানিতে ২৬টি করে কামান থাকবে, এবং ক্যাপ্টেন ও অফিসারদের নিয়ে ৭০ জন করে ইয়োরোপীয় নাবিক জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব নেবেন। তাঁদের খাওয়াদাওয়া ও অন্যান্য যাবতীয় খরচ বহন করবেন জাহাজের মালিকরা। ম্যাডাগাস্কারে গোলাম কিনে জাহাজ বোঝাই করার সম্পূর্ণ ভার থাকবে তাঁদের উপর। গোলামের মধ্যে তিনভাগের দু’ভাগ হবে পুরুষ বয়স ১৫ থেকে ৪০ বছর, এবং একভাগ হবে মেয়ে, বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছর। তার থেকে কম বয়সের, অর্থাৎ, ১০ থেকে ১৫ বছরের হলে, সংখ্যাগণনায় দু’জনকে একজন হিসেবে ধরা হয়। আমাদের ঘাঁটিতে গোলামদের পৌঁছে দেবার পর আমরা প্রত্যেক গোলামের জন্য জাহাজের মালিকদের ১৫ পাউণ্ড করে দেব (Court’s Letter to Bengal, February 22, 1764)।

গোলামের ব্যবসা ক্রমে কলকাতা শহরেও বিস্তারলাভ করে, এবং আফ্রিকার গোলাম কলকাতার বন্দরে ও হাট-বাজারে দলে দলে আমদানি হতে পারে। ক্যালকাটা গেজেট ও অন্যান্য সমসাময়িক পত্রিকার বিজ্ঞাপন থেকে কলকাতার এই গোলামদের কথা অনেকটা জানা যায়। বিজ্ঞাপনগুলি আঠার শতকের শেষপর্বের পত্রিকা থেকে গৃহীত। নমুনা এই :

Wanted-Two Coffrees who can play very well on the French Horn and are otherwise handy and useful about a house, relative to the business of a consumer, or that of a cook;… they must not be fond of liquor. Any person or persons having such to dispose of, will be treated with by applying to the printer.

‘দুজন কাফ্রি চাই, যারা ফরাসি শিঙ্গা খুব ভালভাবে বাজাতে জানে, এবং ঘরের কাজকর্মেও বেশ দক্ষ। তাদের মদপ্যানের অভ্যাস থাকলে চলবে না। যদি কারও সন্ধানে এরকম দু’টি কাফ্রি ছেলে থাকে বিক্রির জন্য, তাহলে তিনি এ বিজ্ঞাপনের প্রিণ্টারকে জানাতে পারেন।’

Wanted-a Coffree slave boy; any person desirous of disposing of such a boy and can warrant him faithful and honest servant will please to apply to the printer.’ To be sold-Two French Horn men, who dress hair and shave, and wait at table.

To be sold-A fine Coffree boy that understands the business of a butler, Kitmutgar, and cooking. Price four hundered Sicca Rupees, Any gentleman wanting such a servant, may seen him, and be informed of further particulars by applying to the printer.

এই ধরনের প্রচুর বিজ্ঞাপন তখনকার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হত। এদেশের সাহেব-নবাবরা তাঁদের ব্যক্তিগত কাজকর্ম ও সেবাশুশ্রূষার জন্য গোলামদের গৃহভৃত্যরূপে নিযুক্ত করতেন। এক-একজন সাহেবের বাড়ি ৫০-৬০ জন থেকে ১০০-১৫০ জন পর্যন্ত ভৃত্য নিযুক্ত থাকত। কেবল এদেশি লোকদের ভৃত্যের কাছে নিযুক্ত করে তাঁরা কূল পেতেন না। তাছাড়া গোলামদের যেভাবে খাটানো যেত, স্বাধীন ভৃত্যদের স্বভাবতঃই সেভাবে খাটানো সম্ভব হত না। গোলামদের উপর তাঁরা অমানুষিক অতাচার করতে পারতেন, যা ভৃত্যদের উপর কিছুতেই করা চলত না। সেইজন্য তাঁরা কলকাতার বাজার থেকে গোলাম কিনে ভৃত্যের কাজে নিযুক্ত করতেন। কাফ্রি গোলামরা শুধু সাধারণ ভৃত্যের কাজই যে করত তা নয়। তাদের ট্রেনিং দিয়ে সাহেবরা ভাল বাবুর্চি ও খিদমৎগার তৈরি করতেন। শুধু তাই নয়, তারা ‘হেয়ার ড্রেসিং’ নানারকম বাদ্যবাজনা ইত্যাদিও শিখত। প্রভুর সেবার জন্য আত্মোৎসর্গ করাই ছিল গোলামের জীবনের একমাত্র কর্ম। কর্মের বিনিময়ে তার প্রাপ্য কিছুই ছিল না, কেবল মনিবের একটু দয়া ও করুণা মধ্যে মধ্যে পেলেই সে কৃতার্থবোধ করত। ছুটি, অবসর, স্বাধীনতা-এসবের উপর তার কোনো মানবিক অধিকার স্বীকৃত হত না। জীবনে কেবল একদিনই তার ছুটি ও অবসর মিলত, মৃত্যুর দিন, এবং সেই মৃত্যুও যে কোনোদিন মনিবের নির্মম প্রহারে ও বেত্রাঘাতে এসে উপস্থিত হত।

গোলামের জীবনে ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান বলে কিছু ছিল না। প্রভুর গৃহে প্রত্যেকটি দিন তার বিভীষিকার মধ্যে কাটত। মধ্যে মধ্যে প্রভুর অত্যাচার যখন সীমা লঙ্ঘন করে যেত, তখন নিরুপায় হয়ে আশ্রয় ত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় থাকত না। প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ করার অধিকার সমাজে সাধারণ মানুষেরই তখন ভাল করে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অতএব গোলামরা সেই অধিকারের কথা কল্পনাই করতে পারত না। সমস্ত অত্যাচার, যত অমানুষিকই হোক, মুখ বুজে তাদের সহ্য করতে হত। যখন তা সহ্য করা একেবারেই সম্ভব হত না, কেবল তখনই তারা আশ্রয় ত্যাগ করে চলে যেত। কিন্তু চলে গিয়েও তারা রেহাই পেত না, কারণ তারা যে গোলাম! সমাজের কোথাও তাদের আশ্রয় ছিল না মুক্ত মানুষ হিসেবে। পলাতক গোলামদের মনিবরা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করতেন। এই বিজ্ঞাপনের কয়েকটি নমুনা দিচ্ছি :

Strayed-From the house of Mr. Robert Duncan in the China Bazar, on Thursday last, a Coffree boy, about 22 years old, named Inday, whoever brings back the same shall receive the reward on gold mohur.

‘পলাতক-চীনাবাজার মিঃ রবার্ট ডানকানের বাড়ি থেকে ইন্দে নামে ২২ বছরের একটি কাফ্রি ছেলে গত বৃহস্পতিবার পলাতক হয়েছে। কেউ যদি ছেলেটিকে ফিরিয়ে দিতে পারেন তাহলে তাকে একটি সোনার মোহর পুরস্কার দেওয়া হবে।’

Slave boys run away. -On the fifteenth of October last two slave boys,… named Sam and Tom, about eleven years of age, and exactly of a size, ran away with a great quantity of plate etc. This is to request, if they offer their service to any gentlemen, they will be so kind as to examine their arms, keep them confined and inform the owner. A reward of one hundred sicca rupees will be given to any black man, to apprehend and deliver them up.

‘পলাতক দু’টি ক্রীতদাস : গত ১৫ অক্টোবর শ্যাম ও টম নামে দু’টি ১১ বছর বয়সের দাস বালক, প্রায় একরকম দেখতে, বাড়ি থেকে অনেক প্লেট ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে পালিয়ে গেছে। যদি কোনো ভদ্রলোকের কাছে তারা চাকরি করতে যায়, তাহলে তিনি তাদের আটকে রেখে যেন মালিককে খবর দেন। তাদের খোঁজখবর দিলে অথবা ধরে দিতে পারলে, মালিক ১০০০ টাকা পুরস্কার দেবেন।

On Monday last a slave boy about fourteen years old. had on when he eloped the dress of a Kitmutgar… it is expected that he has stolen many things. Whoever will give information, so that he may be apprehended, to Mr. Purkis, at NO 51, Cossitollah, shall be handsomely rewarded, if required. Whoever harbours the said slave boy after this notice will be prosecuted according to law.

‘গত সোমবার ১৪ বছরের একটি দাস বালক, খিদমতগারের পোশাক পরে, অনেক জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে বাড়ি পালিয়ে গেছে। ৫১ নং কসাইতলায়, মিঃ পাকিসকে এই ছেলেটি সম্বন্ধে যিনি খবর দেবেন, তাকে তিনি ভালভাবে পুরস্কৃত করবেন।’

Missing, since the night of the 2nd instant, a slave boy, named Din Darah, of about fifteen… is marked on the back and arms with the scars of a number of small burns; had an iron ring on one leg, which, though he may have taken off, the chaffing must be discernible; his gait is slow; if confused, has an impediment in his speech. He is a stranger in this part of the country, and, from his having no money, must soon, offer for service. Any person who will deliver him at No. 1. Larkin’s Lane, shall receive a reward of fifty Sicca Rupees. Should he offer for employ, any gentleman who will send him as above directed will confer a particular obligation on his Master, who will, if he returns voluntarily, forgive his offence.

Any information that can be given respecting him will be thankfully received.

‘গত ২ (জুলাই ১৭৯২) তারিখ থেকে দীন-দারা নামে ১৫ বছরের একটি দাস ছেলে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে। তার পিঠে ও হাতে অনেকগুলি আগুনে পোড়ার দাগ আছে, পায়ে আছে একটি লোহার বেড়ি। যদি বেড়িটা সে খুলেও ফেলে দেয়, তাহলেও তার পায়ে একটা গোলকার কালো দাগ থাকবে। চলাফেরায় খুব ঢিলে, কিন্তু তাতেও যদি তাকে না চেনা যায়, তাহলে তার তোৎলা কথা থেকে নিশ্চয়ই তাকে চেনা যাবে। এ অঞ্চলে সে একেবারে অপরিচিত। তার কাছে টাকাকড়ি কিছু নেই, সুতরাং শ্রীঘ্রই তাকে চাকরি খুঁজতে হবে। এই সময় যদি কোনো ব্যক্তি তাকে ধরতে পারেন, এবং ১নং লাকিন্স লেনে মালিকের কাছে তাকে পৌঁছে দেন, তাহলে তিনি ৫০ টাকা পুরস্কার পাবেন।’

সংবাদপত্রের এই বিজ্ঞাপনগুলি অধিকাংশই ১৭৮০ থেকে ১৮০০ সালের ‘ক্যালকাটা গেজেট’ থেকে সংকলিত। বিজ্ঞাপন থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে কলকাতার মতন শহরেও গোলামরা মনিবদের বাড়ি থেকে পালিয়ে রেহাই পেত না। সত্যিকার গোলামের অবস্থা যে কি ছিল, তা শেষের বিজ্ঞাপনটির মধ্যে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। মাস্টারদের অত্যাচারের চিহ্ন তাদের সর্বাঙ্গে খোদাই করা থাকত। কাটাকুটির চিহ্ন ছাড়া আগুনে ছ্যাঁকা দেওয়ার চিহ্নও গোলামদের হাতে পিঠে প্রচুর পরিমাণে থাকত। সভ্যতার এই কলঙ্কের চিহ্ন সারাজীবন বহন করতে হত গোলামদের। পায়ে থাকত লোহার বেড়ি, এবং তা খুলে ফেলে দিয়েও তার দাগ নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব হত না।

গোলামদের এই সব বিবরণ থেকে হয়ত অনেকের মনে হতে পারে যে কেবল আফ্রিকা, মালয় প্রভৃতি অঞ্চল থেকে আমাদের দেশে ক্রীতদাস আমদানি করা হত, এদেশের লোককে গোলাম করা হত না। কিন্তু এ ধারণা ভুল। আগে বলেছি, আমাদের দেশে দাসত্বপ্রথা দীর্ঘকাল থেকে প্রচলিত ছিল, এবং কোনোকালেই সমাজ থেকে তা একেবারে লুপ্ত হয়নি। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির আমলে দেখা যায় অবস্থাবৈগুণ্যে এই প্রথা আরও একটু বেশি করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। দেশের মধ্যে যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল, তার ফলে মানুষ বিক্রি করা প্রায় স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দারিদ্র্যের চাপে মানুষ নিজের ছেলেমেয়ে, এমন কি স্ত্রী পর্যন্ত, ধনিকদের কাছে বিক্রি করে দিত গোলামির জন্য। তখনকার সংবাদপত্রে আমাদের নিজেদের দেশের এই মানুষ বিক্রির খবর পাওয়া যায়। কয়েকটি সংবাদ প্রাচীন ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা থেকে উদ্বৃত করে দিচ্ছি।

১৮ জুন, ১৮২৫। কন্যা বিক্রয় কএক দিবস হইল মোং বর্দ্ধমান হইতে এক বৈষ্ণব আপন দ্বাদশ বর্ষীয়া সুন্দরী কন্যা সমভিব্যাহারে মোং কলিকাতায় বাবু রামদুলাল সরকারের শ্রাদ্ধের দান উপলক্ষে আসিতেছিল তাহাতে মোং ফরাসডাঙ্গায় আসিয়া অবগত হইল যে শ্রাদ্ধ হইয়া দান সকলকে দিয়া বিদায় করিয়াছেন এজন্য ঐ বৈষ্ণবী ধন লোভে শ্রীযুত রাজা কিষণচাঁদ রায় বাহাদুরের নিকট যাইয়া ঐ কন্যাকে ১৫০ দেড় শত টাকার আপন স্বেচ্ছাপূর্বক বিক্রয় করিয়া দেশে প্রস্থান করিয়াছে ইতি।

সংবাদটি অনেকদিন থেকে গুরুত্বপূর্ণ। শ্রাদ্ধের দান উপলক্ষেও দেশের দরিদ্র লোকেরা নিজেদের ছেলেমেয়েদের দান করতে কুণ্ঠিত হত না। রামদুলাল (দে) সরকার কলকাতার সুবিখ্যাত সাতুবাবু লাটুবাবুর পিতা এবং আঠারো শতকের শেষার্ধের কলকাতার বিখ্যাত বাঙালী ধনকুবের ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর শ্রাদ্ধ উপলক্ষে বর্ধমানের এক দরিদ্র বৈষ্ণবী তার সুন্দরী কন্যাকে দান করতে আসছিল। কারণ রামদুলাল কেবল ধনপতি ছিলেন না, বৈষ্ণবকুল চূড়ামণিও ছিলেন। সুতরাং তাঁর শ্রাদ্ধে দান হিসেবে কিছু উৎসর্গ করতে পারলে সাধারণ বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীদের পক্ষে কৃতার্থ বোধ করা স্বাভাবিক। পূণ্যলোভাতুরা বৈষ্ণবী তাই তার সামান্য দান হিসেবে নিয়ে আসছিল কন্যাটিকে। বর্ধমান থেকে কলকাতা পর্যন্ত দীর্ঘপথ সে হেঁটেই আসছিল মনে হয়। তাই যথাসময়ে কলকাতায় পৌঁছনো তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফরাসডাঙ্গায় (চন্দননগর) পৌঁছে সে শুনল যে রামদুলালের শ্রাদ্ধে দানধ্যানের পর্ব শেষ হয়ে গেছে। তখন বৈষ্ণবীর মনে পুণ্যলোভের বদলে অর্থলোভ দেখা দিল, এবং সে নিঃসকোচে নগদ ১৫০ টাকায় কন্যাটিকে রাজা কিষণচাঁদের কাছে বিক্রি করে দিয়ে বাড়ি চলে গেল। অন্যান্য সামাজিক কুসংস্কার ও কুপ্রথার সঙ্গে গোলামিপ্রথা মিশ্রিত হলে যে কি কদর্য রূপ ধারণ করতে পারে, বর্ধমানের বৈষ্ণবীর এই কন্যাবিক্রি তার একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।

১১ অক্টোবর ১৮২৮। ভার্য্যা বিক্রয়।-শ্রীআনন্দচন্দ্র নন্দীর প্রমুখাৎ আমরা অবগত হইলাম যে জিলা বর্দ্ধমানের মধ্যে এক ব্যক্তি কলু অনেক দিবসাবধি বাস করিত সংপ্রতি বর্ত্তমান বৎসরের তণ্ডুলের মূল্য বৃদ্ধি দেখিয়া মনে ২ মন্ত্রণা করিয়া আপন স্ত্রীকে বিক্রয় করিবার কারণ তত্রস্থ কোন স্থানে লইয়া গেল তাহাতে তত্রস্থ এক যুবা ব্যক্তি আসিয়া কএক টাকাতে তাহাকে ক্রয় করিল এ স্ত্রী দর্শনে বড় কুরূপা নহে এবং তাহার বয়ঃক্রম অনুমান বিংশতি বৎসর হইবেক যাহা হউক সেই কলুপো কএক টাকা পাইয়া ভার্যা দিয়া অনায়াসে গৃহ প্রস্থান করিল।

১১ জানুয়ারী ১৮৪০। আমরা শুনিলাম যে কলকাতার এক জন জমীদার বারাণসী হইতে স্বগৃহে আগমনকালীন ভাগলপুরের বাজারে ৪০ টাকা মূল্যে এক গোলাম ক্রয় করিয়া লইয়া আসিয়াছেন। এবং তিনি কহিলেন সে তদ্দিবসে সেই বাজারে দাসদাসী প্রায় ২০/২৫ জন বিক্রয় হইয়াছিল।

৮ই আগস্ট ১৮৩৫। গোলাম ক্রয় বিক্রয়ের দণ্ড।-কলিকাতার মধ্যে প্রায় অনেক লোক আছেন গোলাম ক্রয় বিক্রয় করিয়া থাকেন অতএব তাঁহারা গত ১৩ জুলাই তারিখে বোম্বাইয়ে ঐ ব্যাপার নিমিত্ত যে মোকদ্দমা হয় তাহার…বিবরণপাঠ করিয়া নিতান্ত সাবধান থাকিবেন যে ঐ অপরাধেতে কি পর্য্যন্ত দণ্ড না হয়। ইহার পূর্ব্বে গোলাম ক্রয় বিক্রয় করণেতে প্রায় অপরাধ ছিল না যে ছিল সে কিঞ্চিন্মাত্র। কিন্তু সংপ্রতি ঐ ব্যবসায় বিশেষতঃ ইঙ্গলণ্ড দেশে ও ভারতবর্ষের গবর্ণমেন্টের দ্বারা অতিশক্তা-শক্তিরূপে নিষেধিত হইয়াছে। গোলামের স্থান উত্তরামেরিকা। এইক্ষণে যে কোন দেশে ইঙ্গলণ্ডীয়েরদের পতাকা উড্ডীয়মানা সেই দেশে কদাচ গোলাম থাকিতে পারে না।

দেশীয় সংবাদপত্রের এই বিবরণগুলি থেকে সহজেই বোঝা যায়, আমাদের দেশে অন্তত অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে, সমাজে গোলামিপ্রথার অত্যধিক প্রচলন হয়েছিল, এবং দারিদ্র্যই ছিল তার অন্যতম কারণ। আমাদের প্রাচীন গ্রাম্যসমাজের যে অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা ছিল, কোম্পানির আমলের বাণিজ্য ও শাসননীতির ফলে তা দ্রুত ভাঙতে আরম্ভ করে। গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেণির ও গোষ্ঠীর লোক তাদের বংশগত বৃত্তি থেকে উচ্ছিন্ন হয়ে নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটাতে থাকে। গোলামিপ্রথা আবার এই সময় মাথা তুলে দাঁড়ায়, এবং তার ব্যাপক প্রসারও হতে থাকে। বিদেশি ইউরোপীয়রা গোলাম ব্যবসায়ের মুনাফার লোভে এই প্রথা প্রসারে সাহায্য করেন। কেবল আফ্রিকা, মালয় প্রভৃতি দেশের গোলাম কেনাবেচা করে তাঁরা যে মুনাফা করেছেন তা নয়, বাংলাদেশ থেকেও অনেক গোলাম কিনে তাঁরা বিদেশে চালান দিয়েছেন।

১৭৮৫ সালে সার উইলিয়াম জোন্স কলকাতার সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলার রায় প্রসঙ্গে দাসত্বপ্রথা সম্বন্ধে যে মন্তব্য করেন তা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন :

I am assured from evidence which, though not all judicially taken, has the strongest hold on my belief, that the condition of slaves within our jurisdiction is, beyond imagination, deplorable; and that cruelties are daily practised on them, chiefly on those of the tenderest age and the weaker sex, which if it would not give me pain to repeat and you to hear, yet for the honour of human nature I should forbear to particularize. If I except the English from this censure, it is not through partial affection to my own countrymen, but because my information relates chiefly to people of other nations, who likewise call themselves Christians. Hardly a men or a women exists in a corner of this populous town, who hath not at least one slave child either purchased at a trifling price, or saved perhaps from a death that might have been fortunate, for a life that seldom fails of being miserable. Many of you. I presume, have seen large boats filled with such children, coming dawn the driver far open sale at Calcutta. Nor can you be ignorant that most of them were stolen from their Parents, or bought, perhaps, for a measure of rice in a time scarcity.

উইলিয়ম জোন্সের এই উক্তির গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি বলে এখানে তা অনেকটা উদ্ধৃত করা হল। তাঁর উক্তির মর্ম এই : ‘আমাদের এখানে গোলামদের দুরবস্থার আমি কিছু কিছু জানি, এবং তা এত মর্মান্তিক যে বলতে সংকোচ হয়। গোলামদের উপর প্রতিদিন এমন নিষ্ঠুর অত্যাচার করা হয়, বিশেষ করে বালক ও স্ত্রীলোকদের উপর, যে মর্যাদার দিক থেকে আমি তার কোনো দৃষ্টান্ত উল্লেখ করতে রাজি নই। আমি এখানে ইংরেজদের কথা উল্লেখ করব না, কারণ স্বজাতির প্রতি আমার যে দুর্বলতা আছে তা নয়; আমি যতদূর জানতে পেরেছি, অন্যান্যরা যাঁরা নিজেদের খ্রীষ্টান বলে পরিচয় দেন তাঁরাই গোলামদের উপর অকথ্য অত্যাচার করেন বেশি। এই বিরাট জনবহুল কলকাতা শহরে এমন একজনও পুরুষ বা স্ত্রীলোক নেই, যাঁরা অন্তত একটি গোলাম ছেলে বা মেয়ে নেই। তিনি খুব সামান্য মূল্যেই গোলামটি কিনেছেন, এবং খোঁজ করলে দেখা যাবে, হয়ত অন্নাভাবের কষ্ট থেকে মুক্তি পাবার জন্য এই যাবজ্জীবন দুঃখের বোঝা গোলামটি অনিচ্ছায় বরণ করে নিয়েছে। আপনারা অনেকেই জানেন নিশ্চয়ই যে, নদীর উপর দিয়ে নৌকা-বোঝাই গোলাম এখানে নিয়ে আসা হয় কলকাতায় বাজারে বিক্রি করার জন্য। আপনারা এও জানেন যে এইসব গোলাম ছেলেমেয়েদের অধিকাংশকেই তাদের বাপমা’র কাছ থেকে চুরি করে আনা হয়, অথবা দুর্ভিক্ষের সময় তাদের গোলামির জন্য সামান্য মূল্যে বেচে দেওয়া হয়।’

আঠার শতকের শেষদিকে কলকাতা শহরে যে বাংলাদেশের মধ্যে গোলাম কেনাবেচার সবচেয়ে বড় বাজারে পরিণত হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাইরে সাম্রাজ্য ও উপনিবেশ স্থাপন করে ইংরেজরাও গোলামির ব্যবসায়ে রীতিমত প্রলুব্ধ হয়েছিলেন, এবং তাঁদের মৌলিক মানবতাবোধটুকু পর্যন্ত মুনাফার বেদিমূলে উৎসর্গ করতে কুণ্ঠিত হয়নি। আঠার শতকের শেষদিক থেকেই ইংলণ্ডে এই গোলাম-ব্যবসায়ের বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের গুঞ্জন উঠতে থাকে। কোম্পানির ডিরেক্টররাও সে সম্বন্ধে অবহিত হন, এবং বাইরের বিভিন্ন উপনিবেশে তা বন্ধ করার চেষ্টা করতে থাকেন। বাংলাদেশ থেকে বাইরে গোলাম চালান দেওয়া বন্ধ করার জন্য তাঁরা ১৭৯৩ সালে এই মর্মে একটি ঘোষণা জারি করেন :

proclamation

Whereas the Hon’ble Court of Directors for the affairs of the East India Company, in consequence of information received by them from the Governor and Council at st. Helena, stating that sundry persons, natives of Bengal and other parts of India, had been unlawfully and unjustly sold as slaves at that Island, did direct and advertisement to be published in this Settlement for the discovery of such persons as had been guilty of the unlawful and inhuman conduct aforesaid, which advertisement was published accordingly on or about the 9th day of September in the year 1793, by and under the orders of Governor General in Council …in future all persons, in whose service natives shall embark form Bengal for England, will be requiered to give good and sufficient security against such natives being sold, or given away as slaves.

এই ঘোষণা থেকে বোঝা যায়, ইংরেজরা এদেশের কাজকর্ম সেরে স্বদেশে ফিরে যাবার সময় দু-চারজন ‘ব্ল্যাক নেটিব’ সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। হোয়াইটদের বিচিত্র দেশ দেখাবার লোভ দেখিয়ে হয়ত ব্ল্যাকদের তাঁরা নিয়ে যেতেন, কিন্তু তাঁদের উদ্দেশ্য থাকত গোলাম হিসেবে ব্যবসায়ীদের কাছে তাদের বিক্রি করে দেওয়া। সেইজন্যই কোম্পানির ডিরেক্টররা তাঁদের ঘোষণায় জানিয়েছিলেন যে বাংলাদেশের কোনো লোককে কোনো ইংরেজ যদি সঙ্গে করে ইংলণ্ডে নিয়ে আসেন, তাহলে তিনি যে তাকে গোলাম হিসেবে বিক্রি করবেন না, এই মর্মে একটি মুচলেকা দিতে হবে।

কলকাতার কাছে চন্দননগরে ফরাসীরাও যে গোলামের ব্যবসায়ে রীতিমত মেতে উঠেছিলেন, তা ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকার একটি বিবরণ থেকে বোঝা যায়। ১৭ সেপ্টেম্বর ১৭৮৯, ‘ক্যালকাটা গেজেট’ লেখেন :

We understand Monsieur Montigny, Governor of Chanderanagore, has lately issued proclamation prohibiting all persons within the jurisdiction of the French Government from purchasing or transporting any of the natives of these Provinces as slaves, and in order more effectually to prevent this infamous practice, a reward of forty Rupees is offered to any person who shall give information of the offender, besides the sum of ten Rupees to be given to each slave who shall be released in consequence. Both sums to be paid by the offender.

The Master Attendant of Chandernagore is also directed to see that no native be embarked without an order signed by the Governor, and all Captains of vessels trading to the port of Chandernagore are strictly prohibited from receiving any natives on board.

উনিশ শতকের গোড়া থেকেই ইংলণ্ডে উইলবারফোর্স (Wilberforce) ও অন্যান্য সমাজ-সংস্কারকদের প্রবল আন্দোলনের ফলে গোলামিপ্রথার বিরুদ্ধে মানুষের বিবেকবুদ্ধি ক্রমে জাগ্রত হতে থাকে। ১৮০৭ সালে গোলাম-ব্যবসা (Slave Trade) বেআইনি ঘোষিত হয়। কিন্তু তার পরেও, সারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে গোলামিপ্রথা একেবারে লুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, সংস্কারকর্মীরা আন্দোলন থেকে বিরত হননি। ১৮৩৩ সালে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেক দেশে, গোলামিপ্রথা বেআইনি ঘোষিত হয়। ওই বছরই উইলবারফোর্স মারা যান। ট্রেভেলিয়ান লিখেছেন : ‘Thus was Wilberforce rewarded for his complete honesty of purpose.’

আরও প্রায় দশ বছর পরে ১৮৪৩ সালে গোলামিপ্রথা ভারতবর্ষে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। ‘ইয়ং বেঙ্গল’ দলের মুখপত্র ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’ পত্রিকা এই আইন পাশ হবার পর উৎসাহিত হয়ে লেখেন :

আমরা অতিশয় আহ্লাদপূর্ব্বক প্রকাশ করেতেছি যে বর্ত্তমান বৎসরের পঞ্চম আইন দ্বারা ভারতবর্ষের দাসক্রয়ের রীতি রহিত হইল এবং এই ব্যবস্থা এতদ্দেশস্থ বহুতর দাসত্বকরিদিগের পক্ষে শুভদায়ক প্রযুক্ত আমরা অতি সম্মানপূর্ব্বক গ্রাহ্য করিলাম। ওএষ্ট ইণ্ডিয়ার গোলামদিগের উপর যেরূপ ভয়ানক অত্যাচার হয় এতদ্দেশীয় দাসগণের উপর যদিও তাদৃশ হয় না তথাচ ইহারা দাসত্ব জন্য মন্দ হইতে মুক্ত নহে, ফলতঃ আমরা দাসদিগের প্রতি নিষ্ঠুরতা ব্যবহার না করিলেও দাসত্বের স্বাভাবিক গুণে তাহাদের মনুষ্যত্ব নষ্ট হইয়া তাহারা সামান্য দ্রব্য পদার্থবৎ গণ্য হয় এবং মনুষ্য জাতি হইলে যে সকল বিষয়ে অধিকার হয় তাহা হইতেও চ্যুত হয়। হিন্দু এবং মুসলমান রাজার দ্বারা দাসত্বের রীতি স্থাপিত হইয়াছিল এবং তাহা ভয়ানক প্রকৃতিতেই হউক অথবা কোমল প্রকৃতিতে হউক এতৎকাল পর্য্যন্ত ছিল কিন্তু এক্ষণে ইংলণ্ডীয় শাসনকর্ত্তাদিকের দ্বারা লুপ্ত হওয়াতে ভারতবর্ষের ইতিহাস মধ্যে তাঁহাদিগের মহতী কীর্ত্তি থাকিলেও বর্ত্তমান শাসনকর্তাদেরও ইহা দ্বারা বিশেষ সুখ্যতি হইল। যে সকল মহাশয়েরা এতদ্বিষয়ে ইংলণ্ডীয় লোকদিকের মনোযোগ আকর্ষণ করিয়াছেন এবং পার্লিয়ামেণ্ট মহাসভায় পুনঃ ২ আন্দোলন করিয়াছেন এক্ষণে তাঁহাদিগের নিকট কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করিলে আমাদিগের কর্ত্তব্য কর্ম্মের হানি হয়। মেষ্টর ডবলউ এডেম, ব্রিটিস এণ্ড ফারেন এণ্টিশ্লেবরির রিপোর্টার ও অন্যান্য সংবাদপত্র সম্পাদকেরা এতদ্বিষয়ে অনেক যত্ন করিয়াছেন। যে সকল ব্যক্তিরা এই অহিতজনক দাসত্ব ব্যবহারের মন্দতা ও অনিষ্টতা দর্শাইতে চেষ্টা করিয়াছেন তাহাদিগের নিরাকাঙ্ক্ষি পরিশ্রম আমরা যাবৎ যথার্থ বিচার ও দয়ার উপকার জ্ঞান থাকিবেক তাবৎ স্মরণ করিব।

কিন্তু যদ্যবধি দাসত্ব মোচনের এই আইন গোলামেরদের উত্তমরূপে বোধগম্য না হইবেক তদবধি তাহারা এই ব্যবস্থার উপকার ভোগ করিতে পারিবেক না; এক্ষণে সকল দাসরক্ষকেরা গোলামদিগকে ভুলাইয়া রাখিতে চেষ্টা করিবেন এবং তাহাদিগের দ্বারা পূর্ব্ববৎ অন্যায় কর্ম করিয়া লইয়া তাহার ফলভোগ করিবেন, অতএব আমাদের প্রার্থনা এই যে উক্ত আইন যাহাতে ফলদায়ক হয় সাবধানপূর্ব্বক তাহার উপায় সৃষ্ট হউক যেন গোলামদিগের অনভিজ্ঞতার বা তাহাদের স্বাধিদিগের অন্যায় দ্বারা ইহার কর্ম্ম নষ্ট হয় না, আর সকল প্রদেশে ইহা উত্তমরূপে প্রকাশিত হউক এবং যাহারা উল্লঙ্ঘন করিবেন তাহাদিগের প্রতি যথোচিত দণ্ডাজ্ঞা হউক (বেঙ্গল স্পেক্টেটর, ১ মে ১৮৪৩)।

স্পেক্টেটর যা আশঙ্কা করেছিলেন তা অনেকটা ঠিক। দাসত্ববিরোধী আইন পাশ হবার পরেও অনেকদিন ধরে শাসকদের আইনচক্ষুর অন্তরালে দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। লুকিয়েচুরিয়ে দেশের লোক গোলাম রাখতেন; এবং কেনাবেচাও করতেন। অনেক জায়গায় জমিদারি প্রথার সঙ্গে গোলামিপ্রথা প্রচ্ছন্নভাবে জড়িত ছিল বলে তা লোপ পেতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। তবে কলকাতা শহরে উনিশ শতকের মাঝামাঝির পর থেকে গোলাম রাখার ও বেচাকেনার পর্ব নিশ্চিন্তভাবে শেষ হয়ে গিয়েছিল মনে হয়।

কুলি-মজুর

আমরা যে-সময়ের কথা বলছি তখন ঠিক মজুরশ্রেণির বিকাশ হয়নি। কারণ কলকারখানা তখনও তেমন গড়ে ওঠেনি। তবুও বিদেশ থেকে দু-একটি করে কল আসতেই আরম্ভ করেছিল, এবং কল হিসেবে নিতান্তই আধিকারের কল হলেও, হাতের বদলে কলের সাহায্যে আমাদের দেশে সেই সময়েই সর্বপ্রথম পণ্য দ্রব্যের উৎপাদন আরম্ভ হয়েছিল। অর্থাৎ ‘ম্যানুফ্যাকচারের’ যুগের অভ্যুদয় হচ্ছিল তখন। হাতের জিনিসের বদলে কলের জিনিসের যুগ আসছিল। কলের এই প্রথম ঐতিহাসিক আবির্ভাবের কথা তখনকার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছিল এইভাবে :

১১ মার্চ ১৮২৬। তণ্ডুল সম্পাদক নূতন যন্ত্র। অর্থাৎ ধানভানা কল।-১৫ ফেব্রুয়ারি বুধবার এগ্রিকলটিউর সোসৈয়িটি অর্থাৎ কৃষি বিদ্যাবিষয়ক সমাজের এক সভা হইয়াছিল। ঐ সভায় ডেবিড কর্তৃক প্রেরিত কাষ্ঠ নির্ম্মিত ব্রহ্মদেশে ব্যবহৃত তণ্ডুলনিষ্পাদক একপ্রকার যন্ত্র অর্থাৎ যাঁতাকল সকলে দর্শন করিলেন ঐ যন্ত্রে প্রতিদিন কেবল দুই জন লোকে ১০ দশ মোন তণ্ডুল করিতে পারে তাহার একজন কল নাড়ে ইহাতে পরস্পর শ্রান্তিযুক্ত হইলে ঐ কর্ম্মের পরিদর্শন করে এতদ্দেশে ঢেঁকি যন্ত্রে তিন জন বিনা অর্দ্ধমোনের অধিক তণ্ডুল হওয়া দুষ্কর আর তাহারা পরিশ্রান্ত হইতেই ঢেঁকি বন্ধ হয়।

৮ আগস্ট ১৮২৯। কলিকাতার গঙ্গাতীরস্থ কল।-যে কল কএক মাসাবধি কলিকাতার গঙ্গাতীরের রাস্তার উপর প্রস্তুত হইতেছিল তাহা সংপ্রতি সম্পূর্ণ হইয়াছে এবং কলিকাতাস্থ লোকদিগকে সূজি যোগাইয়া দিতে আরম্ভ করা গিয়াছে। এই কলের দ্বারা গোম পেষা যাইবে ও ধান ভানা যাইবে ও মর্দ্দনের দ্বারা তৈলাদি প্রস্তুত হইবে এবং এই সকল কার্য্যে ত্রিশ অশ্বের বল ধারি-বাষ্পের দুইটা যন্ত্রের দ্বারা সম্পন্ন হইবে। এতদ্দেশীয় অনেক লোক এই আশ্চর্য্য বিষয় দর্শনার্থে যাইতেছেন এবং আমরা আপনাদের সকল মিত্রকে এই পরামর্শ দি যে তাঁহারা এই অদ্ভুত যন্ত্র বাষ্পের দ্বারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুই হাজার মোন গোম পিষিতে পারে তৎস্থানে সমন করিয়া তাহা দর্শন করেন।

নতুন কল এসেছে কলকাতা শহরে, ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় সেই সংবাদ পরিবেশন করা হচ্ছে। একটি কাষ্ঠনির্মিত চালের কল, আর-একটি সুজি-ময়দা-তেলের কল। চালের কল দু’জন লোক প্রতিদিন দশ মণ চাল তৈরি করতে পারে, কিন্তু ঢেঁকিতে তিনজন লোকের পক্ষে আধমণ চাল করাই কঠিন হয়ে ওঠে। লোকে ভাবে, কলের কি আশ্চর্য মাহাত্ম্য! বাহাদুরি আছে ইংরেজের কলের। ‘একজন কল লাড়ে’, ‘আর-একজন চাল দেখে’, এবং তাতেই সারাদিনে কল থেকে দশ মণ চাল বেরিয়ে আসে। গঙ্গাতীরে আরও একটি কল এসেছে, তার ক্ষমতা আরও বিস্ময়কর। কলকাতার লোক সেই কলের তৈরি সুজি খেতে আরম্ভ করেছে। কেবল সুজি নয়, সেই কলে গম পেষা হয়, ধানভানা হয়, এবং সরিষা মর্দন করে তৈলও নিষ্কাশন করা হয়। হবারই কথা, কারণ তিরিশ অশ্ববলের (horse power) দু’টি বাষ্পীয় যন্ত্র কলটিকে চালায়। ‘এতদ্দেশীয় অনেক লোক এই আশ্চর্য্য বিষয় দর্শনার্থে যাইতেছেন।’ যাবারই কথা, কারণ কলের এমন অপূর্ব মাহাত্ম এদেশের লোক দেবদেবীদেরও প্রকাশ করতে দেখেননি। তাই দেবীদর্শনের মতন তারা দলে দলে গঙ্গাতীরে কলদর্শন করতে যাচ্ছিল।

১৮ আশ্বিন, ১২৬০ ‘সংবাদ প্রভাকর’ সংবাদ দিচ্ছেন যে বহুবাজারের বিখ্যাত ধনিক রাজেন্দ্র দত্তের হৌসে আমেরিকা থেকে ছয়টি ‘অত্যাশ্চর্য্য নূতন কল’ এসেছে। তাতে অল্প সময়ের মধ্যে ‘জামা, চাপকান, ইজার, পেল্টলন’ প্রভৃতি নানারকমের পোষাক ও ‘গনিচটের’ থলে পর্যন্ত সেলাই হয়ে থাকে। অতএব প্রভাকর বলেছেন, ‘ঐ কলের সংখ্যা বৃদ্ধি হইলে মনুষ্যের মত উপকার হইবেক তাহার সংখ্যা করা দুঃসাধ্য’-এবং ‘ঐ যন্ত্র দর্শনার্থ অনেকেই গমন করিতেছেন, আমারদিগের কোনো কোনো বন্ধু তাদ্বারা কাপড় সেলাই করিয়া লইয়া সেলাই দৃষ্টে চমৎকৃত হইয়াছেন।’

কিন্তু শুধু কি কৌতূহলী দর্শকের ভিড় হচ্ছিল কল দেখতে? কলে যারা কাজ করছিল তারা কারা? কাষ্ঠনির্মিত ধানভানা করে, তিরিশ অশ্ববলের ময়দার কলে ও তেলের কলে, আমেরিকার সেলাইকলে, এদেশের লোক যারা সেদিন কাজ করতে গিয়েছিল, তাহার মেহনত বেচে জীবিকা অর্জনের জন্য, তারাই হল আমাদের দেশের আধুনিক শ্রমশিল্পযুগের প্রথম ‘মজুর’। একটা পূর্ণাঙ্গ সামাজিক শ্রেণিরূপে তাদের বিকাশ তখনও কলকাতা শহরে ও তার আশপাশে হয়নি। তা না হলেও এদেশের দরিদ্র গ্রামবাসীদের নাগরিক মজুরশ্রেণিতে রূপায়ণ তখন থেকেই যে আরম্ভ হয়েছিল, তা পরিষ্কার বোঝা যায়। বৈদেশিক পরাধীনতার জন্য যন্ত্রশিল্পের বিকাশ আমাদের দেশে যথানিয়মে হয়নি বলে, গ্রামাঞ্চলের বংশবৃত্তি থেকে উৎখাত যাযাবররা এবং অন্যান্য নিঃস্ব ও দরিদ্রশ্রেণির লোকেরা নতুন শহরের নতুন মজুরশ্রেণিতে পরিণত হতে পারেনি। তাদের এই ঐতিহাসিক পরিণতির পথে বিদেশি শাসকরা অন্তরায় সৃষ্টি করেছেন অনেক। তার ফলে তারা শহর ও শহরতলিতে এসে ভিড় করেছে বটে, কিন্তু নতুন নতুন কলকারখানার মজুর হিসেবে নয়, তার চেয়েও অধম ও অসহায় কুলি হিসেবে। তাই দেখা যায়, নতুন শহর কলকাতায় নতুন যুগে যে নাগরিক প্রলেটারিয়েট গড়ে উঠেছিল, অন্তত উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত, তারা কারখানার মজুরশ্রেণি নয়, স্থান থেকে স্থানান্তরে সদাভাসমান দিনমজুর কুলিশ্রেণি।

পুরনো সরকারি দলিলপত্র ও অন্যান্য বিবরণ থেকে সেদিনের কুলিদের অবস্থার কথা বিশদভাবে জানা যায়। উনিশ শতকের তিরিশ-চল্লিশে অ্যাডভোকেট জনসন কলকাতায় কুলিদের সম্বন্ধে লিখেছেন :

Hundreds of them are waiting in the streets to be hired; and though, like all Hindoos, they make a most Bable-like noise over their work, and require four to carry that which one English porter would think nothing of, yet they are careful carriers, and generally trust-worthy, I had all my furniture removed to another house, three miles distant, by one hundred coolies, for whose services I paid twenty-five rupees.

জনসন সাহেব একশো কুলির মাথায় মাল চাপিয়ে বাড়ি বদল করেছিলেন। তিন মাইল দূর পর্যন্ত মাল বয়ে নিয়ে গিয়ে তারা চার আনা করে মজুরি পেয়েছিল। সুতরাং শত শত কুলি যদি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে, এবং লোক দেখলে বোঝা বইবার জন্য হল্লা করে, তা হলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

কলকাতা শহরে কলকারখানা গড়ে উঠতে দেরি হলেও ঘরবাড়ি ও পথঘাট নির্মাণের কাজ আঠার শতকের গোড়া থেকেই আরম্ভ হয়েছিল, এবং ক্রমেই দিন দিন তা বেড়েছিল ছাড়া কমেনি। নতুন শহর কলকাতার বাইরের এই বিরাট দৈহিক নির্মাণকার্যে সেদিন সবচেয়ে প্রয়োজন হয়েছিল হাজার হাজার মেহনতি কুলির। কলকাতার নতুন নতুন রাস্তা ও ঘরবাড়ি নিয়ে যে বিরাট প্রাসাদপুরী গড়ে উঠতে আরম্ভ করেছিল, তাতে ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যান্য মিস্ত্রীদের দান থাকলেও, দরিদ্র কুলিদের সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। প্রাসাদপুরী কলকাতার আসল কঙ্কাল কুলিদের মেহনতেই গড়ে উঠেছিল বলা চলে।

কোম্পানির নতুন ফোর্ট উইলিয়ম কেল্লা নির্মাণের হিসেবপত্র ও বিবরণ থেকে আঠার শতকের দ্বিতীয় দশকে কুলিদের অবস্থা কি ছিল তা জানা যায়। ১৭৯৭, ১৩ জুন তারিখের কৌন্সিলের প্রসিডিংসে কুলিদের নিয়োগ-পদ্ধতি ও মজুরি সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে, কেল্লার কুলিদের মজুরি দেওয়া নিয়ে প্রায়ই গণ্ডগোলের সৃষ্টি হয়। তার কারণ, কুলিদের মজুরি দেওয়া হয় কড়িতে এবং তাও তাদের হাতে সোজাসুজি দেওয়া হয় না, সর্দারদের মারফত দেওয়া হয়। সর্দাররা ও বেনিয়ারা কুলিদের মজুরি একাংশ নিজেদের কমিশন হিসাবে আত্মসাৎ করে। কুলিদের কাছে খোঁজ করে দেখা গেছে যে, তাদের প্রতিদিনের মজুরি থেকে ১৫।২০ কড়ি করে কেটে তাদের দেওয়া হয়। সর্দার বা বেনিয়াদের জিজ্ঞাসা করলে তারা বলে যে এটা তাদের দেশের রীতি ও ন্যায্য প্রাপ্য-

…The Bunnyas and head-men have the conveniency of stopping a small number out of each man’s share, which they call custom, and the coolies have complained to me that 15 or 20 cowries per day have been deducted in this manner; but these and a great many other had methods, might be broke, which at present is called custom, the Company would then be better served and the coolies satisfied, they would then continue in the works, learn any method that would be desired, and we should not have fresh coolies… every day. (Proceedings, June 13, 1757)

কোম্পানির কাজকর্মে কুলিদের এমনিতেই খুব বেশি মজুরি দেওয়া হত না, বাইরের মজুরির তুলনায় কিছু কম মজুরিতেই তাদের কোম্পানির কাজকর্ম করতে হত। কতকটা সরকারি কাজের মতন তার বিশেষ আকর্ষণ কুলিদের কাছেও ছিল। কিন্তু সেই কম মজুরি থেকেও যখন সর্দার ও বেনিয়ারা কিছুটা ভাগ বসাত, তখন কাজ ছেড়ে দিয়ে তাদের স্থানান্তরে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকত না। শুধু কেল্লা নির্মাণের কাজেই কুলিদের এরকম বারবার চলে যেতে হয়েছে, এবং কোম্পানির কাজে তাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে অনেক। অথচ কেল্লা নির্মাণের জরুরি প্রয়োজনীয়তাও ছিল তখন যথেষ্ট। তাই কোম্পানির কর্তারা শেষপর্যন্ত আদেশ জারী করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে কলকাতার কোনো নাগরিক তাঁর ব্যাক্তিগত কাজের জন্য কুলি বা মিস্ত্রী নিয়োগ করতে পারবেন না। কৌন্সিলের যে বৈঠকে তাঁরা এই সিদ্ধান্ত করেছিলেন তার বিবরণ এই :

The Committee of Works send in a letter to the Board informing us of the difficulty they find in getting labourers and artificers for the fortifications, and desiring the Board will take some method to get them people to carry on the works. Ordered, their letter be entered and that they advertise no artificers shall be employed by the private inhabitants after the first day of February… As to labourers, the Board imagine with proper encouragement a sufficient number may be procured after the harvest of paddy is over. (Proceedings, January 3, 1758)

দীর্ঘদিন ধরে কোম্পানির কর্তারা এই কুলি সমস্যার সমাধান করতে পারেন নি। ১০ মার্চ, ১৭৬০ তারিখের সভার বিবরণে তাই দেখা যায়, তাঁরা কালেক্টরকে আদেশ দিচ্ছেন, কেল্লার কাজের জন্য ৮০০০ কুলি জোর করে সংগ্রহ করতে। তাঁদের প্রস্তাবটি এই :

The works being much retarded to want of cooles, and the farmers not complying with their agreement-Ordered the Collector to send peons into the pergunnaha and to bring up by force 8,000 if to procured.

এই প্রস্তাব থেকে বোঝা যায়, কলকাতার কালেক্টররা মধ্যে মধ্যে পেয়াদা পাঠিয়ে গ্রামাঞ্চল থেকে লোকজনদের জোর করে ধরে নিয়ে আসতেন কুলির কাজ করার জন্য। সাধারণত অবশ্য কোম্পানির কাজের জন্যই তাদের উপর জুলুম করা হত। নগর নির্মাণের আদিপর্বে এইভাবে জোরজুলুম করেই গ্রামের দরিদ্র কৃষিজীবীদের, মনে হয়, কলকাতা শহরে কুলিশ্রেণিতে পরিণত করা হয়েছে। তখন বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল থেকেও যে অনেক নিঃস্ব কৃষককে কলকাতায় কুলির কাজের জন্য ইংরেজ জমিদাররা জোর করে আমদানি করেছিলেন, তা অনুমান করা অসঙ্গত নয়। কেবল বিহারের গ্রামাঞ্চল থেকেই কুলিরা নতুন শহর কলকাতায় আসেনি। পরে বাংলার কৃষকেরা বাংলার গ্রামে ফিরে গিয়ে হয়ত ক্ষেতমজুরি করাকে অনেক বেশি বাঞ্ছনীয় মনে করেছে নগরের নিষ্ঠুর কুলিমজুরির চেয়ে। বিহারিদের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি, তাই তাদের সংখ্যা বেড়েছে।

উনিশ শতকের গোড়া থেকে কলকাতা শহরে রাস্তাঘাটের ও ঘরবাড়ির উন্নয়নকর্ম দ্রুতগতিতে আরম্ভ হয়। প্রধানত ‘লটারি কমিটির’* উদযোগেই কলকাতা শহরের এই উন্নয়ন-পরিকল্পনা কাজে পরিণত করা হয়। লটারি কমিটির অপ্রকাশিত হাতে-লেখা বিররণীর মধ্যে কলকাতার কুলিদের সম্বন্ধে অনেক কথা বলা হয়েছে। বিশেষ করে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত কুলিদের মেহনতের মজুরি কি হারে দেওয়া হত সে-সম্বন্ধে অনেক তথ্য কমিটির রিপোর্ট থেকে পাওয়া যায়।

কলকাতার ক্রীতদাস ও কুলিমজুরদের কথা এইখানেই আমরা শেষ করছি। যারা জল টানে ও কাঠ কাটে, সভ্যতার ইতিহাসে তাদের কথা সামান্য কালো কালির অক্ষরেও লেখা থাকে না। কলকাতার অবশ্য কোনো ইতিহাস নেই, তবে ইতিহাসের নামে যে-সব ইতিকথা আছে তাতেও কোথাও এদের কথা বিশেষ লেখা নেই। স্তূপাকার সরকারি নথিপত্রের মধ্যে ইতঃস্তত যে-সব বিবরণ ছড়িয়ে আছে, তাই জোড়া দিয়ে একটি চিত্র রচনা করা হয়েছে এখানে। চিত্রটি স্বভাবতঃই নিখুঁত ও অখণ্ড হয়নি। না হলেও ক্ষতি নেই এইজন্য যে, যাদের কথা এখানে বলা হয়েছে তাদের জীবনেও কোথাও অখণ্ডতা নেই। অথচ এই ক্রীতদাস ও কুলিমজুররাই কলকাতা শহরে আমাদের প্রথম নাগরিক জীবনের বনিয়াদ গড়ে তুলেছিল-বন কেটে, জল টেনে আমাদের খোরাক যুগিয়ে, খোয়া ও পাথর ভেঙে।

* এই গ্রন্থের ‘কলকাতার ক্রমবিকাশ’ অংশে এই জরিপের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *