একদিন আমি উত্তেজিত হয়েই স্যারের কাছে গেলাম। সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো। স্যার বাড়িতেই ছিলেন। সারা শরীর চাদরে ঢেকে পত্রিকায় চোখ বুলোচ্ছিলেন। আমি বসবার আগেই বলে ফেললাম, কাল টিচার্স ক্লাবে শুনেছি, আপনি ইসলামিক একাডেমীতে নাকি একসময়ে কেনো আমি পাকিস্তান চেয়েছিলাম এ বিষয়ের ওপর একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
রাজ্জাক স্যারের চোখেমুখে কৌতুকবোধ ঝিলিক দিয়ে উঠলো : বক্তৃতা একটা দিছিলাম, ত আপনে চটছেন ক্যান্?
আপনি পাকিস্তানের পক্ষে ওকালতি করবেন চটবো না তো কী?
আমি ত পাকিস্তান চাইছিলাম, হেই কথাডা বলতে দোষ কী? তিনি আমার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকালেন। তিনি যখন আহত বোধ করেন, তার চোখ থেকে এ ধরনের দৃষ্টি বিচ্ছুরিত হয়। আমি একটুখানি ভয় পেয়ে গেলাম। আমার খেয়ালই ছিলো না আমার জন্মের বহু পূর্বে ঘটে—যাওয়া একটি ঐতিহাসিক ঘটনার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করার জন্য আমি স্যারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেছি। স্যার বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। আমিও সাহস করে কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। এই নীরবতা আমার কাছে একটা দুৰ্বহ বোঝা হয়ে উঠেছে। ইচ্ছা হচ্ছিলো পালিয়ে চলে আসি। কিন্তু সেটাও সম্ভব হচ্ছে না।
এরই মধ্যে কাজের ছেলেটি তামাক দিয়ে গেলো। হুঁকোতে দুতিন টান দেয়ার পর স্যার মুখ খুললেন। মনে হল বেঁচে গেছি। স্যার বললেন, ওই বক্তৃতায় আমি কী কইছিলাম হেইডা আপনে দেখছেন কি না?
আমি বললাম, না।
স্যার বলতে শুরু করলেন, আমি কইছিলাম আপনেরা বাংলায় যত উপন্যাস লেখা আইচে সব এক জায়গায় আনেন। হিন্দু লেখক মুসলমান লেখক ফারাক কইরেন না। তারপর সব উপন্যাসে যত চরিত্র স্থান পাইছে রাম শ্যাম, যদু মধু, করিম রহিম নামগুলা খুঁইজ্যা বাইর করেন। তখন নিজের চৌকেই দেখতে পাইবেন, উপন্যাসে যেসব মুসলমান নাম স্থান পাইছে তার সংখ্যা পাঁচ পার্সেন্টের বেশি অইব না। অথচ বেঙ্গলে মুসলিম জনসংখ্যার পরিমাণ অর্ধেকের বেশি। এই কারণেই আমি পাকিস্তান দাবির প্রতি সমর্থন জানাইছিলাম।
আমার তর্ক করার ইচ্ছাটি তখনও দামে যায়নি। তাই জিগ্গেস করলাম, উপন্যাসে মুসলমান চরিত্রের উপস্থিতির স্বল্পতার কারণে আপনি কিন্তু একটি ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সমর্থন দিতে পারেন না।
আপনে এখন ধৰ্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথা কইতাছেন তখন সিচুয়েশন আছিল এক্কেরে অন্যরকম। আরেকটা জিনিস মনে রাখবেন, উপন্যাস আইল গিয়া আধুনিক সোশিয়াল ডিসকোর্স। বেঙ্গলে হিন্দু মুসলমান শত শত বছর ধইর্যা পাশাপাশি বাস কইর্যা অইতাছে। হিন্দু লেখকেরা উপন্যাস লেখার সময় ডেলিবারেটলি মুসলমান সমাজরে ইগনোর কইরা গেছে। দুয়েকজন ব্যতিক্রম থাকলেও থাকবার পারে। বড় বড় সব হিন্দু লেখকের কথা চিন্তা কইর্যা দেখেন। তারা বাংলার বায়ু, বাংলার জল এই সব কথা ভালা কইর্যাই কইয়া গেছে। কিন্তু মুসলমান সমাজের রাইটফুল রিপ্রেজেনটেশনের কথা যখন উঠছে সকলে এক্কেরে চুপ। মুসলমানসমাজরে সংস্কৃতির অধিকার থেইক্যা বঞ্চিত করার এই যে একটা স্টাবর্ন অ্যাটিটিউড হেই সময়ে তার রেমেডির অন্য কোনো পন্থা আছিল না।
একসঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলার পর স্যার একটু দম নিলেন। কাজের ছেলেটি চা দিয়ে গেলো। চায়ে চুমুক দেয়ার পর স্যার আবার মুখ খুললেন : আরেক হিসাব অবসর সময়ে কইর্যা দেইখেন। নাইনটিন ফরটি সেভেন থেইক্যা সেভেনটি পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আমাগো এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেইক্যা লেখালেখির ক্ষেত্রে যতগুলান মানুষ বাইর অইয়া আইছে, নাইনটিন টুয়েনটি ওয়ান থেইক্যা শুরু কইর্যা ফরটি সেভেন, এই কোয়ার্টার সেঞ্চুরি হিসাব কইর্যা দেখেন মুসলমান সমাজের মধ্যে থেইক্যা সেইরকম একজনও মুসলমান লেখক বাইর অইছেন কি না। ফরটি সেভেনের পরে যেসব মুসলমান লেখক বাইর অইছে আউটলুকের দিক দিয়ে সকলে আউট অ্যান্ড আউট সেক্যুলার। পাশাপাশি পশ্চিমবাংলার আধুনিক লেখকদের মধ্যে দেখবেন, সেকুলার লেখক অধিক পাইবেন না। হ তবে কথা উঠতে পারে আর্টিস্টিক একস্প্রেশন সম্পর্কে।
আমি বললাম, হিন্দুসমাজে সেকুলার চিন্তা-ভাবনা তো অনেকদিন আগেই শুরু হয়েছে।
স্যার বললেন, কথাটা ঠিক আবার ঠিকও না। যেই জিনিসটারে আপনেরা বেঙ্গল রেনেসাঁ কাইবার লাগছেন, হেইডা মানতে আমার ঘোরতর আপত্তি আছে। আপনেরা রামমোহনরে রেনেসাঁর মানুষ কইবেন। কিন্তু হে কামড়া কী করছে। তার মতো এমন ধর্মপ্রচার আগেও ইন্ডিয়ায় অনেক মানুষ কইর্যা গেছেন। আমি তা তার বাংলা ভাষা চর্চা ছাড়া উল্লেখ করবার মতো আর কোনো কিছু খুঁইজা পাই না। এন্টায়ার নাইন্টিনথ সেঞ্চুরিতে পুরুষ সিংহ ওই একজনই পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগর মশায় ছাড়া দেবেন ঠাকুর বলেন, বঙ্কিম বলেন, কেশব বলেন, সকলে তো নতুন কইর্যা রিভাইভিলিজমের বিকাশ ঘটাইছেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায় একটা মূল্যবান বই লিখছিলেন। নামটা জানি কী। তিনি দেখাইছেন, যে সময়ে বঙ্কিমের উপন্যাসগুলা প্ৰকাশ পাইবার লাগছিল, একই সময়ে বটতলার মুসলমানি পুঁথিগুলাও মুদ্রণযন্ত্রে ছাপা অইয়া বাইর অইতে আছিল। বঙ্কিমের উপন্যাস দুইশ আড়াইশর বেশি ছাপা অইত না। কারণ আধুনিক সাহিত্য পড়ার পাঠক আছিল খুব সীমিত। কিন্তু বইটা পড়লে দেখতে পাইবেন মুসলমানি পুঁথি ছাপা অইতাছিল হাজারে হাজারে। বঙ্কিমের বিষয়বস্তুর সঙ্গে পুঁথির বিষয়বস্তুর তুলনা করলে ডিফারেন্সটা সহজে বুঝতে পারবেন। পুঁথির বিষয়বস্তু এক্কেরে সেকুলার, কিন্তু চিন্তাপদ্ধতি মধ্যযুগীয়। বঙ্কিমের চিন্তা আধুনিক কিন্তু বিষয়বস্তু ধর্মীয়।
আমি প্রতিবাদ করে বললাম, বঙ্কিমের সব রচনার বিষয়বস্তু তো ধর্মীয় নয়।
স্যার বললেন, ওই অইল একই কথা, রিভাইভিলিস্ট স্পিরিট অ্যান্ড মডার্ন স্পিরিট এ ওর গায়ে ঠেস দিয়া খাড়াইয়া আছে।
স্যারের কথাটা পুরোপুরি মেনে নিতে আমার কষ্ট হচ্ছিলো। তাই বললাম, মাইকেল, বঙ্কিম ওনাদের হাতেই তো বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার সূত্রপাত।
স্যার বললেন, আধুনিকতা জিনিসটিরেও তা ভালা কইর্যা বুঝন লাগব। আধুনিকতা জিনিসটি বেবাক দুনিয়ায় একই সময়ে আইছে। দশ বছর আগে কিংবা দশ বছর পরে। বিলাতে রেলগাড়ি চালু অওনের দশ বছর পরে ইন্ডিয়াতে রেল আইয়া গেছে। বঙ্কিম মারা গেছেন আঠার শো তিরানব্বই সালে। আর টলস্টয় মারা গেলেন উনিশশো এগারো সালে। বঙ্কিমের তুলনায় টলস্টয় দীর্ঘ জীবন পাইছিলেন। সেই দিক দিয়া দেখতে গেলে টলস্টয় বঙ্কিমের কন্টেম্পরারি। দুইজনের লেখার কন্টেন্ট মিলাইয়া দেখেন। টলস্টয় কমন ম্যানকে কী চৌকে দেখছেন, আর বঙ্কিম কী চৌকে দেখছেন। শুধু টলস্টয় আর বঙ্কিম কেন ইউরোপের লিটারারি স্টলওয়ার্ট ফ্লবেয়ার, মোপাসাঁ, চেখভ, টুর্গেনিয়েভ, গোগল, জোলা সকলে একটা বিশেষ সময়ের মানুষ। এদের লগে আপনে রবীন্দ্রনাথরেও ধরবার পারেন।
আমি বললাম, স্যার, রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে কিছু বলেন।
স্যার বললেন, রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা ঠিকই আছিল। বাংলা ভাষাটি ত রবীন্দ্রনাথের হাতেই পুষ্ট অইছে। এক হাতে বিচিত্র বিষয় নিয়া লিখছেন, এইটাই রবীন্দ্রনাথের সবচাইতে বড় ক্রেডিট। আদার দ্যান লিটারারি ট্যালেন্ট অন্যান্য বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের যদি বিদ্যাসাগরের মতো মানুষদের সঙ্গে তুলনা করেন, হি কামস নো হোয়ার নিয়াবার টু দেম।
স্যারের কথাটা শুনে আমার ভালো লাগল না। আমি রবীন্দ্রনাথকে খুব বড় একজন মানুষ হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। তাই জিগ্গেস করলাম, রবীন্দ্রনাথ কি খুব বড় একজন মানুষ নন?
স্যার বললেন, রবীন্দ্রনাথ বড় লেখক, মানুষ হিসাবে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর কিংবা তার মতো মানুষদের ধারে কাছেও আসতে পারেন না। বড় লেখক এবং বড় মানুষ এক নয়। বড় লেখকদের মধ্যে বড় মানুষের ছায়া থাকে। বড় মানুষরা আসলেই বড় মানুষ। লেখক কবিরা যা বলে সেরকম আচরণ না করলেও চলে। হের লাইগ্যা প্লেটো তার রিপাবলিক থ্যাইক্যা কবিগো নির্বাসনে পাঠাইবার কথা বলছিল।
আমি বললাম, একথা কি রবীন্দ্রনাথের বেলায়ও প্রযোজ্য।
স্যার বললেন, রবীন্দ্রনাথ ব্যতিক্রম অইল কেমনে। তিনিও ত এই ক্যাটাগরির মধ্যে পড়েন।
আমার মনের মধ্যে একটুখানি খুঁতখুঁতানি থেকে গেল। সেজন্য পালটা প্রশ্ন করলাম, রবীন্দ্রনাথ কি বাঙালি জনগোষ্ঠীর ভাষাকে উৎকর্ষের একটা বিশেষ স্তরে নিয়ে যাননি?
স্যার বললেন, বাংলা ভাষাটা বাঁচাইয়া রাখছে চাষাভুষা, মুটেমজুর—এরা কথা কয় দেইখ্যাই ত কবি কবিতা লিখতে পারে। সংস্কৃত কিংবা ল্যাটিন ভাষায় কেউ কথা কয় না, হের লাইগ্যা অখন সংস্কৃত কিংবা ল্যাটিন ভাষায় সাহিত্য লেখা অয় না।
স্যার তারপর রবীন্দ্রনাথের সামাজিক প্রবন্ধ নিয়ে তাঁর মতামত প্রকাশ করতে আরম্ভ করলেন। তিনি বলতে থাকলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সামাজিক প্ৰবন্ধসমূহে যে সকল এমপিরিক্যাল কথাবার্তা কইছেন, সেগুলা খুব কাজের জিনিস অইছে। এ নিয়া বেশি মানুষরে কথাবার্তা কইতে দেখা যায় না। আমার ইচ্ছা আছিল যে সকল সামাজিক প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধে স্থান পাইছে, সেগুলোর একটা তালিকা করা।
কিছুদিন পরেই দেখতে পেলাম রাজ্জাক স্যার রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধসমূহ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছেন, বিশেষ বিশেষ জায়গায় লাল পেন্সিল দিয়ে চিহ্নিত করছেন। ছোটো ছোটো কাগজের টুকরো দিয়ে চিহ্নিত পৃষ্ঠাসমূহে নিশানা দিয়ে রাখছেন। আরও কিছুদিন পরে গিয়ে দেখলাম রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধের বই স্যারের টেবিল থেকে উধাও। বুঝতে বাকি রইলো না স্যারের মহৎ সঙ্কল্পগুলোর এভাবেই ইতি ঘটে থাকে। প্রথম দিকে রাজ্জাক স্যারের রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতি বিশেষ অনুরাগ ছিল না। শেষের দিকে দেখলাম তিনি রবীন্দ্রনাথের কোনো কোনো গানের তারিফ করেছেন। বিশেষ করে ধ্রুপদাঙ্গের গানগুলো।